আমাদের সবচেয়ে বড় অভ্যাস বা বদভ্যাস হচ্ছে আমাদের চিন্তা। যে পর্যন্ত
আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা না বদলায় আমাদের জীবন বদলায় না। তাই কেউ যদি নিজেকে
বদলাতে চায়, সর্বপ্রথম তাকে
তার চিন্তার গতিপথ বদলাতে হবে। চিন্তা যদি গতানুগতিক পথে হাঁটার অভ্যাস ত্যাগ করতে
না পারে, তাহলে নতুন পথ
ধরে চলার সময়ও মন পড়ে থাকে পেছনেই। তাই সর্বপ্রথম তোমাকে তোমার নিজেকে ঘিরে
নেতিবাচক চিন্তার গতিপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আত্নসমালোচনা নয় আত্নপর্যালোচনা
করতে হবে। বুঝতে পেরেছো?
জাওয়াদের বলা কথাগুলো ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও মাথা ঝাঁকিয়ে জ্বি ভাইজান
বললো সাহিল।
জাওয়াদ হেসে বলল, একটি বাণী আছে। “তুমি যা জানো না তা জিজ্ঞেস করে জানো। জিজ্ঞেস করার নিলজ্জতাই প্রমাণ করে
তুমি একদিন বিজ্ঞ ও সম্মানিত হবে”। আসলে কি জানো? কোন কিছু না জানা, না পারা কিংবা না
বোঝা মোটেই দোষের কিছু নয়। কিন্তু কোন কিছু জানতে না চাওয়া, বুঝতে না চাওয়া অবশ্যই দোষের। আর কোন কিছু না বুঝেই বোঝার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান সুস্পষ্ট বোকামী। কারন এরফলে সেই বুঝটাই
বোঝাতে পরিণত হয়ে যায়। যেমন ধরো, এখন যদি আমি বলি
যা বুঝেছো আমাকে বুঝিয়ে বলো। তাহলে কি বোঝার ব্যাপারে সম্মতিটাই তোমার উপর বিশাল
বোঝার মতো চেপে বসবে না?
লজ্জায় আরো সঙ্কুচিত হয়ে সাহিল বলল, জ্বি ভাইজান।
সাহিলের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, কোনকিছু বুঝতে না পারলে জিজ্ঞেস করবে। এখানে ভয় কিংবা লজ্জা পাবার কিছুই
নেই। কারণ তুমি আমার কথা ঠিকমতো বুঝতে পারছো না এটা মোটেও তোমার ঘাটতি নয়। বরং
আমিই হয়তো তোমাকে বোঝানোর ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতিটা বেছে নিতে পারিনি। আসলে আমাদের
সবার বোঝার ক্ষমতা কিংবা পদ্ধতি এক নয়। তাই কিভাবে বললে তুমি সহজে বুঝতে পারো সেটা
তোমাকেই বলে দিতে হবে। তা না হলে তো আমি আমার মত করেই বলবো তাই না?
জ্বি ভাইজান। যে কোন ব্যাপার উদাহরণ দিয়ে বোঝালে আমি দ্রুত বুঝতে পারি।
জাওয়াদ হেসে বলল, ঠিকআছে তাহলে
তোমাকে উদাহরণ দিয়েই বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি।
ছোটবেলা থেকেই জিশান ভীষণ রকম দুষ্টু স্বভাবের। যখন আরো ছোট ছিল মাঝে মাঝে
অতি দুষ্টু কিছু কাজ করতো। আমি যখন জানতে চাইতাম,
কেন তুমি এমন করেছো? জবাবে মিটিমিটি হাসি দিয়ে বলতো, আমি যে খুবই
দুষ্টু একটা ছেলে তাই দুষ্টুমি করেছি। একদিন ওকে কোলে নিয়ে বুঝিয়ে বললাম, বাবাটা শোন তুমি কেমন সেটা আল্লাহর পর তুমিই সবচেয়ে বেশি জানো। সুতরাং, তুমি নিজেই যদি নিজেকে দুষ্টুর সার্টিফিকেট দাও তাহলে মানুষও কিন্তু তোমাকে
ভালো বলবে না কখনো। মানুষ তোমাকে দুষ্টু ছেলে বলবে। তুমি কি চাও সবাই তোমাকে
দুষ্টু ছেলে বলুক? সাথে সাথেই জবাব
দিয়েছিল, না আমি তো এমনটা
চাই না। তখন আমি বলেছিলাম, তাহলে তোমাকে
ভালো কাজ করতে হবে। এবং কখনো যদি দুষ্টু কোন কাজ করে ফেলো সেটা মেনে নিতে হবে এবং শুধরানোর
চেষ্টা করতে হবে। কারণ যারা ভালো হতে চায় তারা সারাক্ষণ, সর্বাবস্থায় সঠিক পথে চলতে পারে না। তারাও মাঝে মাঝে ভুল পথ চলে যায়।
কিন্তু সেটা বুঝতে পারা মাত্রই আবারো সঠিক পথে ফিরে আসে এবং ভুলের জন্য আফসোস না
করে যথাসম্ভব সংশোধনের চেষ্টা করে। এরপর থেকে যখনই জিশান কোন দুষ্টুমি করেছে
স্বীকার নিয়েছে যে, কাজটি ঠিক ছিল
না। এবং পরবর্তীতে এমনটা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোমাকেও এখন ঠিক এমনটাই করতে
হবে। তুমি ফাঁকিবাজ, অলস, রুটিন ফলো করতে পারো না ইত্যাদি চিন্তাকে চিরতরে মন থেকে ছুটি দিয়ে দিতে
হবে। কারণ মানুষ নিজেকে যেমনটা ভাবে তেমনটাই দেখতে পায়। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ
চিন্তার প্রতিচ্ছবি। তাই যদি মনেকরি যে কোন সমস্যা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তাহলে
সমস্যা সত্যিই তাই করবে। আর হারিয়ে দেবার, ভাসিয়ে নিয়ে
যাবার এই ক্ষমতাটা আমরাই সমস্যাকে দেই যখন কোনকিছু কে নিজের দুর্বলতা হিসেবে ধরে
নেই এবং হেরে যাবার ভয়কে মনে স্থান করে নেবার সুযোগ করে দেই সেই মুহুর্তেই। অর্থাৎ, যেই মুহুর্ত থেকে আমরা সমস্যার কাছে হেরে যাবার ভয় করতে শুরু করি, সেই মুহুর্ত থেকে
আমাদের মনোবল কমতে থাকে। তাই আমাদেরকে সবসময় এই কথা ভাবতে হবে যে, যাই ঘটুক না কেন আমরা সামলে নিতে পারবো,
ইনশাআল্লাহ।
এরপরেও যদি হেরে যাই ধরে নিতে হবে, এটাই আমার নিয়তি
এবং এতেই নিহিত আছে যাবতীয় কল্যাণ। মূল কথা হচ্ছে,
মুশকিল তো জীবনে
আসবেই। তাই বুদ্ধিমান হচ্ছে তারা যারা মুশকিল দেখলে ভয় পেয়ে দূরে সরে না গিয়ে, মুশকিলের মোকাবিলা করে এবং তাকে হারিয়ে দেয়। আসলে জীবনের আসা
দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা-বেদনা কিংবা সমস্যাকে আমরা বদলাতে হয়তো পারবো না। কিন্তু এসব যাতে
সহ্য করতে পারি, নিজেকে তেমন
মজবুত করে গড়ার চেষ্টা অন্তত করতেই পারি আমরা।
জ্বি ভাইজান। এখন আমি সত্যি সত্যিই বুঝতে পেরেছি আপনার কথা। নিজের সম্পর্কে
আমার ধারণা সত্যিই অনেক নেতিবাচক। কোন কিছু করার আগেই মনেহয়, এটা মনেহয় আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। আবার কোন কিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখতে
চাইলেও মনেহয়, চাইলেই কি
এতদিনের অভ্যাসকে বদলে ফেলা সম্ভব হবে? এসব চিন্তার
দ্বারা প্রথমেই আমি আমার মনোবলকে দুর্বল করে দেই। যারফলে ব্যর্থতাই আসে আবারো। এবং
নিজের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা আরো দৃঢ় হয় আমার মনে। এখন আমিও বুঝতে পেরেছি, আমাদের সবচেয়ে বড় অভ্যাস বা বদভ্যাস আমাদের চিন্তা। ইনশাআল্লাহ আমি আমার
নেতিবাচক চিন্তার বদভ্যাস থেকে অবশ্যই নিজেকে বের করে আনবো।
জাওয়াদ হেসে বলল, এখন তাহলে তোমার
প্রথম কাজ হবে তোমার চিন্তা-ভাবনার প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা। তখন আর এই
প্রশ্নপত্রের উত্তর খুঁজে পেতে খুব বেশি কষ্ট হবে না তোমার ইনশাআল্লাহ। তারপরও
ছোট্ট একটা টিপস দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। সবার আগে প্রথম প্রশ্নের জবাবটা খুঁজে বের
করার চেষ্টা করো। তাহলে বাদ বাকি সব প্রশ্নের জবাব এমনিতেই পেয়ে যাবে। এখন চলো
নাস্তা করতে যাই আমরা। দেখা যাক মামা আজ নাস্তায় কি আয়োজন করেছেন আমাদের জন্য।
সাহিল হেসে বলল, আব্বু যেদিন
রান্না করে জুম্মি আর আমি ছাড়া ভাইয়ারা সবাই পালিয়ে চলে যায় বাসা থেকে। তাতে অবশ্য
আব্বু কষ্ট পান না। রান্না শেষ খাবার নিয়ে করেই নূহা আপার বাসায় চলে যান। আপা আর
রাহাত ভাইয়ার সেদিন বারোটা বেজে যায়।
আজ আমাদেরও বারোটা বাজবে মনেহচ্ছে। বাসায় কদম রাখার সাথে সাথে খাসীর গোশতের
ভয়াবহ ফ্লেবার স্বাগতম জানিয়েছে। রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো আদী।
সাহিল উঠে সালাম দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আদী জাওয়াদের পাশে
বসতে বসতে বলল, যদি জানা থাকতো
সকালের তাজা খবর হচ্ছে, মামা আজ
বাবুর্চি। আমি এমুখো হতাম না।
জাওয়াদ হেসে বলল, এত সকালে এমুখো
হবার কারণ কি?
তোমার জননী আর আমার জননীর ড্রাইভার হিসেবে এসেছি ভ্রাত। সকালে ঘুম থেকে উঠে
দুই বোন যখন টের পেয়েছেন তাদের আরেক বোন মিসিং। তার সন্ধানে ছুটে এসেছেন এখানে।
ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমোতে যাচ্ছিলাম। দুইজন মিলে কিল-ঘুষি মারতে মারতে নিয়ে এসেছে
আমাকে। বৌ-বাচ্চাদের সামনে মান-সম্মান বলে আর কিছু থাকলো না।
জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, ডিনার কেমন হলো
গতরাতে?
কথা বলতে বলতে ঘুমোবার আয়োজন করে ফেলেছিল আদী। জাওয়াদের প্রশ্ন শুনে কম্বল
দিয়ে মুখ ঢাকতে ঢাকতে বলল, হুবহু ডিনারের
মতো। আপাতত আমার সাথে সওয়াল-জবাব বন্ধ করে মাদার গ্রুপের কাছে যান। সারাপথ দুইজন
চোখ মুছতে মুছতে এসেছেন আপনার স্মরণে।
জাওয়াদ হেসে বলল, তুমি মনেহয় ভুলে
গিয়েছো ভ্রাত। আমাদের মাদার গ্রুপের চোখে লিকেজ আছে। কারণে-অকারণেই তাই চোখ দিয়ে
পানি ঝরতে শুরু করে। তবে আশার কথা হচ্ছে, কিছু একটা বলে
উনাদেরকে রাগিয়ে দিতে পারলেই অটোম্যাটিক লিকেজ বুজে গিয়ে পানি পরা বন্ধ হয়ে যায়।
এবং ভরসার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের
আনন্দবাড়ির মহিলা গ্রুপের সদস্যরা রেগে যাবার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। উনাদের রাগ
করার জন্য পান থেকে চুন খসার প্রয়োজনও পড়ে না। তাই রাগিয়ে দিয়ে মাদার গ্রুপের
চোখের লিকেজ দূর করে দেয়াটা মোটেই কঠিন কিছু নয়। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও ভ্রাত। এই
ডিউটি একান্তই আমার।
হাসতে হাসতে আদী ঘুমের জগতে পাড়ি দেবার উদ্দেশ্যে চোখ বন্ধ করলো। জাওয়াদও
হাসতে হাসতে মাদার গ্রুপের চোখের লিকেজ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
@
নাস্তার পর ফাতিমা ও সাবিরাকে বিদায় জানিয়ে বাগানের এক কোণে বসে গভীর
মনোযোগ সহকারে সাহিলকে পড়তে দেখে নূহা পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, এত মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছে আমার ভাইটা?
সাহিল মুখ তুলে হেসে বলল, জিহাদের কাছ থেকে
তোমার ছোটবেলার ডায়েরিটা ধার করে নিয়ে এসেছি। এত সুন্দর সুন্দর কথা ঐটুকু বয়সে
কিভাবে লিখেছো তুমি আপা?
অনেক সুন্দর সুন্দর কথা নাকি? শোনা তো দেখি
সুন্দর সুন্দর কিছু কথা আমাকে।
“আমাদের মনে আছে
শুভ্র ভালোবাসা! আমাদের প্রাণে আছে শুদ্ধ স্বপ্ন-আশা! দূর করতে বিরাজমান সকল
নিরাশা! আঁকবো মোরা জীবনকে গড়ার পরিভাষা! জীবনের সকল অন্ধকার, অকারণ হতাশা!
জ্ঞানের আলোয় দূর হবে এই মোদের প্রত্যাশা! ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবো মন থেকে প্রাণে!
আনন্দ আর সুখের মেলা বসাবো সুন্দর ভুবনে!” এটা সত্যিই তোমার
বারো বছর বয়সের ডায়েরি আপা?
নূহা হেসে বলল, মাঝে মাঝে যখন
আমার ছোটবেলায় ডায়েরি নিয়ে বসি তখন মনেহয়, অনেক কথাই হয়তো
না বুঝেই লিখেছি। কারণ এত গভীর কথার অন্তর্নিহিত ভাব অতো ছোট বয়সে বোঝাটা যথেষ্ট
কঠিন। তখন মনে প্রশ্ন জাগে আমি কি না বুঝেই লিখতাম এসব কথা? নাকি কেবলই ভাইয়াদের কথা শুনে শুনে লিখতাম?
না সত্যি সত্যিই
কিছু একটা অনুভব করে লিখতাম? কিছুক্ষণ পর
অবশ্য নিজ থেকেই জবাব পেয়ে যাই। সুন্দর পরিবেশের সবচেয়ে বড় কল্যাণময়তা এটাই যে, মানুষ নিজের অজান্তেই সুন্দরের অনুকরণ ও অনুসরণ করতে শিখে যায়। সুন্দরের
পথে চলাটাই তখন ধীরে ধীরে স্বভাবজাত হয়ে যায়। সুন্দরতাকেই জগতের সবচেয়ে সহজ ও
স্বাভাবিক জিনিস মনেহয়। উপলব্ধি বিহীনই সুন্দরকে মনের মাঝে লালন ও তার চর্চা করতে
শুরু করে। মোটকথা সুন্দর পরিবেশের অনিন্দ্যসুন্দর প্রভাব যাকে বলে।
আপা আরেকবার বলো কথাগুলো। আমি নোট করবো।
নূহা হেসে বলল, নোট করত হবে না।
তুই চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেই এমনিতেই লিখতে পারবি ইনশাআল্লাহ। কারণ তুইও সুন্দর পরিবেশের আবর্তে আবর্তিত। জানিস বেশ
কিছুদিন আগে পরিবেশের প্রভাব
থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে যোগ্যতা ও দৃঢ়তা অর্জনের জোর তাদিগ দিচ্ছিলাম
ট্রেনিং সেন্টারের স্টুডেন্টদেরকে। আদী ভাইয়া আমাকে ডেকে বলেছিলেন, এই যোগ্যতা ও দৃঢ়তা অর্জন ওদের লাভ কম আর ক্ষতির কারণ বেশি হবে। কারণ
পরিবেশের মধ্যে বিরাজমান অসংখ্য উত্তম প্রভাবও থাকে। যা ব্যক্তির অজান্তেই তাকে
আরো উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। তাই পরিবেশ থেকে বেঁচে চলার শিক্ষা
দিও না কাউকে। বরং, সুন্দর পরিবেশ
কিভাবে গড়ে তোলা যায় সেই শিক্ষা দাও। কেননা চাইলেও মানুষ পরিবেশের প্রভাব থেকে
সম্পূর্ণ রূপে বেঁচে থাকতে পারবে না। কিন্তু যোগ্যতা ও দৃঢ়তার প্রয়োগে সুন্দর
পরিবেশ গড়ার কর্ণধার না হলেও এক একজন সৈনিক খুব সহজেই হয়ে যেতে পারবে। ভাইয়ার কথা
শুনে আমার বোধদয় হলো, আসলেই চাইলেও
মানুষ পরিবেশের প্রভাব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। তাই হয়তো, অন্যের সমালোচনার স্বভাব বর্ণনা করতে যেয়ে নিজেই যে সমালোচনাকারীতে পরিণত
হয়েছে সেই খেয়ালই থাকে না। কত ছোট থেকে ছোট বিষয়কে মানুষ ইস্যু করে বোঝাতে গিয়ে সে
নিজেও যে মানুষের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয়কে ইস্যু করে বর্ণনা দিচ্ছে সেটা বুঝতে
পারে না। খুব গভীর ভাবে অনুধাবন করলাম, পরিবেশের প্রভাব
থেকে বেঁচে থাকাটা অতিমাত্রায় কঠিন কিছু। আসলে সিস্টেমের মধ্যে থেকে যতই মনে করা
হোক যে সিস্টেমের বাইরে চলছি। মূলত, সিস্টেমেই ঘুরপাক
খেতে হয় নিজের অজান্তেই। তাই পরিবেশের প্রভাব থেকে বেঁচে না চলে, পরিবেশটাকে সুন্দর ভাবে বাঁচার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। আর যে কোন
পরিবর্তনের শুরু নিজেকে দিয়ে করাটাই বুদ্ধিমত্তা। এখন বল কি বুঝলি লেকচার থেকে?
সাহিল হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ
আমাদের চারপাশের পরিবেশ এমনিতেই সুন্দর। নিজেকে পরিবর্তন করা, গড়ে তোলার ব্যাপারে শুধু দৃঢ় ইচ্ছা থাকলেই পরিবেশের প্রভাবেই অনেক দূর
এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে আমার পক্ষে ইনশাআল্লাহ।
যা বোঝাতে চেয়েছি বুঝতে পারার জন্য এই নে চকলেট। এটা তোর পুরষ্কার।
নূহাকে চকলেট খেতে দেখে বেশ অবাক কন্ঠে সাহিল বলল, তুমি চকলেট খাচ্ছো আপা?
নূহা হেসে বলল, আচ্ছা তোর কখনো
এমন হয় যে খুব অপছন্দের কিছু খেতে ইচ্ছে করে? শুধু ইচ্ছে না
একদম ভয়াবহ ইচ্ছে যাকে বলে। অর্থাৎ, ঐ মূহুর্তে সেটা
না খেতে পারলে চলবেই না এমন অনুভূতি তৈরি হয় মনের মাঝে।
সাহিল হেসে বলল, এমন পিকুলিয়ার
ইচ্ছে তোমার মত পিকুলিয়ার মানুষদেরই শুধু হয়। অপছন্দের জিনিসের জন্য হঠাৎ পাগল হয়ে
ওঠা তো স্বাভাবিক হতে পারে না!
নূহা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে মনেহয় আমি
মানুষটা খুব একটা স্বাভাবিক না। কারণ শুধু চকলেটই না মাঝে মাঝে আমার ভীষণ অপছন্দের
কোন মানুষকেও অসম্ভব ভালো লাগতে শুরু করে। এমনটা কবে থেকে শুরু হয়েছে জানিস?
কবে থেকে?
যখন থেকে আমি জেনেছিলাম একজন মানুষকে আমরা শুধু এজন্য পছন্দ করি না যে সেই
মানুষটা আসলেই অনেক ভালো। পছন্দ করার পেছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে সেই মানুষটার মধ্যে
সেই সব বা কিছু গুণ থাকে যা আমাদের পছন্দ থাকে। ঠিক তেমনি একজন মানুষকে অপছন্দ করার
পেছনেও কিছুটা দোষ তার থাকে আর কিছুটা থাকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর। এরপর একটা বই পড়ে
জেনেছিলাম একজন মানুষ যতই খারাপ হোক না কেন তার মাঝে যদি বিন্দু পরিমাণও ভালো কিছু
থাকে সেটাকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। হতে পারে কারো কাছ থেকে পাওয়া এই স্বীকৃতিটুকুই
তাকে খারাপ থেকে ভালো হবার পথে প্রেরণা যোগাবে। আরেকটা বাচ্চাদের গল্পে পড়েছিলাম
যে, একজন ব্যক্তি এমন
একটা দ্বীপে আটকা পড়েছিলেন যেখানে নারকেল ছাড়া আর কোন গাছ ছিল না। নারকেল ছিল তার
সবচেয়ে অপছন্দের খাবার। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য লোকটিকে নারকেলই খেতে হচ্ছিলো।
প্রথমে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু একটা সময় যে যখন উপলব্ধি করলো তার কাছে অন্য কোন
অপশন নেই। তখন সে অনুধাবন করলো যে, কারো কাছে যখন
কোন অপশন থাকে না, সেটাও আসলে একটা
অপশনই। এবং বুঝলো যে, যখন কোন কিছু
মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তখন সেটা খুশি মনে মেনে নেয়াই বুদ্ধিমত্তা। এতে কষ্ট
কম কবে, জীবনযাপন অনেক
সহজ হয়ে যায়।
সাহিল হেসে বলল, ওয়াও আপা!
বাচ্চাদের গল্পের বইতেও এমন সব চমৎকার শিক্ষা থাকে?
শিক্ষা তো সবকিছুর মধ্যেই লুকায়িত থাকে। শুধু সেটাকে খুঁজে ও বুঝে নিতে হয়।
এজন্যই তো পড়ার কোন বিকল্প নেই।
আমিও এখন এটা বুঝতে শুরু করেছি আপা।
আলহামদুলিল্লাহ।কিন্তু শুধু বুঝলেই হবে না। বোঝার সাথে সাথে নিজের দুর্বলতা, ঘাটতি ইত্যাদি মেনেও নিয়ে হবে। সারাক্ষণ অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া চলবে না
মোটেই। মনে করতে হবে না বোঝার কারণে আমার দ্বারা কিছু ভুল হয়ে গিয়েছে। এখন যেহেতু
আমি বুঝি আর ভুল করবো না ইনশাআল্লাহ। আমি নিজেকে ভালো একজন মানুষ হিসেবে গড়ে
তুলবো। পথে বাঁধা আসবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বাঁধার কথা ভেবে দুর্বল না হয়ে বরং
কিভাবে বাঁধাকে মোকাবিলা করা যায় সেই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেবো।
সাহিল হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ আমি
তাই করবো। আপা তুমি আমাকে এখান থেকে শুধুমাত্র প্রথম প্রশ্নটার জবাব বলে দেবে
প্লিজ?
সাহিলের হাত থেকে প্রশ্নপত্রটা নিয়ে দেখার পর নূহা বলল, উহু, বলে দেবো না।
তোকেই খুঁজে বের করতে হবে সব প্রশ্নের জবাব। তবে যদি ভুল হয় তোর কোন জবাব সেটা
অবশ্যই শুধরে দেব ইনশাআল্লাহ। নিজেকে গড়তে হলে আগে নিজেকে জানতে হবে। এবং সেটা জানতে
হবে অন্যের সহায়তা ছাড়াই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে,
শুধু প্রথম
প্রশ্নের জবাব জানতে চাইছিস কেন?
সাহিল হেসে বলল, কারণ ভাইজান
বলেছেন প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা বের করতে পারলেই নাকি বাকি সব প্রশ্নের উত্তর খুব
সহজেই বের করতে পারবো। তুমি যে স্টুডেন্টদের মায়ায় আমাকে তখন তাড়িয়ে দিয়েছিলে। আমি
ভাইজানের কাছে গিয়েছিলাম। ভাইজান আমাকে অনেক সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ভাইজানকে
দেখলে অনেক রাগী, মুডি মনেহয়।
কিন্তু যখন কথা বলেন তখন ভীষণ আপন মনেহয়। মনেহয় সবচেয়ে কাছের কেউ। যিনি আমাকে আমার
মতো করেই বুঝতে পারছেন। অবশ্য আদী ভাইয়া, ফায়েজ ভাইয়া, রিসাব ভাইয়া, হুমায়ূন ভাইয়ার
সাথেও যখন কথা হয়। এমনই ফিল করি। আমরা অনেক লাকি তাই না আপা? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে ভাইয়াদের মতো অসাধারণ একেকজন ভাইয়া
দিয়েছেন।
নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ।
এই ব্যাপারে আমার অনুভূতিও তোর মতোই। জানিস আমি যখনই আমার জীবন জুড়ে ভাইয়াদের
অবদানের কথা ভাবতে চেষ্টা করি। মনেহয়, “ ভাইয়ারা
প্রশান্তিকর ছায়া, ভাইয়ারা মানে
বহতা মায়া! ভাইয়ারাই সবচেয়ে
আপন, গড়েছেন আমাদের
ভুবন! দেখিয়েছে আলোর পথ, হয়েছে চলার পথের রথ! দিয়েছে আকাশের সন্ধান,
শিখিয়েছে উদারতার
গান! দেখিয়ে সুগভীর সমুদ্র, বলেছে প্রাণটা
করো দয়াদ্র! ঐ দেখো পাহাড়ের অনড়তা, নীতিতে অর্জন করো
এমনই দৃঢ়তা! হয়ে ভালোবাসার ঝর্ণাধারা, পাখীর মতো উড়ো
বাঁধনহারা! তোমাদের আছে একবিন্দু করে আলো, আঁধারের বুকে
টিমটিম জ্বলো! দুনিয়ার সবকিছুই পরীক্ষা, করো না কারো
সাহায্যের অপেক্ষা! নিজ করণীয় করে যেও অবিচল, উজ্জ্বল হবে তবেই
ফলাফল! মানুষের তরে রেখো না কভু আশা, লালন করো
স্বাবলম্বী হবার অভিলাষা! তোমরা যে সত্য রাহের পথিক,
ঝড়ের মোকাবিলায়
হতেই হবে নির্ভীক! লক্ষ্য যদি থাকে রব্বের সন্তোষ অর্জন, ফুলেল-সুশোভিত হবে তোমাদের জীবন.. ইনশাআল্লাহ।
সাহিল হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ।
নূহা হাসি মুখে বলল, আমার কাছে
ভাইয়ারা সেই উপলব্ধি হয়ে এসেছিল, যা আমার মধ্যে
সত্যিকার জীবন বোধ জাগিয়েছে। আমাকে অনুভব করিয়েছে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর ও
পবিত্র হচ্ছে, নিঃস্বার্থ
ভালোবাসা। যারা আমাকে শিখিয়েছে বিরাজমান সমস্ত আঁধার ঘুঁচে যাবে যদি সম্মুখে পানে
তোমার এগিয়ে চলা আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের লক্ষ্যে হয়। যারা আমার মধ্যে ইসলামের
জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত করে আমাকে সত্যিকার মুসলিম বানিয়েছে। আমাকে দিয়েছে এক আলোকিত
ভুবনের সন্ধান। যেখানে শুধু সুখ আর প্রাপ্তি, আনন্দ আর হাসি, ভালোবাসা আর প্রশান্তির বসবাস, আলহামদুলিল্লাহ।
ভাইয়াদেরকে ছাড়া আমি তাই আমার জীবনকে কল্পনাও করতে পারিনা! ছোটবেলায় পুতুল খেলার
সাথী যেমন ছিল ভাইয়ারা! জীবনের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পথেও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাথী
হিসেবে ভাইয়াদেরকেই পেয়েছি বারংবার! ভাইয়ারা আমার জীবনে আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ
নেয়ামত সমূহের অন্যতম।
আলহামদুলিল্লাহ আমার জীবনেও। তবে ভাইয়াদের সাথে সাথে তুমিও আমার জীবনে
আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ নেয়ামত সমূহের অন্যতম।
নূহা হেসে বলল, হয়েছে এখন পাকামো ছেড়ে, ডায়েরি রেখে
প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করেন আগে। আমিও যাই মাদার গ্রুপকে একটু জ্বালা-যন্ত্রণা
দিয়ে আসি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন