মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৩



সামনে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হল আদীর। সকালে ইয়াসের মুখে ইকবালের কথা শোনার পর বিকেলেই ওকে নিয়ে আসার কথা বলেছিল আদী। ঘন্টা খানেক আগে ইয়াস ও ইমরান এসে ইকবালকে দিয়ে গিয়েছে। বেশ অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারেনি ইকবাল। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে ছিল। বিধ্বস্ত চেহারা দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে দিন যাপন করছে ছেলেটি। মানসিক অসহায়ত্ব চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। কোন প্রশ্নের জবাবই গুছিয়ে দিতে পারছিল না। এর আরেকটি কারণ হয়তো এটা যে, আদী ইকবালের পূর্ব পরিচিত। মানুষ নিজের সমস্যা বা ভুলের কথা পরিচিত কারো চাইতে, একজন অপরিচিতকে অনেক সহজে বলতে পারে। কেননা ব্যক্তির সম্পর্কে ধারণা থাকার কারণে পরিচিত মানুষেরা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রতিটা কথাকে যাচাই করে দেখতে ও সেই মতো পরামর্শ দিতে চেষ্টা করে। যা একজন সমস্যাগ্রস্ত মানুষের কাম্য থাকে না। সমস্যাক্রান্ত মানুষেরা কথা বলার জন্য এমন কাউকে খোঁজে যে বাঁধাহীন ভাবে তার কথা শুনবে এবং নিরপেক্ষ সমাধান দেবে।

ইকবালের এলোমেলো কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো আদী। কিভাবে বন্ধুদের সাহচর্যে ধীরে ধীরে নেশার জগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। তার নেশার করার কথা জানতে পেরে মা স্ট্রোক করলে নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিভাবে নিজেকে বের করে এনেছে অন্ধকার থেকে। পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য বিভিন্ন আচরণ ও কথার দ্বারা কিভাবে প্রতিনিয়ত তাকে ভুলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় সবকিছু খুলে বললো ইকবাল। পরিবারের কাছের মানুষদের এমন নেতিবাচক আচরণ ভেতরে ভেতরে একদম নিঃশেষ করে দিচ্ছে ইকবালকে। দুএক সময় মনেহয় কি হবে ভালো হয়ে? কেউ তো চায় না সে ভালো হোক। শুধুমাত্র মায়ের কথা ভেবে এখনো নিজের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। চাচাতো বোন তানিয়ার সাথে তিন বছর আগে বিয়ের কথাবার্তা ঠিক করাছিল তাই মেলামেশাতে তেমন কোন বাঁধা ছিল না দুজনের। সেই সম্পর্কটার ভবিষ্যৎও এখন অনিশ্চিত। সবকিছু মিলিয়ে বুঝতে পারছে না তার করণীয় কি!

কিছুটা সময় নীরবতার পর আদী বলল, মানুষের চরিত্রের স্বাভাবিক কিছু প্রবণতা আছে। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটা হচ্ছে, মানুষ প্রয়োজনের চাইতে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রতি বেশি আগ্রহী, কারো গুণের চাইতে তার দোষের ব্যাপারে বেশি সতর্ক, ভালো কাজের স্বীকৃতি না দিলেও মন্দ কাজের হিসাব রাখতে কখনোই ভুল করে না ইত্যাদি। এর কারণ হিসেবে আমার কি মনেহয় জানো?

কি মনেহয় ভাইয়া?

মনেহয় মানুষের ভালো কাজ হচ্ছে দুধের মত আর মন্দ কাজ হচ্ছে লেবুর রস। আর দুধে যখন লেবুর রস পড়ে দুধ ফেটে গিয়ে জমাট বেঁধে যায়। পানি আর পনির আলাদা হয়ে যায়। ভালো কাজগুলো পরিণত হয় ঘোলা পানিতে আর মন্দ কাজগুলো পনিরের মত খণ্ড খণ্ড রূপে ভেসে বেড়ায় সেই পানিতে। যারফলে মন্দ কাজগুলো স্পষ্ট রূপে চোখে ধরা পড়াটাই স্বাভাবিক।

ইকবাল ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বি ভাইয়া।

এখন ভেবে দেখো লেবুর রসের প্রভাবে দুধ থেকে যে পনির তৈরি হয়, তার নিজস্ব ব্যবহার তো আছেই সেই সাথে তাকে কাজে লাগানো হয় অনেক ধরণের মিষ্টি তৈরিতে। রসোগোল্লা, চমচম, কালোজাম, সন্দেস আরো অনেক কিছু। ঠিক একই ভাবে জীবনে কখনো কখনো আমাদের দ্বারা ভুল হয়ে যায়। যখন ভুলের উপলব্ধি হয় তখন আমাদের উচিত থমকে দাঁড়ানো এবং চিন্তা করে দেখা যে, এরফলে আমরা কি পেলাম আর কি হারালাম। হারটাকে ভুলের প্রায়শ্চিত মনে করে, পাওয়াটাকে সাথে নিয়ে আমাদের উচিত সামনে এগিয়ে চলা। আবার জীবনের স্বাভাবিকতাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা।

আমি চেষ্টা করছি ভাইয়া। কিন্তু কেউ আমাকে সাহায্য করছে না।

ধরো কেউ এস এস সি পরীক্ষায় ফেল করেছে। এরফলে পরিবারের সবাই তার উপর রাগ। এই রাগের পেছনে কিন্তু পরিবারের সদস্যদের কষ্ট লুকায়িত থাকে, তাদের স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা থাকে। তারা পড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে গিয়ে অনেক সময় এভাবে বলেন যে, ঠিকমতো পড়ো নয়তো আবারো ফেল করবে। কিংবা একবার তো ফেল করে মান সম্মান ডুবিয়েছো, এবার অন্তত ভালো ভাবে পড়ো। যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে কিন্তু এমন কথা শুনে কেউ পড়াশোনা ছেড়ে দেবে না বরং আরো বেশি করে পড়বে এবং পরীক্ষায় পাশ করে দেখাবে। তোমার ব্যাপারটাও কিন্তু অনেকটা একই রকম। তুমিও আদর্শ সন্তান হবার পরীক্ষায়, নৈতিকতার পরীক্ষায় ফেল করেছো। কষ্ট দিয়েছো প্রিয় মানুষদেরকে। ভেঙ্গে দিয়েছো তোমাকে ঘিরে দেখা তাদের মনের স্বপ্নকে। তাই কিছু আঘাত তো এখন তোমার উপর আসবেই। দেখো আপনজনদের রাগ বেশির ভাগ সময়ই তাদের ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ থাকে। আমরা সেটা বুঝতে পারি না কারণ আমরা অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো থাকি। আর একজন অপরাধী কখনোই ইতিবাচক চিন্তা করতে পারে না। তাই কল্যাণকামীতাকে সে অবজ্ঞা ও অবহেলার নাম দিয়ে দেয়। আমার কথা বুঝতে পেরেছো?

জ্বী ভাইয়া।

তোমার করণীয় কি সেটা কি বুঝতে পেরেছো?

জ্বী না ভাইয়া।

কেউ যখন স্কুল বা কলেজের পরীক্ষায় ফেল করে তখন যেমন কেউ সাহায্য করুক বা না করুক পরীক্ষায় পাশের জন্য তাকে পরিশ্রম করতেই হয়। জীবনের কোন পরীক্ষায় ফেল করলেও কেউ পাশে থাক বা না থাক ব্যক্তিকেই পরিশ্রম করে যেতে হবে তা থেকে উত্তোরণের। হ্যা এটা ঠিক যে আপনজনদের কাছ থেকে যখন আঘাত আসে সেটা সহ্য করা অনেক বেশি কঠিন। কারণ এই আঘাত মানুষের মনোবলকে নড়বড়ে করে দেয়। কিন্তু সেই আঘাতটাকে যদি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরে নেয়া যায়, তাহলে সেই আঘাতই হতে পারে সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম তোমার জানা আছে দেখা হলেই আমি তোমার দিকে ইট ছুঁড়ে দেবো। সুতরাং, প্রস্তুতি নিয়েই তুমি আমার আশেপাশে আসবে এবং কৌশলে ছুঁড়ে দেয়া ইট থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সেই ইটকে ব্যবহার করেই আমাদের মাঝে সেতু প্রতিষ্ঠা করবে।

এই প্রথম হাসি ফুটে উঠলো ইকবালের চেহারাতে। হাসতে হাসতে বলল, ভাইয়া এত চমৎকার করে কথা কিভাবে বলেন আপনি?

আদী হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এটা আমার টপসিক্রেট তাই বলা যাবে না। এক কাজ করি চলো বাগানে গিয়ে বসি আমরা। প্রকৃতির সান্নিধ্যে মন খুলে কথা বলাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। কি পছন্দ তোমার চা না কফি?

যে কোন একটা হলেই হবে ভাইয়া।

ঠিকআছে তুমি বাগানে যাও আমি কফি নিয়ে আসছি আমাদের দুজনের জন্য।

কফি নিয়ে এসে বসার পর নীরবেই নিজের কফি শেষ করলো আদী। ইকবালের দিকে তাকিয়ে দেখলো কফির মগের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে। দেখেই বোঝা যায় মানসিক ভাবে খুবই দোদুল্যমান। মনের ভেতর চাপা পড়ে আছে অনেক না বলা কথা, গোপন ব্যথা। আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদী বলল, বুঝতে পারছি মানসিক ভাবে তুমি খুবই অস্থিরতায় সময় কাটাচ্ছো। মন খুলে কারো সাথে তেমন ভাবে কথা বলতে পারছো না। কাছের মানুষগুলো হঠাৎ করে বহু দূরে সরে গিয়েছে যেন। না বলতেও যারা মনের কথাগুলো বুঝে নিতো। আজ তাদের সামনে মনটাকে খুলে দিলেও অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে নিজেই নিজের ভেতরে দগ্ধ হচ্ছো। এমন পরিস্থিতিতে পারিবারিক সাপোর্ট সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে। সেটাও তুমি একদমই পাচ্ছো না।

পরিবারের কেউ সাপোর্ট দেয়া তো দূরে থাক ভাইয়া। উল্টো চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিচ্ছে প্রতিমূহুর্তে। মানুষ কি ভুল করে না ভাইয়া? মানুষ ভুল করবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে কেন কাছের মানুষেরাই একটা ভুলের কারণে সারাজীবনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে বসে থাকে। কেন ভুলটাতে শুধতে নিতে সহায়তা করে না? ঠিকআছে সহায়তা নাহয় নাই করুক। অন্তত সারাক্ষণ অতীত ভুলের কথা মনে করিয়ে দেয়া থেকে তো বিরত থাকতে পারে। ভালো হতে উৎসাহ না দিক, ভালো হবার পথটাকে আরো কঠিন তো না করলেও পারেন তারা।

এই জ্ঞানটুকু তাদের থাকে না বলেই এমনটা করেন। যদি তারা বুঝতেন তাদের এইসব আচরণ, কথা একজন অপরাধীকে এতটা দুর্বল ও অসহায় করে দেয় যে, তারা নিজেকে সংশোধনের ইচ্ছাটাকেই ছেড়ে দেয়। তাহলে নিশ্চয়ই এমনটা করতেন না। এজন্যই আসলে ভুল করার আত্মোপোলব্ধি হবার পর, নিজেকে সংশোধনের ইচ্ছে নিয়ে এমন কারো কাছে যাওয়া উচিত যে কখনোই ফিরিয়ে দেবেন না, ভুল বুঝবেন না। অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার পথকে রুদ্ধ করবেন না। বরং রহমতের চাদরে জড়িয়ে নেবেন। জানো তিনি কে?

কে ভাইয়া?

যিনি বলেছেন, " হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজের আত্মার বিরুদ্ধে পাপ করেছো , তারা আল্লাহর করুণা থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সকল পাপ ক্ষমা করে থাকেন। নিশ্চয়ই তিনি বারে বারে ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।" ইকবাল আমি সবসময় সবার আগে যে পরামর্শটা দেই সেটা হচ্ছে, নিজেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। যখন তুমি সবকিছুর জন্য আল্লাহর উপর নির্ভর করতে পারবে, ভরসা করতে পারবে, বিশ্বাস করবে যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ মনের জোর ফিরে পেতে শুরু করবে। সবকিছু মিলিয়ে অনেক অপরাধবোধে ভোগো তুমি তাই না?

যখন মাকে অসুস্থ দেখি। আব্বু আমাকে এড়িয়ে চলছে বুঝতে পারি। খুব বেশি অপরাধী মনেহয় নিজেকে।

কোরআন ও হাদীসের সংস্পর্শে গেলে এই অপরাধবোধ থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবে ইনশাআল্লাহ। আসলে অজান্তে, অজ্ঞানে, আবেগের বশে কিংবা শয়তানের ওয়াসওয়াসার কারণে মানুষের ভুল করে ফেলতেই পারে। কিন্তু সেই উপলব্ধি হওয়া মাত্র ভুলের উপর বসে না থেকে, সেখান থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করতে হয়। এবং এই চেষ্টা মূলত ব্যক্তিকেই করতে হয়। কারণ ব্যক্তি নিজে চেষ্টা না করলে কেউ এগিয়ে এসে তাকে ভুলের উপর থেকে সরিয়ে নেয় না। তাই যা হবার হয়ে গিয়েছে। এখন থেকে আমি নতুন করে সবকিছু শুরু করবো। এমন একটা পজেটিভ দৃষ্টিভঙ্গী তোমাকে রাখতে হবে। দুর্বল হলে চলবে না কিছুতেই। শক্ত হতে হবে। মানুষের নেগেটিভ কথাতেও ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। ভাববে যে, আজ উনারা এমন করছেন সেজন্য তো আসলে আমিই দায়ী। তাই যদি নিজেকে শুধরে নিতে পারি উনারাও এমন আচরণ করা ছেড়ে দেবেন ইনশাআল্লাহ।

জ্বি ভাইয়া আমি চেষ্টা করবো এখন থেকে এভাবে ভাবতে। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন তো? থাকবেন তো সবসমইয় আমার পাশে?

আদী হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব আমি তোমাকে সাহায্য করবো। তোমার পাশে থাকবো। কিন্তু সারাক্ষণ যেমন সেটা সম্ভব হবে না, তেমনি যখনই তুমি চাইবে তখনই হয়তো বা আমার পক্ষে সবসময় সম্ভব হবে না তোমার পাশে দাঁড়ানোর। সেজন্য তোমার এমন কোন সত্ত্বাকেই নিজের আশ্রয় বানাতে হবে, যাকে তুমি যখনই চাইবে কাছে পাবে। হৃদয়ের টানে যখন তুমি কোরআনের পানে ছুটে যেতে পারবে। তখন থেকে দেখবে সব সমস্যাগুলোর সম্ভাব্য সমাধান তুমি নিজেই খুঁজে নিতে পারছো।

ইনশাআল্লাহ ভাইয়া আমি আজ থেকেই কুরআন ও হাদীস অধ্যয়ন শুরু করবো।

ইনশাআল্লাহ। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তোমার বিয়ের ব্যাপারটা। অনেকটা সময় একসাথে কাটানোর পর তানিয়ার এভাবে এড়িয়ে চলাটা খুবই কষ্টকর তোমার জন্য সেটা বুঝতে পারছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তানিয়া কি নিজ থেকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছে নাকি ওর বাবা-মা ওকে বাধ্য করেছে। যদি বাবা-মা বাধ্য করে থাকে তাহলে নিজের ভুল শুধরে নিয়ে। সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যখন তুমি উনাদের সামনে দাঁড়াবে। তখন উনারাও নিশ্চয়ই তোমাকে আপন করে নেবেন। আসলে কোন বাবা-মায়েরাই চান না তাদের মেয়েকে অনিশ্চিয়তায় মাঝে ঠেলে দিতে। কল্যাণকামনা থেকেই তারা কঠোর হতে বাধ্য হন। আপাত দৃষ্টিকে বাবা-মার এমন আচরণকে স্বার্থপরতা বা নিষ্ঠুরতা মনে হলেও, এটা আসলে সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রকাশ। আর যদি তানিয়া নিজ ইচ্ছেয় নিজেকে তোমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে থাকে। তাহলে পরামর্শ অন্যরকম।

কি রকম ভাইয়া?

সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে পরামর্শ দেবো এমন সম্পর্ক ভেঙে যাবার মাঝেই কল্যাণ। প্রতিটা সম্পর্কের কিছু বেসিক দাবী বা চাহিদা থাকে। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বিপদ, কষ্ট বা সমস্যার সময় একে অন্যের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। এই বিষয়ে কিন্তু অনেক প্রবাদও আছে। যেমন, বিপদে বন্ধুর পরিচয়। ব্যাপারটা কিন্তু আসলেই তাই। যখন তোমার চারপাশের সবকিছু ঠিক তখন কেউ তোমাকে ভালোবাসা, আর যখন খুব কঠিন একটা দূর্যোগ তোমার উপর আপতিত। তখন তোমাকে ভালোবাসার মাঝে অনেক পার্থক্য। এই পার্থক্য নির্ধারণ করে কারো কাছে তোমার গুরুত্ব, এবং তোমার জীবনে কারো প্রয়োজনীয়তার।

তারমানে কেউ নিজ ইচ্ছেয় চলে যেতে চাইলে তাকে বাঁধা দেয়া ঠিক নয়? আটকানোর চেষ্টা না করে তাকে চলে যেতে দেয়াই উচিত?

কেউ যদি তোমার দেয়া কোন আঘাতের কারণে অভিমান করে দূরে সরে যেতে চায়। সেক্ষেত্রে তার অভিমান ভাঙিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা অবশ্যই উচিত। কিন্তু কেউ যদি ভুল পথে চলার কারণে তুমি গর্তে পড়ে গেলে, তোমাকে উঠানোর চেষ্টা না করে জেনে বুঝে সজ্ঞানে তোমার থেকে দূরে চলে যায়। এমন কাউকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। কেননা যাকে ছাড়া তুমি গর্ত থেকে উঠতে পেরেছো, ভুল পথ থেকে ফিরে আসতে পেরেছো। তাকে ছাড়া জীবন পথে চলতে মোটেই কষ্ট হবে না।

সেই মানুষটার প্রতি যদি অনেক ভালোবাসা থাকে তবুও না?

এমন কারো প্রতি যদি ভালোবাসা থেকেও যায় মনের কোনে। বিশ্বাস আর ভরসা বোধকরি থাকে না! আর থাকলেও তাতে চিড় বা ফাটল ধরে যায়। যতবারই কোন কারণে তাকে বিশ্বাস করতে হয়, বা তার উপর ভরসা করার দরকার পড়ে। ঐ চিড় বা ফাটলে চোখ আটকে গিয়ে মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে। আসলে যাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না, তার প্রতি ভরসা করতে মন হয় দোদুল্যমান। আর একে অন্যেকের প্রতি বিশ্বাস, ভরসা ও নির্ভরতার সংমিশ্রণেই সম্পর্কের মাঝে শ্রদ্ধা ও সম্মানের তৈরি হয়। যা ভালোবাসাকে মজবুত করে। ভালোবাসা টিকে থাকে এসবের উপর ভিত্তি করে। ভিত্তিহীন দুর্বল ভালোবাসা জীবনের জন্য অনেক বড় বিড়ম্বনা।

ইকবাল হেসে বলল, জ্বি ভাইয়া আমি বুঝতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ আমি হয়তো এদিক থেকে ভাগ্যবান। তানিয়া বিভিন্ন ভাবে আমাকে চেষ্টা করেছে সাহায্য করার। মূলত চাচা-চাচীই চাইছেন না আমাদের বিয়েটা হোক। এতদিন আমি মনে মনে অনেক কষ্ট পেয়েছি, অভিমান করেছিলাম উনাদের উপর। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি চাচা-চাচী যা করেছেন পিতা-মাতা হিসেবে উনাদের সন্তানের কল্যাণের চিন্তা থেকেই করেছেন। এমনটা করতে আমিই উনাদেরকে বাধ্য করেছি। ইনশাআল্লাহ নিজেকে শুধরে নিয়ে আমি আবার সবার মনে আমার প্রতি আগের সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবো। তখন আর কেউ আমাকে এড়িয়ে চলবে না।

আদী হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ। তোমার দৃঢ়তা দেখে সত্যিই অনেক ভালো লাগছে। তোমার ভেতরে যে ইচ্ছার ঝলক দেখতে পাচ্ছি এই মূহুর্তে। এটাকে কর্মে পরিণত করার চেষ্টা করো এখন।

জ্বি ভাইয়া আমি তাই করবো। আনি নিজের বিছানো আঁধার থেকে বেড়িয়ে আসবোই ইনশাআল্লাহ। অন্যকাউকে আর দায়ী করবো না। উনারা সবাই যা করছেন, আমিই বাধ্য করেছি এমন করতে। অন্যায় করেছি শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু আজ থেকে আমি নতুন ভাবে চেষ্টা শুরু করবো। আমি বিজয়ী হয়ে সবার মনে আবার জায়গা করে নেবো ইনশাআল্লাহ।

আদী হাসি মুখে ইকবালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মুখে বলা প্রতিটা শব্দ ইকবালের মনের ইচ্ছার গভীরতার সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। আসলে অনেকসময় অজানা আশঙ্কায় মানুষের মন গোধূলি বেলায় থমকে দাঁড়িয়ে যায়। তারা প্রতীক্ষা করে কেউ তাদেরকে আশ্বাস ভরা কন্ঠে মনে করিয়ে দেবে যে, যখন সূর্যাস্ত হয় তখনো সকল ধূসরতা ম্লান করে রক্তিম ছটায় অদ্ভুত সুন্দর সাজে সেজে ওঠে আকাশপট! অথচ সময়টা গোধূলি লগ্ন! যখন পৃথিবীকে ছেড়ে বিদায় নেবার উদ্দেশ্য নিজের আলোক রোশনিকে গুটিয়ে নেবার আয়োজনে ব্যস্ত সূর্য। নিজেকে সাজিয়ে গুজিয়ে আঁধারের পূর্বাভাস জানান দিয়ে প্রকৃতি আসলে এই সংবাদই জানিয়ে দেয় যে, ভয় নেই নতুন সূর্যোদয়ের রূপে আমি আবারো ফিরে আসবো পৃথিবীর বুকে, তোমাদেরকে স্নাত করতে আমার আলোর ঝর্ণাধারায়।


ঠিক তেমনি জীবন থেকে হাসি-আনন্দ যখন টুপটুপ ডুবে যেতে থাকে কালের গহ্বরে। দুঃখ-বেদনারা নীলচে নীলাভ আভা ছড়িয়ে দেয় জীবনে। মুষল ধারে ঝরে যেতে থাকে স্বপ্নরা। আশা-নিরাশার মাঝে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। আবেগ আর বিবেক জুড়ে দেয় তর্ক-বিতর্ক। দোদুল্যমান মনটাকে মস্তিষ্ক আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেয় বাস্তবতা। তখন যদি আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ভরসা রেখে জীবনের দিকে তাকানো যায় সন্তোষ ভরা দৃষ্টিতে, তাহলে দেখা মেলে কল্যাণময়তায়। যা আসলে আনন্দেরই আগমনী বার্তা শুনিয়ে যায় চুপিচুপি। এটা ঠিক যে, কখনো কখনো খুব বেশি দুরূহ লাগে জীবন চলার পথ! ইচ্ছে থাকা স্বর্ত্বেও থমকে যায় কদম, গতি হয় শ্লথ! কিন্তু মনেতে থাকে যদি অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ধৈর্য্য। সৌভাগ্যের দুয়ার একদিন উন্মোচিত হওয়াটা অনিবার্য! কেননা পাহাড় সম বাঁধাও তার সামনে হয়ে যায় চূর্ণ! আল্লাহর তরে বিশ্বাস ও ভালোবাসায় অন্তর যার পূর্ণ...

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২২



ডাইনিং টেবিলে এসে নাস্তার সমস্ত আইটেমে চোখ বুলিয়ে খাবো নাআআআ বলে বিরাট চিৎকার করে ছুট দিয়েছিল জারিফ। জিহাদ, জিশান, নাবিহা তিনজনই চেয়ার টেনে বসে পড়েছিল ততক্ষণে। কিন্তু ছোট ভাইকে দৌড়ে পালাতে দেখে তিনজনও উঠে পিছন পিছন ছুট লাগালো। চারজনকে এমন দৌড়ে পালাতে পিছু নিয়েছিলেন মিসেস নুসরাত। এক ছুটে বাগানে যেয়ে নাক চেপে ধরে দাঁড়িয়েছিল জারিফ। জিহাদ পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি এমন কেন করলে ভাইয়া?

জারিফ জবাব দিলো, আমি খাবো না। দেখতে একটুও সুন্দর হয়নি খাবার।

নাবিহা এগিয়ে গিয়ে জারিফের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এভাবে বলতে হয় না ভাইয়া। বড় মানা ভাই শুনলে কষ্ট পাবে তো। মানা ভাই কত কষ্ট করে সকাল থেকে আমাদের জন্য নাস্তা বানিয়েছেন। ভালো না লাগলেও একটু করে খাওয়া উচিত আমাদের। যাতে মানা ভাই খুশি হন। মনে নেই তোমার পাপা আমাদেরকে কি বলেছিলেন?

পাপা কি বলেছিলেন আপ্পি? আমি ভুলে গিয়েছি।

জিশান হেসে বলল, পাপা বলেছিলেন, মানুষকে খুশি করার জন্য, আনন্দ দেবার জন্য যদি তোমাদেরকে কখনো একটু কষ্ট পেতে হয় কিংবা করতে হয়। কখনোই পিছিয়ে যাবে না। বরং তোমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকা প্রতিটি আনন্দে অন্যদেরকে শরীক করার চেষ্টা করবে। কারণ জগতময় আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণ ছড়িয়ে দেয়াটাই তো তোমাদের কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে শুধু একটা কথা মনে রাখবে। সেটা হচ্ছে, কখনোই এমন কিছু করবে না যাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নারাজ হতে পারেন তোমাদের উপর।

জারিফ হেসে বলল, হ্যা এখন আমার মনে পড়েছো তো। আপ্পি, ভাইয়া চলো চলো নাস্তা করতে যাই আমরা। নয়তো বড় মানা ভাই কষ্ট পাবে।

চার ভাইবোনকে গলাগলি ধরে নাস্তার টেবিলে এসে বসতে দেখে এবং খুব আনন্দ নিয়ে খাবার খেতে দেখে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছিল মিসেস নুসরাতের। মোটেই নরম মনের কোন মানুষ নন মিসেস নুসরাত। বরং পরিবারের সবচেয়ে শক্ত মনের সদস্যদের কাতারে নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছেন বহু বছর আগেই। কিন্তু আজ কেন জানি নিজেকে সামলাতে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছিলো। নিজের দুর্বলতা কারো চোখে পড়ে যাক সেটাও চাচ্ছিলেন না। তাই নাস্তার প্লেট নিয়ে বারান্দার এক কোণে এসে বসেছেন। দরজার ফাঁকা দিয়ে জিহাদ, জিশান, নাবিহা আর জারিফের হাস্যরত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকাতে মিসেস নুসরাতের মন ছুট লাগালো অতীত পানে। জাওয়াদ আর নূহার বিয়ের কয়েক মাস পর কোন এক ছুটির দিনে পরিবারের সবাই মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছিলেন। চোখে মুখে ঝিকিমিকি ভালোবাসা নিয়ে জাওয়াদ যখন নববধূর পাশে বসতে যাচ্ছিলো তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বলেছিলেন, এই তুই ঐদিকে কোথায় যাচ্ছিস? বিয়ে হয়েছে বলে কি সারাক্ষণ বৌয়ের আঁচলের নীচে থাকবি নাকি? মা-খালাদের প্রতি পালনীয় সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে ভুলে যাবি?

জাওয়াদ হাসি মুখে বলেছিল, জ্বি খালাজ্বি বলেন কি দায়িত্ব পালন করতে হবে আপনার জন্য?  

আমার পাশে এসে বোস। আপাতত জার্নিতে আমাকে বিনোদন দেয়া হচ্ছে তোর দায়িত্ব। জাওয়াদ বিনা বাক্য ব্যয়ে তার পাশে বসতে গেলে মিসেস নুসরাত বলেছিলেন, এখানে না জানালার পাশে বসবি তুই। এখানে বসলে কথা বলবি আমার সাথে কিন্তু তাকিয়ে থাকবি বৌয়ের দিকে। এই সুযোগ আমি তোমাকে দেবো না বাপধন। জাওয়াদ তখন হাসতে হাসতে জানালার পাশে গিয়েই বসেছিল। দুষ্টুমি মাখা স্বরে তিনি তখন বলেছিলেন, তোর বৌকে বলেছি আজ ওকে বোঝাবো দজ্জাল শ্বাশুড়ি কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি।

ভেরি গুড আইডিয়া। যদি নিজের বুঝ থাকে অন্যেকে বোঝানোটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তাই যত কষ্টকরই হোক নতুন পরিস্থিতি বোঝার সুযোগ হাতছাড়া করতে নেই।

তোর বৌও এই কথাই বললো আমার কথা শুনে। তোরা দুইজন সবসময় একই সুরে বাজিস কিভাবে?

বুঝলেন খালাজ্বি সম্মুখের সুন্দর লক্ষ্য চলার পথের বাঁধা-বিঘ্নকে জয় করার ব্যাপারে উৎসাহ ও উদ্দীপনার কাজ করে যায়। অনেক কঠিন কাজও খুব সহজেই করে ফেলা যায় যদি মানুষ নির্দিষ্ট একটা গন্তব্যে পৌঁছানোর নকশা অনুযায়ী চলে। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের দুজনের কাছে এমন একটা লক্ষ্য ও গন্তব্য আছে। কি সেই লক্ষ্য আমিও তো একটু শুনি! ইনশাআল্লাহ আমরা দুজন মিলে দাম্পত্য জীবনকে ঘিরে খুব সহজবোধ্য, মনোরম ও আকর্ষণীয় একটি সঙ্গীত রচনা করে যেতে চাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। যে সঙ্গীতটা শুনতে যেমন ছন্দময় ও শ্রুতিমধুর হবে, তার প্রতিটি শব্দ হবে হৃদয় স্পর্শিত অনুভূতির রসে সিক্ত। মনকে নাড়া দেবে, প্রাণে সাড়া জাগাবে, অজান্তেই গুনগুন করে উঠবে অন্তরও মাঝে।

এত ভাবুকতা যে কোত্থেকে এলো তোদের দুইজনের মনে! তবে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি তোদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাগত জানানোর জন্য। আনন্দবাড়ির দুষ্টুদের শ্রেষ্ঠ দুষ্টু হচ্ছিস তোরা দুইটা। দেখা যাক দুই দুষ্টুর সংমিশ্রণে কি জন্ম নেয় পৃথিবীতে। অবশ্য বিষে বিষ ক্ষয় বলেও একটা কথা আছে। হয়তো দেখা যাবে তোদের বাচ্চাকাচ্চাই হয়েছে আনন্দবাড়ির শ্রেষ্ঠ শান্তশিষ্ট বাচ্চাদের অন্যতম।

জাওয়াদ তখন হাসতে হাসতে বলেছিল, জগতে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। তাই যে কোন কিছুই সংঘঠিত হতে পারে। তাহারা দুষ্টু হোক বা শান্ত হোক সেটা নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই, চাওয়াও নেই। তবে যেমনই হোক তাহাদের মাতার মতন মনোজাগতিক কৃষাণী হোক এটাই প্রার্থনা।

মনোজাগতিক কৃষাণী? সেটা আবার কি? অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করেছিলেন মিসেস নুসরাত।

জাওয়াদ জবাবে বলেছিল, মনের ভেতরটা যদি অনুর্বর থাকে তাহলে আমাদের চিন্তা-চেতনা-ভাবনা-বিবেচনা সঠিক ও পর্যাপ্ত রসদের অভাবে পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত হয়। অনুর্বর জমির মতো অনুর্বর মনও ফসল ফলাতে ব্যর্থ হয়। আবার ফসল ফললেও তার গুণগত মানে ঘাটতি থেকে যায়। উন্নত ও পর্যাপ্ত ফলনের জন্য তাই মনভূমিকেও চাষের জমির মতোই উপযোগী করে তৈরি করতে হয়। আমাদের প্রতিটা কাজ, প্রতিটা অ্যকশন এমন হওয়া উচিত যার জন্য প্রাউড ফিল করা যায়। আর এরজন্য ডিসিপ্লিন অর প্ল্যানিং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রুলের সমন্বয়ে তৈরি হয় ডিসপ্লিন। অনুশাসন থেকে তৈরি হয় প্রাইড। আর প্রাইডের জন্য দরকার হয় স্বচ্ছ চরিত্র। যা কিনা পরিস্কার চিন্তা-চেতনা-ভাবনা ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। মোটকথা অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনায় চরিত্রকে গড়তে হয়। মনোজাগতিক কৃষাণ-কৃষাণী হওয়া ছাড়া চরিত্রকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়।

হুম, বুঝলাম। তবে এখন লেকচার বন্ধ। তোকে বিনোদন দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, লেকচার শোনানোর না। বুঝেছিস? সুযোগ একটু পেলেই হয়েছে ক্লাস নেয়া শুরু করিস তোরা জামাই-বৌ। আচ্ছা তাহলে বলে দাও কি করতে হবে তোমাকে বিনোদন দেবার জন্য। তোর বৌকে একটা রোম্যান্টিক ম্যাসেজ লেখ। লেখার পর আমাকে দেখিয়ে তারপর সেন্ড করবি। বুঝেছিস?

 অবশ্যই বুঝেছি খালাজ্বি। আপনি কিছুক্ষণ চলন্ত প্রকৃতি দেখতে থাকুন। আমি ততক্ষণে রোমান্টিক একটা ম্যাসেজ লিখে ফেলছি ইনশাআল্লাহ।  

এবং সত্যি সত্যিই কিছুক্ষণের মধ্যে জাওয়াদ নূহার জন্য ম্যাসেজ লিখে ফেলেছিল। এত বছর পরেও যে ম্যাসেজের প্রতিটা শব্দ মিসেস নুসরাতের মনে আছে। কথার যাদুকরী ক্ষমতার সাথে পরিচয় ছিল! জানা ছিল মানুষের শব্দ পারদর্শিতার কথা! শব্দে লুকায়িত প্রাণ জাগাতে পারে নব আশ্বাস! নিরাশার আঁধারে দিয়া হয়ে জ্বলতে পারে শব্দ! তোমার শব্দের জোয়ার-ভাটার ইচ্ছে স্রোতে ভেসে! শব্দের বহুমুখী প্রতিভার সাথে পরিচয় হয়েছিল অবশেষে! জেনেছিলাম,গাইতে পারে শব্দ, উড়তে পারে বাঁধনহারা উল্লাসে! হাসতে পারে শব্দ,শিশির হয়ে ঝরতে পারে দুর্বাঘাসে! শব্দ অমূল্য মোতি,শব্দ ছড়ায় জোনাক জোনাক জ্যোতি! শব্দে লুকায়িত শক্তি,আত্মবিস্মৃত মনে জাগায় ভক্তি! শব্দে আছে আশা, অজান্তেই প্রাণেতে বুনে দেয় ভালোবাসা! শব্দ ঝরে নীরবে,মুগ্ধতার শ্রাবণ হয়ে আপন গৌরবে! শব্দ বাড়িয়ে দেয় হাত,কুয়াশা ছিন্ন করে আলোর প্রভাত! শব্দ করে অভিমান,কম্পিত হিয়া ভুলে যায় সুখের গান! শব্দের থৈথৈ আদর,বুঝিয়ে দেয় প্রিয়জনের কদর! শব্দে আছে সম্ভাষণ,কারো নিভৃত সূর্যোদয়ে সাজে ভুবন! শব্দ দেখায় স্বপন,পূর্ণতাতে যার তুমি আজ আপন!

নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন মিসেস নুসরাত অতীতের সেই ভালোবাসাময় মূহুর্তগুলোর মাঝে। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে নূহাকে দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি টেনে বললেন, কিছু বলবি মা?

নূহা হেসে বলল, তুমি নাস্তার প্লেট নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছো কেন? দেখতে খারাপ হলেও খেতে কিন্তু বেশ মজাই হয়েছে মামার রান্না করা খাদ্য। তাই নির্ভয়ে খেতে পারো।

মিসেস নুসরাত হেসে বলল, খেয়েছি কিছুটা। আমার কাছেও ভালোই লেগেছে। কিন্তু আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তবে তোর বানানো হালুয়া খাবো। আচ্ছা শোন একটা কথা সকাল থেকে বলি বলি করেও বলা হচ্ছে না তোকে। আমাদের পাশের বাড়িতে নতুন প্রতিবেশী এসেছে।

সেটা তো আরো দুইমাস আগে এসেছে।

কথা পুরোটা না শুনেই মাঝখানে কথা বলার অভ্যাসটা আর তোর গেলো না।

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা সরি। এই নাও মুখে তালা দিলাম। তুমি কথা শেষ করার আগে আর কিছু বলবো না।

আমার সাথে প্রতিবেশী সেই মহিলার বেশ সখ্যতা হয়েছে বলতে পারিস। দুই মেয়ে মহিলার। বড় মেয়েটার মনেহয় কোন সাইকোলজিল্যাল সমস্যা আছে। তোর সাথে যোগাযোগ করতে বলেছি। তোর নাম্বার দিয়ে দিয়েছি। যোগাযোগ করলে একটু দেখিস কি সমস্যা মেয়েটার।

নূহা হেসে বলল, একটু না পুরো সমস্যাই দেখবো ইনশাআল্লাহ। আপাতত সমস্যার রাজ্যই আমার আবাসভূমি। তাই সেখানেই দেখি সমস্যা, মনে জেগে ওঠে আশা।

কিসের আশা?

নূহা হেসে বলল, সেটা বলা যাবে না। এটা আমার টপ সিক্রেট। এসব কথা এখন বাদ। তুমি চলো মামণি ডাকছে তোমাকে। আরেকটু পরই মনেহয় রওনা দেবে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

তুই যাবি আমাদের সাথে?

যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাহাত একটু আগে ফোন দিয়ে জানালো বিকেলে আসছে ইনশাআল্লাহ। তাই আর যেতে চাচ্ছি না। তুমি চলো বাপীর জন্য হালুয়া প্যাক করে দেবো।

মিসেস নুসরাত হেসে বললেন, আচ্ছা চল।

@

আলো ও অন্ধকারের মাঝে আলো অপ্রতিরোধ্য। সত্যিই কি তাই? হবে হয়তো! সেজন্যই হয়তো তীব্র আন্ধকারের মধ্যেও একবিন্দু আলো তার অস্তিত্ব জানান গিয়ে যায়। কিন্তু আলোকে ম্লান করতে অন্ধকারকে বিশাল চাদর নিয়ে হাজির হতে হয়। আচ্ছা ইতিবাচক অনুভূতি গুলোকে আলো আর নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে কি অন্ধকারের সাথে তুলনা করা যায়? যদি যায় তাহলে আনন্দ ও বেদনার মধ্যে কোন অনুভূতিটা অপ্রতিরোধ্য? ভালো লাগা ও মন্দ লাগার মধ্যে কার আধিপত্য বেশি মনের উপর? ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাতে থাকা সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিক্ষিপ্ত এসব ভাবনা দলে দলে দলে হানা দিতে লাগলো ইমরানের মনে। চোখ বন্ধ করলো সে। মনটাকে টেনে আরেকদিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। মনের ভাবনা গুলোকে ভাঁজ করে তুলে রাখাটা এখানো রপ্ত করতে পারেনি সে। মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়াই মন খারাপ হয়ে যায় তার।

তুই এখানে আমি আরো লাইব্রেরী, ক্যান্টিন সব জায়গায় খুঁজে এলাম তোকে। বাসায় যাবি না? ইমরানের পাশে বসতে বসতে বললো ইয়াস।

বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো ইমরান। ছোটবেলা থেকে একই সাথে বড় হয়েছে ইমরান ও ইয়াস। একই স্কুলে ও কলেজে পড়েছে। ইউনিভার্সিটিতে এসেও একই বিষয় নিয়ে পড়ছে দুজন। একে অন্যেকে ছাড়া চলেই না দুজনের। পরিচিত মহলে মানিকজোড়নামে খ্যাত দুজন।

বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে ইয়াস বলল, কি রে তোর কি মন খারাপ কোন কারণে?

ইমরান বলল, বুঝতে পারছি না। কেন জানি না কিছুই ভালো লাগছে না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে। আচ্ছা তোর কি কখনো এমন হয় যে, অকারণেই মন খারাপ হয়ে যায়?
আগে মাঝে মাঝে এমন মনে হতো। কিন্তু একদিন আদী ভাইয়া বুঝিয়ে বলেছিলেন, আমাদের মন খারাপ আসলে কখনোই অকারণে হয় না। মন খারাপের পিছনে সবসময়ই কোন না কোন কারণ থাকে। তবে সবসময় কারণটা আমরা বুঝতে পারি না বিধায় মনে করি অকারণে মন খারাপ হয়েছে।

হুমম, সেটাই হবে হয়তো।

হবে হয়তো না। আসলেই এটাই। তুই তো জানিসই আদী ভাইয়া সাইকিয়াট্রিস্ট। ভাইয়া আমাকে চমৎকার করে বিষয়টা বুঝিয়ে বলেছিলেন। ভাইয়া বলেছিলেন, ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, আমাদের মনের এক কোণে বদ্ধ কুঠিরে আটকা পড়ে আছে বেদনাক্ত কোন স্মৃতি। মাঝে মাঝেই যে নিজেকে মুক্ত করার জন্য ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। বদ্ধ ঘরের দূষিত বাতাস ও ধূলো-বালি ফাঁকফোকর দিয়ে তখন বাইরে চলে আসে। যার প্রভাবে ব্যহত হয় স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস। হাঁসফাঁস করতে থাকে মন তখন বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য। ধূলো-বালির কুয়াশার আস্তর ফেলে দেয় যার ফলে বুঝে উঠতে পারে না কি থেকে কি হয়ে গেলো। ধারণা করে নেয় অকারণেই বুঝি তার এমন লাগছে। তুই আমার সাথে বাসায় চল। ভাইয়া বাসায় থাকলে তোর এই মাঝে মাঝে অকারণে কেন মন খারাপ হয়ে যায় এটার কারণ কি হতে পারে সেটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা যাবে।

ইমরান হেসে বলল, সাইকিয়াট্রিস্টরা কত সহজেই মনের অবস্থা সমূহের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে সমাধান দিয়ে ফেলেন। কিন্তু সমস্যার ব্যাখ্যার মত সমাধানগুলোও যদি সহজ হতো কতই না ভালো হতো।

এই কথা বলছিস কেন?

কিছুক্ষণ নীরবতার পর ইমরান বলল, আমার কাজিন ইকবাল ভাইয়া একসময় অসৎ সঙ্গের কারণে নেশায় আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু পরে সবাই মিলে বোঝানোর পর বেড়িয়ে এসেছে অন্ধকার সেই জগত থেকে। কিন্তু তারপরও সবাই এখনো উনাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখে। চাচার এক বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল কিন্তু এখন আর তারা তাদের মেয়েকে ইকবাল ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে না। মনে মনে বেশ ভেঙ্গে পড়েছেন ভাইয়া।

ইয়াস বলল, জানিস ভাইজান একটা কথা প্রায়ই বলেন আমাদেরকে। বলেন, নিজের ভুল বুঝতে পেরে যারা নিজেকে শুধরাতে চেষ্টা করে তাদেরকে কখনোই অবিশ্বাস করা ঠিক না। কারণ তাদেরকে বিশ্বাস না করতে তারা কখনোই নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে পারবে না। আর আমরা যদি তাদের হাত না ধরি, তাহলে যে কোন সময় তারা আবার পথ হারিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু এসব নীতিকথা মনে করে আমাদের সমাজের মানুষেরা উড়িয়ে দেয়। তারা জেনে শুনে ঘুষখোর ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে কিন্তু নিজেকে সংশোধন করে সত্যের পথে পা বাড়ানো কারো দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে না। আমাদের এই সমাজে তাই ভালো হতে চাইলেও ভালো হওয়াটা অনেক কঠিন।

হ্যা ঠিক বলেছিস তুই। এখন বুঝতে পারছি আমি আসলে ইকবাল ভাইয়াকে নিয়েই ভাবছিলাম। তাই মন খারাপ লাগছিলো খুব।

ইয়াস হেসে বলল, আদী ভাইয়া অবশ্য এই কথাটাও বলেছিল। পছন্দের কারো সাথে মন খুলে কথা বললেও মনের গুমোট ভাব কেটে যায়। মন খারাপের অজানা কারণ বেড়িয়ে আসে কথার ফাঁকে।
ইমরান বলল, আচ্ছা আদী ভাইয়া কি সময় দিতে পারবেন আমাকে? আমি তাহলে ইকবাল ভাইয়াকে নিয়ে আসতাম একদিন। আমার খুব ভয় হচ্ছে মানুষের নেগেটিভ আচরণের কারনে ভাইয়া আবার না ফিরে যায় অন্ধকার সেই জীবনে।

ইয়াস বলল, ইনশাআল্লাহ আমি তোকে জানাবো। এখন চল আমরা উঠি।


ইয়াস উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো ইমরানের দিকে। ইমরানও হেসে বন্ধুর বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরলো।