সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...২১




অন্য সময় হলে এই মূহুর্তে দলবল সহ খালামণি, ফুপ্পিদেরকে ঢুকতে দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হতো নাবিহা মামণির সাথে তার একান্ত সময়ে ভাইদের ছাড়া আর কারো আগমন একদম মেনে নিতে পারে না কিন্তু এই মূহুর্তে আত্মজা, জুনি, নায়লা খালামণি সহ আরো চার-পাঁচজনকে ঢুকতে দেখে মনে মনে খুবই আনন্দিত হলো নাস্তার ট্রে নূহার পাশে নামিয়ে রেখে হাসি মুখে বলল, মামণি তুমি তাহলে এখন খালামণিদের সাথে কথা বলো আমরা পরে গল্প করবো ইনশাআল্লাহ আমি নদীর পাড়ে যাই আল্লাহ হাফেজ আসসালামু আলাইকুম বলে জবাবের অপেক্ষা না করেই নাবিহা ছুট লাগালো প্রায় ছুটতে ছুটতেই নদীর পাড়ে এসে পৌঁছালো বিকেল বেলা বাবা কিছুতেই ঠাণ্ডা পানিতে নামবে না সেটা ভালো মতই জানা আছে নাবিহার তারপরও যখন সবাইকে নদীতে আর বাবাকে পাড়ে বসে থাকতে দেখলো খুবই আনন্দ লাগলো প্রিয়জনদের ব্যাপারে নিজের জানাকে সত্য প্রমাণিত হতে দেখার আনন্দই অন্যরকম কে বলেছিল কথাটা? পাপা নাকি মামণি? ঠিক মনে করতে পারলো না নাবিহা থাক, পরে ভেবে দেখা যাবে এটা নিয়ে এখন এরচেয়ে অনেক জরুরি কথা জানতে চায় সে ছুটে গিয়ে বাবার পাশে বসে নাবিহা বলল, বাবা বলো বলো তাড়াতাড়ি বলো নয়তো সবাই আবার সুইমিং শেষ করে চলে আসবে

রাহাত হেসে বলল, এখনই শুনতে হবে?

হ্যা। পাপা বলেছে আজকের কাজ কখনোই আগামীকালের জন্য রাখতে নেই। তাহলে আগামীকালের জন্য সেটা বোঝা হয়ে যাবে। আবার কোন কারণে যদি আগামীকালও সেটা করা সম্ভব না হয়, তাহলে হয়তো সারাজীবনই গতকালের বোঝা কাঁধে নিয়ে পথ চলতে হবে। তবে নিরুপায় হয়ে কখনো যদি আজকের কাজ আগামীকালের জন্য জমিয়ে রাখতে হয়, তখনও কাজটি করার সর্বাত্মক চেষ্টা করার পর রাখবে। কোন কিছু জানার ব্যাপারেও নিশ্চয়ই একই ফর্মূলা।
রাহাত হাসতে হাসতে বলল, হুম, একই ফর্মূলা হওয়াই ভালো।

তাহলে বলো মামণিকে বিয়ের করার কথা কিভাবে বলেছিলে নানাভাইকে?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে একটু গুছিয়ে রাহাত হাসি মুখে বলল, আমি আসলে তোমার নানাভাইকে বিয়ের কথা বলিনি। বলার উপায়ও ছিল না। কারণ বিভিন্ন ইসলামিক প্রোগ্রামে তোমার নানাভাইর সাথে দেখা সাক্ষাৎ হলেও কখনোই তেমন কথাবার্তা হয়নি। সংগঠনের অন্য আর দশজন সাধারণ সদস্যর মতোই ছিলাম আমি। শুধুমাত্র ভাইজান, আদী ভাইয়া, ফায়েজ ভাইয়া, রিসাব ভাইয়া আর হুমায়ুন ভাইয়ার সাথেই আমার খুব ভালো মতো জানা শোনা ছিল। সবচেয়ে বেশি ছিল ভাইজানের সাথে। মূলত রিহ্যাভ সেন্টারের কাজ শুরু হবার পর থেকেই আমি ভাইজানের অনেক কাছাকাছি যাবার সুযোগ পেয়েছিলাম। আর তোমার মামণিকে দূর থেকে ভাইজানের সাথে মাঝে মধ্যে দেখলেও, সালাম বিনিময় পর্যন্তও হয়নি কোনদিন। আমাদের বিয়ে ঠিক হবার আগে কোনদিন আমি তোমাদের মামণিকে কাছ থেকে দেখিনি।

তাহলে বিয়ে করতে চেয়েছিলে কিভাবে? অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো নাবিহা

রাহাত হেসে বলল, আসলে তোমার পাপার চলে যাবার পর এক কথায় বলতে গেলে প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল তোমার মামণি। সবাই ভেবেছিল তোমাদের জন্মের পর হয়তো স্বাভাবিক হয়ে যাবে নূহা। কিন্তু তোমাদের জন্মের পর বছর পেরিয়ে গিয়েছিল কিন্তু নূহা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গিয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া করতো না ঠিকমতো, ঘুমতো না, সারাদিন চুপ করে বসে থাকতো। ধীরে ধীরে শারীরিক ভাবেও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলো আরো বেশি। বাড়িতে তো বড়মামা, আদী ভাইয়া ছিলেনই তারপরও বাইরের সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াটিস্ট দিয়েও ট্রাই করা হয়েছিল কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক করা যাচ্ছিলো না নূহাকে। তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নূহাকে বিয়ে দেয়ায়। প্রথমে তো কিছুতেই রাজী হয়নি নূহা বিয়েতে। এরপর রাজী হলেও শর্ত দিয়েছিল পরিবারের ভেতর কাউকে বিয়ে করবে না। দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের ভেতর থেকেও অনেকেই বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছিল। কিন্তু নূহার একটাই কথা ছিল কোন ভাবেই পরিবারের সাথে রিলেটেড কেউ হতে পারবে না। এরমধ্যে অস্ট্রিয়াতে একটা ইসলামিক কনফারেন্স এটেন্ড করতে গিয়েছিলাম আমি ফায়েজ ভাইয়া আর রিসাব ভাইয়ার সাথে। দুজনই অনেক টেন্সড ছিলেন নূহাকে নিয়ে। তোমাদের খোঁজখবর জানতে চেয়েছিলাম ভাইয়াদের কাছে। এরপর কথায় কথায় তোমার মামণির প্রসঙ্গ উঠেছিল। আমার সম্পর্কে ভাইয়ারা সবকিছুই জানতেন। আমার বাবা-মা ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছেন। ভাইবোনেরা সবাই নিজ নিজ জীবনে সেটেল্ড। এককথায় আমার কোন পিছুটান ছিল না। আমি কারো উপর ডিপেন্ড ছিলাম না, আমার উপরও কেউ ডিপেন্ড ছিল না সময়। আর নূহার জন্য এমন কাউকেই খুঁজছিলেন ভাইয়ারা। যাতে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি রিলেটেড কিছু ডিল করতে না হয় নূহাকে। সংগঠনের ভাইদের মধ্যে দ্বীনদার, বিশ্বস্ত, ভাইজানকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন এমন অনেক ভাই ছিলেন। যাদের সবাই খুশি মনে রাজী হয়ে যেতো নূহাকে বিয়ের ব্যাপারে। কিন্তু সবারই ফ্যামেলি ছিল, ফ্যামেলিকে ঘিরে দায়-দায়িত্ব ছিল। ভাইয়াদের সিলেক্টেড পারসনদের মধ্যে আমিই একমাত্র মোটামুটি যেমন কাউকে চাচ্ছিলেন উনারা তেমন ছিলাম। তোমার মামণিকে বিয়ের প্রোপজাল ফায়েজ ভাইয়া আমাকে দিয়েছিলেন। বুঝিয়ে বলেছিলেন, যেভাবেই হোক স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চান নূহাকে।

নাবিহা হেসে বলল, বড় মামা যখন তোমাকে মামণিকে বিয়ের কথা বলেছিল তখন তোমার কেমন লেগেছিল?

রাহাত হেসে বলল, কিছুক্ষণ বুঝতেই পারছিলাম আসলে কি বলছেন উনারা। একবার মনেহচ্ছিলো ভুল শুনছি। আরেকবার মনেহচ্ছিলো উনারা টেনশনের কারণে বলে ফেলেছেন। কিন্তু পরে যখন সবকিছু খুলে বলেছিলেন আমি সাথে সাথেই রাজী হয়ে গিয়েছিলাম। রাজী না হবার আসলে কোন কারণও ছিল না আমার কাছে। ভাইজানের অসংখ্য অবদানে ঘেরা ছিল আমার জীবন। অন্যের খুশির মাঝে নিজের সুখ খুঁজে নেয়াও আমি ভাইজানকে দেখেই শিখেছিলাম। পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এই লাইনটির বাস্তব উদাহরণ ছিলেন ভাইজান আমার কাছে। তাই ভাইজানের জন্য কিছু একটা করার সুযোগ পেতে যাচ্ছি ভেবে নিজেকে ভাগ্যবান মনেহচ্ছিলো। এরপর ভাইয়ারা যেভাবে যেভাবে বলেছেন আমি সেভাবেই সবকিছু করেছি। যদিও ভাইয়ারা আড়ালে ছিলেন। কারণ তা না হলে তোমার মামণির হয়তো কোন একটা কারণ খুঁজে বের করে আপত্তি জানানোর সুযোগ পেয়ে যেত। আমাদের বিয়েটা খুব সহজেই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পরের সফরটা বেশ কঠিন ছিল। আমার জন্য সবকিছুই নতুন ছিল। আনন্দবাড়ি, বাড়ির সদস্যরা, তাদের লাইফ স্টাইল সবকিছু। যদিও খুব দ্রুতই সবাই আমাকে আপন করে নিয়েছিল। মাস খানেকের মধ্যেই আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম সবকিছুর সাথে। জানোই তো মানুষকে আপন করে নেবার কি অসাধারণ ক্ষমতা আমাদের বাড়ির প্রতিজন সদস্যের। এই ক্ষমতা আগেও ছিল। বিশেষ করে তোমার মামণির সমবয়সী সেই ভাইবোন যারা ছিল ওরা খুব সাহায্য করেছে আমাকে। তোমার মামণির ভালো লাগা, মন্দ লাগা, পছন্দ-অপছন্দ, আমাকে কখন কি করতে হবে, কি বলতে হবে সবকিছু পয়েন্ট টু পয়েন্ট বলে দিতো রাহা, তাসমিয়া, আয়ান, জাফর ওরা সবাই মিলে। ওরা সবাই মিলে তো করণীয়-বর্জনীয়র চার্ট পর্যন্তও তৈরি করে দিয়েছিল আমাকে। এছাড়া বাবা-মামণি, পাপা-মা, বাপী তো ছিলেনই পরামর্শ দেবার জন্য। আদী ভাইয়া সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন তোমার মামণিকে বোঝার ব্যাপারে। এছাড়া আমাদের সংগঠনের ভাইয়েরা যখনই দেখা হতো কিংবা ফোনে কথা হতো একই কথা বলতো, আল্লাহ তোমাকে অনেক বড় একটা সুযোগ দিয়েছে ভাইজানের জন্য কিছু করার। এই সুযোগকে যথাযথ কাজে লাগিয়ো। আপামণি আর বাচ্চাদের খেয়াল রেখো সবসময়। মনে রেখো উনারা তোমার কাছে ভাইজানের আমানত।

নাবিহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আংকেলরা সবাই পাপার মতো মামণিকেও অনেক ভালোবাসেন।

হ্যা। কারণ আমরা নতুনরা ছাড়া বাকি সব ভাইয়ারাই ছোটবেলায় তোমার মামণিকে দেখেছেন। ভাইজানের খুব বেশি আদরের ছিল তাই বাকি সবার কাছেও খুব আদরের ছিল নূহা। যেই ছয় মাস এখানে ছিল, একদিন নূহা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। খুব মন খারাপ ছিল সেদিন ভাইজানের। জরুরি একটা ডকুমেন্ট দেখানোর জন্য আমি হসপিটালে গিয়েছিলাম। ভাইজানের মন খারাপ দেখে সঙ্গ দেবার জন্য পাশে বসেছিলাম। সেদিন কথায় কথায় ভাইজান আমাকে বলেছিলেন, নূহা যতটা না আমার ভালোবাসার তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি আদরের। নিজেই নিজেকে অসংখ্যবার একটা প্রশ্ন করেছি, কেন আমি নূহার হাজবেন্ডের অবস্থানে দাঁড়ানো? আমার তো এখানে থাকার কথা ছিল না। আজ পর্যন্তও আমি নূহাকে ঘিরে আমার মনের অনুভূতিকে ভুলও বলতে পারিনি আবার সম্পূর্ণ রুপে মেনেও নিতে পারিনি কখনোই। লাইফের যে স্টেজে নূহাকে ঘিরে আমার মনে অন্যরকম ভালো লাগার জন্ম হয়েছিল। শুধুমাত্র আবেগে ভেসে যাবার বয়স ছিল না সেটা আমার। অনেকটা অজান্তেই ছোট ভাইবোনদের সবার মনে আইডল এর স্থান করে নিয়েছিলাম। সংগঠনের প্রতিজন সদস্যের চোখে আদর্শ একজন মানুষ ছিলাম। তাই নূহাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমার জন্য মোটেই সহজ ছিল না। আমার কাছে আমার রেপুটেশন, ইমেজ খুব বেশি গুরুত্ব বহন করতো। নিজের ভাবমূর্তি যাতে কখনোই ক্ষুণ্ণ না হয়, সে ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক ছিলাম। কারণ যেহেতু আমি একজন পাবলিক ফিগার, নেতিবাচক কিছু আমার দ্বারা সংগঠিত হওয়া মানে ইসলামকে মিন করে যা ইচ্ছে মন্তব্য ওঠার সম্ভাবনা। এত সব চিন্তা করে নিজের ভালো লাগাকে ইগনোর করাটাই উত্তম মনে হয়েছিল আমার। এবং সেটাই করেছিলাম। আমি সম্পূর্ণ রুপে নূহার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। এবং মনের অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার মত দৃঢ়তাও আমার ছিল আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু যখন দেখেছিলাম এরফলে নূহা প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছে। আমার শূন্যতা নূহাকে বদলে দিচ্ছে। আমি অন্য সব কিছু ভুলে গিয়েছিলাম। আমার ইমেজ, রেপুটেশন, কে কি বলবে, কি ভাববে সবকিছু গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল। গুরুত্ব ছিল শুধু একটাই, নূহা কষ্ট পাচ্ছে আমার কারণে। আর আমার পক্ষে নূহাকে কষ্ট দেয়া সম্ভব ছিল না। সেই মেয়েটিকে দূরে সরিয়ে দেয়াটা আমার জন্য মোটেই কঠিন কিছু ছিল না। পরিস্থিতির কারণে যাকে ঘিরে আমার মনে দুর্বলতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছোট্ট যে নূহা আমার মনে গুটিসুটি হয়ে বসে ছিল তার চোখে একবিন্দু অশ্রু সহ্য করাও অসম্ভব ছিল। জানো গরম পানি পড়ে নূহার পা পুড়ে গিয়েছে শুনে আমি এমবিবিএস ফাইনাল এগজাম চলাকালীন সময় অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ছুটে গিয়েছিলাম। নিজ চোখে দেখে নিশ্চিত হতে চাইছিলাম সত্যিই সিরিয়াস কিছু হয়নি ওর। ছয় বছর বয়সী ছোট্ট নূহার কাছে করা ছেলেমানুষি প্রমিস রক্ষা করার জন্য আমি প্রতিমাসে দেশে যেতাম। একদিনের জন্য হলেও যেতাম। ভাবনা কাজ করতো তা না হলে নূহার মন খারাপ হবে। ছোটবেলা থেকেই নূহার কষ্ট পাবে এই চিন্তাটার চেয়ে অসহনীয় আর কিছুই ছিল না আমার কাছে। ওর চোখে অশ্রু দেখলে আমার বুকের ভেতর ভার হয়ে আসতো। কেন এমন হতো সেটা এখনো আমি জানি না। শুধু জানি যখন নূহার মুখে হাসি দেখতাম মনেহতো, এভরিথিংক ইজ পারফেক্ট। তাই নূহার কষ্টের বিনিময়ে আমি আমার রেপুটেশন, ইমেজ অক্ষুণ্ণ রাখার কথা চিন্তা করতে পারিনি। পরিবারের কারো কাছে জবাবদিহীতার ভয় করিনি। নূহার খুশি যদি আমার মধ্যে থাকে। তাহলে সবার সাথে লড়াই করে হলেও সেই খুশি আমি ওকে দেবো এই ব্যাপারে দৃঢ় ছিলাম। যদিও লড়াই করতে হয়নি কারো সাথেই। খানিকটা বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কোন রিঅ্যাকশন ছিল না ঘরে বাইরে কারোরই। কিন্তু এতকিছুর পরেও আমি নূহাকে কষ্ট থেকে আড়াল করে রাখতে পারি না। ওর শারীরিক কষ্টগুলো নীরবে সয়ে যাওয়া ছাড়া যখন আর কিছুই করার থাকে না। নিজেকে খুব বেশি অসহায় লাগে এমন মূহুর্তগুলোতে। সেদিন ভাইজানের এই কথাগুলো থেকে আমি কিছুটা হলেও আন্দাজ করেছিলাম নূহাকে ঘিরে ভাইজানের ভালোবাসাকে।

নাবিহা হেসে বলল, পাপা বলে পুরো দুনিয়া একদিকে আর মা একদিকে পাপার কাছে। কিন্তু সেটা আমাদের মা হিসেবে না। পাপার সেই ছোট্ট নূহা হিসেবে। যে সারাক্ষণ ভাইয়া, ভাইয়া করে পাপার পেছন পেছন ঘুরতো।

রাহাত হেসে বলল, হুম, এতে কোনই সন্দেহ নেই। তবে সত্যি কথা কি জানো? তোমার মামণিকে ভালোবাসার অনেক আগে আমি পরিবারের অন্যান্য সদস্যেদেরকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এত আদর, এত ভালোবাসা আমি এরআগে কোনদিন পাইনি জীবনে। তোমার নানাভাই যখন আমাকে আব্বা বলে ডাক দিতেন চোখে পানি চলে আসতো আনন্দে। মায়ের আদর-মমতা স্বাদ মামণির কাছ থেকেই প্রথম পেয়েছিলাম। আমার আম্মু তো জ্ঞান হবার আগেই মারা গিয়েছিলেন। এছাড়া পরিবারের প্রতিটা সদস্যের কাছে স্পেশাল ভালোবাসা, সম্মান পেয়ে আমি বুঝে নিয়েছিলাম তোমার মামণি কতটা স্পেশাল সবার কাছে। আর আমার কাছে তো স্পেশাল ছিলই শুরু থেকেই ভাইজানের কারণে।

কিন্তু মামণি তো নিজের মতো থাকতো সবসময়। তোমার তখন কষ্ট হতো না?

যদি পরিবারের সদস্যরা আমাকে আপন করে না নিতেন, প্রতিটা বিষয়ে সাহায্য না করতেন, আমাকে সবকিছু না জানাতেন তাহলে হয়তো কষ্ট হতো। তাছাড়া বিয়ে আগে থেকেই আমার জানা ছিল আমাদের বিয়েটা তোমার মামণির জন্য এক ধরণের ট্রিটমেন্ট। আমি সত্যি স্বপ্নেও ভাবিনি কোনদিন তোমার মামণি আমাকে মেনে নেবে। আমার ধারণা ছিল স্বাভাবিক হবার সাথে সাথেই হয়তো ডিভোর্স চাইবে। আমি রকম কিছুর জন্যই প্রস্তুত ছিলাম মনে মনে। সত্যি বলতে বিয়ের প্রথম দিকে আমার সম্পূর্ণ ইনটেনশন জুড়ে শুধু এটাই ছিল যে, ভাইজানের ওয়াইফ আর বাচ্চাদের জন্য আমি কিছু করতে পারছি। এছাড়া আর কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তবে একদম প্রথম দিনই কিন্তু আমি নাবিহার ফ্যান করে গিয়েছিলাম। নাবিহা হেসে ফেললে রাহাতও হেসে বলল, একটুও বাড়িয়ে বলছি না কিন্তু। আমার জানা ছিল তোমাদেরকে ঘিরে ভাইজানের সমস্ত ইচ্ছের কথা। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করেছি সেভাবেই তোমাদেরকে ভালোবাসতে, আদর করতে।

জানি তো। তুমিও আমার অনেক প্রিয় বাবা। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষদের একজন। আচ্ছা বাবা স্বাভাবিক হবার আগে মামণি কি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে?

রাহাত হেসে বলল, তোমার মামণি কখনোই আমাকে কষ্ট দেয়নি। সে শুধু নিজের মতো থাকতো। সেটা তো এখনো থাকে। তবে সময় না পারতে কখনোই কথা বলতো না আমার সাথে। কিন্তু আমি কখনো কিছু জিজ্ঞেস করলে আবার ঠিকই জবাব দিতো।

তারপর মামণির সাথে তোমার ফ্রেন্ডশীপ কিভাবে হলো?

ফ্রেন্ডশীপ কিভাবে হলো সেই গল্প নাহয় আরেকদিন বলবো।

না না তা হবে না। তুমি এক্ষুণি বলো আমি শুনবো।

রাহাত হেসে বলল, একসাথে থাকতে থাকতে কিভাবে কিভাবে যেন হয়ে গিয়েছিল ফ্রেন্ডশীপ। আমাদের মাঝখানে যে দেয়াল ছিল তোমার মামণিই একটি একটি করে ইট সরিয়ে নিয়েছিল ধীরে ধীরে। এখনো পর্যন্ত তোমার মামণি আর আমি কিন্তু সত্যিই খুব ভালো বন্ধু। তোমার মামণি নিজের মতো থাকে, খুব মুডি এটা যেমন সত্য, তেমনি আমাদের দুজনের মাঝে অপ্রয়োজনীয় কোন আড়াল বা লুকোচুরিও নেই এটাও সত্য। তোমার মামণি যে আমাকে অনেক ভালোবাসে সেটাও আমি ফিল করি ওর কথা, কাজ, আচরণে। তোমার মামণি আমাকে যত কাছে যাবার সুযোগ দিয়েছে আমি ততই মুগ্ধ হয়েছি ওর সবকিছুতে। বুঝতে পেরেছি মেয়েটা ভালোই একরোখা স্বভাবের, ভীষণ খেয়ালি, নিজের মর্জির মালিক। কিন্তু এইসব কিছু ছাপিয়ে অদ্ভুত সুন্দর একটা মন আছে ওর। যখনই বিয়ে নিয়ে আলোচনা হয়েছে কোন প্রোগ্রামে। ভাইজান শুধু একটা কথাই বলতেন আমাদেরকে, দ্বীনদারী দেখো আর সুন্দর একটা মন দেখো। আর কিছুই দেখো না। ব্যাস দুনিয়াটা জান্নাত হয়ে যাবে তোমাদের। আলহামদুলিল্লাহ আমিও তোমার মামণির মনের ভেতর আমার জান্নাতের সন্ধান পেয়েছিলাম।

আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু ফ্রেন্ডশীপ কিভাবে হয়েছিল সেটা তো বললে না?

রাহাত হেসে বলল, মামণিকে জিজ্ঞেস করো।

না, ধমক দেবে মামণি। তোমাকেই বলতে হবে।

তাহলে চলো তোমাকে একটা দুষ্টু বুদ্ধি দেই। মামণির ডায়েরি কোনভাবে চুরি করা যায় কিনা দেখো। আমারো খুব শখ তোমার মামণির সময়ের ডায়েরি গুলো পড়ার।

কিন্তু মামণির সব ডায়েরি তো পাপার কাছে।

সেজন্যই তো বললাম। তোমার জন্য চুরি করা সহজ।

নাবিহা মুখ কালো করে দুঃখী কন্ঠে বলল, মোটেই সহজ না। ধরা পড়লে পাপা হাত ভেঙে দেবে। পাপা সারাক্ষণ হাসে কিন্তু মামণির চেয়ে অনেক বেশি দুষ্টু ছেলে। আচ্ছা বাবা পাপা ফিরে আসার পর মামণি কি কখনো পাপার কাছে ফিরে যাবার কথা বলেছে?

না তোমার মামণি কখনোই এমন কিছু বলেনি। তবে আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার যাবার সময় এসে গিয়েছে। তোমার মামণিকে যখন একথা বলেছিলাম। তোমার মামণি জবাবে বলেছিল, আই হ্যাভ লস্ট এভরি থিংগ ইন মাই লাইফ, সো আই নো দ্য পেইন অব লুজিং সামওয়ান ইউ লাভ দ্য মোস্ট। তাই যে কষ্টের প্রচন্ডতা আমি জানি, সেই কষ্ট কোনদিন কাউকে আমি দেবো না ইনশাআল্লাহ। তার বদলে যদি আমাকে কষ্টের চোরাবালিতে আকন্ঠ নিমজ্জিতও হয়ে যেতে হয়, তাও না। তাছাড়া আমি তাকদীরে বিশ্বাসী। সুতরাং, আমার সাথে যা কিছু ঘটেছে তা আমি আমার নিয়তি বলে মেনে নিয়েছি। এই মেনে নেয়ার উপর ভিত্তি করেই আমি জীবন সফরে এগিয়ে চলা অব্যহত রাখবো। এবং অদ্ভুত কি জানো? হুবহু এই কথাগুলোই তোমার পাপাও বলেছিলেন আমাকে।

নাবিহা হেসে বলল, নানুমণি বলে, পাপা আর মামণি নাকি সবসময় একই সুরে কথা বলে। জাযাকাল্লাহ বাবা আমাকে এসব কথা বলার জন্য। আমি কি আমার ভাইয়াদের সাথে শেয়ার করতে করতে পারি?

রাহাত হেসে বলল, অবশ্যই পারো। আর কখনো যদি মামণির ডায়েরি চুরি করতে পারো, তাহলে কিন্তু আমার সাথে শেয়ার করতে ভুলবে না।

নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, ডান ডিল। আমি তাহলে এখন যাই। খালামণি, ফুপ্পিদেরকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে মামণির সাথে গল্প করবো। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মামণির কাছে ছুটলো নাবিহা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন