শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...শেষ পর্ব




এমন আত্মমগ্ন হয়ে কি ভাবছেন?

নদীর পাড়ে বসে মৃদুমন্দ বয়ে চলা জলরাশির দিকে তাকিয়ে ছিল নূহা। স্পর্শ না করেও বহতা নদীর স্রোতের মাঝে এমন ভাবে ডুবে গিয়েছিল টেরই পায়নি কখন জাওয়াদ পাশে এসে বসেছে। প্রশ্ন শুনে জলরাশি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জাওয়াদকে পাশে দেখে হাসি মুখে বলল, কিছু ভাবছি না তো। নদীর বয়ে চলা দেখছি।

নূহার পাশে বসতে বসতে জাওয়াদ বলল, বহতা নদীর এমন দৃশ্য দেখার পরও চুপটি করে বসে থাকার মতো অলস তো আপনার ভাবনা নয়। আমি নিশ্চিত আপনার মন নদীতে ভাবনারাও  ভাসছে শাপলা, পদ্ম রূপে।

নূহা হেসে বলল, তোমার মনেআছে আমাকে একদিন বলেছিলে আমাদের জীবনের জন্য যা কিছু কল্ল্যাণকর, এমন কিছুকে কখনোই চলে যেতে দেয়া উচিত নয়। এমন কিছুকে কখনোই স্ব ইচ্ছেয় ছেড়ে দিতে নেই। এমনটা করলে নিজেকেই ক্ষতির স্বীকার হতে হয়। জীবনের জন্য যা কিছু অকল্ল্যাণকর, তেমন সবকিছু থেকে অবশ্যই নিজেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু শুভ্রিত সুন্দর কিছুকে যদি আদায় করে নিতে হয় কখনোই দ্বিধা করা উচিত নয়। বরং সেজন্য যদি কৌশলী হতে হয়, হওয়া উচিত। নীরবতা যতই পছন্দের হোক না কেন, প্রয়োজনে সরব হতে হয়। যেখানে বলার সেখানে বলতে হয়। আমি জানি তুমি ব্যক্তি জীবনে এই কথাগুলো মেনে চলে এসেছো সবসময়ই। ভবিষতেও হয়তো মেনেই চলবে ইনশাআল্লাহ। তারপরও জানতে ইচ্ছে করছে তোমার সামনে যদি কখনো এমন কন্ডিশন আসে। যেখানে তোমাকে তোমার ব্যক্তি জীবনের সুখ-আনন্দ এবং ফ্যামিলির খুশির মধ্যে যে কোন একটাকে বেছে নিতে হয়। তাহলে তুমি কি করবে?

একটুক্ষণ সময় নিয়ে জাওয়াদ বলল, আমার ব্যক্তিগত সুখ-আনন্দের সাথে যদি সত্যিই কখনো ফ্যামিলির দুঃখ-বেদনা জড়িয়ে যায়। ইনশাআল্লাহ আমি আমার ফ্যামিলির খুশিকে বেছে নেবো। কিন্তু যদি কিছু জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা স্বর্ত্বেও আমার এমনটা মনেহয় যে, আমার আনন্দকে অক্ষুণ্ণ রেখেও আমি ফ্যামিলিকে কষ্ট পাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবো। সেক্ষেত্রে কখনোই নিজের সুখকে ত্যাগ করবো না। কারণ জগতে সবাই সুখী হতে চায়। তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নিজেকে দুঃখে নিমজ্জিত রেখে ক্রমগত অন্যদেরকে সুখী রাখা সম্ভব নয়। গাছের পাতাও তো স্থির হয়ে যায়, বাতাসের প্রবাহ ছাড়া। সেখানে মন কিভাবে সচল থাকবে কিছু প্রাপ্তির স্পর্শ ছাড়া?

হুমম...

হুমম না কারণ বলো।

কিসের কারণ?

আমাকে এমন প্রশ্ন করার কারণ।

নূহা হেসে বলল, এক ক্লাসমেট আজ চলে যাচ্ছিলো তার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে। তাকে তখন ফ্যামিলির ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর থেকে বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে এমন কন্ডিশন কখনো আমার জীবনে এলে আমি কি করবো? আমি কি আমার ভালোবাসা বেছে নেবো নাকি ফ্যামিলি?

কোনটা বেছে নেবে তুমি? হাসি মুখে প্রশ্ন করলো জাওয়াদ।

এতক্ষণ সত্যিই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কারণ আমার ভালোবাসার যে নির্দিষ্ট একটি চেহারা আছে। ভাবতে গেলে যখনই তার চেহারা ভেসে ওঠে। মনেহয় শুধু ফ্যামিলি কেন এই মানুষটির জন্য তো আমি দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে দিতে পারি।

জাওয়াদ হেসে বলল, এতো বিধ্বংসী ভালোবাসা। আল্লাহ রক্ষা করুক সবাইকে এমন ভালোবাসার কবল থেকে।

নূহা হেসে বলল, এজন্যই তো তোমার কাছে জিজ্ঞেস করলাম। গাইড লাইন পেয়েছি। এখন থেকে এভাবেই চিন্তা করবো ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা দুজন মানুষের জীবন যদি কখনো নদীর দুই কূলের মতো হয়ে যায়, তাহলে কি করা উচিত? আইমিন, একই নদীর দুই কূল কিন্তু সর্বদাই বিপরীত দুই দিকে প্রবাহমান। তাদের নাম, পরিচয়, অস্তিত্ব একই কিন্তু দুই কূল কখনোই এক হতে পারে না। অর্থাৎ, নদীর দুই কূল না একে অন্যের থেকে আলাদা হতে পারে, না কখনো একসাথে মিলতে পারে। দুজন মানুষের জীবন যদি এমন হয়? তারা একই ডোরে বাঁধা কিন্তু দুজন দু প্রান্তে। না তারা মিলতে পারছে, না একে অন্যেকে ছেড়ে যেতে পারছে। কি করা উচিত তখন?

তোমার প্রশ্নের মধ্যেই তো উত্তর রয়েছে। একাকার হওয়ার চেয়েও কিন্তু এক হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এই নদীটির কথাই ধরো। নদীর দুই কূলকে কিন্তু কেউই দুই নামে ডাকে না। দুই কূলের দুরুত্ব যতই হোক না কেন, কোনদিন তারা মিলতে নাইবা পারুক। তাতে কিন্তু কিছুই এসে যায় না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যত দুরুত্ব থাক আর যত যাই কিছু হোক না কেন, তাদেরকে কেউই আলাদা করতে পারবে না। একে অন্যের থেকে শত মাইল দূরে থেকেও নদীর দু কূলের নাম, পরিচয়, অস্তিত্ব একই থাকবে। মনে নেই তোমাকে আটলান্টিক মহাসাগর আর ভারত মহাসাগরের মিলনস্থান দেখিয়েছিলাম? একটা স্থানে এসে দুটা সাগর এক হয়ে গিয়েছে কিন্তু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি। পানির রঙ দেখে তাদেরকে আলাদা করা যায় খুব সহজেই। মহাসাগর দুটি পাশাপাশি একে অপরকে ছুঁয়ে থাকার পরেও উভয়ের অস্তিত্ব আলাদা, নাম ও পরিচয় আলাদা। কিন্তু ভারত কিংবা আন্টলান্টিক মহাসাগরের দুই কূলের দুরুত্ব যতই হোক না কেন, তাদের নাম ও পরিচয় কিন্তু একই। মানুষের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই ব্যাপার। মন যদি এক হয়, তাহলে শারীরিক দুরুত্বে কিছুই এসে যায় না।

নূহা হেসে বললেন, বুঝতে পেরেছি। জাযাকাল্লাহ।

কিন্তু আমি মোটেই বুঝতে পারিনি আপনি আজ এই সমস্ত প্রশ্ন কেন করছেন।

নূহা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, জগতের সবকিছু সবাইকে বুঝতেই হবে এমন কোন নিয়ম নেই।

কিন্তু তোমার উদ্ভট প্রশ্ন তো এই সংজ্ঞার আওয়ায় আসবে না। তাছাড়া বৌয়ের মতি গতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখা প্রতিটি সচেতন স্বামীর জন্য অতীব জরুরি। আর যে স্বামীর বৌয়ের মতি এমন ক্ষণে ক্ষণেই গতিপথ বদলায়। তার তো এছাড়া ভিন্ন কোন অপশনই নেই। তা না হলে সুখ পাখী দুঃখের পালক ঝরাতে ঝরাতে উড়াল দেবে।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, ভালো কথা মনে পড়েছে। সকালে বারান্দায় সুখ-দুঃখ নিয়ে কি আলোচনা হচ্ছিলো তোমার আর বাবার মধ্যে? আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুধু সুখ আর দুঃখ শব্দ দুটোই শুনেছি।

ঘুমের মধ্যেও হাজবেন্ড কি বলছে, না বলছে শোনার জন্য আড়ি পাততে হবে? ঘুমের সময় তো অন্তত ছেড়ে দেয়া উচিত একজন মানুষকে।

কখনোই ছাড়বো না। এক মূহুর্তের জন্যও না। সর্বক্ষণ সিন্দাবাদের ভূতের মধ্যে তোমার মনের মধ্যে বসে থাকবো ইনশাআল্লাহ। সুখ দুঃখ নিয়ে কি বলছিলে তাড়াতাড়ি বলো এখন।

জাওয়াদ হেসে বলল, বলছিলাম জীবনের অনেক নিয়মের মধ্যে একটি হচ্ছে, জীবন কখনোই তোমাকে তোমার আকাঙ্ক্ষিত সব খুশি, সব আনন্দ একসাথে দিয়ে দেবে না। সুখের আঁচল ধরে নানান ধরণের দুঃখও হাজির হবে জীবনে। দুনিয়ার এই জগতের ধারাটাই আসলে এমন। আনন্দের কাব্য বুনে শেষ করতে না করতেই বেজে ওঠে বেদনার ডংকা! স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বটের ছায়ায় বসতে না বসতেই ঝরে পড়ে বিবর্ণ পাতা রূপে শংকা! প্রিয়জনদের সংস্পর্শে হেসে উঠে জীবন উল্লাসে, প্রিয় কাউকে হারানোর শূন্যতা পরিণত হয় দীর্ঘশ্বাসে। হঠাৎ জীবন এমন এক মোড় এসে থমকে দাঁড়ায়, মুহূর্তে পাল্টে যায় চলার পথ, পথের গন্তব্য।

হুমম...

তবে কি জানো? কষ্টের মূহুর্তগুলোর মধ্যেও ছোট ছোট আনন্দ লুকায়িত থাকে। সেইসব আনন্দ কিন্তু এমনিতে কারো কাছে ধরা দেয় না। দুঃখের প্রবাহিত স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে চলা সুখগুলোতে আমাদেরকে খুঁজে বের করে তুলে নিয়ে হয়। তুমি আনন্দভুবনের সদস্য। তোমাকে তাই এটা শিখতে হবে।

নূহা বলল, একজন জ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, সময় এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবনের প্রয়োজনে তাই সময়ই মানুষকে সবকিছু শিখিয়ে দেয়। যখন প্রয়োজন হবে আমিও ইনশাআল্লাহ দুঃসময়ের উলু বন থেকে সুখের মুক্তো কুড়িয়ে নেবো। আর যদি কখনো আমি এমনটা করতে ব্যর্থ হই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে পথ দেখানোর জন্য ঠিক ঠিক তোমাকে পাঠিয়ে দেবেন। তুমি নানান ধরণের হুমকি ধামকি দেবে, কড়া কড়া বিষাক্ত কথা শোনাবে। কিন্তু নিঃসন্দেহে মঞ্জিলে পৌঁছানোর আগে কখনোই আমার হাত ছাড়বে না।

নূহার কথা শুনে হেসে ফেলেছিল জাওয়াদ স্বশব্দে। অতীতে বুনা আসা সুন্দর মূহুর্তের মূছর্নায় হাস্যেজ্জল হয়ে উঠেছিল বর্তমানের সময়টুকুনও। সম্মুখে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর জাওয়াদকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অতীতের মনোমুগ্ধকর এমনই কোন এক নদীর পাড়ে। কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে আসা একসাথে অনেকগুলো প্রিয় কন্ঠস্বরের সম্মিলিত গুঞ্জন বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে এলো জাওয়াদ। ঘুরে তাকিয়ে দেখলো ফায়েজ, আদী, রিসাব, হুমায়ূন এবং রাহাত কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে তার দিকেই। হাসি মুখে সবাইকে উদ্দেশ্যে করে সালাম দিলো জাওয়াদ।

সালামের জবাব দিয়ে আদী বলল, সবাই মিলে পিকনিকে আসার লক্ষ্যই ছিল একসাথে কিছুটা সময় কাটানো। আর তুই কিনা সবাইকে ফেলে এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস?

জাওয়াদ হেসে বলল, মাদার গ্রুপের সবাই মিলে চেপে ধরে যে পরিমাণে খাইয়েছে আজকে। ওয়ার্ক আউট করাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। তোরা সবাই গল্প করছিলি তাই কাউকে বিরক্ত না করে একা একাই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু এই জায়গাটায় এসে অজান্তেই থেমে গিয়েছিল কদম।

রিসাব হেসে বলল, জায়গাটার ভয়াবহ সৌন্দর্য নিয়ে কিছুই বলার নেই। কিন্তু আপনার কাছে প্রশ্ন আছে ভাইজান। সত্যি করে বলেন কোন বিশেষত্ব আছে এই জায়গাটার?

জাওয়াদ হেসে বলল, হুমম, আলহামদুলিল্লাহ তা আছে বলা যায়।

তাহলে এখন বিশেষত্ব বর্ণনা করে আমরা যে আপনার বিশেষ মানুষ সেটা প্রমাণিত করুন। দুষ্টুমি আর হাসি মাখা কন্ঠে বললো হুমায়ূন।

জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, এই জায়গাটায় এসে অনেকদিন পর পেছনে ফিরে তাকানোর সাধ জেগেছিল। পেছন দিকের কিছুটা পথ হেঁটে আসার পর নতুন করে পুরোনো একটা উপলব্ধি নাড়া দিয়ে গেলো মনকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমতের ছায়ায় জীবনের এই অব্দি সফর সুখ স্বাচ্ছন্দেই পেরিয়ে এসেছি আমরা। হ্যা ছোট বড় অনেক পরীক্ষা এসেছে জীবনে। কিন্তু সেই প্রতিটা পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হবার ব্যবস্থাও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন করে দিয়েছেন। সম্মুখেও হয়তো আরো পরীক্ষা প্রতীক্ষামাণ আমাদের জন্য। মনে প্রাণে বিশ্বাস করি অতীতের মতো ভবিষ্যতের বাঁধা-বিঘ্ন গুলোও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দূর করে দেবেন। কিন্তু তারপরেও আমাদেরকে প্রস্তুতি তো নিতেই হবে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। জীবনের মূল লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে চলা অব্যহত রাখতে হবে আমাদেরকে সর্বাবস্থাতে। এবং একই শিক্ষা আমাদের সন্তানদেরকেও দিতে হবে। আজকাল মাঝে মাঝে কখনো বাচ্চাদের কথায়, কখনো শব্দ প্রয়োগে, কখনো বা কন্ঠে কিছু কিছু ব্যাপারে অসন্তোষের আভাস অনুভব করি। নিজ অবস্থানে অসন্তোষ ভয়াবহ কোন জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয় মনোজগতের জন্য। তাই কিছুটা শঙ্কা, কিছুটা ভীতি কাজ করছে মনের মাঝে। কেননা নিজ অবস্থানে অসন্তোষ মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিচার-বিবেচনাকে ওয়ান ট্র্যাক করে দেয়। মানুষ তখন জীবনে কি কি পায়নি সেই হিসেবের মাঝে এমন ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, নিজের হাজারো প্রাপ্তি তাদের চোখে পরে না। মনের এই অন্ধত্বকে আমি প্রচন্ডরকম ভয় পাই। আমি চাই না আমার আশেপাশের কেউ এমন আত্মিক অন্ধত্বের শিকার হোক। যারফলে, যে রব্বের অফুরন্ত নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে ভুলে যাবে। কৃতজ্ঞতাকে সমস্ত উত্তম গুণাবলীর মা এর উপাধী দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, আবেগের সাম্রাজ্যকে সঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য রাজমুকুট কৃতজ্ঞতার মাথাতেই তুলে দিতে হবে। তা না হলে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা অবশ্যম্ভাবী।

রাহাত বলল, তারমানে আমাদের সন্তানদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কৃতজ্ঞ বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আরো সচেতন, আরো দৃঢ় এবং আরো কৌশলী হতে হবে আমাদেরকে। এই ব্যাপারে নিশ্চয়ই আপনার কোন পরিকল্পনা আছে ভাইজান?

জাওয়াদ হেসে বলল, এই মূহুর্তে আসলে ঠিক তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। তবে আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞ বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে আমাদের অভিভাবক গণ যেভাবে শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমাদেরকেও সেই পথ ধরেই চলতে হবে। জানো আমার মাঝে মাঝে ভেবে অবাক লাগে যে, আমাদের অভিভাবকগণের তো আমাদের মতো হিউম্যান সাইকোলজি, চাইল্ড সাইকোলজির ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান ছিল না। তারপরেও কি চমৎকার ভাবেই না উনারা আমাদের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ আলোকিত জীবনবোধ, পরিশুদ্ধ দর্শনের জ্ঞান এবং স্বচ্ছ ও সঠিক যুক্তির চমৎকার কম্বিনেশন আমাদের অভিভাবকগণের প্রতিজন। আর এই অনন্য, অনিন্দ্য কম্বিনেশন উনারা অর্জন করে ছিলেন কুরআন-হাদীসের সঠিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে। সুতরাং, আমাদেরকেও তাই করতে হবে।

আদী হেসে বলল, সুখ সম্পর্কে বলা বাপীর কথাগুলো আমার যখনই মনেহয় আরেকবার করে মুগ্ধ হই। এখনো বাপীর কাছে সাইকোলজি এই জগতের সবচেয়ে বোরিং সাবজেক্ট। ত্রিশ বছর আগে হয়তো সাইকোলজির সাথে বাপীর পরিচয় শুধু এই নামে একটা সাবজেক্ট আছে এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কত চমৎকার ভাবেই না বাপী আমাদেরকে সুখ সম্পর্কে বলতে যেয়ে বলেছিলেন, মানুষের সকল অপূর্ণতা, সকল অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তির মূল কারণ চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যের ফারাক। চাওয়া ও পাওয়ার এই বৈষম্যই মানুষকে দুঃখী করে। চাওয়া ও পাওয়ার আসলে একই ধারার প্রবাহিত হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। কারণ মানুষের চাওয়ার কোন সীমা নেই, গন্ডি নেই। মানুষ যত পায় ততই আরো বেশি চায়। কিন্তু মানুষ যদি শুধু তার চাওয়াকে সীমিত রাখতে পারতো তাহলে হতাশা, নিরাশা, দুরাশার ঘেরাটোপে আঁটকে থাকতো না। সুখের জন্য মানুষের এই যে এত আহাজারি, হাহাকার। এই সুখ জিনিসটা তো মূলত মনের ব্যাপার। কেউ যদি মানসিক ভাবে নিজেকে সুখী ভাবে তাহলে জগতের কোন কিছুই তাকে দুঃখী করতে পারে না। আবার জীবনে কিছু অপূর্ণতা কিছু বেদনা থাকার অর্থ কিন্তু এটা নয় যে সেই ব্যক্তি চির দুঃখী। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আলো-অন্ধকার নিয়েই মানুষের জীবন। তাই কোন মানুষ যদি জীবন থেকে সুখ-আনন্দ-হাসিই পেতে চায়। তাহলে বলতে হবে এরচেয়ে নির্বোধ ও অমূলক কোন চাওয়া হতেই পারে না। দিন রাত্রির পালা বদলের মতো সুখ ও দুঃখও পালাক্রমে জীবনে আসবে। আমরা কি কখনো রাতের আঁধারের মধ্যে দিনের আলোর জন্য হা হুতাশ করি? বরং উভয়ের স্বাভাবিকত্বকে মেনে নিয়ে রাতের আঁধার দূরীভূত করার জন্য নিজেরাই কোন একটা ব্যবস্থা করে নেই। এই ক্ষেত্রেও তাই করতে হবে। কষ্টকে রাখতে হবে কষ্টের জায়গায় আর সুখকে সুখের জায়গায়। সুখ-দুঃখ প্রতিদ্বন্দ্বী নয় মোটেও। বরং সহোদর। তাই সংঘর্ষ নয় সুখ ও দুঃখের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলেই সুখকে আর খুঁজে বেড়াতে হবে না। সুখই পায়ে পায়ে ঘুরবে। আসলে সুখী মানুষ হওয়া তো এই জগতের সবচেয়ে সহজ কাজ। তোমাদের যা কিছু আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকাই হচ্ছে সুখে থাকার সবচেয়ে সহজ ফর্মুলা। মানুষ হন্যে হয়ে সুখের পেছনে ছুটে বেড়ায়। অথচ জানেই না সুখ তার হাতের মুঠোতেই বন্দী। যাপিত জীবনের ভাঁজে ভাঁজে খাঁজে খাঁজে ঝাঁকে ঝাঁকে বাস করে সুখ পাখী।

আদীর কথা শুনতে শুনতে হাসি ফুটে উঠলো সবার মুখেই। রিসাব হাসি মুখে বলল, আসলেই কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত ও যথাযথ জ্ঞানই আমাদের বাবাদের ও মায়েদের চিন্তার জগতকে এমন উদার-উন্মুক্ত ও বিশালত্ব দান করেছিল। যারা কুরআন-হাদীস পড়ার সাথে সাথে বোঝার ও উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। তাদের সাইকোলজি, ফিলোসফি আর লজিক রপ্ত করার জন্য বাড়তি কোর্সের কোন দরকার পড়ে না। বড়আব্বুর সেই নসীহার কথা মনেআছে তোমাদের?

ফায়েজ হেসে বলল, হুম, আলহামদুলিল্লাহ। বড়আব্বু বলেছিলেন, থাকে যদি সুখী হবার গরজ, জেনে নাও সুখে থাকা খুবই সহজ। সুখের জন্য করতে হবে না আরাধনা, জানাতেও হবে না বিরাট সংবর্ধনা। যা কিছু আছে তোমার তাতেই খুঁজে নিলে সন্তুষ্টি, ইনশাআল্লাহ বারো মাসই ঝরবে সুখ নামক বৃষ্টি। শুধু যদি থাকে উপলব্ধি সুখ হাতছানি মিলবে মায়ের হাসিতে, বাবার পরামর্শে! দেখতে পাবে বোনের দুষ্টুমিতে লুকানো সুখ, সুখ ভাইয়ের সাহচর্যে, বন্ধুর পাশে থাকার মাঝেও সুখ! সুখ ভাসে ঝকঝকে নীলাকাশে, সূর্যের ঘুমে সুখ, চাঁদের প্রকাশে! নক্ষত্রের আকাশে জ্বলজ্বল করে সুখ,  মেঘের বুক থেকে বৃষ্টি রুপে ঝরে সুখ! সুখ জোনাকির টিমটিমে আলোতে, পথের কোণে ফুটে থাকা ছোট্ট ঘাসফুলেও সুখ! বাবার হাত ধরে আঁকাবাঁকা পা ফেলে হেঁটে চলা শিশুর উচ্ছ্বাসে সুখ! পরস্পরকে অবলম্বন করে সম্মুখে ধাবমান প্রবীণ দম্পতির নির্ভরতায় সুখ! বাতাসে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে সুখ! বুকের ভেতর ভালোবাসার অস্তিত্বে সুখ! সুখ অভিমানে, অনুরাগে, খুনসুটি ও ত্যাগেও! বিশ্বাসে সুখ, ভরসায় সুখ, আশাতে সুখ, সুখ কিছু কিছু অপূর্ণতাতেও! জয়ে যেমন আছে সুখ, ব্যর্থতাতেও আছে সুখ নব প্রচেষ্টার। জগতের সর্বত্র ছড়ানো সুখের মেলা, তবে কেন কাটাবো  দুঃখবিলাসীতায় বেলা? কেঁদে ভাসাই সুখ বিহনে নিঃসঙ্গ একাকী, কারণ আমাদের জানাই নেই সুখ আসলে কি?

জাওয়াদ হেসে বলল, কিন্তু আমরা জানি সুখ আসলে কি! আমরা জানি কিভাবে সুখী হতে হয় আলহামদুলিল্লাহ। জানিস এই জগতে কিছু কিছু মানুষ আছেন, নতুন প্রজন্ম যাদের মাঝে  ভালোবাসার প্রকৃত সংজ্ঞা খুঁজে পায়! যারা সত্য ও সুন্দরের সমস্ত রুদ্ধ দ্বারগুলো এক এক করে উন্মুক্ত করেন তাদের পরিশুদ্ধ চিন্তার দমকা হাওয়ায়। যাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় এক একটি অনবদ্য গল্প। যাদেরকে দেখে শিল্পীরাও শিখে নেয় শিল্পের নব নব কলাকৌশল! স্বপ্নচারীরা যাদের  মাঝে সন্ধান পায় কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন রাজ্যের। আমাদের অভিভাবকগণের প্রত্যেকজন ঠিক তেমন একজন মানুষ আলহামদুলিল্লাহ। চিন্তা ও কর্মে উনারা সবার চেয়ে এগিয়ে। জীবনের দূর্যোগের অঝোর শ্রাবণধারায় এমন মানুষগুলো এক মুঠো রোদ হয়ে উঁকি দিয়ে যায় বলেই আকাশ জোড়া আশার  রঙধনু ওঠে। জীবনকে এমন মানুষেরা শুধুই যাপন করতে নারাজ। অনুভব করতে চায় সময়ের প্রতিটি মূহুর্তকে। তাই জীবনের রূপ সরল হোক কিংবা জটিল, তারা দু’বাহু উন্মুক্ত করে জীবনকে বোঝার চেষ্টা করে পরিপূর্ণভাবে। অনেকসময় হয়তো দেখে মনেহয় ভীষণ আত্মভোলা এই মানুষগুলো। কিন্তু চারপাশে কি ঘটছে, কেন ঘটছে সেসব ঠিকই ধরা পড়ে যায় তাদের মনের রাডারে। আর এমন মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, জ্ঞানের উত্তাপে মোমের মতো গলে যান। তাদের জ্ঞান যেমন আলো হয়ে জ্বলতে পারে, তেমনি অথৈ পানির বুকে ভাসতে পারে। আবার  প্রয়োজনে সীলগালার কাজও করতে পারে। আরো পারে সূচালো, ধারালো এই পাথরের পৃথিবী থেকে সুখের ছোট্ট ছোট্ট নুড়ি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে নিজেরা সুখী হতে এবং অন্যদেকে সুখী করতে। আমাদের সবাইকে উনাদের মতো হতে হবে। রাহবার হয়ে পথ প্রদর্শন করে গিয়ে উনাদের দায়িত্ব উনারা পালন করে গিয়েছেন। এখন সেই আলোকিত পথ ধরে এগিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের। তাহলে ইনশাআল্লাহ এই পথ ধরে আমাদের সন্তানরাও হাঁটবে তাদের সন্তানদের হাত ধরে।

আবারো সম্মিলিত হাসির রেখে ফুটে উঠলো সবার চেহারাতে। তবে সেই হাসিতে ছিল আশা জাগানিয়া দখীনা পবনের পরশে মনের স্বপ্নীল বাতায়নের কপাট উন্মুক্ত হবার পরিতৃপ্তি। দুনিয়াবী গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে খেতে হঠাৎ সম্মুখে সত্যের আঙিনাকে উদ্ভাসিত হতে দেখার স্বস্থি। অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে ছোট্ট ছোট্ট আলোকধারী জোনাক জোনাক মানুষদের জীবনের মূল গন্তব্য হাসিলের উদ্দেশ্যে নিভৃত স্বপ্নচারী হবার প্রত্যাশা......


খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...৩০



গাছের নীচে গোল হয়ে বসে অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখা ছোট বোনদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই হাসি ফুটে উঠলো নূহার চেহারাতে। ট্রেতে থাকা শেষ কফির মগটি নিজের জন্য তুলে নিয়ে বোনদের  কাছে রওনা হলো। সকালে যখন হঠাৎ করেই পরিবারের সবাই মিলে বনভোজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নায়লা, জুয়াইরিয়া, জুম্মি, জুনি ওরাই সবচেয়ে বেশি খুশি ছিল। সবাই মিলে কোন পিকনিক স্পটে যাওয়া হবে সেটা নিয়ে প্ল্যান প্রোগ্রাম করতে বসে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেদের পছন্দের স্থান নির্বাচন করে জানিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সময়ের সল্পতা ছিল এবং ওদের পছন্দের স্পটটি বেশ দূরে ছিল, যাওয়া আসা মিলিয়ে অনেক সময় লেগে যাতো। তাই সময়, দুরুত্ব অন্যান্য সবকিছু বিবেচনা করে বাড়ি কাছাকাছি একটি জায়গাতেই আসা হয়েছে সবাই মিলে। পরিবারের বড়দের এই সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি হতে পারেনি জুম্মি আর তার গ্রুপ। সবাই মিলে নূহাকে এসে ধরেছিল যেন তাদের পছন্দের ব্যাপারে সুপারিশ করে। কিন্তু নিজেও সময়ের সল্পতার স্বীকার থাকার কারণে উল্টো ওদেরকেই বোঝানোর চেষ্টা করেছিল নূহা। বলেছিল, কোথায় যাওয়া হচ্ছে এটা তো কোন ম্যাটার না। ম্যাটার হচ্ছে পরিবারের সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়াটা। যখন আপনজনেরা কাছে থাকেন, পাশে থাকেন তখন তো যে কোন স্থানই আনন্দভূমি। ব্যাস তাতেই হয়েছে এই হাল, অভিমানে বোনেদের ফুলেছে গাল। ওদের ইচ্ছে, চাওয়া, খুশির কোন মূল্য নেই পরিবারের বড়দের কাছে, সারাটা জীবন শুধু উনাদের মরজিই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ইত্যাদি নানান কথা বললো কিছুক্ষণ সবাই মিলে। এরপর থেকে ছয়জন এক জোট হয়ে ঘুরছে ফিরছে। বনভোজনের স্থানে আসার পর থেকেও যে ছয়জন সবার থেকে দূরে দূরে ঘুরছে সেটা খেয়াল করেছে নূহা। কিন্তু এতক্ষণ বাচ্চাদের সাথে ব্যস্ত থাকার কারণে বোনদের কাছে আসতে পারেনি।  একদম বোনদের মাঝখানে যেয়ে বসতে বসতে নূহা বলল, তোদের কেউ কি কফি পানে আগ্রহী?

জুয়াইরিয়া বলল, আগ্রহী হলেই বা কি? আমাদের ইচ্ছে, আগ্রহের কি কোন মূল্য আছে?

নূহা হেসে বলল, মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা কি জানিস?

নায়লা বলল, আমরা জানতে চাই না।

হ্যা হ্যা একদম জানতে চাই না। তা না হলে মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা জানানোর সুযোগে তুমি আমাদের পটিয়ে ফেলবে। আজ আমরা কিছুতেই তোমার কথার ফাঁদে পড়ছি না। উহু, কিছুতেই না। দৃঢ় কন্ঠে বলল জুনি।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, ঠিকআছে তাহলে মানুষের কথা বাদ। চল আমরা সবাই মিলে গল্প করি। অনেকদিন তোদের হালচাল জানা হয়নি। তোদেরকে বলার মতো কত কথা ফুটেছে বন বাগিচায়। চল আজ এই সুযোগটাকে কাজে লাগাই। আমাদের লাস্ট বৈঠক তিনমাস আগে হয়েছিল। তিনমাস আগের একটা মজার ঘটনা শেয়ার করবো?

ফোলানো গালের সাথে সাথে ভ্রূও খানিকটা কুঁচকে বোনেরা সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেবার পর  নূহা হেসে বলল, তিনমাস আগে আমার পুরোনো বাসা ছেড়ে বড়মামার বাড়িতে উঠেছি সেটা তো তোরা জানিসই। যেদিন বাসা বদলানো নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল সেদিন কি অনুভব করেছিলাম জানিস?

কি অনুভব করেছিলে? মুখ ভার করেই প্রশ্ন করলো নায়লা।

অনুভব করেছিলাম ঐ সময় যে বাসাটায় ছিলাম সেটা আমার কতটা পছন্দের। পছন্দ করার  অবশ্য অনেকগুলো কারণও ছিল। তোরা তো দেখেছিসই গেট দিয়ে ঢুকতেই ফুল আর পাতাবাহারের কি সুন্দর বাগান ছিল। এছাড়া খোলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখা যেতো সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়, তারাভরা আকাশ, জোছনার আলোতে ভেসে যাওয়া প্রকৃতি। আবার সামনেই ছিল বিশাল পার্ক তাই সবুজের সমারোহ, আর ছিল ভীষণ সুন্দর ছাদ। এদিককার বাড়িগুলো তৈরিই হয় এমনভাবে যে ছাদে উঠার  সুযোগ বেশ কম থাকে। তাই ছাদ আছে এমন বাড়ি পাওয়া সত্যিই অনেক আনন্দের। এই আনন্দ ও ভালোলাগা গুলো সবসময় অনুভব করলেও যখন জানলাম বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে অনুভবের মাত্রা বেড়ে গেলো। অবশ্য মানুষের স্বভাবটাই মনেহয় এমন। যখন কোনকিছু হারিয়ে ফেলে বা ফেলতে যায় কিংবা নিজের না জানে তখন সেটার প্রতি টান বেড়ে যায়। বেশ মন খারাপ নিয়েই গোছগাছ করলাম সবকিছু। কিন্তু জারিফকে দেখলাম ঘুরে ঘুরে সব রুমকে বিদায় জানাচ্ছে। এমনকি রান্নাঘর ও বাথরুমের কাছ থেকেও বিদায় নিলো। ওর কান্ড দেখে মজা পেয়েছিলাম খুব। সাথে সাথে অনুভবও করেছিলাম শিশুরা মনের ভেতরের অবস্থা কত সহজে প্রকাশ করে ফেলতে পারে। রাখ ঢাক করতে জানে না বলেই শিশুদের মধ্যে কোন ভাণ নেই। আমারো কষ্ট হচ্ছিলো, মনখারাপ লাগছিল কিন্তু পারিনি পুত্রের মত করে সেটা প্রকাশ করতে। আবার নতুন বাসায় যেদিন উঠলাম জারিফের সেকি খুশি। আগের বাসায় চেয়ে অনেক বড় রুম পেয়েছে নিজের জন্য। দু’হাত বাড়িয়ে মহা আনন্দে আলিঙ্গন করে নিলো নতুন বাসাকে। নিজের রুম নিজেই গোছাতে লেগে গেলো।

জুনি হাসতে হাসতে বলল, নতুন বাসায় ঢুকেই জারিফ সব রুমে রুমে ঘুরে যখন ফেরেশতাদের সালাম দিচ্ছিলো তখন আমিও ছিলাম সাথে। ওর সাথে সাথে আমিও সালাম দিয়েছি।

সবাই হেসে ফেললে নূহাও হেসে বলল, আমি কিন্তু প্রথমে কিছুতেই জারিফের মত আপন করে নিতে  পারছিলাম না নতুন বাসাটাকে। রান্নাঘরে ঢুকেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনের পর্দায় ভেসে উঠলো আগের বাসায় সেই রান্নাঘরের ছবি। বেশ মনখারাপ নিয়েই নতুন বাসা সাজানো গোছানোর কাজ শুরু করলাম। একবার মনেহলো বাসাটা না বদলালেই ভালো হতো। মেঘাচ্ছন্ন মন নিয়েই ঘুমোতে গেলাম। পরদিন ভোরে চোখ খুলেই দেখি দূরে কি যেন একটা মিটমিট করছে। প্রথমে ভেবেছিলাম প্রভাতের তারা, পরে বুঝলাম যে আকাশের বুকে চলমান বিমানের আলো। বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিলাম বহুদিন পরে। আগের বাসায় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যেত কিন্তু বিছানায় শুয়ে এমন আকাশ দেখা যেত না। তখন হঠাৎ মনেহলো প্রতিটি জায়গা, জিনিস কিংবা মানুষের সৌন্দর্য আসলে আলাদা আলাদা। আমরা বেশির ভাগ সময়ই সৌন্দর্যের সেই বৈচিত্র্যতা খুঁজে নিতে পারিনা বা চেষ্টা করি না। কখনো ইচ্ছে তো কখনো খেয়ালের অভাবে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই হারিয়ে ফেলা কিছুর শোকে বর্তমান পাওয়াটাকে মূল্যায়ন করতে পারিনা। আর দৃষ্টি পেছনে থাকলে সামনের কিছু দেখা যাবে না এটাই তো স্বাভাবিক। সামনের প্রাপ্তি যেমন দেখা যাবে না, খাদা-খন্দও দেখা যাবে না। দৃষ্টি পেছনে রেখে পথ চলার কারণে সামনে থাকা পাথরের সাথে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পরে আমরা আহাজারি করতে থাকি "আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম"! অর্থাৎ, নিজের ভুল বা অসতর্কতার দোষ দেই ভাগ্যকে। আমরা মানুষেরা আসলেই বড় অকৃতজ্ঞ আর বেখেয়ালি। আবারো অনুভব করলাম প্রতিটা জিনিসের মাঝেই আছে কল্যান। শুধু তার রকম ও ধরণ আলাদা আলাদা। তাই মানুষ হোক আর জিনিস সবসময় খেয়াল রাখা উচিত কখনই তুলনা করা চলবে বা একটার সাথে আরেকটার। শুধুমাত্র তাহলেই হয়তো উপভোগ করা সম্ভব হয় জীবনের রঙ বদলের খেলা ও বৈচিত্র্যতাকে।

জুম্মি বলল, আমরা জানতাম তো তুমি এমন কিছুই বলবে আমাদেরকে। এজন্যই তো তোমার কথা শুনতে রাজী হইনি। এখন যেমন অপরাধী মনেহচ্ছে নিজেদেরকে।

নূহা হেসে বলল, আমি কিন্তু মোটেই তোদেরকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইনি। আমি শুধু এটা বোঝাতে চেয়েছি জীবন যখন যেভাবে আমাদের সামনে আসে সেভাবেই তাকে আপন করে নেয়া উচিত। চাওয়া পাওয়ার দ্বন্দ্ব আমাদের মনের শান্তি কখনোই বিনষ্ট করতে পারতো না, যদি আমরা যা পাচ্ছি সেটাকে মূল্যায়ন করতে পারতাম। মনের অভিমান একপাশে রেখে চিন্তা করে দেখ আজকের এই বনভোজন কি আমাদের জন্য অপ্রত্যাশিত একটি প্রাপ্তি নয়? প্রচন্ড ব্যস্ততা স্বর্ত্বেও ভাইয়ারা আমাদের সাথে বনভোজনে আসার জন্য রাজী হয়েছেন। কারণ উনাদের কাছে নিজেদের শত ব্যস্ততার চেয়েও আমাদের ইচ্ছে, খুশির প্রায়োরিটি বেশি। তাই আমাদেরও তো উচিত উনাদের সুবিধার দিকে খেয়াল রাখা। তাই না? এভাবেই তো পরিবারের সদস্যদের একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা, ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। বন্ধন দৃঢ় হয়।

জুয়াইরিয়া বলল, আমরা বুঝতে পেরেছি আপ্পা। ভালো মতো না বুঝেই এমন বোকামী সুলভ অভিমানের জন্য আমরা খুবই লজ্জিত।

নূহা হেসে বলল, শুধু লজ্জিতই না আপনারা অনেক আনন্দ থেকেও নিজেদেরকে করেছেন বঞ্চিত। বাবা, বাপী, ভাইয়াদের কত অসাধারণ সব জ্ঞানগর্ভ কথা, দিকনির্দেশনা মিস করেছেন সেই হিসাব দিয়ে আপনাদেরকে এখন আর কাঁদাতে চাই না। তারচেয়ে পরামর্শ দিচ্ছি আর সময় নষ্ট না করে ছুট লাগান। এখনো আলোচনা চলছে নদীর পাড়ে।

নূহা কথা শেষ করার আগেই ছয়জন উঠে ছুট লাগালো। নিজ নিজ জীবন ভান্ডারের জন্য অমূল্য মণিমুক্তো সংগ্রহের লক্ষ্যে ছুটন্ত বোনদের দেখে প্রশান্তিকর হাসি ফুটে উঠলো নূহার মুখে। কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের উদ্দেশ্যে গাছে হেলান দিয়ে বসলো। তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে নানান ধরণের পাতাবাহারের ঝোপের একপাশে বইয়ের খুলে ইয়াসকে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো নূহা। যে ছেলেকে না বকে বই নিয়ে বসানো যায় না। সে কেন ঘুরতে এসে বই নিয়ে বসে আছে এই রহস্য উদঘাটনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে উঠে দাঁড়ালো নূহা। ইয়াসের কাছে পৌঁছে বলল, আমার ছোট্ট ভাইটি যে এত বড় পড়াকু সেটা তো এতদিন আমার জানাই ছিল না।  

নূহার কথা শুনে বই থেকে মুখ তুলে হেসে ফেললো ইয়াস। বই বন্ধ করে বলল, আগামীকাল আমার  ক্লাসটেস্ট আছে আপ্পা। আজ যে পিকনিকে আসা হবে সেটা তো আগে জানা ছিল না। পরীক্ষার আগেরদিন পড়া রেডি করবো ভেবে এতদিন কিছুই পড়িনি। এখন তাই অনিচ্ছা স্বর্ত্বেও আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে পড়তে হচ্ছে।

ছোট ভাইয়ের পাশে বসে হাসি মুখে নূহা বলল, এমনই হয় আসলে আমরা আজকের কাজ আগামীকালের ভয়সায় ফেলে রাখি। অথচ আগামীকাল আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাও আমাদের নেই। আগামীকাল তো অনেক পরের কথা একটু পর কি ঘটতে যাচ্ছে সেটাও তো আমাদের অজানা। ভেবে দেখ সকালে নাস্তার সময়ও কি আমাদের কারো জানা ছিল আজ পরিবারের সবাই মিলে বনভোজনে আসবো?

আই এম সরি আপ্পা।

নূহা হেসে বলল, আমি কিন্তু মোটেই তোকে দুঃখিত করতে চাইনি। শুধু এইটুকু বোঝাতে চাইছি যে আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকা উচিত প্রতিদিনের সমস্ত কাজ প্রতিদিন সেরে ফেলার। আগামী দিনের জন্য আলসেমি করে, গাফলতি করে কাজ জমিয়ে না রাখা। কারণ আগামীকাল আমাদের জীবনে আসবে কিনা সেটাও তো অনিশ্চিত তাই না?

জ্বি আপ্পা।

একটুক্ষণ চুপ থেকে নূহা হেসে বলল, চল তোকে মজার একটা ঘটনা বলি।  দেখছিস ই তো গত কয়েকদিন থেকে আমাদের ওদিকটায় কেমন রোদ ঝলমলে আলোকোজ্জ্বল দিন। বেশ গরমও পড়ে  গিয়েছে। তাই সামারের কাপড়-চোপড় নামিয়ে ধুয়ে ছাদে নেড়ে দিয়ে এসেছিলাম গতপরশু সকালে।  বিকেল বেলা ছাদে গিয়ে কাপড় আনার কথা মনে হতেই একরাশ আলসেমি এসে মনে জড়ো হলো। ছাদে যাওয়া, ভাঁজ করে কাপড় তোলা, বাসায় আসা, আবার সবকিছু জায়গামত গুছিয়ে রাখা! নাহ! অনেক অনেক কাজ মনেহলো। ভাবলাম থাক আগামীকাল নামাবো ছাদ থেকে কাপড়-চোপড়। কিন্তু   রাতের বেলা রাহাতকে দেখলাম ছাতা হাতে বাসায় ঢুকছে। জানতে চাইলাম, বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে? রাহাত  জবাবে বললো, হ্যা বেশ বৃষ্টি বাইরে। জারিফ তখন উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে জানালো, মা   আগামীকাল সারাদিন বৃষ্টি। শুধু বৃষ্টি না বিজলি চমকে চমকে বৃষ্টি।

ইয়াস হেসে বলল, তুমিও তাহলে এমন কান্ড করো।

নূহা হেসে বলল, ভুল করি বলেই তো আমার অভিজ্ঞতার ভান্ডায় সংশোধনের খাজানাতে পরিণত হয়েছে। দেখিস না তোদের প্রায় সব ভুলের ব্যাপারেই লেকচার রেডি থাকে আমার কাছে। এইসবই আমার ভুলের সাধনা আলহামদুলিল্লাহ। তবে আমি কিন্তু কখনোই ভুলের জন্য আফসোস করিনা। চেষ্টা করি ভুলটাকে যতটা সম্ভব শুধরে নেবার। অবশ্য কেন ভুলটা হলো সেই বিষয়ে আবার অনেক চিন্তাভাবনা করি। যেমন পরশুরাতে মনের মধ্যে শুধু খচখচ মধ্যে করছে। কেন একটু  জোর করে গেলাম না ছাদে? তাহলেই তো শুকনো কাপড় গুলো ভিজতো না! কেন মনের অলস  ইচ্ছের কাছে নিজেকে সপে দিলাম? কেন আগামীকালের চিন্তা করে নিশ্চিন্তে বসে রইলাম? আগামীকাল কি হবে বা কি অপেক্ষা করছে সেটা তো অজানা! তাহলে কেন আগামীকালের ভরসায় আজকের করণীয়তে অবহেলা করলাম? তারপর মনেহলো আজকাল খুব করছি এই কাজটা আমি। এখন ইচ্ছে করছে না, থাক পরে করবো, আগামীকাল করবো ভেবে কাজ ফেলে রাখছি ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু ভবিষ্যতে যে কাজটি আমি করতে পারবো, যেভাবে ভেবে রাখছি সবকিছুই সেভাবে হবে সেই নিশ্চয়তা কোথায় পেলাম আমি??? একথা তো আমার অজানা নয় যে জীবনের কিছুই স্থায়ী নয়। যে কোন মুহুর্তে বদলে যেতে পারে জীবনের রুপ। তাহলে কেন এই অস্থায়ী এবং পর্যায়ক্রমে আবর্তিত ও পরিবর্তিত জীবনে আগামী কালকের জন্য তুলে রাখি নিজের কাজ? কেন ভুলে যাই যে আগামী কাল তো আমার জীবনে নাও আসতে পারে! কিংবা আগামী হয়তো নতুন কাজ ও দায়িত্বের বোঝা নিয়ে হাজির হবে আমার কাছে। তখন আমি নতুন কাজ করবো নাকি জমিয়ে রাখা পুরনো কাজ?! এই সম্পর্কিত রাসূল (সঃ) এর একটি হাদীস আছে। “রাসূল(সাঃ) বলেছেন, পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দেবে। এক. বার্ধক্য আসার আগে যৌবনকে। দুই. অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে। তিন. দারিদ্র আসার আগে সচ্ছলতাকে। চার. ব্যস্ত হয়ে পড়ার আগে অবসর সময়কে। এবং পাঁচ. মৃত্যু আসার আগে জীবনকে”। ভেবে আমরা মুসলিমরা কতটা সৌভাগ্যবান। আমাদের করণীয়-বর্জনীয় সব সবকিছুই বলে দেয়া আছে কুরআন ও হাদিসে। কিন্তু তবুও আমরা ভেসে চলছি নফসের স্রোতে। অবহেলা করছি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে।

হ্যা আপ্পা। ইনশাআল্লাহ আজ থেকেই আমি এই ব্যাপারে সতর্ক থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।

নূহা হেসে বলল, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তোর ইচ্ছে দৃঢ় করে দিন এই দোয়া করি। আচ্ছা আর বিরক্ত না করি তোকে। মন নিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নে। আমি দেখি ফ্যামিলি কি করছে। ইয়াসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নদীর পাড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলো নূহা।

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৯



ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনের মিক্সড ফ্রুট স্যালাডটা ভীষণ পছন্দের ছিল আমার। প্রথমদিন খাওয়ার পর থেকে গড়ে প্রায় প্রতিদিনই ঐ ফ্রুটস স্যালাডটা দিলেই লাঞ্চ করতাম। তবে এত পছন্দের ফ্রুটস স্যালাডটাতে একটা সমস্যা ছিল। অন্যান্য ফ্রুটসের সাথে চেরিও দেয়া হতো স্যালাডে। চেরি হচ্ছে এমন একটা ফল যার গাছের নীচ দিয়ে যাবার সময়ও এলার্জীর অ্যাটাকে আমার ননস্টপ হাঁচি শুরু হয়ে যেত। ক্যান্টিনে অনুরোধ করে বলেছিলাম আমার স্যালাডে যাতে চেরিটা না দেয়া হয়। কিন্তু সপ্তাহের বড়জোর দু থেকে তিনদিন সেই অনুরোধ মনে থাকতো ক্যান্টিনের স্টাফদের। বাকি দিনগুলোতে চেরি সহ ই স্যালাড নিয়ে হাজির হতো। যদিও আমি কখনোই চেরি খেতাম না। তুলে রেখে দিতাম। কিন্তু তারপরও এলার্জীর অ্যাটাক থেকে রক্ষা পেতাম না। আবার ছোটবেলা থেকেই  ভ্রমণের খুব শখ আমার। সুযোগ পেলেই ছুট লাগাতাম দু চোখ ভরে জগতটাকে দেখার জন্য। দু’তিন মাস পর পরই ক্লাসমিটরা মিলে প্যাকেজ ট্যুরের আয়োজন করতো। ট্যুরে যাবার প্রস্তুতির সময় যতটা আনন্দিত থাকতাম, ট্যুরে কোথায় যাওয়া হবে সেটা ফাইলান হবার পর সেই আনন্দে  প্রায়ই ভাঁটা পড়ে যেত। কারণ বেশির ভাগ সময়ই দেখা যেত সবাই এমন জায়গা পছন্দ করেছে যেখানে অলরেডি আমি ঘুরে এসেছি। কিন্তু সবার পছন্দ ও উৎসাহের সামনে নিজেকে জাহির করতে ইচ্ছে হতো না। মুখে হাসি টেনে তাই বেরিয়ে পড়তাম সবার সাথে ভ্রমণে। নতুন কোন  জায়গা ভ্রমণের সময় যে আনন্দ উদ্দীপনা ঘিরে ধরতো মনকে ঠিক তেমনটা অনুভব না করলেও সবার সাথে হাসি আনন্দেই কাটতো সময়। জীবনে অসংখ্যবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বার বার এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হতে হয়েছে আমাকে। যেখানে আমি যা চাচ্ছিলাম তা পেয়েছিলাম। কিন্তু ঠিক সেভাবে নয় যেভাবে আশা করেছিলাম কিংবা প্ল্যান করেছিলাম। কখনো পছন্দের সাথে সাথে অপছন্দের কিছুও হাজির হয়েছে। কখনো বা অপছন্দের কিছুর সাথে অ্যাডজাস্ট করে নিতে হয়েছে। তখন বয়স কম ছিল। অভিজ্ঞতার ঝুড়িটাও শূন্যই ছিল বলা চলে। কিংবা এভাবেও বলা যায় চলার পথ থেকে সবে মাত্র একটা দুটা করে ফুল কুড়াতে শুরু করেছিলাম। তাই খুব সহজ ভাবে মেনে নিতে কষ্ট চাওয়া ও পাওয়ার মাঝে এমন কিঞ্চিৎ গড়মিলও। প্রায়ই উদাস চোখে দিগন্তের পানে চেয়ে ভাবতাম কেন সবকিছু ঠিক সেভাবেই হচ্ছে না যেভাবে আমি আশা করি, আমি পরিকল্পনা করি? কেন আমার ভালো লাগার হাত ধরে মন্দ লাগাও চলে আসে জীবনে?

ঠিক এই প্রশ্নগুলোই আমার মনেও সারাক্ষণ ঘোরা ফেরা করে ভাইজান। চাওয়ার সাথে সাথে না হলেও বেশির ভাগ সময়ই পেয়ে যাই আকাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলো। কিন্তু ঠিক সেভাবে নয় যেভাবে আমি চেয়েছিলাম। প্রায় সময়ই বিস্তর ফারাক থেকে যায় চাওয়া ও পাওয়ার মাঝে। বলতে বলতে আবারো কিঞ্চিৎ বিষণ্ণতা ছেয়ে গেলো জাহিনের চেহারাতে।
হাসি মুখে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকালো জাওয়াদ। সকালের নাস্তার পর বাগানে এসে বসার পরপরই জাহিন এসে হাজির হয়েছিল গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘে ভরা মন নিয়ে। হাত বাড়িয়ে জাহিনের কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, তোমাকে ফ্রুটস স্যালাড আর ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা কেন বললাম জানো? কারণ তোমার মতই আমিও একসময় চাওয়া ও পাওয়ার অমিল মেনে নিতে পারতাম না। বিষণ্ণ প্রহরের বিনিময়ে অবশেষে একদিন উপলব্ধি করেছিলাম। এই জগতের সবকিছুই কেমন যেন একে অপরের সাথে মেলানো মেশানো। রাতের সমাপ্তিতে দিন আসে, অতঃপর দিন হারিয়ে যায় রাতের গভীরে। কেউ জয়ের মুকুট মাথায় পড়তে পারে  অন্য কেউ পরাজিত হয় বলেই। অপছন্দনীয় কিছুর যাতনা অসহনীয় বলেই পছন্দকে আঁকড়ে ধরে রাখার আকুলতা। দুঃখ আছে বলেই সুখের এত কদর। জগতের সবকিছু কেমন যেন জোড়ায় জোড়ায় আবদ্ধ। তাই একটা চাইলে অপরটা সাথে চলেই আসে। যেমন, আনন্দ সবাই চায় আর বেদনা কেউই চায় না। কিন্তু আনন্দ-বেদনা যে একই ডোরে বাঁধা। কেউ না চাইলেও তাই সুখের সাথে সাথে দুঃখও হাজির হয়ে যায়। জীবন নামক এই সফরে সবকিছুই আসলে প্যাকেজ ডীলের মতো। অনেককিছুই যেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত কিংবা অপ্রয়োজনীয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। মূলত একটি প্যাকেজের সবকিছুই মনের মতো হবে না। সেই সত্যটাকে যেদিন উপলব্ধি করে মনে প্রাণে মেনে নিয়েছিলাম। আমার সমস্ত বিষণ্ণতা সেদিন ওয়ান ওয়ে টিকিট কেটে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিল। আলহামদুলিল্লাহ এরপর থেকে আজ অব্দি তার দেয়া পাইনি।

জাহিন হাস্যেজ্জল চেহারায় বলল, আমিও আমার সমস্ত বিষণ্ণতারকে ওয়ান ওয়ে টিকিট কেটে নিরুদ্দেশ যাত্রায় পাঠিয়ে দিতে চাই ভাইজান। কোথায় পাবো এই টিকিট?

জাওয়াদ হেসে বলল, দুনিয়া নামক এই পরীক্ষাক্ষেত্রে সবর নামক একটি স্ট্রেশন আছে। সেখানে পাবে সমস্ত বিষণ্ণতার ওয়ান ওয়ে টিকিট। আচ্ছা চলো তোমাকে স্টেশনে পৌঁছার নকশা বলে দিচ্ছি। সূরা বাকারাহ এর ২১৬ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, “হতে পারে তোমরা এমন কিছুকে অপছন্দ করছো যা প্রকৃত পক্ষে তোমাদের জন্য কল্ল্যাণকর অথবা এমন কিছুকে পছন্দ করছো যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন কোনটা তোমাদের জন্য উত্তম, তোমরা জানো না(ভাবানুবাদ)”। এই নকশা ধরে চলতে গিয়েও যদি কখনো পথ হারিয়ে ফেলো কিংবা ক্লান্তি চেপে ধরে তখন আমাদের পথ প্রদর্শক রাসূল(সাঃ)এর কথা স্মরণ করবে। তিনি বলেছেন, “কিয়ামতের দিন ইনসাফের দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। দাতাগণ আসলে তাদের দান-সাদাকা ওজন করে সেই পরিমাণে সওয়াব প্রদান করা হবে। এমনিভাবে, নামাজ, হাজ্জ্ব প্রভৃতি ইবাদতকারীদের তাদের আমল অনুযায়ী মেপে প্রতিদান দেয়া হবে। অতঃপর বালা-মুসিবতে সবরকারীরা আগমন করলে তাদের জন্য কোন ওজন ও মাপ হবে না। বরং অগণিত ও অপরিমিত সওয়াব তাদের দেয়া হবে তাদেরকে”। সূরা যুমার ১০ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও বলেছেন, “যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরষ্কার পায় অগণিত”।

আলহামদুলিল্লাহ আমি বুঝতে পেরেছি ভাইজান।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। চলো তোমাকে একটা মজার একটা ঘটনা বলি। বড়আব্বু ঈদের সময় আমাদেরকে ভীষণ স্পেশাল সব ঈদী দিতেন। আমরা বড়আব্বুর ঈদীর জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম। একবার খুব সুন্দর কারুকার্য খচিত ইনভেলাবের ভিতর বড়আব্বু সূরা যুমার ১০ নং আয়াত এবং রাসূল (সঃ) এর “কিয়ামতের দিন ইনসাফের দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা বিষয়ক হাদীসটা আমাদেরকে ঈদী দিয়েছিলেন। আমাদের খানিকটা আশাভঙ্গ হয়েছিল। কিন্তু পরে যখন বড়আব্বু বললেন, জীবনের চলার পথে যখনই আঁধার ঘনিয়ে আসবে। তোমরা সম্মুখে কিছুই দেখতে পাবে না। সবকিছু দুর্বোধ্য লাগবে তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এবং রাসূল সঃ এর এই বাণী দুটো স্মরণ করো। ঘোর আঁধারে নাইট ভিশন চশমার কাজ করবে ইনশাআল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ বড়আব্বুর কথাটিকে আমি সবসময় সত্য বলে প্রমাণিত পেয়েছি আমার জীবনে। যখনই জীবন অন্ধকারের প্রলেপ মেখে দিয়েছে আমার চলার পথে। সবরের নাইট ভিশন গগল এর শক্তিতে কখনো বহুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা আলোকরশ্মি দেখে, কখনো বা আঁধারের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা আলোর গুঞ্জরন অনুভব করে আশ্বস্ত বোধ করেছি। আজ যদিও ঈদ নয়। অবশ্য আপনজনদেরকে উপহার দেবার জন্য কোন বিশেষ দিন জরুরিও নয়। তাই বড়আব্বুর দেয়া সেই ঈদী আজ তোমাকে উপহার দিচ্ছি।

জাহিন হেসে বলল, জাযাকাল্লাহ ভাইজান। ইনশাআল্লাহ আমি জীবনে পাওয়া সবচেয়ে আরাধ্য কিছুর মতোই আগলে রাখবো এই উপহারটিকে এবং যথাযথ মেনে চলতেও আপ্রাণ চেষ্টা করবো।

হাসলেও মুখে আর কিছু বললো না জাওয়াদ। আসলে চাওয়া ও পাওয়ায় দ্বন্দ্বে ভরাই মানুষের জীবন। কাঙ্ক্ষিত জিনিস না পাওয়াটা যেমন কষ্টের, তেমনি ঠিক যেভাবে আশা করা হয়েছিল সেভাবে না পাওয়াটাও যাতনার। অবুঝ মন মানতেই চাও না যদি চাওয়াটা পূরণ হলোই সেভাবে কেন হলো না যেভাবে সে চেয়েছিল? এই প্রশ্নের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাওয়ার কারণেও অনেক সময় মানুষ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় ভিন্ন কিছু প্রাপ্তির মাঝে লুকায়িত কল্ল্যাণকে। তাছাড়া মানুষ শুধু চাইতে পারে, সেই লক্ষ্যে চেষ্টা ও পরিশ্রম করতে পারে। কিন্তু তার পূর্ণতা তো কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইচ্ছাধীন। নিজেদের ক্ষুদ্র জ্ঞানের কারণে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে না বলেই হতাশ হয়, আহাজারি করে চাওয়া ও পাওয়ার অমিলের দ্বন্দ্বে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতিটি সিদ্ধান্তই মানুষ জন্য কল্যাণময়। তবে বেশির ভাগ সময়ই হয়তো নানান পরীক্ষার আড়ালে আসে বলে সেই কল্ল্যাণ সমূহকে খালি চোখে দেখা যায় না। উপলব্ধিতে সবরের নাইট ভিশন গগলস লাগিয়ে খুঁজে নিতে হয় কল্ল্যাণময়তাকে।

@

“তোমার অভিমানে মনের অনুভূতিরা হয় হিম শীতল, রোদে ছাওয়া আকাশকে ঢেকে ফেলে জমাট বিষন্ন মাখা বাদল। সুবাস ছড়ায় না ফুলেরা, চঞ্চল প্রজাপতি বসে থাকে নিশ্চুপ, ঝরে পরে মনের কোনে জমে থাকা সুখের মূহুর্তরা টুপটুপ। পাখীরা ভুলে যায় কুহুতান, গুঞ্জন তোলে না জোনাকি আলোর, আঁধারে উন্মোচনে ঊষার নূপুর পায়ে এগিয়ে আসে না সুহাসিনী ভোর”।

কবিতা শুনে প্রচন্ড বিরক্তি ভরা চোখে মিসেস সুরাইয়া নূহার দিকে তাকালেন। নাবিহা হাসতে শুরু করলে নূহাও মেয়ের সাথে হাসিতে যোগ দিলো। মিসেস সুরাইয়া চোখ থেকে বিরক্তি কন্ঠে নামিয়ে এনে বলল, মা মেয়ে মিলে হিহি বন্ধ কর। না তোদের কবিতা শুনতে চাই, না তোদের হিহি।

নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে মনের সব অভিমান উড়িয়ে দাও বাতাসে, চলো তিনজন মিলে গল্প করি আনন্দের সিংহাসনে বসে।  

নূহা বলল, হুম, তা না হলে মিলাবো ছন্দ আরো ভয়ঙ্কর, বাঁচতে চাইলে অভিমানকে তাড়াও মেরে চড়।

কিছুতেই হাসবেন না সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল মিসেস সুরাইয়ার। কিন্তু মেয়ে আর নাতনীর ছন্দ শুনে হেসে ফেলে নূহার পিঠে আদরের থাপ্পড় লাগিয়ে দিলেন একটা। সাথে সাথেই নাবিহা হুঙ্কার ছেড়ে বলল, খবরদার নানুমণি আমার মামণিকে মারবে না।

তোর মামণি কাজকর্ম করে মার খাওয়ার মতো। মারবো নাতো কি করবো?

বুঝিয়ে বলবে। আমার মামণি মাশাআল্লাহ অনেক সমঝদার মেয়ে। বুঝিয়ে বললেই বোঝে। তাই মা মামণি?

নূহা চেহারায় নিরীহ ভাব ফুটিয়ে তুলে অতি বাধ্য মেয়ের মতো মেয়ের কথায় সম্মতি সূচক মাথা ঝাঁকালো।

মিসেস সুরাইয়া হেসে ফেলে বললেন, মেয়েটাকে নিজের মতো বহুরূপী গিরগিটি বানাস না। নয়তো আজ আমি যেমন ভুগছি, কাল তোকেও ভুগতে হবে। শীত যে এক মাঘে যায় না হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছেড়ে দেবে তোর মেয়ে তোকে।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, মামণি তারমানে তুমিও নিশ্চয়ই আমার নানুমণিকে এক কালে মাঘ মাস দেখিয়েছিলে।

নাবিহা খিলখিল করে হেসে ফেললো। মিসেস সুরাইয়াও হেসে বললেন, এটাই তো রহস্য। আমি এত শান্তশিষ্ট ছিলাম সারাটা জীবন। অথচ আমার মেয়ে হয়ে তুই এত অশান্ত কিভাবে হলি?

নূহা হেসে বলল, এটাকে সাম্যাবস্থা বলে জননী। তুমি অতি শান্ত ছিলে তাই আমি অতি অশান্ত। তুমি আর আমি মিলে ভারসাম্যপূর্ণ ভার্সন হচ্ছে নাবিহা। কখনো অশান্ত কখনো প্রশান্ত।

নাবিহা হেসে বলল, হ্যা নানুমণি। তাছাড়া অ্যান্টি হিরো ছাড়া যেমন হিরো হয় না। তেমনি কারো অশান্ত হওয়ার জন্য কারো শান্ত হওয়াটা জরুরি।

মিসেস সুরাইয়া বললেন, উফফ, আরো কত নতুন নতুন তত্ত্ব কথা যে শুনতে হবে তোমাদের মা মেয়ের কাছ থেকে।
নাবিহা হেসে বলল, এটা আমার নাতো নানুমণি পাপার কথা। গত কয়েকদিন আগে আমাদের গ্রুপের একজনকে পাপা শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু জিহাদ ভাইয়া কিছুতেই চাচ্ছিলো না সে শাস্তি পাক। তাই পাপাকে যখন তার সাপোর্টে বলতে গিয়েছিল তখন পাপা বললেন, তোমরা এখনো অনেক  ছোট। তোমাদের যে কোন ভুল, যে কোন অন্যায় একবার কেন শতবার মাফ করতে প্রস্তুত থাকি আমি। কিন্তু মিথ্যাচার, মিথ্যাচরণ এর জন্য কোন মাফ নেই। এত সুযোগ, এতটা ইতিবাচক পরিবেশ দেবার পরও যদি তোমাদের মধ্যে কেউ মিথ্যা পরিহার করতে না পারো। তাহলে যখন ট্রেনিংসেন্টার থেকে বেরিয়ে নেতিবাচকতায় ভরপুর এই দুনিয়াকে মোকাবিলা করতে হবে তখন কি করবে? তখন তো ভুল আর মিথ্যার স্রোতে ভেসে যাবে উপলব্ধি বিহীন। সুতরাং, মিথ্যা বলার শাস্তি তো পেতেই হবে। এমনকি মিথ্যাবাদী কারো সাপোর্টে যে কথা বলবে তাকেও আমি শাস্তি দেবো। কেননা সেও শয়তানের প্ররোচনার স্বীকার হয়েই মিথ্যাবাদীর আশ্রয়দাতা হতে চাইছে। জিহাদ ভাইয়া তখন আই এম সরি পাপা বলে চুপচাপ বই নিয়ে বসলো। পাপা অনেক বিরক্ত বুঝতে পেরে জিশান আর আমিও বই নিয়ে পড়তে বসে গেলাম। কিছুক্ষণ পর জিশান বলল, পাপা সব দোষ আসলে শয়তানের। শয়তান শুধু পঁচা পঁচা কাজ করতে বলে, মিথ্যা বলতে বলে। শয়তান না থাকলে আমরা সবাই সর্বক্ষণ ভালো থাকতে পারতাম।

মিসেস সুরাইয়া আর নূহা হেসে ফেললে নাবিহাও হেসে বলল, জিশানের কথা শুনে পাপাও হেসে ফেলেছিল। এরপর বললেন, কয়েকদিন আগে যে শিশুদের একটা আর্ট ফ্লিম দেখেছিলে তোমরা মনে আছে? যেখানে আব্দুল্লাহ নামে খুব ভালো একটি ছেলে ছিল। যে ঠিকমতো লেখাপড়া করতো, বড়দের  কথা শুনতো, মানুষের উপকার করতো। এককথায় গুড বয় ছিল আব্দুল্লাহ। শুধু একটু ভীতু ছিল। কিন্তু ইকবাল খুবই দুষ্টু আর সাহসী ছিল। কাউকে ভয় পেতো না, স্কুলেও ঠিকমতো যেত না। এছাড়াও ইকবাল সারাক্ষণ আব্দুল্লাহকে বিরক্ত করতো। দুষ্টু কথা বলতো, মারতো। ইকবালকে শিক্ষা দেবার জন্য আব্দুল্লাহ ধীরে ধীরে সমস্ত ভয় কাটিয়ে অনেক সাহসী হয়ে উঠেছিল। এবং একদিন দুষ্টু ইকবালকে হারিয়ে গুড বয় থেকে সুপার বয় হয়ে গিয়েছিল আব্দুল্লাহ। এখন ভেবে বলো তো যদি  ইকবাল না থাকতো তাহলে কি আব্দুল্লাহ নিজের ভয়কে জয় করার মিশনে নামতো? এবং অতি সাধয়ায় ভয়কে জয় কখনো সুপার বয় হতো? কখনোই না। তারমানে আব্দুল্লাহর ভালোর পাশাপাশি সাহসী ও প্রতিবাদী হবার পেছনে ইকবালের দুষ্টু স্বভাবেরও অবদান আছে। এটা থেকে কি বুঝলাম আমরা? জিশান সাথে সাথে জবাব দিলো, জগতে দুষ্টুরা মোটেই মিনিংলেস, জব লেস না। তাদেরও অনেক অবদান আছে জগতকে সুপার করে তোলার পেছনে। পাপা তখন হেসে বললেন, জ্বি আপনি  তো এই কথাই বলবেন। দুষ্টুর শিরোমনি বলে কথা।

নূহা হেসে ফেলে বলল, সেটাই তো দুষ্টুমির সাপোর্টে কথা বলার এত বড় সুযোগ কি জিশান হাতছাড়া করতে পারে? যাইহোক, এরপর কি বলেছিলেন পাপা তোমাদেরকে?

নাবিহা হেসে বলল, পাপা বলেছিলেন  খুব ছোটবেলায় আমি একটা জিনিস উপলব্ধি করেছিলাম। একজন হিরোর সুপার হিরো হবার জন্য তার জীবনে একজন অ্যান্টি হিরো বা ভিলেনের খুব বেশি প্রয়োজন। যেমন, আমার নানাভাইর সাথে নীতির দ্বন্দ্বে অনেক ছোটবেলাতেই জড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। এরপর থেকে আমি এমন অনেক কাজ করেছি যা হয়তো কখনোই করতাম না যদি না নানাভাইর সাথে সহিহ গলদের প্রতিযোগীতা না থাকতো। আমি অকপটে স্বীকার করি নানাভাই আমার পেশেন্সের চারাগাছকে বটবৃক্ষ হতে সহায়তা করেছিল। সকল অন্যায়, ভুল পথ, মতের বিরুদ্ধে অনঢ়, অটল ভাবে আমার টিকে থাকার শক্তিশালী একটা কারণ হিসেবে কাজ করেছে। মোটকথা আমার সারভাইভ্যল স্কিল্ক পুনঃপুনঃ বুলন্দ করেছেন। নানাভাইর প্রতিটা চ্যালেঞ্জকে দ্বিগুণ গতিতে ফিরিয়ে দেবার জেদ চেপে বসেছিল আমার মনে। পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং সর্বোপরি আল্লাহর উপর ভরসা একজন মানুষকে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে জিরো থেকে হিরোতে রুপান্তরিত করতে পারে এটাই প্রমাণ করে দেখাতে চেয়েছিলাম আমি নানাভাইকে। এবং এই লক্ষ্য অর্জনে আমি দিন-রাতের প্রভেদ ভুলে গিয়েছিলাম, নাওয়া-খাওয়া, বিশ্রাম ভুলে গিয়েছিলাম। এবং একটা সময় অভিষ্ট্য লক্ষ্যকে ছুঁয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছিলাম নানাভাইর সামনে।  এমনটা কিন্তু নয় যে নানাভাই আর আমার সম্পর্কে ভালোবাসার কোন ঘাটতি ছিল। বুঝতে শেখার পর থেকে নিয়ে এখনো পর্যন্ত নানাভাই আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষদের একজন। আমাদের দ্বন্দ্ব ছিল নীতি নিয়ে। যেই দ্বন্দ্বের কারণেই আমি প্রাচুর্যের মোহজাল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। খুঁজে পেয়েছিলাম জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেকে। উপলব্ধি করেছিলাম জীবনের প্রকৃত স্বরুপ। নানাভাইর সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া ছাড়া ব্যক্তি আমি হয়তো আজ এই অবস্থানে এসে পৌঁছাতাম না। ঠিক তেমনি একজন ঈমানদার হিসেবে টিকে থাকার পেছনেও শয়তানের অনেক অবদান খুঁজে পাই আমি। নেতিবাচক কিছু মনে আসার সাথে সাথেই শয়তানের ওয়াসওয়াসা ভেবে এই যে নিজেকে সাবধান করা, সংশোধন করা এবং নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এরজন্য শয়তানের উপস্থিতি জরুরি ছিল। যখন চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু চলে আসে এবং আল্লাহর ভয়ে দৃষ্টি অবনত করি। তখন কিন্তু শয়তানকে হারিয়ে দেবার স্বস্থিও কাজ করে। সকল ভুলের তরে এত শত সতর্কতা তো শয়তানের ধোঁকার পরে যাতে আল্লাহকে নারাজ না করে ফেলি সেজন্যই। তাই যদি তোমরা প্রকৃত মুসলিম হিসেবে সত্যিকার অর্থেই হিরো হতে চাও, তাহলে অ্যান্টি হিরো বা ভিলেন অর্থাৎ, শয়তানের সাথে লড়াই করেই সেটা হতে হবে। কেননা অ্যান্টি হিরো আছে বলেই তো সুপার হিরোর এত সম্মান। তাই তোমাদের জীবনে সবসময় অ্যান্টি হিরোদের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত রাখবে। তবেই হতে পারবে এক একজন সুপার হিরো ইনশাআল্লাহ।
নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এজন্যই তোমার পাপার শেখানোর স্টাইলটার ভীষণ ভক্ত আমি। জানো উনি খুব কম সময়ই আমাকে হাতে কলমে কিছু শিখিয়েছেন। ৯৫ পার্সেন্ট সময়ই উনি শিক্ষার উপকরণের সাথে আমাকে শুধু ইনভল্ভ করে দিয়েছেন, কিছু একটার সাথে রিলেট করে দিয়েছেন, আমার মনের দ্বারে নাড়া দিয়ে উপলব্ধিকে জাগ্রত হতে সহায়তা করেছেন। আমাকে জীবনের রত্নভান্ডারের সন্ধান দিয়েছেন। চলার পথের নকশা হাতে গুঁজে দিয়ে দূর থেকে মঞ্জিল দেখিয়ে দিয়েছেন। অন্তঃদৃষ্টি উন্মোচন করতে সহায়তা করেছেন।শুধুমাত্র বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখে এই দুনিয়াতে স্বস্থিতে থাকার আসলে কোনই সুযোগ নেই। উপলব্ধি বিহীন জীবনের কোথাও তৃপ্তি নেই। জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত থেকে নিজের জন্য কল্ল্যাণ খুঁজে নেবার জন্য অন্তঃদৃষ্টি ও আত্মপোলব্ধি সংমিশ্রণ তাই অতীব জরুরি। আমাদের চারপাশে এত সমস্যা এর একটা কারণ কিন্তু এটাও যে, অন্তঃদৃষ্টি তো অনেক পরের কথা বাহ্যিক দৃষ্টি থাকতেও আমরা অন্ধের মতো পথ চলি। মনের মধ্যে সর্বক্ষণ আবেগের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবার পরেও আমরা অনুভব, উপলব্ধি বিহীন একটা জীবন কাটিয়ে যাচ্ছি। পর্দার আড়ালে কি আছে পর্দা সরিয়ে দেখার সুযোগ থাকতেও ধারণা করতেই পছন্দ করা স্বভাবের মানুষ আমরা। সেই আমরা সমস্যার ভাঁজে ভাঁজে লুকায়িত সম্ভাবনা খুঁজে নেবার তাগিদা বোধ করবো না এটাই তো স্বাভাবিক।

নাবিহা হেসে বলল, পাপা আমাদেরকেও সবসময় এভাবেই শেখান।

নূহা বলল, এটাই আসলে শিক্ষা দেবার সঠিক পদ্ধতি। একজন উত্তম শিক্ষক কখনোই সবটা বলে দিয়ে অন্যকে দেখে নকলে অভ্যস্ত করেন না তার ছাত্রদের। কেননা জীবনকে মুখস্ত যাপনের সুযোগ সময় খুব কমই দেয় মানুষকে। জীবন নামক পরীক্ষাক্ষেত্রে সবার প্রশ্নপত্রেই শব্দার্থ, বাক্য রচনা, ভাব-সম্প্রসারণ, সারাংশ-সারমর্ম, ট্রান্সলেশন, বীজগণিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি ইত্যাদি থাকে। কিন্তু সব ক্লাসের প্রশ্নপত্র যেমন একরকম হয় না। তেমনি ব্যক্তি ভেদে জীবনের  প্রশ্নপত্রও থাকে আলাদা আলাদা। তাই প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়ার চেয়ে সমস্যা সমাধানের নিয়ম ও ফর্মূলা শিখিয়ে দেয়াটাই একজন শিক্ষকের দায়িত্ব।

মিসেস সুরাইয়া বললেন, হুম! বুঝলাম। এখন একটা কথা পরিষ্কার করে বলো তোমাদের মাতা-কন্যার কি শিক্ষাসফরে বের হবার ইচ্ছে? তাহলে আমি রন্ধনশালায় যাবো।

নূহা হেসে বলল, মোটেই না। আমাদের মাতা-কন্যার তো আপনাকে সাথে নিয়ে গল্পসফরে বের হবার ইচ্ছে।

নাবিহা হেসে বলল, হ্যা। ঐ যে দেখো পাপার গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ির গেট দিয়ে। চলো বাগানে বসে আমরা গল্পসফর শুরু করবো। বলতে বলতে দুহাতে মামণি আর নানুমণির হাত ধরে টানতে টানতে বাগানের দিকে হাঁটতে শুরু করলো নাবিহা।

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৮



“ছোট্ট একটা পরী, ভীষণ দুষ্টু বুড়ি। একদিন এলো উড়ে, আমাদের সংসারে। এরপর হলো জাদু, গড়লো সে আনন্দসিন্ধু। শব্দে ছিল তার মায়া, ভালোবাসার প্রতিচ্ছায়া। হাসতো ফুল ছড়িয়ে, গাইতো সুর সাজিয়ে। অভিমানে ঝরাতো বৃষ্টি, ছিল গভীর অন্তঃদৃষ্টি। স্বপ্নের অবিরাম ঝর্ণাধারা, মনটা ছিল বড্ড বাঁধনহারা”। বইয়ের প্রথম পাতায় ভালোবাসার তুলির ছোঁয়ায় বুনে দেয়া শব্দগুলো পড়ার সময় আনন্দ ছুটে এসে জাপটে ধরলেও চেহারায় গাম্ভীর্য অক্ষুণ্ণ রেখে নাবিহা বলল, আমি খুব ভালো করে জানি তো এটা যে নকল কবিতা। মোটেই তুমি লেখোনি আমার জন্য। এটা সুবহা চাচী লিখেছিল তোমার জন্য।

অভিমানী মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে নূহা হাসি মুখে বলল, তাকে কি? আমি যদি আমার ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় খেলনাটা তোমাকে দিতে পারি, আমার শৈশবের ডায়েরি তোমাকে দিতে পারি। তাহলে আমাকে দেয়া আমার প্রিয় কারো কবিতা কেন দিতে পারবো না? তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, আমি তোমার জন্য যে শব্দগুলোকে ভালোবাসার ফ্রেমে বাঁধতে চাচ্ছিলাম। সেগুলো যদি আগেই কেউ তার ভাবনার জালে আঁটকে ফেলে থাকে। সেই দোষ কি আমার? বলো তুমিই বলো। বিবেচনা করে বলো।

নাবিহা হেসে বলল, আমি জানি তো তুমি আমাকে পটাতে চাইছো।

তাহলে আর দেরি না করে ঝটপট পটে যাও। তারপর চলো আমরা দুজন মিলে গল্প করি।

নাবিহা চেহারা আঁধার করে বলল, পরশুরাতেও তুমি বলেছিলে গল্প করবে। আমি রাত দু’টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। কিন্তু তুমি ফোন করোনি।

নূহা হেসে বলল, ভুলে গিয়েছিলাম আমি সেটা তো বলেছি তোমাকে। সেজন্য তোমাকে সরিও বলেছি। অথচ এরপরও তুমি অভিমান করে আছো। এখন যদি মামণি অভিমান করি তোমার উপর?

নাবিহা চোখ বড় বড় করে অবাক কন্ঠে বলল, তুমি কেন অভিমান করবে আমার উপর?

কারণ তুমি তো জানোই মামণি ভুলে যাই। যখন আমি ফোন দিতে দেরি করছিলাম তুমি কেন কল করোনি আমাকে? জানি তুমি পরীক্ষা করে দেখতে চাইছিলে আমার মনে থাকে কিনা তোমাকে ফোন দেবার কথা। আচ্ছা আমি যদি তোমার পরীক্ষায় পাশ করতাম তাহলে কি হতো? স্পেশাল কিন্তু তেমন কিছুই হতো না। ফোন দেবার কথা ছিল তাই দিতাম এবং কিছুক্ষণ গল্প করতাম তুমি আর আমি। এবার ভেবে দেখো তো তোমার পরীক্ষায় আমি ফেল করাতে কি হয়েছে? তুমি অপেক্ষা করেছো অনেকটা সময় ধরে। অপেক্ষায় সময়টুকুতে আমি ফোন করবো কি করবো না এই দোদুল্যমনতায় ভুগেছো। শেষপর্যন্ত ফোন না করাতে কষ্ট পেয়েছো, কান্নাও করেছো জানি। এবং এরপর থেকে আমার উপর অভিমান করে বসে আছো। গতকাল সারাদিন সারারাত তুমি একবারও আমার সাথে কথা বলোনি, ম্যাসেজ করোনি, আমার ম্যাসেজের জবাবও দাওনি। সবসময় আমি বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে তুমি সবার আগে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ো আমার কোলে। কিন্তু আজ অভিমান বোঝানোর জন্য তুমি ছুটে আসোনি আমার কাছে। এটা আমার জন্য প্রচন্ড কষ্টের ছিল। এখনো ভাবতে গিয়ে আমার চোখ ভিজে আসছে। অথচ তুমি যদি পরশুরাতে ফোন দিতে আমাকে তাহলে এসবের কিছুই হতো না। না চাইতেও আমরা দুজন একে অন্যের কষ্টের কারণ হতাম না। গত তেতাল্লিশ ঘন্টার যে ছোট্ট দুরুত্বটা আমাদের মাঝে তৈরি হয়েছিল সেটা হতো না।

দুহাতে নূহাকে জড়িয়ে ধরে কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে একরকম ফুঁপিতে উঠে নাবিহা বলল, আই এম সরি মামণি। আই এম রিয়েলি ভেরি সরি। আমি আর কখনো কোনদিন এমন বোকামি করবো না ইনশাআল্লাহ। আই প্রমিস।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হেসে ফেললো নূহা। হাত বাড়িয়ে চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রুবিন্দু মুছে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, তবে মাঝে মধ্যে এমন একটু আধটু মান অভিমানেরও দরকার আছে। মনেরও তো কখনো সখনো ইচ্ছে করে স্পাইসি কিছু টেস্ট করে দেখতে।

নাবিহার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলেও অপরাধী কন্ঠে বলল, তারপরেও আমার ওমন করাটা ঠিক হয়নি।

নূহা হেসে বলল, হুমম, সেটা অবশ্যই ঠিক হয়নি। জীবন তো সারাক্ষণই নানান ধরণের পরীক্ষার আয়োজন সাজিয়ে চলার পথের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য। জীবন নামক এই পরীক্ষা ক্ষেত্রে আপনজনেরাই তো আমাদের এক টুকরো প্রশান্তির আশ্রয়। সেই কাছের মানুষেরাও যদি পরীক্ষা নেয়া শুরু করে তাহলে কোথায় গিয়ে স্বস্থির একটু নিঃশ্বাস ফেলবো আমরা?

আমি বুঝতে পেরেছি মামণি। আর কখনোই এমন হবে না ইনশাআল্লাহ। এরপর থেকে যখনই তুমি কোন কিছু ভুলে যাবে আমি তোমাকে জোর করে মনে করিয়ে দেবো।

নূহা হেসে বলল, আমাদের তো আসলে এমনটাই করা উচিত। আপনজনদের চলার পথটাকে যতটা সম্ভব মৃসুন করে তোলার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা উচিত। আপনজনদের পরীক্ষাগুলোকে কিভাবে সহজ করে তোলা যায়, কিভাবে তাদেরকে পাশ মার্ক তুলতে সহয়তা করা যায় সেই পথ ও পন্থার সন্ধান করা উচিত। কখনোই তাদের চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করা উচিত নয় যে, কাঁটার আঘাত এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে কিনা। যদি সে না পারে তাহলে পথে কাঁটা বিছানোর দায় তো আমাদের উপরই বর্তাবে তাই না?

জ্বি মামণি।

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা চলো এখন আমরা অন্য কথা বলি। তোমার স্কুলের গল্প শোনা হয়নি কিন্তু বেশ কিছুদিন। কেমন আছে তোমার ক্লাসফ্রেন্ডরা সবাই?

নাবিহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে। শুধু তাজকিয়া ছাড়া।

কেন? কি হয়েছে তাজকিয়ার? এখনো কি একটুতেই মনখারাপ করে বসে থাকে?

হ্যা মামণি কেউ কিছু বললেই তাজকিয়া মনখারাপ করে, কান্না করে। ওকে যতই বলি মনখারাপ হয় এমন কথা বেশি ভাবতে নেই। ততই আরো বেশি বেশি ভাবে আর মনখারাপ করে। মামণি তাজকিয়াকে একদিন নিয়ে আসি তোমার কাছে?

নূহা হেসে বলল, আগে তুমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করো। একান্তই যদি না বোঝে তোমার কথা। এরপর নাহয় আমি কথা বলবো ওর সাথে।

নাহিবা হাসি মুখে বলল, আচ্ছা। তাহলে আমাকে বলে দাও কিভাবে ওকে বোঝাবো।

একটুক্ষণ সময় নিয়ে নূহা হেসে বলল, একটা সময় ছিল যখন অতি সামান্য কারণেই মনের ঘরের ইলেকট্রিক কানেকশন, জেনারেটর পাওয়ার, চার্জ লাইট, চর্ট লাইট, হারিকেন, মোমবাতি সবকিছু নিভিয়ে দুনিয়া আঁধার করে বসে থাকতাম আমি। কোন কিছু মনের মতো না হলেই মননদীতে জোয়ার  এসে চোখের কূল ভেঙে ছলকে ছলকে বেরিয়ে আসতো জলধারা। কেউ কেন এমন কথা বলবে যা আমার পছন্দ নয়? এই প্রশ্নের উত্তাপে ফেটে পড়তো মনের আগ্নেয়গিরি। নিজ চিন্তার লকলকে লাভার স্রোতে দগ্ধ হতে হতে ভস্ম হয়ে যেতাম নিজেই। আসলে একটু বেশির স্পঞ্জি স্বভাবের ছিল আমার মনটা তখন। তাই যাই শুনতাম বা দেখতাম নিজের মাঝে ধারণ করে ফেলতাম। ইতিবাচক হলে তো সমস্যা ছিল না। কিন্তু নেতিবাচক যে কোন কিছুই আমাকে খুব ব্যথিত করতো। ছোট ছিলাম তাই নেতিবাচক ও ইতিবাচক অভিজ্ঞতাকে সমূহকে আলাদা যেমন করতে পারতাম না। তেমনি ইতিবাচকতার ছোঁয়ায় নেতিবাচক কিছুকে বদলে দিতেও পারতাম না। আবার না পারতাম নেতিবাচকতাকে নিংড়ে বের করে ফেলতে। যারফলে, উনিশ থেকে বিশ হলেই আমার মনের আকাশ ছেয়ে যেত ঘন কালো মেঘে। অকারণ কষ্ট পাবার, কষ্ট তৈরি করার, কষ্ট পোষার একটা স্বভাব তৈরি হতে শুরু করেছিল আমার ভেতর। একদিন তোমার পাপার খুব সামান্য একটা কথাতে মনের আকাশ থেকে ঝিলমিলে তারাগুলোকে টেনে টেনে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের নীচে নিজেকে গুঁটিয়ে বসেছিলাম।

নাবিহা হেসে বলল, পাপা কি বলেছিল তোমাকে?

নূহা হেসে বলল, সেটা তো বলা যাবে না। টপ টাইপের সিক্রেট কথা এটা। তবে এরপর কি বলেছিলেন সেটা বলতে পারি তোমাকে।

নাবিহা লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, নাই মামার চেয়ে কানা মামা নাকি ভালো। বলো সেটাই বলো শুনি।

নূহা হেসে বলল, সেদিন তোমার পাপা বলেছিলেন, “জীবন আলো আঁধাররির সংমিশ্রণ, শুধু সুখ কিংবা দুঃখ হবে না অর্জন। আনন্দের সুর শুনতে পাবে এই ক্ষণে, বেদনা তুলে দেবে কম্পন পরক্ষণে। মেনে নিয়ে পথ চলে যারা এই সত্য, তারাই উপভোগ করে সময়কে নিত্য। জীবনে  বারংবার ঘটবে মন খারাপের ঘটনা, কষ্ট নানান মুখোশে পুনঃপুনঃ করবে ছলনা। প্রতিবারই যদি হও তুমি উদাস, অর্জিত করবে উপাধী নফসের দাস। তাই বিবেকের কার্যাবলীকে করতে না চাইলে শিথিল, আজ থেকেই তিলতিল করে মনকে করো তোলো পিচ্ছিল”।

নাবিহা হেসে বলল, মনকে করো তোলো পিচ্ছিল?

হাসতে হাসতে নূহা বলল,  কথাটা শুনে আমিও অনেক মজা পেয়েছিলাম সেদিন। মনখারাপ ভুলে আমি হেসে ফেললে তোমার পাপাও হাসি মুখে বলেছিলেন,  আজ থেকে রোজ নিয়ম মাফিক দুইবেলা তোমার মনে অলিভ অয়েল মাখবে। এক্কেবারে তেল চপচপা তেলতেলে করে ফেলবে মনকে। মনকে বিষণ্ণ করা, উদাস করা কোন কথাই যেন স্থির হয়ে দুদন্ড দাঁড়ানোর সুযোগ না পায় তোমার মনে। নেতিবাচক সমস্ত কিছুর প্রভাব যেন পিছলে গিয়ে দূরে চিৎপটাং হয়।
নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, তারমানে তাজকিয়াকে পাপার এই অয়েল ফর্মূলাটা দিতে হবে। তাই না?

হ্যা। এবং একই সাথে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলবে, দুনিয়ার এই ছোট্ট জীবনে মনখারাপ করার মতো, কষ্ট পাবার মতো, ব্যথিত হবার মতো, আহত হবার মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আমরা শত চেষ্টা করেও জীবনে আসা এইসব নেতিবাচকতাকে থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারবো না। কিন্তু ইচ্ছেশক্তি ও চেষ্টার দ্বারা এইসবের নেতিবাচক প্রভাব থেকে অবশ্যই নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারবো। এবং নিজের জন্যই এমনটা করতে হবে আমাদেরকে। তা না হলে জীবনের ইতিবাচক দিক সমূহের সুফল থেকেও বঞ্চিত হতে হবে আমাদেরকে। জীবন বেদনা যেমন দেয়, আনন্দও তো দেয়। বেদনায় নিমজ্জিত থাকি বলেও কিন্তু অনেক আনন্দের আগমনী ধ্বনি শুনতে পাইনা আমরা। দেখতে পাইনা অনেক সুখের মৃদু হাতছানি। সর্বাবস্থাতেই তাই ইতিবাচক চিন্তা করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা আমরা কোন কিছুকে কিভাবে দেখছি, কিভাবে ভাবছি সেটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। আবার চিন্তার প্রতিফলনই আমরা বাস্তবে দেখতে পাই। তাই আমরা মনকে নেতিবাচকতা নাকি ইতিবাচকতা সাপ্লাই করছি সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনকে আমরা যেই কাঁচামাল সাপ্লাই করবো মন তার দ্বারাই গড়ে তুলবে প্রোডাকশন হাউস। সেজন্য আমরা যদি সুখী ও সুন্দর একটা জীবন চাই তাহলে আমাদেরকে ইতিবাচক সবকিছুর প্রতিই মনোযোগী হতে হবে। এবং নেতিবাচক সবকিছুর জন্য মনকে স্পেশালি ট্রেনিং দিয়ে করে তুলতে হবে পিচ্ছিল।

নাবিহা হেসে বলল, একদম সুপার পিচ্ছিল। ইনশাআল্লাহ আমি তাজকিয়া বুঝিয়ে বলবো।

নূহা হেসে বলল, দ্যাটস লাইক অ্য মাই গার্ল। আচ্ছা এখন তুমি তোমার জন্য নিয়ে আসা বইটা পড়ো। আমাকে দু’চার ঘন্টার জন্য হসপিটালে যেতে হবে। ইনশাআল্লাহ ফিরে এসে সন্ধ্যায় অনেক গল্প করবো আমরা।

জড়িয়ে ধরে মামণিকে আদর করে দিয়ে বিদায় জানিয়ে বই খুলে বসলো নাবিহা।

@      

ফজরের নামাজ আদায় করে বারান্দায় এসে বাইরের দিকে তাকাতেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো নাবিহার মন। বাইরে অঝোর ধারায় ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে। যতটা না বৃষ্টির জন্য তারচেয়ে বেশি খুশি হলো আজকের নিজের শুরুটা বৃষ্টিমুখর হবার জন্য। গতরাতেই গল্প করার ফাঁকে মামণি তাকে বলেছিল বৃষ্টিমুখর দিনে সকালের নাস্তায় মসলা চা আর গরম গরম সবজি পাকোড়া খেতে ভীষণ পছন্দ করে। গতরাতে যখন মামণির সাথে গল্প করছিল তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। দোয়া চাইবার মোক্ষম সময়টা হাতছাড়া হতে দেয়নি নাবিহা। আল্লাহর কাছে এমন একটা বৃষ্টিমুখর দিন চেয়েছিল। যাতে নিজ হাতে মামণিকে মসলা চা আর সবজি পাকোড়া বানিয়ে খাওয়াতে পারে। তার খুব ভালো মতোই জানা আছে বৃষ্টির দিনে পাপার প্রিয় নাস্তাও মসলা চা আর সবজি পাকোড়া। আর এক মূহুর্ত দেরি না করে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে ছুট লাগালো নাবিহা। কিন্তু দরজায় পৌঁছে রান্নাঘরের ভেতরে নানাভাইকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো।

কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে নাবিহাকে দাঁড়ানো দেখে হেসে সালাম দিলেন আজাদ সাহেব।
সালামের জবাব দিয়ে ধমকের সুরে নাবিহা বলল, নানাভাই তুমি এত ভোরে কিচেনে কি করছো? চুরি করে মিষ্টি খেতে এসেছো বুঝি?

হেসে ফেললেন আজাদ সাহেব। হাসতে হাসতে বললেন, তুমি যে কারণে এসেছো আমিও ঠিক একই কারণে এসেছি।

হাসি ফুটে উঠলো নাবিহার চেহারাতেও। গতরাতে তার আর মামণির গল্পের আসরে নানাভাইও ছিল। তার মতো নানাভাইও নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে বৃষ্টির দোয়া করেছিল। আনন্দময় কাজে সঙ্গী পেয়ে যাওয়াটাও আনন্দের। নানাভাইকে সাথে পেয়ে নাবিহারও আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেলো। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে চোখ বড় বড় করে ঝগড়া করার স্টাইলে বলল, মামণির জন্য মসলা চা আর সবজি পাকোড়া কিন্তু আমি বানাবো। তুমি দূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখবে। এটা হচ্ছে কন্ডিশন। বুঝেছো?

আজাদ সাহেব হেসে বলল, সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু কথা হচ্ছে গিয়ে আমাদের দুজনের লক্ষ্য যেহেতু এক। শুধু শুধু কন্ডিশন টেনে এনে দুরুত্ব তৈরি করার কি দরকার মাঝখানে বলো? তারচেয়ে চলো দুজনে মিলেই আমাদের মায়ের জন্য তার পছন্দের নাস্তা বানাই।

নাবিহা হেসে বলল, আচ্ছা ডান। কিন্তু নাস্তা বানাতে বানাতে আমাকে মামণির গল্প শোনাতে হবে।

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, অবশ্যই শোনাবো। জানো নূহা আর আমিও মাঝে মাঝে এমন একসাথে রান্না করতাম। তবে সেইসব রান্না বেশির ভাগ সময়ই হতো গভীর রাতে।

নাবিহা হেসে বলল, গভীর রাতে কেন? অন্যসময় কি নানুমণি বকা দিতো?

আসলে আমাদের পিতা-কন্যার গল্পের আসর বসতো রাতের বেলা। গল্প করতে করতে ক্ষুধা লেগে গেলে দুজন মিলে কিছু একটা বানিয়ে খেতাম। বেশির ভাগ সময়ই বিভিন্ন ধরণের পাকোড়া, নয়তো আলুর চপ বা বেগুনী, কিংবা অন্য কোন স্পাইসি নাস্তা বানাতাম। সাথে চা কমন। তবে দু'একদিন আবার হেভি কিছু খেতে ইচ্ছে করতো। এমন দিনগুলোতে হয় আমার পছন্দের প্লেইন পোলাও আর কাবাব, নয়তো নূহার পছন্দের ভেজিটেবল বিরিয়ানি রান্না করতাম।

নানূমণির হাতে ধরা পড়তে না কখনোই? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো নাবিহা।

আজাদ সাহেবও মুখের হাসি আরো বিস্মৃত করে বললেন, তোমার নানুমণি তো রোজই হাজির হয়ে যেতো খাবারে ভাগ বসানোর জন্য। জাওয়াদের সাথে নূহার বিয়ের পর আমাদের নিশি আড্ডার সদস্য সংখ্যা আরেকজন বেড়েছিল। সত্যি বলতে জাওয়াদ যোগ দেবার পর থেকে আমাদের আড্ডার আনন্দও অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। একদিন আমরা চারজন মিলে লং ড্রাইভে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। সারারাত বাইরে ঘুরাঘুরি করে একদম ফজরের একটু আগে বাড়িতে ফিরেছিলাম। জাওয়াদ সাথে না থাকলে আমার কখনোই সাহস হতো না গভীর রাতে নূহা আর তোমার নানুমণিকে নিয়ে বাইরে বেরুবার।

ইশশ, তোমরা কত্তো মজা করেছো। তখন আমি থাকলে আমিও আনন্দ করতে পারতাম।

নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি মুখে আজাদ সাহেব বললেন, প্রকৃতি জুড়ে যখন যে ঋতুর মেলা বসে। তখন সেখান থেকেই আনন্দের উপকরণ খুঁজে নিতে হয়। যেমন ধরো, বরষার সময় বৃষ্টিকে উপভোগ করাই আনন্দ, বসন্তে ফুলের সমারোহে ছড়ানো থাকে খুশি। জীবনও তেমনি একেকসময় একেক ঋতু নিয়ে হাজির হয় আমাদের কাছে। তখন জীবনে হেমন্ত এসেছিল। নবান্ন উৎসবের পাশাপাশি সুখানন্দের অনেক ফসলও ঘরে তুলেছিলাম আমরা আলহামদুলিল্লাহ। এই শীতে সেখান থেকে নিজেদের খোঁড়াক মেটাই চলো।

নাবিহা হেসে বলল, হ্যা হ্যা তাই করবো আমরা। নানাভাই তোমার কথা পাপা মামণির মতোই ফাটাফাটি।

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। এখন তাহলে চলো তোমার পাপা মামণির জন্য ফাটাফাটি মসলা চা আর পাকোড়া বানানোতে মনোযোগ দেই। তোমার নানুমণি এলে আমাদেরকে নির্ঘাৎ রান্নাঘর থেকে বের করে দেবে।

হ্যা নানাভাই চলো তাড়াতাড়ি করে নাস্তা বানিয়ে ফেলি আমরা। বৃষ্টি থেমে যাবার আগেই নাস্তা দিতে চাই মামণি পাপাকে। গল্পে সাময়িক বিরতি টেনে নানা নাতনী মিলে তখন নাস্তা বানানোতে মনোনিবেশ করলো।

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৭



দূর থেকে তাকে দেখা মাত্রই সাফিনকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসতে দেখে হাসি ফুটে উঠলো নূহার মুখে। মনে পড়লো সপ্তাহ দুয়েক আগে পরাপর দুইদিন সাফিন কথা বলতে এসেছিল। একদিন ব্যস্ততার কারণে এবং অন্যদিন ক্লান্তির কারণে সময় দিতে পারেনি নূহা। এরপর থেকে গত দুই  সপ্তাহে মনে মনে সাফিনকে অনেক খুঁজেছে কিন্তু দেখা পায়নি বলে কথাও বলা হয়ে ওঠেনি। বেশ কয়েকবার অবশ্য ফোন দেবার কথা ভেবেছিল, ম্যাসেজ পাঠাতে চেয়েছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠেনি নানান ব্যস্ততার কারণে। যদিও নূহা জানে এগুলো মোটেই এক্সকিউজ হতে পারে না। চাইলে শত ব্যস্ততার মধ্যেও যোগাযোগ করা যায়। আর সমস্যা এখানটাতেই। নিজ থেকে কারো সাথে যোগাযোগ করাটা কেমন চেন হয়েই ওঠে না তার। এমনটা নয় যে কারো কথা মনে পড়ে না। বরঞ্চ এর উল্টো। সারাক্ষণই তার মনের রাজ্যে জুড়ে কাছের দূরের পছন্দের মানুষগুলো আনাগোনা করে। কিন্তু বাস্তবে কেউ যোগাযোগ না করলে কেমন যেন হয়ে ওঠে না যোগাযোগ করাটা। নূহা নিজেও অনুভব করে এই স্বভাবটা চেঞ্জ করা জরুরি। কিন্তু অনুভবটা ভাবতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। এরফলে কাছের দূরের সবার অভিমানেই স্নাত হতে হয় তাকে। তার উপর অভিমান করার পেছনে তাই যথার্থ কারণ আছে সাফিনেরও। সাফিনের পাশে দিয়ে দাঁড়িয়ে নূহা হাসি মুখে বলল, আমি কি তোর পাশে বসতে পারি?

মুক্ত জায়গা যেখানে ইচ্ছে সেখানেই বসতে পারিস। অনুমতি নিষ্প্রয়োজন।

সাফিনের পাশে বসতে বসতে নূহা বলল, ঘটনা কি বলতো আজ এই বাড়ির মানুষজন সব এমন দলে দলে আমার উপর অভিমান করে বসে আছে কেন? যার কাছেই যাচ্ছি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আমার উপর থেকে। বাবা অভিমান করে আছেন গত মাসে একটিও চিঠি লিখিনি বলে। মামণি গাল ফুলিয়ে বসে আছেন গত সপ্তাহে পাঠানো নতুন ড্রেসটা পড়ে আসিনি কেন সেজন্য। আম্মির রেগে আগুন হয়ে আছেন উনার বান্ধবীর মেয়ের কাউন্সিলিং করার কথা বলেও কেন গত তিন সপ্তাহের মধ্যে সময় বের করতে পারলাম না। বাপী ভীষণ বিরক্ত বার বার বলার পরেও কেন শিশুদের জন্য কুরআন ও হাদীসের গল্প লেখা শুরু করছি না। স্টুডেন্টরা দল বেঁধে ম্যাসেজ পাঠানো বন্ধ করে বসে আছে। কারণ ওদের ম্যাসেজের জবাব দিতে পারিনা বেশির ভাগ সময়ই। বোনেরা এবং ভাবীদের কাছেও আমার উপর রেগে থাকার নিজ নিজ কারণ আছে। তোর কাছেও আছে জানি। আমার কাছেই আসলে কোন কারণ নেই সবাইকে খুশি রাখতে ব্যর্থ হবার।  

চোরের মায়ের বড় গলা প্রবাদটা তোর জন্যই লিখে রেখে গিয়েছেন কোন বিচক্ষণ ব্যক্তি। বুঝেছিস?

হুমম... দুনিয়ার সবার সবকিছু বোঝার জিম্মা নিয়েছি। না বুঝে যাবো কোথায়?

সাফিন হেসে বলল, তোর এই দুঃখী মানুষের অ্যাক্টিং গিয়ে অন্য কারো সাথে কর। হাড়ে হাড়ে চিনি তোকে আমি।
হেসে ফেললো নূহাও। এরপর বলল, আজ আমার সত্যিই মন খারাপ হয়েছে সবার আচরণে। সবাই মিলে একসাথে এত এক্সপেক্টটেশনের বোঝা চাপালে আমি কোথায় যাব বল? আমি তো আপ্রাণ চেষ্টা করি সবাইকে খুশি রাখতে, কাউকে ব্যথা না দিতে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমারো তো ইচ্ছে করে নির্বিঘ্নে কিছুটা সময় নিজের মতো করে কাটাতে। আমি কাজ করতে ভালোবাসি, ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করি। এর অর্থ তো এটা নয় আমার অবসরের কোন প্রয়োজন নেই। সবাই নিজ নিজ আবদার নিয়ে হাজির হয়। কারো আবদার রাখতে না পারলেই অভিমান করে বসে থাকে। ভেবে নেয় সবার কাজ করতে পারে শুধু আমি কিছু বললেই অবহেলা করে নূহা। প্রত্যেকেই এমন নিজের কথা ভাবে। কেউ ভাবে না নূহা তো একা একজন। আর একজনের পক্ষে সবার আবদার একসাথে পূরণ করা সম্ভব হবে না এটাই স্বাভাবিক। অথচ এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা কেউই বুঝতে চায় না। এমন কেন বলতো? মানুষ ধরে নেয় সবাই তাকে বুঝবে কিন্তু তাকেও যে অন্যদেরকে বোঝার প্রয়োজন আছে এই উপলব্ধিটা কেমন যেন এড়িয়ে চলে সবাই।

সাফিন হেসে বলল, আজ তো মনেহচ্ছে তুইও সবার উপর অভিমান করেছিস। আচ্ছা যা অভিমানে অভিমানে কাটাকাটি। চল দুই ভাইবোন মিলে গল্প করি। কথা বলছিস না কেন?বাড়িতে ঢোকার পর থেকে একের পর এক সবার অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিস বুঝি?

মুখে হাসি টেনে নূহা বলল, অনেক বছর আগে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছিলেন, জগতে ভালোবাসার কথা সবাই বলতে পারে কিন্তু ভালোবাসতে পারে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। তাই ভালোবাসার কথা কাউকে মুখে বলার চেয়ে, ভালোবেসে কিভাবে ভালোবাসতে তা শিখিয়ে দিও। আমি জ্ঞানী ব্যক্তির এই কথাটিকে গাইড লাইন বানিয়ে নিয়েছিলাম নিজের জন্য। মুখে না বলে সবাইকে ভালোবেসে ভালোবাসা বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করতে শুরু করেছিলাম। এই চেষ্টাটাই বিরাট এক গর্তে পরিণত হয়েছে আমার জন্য।

সাফিন হেসে বলল, সেটা কিভাবে?

এই যে এখন আর কাউকে ভালোবাসার কথা বলতে পারি না। চুপচাপ ভালোবেসে যেতেই ভালো লাগে। মনেহয় ভালো তো বাসিই, দোয়া তো করিই। শুধু শুধু বলার কি আছে? কিন্তু না বলারও সাইট অ্যাফেক্ট আছে। খুব কাছের মানুষেরাই যেখানে ভুল বোঝে। সেখানে দূরের মানুষদের ভুল না বোঝাটাই অস্বাভাবিক। যাইহোক, তোর কথা বল। কি বলতে চেয়েছিলে সেদিন?

তেমন সিরিয়াস কিছু না। এমনিতেই গল্প করতে ইচ্ছে করছিল তোর সাথে। মনে যখন বিষণ্ণতা্র মেঘ জমে, তোর কথা দমকা হাওয়ার কাজ করে। আমার বোঝা উচিত ছিল সবসময় চাইলেই দমকা হাওয়া হাজির হয়না। কখনো কখনো কালোর মেঘের ভারমুক্তির জন্য আকাশকে অঝর কাঁদতে হয়।  

আকাশ বুঝি অঝর কেঁদেছে?

সাফিন হেসে বলল, হুমম... ভীষণ। তবে এখন আকাশ রোদজ্জল আলহামদুলিল্লাহ। সাথে সাথে ঘন নীলের বুকে চলছে ধবধবে সাদা মেঘের রূপ বদলের খেলা।

নূহা চোখ বড় বড় করে বলল, হায় আল্লাহ! তাই তো দেখছি। ডান পাশের ঐ দিকটাকে তো থোকা থোকা সাদা মেঘের ফুলারন্য মনেহচ্ছে। আচ্ছা বাম দিকে লম্বা মতো ঐটা কি?

মেঘের লাঠি। তোকে ধোলাই দেবার জন্য রেডি হচ্ছে। হাসতে হাসতে বললো সাফিন। হাসিতে যোগ দিলো নূহাও। সম্মিলিত হাসির পরশে অভিমানের মেঘ সরে গিয়ে আনন্দের সূর্যালো ছড়িয়ে পড়লো আবারো সর্বত্র। কিছুক্ষণ দুই ভাইবোন নীরবেই আনন্দ স্নান সেরে নিলো। এরপর সাফিন বলল, ভাইজান সেদিন বলছিলেন নিজেকে আবারো উন্মুক্ত করার ব্যাপারে। আমি নিজেও আজকাল অনুভব করছি কেমন যেন আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে চিন্তাভাবনারা। আগে ইচ্ছে হলেই মনের অনুভূতিগুলোকে ফুলের মতো ফোঁটাতে পারতাম, পাখীর রূপে উড়াতে পারতাম, প্রজাপতির মতো বর্ণিল ডানা লাগিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন চেষ্টা করলেও নিজেকে ব্যক্ত করতে পারিনা। আজকাল আরেকটা সমস্যাও খুব হচ্ছে। বলতে যাই একটা কিন্তু বলে ফেলি আরেকটা। আইমিন, আমি ঠিক ভাবেই বলছি মনেহয় কিন্তু যাকে উদ্দেশ্যে করে বলি উনি কেন জানি না বুঝেই কষ্ট পান। বিশেষ করে আম্মুর সাথে এটা সবচেয়ে বেশি হয়। সবকিছু মিলিয়ে মাঝে মাঝে খুব দমবন্ধকর অনুভূতি হয়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাই আমি। তুই কি আমাকে সাহায্য করবি নিজেকে আবারো ব্যক্ত করতে?

নূহা বলল, ইনশাআল্লাহ অবশ্যই আমি তোকে সাহায্য করবো। নিজেকে ব্যক্ত করতে পারাটা আসলে  খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। অর্থাৎ, মনে চিন্তার যে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, তাকেই বাইরে বের করে নিয়ে আসা। যা ভাবছি সেটাই বলতে পারা বা শব্দে রুপ দিতে পারা। নিজেকে ব্যক্ত করার পথে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা নিজের সম্পর্কে অজ্ঞতা। আমরা আসলে ঠিকমতো জানিই না জীবনে কোন জিনিসটা না হলেই না, কোন জিনিসগুলো ছাড়াও দিব্যি কেটে যেতে পারে সময়। আবার কোন জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়, কোনগুলোকে চলে যেতে দেবার মধ্যেই কল্ল্যাণ। আমরা যোগ্যতা, দক্ষতা অর্জন করতে যেয়ে নিজেকে জানার, বোঝার ব্যাপারে উদাসীনই থেকে যাই। অথচ নিজের সম্পর্কে দক্ষ না হলে নিজেকে যথাযথ প্রকাশ ও উপস্থাপন করা যেমন সম্ভব হয় না। তেমনি নিজ জীবনের প্রায়োরিটি গুলোকেও বেছে নেয়া যায় না। তারউপর আবার আছে ভুল প্রকাশ ও উপস্থাপনের ঝক্কি। কথা, কাজ বা আচরণে উনিশ থেকে বিশ হলেই মানুষের মনে ভুল ধারণা তৈরি হয়ে যায়। তাই নিজেকে সঠিক ভাবে ব্যক্ত করার জন্য ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে তোকে। যেমন ধর  প্রচুর পড়া। অনেক সময় শব্দ ভান্ডারের সল্পতা কিংবা সঠিক শব্দ বাছাই করতে না পারার কারণেও মনের ভাব সম্পূর্ণ রুপে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। মনের ভাবনা গুলোকে যথাযথ প্রকাশের জন্য সঠিক শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগ করতে পারাটা খুবই জরুরি। তাই এক্ষেত্রে পড়ার কোন বিকল্প নেই।

হুমম, আফরা চলে যাবার পর আমার জ্ঞানার্জনের আগ্রহটাও কোথায় যেন বিলীন হয়ে গিয়েছে। বই খুলে বসলেও শুধুমাত্র তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করা হয়না।

সেজন্যই তো তোর জন্য বই নিয়ে এসেছি। আমি মূলত তোকে এই বইগুলো দিতেই এসেছিলাম। হাতে ধরে থাকা বইগুলো সাফিনের দিকে বাড়িয়ে ধরে হাসি মুখে নূহা বলল, তোর মনেআছে  ছোটবেলায় পরিবারের সবাই মিলে সমুদ্র ভ্রমণে গিয়েছিলাম আমরা? একদিন বিকেলে বাবার হাত ধরে বীচে খালি পায়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ পায়ের নীচে একটা ছোট্ট নুড়ি পাথর এসে পড়াতে চিৎকার করে উঠেছিলাম ব্যথায়। বাবা বসে আমার পায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে হাসি মুখে বলেছিলেন, হঠাৎ একটা স্বপ্ন মনে উঁকি দিয়ে গেলো বুঝলি মা। প্রশ্ন করেছিলাম, কি স্বপ্ন বাবা? বাবা হেসে জবাব দিয়েছিলেন, তুই আর আমি এমন হাত ধরে জ্ঞানোসমুদ্রের বীচে হাঁটছি। আমাদের চলার পথে একটু পর পরই ছোট বড় মাঝারি নানান সাইজের জ্ঞানের নুড়ি পাথর এসে হাজির হচ্ছে। আর তুই উচ্ছ্বাসিত হয়ে সেই নুড়িটা তুলে নিয়ে সমৃদ্ধ করছিস জীবনের জ্ঞানো ভান্ডার।

সাফিন হেসে বলল, আমাদের ফুপাজান মাশাআল্লাহ বিরাট একজন স্বপ্নবাজ মানুষ।

আলহামদুলিল্লাহ! একই সাথে বাবা স্বপ্নের মালীও। শুধু নিজে স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত হন না। অন্যের মনেও স্বপ্ন বুনে দিয়ে পরিচর্যায় দ্বারা বেড়ে উঠতেও সাহায্য করতেন। আমার মনে জ্ঞানানন্দে ডানা মেলার স্বপ্নটাও বাবারই দেয়া ছিল। যদিও বাবা ছাড়াও আরো একাধিক মালীর পরিচর্যার ছোঁয়া লেগেছে আমার সেই স্বপ্নে। তবে বাবা তাদের সবার চেয়ে সবসময়ই স্পেশাল ছিলেন। বাবার সাথে ঘুরতে বের হলে এক জিনিস সবসময়ই কমন ছিল। ঘুরতে বেরোলে অবশ্যই অবশ্যই বই কেনা। মূলত বই কেনার উদ্দেশ্যেই আমি আর বাবা একা একা ঘুরতে বের হতাম। আমাদের এই ভ্রমণ আবার মামণির অতি মাত্রায় অপছন্দ ছিল। বই কেনা নিয়ে অবশ্য মামণির আপত্তি ছিল না। মামণির বিরক্তির কারণ ছিল বাড়িতে ফিরেই আমি আর বাবা সদ্য কেনা বইয়ের ভেতরে ঢুকে যেতাম। জানিস আমার আর বাবার মধ্যে বই পড়ার ব্যাপারে গোপন একটা চুক্তি ছিল। চুক্তিটি হচ্ছে, বই থেকে নতুন কি শিখলাম, জানলাম। অর্থাৎ, জ্ঞানো ভান্ডারে নতুন কি রত্ম যোগ হলো সেটা  একে অন্যেকে জানানো। আমাদের পিতা-কন্যার কত রাত যে পাড় হয়ে গিয়েছে নতুন অর্জিত রত্নটির চমক মূল্যায়নের গবেষণাতে। মামণি মুখে মুখে যতই রাগ করুক না কেন। সারাক্ষণই ছায়ায় মতো লেগে থাকতেন বাবা আর আমার পেছনে। এবং একটু পরপরই হুমকি দিতেন বাড়ির লাইব্রেরী আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেবার।

সাফিন হেসে ফেলে বলল, তোর সাথে ফুপ্পির চিৎকার চেঁচামেচি গুলো সত্যিই মিস করি।

নূহা হেসে বলল, আমিও মিস করি। বাবার সাথে জ্ঞানার্জনের সফরটাকেও খুব মিস করি। অনেক বছর হয়ে গিয়েছে বাবার সাথে একাকী ঘুরতে বের হওয়া হয়ে ওঠেনি। চলার পথের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞানের নুড়ি পাথর তুলে নেয়া হয়নি। জ্ঞানানন্দে ডুবে থেকে রাত গড়িয়ে ভোরের পথে যাত্রা শুরু করেনি। যাইহোক, তোর উপর দিয়ে যে ঝড়টা গিয়েছে তাতে মন বাগিচার সমস্ত ফুল পাখী প্রজাপতি ঝরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। আলহামদুলিল্লাহ এখন যেহেতু শূন্যতার হাহাকার থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছে তোর মনে। আবারো নতুন করে ফুল পাখীর গুঞ্জরন তুলে যাবে তোর মনে ইনশাআল্লাহ। এজন্য নিজেকে জানার জন্য, বোঝার জন্য তোকে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে, চিন্তা ও গবেষণা করতে হবে। এইক্ষেত্রে সবচেয়ে একটা পদ্ধতি হচ্ছে, নিজের চিন্তা-ভাবনা গুলোকে লেখা। হতে পারে ডায়েরী লেখা, গল্প-কবিতা লেখা। কখনো প্রকৃতির কোলে বসে মনের মাধুরি মিশিয়ে তার সৌন্দর্য বর্ণনের চেষ্টা করা। এভাবে ধীরে ধীরে মনের চিন্তা- ভাবনাকে আয়ত্ত্বে আনা সম্ভব হয়। চল এখনই দুজন মিলে ট্রাই করি।

কি ট্রাই করবো?

নূহা হেসে বলল, প্রকৃতিকে নিজের মাঝে করে ধারণ, ভাবনার রসে সিক্ত করে করো বর্ণন। নীলাকাশের বুকে ভাসছে যেমন সাদা মেঘের ভেলা, শব্দে শব্দে হয়ে যাক তাদের নিয়ে চড়ুইভাতি খেলা।

সাফিন হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ আবারো খেলবো তোর সাথে শব্দে শব্দে ভাবনার চড়ুইভাতি। তবে তারআগে নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নেই। আরেকটু সময় দে আমাকে।

নূহা হেসে বলল, ওকে সময় দেয়া হলো। তুই প্রকৃতির মাঝ থেকে নিজের ভাবনাদের তুলে নেবার চেষ্টা করতে থাক। আমি ততক্ষণে আমার কন্যার সাথে দেখা করে আসি। উনিও অভিমান করে বসে আছেন।

নূহাকে বিদায় জানিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর পাশ থেকে একটি বই তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে মেলে ধরলো সাফিন চোখের সম্মুখে। শুধু বই না সাথে ছোট্ট একটা কবিতাও উপহার দিয়ে গিয়েছিল নূহা...

বই যার নিত্যদিনের সাথী
অন্তরে তার ফুল, পাখী, প্রজাপতি
বচন যার প্রশান্ত ছায়াবীথি,
আশার আলোতে জ্বালায় সে জ্যোতি
পুষ্পিত চিন্তারা তার মন বাগিচায় দোলে
আঁধার আকাশে জোছনার দ্বার সে খোলে
হৃদমাজারে জ্বলে যার জ্ঞানের দিয়া,
সত্য ও সুন্দরের আবাসভূমি তার হিয়া
পথে পথে বুনে চলে সে নতুন সম্ভাবনা,
তুলির স্পর্শে আঁকে সুন্দর পৃথিবীর আল্পনা......

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৬



তন্দ্রাভাব এসে দস্তক রাখতে না রাখতেই হঠাৎ মুখে ঠান্ডা কিছুর ছিটা অনুভব করে খানিকটা চমকে উঠে চোখ খুলে তাকালো জাওয়াদ। চেহারায় হাত বুলিয়ে বুঝতে পারলো ঠান্ডা পানিতে মাখামাখি হয়ে আছে। আশেপাশে কেউ না থাকলেও পর্দায় পেছনে নাড়াচাড়া দেখে জাওয়াদের বুঝতে মোটেই কষ্ট হলো না এই দুষ্টু কাজটি কার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। উঠে বিছানাতে হেলান দিয়ে বসতে বসতে বলল, জিশান দুষ্টু ছেলে কান টেনে ছিঁড়ে দেবো তোমার।

সাথে সাথে বিশাল হাসি দিয়ে এক লাফে পর্দার আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো জিশান। এবং দ্বিতীয় লাফে পাপার কোলের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাসতে হাসতে বলল, গুড মর্নিং মোষ্ট হ্যান্ডসাম এন্ড সুইটু পাপা ইন দ্য ওয়াল্ড।  

ছেলের কান টেনে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জাওয়াদ বলল, গুড মর্নিং মোষ্ট দুষ্টু এন্ড কিউটু সান ইন দ্য ওয়াল্ড।

জিশান হাসি আনন্দ ভরা কন্ঠে বলল, পাপা আই লাভ ইউ এত্তোগুলা।

আই লাভ ইউ টু তত্তোগুলা। এখন আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও।

পাপা তুমি শুধু প্রশ্নটা করো। সাথে সাথে জিশান জবাব দিয়ে দেবে ইনশাআল্লাহ।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমস্ত দুষ্টুমি করা জিশান কবে ছাড়বে?

জবাব হচ্ছে, জিশান প্রায়ই দুষ্টুমি ছেড়ে দেবার কথা ভাবে। কিন্তু পাপার সাথে দুষ্টুমি করা জিশানের কাছে অক্সিজেনের মতো। মানুষ যেমন অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না। জিশান তেমন পাপার সাথে দুষ্টুমি করা ছাড়া থাকতে পারে না। আবার স্ব ইচ্ছায় অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে নিজের উপর জুলুম করলে তো আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে। এখন তুমিই বলো জিশান ছোট বাচ্চাটা কি করবে?

জাওয়াদ হেসে বলল, দুষ্টুর সাথে সাথে কথার মারপ্যাঁচও তো ভালোই শিখেছে জিশান। মা’র বাসায় গিয়ে কি প্যাঁচালো কথার ট্রেনিং নেয়া হচ্ছে নাকি আজকাল।

জিশান হেসে ফেলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে মূহুর্তেই চেহারাতে গুরুগম্ভীর ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, এভরিথিং ইজ ডান। বাট আমার সোনা মা’র ব্যাপারে ব্যাড কমেন্ট নট ডান। নেভার এভার ডান। আন্ডাসট্যান্ড?

জাওয়াদ হেসে বলল, ইয়েস স্যার। ব্যাড কমেন্ট উইথড্রো করা হলো। এখন বলেন আপনার ভাই বোন কোথায়?

জিশান হেসে বলল, গুড বয় ভাইয়া পড়ছে আর অ্যাংরি গার্ল নাবিহা নাস্তা বানাচ্ছে।

নাবিহা একা একা নাস্তা বানাচ্ছে? চলো আমরা যাই ওকে সাহায্য করবো।

আমি গিয়েছিলাম তো পাপা সাহায্য করতে। নাবিহা ধমক দিয়ে বের করে দিয়েছে কিচেন থেকে। আর যাবো না ওকে সাহায্য করতে। তাছাড়া এখন সাইন্স চ্যানেলে আমার ফ্রেব্রেট শো লিটল সায়েন্টিস্ট শুরু হবে।    

বিছানা থেকে নামতে নামতে জাওয়াদ বলল, ওকে মাই লিটল সায়েন্টিস্ট আপনি আপনার ফ্রেব্রেট শো দেখেন। আমি যাচ্ছি আমার কন্যাকে সাহায্য করার জন্য। রুম থেকে বেড়িয়ে কিচেনে যাবার পথে দরজা খোলা দেখে জিহাদের রুমে উঁকি দিলো জাওয়াদ। জ্ঞানার্জনে গভীর আত্মমগ্ন পুত্রের দিকে হাসি ফুটে উঠলো মুখে। দুর্বোধ্য জিনিসগুলোও সময়ের ব্যবধানে কত সহজ স্বাভাবিক রূপেই না ধরা দেয়। ত্রিশ বছর আগে বাবা কেন আড়াল থেকে মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিতে থাকেন কিছুতেই বোধগম্য হতো না। কিন্তু আজ নিজে পিতার স্থানে দাঁড়িয়ে অজানা যেই রহস্যের সমাধান উপলব্ধির করায়ত্ত। ঠিক তেমনি বর্তমানের অনেক রহস্য, অনেক অজানা প্রশ্নের জবাব হয়তো প্রতীক্ষমাণ ভবিষ্যতের কোন এক মোড়ে। আসলেই সময়কে সময় দিতে পারলেই জীবনের অধিকাংশ রহস্য আঁধারের পর্দা ভেদ করে আলোয় উদ্ভাসিত হয়।

কিচেনের দরজায় নক হিবার শব্দ শুনে ঘুরে তাকিয়ে পাপাকে দেখতে পেয়ে আনন্দ চিকচিক করে উঠলো নাবিহার দু’চোখে। সালাম দিয়ে হাসি মুখে বলল, ভেতরে এসো পাপা।

সালামের জবাব দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জাওয়াদ বলল, আমার মা নাকি একা একা নাস্তা বানাচ্ছে? পাপাকে কেন ডাকেনি?

নাবিহা হেসে বলল, তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। আমি আজ ছোটবেলায় আমাদের খুব পছন্দের একটা নাস্তা বানাচ্ছি। তুমি যে আমাদেরকে ছোট ছোট স্যান্ডুইচ বানিয়ে দিতে সেই নাস্তাটা।

জাওয়াদ হেসে বলল, এটা তো আমারো অনেক পছন্দের নাস্তা। চলো দুজন মিলে বানাই। তাহলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।
নাবিহা হেসে বলল, নাস্তা বানানো শেষ তো পাপা। এখন শুধু টেবিলে সাজাতে হবে। তুমি তাহলে নাস্তা টেবিলে দাও। আমি নানাভাই দাদাভাইদেরকে স্যান্ডুইচ দিয়ে আসি।

নাবিহা বেরিয়ে যাবার পর টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে দুই ছেলেকে ডাকলো জাওয়াদ। ডাক দেবার প্রায় সাথে সাথে জিহাদ চলে এলেও ফেব্রেট শো থেকে উঠিয়ে আনার জন্য বেশ কয়েকবার ডাকতে হলো জিশানকে। নাস্তা টেবিলে এসে বসতে বসতে জিশান বলল, জানো পাপা সাইন্স চ্যানেলে নতুন একটা প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। আর ইউ গুড অর ইভিল ফাটাফাটি সব কথাবার্তা বললো প্রোগ্রামটাতে। বুঝলে পাপা মানুষের মধ্যে ভালো ও মন্দ দুটা স্বত্বাই থাকে। পরিবেশ ও জেনেটিক সমস্যা মিলিয়ে কিছু মানুষ ইভিল হয়ে যায় আর কিছু মানুষ ফাটাফাটি ভালো হয়ে যায়।

জাওয়াদ বললেন,একথা প্রোগ্রামে বলেছে?  

জিশান মুখ খোলার আগেই জিহাদ বলল,পাপা সত্যিই কি একজন খুব খারাপ মানুষের সন্তানদের জেনেটিক ভাবেই খারাপ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে?  

জাওয়াদ হেসে বললেন, ভালো ও মন্দের সমন্বয়েই প্রতিটি মানুষ। তাই সম্ভাবনা উভয়টারই থাকে। তবে একটি শিশু যদি জন্মের পর থেকে খুব ভালোবাসাময়,সুন্দর ও পবিত্র পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠে। তাহলে জেনেটিক প্রভাব মুক্ত থাকাটা খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। ঠিক তেমনি একজন অতি উত্তম মানুষের সন্তান যদি খুবই নেতিবাচক কোন পরিবেশে,অর্থাৎ,ঘৃণা,অনৈকতা,অবহেলা ইত্যাদি পেতে পেতে বড় হয়। তাহলে তার অ্যান্টিসোশ্যাল হবার সম্ভাবনাই বেশি।

জিহাদ বলল,তার মানে জেনেটিক ফ্যাক্টরের চেয়ে এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাক্টর বেশি ইম্পটেন্ট। পরিবেশের প্রভাবে খুব খারাপ কেউও ভালো হয়ে যেতে পারে। ঠিক তেমনি খুব ভালো কেউ হয়ে যেতে পারে খারাপ।

জিশান বলল,তবে ভালোর চেয়ে খারাপ হওয়াটা বেশি সহজ তাই না পাপা?  

জাওয়াদ হেসে বললেন,গোঁড়ায় গলদ বলে একটা কথা আছে। এরমানে হচ্ছে,বীজ কিংবা অঙ্কুরেই যদি সমস্যা থাকে,তাহলে যথাযথ ও পর্যাপ্ত পরিচর্যার পরেও আশানুরূপ ফসল উৎপাদন সম্ভব হয় না। তাই গোঁড়া থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,মানুষের গোঁড়াটা কোথায়?  

জিশান হাত উঁচু করে বলল,মানুষের গোঁড়া হচ্ছে,শৈশব। একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে একটি বীজের মতো থাকে। রাইট পাপা?

স্যরি রাইট বলতে পারছি না। একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে বীজ থেকে চারা গাছে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
জিহাদ বলল,তারমানে মানুষের গোঁড়া হচ্ছে তার বাবা-মা। তাই না পাপা?  

জাওয়াদ হেসে বললেন,রাইট। একটি উৎকৃষ্ট বীজের জন্য ভালো মানের বৃক্ষ হওয়াটাও জরুরি। শুদ্ধতার সফর তাই বীজ থেকে নয়। বীজ উৎপাদিত হয় যে গাছ থেকে। সেই গাছ থেকেই শুরু করতে হয়।

জিশান বলল,আরেকটু সহজ করে বলো না পাপা প্লিজ।

ওকে সহজ করেই বলছি। আমাদের ছোটবেলার একটা গল্প বলি তোমাদেরকে। আমরা তখন গ্রামে থাকতাম। আমাদের একজন প্রতিবেশী চাচা ছিলেন। উনার চার ছেলে ছিল। সেই চার ছেলে নিয়ে উনি সারাক্ষণই একটা কম্পিটিশনের মুডে থাকতেন আমাদের বাবা-পাপাদের সাথে। খুব গর্ব করতেন নিজের সন্তানদের নিয়ে। অবশ্য উনার চার ছেলে বেশ বাধ্য ও অনুগত ছিল বাবা-মার। উনারা যা বলতেন ছেলেরা তাই শুনতো। আমরা পাঁচ ভাই মোটেই তেমন ছিলাম না। তখনো বাবা-মায়েদের কোন কথা যদি আমাদের কাছে সঠিক মনে না হতো। আমরা তীব্র বিরোধ করতাম। আমাদের চোখের সামনে কেউ অন্যায় করলে সে বয়সে ছোট নাকি বড় সেই চিন্তা না করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম। আমরা তাই গ্রামের অতি অবাধ্য ছেলে হিসেবেই পরিচিত ছিলাম। কিন্তু প্রতিবেশি ঐ চাচার চার ছেলের খুব সুনাম ছিল গ্রাম জুড়ে। ক্লাস সিক্সে ওঠার পরই আমরা ঢাকায় চলে এসেছিলাম। এর কয়েক বছর পর দেশের বাইরে। সবকিছু মিলিয়ে অনেক বছর গ্রামে যাওয়া হয়নি আমাদের। এরপর যখন গ্রামে গিয়েছিলাম আমাদের বয়স বিশের কাছাকাছি ছিল। ঐ সময় গ্রাম জুড়ে প্রতিবেশী সেই চাচার ছেলেদের অনৈতিক কর্মকান্ডের কথা ভেসে বেড়াতো। কিন্তু ঐ চাচা-চাচী কিছুতেই সেসব কথা বিশ্বাস করতেন না। কারণ তারা তাদের সন্তানদেরকে সবসময়ই ভালো সন্তান হিসেবেই পেয়েছে। সমস্যাটা তাহলে কোথায় হয়েছে? সমস্যাটা হচ্ছে,ভালো সন্তান বলতে উনারা শুধু পিতামাতার বাধ্য ও অনুগত এই ব্যাপারটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু ভালো মানুষের সংজ্ঞা এত ক্ষুদ্র নয়। কেউ যখন মানসিক ও আত্মিক দিক থেকে উন্নত ও পবিত্র থাকে। এবং মানবিক গুণাবলীতে সজ্জিত থাকে।  তাকেই কেবল একজন আদর্শ মানুষ বলা যায়।

আরো সহজ করে বলো পাপা। অনুরোধের স্বরে বললো জিশান।

আমি তো বলতে চেষ্টা করছি বাবা। একটু ধৈর্য্য ধরে পাপার সম্পূর্ণ কথা শুনতে হবে বোঝার জন্য।

জিশান হেসে বলল,আচ্ছা আর কথা বলবো না মাঝখানে।

আমার পরিচিত এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের শরীয়তের জ্ঞান যথেষ্ট। চর্চাও করেন শরীয়তের বিধি বিধানের। তারা ফিজিক্যালি কোন মানুষকে আঘাত করেন না কখনোই। কিন্তু প্রায়ই অতি ক্ষুদ্র কারণে মানুষকে ইমোশনালি বিধ্বস্ত করে দেন পুরোপুরি। এবং এদের মধ্যে অনেকেই অন্যের ভালো করছেন ভেবেই তাকে আঘাতের পর আঘাত করে। এর কারণ তাদের অনুভূতি আছে কিন্তু সহানুভূতি নেই। তাদের চিন্তার গন্ডি খুবই সংকীর্ণ। যেমন,আমার সন্তান শুধু আমার বাধ্য ও অনুগত হলেই উত্তম মানুষের সার্টিফিকেট ধারী হয়ে যায় না। অন্যের সাথে তার ভারসাম্যপূর্ণ আচরণও জরুরি। আমি অবশ্যই ভুল কাউকে সংশোধনের লক্ষ্যে কিছু বলতে পারি। কিন্তু তাকে কখনোই আমি মানসিক ভাবে আঘাত করতে পারিনা।

জিহাদ বলল,আমরা অন্যকে অনুভব করার চেষ্টা করি না বা পারি না বলেই,খুব সহজে আঘাত করতে পারি। তাই না পাপা?

হুম! নিজের কষ্টের আয়নায় যদি অন্যের প্রতিচ্ছবি দেখার চেষ্টা করতে পারতাম। তাহলে আমাদের প্রতিটা কথা, কাজ ও আচরণ অন্যের তরে কল্ল্যাণকামী হয়ে যেত। যাইহোক,যা বলছিলাম। আমাদের বাড়ি থেকে বাজারের দিকে যাবার পথে একটা স্থানে লাল পিঁপড়ার বাসা ছিল। আমি যতদিন বাবার সাথে বাজারে গিয়েছি। সবসময় দেখেছি বাবা খুব সাবধানে প্রতিটা কদম ফেলতেন ঐ স্থানটা পাড় হবার আগ পর্যন্ত। বাবা সতর্ক থাকতেন কোন  ভাবেই যাতে পায়ের নিচে একটা পিঁপড়া চলে না আসে। বাবা কখনোই মুখে আমাকে কিছুই বলেননি। কিন্তু  বাবাকে দেখে আমিও রপ্ত করে নিয়েছিলাম ছোট্ট ঐ প্রাণীটির প্রতি সহানুভূতির প্রদর্শন। যাদের অ্যাফেক্টিভ এমপ্যাথি। অর্থাৎ,যারা অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা অন্যের দুঃখ কষ্ট ব্যথা সহ্য করতে পারে না। অন্যের দুঃখকে নিজের মত করে অনুভব করে ব্যথিত হয়ে ওঠে। অন্যের কষ্টে তাদের চোখ ভিজে ওঠে। অন্যের ভালোর চিন্তায় তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু যাদের এই এমপ্যাথি থাকে না। তারা অবলীলায় অন্যকে আঘাত,কষ্ট দিতে পারে। অন্যায়,অপকর্ম করতে পারে। তাই ছোটবেলা থেকেই এমপ্যাথির উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে এর ঘাটতি দেখা দেবেই স্বভাব,চরিত্রে।    

এমপ্যাথির উন্নয়ন ঘটানোর জন্য আমাদেরকে কি করতে হবে পাপা? প্রশ্ন করলো জিহাদ।

প্রতিদিন তোমার ভেতরের এমপ্যাথি ব্যবহার করতে হবে। চলার পথে আমার পায়ের নীচে যখন একটা শুকনো পাতাও উড়ে আসে। আমি চেষ্টা করি সেটাকে না মাড়িয়ে পথ চলতে। কি দরকার বৃক্ষের কোল থেকে ঝরে পরা শুষ্ক পাতাটিকে গুঁড়িয়ে দেবার? মোটকথা,মানবিক গুণাবলীর চর্চা থেকে এক মূহুর্তের জন্যও বিরত থাকা চলবে না। কারণ কারো ভেতর যখন মানবিক গুণাবলীর চর্চা হ্রাস পায়। ধীরে ধীরে তার মনুষত্ব্য ক্ষয় হতে শুরু করে।    

জিশান হেসে বলল,আলহামদুলিল্লাহ এবার বুঝতে পেরেছি। আমাদেরকে সহনুভূতিশীল ও দরদী হতে হবে। তাহলে আমরা অন্যায় করা থেকে,মানুষকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারবো। এবং আমাদের মধ্যের ইভিলকে ধ্বংস করে ফাটাফাটি ভালো মানুষ হয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।  

জাওয়াদ হেসে বললেন,তোমার সহানুভূতিশীলতার একটা উদাহরণ শোনাও আমাদেরকে।  

জিশান বলল,আমার ফেব্রেট প্রোগ্রাম চলছে। কিন্তু দেখো আমি তোমাকে কোম্পানি দিতে চলে এসেছি। প্রোগ্রাম যখন আবার রিপিট হবে তখন দেখে নেবো। কিন্তু আমার পাপা আর ভাইবোন একা একা খাবে এটা সহ্য করা আমার পক্ষে ইমপসিবল। এবার বুঝেছো তো আমি কত্তো সহানূভুতিশীল?

জিহাদ হেসে কুটিকুটি হলো জিশানেরর উদাহরণ শুনে। জাওয়াদও হেসে ফেলে ছেলের কান টেনে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,এই সমস্ত উদাহরণ যখন দেবে তখন আমার হাতের কাছ থেকে নিরাপদ দুরুত্বে থাকার চেষ্টা করবে। নয়তো কবে দেখবে তোমার চেহারা আছে কিন্তু দুইপাশ থেকে কান দুটা ঘায়েব হয়ে গিয়েছে।    

হুমকিতে ভয় পাওয়ার বলদে হাসতে হাসতে একদম পাপার গায়ে গড়িয়ে পড়লো জিশান। হাসিতে যোদগ দিল জাওয়াদ আর জিহাদও।

নাবিহা ঢুকে সবাইকে হাস্যরত দেখে মুখ গোমড়া করে গাল ফুলিয়ে বলল, আমি একটুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছি আর সবাই একা একা আনন্দ করতে শুরু করে দিয়েছে।

জাওয়াদ হেসে বলল, নাবিহাকে ছাড়া আনন্দ? এটা তো পসিবলই না। আপনি মনেহয় ভুলে গিয়েছেন সল্টি বেবী লবণ ছাড়া যেমন সবকিছু ফিকা, আপনাকে ছাড়া তেমন আমাদের আনন্দরাও ভবঘুরে একা।

চেয়ার টেনে সবার সাথে বসতে বসতে নাহিয়া বলল, তাহলে বলা হোক কেন সবাই হাসছিল এতক্ষণ। জিহাদ হাসি মুখে এতক্ষণের আলোচনার বিষয়বস্তু খুলে বললো বোনকে। শোনার পর নাবিহা বলল, পাপা এমপ্যাথি সম্পর্কে আরো বুঝিয়ে বলো আমাদেরকে।

একটুক্ষণ চুপ থেকে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল,  পৃথিবীর সমস্ত কিছুর উর্দ্ধে আমার কাছে আশরাফুল মখলুকাত হিসেবে জন্মগ্রহণ করার  পর,আশরাফুল মখলুকাত হয়েই বিচরণ করা এবং আশরাফুল মখলুকাত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই অন্যকে খালি চোখে দেখলেও,নিজেকে সর্বদা মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে দেখতে সচেষ্ট থাকি। কারণ যে মানুষ মানবীক গুণাবলীর চর্চা থেকে দূরে সরে যায়। তার মনুষ্যত্বও ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করে। হিউম্যান সাইকোলজির উপর বিশেষ কিছু কোর্স করার আগে এই বোধটা হয়তো আমার ভেতর এমন ভাবে ছিল না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমি সহানুভূতিশীল ও দরদী মনের মানুষ হবার শিক্ষা পেয়েছিলাম অভিভাবকগণের কাছ থেকে। আলহামদুলিল্লাহ! আমি দরদী ছিলাম মানুষ থেকে নিয়ে শুরু করে ছোট্ট একটা পিঁপড়া,এমনকি প্রতিটি ঝরা পাতার প্রতিও। আমার এমপ্যাথি প্রবল ছিল তাই জ্ঞানত দূর থাকার চেষ্টা করতাম খারাপ কথা,কাজ ও আচরণ থেকে,অন্যকে কষ্ট দেয়া থেকে,সব ধরনের অন্যায় থেকে। এর মানে আবার এটা নয় যে,একেবারে বিশুদ্ধ একজন মানুষ ছিলাম। এমন অসংখ্য কাজ করেছি যা হয়তো  সঠিক ছিল না। কিন্তু সেসব অজান্তে করেছি। এবং জানার সাথে সাথে নিজেকে সংশোধন করার সাধনায় রত হয়েছি। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে আসার পর। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার অফুরন্ত নেয়ামতে ছায়াতলে আশ্রয় পাবার পর। নিজেকে আর কোন ভুলের স্রোতে ভাসতে দিতে নারাজ আমি। তাই প্রতিটা কথা,কাজ ও আচরণ করার আগে মনুষ্যত্বের আয়নায় নিজেকে একবার করে দেখে নেই। আমার দৃষ্টিতে এটাই এমপ্যাথি।

ইনশাআল্লাহ আমাদের দৃষ্টিতেও আজ থেকে এটাই এমপ্যাথি। নাবিহা, জিহাদ, জিশান একসাথে বললো।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এখন চলো সবাই আগে নিজ নিজ নাস্তা শেষ করি।

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৫


চোখের সামনে প্রশ্নপত্র মেলে ধরতেই স্বস্থির হাসি ফুটে উঠলো সাহিলের মুখে। ভাইজান বলেছিলেন প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পেলেই বাকি প্রশ্নের জবাবগুলোও পেয়ে যাবে। এক সপ্তাহ অনেক ভাবার পর তার জীবনের লক্ষ্য কি প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিল সাহিল। একজন মুসলিমের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত চিন্তা ও কর্মের দ্বারা দুনিয়াতে কল্যাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আখিরাতে জান্নাত প্রাপ্তি। এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাবার সাথে সাথেই ম্যাজিকাল একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো সাহিল। বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে তার আর মোটেই কষ্ট হচ্ছে না। সময়কে কাজে লাগিয়েই দুনিয়াতে কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুতরাং, সময় তার কাছে এমন এক নেয়ামত যার যথাযোগ্য ব্যবহার সুগম করবে তার অভিষ্ট লক্ষ্য পানে চলা পথকে। আর এরজন্য তাকে রুটিন মেনে চলতেই হবে। এখানে পছন্দ বা অপছন্দের কোন অবকাশই নেই। মানুষের জীবনের কল্যাণকর সবকিছুর সূচনা জ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব বলেই হয়তো মানুষের উদ্দেশ্যে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তায়ালার বলা প্রথম শব্দটি ছিল “পড়ো”। আল্লাহ তায়ালার প্রথম নির্দেশ হচ্ছে পড়া। তাই পড়াশোনাকে ভালো লাগা ছাড়া জীবন তো বৃথা। আর সাহিল চায় না তার জীবনকে বৃথা যেতে দিতে। এরপর থেকে ক্লাসের বইয়ের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব সহকারে সাহিল ইসলামী সাহিত্য, ইসলামের ইতিহাস, মনীষীদের জীবনী পড়তে শুরু করেছে। কুরআন, হাদীস, তাফসীর আগে পড়তে হবে তাই পড়তো কিন্তু এখন অন্তর থেকে ভালোবেসে পড়ে। এমন প্রতিটা প্রশ্নের জবাবই সাহিল খুব সহজেই খুঁজে পেলো যখন শরীয়তের আলোকে চিন্তা করলো।

হঠাৎ যদি কোনদিন খাবারের টেবিল সামান্য এলোমেলো দেখে খাবার নিয়ে নিজের রুমে চলে যায় সাহিল। আর বাড়িতে যেদিন স্পেশাল কোন মেহমান আসে খাবারের আইটেমগুলোর চেহারাই বদলে যায়। গার্নিশিং প্রতিটা খাবারের শোভা বর্ধন করে একশো গুণ বেশি। সেদিন খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মনেহয় যেন ক্ষুধা মিটে যায়। শরীরের খোড়াকের সৌন্দর্য যেখানে মনের উপর এমন প্রভাব ফেলে। যেখানে সেই মনের খাবারের সৌন্দর্য অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আগে নিজের রুম এলোমেলো করে রাখতো। কিন্তু যেদিন থেকে তার ঘরের পরিবেশ সুন্দর সাজানো গোছানো। সেদিন থেকে মনও অনেক প্রফুল্ল লাগে। আগে একটা বই খুঁজতে হলে দশটা নামিয়ে দেখতে হতো। এই খোঁজার আলসেমির কারণেও অনেক সময় পড়তে বসা হতো না। কিন্তু এখন পড়াশোনার সমস্ত উপকরণ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। পরিবারের গুরুত্বও অনুধাবন করেছে। জীবনের চলার পথে পরিবার প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে ট্র্যাফিক সিগন্যাল আর স্টীট লাইটের মত। হলুদ বাতি জ্বালিয়ে সাবধান করা, লালবাতি জ্বালিয়ে থামতে বলা আর সবুজ বাতি জ্বালিয়ে বুঝিয়ে দেয়া যে এগিয়ে যাও তোমার চলার পথ এখন নিরাপদ। আর আঁধারে স্টীট লাইটের মত আলোকিত করে পথ। অনেক চিন্তাভাবনার পর সাহিল উপলব্ধি করেছে, তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সে নিজেই। কারণ সে আছে বলেই তার জীবন আছে। আর জীবন আছে বলেই তো এত হিসাব নিকাশের প্রয়োজনীয়তা।

কিছুটা কষ্ট হচ্ছে অনলাইন জগতের অভ্যাসটি কমাতে। তবে এই ব্যাপারে একদমই তাড়াহুড়া করছে না সাহিল। আস্তে আস্তে অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। আগে যেখানে চার-পাঁচ ঘন্টা  সময় কাটাতো। এখন প্রতিদিন চেষ্টা করছে বিশ মিনিট, আধ ঘন্টা করে কমিয়ে আনার। আরো  কমানোর চেষ্টা জারি রেখেছে। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ হয়ে যাবার পর পড়াশোনায়ও মনোযোগ বাড়তে শুরু করেছে। মনোযোগের ব্যাপারে নূহা আপা বলেছিল, এটা একশো ভাগ ঠিক যে মনোযোগ সহকারে না পড়লে কখনোই জ্ঞানার্জনে বরকত আসে না। মনোযোগ কেন আসে না জানিস? কারণ মনের সামনে একাগ্র হবার মত কোন লক্ষ্য থাকে না। যেমন ধর তুই যখন পরীক্ষার হলে। প্রশ্নপত্র হাতে পাবার পর তুই কি করবি? সবকিছু ভুলে ঝাপিয়ে পড়বি উত্তর লিখতে। কারণ তোর হাতে সময় মাত্র দুইঘন্টা। এরমধ্যে সব প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে। এমন অবস্থায় কিন্তু কখনোই তোর মনে অন্যকোন চিন্তা জায়গা করে নিতে পারবে না। তোর ইচ্ছে করবে না ফেসবুকে ঢুকতে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে কিংবা একটু ঘুমিয়ে নিতে। কারণ তোর লক্ষ্য নির্ধারিত এবং তোর কাছে সেটা স্পষ্টও। আসলে আমরা মনোযোগ আনতে পারি না বা ধরে রাখতে পারি না এর কারণ আমাদের সামনে স্পষ্ট কোন লক্ষ্য থাকে না। আমরা আমাদের ভাবনাগুলোকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখি চারপাশে। কিন্তু যখন বাধ্য হই তখন কিন্তু ঠিকই আমরা মনোযোগ একটি বিষয়ের উপর ধরে রাখতে পারি।

মনকে তাই কখনোই তার ইচ্ছের উপর ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। তাহলে মন ডালপালা ছাড়িয়ে একাকার করে ফেলে।মনোযোগ যাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না পড়তে যেটা বোঝাতে আপা বেশ মজার একটা গল্প বলেছিল সাহিলকে। এক রাজা ছিলেন যার সিংহাসনের পাশে সবসময় একটা বানর বাঁধা থাকতো। রাজা প্রতিদিন দরবারে বসার পর একটা চাবুক দিয়ে বানরটার পিঠে সপাৎ করে একটা বাড়ি দিতেন। বানরটা ব্যথায় কিচকিচ করে উঠতো তারপর চুপচাপ বসে থাকতো বাকিটা সময়। দিনের পর দিন একই কান্ড দেখে একদিন রাজদরবারীরা বললেন, রাজা মশাই এত ভদ্র একটা বানরকে আপনি প্রতিদিন কেন চাবুক দিয়ে আঘাত করেন? রাজা বললেন, এই বানরটা আমার খুবই প্রিয়। তাই সবসময় আমি ওকে পাশেই রাখি। আর প্রতিদিন কেন মারি সেটা জানতে চান? ঠিকআছে আপনাদেরকে জানানোর ব্যবস্থা করছি। পরদিন দরবারে বসে রাজা বানরকে মারলেন না। বানর সারাদিন চুপ করে বসে রইলো। এরপর দিনও মারলেন না। তৃতীয় দিনও যখন মারলেন না বানর নড়াচড়া শুরু করলো। চতুর্থ দিন বানর রাজার সিংহসনের হাতলে চড়ে বসলো। পঞ্চম দিন রাজার ঘাড়ে, ষষ্ট দিন রাজার মাথায় এবং সপ্তম দিনে রাজার মাথা থেকে মুকুট কেড়ে নিয়ে সে রাজ সিংহাসনে বসে পড়লো। সেদিন রাজা আবার চাবুক হাতে নিলেন। বানর কিচকিচ করতে করতে আবার তার স্থানে ফিরে গেলো।

মানুষের মনটাও নাকি অনেকটা এই বানরের মত। মনকে যদি ছেড়ে দেয়া হয় সে যা ইচ্ছে তাই করে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। তাই বানরের মতই মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যও দরকার নিয়মিত চাবুকের বাড়ি। কিন্তু মন তো ধরা ছোঁয়ার বাইরের জিনিস। আর যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না তাকে চাবুক কিভাবে মারা সম্ভব? তাহলে উপায়? উপায় হচ্ছে, অধরা মনের দায়িত্ব এমন কাউকে দেয়া যে নিজেও অদেখা কিন্তু অধরা মনকে দেখতে ও ধরতে সক্ষম। সে হচ্ছে আমাদের বিবেক। মনের লাগাম যদি বিবেকের কাছে থাকে তাহলে বেসামাল হবার সুযোগ অনেক কমে যায়। আর বিবেককে পরিচালিত করে আমাদের জ্ঞান। আমাদের অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতেই বিবেক কোন সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আমরা যদি আমাদের বিবেককে শরীয়তের জ্ঞান দ্বারা সজ্জিত করতে পারি। তাহলে বিবেকও মনকে প্রতিটি কর্মের পেছনে একটি অভিষ্ট লক্ষ্য দিতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ। তবে সাথে সাথে আপা সাহিলকে অভয় দিয়ে একথাও বলে দিয়েছিল যে, এমনটা কখনোই একদিনে সম্ভব না। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে আয়ত্ত্ব করতে হবে। যেমন বাংলা রিডিং পড়ার আগে অ, আ, ক, খ ইত্যাদি শিখতে হয়েছে, আ-কার, ই-কার শিখতে হয়েছে, এরপর বেশ কিছুদিন বানান করে পড়তে হয়েছে ঠিক তেমন। মনোযোগের ব্যাপারেও তেমন আগে ইনগ্রিডিয়েন্স সমূহকে একত্রিত করতে হবে ধীরে ধীরে। অতঃপর সবকিছুর সংমিশ্রণে তৈরি হবে উৎকৃষ্ট, মজাদার এবং আরাধ্য কিছু।

নিজেকে পুনঃপুনঃ চেষ্টায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সাহিল এখন আর ঘুমের মধ্যে এলোমেলো স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্ন দেখে না। এখন সে খোলা চোখে স্বপ্ন দেখে। অন্তত জীবন চির শান্তির জান্নাতে সকল প্রিয়জনদের নিয়ে একসাথে কাটাবে সেই স্বপ্ন। এই মূহুর্তেও বুক ভরা প্রশান্তি নিয়ে খোলা চোখে স্বপ্ন দেখাতে মগ্ন ছিল সাহিল। বাগানে দিকে চোখ পড়তেই চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে আপাআআ বলে চিৎকার দিলো।

বাইরে যাবার উদ্দেশ্যে মেইল গেটের দিকে যাচ্ছিলো নূহা। চিৎকার শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকিয়ে সাহিলকে দেখতে পেয়ে হাসি মুখে বলল, কিরে সাত সকালে টারজান হবার সাধ জেগেছে নাকি তোর?

সাহিল হেসে বলল, আপা তোমার সাথে অনেক জরুরি আলোচনা আছে আমার।

কিন্তু এখন তো আমি বেরোচ্ছি।

আজ তো তোমার ডিউটি নেই বলেছিলে। এত সকালে তাহলে কোথায় যাচ্ছো?

বাবার শরীর খারাপ করেছে তাই দেখতে যাচ্ছি।

তাহলে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো আমার জন্য প্লিজ আপা। আমিও যাবো তোমার সাথে ফুপাজানকে দেখতে।
পাঁচ মিনিটের এক সেকেন্ড বেশিও অপেক্ষা করবো না। জারিফ ওর বাবার সাথে গাড়িতে অপেক্ষা দশ মিনিট ধরে আমার জন্য। অলরেডি দুইবার আমাকে ফোন দিয়েছে। এখন যদি আবার শোনে তোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে বাচ্চা কান্নাই জুড়ে দেবে।

আপা এই কথা বলে তুমি আমার স্পীড বাড়িয়ে দিয়েছো। আমি আমার সুইট ভাগিনাকে চোখে একবিন্দু অশ্রুকণাও আসতে দেবো না। ড্রেস চেঞ্জ করার ইচ্ছে ত্যাগ করলাম। শুধু আম্মুকে বলেই আমি আসছি। কথা শেষ করেই ছুট দিলো সাহিল।

নূহাও হেসে মেইন গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করলো।

@

বিবেক যদি টেবলেট আকারে পাওয়া যেত দুনিয়াতে এত আত্মিক দীনতার ছড়াছড়ি থাকতো না। শারীরিক রোগের সমাধানের জন্য কত ধরনের ঔষুধ আছে। মনের রোগেরও এমন ঔষুধ থাকা উচিত ছিলো। মানুষের মধ্যে যখন নুন্যতম বিবেক বোধেরও অনুপস্থিতি দেখি সত্যি অনেক খারাপ লাগে। বিবেক বোধ তো দূরে থাক কমনসেন্স বলে যে একটা জিনিস আছে সেটাও অনুপস্থিত বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে।  

ফাইল থেকে মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকালো আদী। বাচ্চাদের এলোমেলো করে রাখা খেলনা গুছাতে গুছাতে নিজ মনেই গজগজ করছে তাইয়্যেবা। ফাইল পাশে রেখে হাসিমুখে বলল, কমনসেন্স না থাকা কিংবা কম থাকাই আসলে ভালো। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি কি বলেছেন জানো? বলেছেন, কমনসেন্স ইজ নট অ্য গিফট, ইট’স অ্য পানিশমেন্ট। বিকজ ইউ হ্যাভ টু ডিল উইথ এভরিওয়ান হু ডাজনট হ্যাভ ইট।    

কিছুটা বিরক্তি মাখা কণ্ঠে তাইয়্যেবা বলল, আমার এমনিতেই মেজাজ গরম। আপনি এইসব পাগল টাইপ কথাবার্তা বলবেন নাতো এখন।  

হাসতে হাসতে আদী বলল, তা তোমার মেজাজ গরম হইবার মত কর্মখানা কার দ্বারা সংঘটিত হইলো?  

আপনাকে মানা করলে আরো বেশি করে ফান করেন সবসময়। সত্যি অনেক মেজাজ খারাপ আমার।  

আচ্ছা ফান বন্ধ। বরং তোমার মেজাজ ভালো করার মত কোন পরামর্শ দেই চলো।মাঝে মাঝে মানুষের উদ্ভট কথাবার্তা ও কর্মকান্ড দেখে বা শুনে আমারো প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মন। তখন আমি নিজেকে বলি, হে আমার রব আমাকে এমন একটা ধৈর্য্যশীল ও প্রশান্ত মনের অধিকারী করো, যা সর্বদা থাকবে সদ্য প্রস্ফুটিত কোন ফুলের ন্যায়। যার সৌন্দর্য মনকে করবে মুগ্ধ,যার সুগন্ধ ছড়িয়ে যাবে চারপাশে। এমন আত্মিক সুষমা মণ্ডিত সুমধুর শব্দভাণ্ডার দাও আমাকে, যার আলোকময়তা স্পর্শ করে যাবে হৃদয় বীণা। আমাকে করে দাও জ্ঞানের আলোকবর্তিকা। পথহারা একটি মানুষের তরেও যেন হতে পারি বাতিঘর। কখনো যেন কাউকে ঘৃণা ভরে অবজ্ঞা না করি। না হই যেন কারো মর্মবেদনার কারণ। দিতে পারি যেন অকৃত্রিম ভালোবাসা। ক্রোধকে করতে পারি যেন দমন। প্রতিহিংসা যেন হয় পরাভূত আমার উদারতার কাছে। হে দয়াময় আমাকে সর্বোত্তম সম্পদ উত্তম আখলাক দান করো। বিনয় যেন হয় সেই প্রদ্বীপের তেল যেই আলো আমি ছড়াতে চাই। কিছুক্ষণ পরই আমি অনুভব করি যে, পাখীর পালকের মত নরম, কোমল, পেলব কিছু পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে আমার মেজাজে। অদ্ভুত এক পশলা শান্তির শ্রাবণধারা ধুয়ে মুছে দিয়ে যায় মনের সমস্ত বিরক্তি।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে কপট রাগের ভাণ করে তাইয়্যেবা বলল, আপনি আর আপনার সাইকোলজির দুইটাই অসহ্য। সুপার অসহ্য। এইসব শোনার চেয়ে গিয়ে বাচ্চাদের হৈচৈ শোনা ভালো।  

আদী হেসে বলল, এটা অবশ্য ঠিক বলেছো তুমি বাচ্চাদের হৈচৈ এর চেয়ে মনোমুগ্ধকর আসলে খুব কম জিনিস আছে পৃথিবীতে।  

এবার হেসে ফেললো তাইয়্যেবা। আপনি সবসময় এমন পজিটিভ মাইন্ডের থাকেন কিভাবে সত্যিই বুঝি না আমি!  

সবসময় থাকি কে বললো? তাছাড়া কোন মানুষই সবসময় পজেটিভ মাইন্ডের থাকতে পারে না। এমন অসংখ্য ব্যাপার আছে যা আমাকেও অস্থির করে তোলে। কিন্তু মানুষের ব্যাপারে তো ধৈর্য্য রাখতেই হবে। আমার প্রফেশনই এটা। তাছাড়া আমার কি মনেহয় জানো? ব্লক, বুটিক, সেলাইয়ের কাজ বা ভালো রান্না জানা যেমন একজন মানুষের এক্সট্রা কোয়ালিটির মধ্যে পড়ে। ঠিক তেমনি উদারতা, সহনশীলতা, সহানুভূতি, কমনসেন্স এসবও মানুষের এক্সট্রা কোয়ালিটি। এখন কেউ ভালো রান্না না জানলে যেমন আমরা তাকে শিখে নিতে উৎসাহিত করি, ক্ষেত্র বিশেষে সাহায্য করি। উদারতা, সহনশীলতা ইত্যাদির ঘাটতিতেও যদি তেমনটা করতে পারতাম তাহলে কতই না ভালো হতো। কিন্তু আমরা তেমনটা সচারচর করি না। আমরা তাদের উপর ক্ষুব্ধ হই, তাদের নিন্দা ও সমালোচনা করি। তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে দেই যে তারা মানুষ সুবিধার না। যারফলে মানুষ হিসেবে সুবিধা জনক স্থানে তারা কখনোই উঠে আসতে পারে না।

বুঝলাম আপনার কথা। কিন্তু উদারতা, সহনশীলতা, সহানুভূতি, কমনসেন্স এসব মানুষের এক্সট্রা কোয়ালিটি এটা মেনে নিতে পারলাম না। এগুলো মানুষের ফিতরাতের অন্তঃর্গত। প্রতিটা মানুষ জন্মের সময়ই এসব সাথে করে নিয়ে আসে।

একটা বীজের ফিতরাত কি জানো? তাকে মাটিতে বপন করা হবে, চারা বের হবে, ধীরে ধীরে বড় হবে এবং ফুল ও ফল দেবে। এখন একটা বীজকে তুমি মাটিতে বপন করলে কিন্তু অনুকূল পরিবেশ ও আবহাওয়া দিলে না। সে কি ফিতরাতে অবিচল থাকতে পারবে? হ্যা অনুকূল পরিবেশ ও আবহাওয়া ছাড়াও গাছ জন্মে। কিন্তু তাদের নাম দেয়া হয় আগাছা। অবশ্য ব্যতিক্রম কিছু ঘটনাও ঘটে। কিন্তু সেজন্যই তো সেটা ব্যতিক্রম বলে খ্যাত হয়। রাসূল (সাঃ) কিন্তু এই কথাটি বলে গিয়েছেন। "প্রতিটি শিশু (ইসলামের) ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। তার পিতামাতাই তাকে ইহুদি বানায়, খ্রিষ্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক বানায়।" ঠিক তেমনি পিতামাতা সন্তানদেরকে অমানবিক, অসৎ ইত্যাদিও বানায়।

আর কিছু না বলে হেসে নিজের কাজে মন দিলো তাইয়্যেবা। কিছুক্ষণ পর কিছু একটা বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতে যেয়েও আদীর দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেলো তাইয়্যেবা। আদীর সমস্ত মনোযোগ নিবিষ্ট হাতে ধরে থাকে ফাইলের মধ্যে।
এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছে জিজ্ঞেস করতে যেয়েও আবার নিজেকে সামলে নিলো তাইয়্যেবা। পরিচিত হোক বা অপরিচিত কারো ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েই আলোচনা করে না আদী কখনোই। বিয়ের প্রথম প্রথম এই স্বভাবটা মনে কষ্ট তৈরি করলেও এখন তাইয়্যেবা বোঝে এটা আদীর অনেক বড় একটা গুণ। প্রতিটা সম্পর্কের মধ্যে রেসপেক্ট অত্যাবশ্যকীয় একটা জিনিস। একজন ডক্টর ও পেশেন্টের সম্পর্কও এর বাইরে নয়। অনেক ভরসা নিয়ে একজন পেশেন্ট ডক্টরের কাছে আসে। খুলে বলে তার শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। সবদিক দিয়ে এই ভরসা যারা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন তারাই আসলে প্রফেশনাল ও পারসোনাল উভয় দিক দিয়ে একজন কল্যাণকামী মানুষ। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনেহয় তাইয়্যেবার এমন একজন মানুষের জীবনসঙ্গিনী হতে পারার জন্য। আদীকে আর বিরক্ত না করে চুপচাপ খেলনা গুছিয়ে রেখে বাচ্চাদের খোঁজে বের হলো।

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৪

  


ভালোবাসার সুবাসে সুবাসিত শব্দগুলো পড়তে পড়তে কখন যে দু' চোখ ছাপিয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে শুরু করেছে টেরই পাইনি নূহা কাঁধে রাহাতের স্পর্শ অনুভব করে চোখ তুলে তাকালো দুশ্চিন্তা দরদ ভরা চোখে আকুল হয়ে তাকিয়ে আছে রাহাত কি হয়েছে, কেন কান্না করছে নানান প্রশ্নের ভীতিকর গোলকধাঁধায় ঘুরছে রাহাত দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো হেসে ফেললো নূহা চোখ মুছে নিয়ে রাহাতকে ধরে পাশে বসিয়ে হাসতে হাসতে বলল, এতটা ঘাবড়ে যাবার মত কিছুই হয়নি কারো ভালোবাসার প্রাপ্তিতে মন হয়েছে বাঁধনহারা, দু'চোখ ছাপিয়ে নেমেছে তাই আনন্দাশ্রুর ধারা

হাসি
ফুটে উঠলো রাহাতের চেহারাতেও। বলল, আচ্ছা তাই বলো। আমি তো আরো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
জানতে চাইলে না কার ভালোবাসার ছোঁয়ায় মনের আকাশ আজ শ্রাবণ ছোঁয়া? দুষ্টুমি মাখা স্বরে প্রশ্ন করলো নূহা।

রাহাত
হেসে বলল, বলার ইচ্ছে থাকলে আমার বৌ জানতে না চাইলেও জোড় করে শোনাবে। ইচ্ছে না থাকলে বার বার প্রশ্ন করেও কোন লাভ হবে না। তাই প্রশ্ন করা ছেড়ে দিয়ে বৌয়ের মরজির কাছে নতি স্বীকার করে নিয়েছি।

আচ্ছা
কখনো কি জোর করে কথা আদায় করে নিতে ইচ্ছে করে না তোমার?

উহু
করে না।

কেন
?

কারণ
আমার উস্তাদজ্বি বলেছেন, কখনো কখনো মানুষকে কিছু কাজ নিজের জন্য নয়, অপরের জন্য করতে হয়, অপরের জন্য মেনে নিতে হয়। ঐসব কাজ করার বা মেনে নেয়ার মাঝে সেভাবে করে হয়তো মনের খুশি সামিল থাকে না। উল্টো মনের মধ্যে খুঁতখুঁতে আবহ তৈরি হয়। কিন্তু চুপচাপ মেনে নেবার ফলে পাশের জনকে হয়তো বলার অস্বস্থির স্বীকার হতে হয় না। সে হয়তো অপছন্দনীয় কিছু কিংবা যা বলতে চাইছে না এমন কিছু বলতে হয়নি সেজন্য খুশি হয়। আর আমাদের নিশ্চুপে কিছু করে যাওয়া কিংবা মেনে নেয়ার ফলে যখন আমাদের জীবনের সাথে জুড়ে থাকা মানুষরা খুশি হয় ,তখন কোন অনুশোচনাও থাকে না স্যাক্রিফাইসের জন্য। সব কাজ করে হয়তো আনন্দ মেলে না, কিন্তু শান্তি পাওয়া যায়। কারণ আমি আনন্দ পাইনি তো কি হয়েছে? আমার সাথে জুড়ে থাকা মানুষেরা তো আনন্দে আছে।

নূহা
হেসে বলল, ধন্য উস্তাদের ধন্য শিষ্য। তবে সত্যিই নিজের সাথে জুড়ে থাকা মানুষেরা যখন ভালো থাকে, তখন অনেক কষ্টের মাঝেও সুখ সুখ অনুভূতি ঘিরে থাকে মনকে। তবে এটাও আবার ঠিক, সব আনন্দ ফিকে লাগে যখন প্রিয় কেউ কষ্টে আছে উপলুব্ধ হয়। এটাই মনেহয় সম্পর্কের বন্ধনে বিদ্যমান ভালোবাসার প্রমাণ। অন্যের খুশির মাঝে নিজের খুশি খুঁজে নেয়া, অন্যের বেদনায় বেদনাক্ত হয়ে ওঠার এই যে প্রবণতা। এটাই রাঙিয়ে যায় জীবনকে ভালোবাসা ত্যাগের মহিমায়।

আলহামদুলিল্লাহ
আমিও এখন এমন করে ভাবতে পারি। আমিও অন্যকারো মুখে হাসি দেখে তৃপ্তির হাসি হাসতে পারি। নিজের চেয়ে অন্যের সাচ্ছন্দের কথা আগে ভাবতে পারি। এবং যখন থেকে এই গুণটাকে নিজের মাঝে ধারণ করতে পেরেছি। আমার ভালো থাকাটা, স্বস্থিতে থাকাটা অনেক বেশি সহজ হয়ে গিয়েছে।

আলহামদুলিল্লাহ
আমিও অনেক আগেই এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। যদি আমরা অন্যের স্বস্থি ভঙ্গের কারণ হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারি। আমাদের নিজ জীবনের স্বস্থি অটোম্যাটিক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আসলে নিজে ভালো থাকার জন্য অন্যকে ভালো রাখাটা অতীব জরুরি। এই সহজ সত্যটা সম্পর্কে অবগত থাকি না বিধায়ই আমরা অন্যের কষ্টের বদলে নিজের সুখ কিনতে চাই। যাইহোক, আমি আসলে আমার ছোটবেলার ডায়রি পড়ছিলাম। জীবনে আসা প্রতিটা সুন্দর মূহুর্তকে ধরে রাখাটা সবচেয়ে প্রিয় শখ ছিল আমার। সেইসব সুন্দর মূহুর্তের স্পর্শে মনের বিষণ্ণতা কাটাতে চেষ্টা করছি।

মনের
বিষণ্ণতা? আবারো কন্ঠে উদ্বেগ ফিরে এলো রাহাতের।

কিছুক্ষণ
নীরব থেকে নূহা বলল, “আমাদের জীবনের সবচেয়ে অবধারিত ঘটনা হচ্ছে মৃত্যু। তাই একটি মুহুর্তকেও এলোমেলো, অগোছালো, উদ্দেশ্যহীন ভাবে কাটানোর কোন সুযোগ নেই। তাই কোন ভাবনা যদি স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করে তবে সেটা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। কেননা কোন কিছুর বিনিময় জীবনের স্বাভাবিকত্বের সাথে হতে পারে না।এই কথাগুলো আমাদের নিউরো সাইকোলজির প্রফ বলেছিলেন আমাদের এক ক্লাসমেটকে। ক্লাসমেটটি তার পারিবারিক কিছু জটিলতার ভাবনাতে এতোই এলোমেলো হয়ে পড়েছিল যে তার প্রভাব পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলো। প্রফের কথাটি শোনার পর শুধু সেই ক্লাসমেটই নয় আমরা সবাই সতর্ক হয়েছিলাম আমাদের সেইসব ভাবনার ব্যাপারে যা অকারণ জটিলতার বীজ বুনে চলছিল আমাদের জীবনে। আমার সবচেয়ে প্রিয় টিচারদের একজন ছিলেন উনি। শুধু তাই নয় যাদেরকে দেখে শিখেছিলাম জীবনকে জীবনের মত করে যাপন করতে, যাদের কাছে জেনেছিলাম জীবনে সুখী হবার সবচেয়ে শর্টকার্ট ফলপ্রসূ টিপস হচ্ছে,সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা উনি তাদেরও একজন ছিলেন।

ছিলেন
? ছিলেন বলছো যে? কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো রাহাত।

রাহাতের
প্রশ্ন শুনতেই পাইনি এমন ভান করে নিজের কথা বলে যেতে লাগলো নূহা। বাবা সেই ছোটবেলা থেকেই বার বার বলতেন, কখন যে জীবন বৃক্ষ থেকে হঠাৎ কে ঝরে যাবে সেটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তাই আপনজন, প্রিয়জন, পছন্দের মানুষদেরকে কখনোই যথাযথ মূল্যায়ন করতে অবহেলা করবে না। কিন্তু তারপরও অবহেলা যে হয়েই যায় সেটা আবারো অনুভব করলাম আমাদের নিউরো সাইকোলজির প্রফের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর।

তোমাদের
নিউরো সাইকোলজির প্রফ মারা গিয়েছেন? ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কবে মারা গিয়েছেন উনি?

গত
পরশু রাতে। তুমি শহরের বাইরে ছিলে তাই আর জানাইনি। জানো প্রফের মৃত্যু সংবাদটা শোনার সাথে সাথে প্রফের বলা একটা কথা মনে পড়েছিল।নূহা খুব ইচ্ছে করছে তোমার হাতের মাটন বিরিয়ানি, চিকেন তান্দুরী আর গাজরের লাড্ডু খেতে শেষ যেদিন কথা হয়েছিল আমার হাতের খাবার খেতে ইচ্ছে করছে এই আবদার করেছিলেন প্রফ। আবদারটা রাখার সুযোগ পেলাম না আমি। একবার কোলকাতায় গিয়েযখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন...” এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি শুনেছিলেন প্রফ। ফিরে এসে ক্লাসে জানতে চাইলে অর্থ বুঝিয়ে বলার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলেন, আচ্ছাযখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটেতোমরা কি আমাকে মনে রাখবে? তোমরা আমাকে মনে রাখতে পারো এমন কিছু তোমাদেরকে শেখাতে পেরেছি? এরপর থেকে প্রতি ক্লাসের পরই উনি আমাদের সবার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় জানতে চাইতেই, আমাকে তোমরা মনে রাখবে এমন কিছু আজ শেখাতে পেরেছি?! আমরা কখনোই খুব একটা সিরিয়াসলি নেইনি প্রফের প্রশ্নটিকে। বেশির ভাগ সময়ই হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু উনার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর প্রথমেই কানে বেজে উঠেছিলখুব ইচ্ছে করছে তোমার হাতের মাটন বিরিয়ানি, চিকেন তান্দুরী আর গাজরের লাড্ডু খেতে চোখ থেকে ঝরঝর অশ্রু নেমে এসেছিল। বলতে বলতে নূহার দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়লো অশ্রুধারা।

রাহাত
হাত বাড়িয়ে নূহার হাতের উপর রেখে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো।

চোখের
অশ্রু মুছে নিয়ে নূহা বলল, তুমি তো জানো এমনটা আমার দ্বারা কখনোই হয় না সাধারণত। কেউ কিছু খেতে চাইলে শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমি তাকে সেটা রান্না করে খাওয়াতে চেষ্টা করি। জানি না কেন প্রফের ক্ষেত্রে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে আজ করবো কাল করবো করে করে শেষপর্যন্ত আর উনার জন্য রান্না করাই হলো না।আমাকে তোমরা মনে রাখবে এমন কিছু আজ শেখাতে পেরেছি’? এই প্রশ্নটার কথা মনে পড়ার পর বেদনার আরেকটি তীব্র স্রোত বয়ে গিয়েছিল অন্তর জুড়ে। কেন এই ছোট সহজ প্রশ্নটির জবাব নিয়ে এত হেয়ালি করেছিলাম? বেদনার সাথে যুক্ত হয়েছিল অপরাধবোধও। অবুঝের মতো ছুটে গিয়েছিলাম রান্নাঘরে। মাটন বিরিয়ানি, চিকেন তান্দুরী, গাজরের লাড্ডুর সাথে চমচম আর বোরহানিও তৈরি করলাম। প্রফ আমার হাতের চমচম আর বোরহানিও অনেক পছন্দ করতেন। রান্না শেষ করে মেইল লিখতে বসলাম। কত কিছু শিখেছি গত বারো বছরে প্রফের কাছে। এক এক করে সব লিখলাম। প্রফকে দেখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা শিখেছিলাম সেটা হচ্ছে মানুষের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখা। দীর্ঘ এত বছরে এমন একবারও হয়নি উনি কারো ব্যাপারে সামান্য নেতিবাচক কিছু বলেছেন। কিংবা উনার কাছে কেউ কারো সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলতে চাইলে সেটাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আমাদের এক ক্লাসমেট যখন বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সবার সম্পর্কে ওর নেতিবাচক ধারণার কথা বলছিল প্রফ বলেছিলেন, সারাজীবন যাদের সাথে কাটাতে হবে তাদের ব্যাপারে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয়। সময় নাও। দেখবে সময় ধারণাকে উন্নত করে তুলবে ধীরে ধীরে।

হ্যা
তুমি আমাকে বলেছিলে প্রফের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে।

হুম
! সর্বক্ষণ একজন মানুষের এতটা ইতিবাচক থাকাটা মুগ্ধ করতো আমাকে। বেশ কয়েকমাস আগে একজন ব্যক্তির কিছু কথা কাজের কারণে তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধে চিড় ধরে গিয়েছিল। প্রফ বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন কারো একটা বা দুটা ভুল আচরণের জন্য তার উপর নেতিবাচকতার সাইনবোর্ডই লাগিয়ে দেয়াটা অন্যায়। কেউ ভুল ত্রুটির উর্দ্ধে নয় এটা সবসময় মনে রাখা উচিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা যাদেরকে পছন্দ করি তাদেরকে মনের সর্বোচ্চ স্থানে জায়গা দিয়ে ফেলি। তাই তাদের সামান্য চ্যুতিও আমাদেরকে মুষড়ে দেয়। আর চ্যুতি যখন ক্রমাগত হতে থাকে তখন শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। অবশ্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরও সচেতন থাকা অবশ্যক। কেননা একটা আচরণের দ্বারা যদি আমি কারো মনে শ্রদ্ধার বীজ বপন করি। তখন সেই বীজটা যাতে অক্ষত থাকতে পারে, বীজ থেকে চারা বের হতে পারে, চারা গাছে রূপান্তরিত হতে পারে সেই দায়িত্বটাও আমারই পালন উচিত। সবসময় শুনেছি শ্রদ্ধা অর্জন করার চেয়ে টিকিয়ে রাখাটাই বেশি কঠিন। প্রফের কাছ থেকে জেনেছিলাম নিজ আচরণ দ্বারা কারো মনে যদি শ্রদ্ধার জন্ম দেই তাহলে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আমার। এমন ছোট-বড় আরো কতই কিছুই না শিখিয়ে গিয়েছেন উনি আমাদেরকে। যা যা মনে পড়েছে এক এক করে সব লিখে মেইল পাঠিয়ে দিয়েছি প্রফকে। জানি সেই মেইল উনি হয়তো দেখবেন না কোনদিন। তবুও আমি এমনটা করেছি নিজের মনের স্বস্থির জন্য। কেননা মনে স্বস্থি না থাকলে জীবনে সব থাকতেও কোথাও শান্তি মিলে না এটা আমার খুব ভালো মতই জানা আছে। তাই সদা সতর্ক থাকতে চেষ্টা করি যাতে কিছুতেই মনের স্বস্থি বিঘ্নিত না হয়। কিন্তু সবসময় পারিনা। প্রফ যেহেতু আমার কলিগও ছিলেন এমন বেশ কয়েকবার হয়েছে উনার উপর রেগে গিয়েছি, যা বলেছেন তার উল্টো বলেছি, আমার যুক্তির সাথে মেলেনি তাই কেয়ার করিনি উনার কথা। সব বার হয়তো তেমন করে সরি বলাও হয়নি। গত তিন-চার মাস থেকে খুব কথা বলতে চাইতেন আমার সাথে। আমারও নানান ঝামেলা যাচ্ছে তাই নিজে তো ফোন দিতামই না উনি করলেও তেমন করে কথা বলা হয়ে ওঠেনি যেমনটা করে উনি বলতে চাইতেন। আজ এসব স্মৃতি মনেকরে অপরাধবোধে ভোগা, দুঃখিত হওয়া আসলে অর্থহীন। কেননা আমার কোন অনুভূতিই উনার কাছে পৌছোবে না। কথায় বলে জীবনে সুযোগ, সম্ভাবনা একবারই আসে। হেলায় হারিয়ে ফেললে তাকে আর পাওয়া যায় না জীবনে। কিন্তু আপনজন, প্রিয়জন, পছন্দের মানুষদের ঘিরে স্মৃতিগুলোকে সুন্দর করার সুযোগ বার বার আসে, আর আসতেই থাকে আমাদের জীবনে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আমরা সেই সুযোগকে কাজে লাগানো তো দূরে থাক, সেটা যে একটা সুযোগ এটাই অনুভব করতে পারি না। সমস্ত অনুভব, উপলব্ধি একসাথে মনে এসে ভিড় করে যখন সেই মানুষগুলো আমাদেরকে ছেড়ে চলে যায় অনেক দূরে। অথচ এই মানুষগুলোই জীবন যখন তপ্ত দাহ নিয়ে হাজির হয়, প্রশান্তিকর ঘন ছায়া রূপে উদ্ভাসিত হন!

বুঝতে
পারছি অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমার। কিন্তু আমার মতো তুমিও জানো এসব ভেবে মন খারাপ করাটা অর্থহীন। তারচেয়ে এই মূহুর্তে আমাদের জন্য সবচেয়ে অর্থহীন যেই জিনিসটা সেটা করা উচিত।

কি
সেটা?

প্রফের
জন্য বেশি বেশি করে দোয়া। তুমিই তো বলো যখন কারো জন্য আমাদের কিছুই করার থাকে না। তখনো ভীষণ শক্তিশালী একটা জিনিস করার থাকে। সেটা হচ্ছে, দোয়া। মাগরীবের নামাজের সময় হয়ে গিয়েছে প্রায়। চলো নামাজের প্রস্তুতি নেই আমরা।

নূহা
হাসি মুখে বলল, হ্যা চলো