চায়ের কাপ তিনটা কেন?
মামীর প্রশ্ন শুনে নূহা হেসে বলল, কারণ একটু পরই
মামা হাজির হবে ঘুম আসছে না বলে। নয়তো তুমিই বলবে,
যা তো মা তোর
মামাকে গিয়ে ডেকে নিয়ে আয়। একা একা বসে আছে বেচারা।
কে কখন কি বলবে সব তোর মুখস্ত। তাই না?
আলহামদুলিল্লাহ! আমার কাছের মানুষদেরটা মোটামুটি মুখস্ত বলা যায়। কেন জানো? কারণ, আমার কাছে
মানুষগুলোকে বাইরে থেকে যতই প্যাঁচালো মনে হোক না কেন, তাদের ভেতরটা সরলরেখার মতো।
শুধু একজন ছাড়া। যাকে বাইরে থেকে দেখে মনেহয় একদম সরলরেখা। কিন্তু ভেতরে
বক্ররেখার গোলকধাঁধা, প্যাঁচ আর
প্যাঁচ।
কিছু না বলে হাসতে শুরু করলো নূহা।
মিসেস আলিফা বললেন, আর তাকে কিছু
বলতে গেলেই সে তার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হাসির প্রয়োগে বক্তার ভাবনার পথকেই
বদলে দেয়।
নূহা হাসতে হাসতে বলল, প্রাচীন যুগ থেকে
মেয়েদের শক্তিশালী অস্ত্র কান্নাকে বলা হয়েছে। যার দ্বারা তারা যুক্তি মেনেও
তালগাছের মালিকানা তাদেরকে দিতেই বাধ্য করে। নতুন যুগে কেউ যদি নতুন অস্ত্রের
প্রচলন করতে চেষ্টা করে। তাকে উৎসাহিত করা উচিত। এমন তীর্যক খোঁচা মারা উচিত নয়।
তাছাড়া আমার যুক্তি হচ্ছে, কান্নাকাটি করে
অন্যেকে বাধ্য করে কেন কোন কিছু আদায় করবো কিংবা মানাতে যাবো। তারচেয়ে হাসি মুখে
তাকে উৎসাহিত করবো সেই কাজটি করার জন্য। তার সামনে কোন অপশনই রাখবো না সেটা মেনে
নেয়া ছাড়া।
তাহলে আর না প্যাঁচিয়ে বলে ফেল আজ আমার সামনে অপশন ছাড়া কি রাখার পরিকল্পনা
নিয়ে এসেছিস?
নূহা হেসে বলল, পরিকল্পনা ছাড়াই
এসেছিলাম। তবে এখন একটা বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি। মামীমা সাদাতের বিয়ের ব্যাপারটা
নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি। সাদাত যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে সেটা কিন্তু প্রশংসনীয়। অসহায়
একটা মেয়ের পাশে দাঁড়াতে চাইছে। আশ্রয়হীন একজন মানুষের তরে আশ্রয় হতে চাইছে। তাহলে
তুমি কেন আপত্তি করছো?
কেন আপত্তি করছি সেটা সাদাত বলেনি তোকে?
বলেছে। ব্রোকেন ফ্যামেলির কোন মেয়েকে তুমি পুত্রবধূ করতে চাও না। কিন্তু
এটা কি কোন যুক্তি হতে পারে মামীমা? মেয়েটার বাবা-মা’র সংসার ভেঙে গিয়েছে এতে ওর কি দোষ?
দোষের কথা তো আমি কিছু বলিনি। আমি বলেছি সাহায্য করতে চাইলে তো কত ভাবেই
করা যায়। জাওয়াদকে বললেই মেয়েটার ভালো কোন বিয়ে ব্যবস্থা করে দেবে ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু আমি কোন ব্রোকেন ফ্যামেলির মেয়েকে আমার ঘরের বৌ করতে চাই না।
কিন্তু কেন?
কারণ ব্রোকেন ফ্যামেলির মেয়েরা পরিবারের ইউনিটির মূল্য বোঝে না। এরা
সারাক্ষণই পরিবার ভাঙার চিন্তা করে, গড়ার না। কিছু
হলেই এদের মনের মধ্যে ছেড়ে দেয়ার চিন্তা সবার আগে উঁকি দেয়। যেহেতু পরিবারের জন্য
স্যাক্রিফাইস, কম্প্রোমাইজ করার
শিক্ষা এরা পায় না বাবা-মা’র কাছ থেকে। তাই
এরা স্বার্থপর স্বভাবের হয়। নিজেকে ছাড়া আর কারো সুখ-সাচ্ছন্দের কথা ভাবতে পারে
না। এদের জগত হয় আমিময়। আর আমার বাড়িতে আমিময় কারো জন্য জায়গা নেই।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূহা বলল, তোমার কথাগুলো
অনেকাংশেই ঠিক হয়তো। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও তো আছে। মানুষের মধ্যের ভালো ও মন্দ গুণ
পরিবেশ ও পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয় সেটা মানছি। কিন্তু ভালো পরিবেশ থেকেও তো
মন্দ বের হয়। আবার মন্দ থেকেও বেরিয়ে আসে ভালো। ঠিক তেমনি ভালোর সংস্পর্শে মন্দও
বদলে যায়। আমাদের পরিবারে বাইরে থেকে তো আর বৌ এসেছে। তাইয়্যেবার কথাই ধরো।
তাইয়্যেবাও তো ব্রোকেন ফ্যামিলি থেকে এসেছে। তারউপর তাইয়্যেবা ভিন্ন দেশের, ভিন্ন কালচারের মেয়ে ছিল। কিন্তু তাইয়্যেবাকে দেখে কি এখন বোঝার উপায় আছে ও
বাইরে থেকে এসেছে? বরং বাড়ির বৌ আর
মেয়েদের চেয়েও অনেক বেশি দায়িত্বশীল তাইয়্যেবা পরিবারের প্রতিটি ব্যাপারে।
এর সবচেয়ে কারণ আদী। পরিবারের ব্যাপারে আদীর কাছ থেকে কোন রকমের ছাড় পাবার
কোন সম্ভাবনা তাইয়্যেবার ছিল না। তাইয়্যেবার খুব ভালো মতো জানা ছিল পরিবারের খুশির
প্রশ্নে ওকে ছেড়ে দিতে দ্বিতীয়বার চিন্তাও করবে না আদী।
তোমার কথাটা আমি মানতে পারলাম না মামীমা। পরিবারকে মূল্যায়ন করার অর্থ এটা
নয় যে, স্ত্রীর কোন
মূল্য থাকবে না। হ্যা এটা ঠিক যে ভাইয়াদের কাছে পরিবারের ইউনিটির মূল্য সবচেয়ে
বেশি। এবং সেই ইউনিটি রক্ষার্ত্রে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনেও উনারা পূর্ণ সচেতন। আদী
ভাইয়া তাইয়্যেবাকে প্রথমে বুঝিয়ে বলেছে জীবনে পরিবারের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা। পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে বলেছে। শরীয়তের আলোকে সবকিছু
বিবেচনা করার সুযোগ দিয়েছে। এবং পরিবারকে আপন করে নেবার ব্যাপারে তাইয়্যেবাকে
সর্বাত্মক সহায়তা করেছে। আমরা সবাইও তাইয়্যেবাকে নিজ নিজ স্থান থেকে আপন করে
নিয়েছি, ওকেও আপন হতে
সহায়তা করেছি। এভাবেই তো গড়ে ওঠে একটা পরিবার। একে অন্যের সহায়তাতে। তোমার চোখে
সাদাত এখনো অনেক ছোট। তাই হয়তো ভাবছো বিয়ের পর পরিবারের কথা ভুলে গিয়ে বৌয়ের কথাতে
চলতে শুরু করবে। এটা শুধুই তোমার মনের ভয় মামীমা। ছোটবেলা থেকে যে শিক্ষার আলোকে
সাদাত বেড়ে উঠেছে। বাইরের একটা মেয়ের প্রভাবে যদি সেটা বদলে যায়। তাহলে তো বুঝতে
হবে সেই শিক্ষাতেই দুর্বলতা ছিল। কিন্তু যে শিক্ষা তোমরা আমাদেরকে দিয়েছো সেটা তো
এতোটা দুর্বল নয়। আমরা গড়ার দলের মানুষ মামীমা। কোন ঝরে পড়া ফুল যখন আমাদের পাশে
এসে দাঁড়ায়। আমরা তাকে তুলে নিয়ে সযতনে ফুলদানীতে আমাদের পাশে সাজিয়ে নেই। ফুলটি
তখন নতুন চমক নিয়ে আসে ফুলদানীতে। দেখে বোঝার উপায়ই থাকে না সেটি ভিন্ন গোত্রের
কিংবা তার রঙ আলাদা।
হরেক রকমের ফুলের তোড়াতে যদি একটি সুবাসিত ফুল থাকে, তার সুবাসই অনেকসময় যথেষ্ট হয় পুরো তোড়াটিকে সুবাসিত স্বীকৃতি দেবার জন্য।
মিসেস আলিফা আর নূহার মাঝখানে এসে বসতে বসতে বললেন সুহাইব সাহেব।
মিসেস আলিফার চেহারার গাম্ভীর্য আরো এক ধাপ উপরে উঠে গেলেও নূহা হেসে বলল, রাইট মামাজ্বি। আর মামীজ্বি আপনার সুবাসই যথেষ্ট এই ঘরকে সুবাসিত করে রাখার
জন্য। তাই বাইরে থেকে যদি কোন সুবাসহীন ফুল এসেও যায় এতো অস্থির হবার কিছু নেই।
স্ত্রীর দিকে সুহাইব সাহেব বললেন, সাদাতের মুখে
শোনার পর আমি জাওয়াদের সাথেও কথা বলেছি এই ব্যাপারটা নিয়ে। জাওয়াদ মেয়েটার
সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখেছে। দুই বছর আগে মেয়েটার বাবা-মা’র ডিভোর্সের পর থেকে চাচার কাছেই আছে। মেয়েটির চাচা-চাচীও বেশ ভালো মানুষ।
মেয়েটির চাচাতো ভাই সাদাতের ক্লাসমেট ছিল। ক্লাসমেটের কাছে যখন সাদাত মেয়েটির
সম্পর্কে জানতে পেরেছিল এবং শুনেছিল ওকে বিয়ে দিতে চাইছে। তখন সাদাত আমাদেরকে এসে
বলেছে। মেয়েটি ব্রোকেন ফ্যামেলির শুনেই যদি আমরা নেতিবাচক চিন্তা করা শুরু করি।
সেটা মনেহয় ভুলই হবে। অন্তত পক্ষে আমাদের ছেলেটা যাতে আমাদের সিদ্ধান্তে নিরাশ হয়ে
না যায় সেই খেয়ালটা মনেহয় রাখা উচিত। তাই বলছিলাম যে অন্তত একদিন আমরা দুজন নূহা
আর জাওয়াদকে নিয়ে মেয়ের চাচার বাসায় যাই চলো। এরপর যদি তোমার পছন্দ নাহয় তখন
সাদাতও মনে কষ্ট পাবে না। কি মনেহয় তোমার?
মুখে কিছুই না বলে উঠে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলেন মিসেস আলিফা। সুহাইব
সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোর মামীমা আমার
কথা মেনে নেবে বলে কি মনেহয় তোর?
নূহা হেসে বলল, উহু, নেবে না। মামীমা আমার কথাও পাত্তা দেননা। মামীমাকে শুধু একজনই পারবে রাজী
করাতে। উনাকেই বলো কথা বলতে মামীমার সাথে।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে সুহাইব সাহেব বললেন,
মনের ডক্টর আমরা
তাই আমাদের তো অজানা নয় অতীতের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা মানুষের বর্তমানের সিদ্ধান্তকে
কতটা প্রভাবিত করে। তোর মামীমার মা মারা যাবার পর ওর বাবা আবারো বিয়ে করেছিলেন।
সেই মেয়ে ছিল ব্রোকেন ফ্যামিলির। মেয়েটা এসে তছনছ করে দিয়েছিল একটা সুখের সংসার।
নিজের বৃদ্ধ বাবা-মার কাছে চার সন্তানকে রেখে নতুন বৌ নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল আমার
শ্বশুর সাহেব। আলাদা হবার আগে বৌয়ের কথা শুনে নিজের বাবা-মা ও সন্তানদের উপর অনেক
অত্যাচারও করেছেন। আলাদা হয়ে যাবার পরও কোন খোঁজখবর রাখেনি কারো। কিভাবে চার
সন্তান ও বাবা-মা দিনযাপন করছে জানার চেষ্টা করেনি। সাহায্য করা তো দূরের কথা।
অনেক কষ্ট দেখেছে জীবনে তোর মামীমা। যার কারণ হিসেবে বাবার দ্বিতীয় বৌকেই দোষী
পেয়েছে। এজন্যই তো জাওয়াদের দ্বিতীয় বিয়ের বিপক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার কন্ঠস্বর শুরু
থেকেই তোর মামীমারই ছিল।
নূহা হেসে বলল, হুমম! তবে
মামীমাদের সাথে যেটা ঘটেছে তাতে উনার বাবার দোষ ঐ মহিলার চেয়েও বেশি ছিল। উনি মেনে
নিয়েছিলেন বলেই ঐ মহিলা সংসার ভাঙার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু আমাদের সাদাত তো
মাশাআল্লাহ অনেক সমঝদার এসব ব্যাপারে। কিন্তু মামীমাকে একথা বোঝানো এত সহজ হবে না।
আমি সাদাতকে বুঝিয়ে বলবো যেন আপাতত ঐ মেয়ের ব্যাপারে কিছু না বলে মামীমাকে। এই
বিষয়টাকে ঘিরে যাতে মামীমার সাথে অভিমান করেও না থাকে আর। নয়তো মামীমার আবার
মনেহবে আসার আগেই যে মেয়ে আমার আর আমার ছেলের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে দিয়েছে। আসার
পরে না জানি আরো কত কিছু করবে। শুধু শুধু মামীমাকে এখন নেতিবাচক চিন্তার রসদ
সরবরাহ না করাটাই উত্তম। আর তুমি ভাইয়াকে বলো মামীমার সাথে কথা বলতে।
হ্যা সেটাই করতে হবে। এখনই তাহলে ফোন করি জাওয়াদকে।
নূহা উঠে বলল, ঠিকআছে তুমি কথা
বলো। আমিও যাই এখন। মামা-মামীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বের হতে বাগানের দিকে
চোখ পড়তেই সাদাতকে অস্থির ভাবে পায়চারী করছে দেখতে পেলো নূহা। এগিয়ে গিয়ে বলল, কিরে সাদাত তুই এমন কেন করছিস?
নূহাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে সাদাত বলল, কেমন আপা?
এই যে একবার ডানে যাচ্ছিস, আরেকবার বামে
যাচ্ছিস। আবার আগ-পিছ করছিস। দেখে মনেহচ্ছে তোর ব্রেকফেল হয়ে গিয়েছে।
আপা কি যে সব বলো না তুমি! মানুষের আবার ব্রেক আছে নাকি? যাইহোক, তোমার সাথে আমার
কথা ভয়াবহ জরুরি কিছু আছে। আমি কি তোমার বাসায় আসতে পারি কিছুক্ষণের জন্য?
অবশ্যই আসতে পারিস না। আমার বাসায় দুইটা অবিবাহিত কুমারী মেয়ে আছে। এবং
বাসায় কোন পুরুষ নেই। এই মুহুর্তে তোর প্রবেশাধিকার সম্পূর্ন রূপে নিষিদ্ধ।
তুমি থাকলে আবার কোন পুরুষ মানুষের দরকার আছে নাকি?
নূহা হেসে, তোর কথায় যুক্তি
আছে। কিন্তু রুল ইজ রুল। তবে এখানে দাঁড়িয়ে তোর কথা ভয়াবহ জরুরি কথা শুনতে সমস্যা
নেই।
এক মূহুর্ত সময় নিয়ে সাদাত বলল, আপা তোমাকে সেই
কবে থেকে বলছি আমাকে এমন কোন মেডিসিন দাও যাতে
আমার অভিমান করার অভ্যাসটা ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তুমি আমার কথায় কানই দিচ্ছো না।
তুমি সারাক্ষণ সমাজ সেবায় ব্যস্ত থাকে। ঘরের মানুষের জন্য সময়ই নেই তোমার কাছে। আর
শুধু তোমার কাছে কেন? ভাইজান, আদী ভাইয়া তোমরা সবাই শুধু সমাজ সেবার ব্যস্ত। আলো ছড়াচ্ছো জগতময়। অথচ ঘরের
মানুষদের মনগুলো সব অন্ধকারে ডুবে আছে। সেই খেয়াল তোমাদের নেই।
ভাইয়ের কথা শুনে হেসে ফেললো নূহা। হাসতে হাসতে বলল, ওরে বাবা এত্তো অভিযোগ? আচ্ছা বল দেখি কি
হয়েছে তোর শুনি।
তোমাকে তো বলেছিই সামান্য কথাতেই অভিমান হয় আমার। খুব খুব রাগ হয় তখন। এতে
বিঘ্নিত হয় আমার স্বাভাবিক কাজকর্ম। আজ কোন সমাধান না নিয়ে আমি ছাড়ছি না তোমাকে।
ঠিকআছে সমাধান দিয়েই নাহয় যাবো। কিন্তু অভিমান হলে আবার রাগ হবে কেন? অভিমান আর রাগ তো এক জিনিস না। রাগ হচ্ছে একটি নেতিবাচক অনুভূতি আর অভিমান
হচ্ছে অধিকার ও ভালোবাসার সংমিশ্রণের মিশ্র অনুভূতি। যখন কারো আচরণ বা কথা
আমাদেরকে মনকে ব্যথাতুর করে দেয় সেটা হচ্ছে অভিমান। কিন্তু কারো কথা বা আচরণ যখন
মনে বিদ্বেষ ও ঘৃণা তৈরি করে, মন প্রতিশোধ নিতে
চায়। কিংবা তাকে মন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায় সেটা কিন্তু অভিমান না বরং রাগ।
কেননা অভিমানে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে। আর রাগ আছে অহং ও প্রতিহিংসা থেকে।
আরো একটু বুঝিয়ে বলো আপা।
তোর সমস্যার সমাধান দেবার আগে জানতে হবে তোর অভিমানটা কি ধরণের? অভিমানের আসলে অনেক ধরণ। সমাধান দেবার জন্য তাই জানা দরকার অভিমানের উৎস
কোথায়। তোকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন বলে দিচ্ছি। চিন্তা ভাবনা করে জবাব দেবার চেষ্টা
কর। ভেবে দেখ তো কতটা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়ে অভিমান হয় তোর? ধর কাউকে ফোন করেছিস কিন্তু সে কোন কারণে রিসিভ করলো না। কারণ কি হতে পারে
সেই চিন্তা না করেই কি আগে অভিমান দানা বেঁধে উঠে মনে? কিংবা কেউ কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলো না। এর পেছনের কারণ জানার আগেই কি
অভিমান হয়? কারো বলা একটা
শব্দও যদি অপছন্দ হয় তাহলে কি তার প্রতি অভিমান হয়?
হ্যা আমার এমন একটুতেই অভিমান হয়। একটা শব্দ অপছন্দ হলেও আমি কষ্ট পাই।
আচ্ছা অভিমান হলে তোর মনে কি ধরণের চিন্তার উদ্রেক হয়। নেগেটিভ নাকি পজেটিভ? মানে মনে কষ্টের মেঘ জমে নাকি রাগের লাভা তৈরি হয়? কেউ আঘাত করলে কোন স্বত্ত্বাটি আগে নড়ে উঠে?
বেদনার নাকি
যন্ত্রণার? ভেতরটা কি দুমড়ে
মুচড়ে ওঠে নাকি ধিকি ধিকি জ্বালা করে?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাদাত বলল, নেগেটিভ চিন্তাই
বেশি কাজ করে।
কষ্ট পাস নাকি মেজাজ খারাপ হয়? ভেবে জবাব দিতে
হবে।
মেজাজই আসলে খারাপ হয় আমার।
আমিও সেটাই ভাবছিলাম। তুই যাকে অভিমান ভাবছিস সেটা আসলে অভিমান না রাগ। তোর ইগো। আর ইগো বলেই তোর মনে রাগের উদ্রেক হয়, তার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করিস তুই নিজেকে। কোন কোন ক্ষেত্রে
সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলার কথাও ভাবিস।
হ্যা সত্যিই আমার এমনটাই হয়। এত রাগ হয় ইচ্ছে করে আর সম্পর্কই রাখবো না।
জানিস মানুষ কিন্তু সবার উপর অভিমান করে না। খুব কাছের বা প্রিয়জনদের উপরই
অভিমান করে। যাদেরকে সে পছন্দ করে, ভালোবাসে। আর
ভালোবাসার একটা দাবী আছে। সেই দাবী থেকে মানুষ আশা করে যে প্রিয়জন তার অভিমানটা বুঝবে
এবং তাকে মানাতে আসবে। কিন্তু এমনটা যদি না হয় তাহলে মনে কষ্ট তৈরি হওয়া
স্বাভাবিক। ক্রমাগত এমনটা ঘটতে থাকলে কষ্ট একসময় রাগে, রাগ ক্ষোভে এবং ক্ষোভ অহংয়ে পরিবর্তিত হতেই পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষণীয়
হচ্ছে এই অহংয়ের উৎপত্তি অভিমানে। যা অনাদর-অবহেলা-অবমূল্যায়নের বিষ পান করে করে
একসময় বিরক্ত হয়ে রাগ ও ক্ষোভের পথ ধরে অহংয়ের মঞ্জিলে পৌছেছে। তাই বাইরে থেকে
দেখতে একে অহংয়ের মত নাক উঁচু মনে হলেও, সঠিক মূল্যায়ন, একটু আদর ও আহ্লাদ এবং স্বীকৃতি পেলেই বরফের মত গলে যাবে। কিন্তু এর বদলে
যদি অপবাদ কিংবা অপমানের বৃষ্টি ঝরতে থাকে অনবরত। মনের গহীনে তৈরি হয়ে যায় কোন
খরস্রোতা নদী। তাহলে সমাধানটা বেশ জটিল। কেননা তখন আর কোন কিছুই প্রভাব ফেলতে পারে
না মনে। কিন্তু তোর সমস্যা এটা না। পান থেকে চুন খসলেই তোর রাগ হয়। তুই যেটাকে
অভিমান ভাবছিস সেটা আসলে অভিমানরা বরং রাগ। আর রাগ বলেই সেটা তোর স্বাভাবিক
কর্মকান্ডকে ব্যহত করে।
এখন তাহলে আমি কি করবো?
মানুষকে বোঝার চেষ্টা করবি। নিজেকে দিয়ে অন্যকে যাচাই করার চেষ্টা করবি।
মানুষকে বিচার কথা ছেড়ে দিবি। আমরা যখন মানুষকে বিচার করতে শুরু করি, তখন তাকে আর ভালোবাসতে পারি না। কারণ এই পৃথিবীতে কোন মানুষই অন্য কারো মত
না। কেউই দোষ ও গুণের উর্দ্ধে না। কেউই একশো ভাগ তোর মনের মত হবে না। কারোই সব কথা
তোর মনকে ছুঁয়ে যাবে না ভালো লাগার পরশ হয়ে। দেখ প্রত্যেকটা মানুষ চিন্তা করে তার
নিজ নিজ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে। প্রত্যেকে প্রভাবিত হয় নিজ নিজ পরিবেশ-পরিস্থিতি
ও পরিমণ্ডল দ্বারা। সুতরাং, এটা আশা করাও
অন্যায় সবাই তোর মত ভাববে। আমরা সবাই যার যার দৃষ্টিতে জগতকে দেখি। তুই তাই তোর
দৃষ্টিভঙ্গী অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারিস না। শরীয়ত ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে কারো
দিকে আঙ্গুলও তাক করতে পারিস না। আমরা সবাই আলাদা। আমাদের উপলব্ধিও তাই আলাদা। এই
কথাটা মনে রাখলেই যে কোন সম্পর্কের মাঝে জটিলতা অনেক কমে যায়। কিন্তু আমরা সেটা না
করে অন্যের উপর নিজ উপলব্ধি চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করি।
হুমম, তুমি ঠিক বলেছো
আপা।
আরেকটা গুরুত্বপুর্ণ কথা কি জানিস? আমরা যাদেরকে
ভালোবাসি তাদেরকে ঘিরে আমাদের চাহিদাটা উচ্চাশার পর্যায়ে চলে যায়। আমরা তাদের কাছ
থেকে শুধু ইতিবাচক আচরণই প্রত্যাশা করি। কিন্তু এই পৃথিবীতে কারো পক্ষেই সবসময় একই
রকম আচরণ করা সম্ভব নয়। তাই আপনজন, প্রিয় ও পছন্দের
মানুষদেরকে যদি আমরা কিছু কষ্ট দেবার অধিকারও দিয়ে দিতে পারি তাহলেও সম্পর্কের
টানাপোড়ন অনেকটা কমে যেতে পারে।
ভাইজানের একটা কথা তোমার মনেআছে আপা? ভাইজান বলেছিলেন, প্রতিটা মানুষের মধ্যে এক টুকরো করে মেঘ আছে। যে মেঘ কখনো ঝরঝর বারিধারা
হয়ে তোমার মনের বৃক্ষকে সেচ দিয়ে যাবে। আবার কখনো কালবৈশাখী হয়ে ভেঙ্গে দিয়ে যাবে
কিছু ডালপালা।
নূহা হেসে বলল, এই তো আমার ছোট্ট
ভাইটি বুঝতে পেড়েছে। আমাকেও যখন কোন প্রিয়জন কষ্ট দেয় আমি মনে মনে বলি, এত শ্রাবণ দিলো যে আমারে, কিছু ডালপালা
দিলাম তাহারে।
শব্দ করে হেসে ফেললো সাদাত। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, মানুষকে বোঝার জন্য আমাকে কি করতে হবে আপা?
নিজেকে বুঝতে হবে। যখন তুই নিজেকে বুঝতে পারবি তখন অন্যের প্রত্যেকটা কথা ও
আচরণের পেছনে যে কোন না কোন কারণ আছে সেটা অনুধাবন করতে শিখে যাবি।
ঠিকআছে আমি এখন থেকে নিজেকে খুব ভালো মতো বোঝার চেষ্টা শুরু করবো, ইনশাআল্লাহ। তুমি আমাকে সাহায্য করবে তো?
ইনশাআল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবো। এখন তুই যার উপর রাগ করেছিস ও যে কারণে
করেছিস সেটা শান্ত মনে চিন্তা করে দেখ। নিজেকে ঐ অবস্থানে নিয়ে চিন্তা করে দেখতে
চেষ্টা কর। এবং ঐ ব্যক্তির অবস্থানকে অবশ্যই খেয়াল রাখবি। যাচাই যেন নিজের অবস্থান
দিয়ে না হয়। যাচাই হতে হবে সেই ব্যক্তির অবস্থান দিয়ে।
ঠিকআছে আপা। আমি আসলে আম্মুর উপর রাগ করে আছি।
নূহা হেসে বলল, জানি। এই বিষয়ে
আমরা আগামীকাল সকালে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। এখন তোর রুমে যা। এতক্ষণ যা বললাম যেসব
নিয়ে চিন্তাভাবনা কর।
সাদাতকে বাসায়
ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে নূহাও নিজের বাসায় রওনা দিলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন