রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি...২৪




আদীর ধারণা ছিল জাওয়াদ আর নূহার বিচ্ছেদের অংশটুকু শোনার পর বাচ্চাদেরকে সামলানোটা বেশ কঠিন হবে। ওদেরকে কিভাবে শান্ত করবে, কি বলে বোঝাবে এসব ভেবে বেশ চিন্তিতও ছিল। কিন্তু ভীষণ রকম অবাক করে আদীর ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে দিলো জিহাদ, জিশান, জারিফ আর নাবিহা। নাবিহাকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত ছিল আদী। কারণ মায়ের ব্যাপারে খুব বেশি স্পর্শকাতর নাবিহা। কিন্তু তিন ভাইয়ের উপর একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে প্রসন্ন চেহারায় নাবিহা বলল, জানো আদীব্বা জাল দাদাভাই আমাদেরকে এখন সূরা ইউসুফের তাফসীর পড়াচ্ছেন। গত সপ্তাহে আমরা জেনেছি, পৃথিবীতে কোন কিছুই এমনি এমনি ঘটে না। সব ঘটনার পেছনের কোন না কোন কারণ অবশ্যই থাকে। কিন্তু সবসময় ঘটনার পেছনের কারণকে সাথে সাথেই বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। মন সন্তুষ্ট হবার মতো ব্যাখ্যা দাঁড় করানোও সম্ভব হয় না তাৎক্ষনিক ভাবে। তাই ঘটনাটির পেছনের কারণটিকেও যথাযথ অনুধাবন করা সম্ভব হয় না আমাদের পক্ষে। তাই সেই ঘটনাটিকেই আমরা নিজেদের সবচেয়ে বড় কষ্টের কারণ ভেবে নেই, যেই ঘটনাটি মূলত আমাদের সৌভাগ্যের দ্বার উন্মোচন করার জন্যই সংঘটিত হয়েছিল। তাই না জাল দাদাভাই?  

আফজাল সাহেব হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ অবশ্যই তাই দাদুমণি। আল্লাহর কল্যাণময় সিদ্ধান্তকে বোঝার মতো অন্তঃজ্ঞান, দূরদৃষ্টি সাধারণ মানুষদের থাকে না বলেই সবরের সুমিষ্ট ফল আস্বাদন করতে ব্যর্থ হয়। আপাত দৃষ্টিতে খুব কষ্টকর কিছুও অদূর ভবিষ্যতে দিয়ে আনন্দের ফল্লুধারা প্রবাহের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তাই দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা এলে কখনোই অধৈর্য্য বা নিরাশ হতে নেই। তাছাড়া দুনিয়াটা যেহেতু আমাদের জন্য পরীক্ষা ক্ষেত্র। নানান ধরণের পরীক্ষা তো আমাদেরকে দিতেই হবে। স্কুল-কলেজের ভালো স্টুডেন্টদের ব্যাপারে যেমন শিক্ষকদের প্রত্যাশা বেশি থাকে, ভালো ফলাফলের জন্য যেমন তাদেরকেও যেমন বেশি চেষ্টা, সাধনা করতে হয়, মনের অনেক ইচ্ছে ত্যাগ করতে হয়। এখানেও ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই। আল্লাহ্‌র সিদ্ধান্তকে খুশি মনে মেনে নেবার জন্যও ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হয়। যারা ধৈর্য্য, সহিঞ্চুতা, আত্মত্যাগ ও প্রার্থনার মাধ্যমে পরীক্ষায় পাশের চেষ্টা জারি রাখতে পারে। এই বিশ্বাস ধরে রাখতে পারে যে, নিশ্চয়ই এই কষ্টের বদলে উত্তম কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, তারাই কেবল সন্ধান পায় প্রশান্তিকর এক জীবনের।

জিশান হেসে বলল, এবার বুঝলে তো আদীব্বা কেন আমাদের মন খারাপ হয়নি? কারণ আমরা জানি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। তাই কখনো যদি মনেহয় আল্লাহ আমাদেরকে কষ্ট দিচ্ছেন। তখন মনে এই বিশ্বাস রাখতে হবে এই কষ্টের মাঝেই আমার জন্য কল্যাণ লুকায়িত। যেমন ধরো, আমি যখন আরেকটু ছোট ছিলাম সারাক্ষণ চকলেট, আইসক্রিম, পেস্ট্রি, মিষ্টি এসব খেতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু পাপা আমাকে খেতে দিতো না। আমি ফ্রীজ থেকে লুকিয়ে খাবার খেতে গিয়ে কত দিন যে ধরা পড়েছি পাপার হাতে। পাপা মাঝে মাঝে বকেও দিয়েছে আমাকে। আমার তখন অনেক রাগ হতো পাপার উপর। মনেহতো পাপা আমাকে একটুও ভালোবাসে না। তা না হলে ভাইয়া আর নাবিহাকে তো কখনোই খেতে মানা করে না। আমাকেই শুধু খেতে দিতে চায় না পছন্দের কোন খাবার। কিন্তু এখন আমি বুঝি পাপা কেন আমাকে খেতে দিতো না। কারণ আমার ডায়াবেটিস আছে। আমার কল্যাণের কথা চিন্তা করেই পাপা আমাকে আমার পছন্দের জিনিস দেয়া থেকে বিরত থাকতো।

জিহাদ, জারিফ আর নাবিহা তিনজনই আরেকটু করে এগিয়ে জিশানের গা ঘেঁষে বসলো। জিহাদ জিশানের একটি হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলল, পাপা বলেছে, অনেক কঠিন কিছুও খুব সহজ হয়ে যায় যদি সবাই মিলে একসাথে সেটাকে মোকাবিলা করা হয়। জিশানের ডায়াবেটিসের কথা যেদিন আমরা জেনেছিলাম। আমি আর নাবিহাও সেদিন থেকে সেই সব খাবারই শুধু খেতাম যেগুলো জিশান খেতে পারতো। আমরা দুজনও জিশানের খাবারের রুটিন ফলো করতে শুরু করেছিলাম এরপর থেকে। পাপাও সবসময় জিশানের রুটিন ফলো করতো। যখন পাশে বসে আমরা তিনজনও সেই একই খাবার খেতাম তখন থেকে জিশান সবজি, ফল, স্যালাড দেখে কান্না করা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিয়েছিল। একা একা কোন কিছুর সাথে ফাইট করাটা সত্যিই অনেক কঠিন। কিন্তু সবাই মিলে করার কারণে খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক তেমনি আমাদের জীবনের সমস্যাগুলোও যদি আপনজনদের সাথে ভাগ করে নেয়া যায়। তাহলে অনেক সহজ হয়ে যায়।  

জারিফ বলল, ভাইয়া, আপ্পি আজকে থেকে আমিও চকলেট, আইস্ক্রিম, পিজা কিছুই খাবো না।

জিশান হাসতে হাসতে বলল, আমরা তো সবকিছুই খাই জারিফ। কিন্তু পরিমাণ মতো।

জারিফ দৃঢ় কন্ঠে বলল, আচ্ছা তাহলে আমিও সবকিছু পরিমাণ মতো খাবো। একটুও বেশি খাবো না তোমাদের চেয়ে ইনশাআল্লাহ।

নাবিহা জারিফের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, আদীব্বা তোমাদের মেঝ মামা এখন কোথায় থাকে? আমরা তো কখনো দেখিনি উনাকে।

আদী বলল, যে কাজ করেছে এরপর তো আর বাড়িতে আসার কোন সুযোগ নেই উনার। তাই তোমরা কখনো দেখোনি। এখন মনেহয় আমেরিকার কোথাও থাকে।

জিহাদ বলল, কোথায় থাকে সঠিক জানো না তোমরা?

আমি সত্যিই সঠিক জানি না।

কিন্তু ইবলিশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে পাপা আমাদেরকে বলেছিল, বন্ধুদের সম্পর্কে যদি কিছু অজানা থেকেও যায় তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু দৃশ্য এবং অদৃশ্য উভয় প্রকার শত্রুদের সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখাটা বাধ্যতামূলক।

আদী হেসে বলল, তোমাদের পাপা ঠিক বলেছে। ইনশাআল্লাহ আজই আমি জেনে নেবো আমাদের মনুষ্য রুপী শত্রুটা কোথায় আছে। তবে তোমাদেরকে এত স্বাভাবিক দেখে বুঝতে পেরেছি এসব ঘটনা তোমাদের জানা ছিল। আমার ধারণা কি সঠিক?

নাবিহা হেসে বলল, কিছু কিছু জানা ছিল। নানাভাই বলেছিলেন আমাদেরকে। তখন অবশ্য আমাদের অনেক মন খারাপ হয়েছিল। নানাভাই আমাদের মন খারাপ দেখে বলেছিলেন, প্রতিটা ঘটনার মধ্যেই শিক্ষা লুকিয়ে থাকে এবং সে শিক্ষাকে খুঁজে নিতে হয় নিজ ইচ্ছে ও চেষ্টার জোড়ে। কিন্তু তোমরা যদি ঘটনার মোকাবেলাতেই ঘাবড়ে যাও, তাহলে শিক্ষা নিবে কিভাবে? তাই সবসময় মনে রাখবে ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়েই মানুষের জীবন। যে কোন সময় যে কোন ধরণের বিপদ-আপদ মানুষের সুন্দর জীবন এলোমেলো করে দিতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি বিপদে-আপদে, দুঃখ-শোকে, স্থির থাকতে পারে, বিচলিত না হয়ে ধৈর্য্যের সাথে পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে জানে সেই হচ্ছে প্রকৃত বুদ্ধিমান। তাই তোমাদেরকে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেয়া জানতে হবে। এবং ভীত বা শঙ্কিত না হয়ে সর্বাবস্থায় শান্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে।

আদী হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ তোমাদের নানাভাই কথা তো মনের পাতা ঝরা ক্ষণকে মূহুর্তে বসন্তের পিহু পিহু কলতানে রূপান্তরিত করে দেয়। যাইহোক, আমাকে এখন হসপিটাল যেতে হবে। তোমরা সবাই থাকো তোমাদের বাবা আর চাদা ভাই আর চাদী মণির সাথে।     

কিন্তু মামণি তো এখনো আসছে না আদীব্বা। পনে দশটা তো বেজে গিয়েছে। তুমি মামণি আসার আগে যেতে পারবে না। ফোন দিয়ে দেখি মামণিকে?

নাবিহার প্রশ্নের জবাবে আদী বলল, আচ্ছা দেখো ফোন দিয়ে। আমি একটু ক্ষণ বারান্দায় দাঁড়াই। বারান্দায় এসে দাঁড়াতে নীচ থেকে কথার শব্দ শুনতে পেয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো দুজন ভদ্রমহিলার  সাথে বাগানে কথা বলছে নূহা। বারান্দায় আরেক পাশে এসে দাঁড়ালো আদী। একবার ভাবলো নাবিহা ডেকে জানিয়ে দিতে ওর মামণি যে চলে এসেছে। কিন্তু শোনা মাত্র চার ভাইবোন নীচে ছুট লাগাবে। কথা বলতে দেবে না আর নূহাকে কারো সাথে। তাই নাবিহাকে না জানানোটাই ভালো মনে করে চুপ করে রইলো। বাচ্চাদেরকে শান্ত ও স্বাভাবিক ভাবে সবকথা শুনতে ও মেনে নিতে দেখে প্রচন্ড ভালো লাগা আর স্বস্থি কাজ করছিল মনে। কিন্তু বহুদিন পর অতীতের পথে হাঁটতে গিয়ে অদ্ভুত এক ধরণের বিষন্নতাও ঘিরে ধরেছিল আদীকে। নূহা সবসময়ই ভীষণ রকম মুগ্ধ করতো আদীকে। কিন্তু শরীয়তের বিধান এবং পারিবারিক অনুশাসন সবসময়ই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মনের এই ভালো লাগার কথা প্রকাশ করার পথে। তাছাড়া নূহার বয়স এতো কম ছিল তাই আরো পরেই পরিবারের কাছে পছন্দের কথা জানানো সঠিক মনে হয়েছিলো আদীর। কাজিনদের অবাধ মেলামেশা বা কথা বলার সুযোগ কখনোই তাদের পরিবারে ছিল না। কিন্তু এর মাঝেও চমৎকার একটা বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল নূহার সাথে আদীর। বয়স এতো কম হবার পরও পরিবারের সবার সবকিছু নখদর্পনে ছিল নূহার। এই জিনিসটাই আদীকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করতো। আর জাওয়াদকেও নিশ্চয়ই নূহার এই গুণটিই আকর্ষিত করেছিলো সবচেয়ে বেশি। নূহাকে ঘিরে মনের এসব ভাবনা কখনোই হয়তো প্রকাশ করতো না আদী। জাওয়াদ আর নূহার বিয়ের পর এসব ভাবনা কখনোই প্রশয় দেয়নি। কিন্তু জাওয়াদের চলে যাবার পর নূহার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটাকে চেপে রাখতে পারেনি। মনের কথা খুলে বলেছিল মা আর খালামণিদেরকে। কিন্তু নূহা কিছুতেই রাজী হয়নি। নূহার উপর কোন রকম জোর করতে চায়নি বলে ওর সিদ্ধান্তকেই চুপচাপ মেনে নিয়েছিল আদী।

অবশ্য এখনো মেনে নেয় নূহার স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক সব ধরণের কথা, কাজ ও আচরণ। কারণ সবকিছু ছাড়িয়ে নূহার ভালো থাকাটাকেই সবচেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষিত মনেহয় আদীর কাছে। নিয়তির সাত পাকে জড়িয়ে বারবার সামনে এগিয়ে যাবার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবার পরও, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জীবন সফরে বেদনাক্ত পথ একা একাই পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে নূহা সেই কবে থেকে। তবুও ওর চেহারাতে এতটুকু ক্লান্তির ছাপ পড়েনি! আগের সেই উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত, ছটফটে স্বভাব ক্ষুণ্ণ হলেও, তার রেশ রয়ে গিয়েছে এখনো ওর মনে! আকাশে নক্ষত্রের ফুল হোক কিংবা পথের ধারে অযত্নে ফুটে থাকা ঘাসফুল! কারো সাধ্য নেই নূহার স্বপ্নময়ী শিকারি চোখকে ফাঁকি দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার! ওর কথায় তাই রঙেরা খেলা করে! শব্দে শব্দে গড়ে তোলে ভালোবাসার রঙধনু! ভাবুকতার সম্রাজ্যে আকণ্ঠ ডুবে থাকা মূহুর্তগুলোর মাঝেই ক্ষণে ক্ষণেই রূপান্তরিত হয় চঞ্চল প্রজাপতিতে! সযতনে পদচিহ্নের আল্পনা রেখে যায় পথহারা পথিকের পানে! সইতে পারে না কারো চোখের নোনা পানির ধারা! সুনিবিড় আলিঙ্গনে তাকে জড়িয়ে নেয় মমতার ভাঁজে ভাঁজে! অন্ধকারের বুকে জোনাকি হয়ে উদ্ভাসিত হয় অপার্থিব আলো নিয়ে। গুনগুন করে বুনে চলে সুন্দরের আগমনী গান। নির্দিষ্ট দুরুত্ব বজায় রেখে এমন কারো পাশে থাকতে পারাটাও অনেক বড় প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তিটুকু তাই বড় বেশি আরাধ্য কিছু আদীর কাছে।

মামণি তো এসেছে। নাবিহার চিৎকার শুনে ঘুরে তাকালো আদী। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীচে দাঁড়িয়ে থাকা নূহার দিকে তাকিয়ে সমানে হাত নাড়ছে নাবিহা।

আদী হেসে বলল, আপনার ভ্রাতত্রয় কোথায় আম্মাজান?

নাবিহা হেসে বলল, বাবাকে রান্নায় সাহায্য করছে। আদীব্বা আমি মামণিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি। তুমি শুনে বলতো কেমন হয়েছে।

আদি হেসে বলল, ঠিকআছে শোনাও আগে।

কবিতার নাম দিয়েছি ‘মামণি তোমাকে পেয়ে’। এখন কবিতা শোনো। “খোলা চোখে স্বপ্ন দেখতে শিখেছি তোমারি জন্য, এই জগতে তোমার চেয়ে নেই তো কেউ অনন্য। তোমার কোলেতে শুয়ে জুড়ায় আমার মন-প্রাণ,সব ফুলের চেয়েও শ্রেষ্ঠ মামণি তোমার সৌরভ ও ঘ্রাণ। ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে পাড়াও তুমি ঘুম, সুর্যের প্রথম আলো হয়ে তুমিই চোখে দাও চুম। তোমার মনের মাঝে আছে হাজার কথার ঝুড়ি, আরেকটি বার ডাকো আমায় মিষ্টি করে বুড়ি। তোমার মুখে বুড়ি ডাকে মনটা উঠে গেয়ে,ধন্য আমি ধন্য শোনো মামণি গো তোমায় পেয়ে”। কেমন হয়েছে?

মাশাআল্লাহ। জাস্ট অসাম। এই কবিতা পড়ে তোমার মামণিও নিজেকে ধন্য মনে করবে তোমাকে পাওয়ার জন্য।

নাবিহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমি বেশি ধন্য। কারণ আমার মামণি আছে, পাপা আছে, বাবা আছে, ভাইয়ারা আছে এবং আমার আদীব্বা আছে। আদীব্বা যেমন মামণির সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমারো সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ঠিক বলেছি কিনা বলো?

আদী হেসে বলল, অবশ্যই ঠিক বলেছেন আম্মাজান।

তাহলে এবার আমাকে বলো তোমার কেন মন খারাপ?

কে বলেছে আমার মন খারাপ?

কেউ বলেনি কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার, পাপার, মামণির, বাবার মন খারাপ হলে আমি বুঝতে পারি।

আদী হেসে বলল, তুমি তো দিন দিন একদম তোমার মামণির মতো হয়ে যাচ্ছো। জানো ছোটবেলায় তোমাদের মামণিও এমন ছিল। সারাক্ষণ বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতো। বাড়ির চলন্ত লাইভ নিউজ চ্যানেল ছিল তোমাদের মামণি। বাড়িতে কোন ঋতু চলছে, কোন ঋতু আসার অপেক্ষায় দন্ডায়মান, আজকের আবহাওয়া কেমন, কোন বিপদ সংকেত আছে কিনা। সব খবর তোমাদের মামণির কাছ থেকে পেতাম আমরা। এভাবেই ধীরে ধীরে তোমাদের মামণি আমাদের সবার মনে নিজের জন্য ভালোবাসাময় ছোট্ট একটি করে কুটির গড়ে নিয়েছিল। তুমিও আজকাল সেই পথেই এগোচ্ছো।

নাবিহা উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল, আমি তো মামণির পদচিহ্ন আঁকা পথ ধরেই এগিয়ে যেতে চাই আদীব্বা। তোমাদের সবার মনে মামণির যে কুটির আছে, সেটার পাশে আমিও ছোট্ট আরেকটা কুটির বানাতে চাই ইনশাআল্লাহ আমার জন্য।

নাবিহার মাথায় হাত বুলিয়ে আদী হেসে বলল, আর কারো কথা জানি না তবে আমার হৃদয়ে তোমার কুটির তৈরি কাজ অলমোস্ট কমপ্লিট।

সত্যি আদিব্বা? আলহামদুলিল্লাহ আমি এক্ষুণি ভাইয়া, জিশান আর জারিফকে এই সংবাদটা দিয়ে আসছি। আনন্দে ছুটতে ছুটতে ভেতরে চলে গেলো নাবিহা।

@

নূহা বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই বাড়িতে ফিরে যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন নুসরাত খালামণি। জটপট ফ্রেশ হয়ে সবাইকে নিয়ে তাই রাতের খাবার খেতে বসে গিয়েছিল নূহা। খাওয়ার পর খালামণি আর বাপীকে বিদায় দিয়ে বাচ্চাদের সাথে করে জামায়াতে ঈশার নামাজ আদায় করার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। ক্লান্তি এমন ভাবে চেপে বসেছিল শরীরে বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিল। ঘুম ভাঙার পর আশেপাশে কাউকে না দেখে হাত বাড়িয়ে টেবিল ঘড়ি নিয়ে দেখলো রাত সাড়ে তিনটা। এখনো রাহাত ঘুমোতে আসেনি কেন? প্রথমেই এই প্রশ্নটা জাগলো মনে। বাচ্চাদের সাথে বসে গল্প করছে না তো? কিন্তু কোন রকম সাড়া শব্দ না পেয়ে উঠে বসলো নূহা। ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। হল রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো এক গাদা ফাইলপত্র নিয়ে কাজের মধ্যে ডুবে আছে রাহাত। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে গিয়ে রাহাতের পাশে বসতে বসতে সালাম দিলো নূহা।

সালামের জবাব দিয়ে রাহাত হেসে বলল, ঘুম হয়ে গেলো এত জলদি?

তুমি এত রাতে না ঘুমিয়ে কি করছো?

গত কয়েকদিন বাসায় থাকাতে অনেক কাজ জমে গিয়েছি। ঘুম আসছিল না তাই ভাবলাম যতটা সম্ভব আগিয়ে রাখি। তুমি যাও ঘুমোও।

উহু, তুমি শেষ করো। এরপর একসাথে যাবো।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাসি মুখে রাহাত বলল, তোমার ছেলে-মেয়েরা সব তোমার মতো হয়েছে। পান থেকে চুন খসলে চিৎকার চেঁচামেচি করে অস্থির করে তোলে সবাইকে। কিন্তু বিশাল আকারের পাহাড় যখন ভেঙ্গে পড়ে একটুও বিচলিত না হয়ে নিজেদের সাথে সাথে অন্যেদেরকেও সামলাতে চেষ্টা করে। আমি আর আদী ভাইয়া তো ভয় পাচ্ছিলাম ওদের রিঅ্যাকশন কেমন হবে সেটা ভেবে। কিন্তু এত স্বাভাবিক ছিল ওরা মাশাআল্লাহ। ওদের কথা শুনে আমাদের মনে যে মেঘ জমেছিল সেটাও কেটে গিয়েছিল। জানো আজকাল জিহাদ, জিশান, নাবিহা ওদের তিনজনের মধ্যেই আমি জাওয়াদ ভাইয়ার প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাই। ভাইয়া উনার মতোই অনন্য মানুষ হিসেবেই গড়ে তুলছেন ওদের তিনজনে। তাই ভাবছিলাম জারিফকেও ভাইয়ার কাছে পাঠিয়ে দেয়া উচিত আমাদের। আমাদের কাছে থাকলে তো ভাইয়ার মতো হবে না জারিফ। ওর ভাইবোনদের সাথে অনেক অমিল রয়ে যাবে।

নূহা হেসে বলল, তুমি থাকতে পারবে জারিফকে ছাড়া?

রাহাত হেসে বলল, তুমি থাকতে পারলে, আমিও পারবো ইনশাআল্লাহ। অবশ্য একাকীত্ব যাতে কষ্ট দিতে না পারে সেজন্য দারুন একটা আইডিয়া আছে আমার কাছে?

আচ্ছা। তা কি সেই আইডিয়া?

তোমার স্বপ্ন পূরণ।

কোন স্বপ্ন?

রঙধনু সৃষ্টির। আমাদের রঙধনুতে যে তিনটি রঙ মিসিং সে খেয়াল কি আছে ম্যাডামের?

হেসে ফেললো নূহা। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তুমি বোস কফি নিয়ে আসি আমাদের জন্য।

রাহাতও হেসে বলল, ওকে বারান্দায় বসছি আমি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনের জন্য কফি নিয়ে হাজির হলো নূহা। রাহাতের হাতে কফির মগ তুলে দিয়ে বলল, কফি বানাতে বানাতে ভাবছিলাম একটা বাণী লিখবো। বানীটা কি জানো?

কি?

“সংসার সুখের হয় পুরুষের গুণে, যত পঁচা পত্নীই থাকুক না তার সনে।”

রাহাত হেসে বলল, আমার ধারণা অবশ্য অন্যরকম।

কি রকম?

স্বামী-স্ত্রী একে অপরের থেকে ভিন্ন দুজন মানুষ। আর যে যেমন তাকে তেমন ভাবে একসেপ্ট করাই সংসার সুখের বা দাম্পত্য ভালোবাসার প্রথম শর্ত।

তুমি সবসময় এমন সুপারহিট কথা কি করে ভাবো বলো তো?

কারণ আমি যে সবসময় একজন সুপারস্টার মা আর তার চার চারটি রকস্টার বাচ্চাদের সাথে থাকি। কিন্তু তুমি আমার বৌকে পঁচা বললে কেন?

তোমার বৌ পঁচা নয়তো কি?

আমার বৌ তো এতো সুইট যে আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি যে ভাগ্যিস আমার ডায়াবেটিস নেই।

মানে?

মানে তাহলে সকাল-বিকাল ইনসুলিন নিয়েও আমি সুগার লেভেল ঠিক রাখতে পারতাম না।

হাসতে হাসতে নূহা বলল, উফফ তোমার কথা। বাচ্চাদের কথা বলো। আমি ঘুমোনোর পর ওরা ঘুমোতে যাবার আগ পর্যন্ত কি কি কান্ড করেছে?

সবসময় যা করে। নিত্যনতুন দুষ্টুমি। তোমার রকস্টার ছোট মনের আনন্দে তার বডিলোশন আমার চুলে মেখেছে। আর তোমার রকস্টার কন্যা তাই দেখে বলল, বাবা কোন অ্যাড এজেন্সির সাথে কি তোমার পরিচয় আছে? জানতে চাইলাম, কেন? জবাবে বলল, একটা জিঙ্গেল লিখে দিতাম। “শুষ্ক, খসখসে চুল নিয়ে কি আপনি চিন্তিত? আর কোন চিন্তা নেই নিয়মিত বেবী লোশন ব্যবহার করুন চুলে’’। আর বোনের কথা শুনে তোমার রকস্টার মেঝ পুত্র হাসতে হাসতে হাত থেকে দুধের গ্লাসই ফেলে দিলো। আর বড় পুত্র সবসময়ের মতো হেসে কুটিকুটি হলো ভাইবোনদের কর্মকান্ড দেখে। নূহা তাকিয়ে দেখো পেছনে।

রাহাতের মুখে বাচ্চাদের কান্ড শুনে হাসছিল নূহা। রাহাতের কথা মতো পেছনে তাকিয়ে দেখলো জিহাদ, জিশান, জারিফ আর নাবিহা মুখে হাসির বিশাল একেকটা সাইনবোর্ড টানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

নূহা অবাক কন্ঠে বলল, তোমরা ঘুমোওনি এখনো?

নাবিহা কোমরে হাত দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কিভাবে ঘুমাবো শুনি? তুমি তো আমাদেরকে আদরই দাওনি। মায়ের আদর ছাড়া বুঝি ছোট ছোট মাসুম বাচ্চাদের ঘুম আসে কখনো?

হাসতে হাসতে নূহা বলল, ওল্লে আমার ছোট ছোট মাসুম বাচ্চাগুলা! পিটিয়ে যদি আজ চারটার পিঠের চামড়া না তুলে নিয়েছি আমি।  

নূহার কথা শুনে হাসতে হাসতে হুড়মুড় করে নিজেদের রুমের দিকে ছুট লাগালো বাচ্চারা। মারমুখী ভঙ্গীতে নূহাও পেছন পেছন ছুটলো।

বাচ্চাদের সাথে মাঝে মাঝে একদম বাচ্চাই হয়ে যায় নূহা। নূহা আর বাচ্চাদের হৈচৈ আর আনন্দে মেতে থাকা মুহুর্তগুলোতে নিজের ঘরটাকে জান্নাতের একটা টুকরা বলেই মনেহয় রাহাতের কাছে। আর নিজেকে সবসময়ই পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষদের একজনই মনেহয় রাহাতের। সুখ-হাসি-আনন্দ-ভালোবাসা কোন কিছুরই অভাব নেই তার জীবনে। তবে কথায় বলে যে, স্বর্গেও নাকি সাপ থাকে। মাঝে মাঝে নূহার অসহ্যকর নীরবতা আর নির্লিপ্ততাকে এমনই এক সাপ মনেহয় রাহাতের কাছে। রাহাত জানে তার এক যুগের পাগল করা ভালোবাসাও পারেনি নূহার মন থেকে জাওয়াদ ভাইয়ার প্রতি ভালোবাসাকে এতটুকুও ম্লান করে দিতে। অবশ্য এমন কোন চেষ্টাও ছিল না রাহাতের কখনোই। কিন্তু তারপরও মনেহয় কথা থেকে যায়! এমন কিছু অনুভূতির জোয়ার মাঝে মাঝে মনে বয়ে যায়, যা কিছুক্ষণের জন্য হলেও রাহাতের মনকে বেদনায় ছেয়ে দেয়। নূহার স্বামী না বরং বন্ধু হয়ে পথে চলতে চেষ্টা করে সে এবং চলেও। ভীষণ ভালো লাগে যখন উল্টো পাল্টা কোন কথা, কাজ বা আচরণের জন্য সরাসরি সরি না বলে আদর ও আবদারের সুরে নূহা বলে, তুমি না আমার এত্তোগুলা প্রিয় দোস্ত? তোমার সাথে এমন নির্বুদ্ধতা করবো নাতো কার সাথে করবো বলো? কিন্তু তারপরও নূহার মনের বন্ধ সেই কুঠুরি, যেখানে পৃথিবীর অন্য আর সবার মতো তারও প্রবেশ নিষেধ। জানতে ইচ্ছে করে কি আছে সেখানে? কাকে ঘিরে নূহার সেই জগৎ? তার কি কোন অস্তিত্ব আছে সেখানে? ধ্যাৎ...কি সব ভাবচে, নিজেকেই শাসন করলো রাহাত। সে তো যতটুকু এবং যা পাচ্ছে তার মধ্যেই সুখকে খুঁজে নিয়ে সুখী হবার দলের মানুষ। না পাওয়ার হিসাব করে জীবনকে জটিল করার ঘোর বিরোধী । তাছাড়া কিছু অপ্রাপ্তি তো থাকবেই জীবনে। সব পেয়ে ফেলাও যে এক ধরণের বিড়ম্বনা। মনের ভাবনাগুলোকে ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালো রাহাত। ধীর পায়ে রওনা হলো সেই মানুষগুলোর কাছে যাদেরকে ঘিরে দুনিয়ার বুকে গড়ে উঠেছে তার ছোট্ট এক টুকরো জান্নাত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন