রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি......৯





দূর থেকে দেখে যে কেউই বলে দিতে পারবে ডক্টর জাওয়াদ এখন নিজের সাথে তুমুল তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত। তর্ক-বিতর্কে বাড়তি জোশ নিয়ে আসার জন্য তাই গরমা গরম ধূমায়িত গ্রীণ টি। জাওয়াদের পাশে বসতে বসতে বললো আদী।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, জাযাকাল্লাহ। সত্যিই চায়ের তেষ্টা অনুভব করছিলাম।

তারমানে তো আমার আন্দাজও সঠিক। নিজের সাথে তর্ক-বিতর্ক চলছিল ডক্টর জাওয়াদের।

কেন নিজের সাথে তর্ক-বিতর্ক করা নিষেধ নাকি?

নিষেধ হবার তো কোন অবকাশই নেই ভ্রাত। ইনফ্যাক্ট, মানুষ নিজের সাথেই সবচেয়ে বেশি তর্ক-বিতর্ক করে। কেন ঐ লাইনগুলো শুনিসনি?

কোন লাইনগুলো?

‘মনের অতলান্ত সাগরের গুপ্ত কুঠোরিতে ভাবনা থাকে শায়িত, ঝিনুকের মাঝে লুকোনো মুক্তো রূপী শব্দ রয়েছে তাতে অগণিত। একে অন্যের সংস্পর্শে টুনটুন ধ্বনি ছড়ায় সুখ সুখ আবেশে, কখনো বা বেসুরে নিজেকেই দিয়ে যায় একরাশ যাতনা মৃদু পরশে।’

জাওয়াদ হাসলেও মুখে কিছু বললো না। আদীও হেসে বলল, আসলে নিজের সাথে নিজের কথোপকথন আসলে সর্বক্ষণই চলতে থাকে। বেশির ভাগ সময়ই অবচেতনে চলে তাই সেভাবে খেয়াল করা হয় না।একজন মানুষ মূলত নিজের সাথেই কথা বলে সবচেয়ে বেশি। এই কথাগুলো যদি অজান্তে না বলে সচেতন ভাবে বলতে পারতো তাহলে সমস্যা, প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি মনের মাঝে শূন্যতার হাহাকার না তুলে, করণীয় ও বর্জনীয়র নকশা এঁকে দিতে পারতো। কারণ প্রতেক্যের ভেতরের ‘আমি’ তাকে খুব ভালো মতো চেনে, জানে ও বোঝে। জানে তার ক্ষমতার উচ্চতা, অক্ষমতার কারণ। ভেতরের ‘আমি’ অধরা থাকে বলেই বাইরের আমি অসহায় বোধ করে। এই দুই আমিকে একাকার করতে তাই নিজের মাঝে ডুব দিয়ে খুঁজে নিতে হয় নিজেকেই। মনের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় হচ্ছে সেই দেহটি যাতে মন অবস্থান করে। অর্থাৎ, প্রতেক্যের সবচেয়ে আপনজন সে নিজেই। আর তাই আপনাকে আপন করে পেতে নিজের সাথে কথা বলার কোন বিকল্প নেই।

তুই কি আমাকে লেকচার দেবার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিস নাকি?

আদী হেসে বলল, নারে ভাই এত বড় লেকচারার আমি এখনো হইনি যে তোকে লেকচার শোনাতে আসবো। কথা প্রসঙ্গে উঠলো তাই বলে ফেললাম আরকি। কিন্তু এখনো তোকে বাড়িতে দেখে অবাক হচ্ছি। হসপিটালে যাবি না আজ?

বিকেলে যাবো ইনশাআল্লাহ।

রাতে ঘুমোতে পারিসনি তাই না? আচ্ছা আমি যেয়ে নাহয় জিহাদ, জিশান আর নাবিহাকে নিয়ে আসবো কিছুক্ষণ পর।

না ওদেরকে আনতে হবে না। ওদেরকে কথা দিয়েছিলাম কনফারেন্স থেকে ফিরে এসে ওদেরকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবো। ভাবছি নেক্সড উইকেই ওদেরকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবো ইনশাআল্লাহ। এই কয়েকদিন তাই ওদের মা’র সাথে সময় কাটানোই ভালো হবে। তাছাড়া ওরা কাছে থাকলে নূহাও ভালো থাকবে।

আর তুই? তোর ভালো থাকার কি হবে?

আলহামদুলিল্লাহ আমরা সবাই যাতে নিজ নিজ অবস্থানে ভালো থাকতে পারি সেজন্যই তো নিয়তির লিখনকে মেনে নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমাদের জীবনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার প্রভাব আমাদের বাচ্চাদের উপর পড়তে দেবো না এই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আমার আর নূহার ডিভোর্সের আগ মূহুর্তে বাবার বলা একটা কথা আমার অন্তরকে ছুঁয়ে দিয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, স্বামী-স্ত্রীর ডিভোর্স হয় কিন্তু বাবা-মা’র নয়। ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করার পর তোমাদের বিয়ে ভেঙে যাবে। কিন্তু সন্তানদের সাথে তোমাদের বন্ধন অটুট। তোমাদের দুজনের বিয়ে অসফল রয়ে গিয়েছে এটা তোমার নিয়তি। তবে পিতা-মাতা হিসেবেও যাতে তোমাদেরকে ব্যর্থ হতে নাহয় সেদিকে খেয়াল রেখো। তোমাদের অসতর্কতার কারণে এই কলিগুলো যেন প্রস্ফুটিত হবার আগেই ঝরে না যায়। বাবার কথাগুলো আমি শুধু মনেই রাখিনি, মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। নূহাও করেছে ওর সাধ্যানুযায়ী। শরীয়ত আমাদেরকে যে সীমা বেঁধে দিয়েছে। সেই সীমাকে লঙ্ঘন না করে আমি আর নূহা পিতা-মাতার দায়িত্ব পালন করতে সবসময় সচেষ্ট ছিলাম, সচেষ্ট আছি। তবে এটা হয়তো কখনোই সম্ভব হতো না যদি রাহাত এত বড় মনের অধিকারী না হতো।

আলহামদুলিল্লাহ। আমিও যখনই রাহাতের উদারতা ও মহানুভবতার কথা চিন্তা করি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় অন্তর সিক্ত হয়ে আসে। কতটা অসাধারণ করেই না আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এক আকাশ উদারতা, এক সাগর ভালোবাসা ধারণ করার ক্ষমতা আল্লাহ মানুষের অন্তরে দিয়েছেন। আমরা মানুষেরাই নফসের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হয়ে মনটাকে ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ ও জরাগ্রস্ত করে ফেলি। আলহামদুলিল্লাহ রাহাত ওর মনটাকে উন্মুক্ত রাখতে পেরেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা রাহাতকে এই ক্ষমতা দিয়েছেন।

আলহামদুলিল্লাহ। এর উত্তম প্রতিদানও ইনশাআল্লাহ রাহাত একদিন পাবে।

ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তোর কি হবে? নূহা আর রাহাত ওদের জীবনকে গুছিয়ে নিয়েছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে ওরা ভালোও আছে। কিন্তু তুই? তুই তো এখনো এগারো বছর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছিস।  

জাওয়াদ হেসে বলল, ছোট খালামণির পানি পড়া খেয়েছিস নাকি? হুবহু খালামণির টোনে কথা বলছিস।

আদী হেসে বলল, আজকাল কিন্তু তুই খুব ছোট ছোট কারণেই বিরক্ত হচ্ছিস সবার উপর। এটা ঠিক যে আমাদের মাদার’স গ্রুপ মাঝে মাঝে ওভার রিঅ্যাক্ট করে। কিন্তু উনারা সবাই ভীষণ ভালোবাসে তোকে। সবাই তোর কল্যাণ চায়, তোকে ভালো দেখতে চায়, সুখে আছিস সেটা অনুভব করতে চায়।  

আপনজনদের কল্যাণ কামনা কারো কারো চলার পথকে কন্টকাকীর্ন করে দেয়। আর ফ্যাক্ট হচ্ছে, সেই কাঁটা বিছানো পথের উপর দিয়ে ক্ষত বিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন অপশন থাকে। আবার অভিযোগ করে কাউকে কিছু বলাও যায় না। কারণ আপনজনেরা পথে আসলে ফুলই ছড়িয়ে দিয়েছিল। ফুলের আড়ালে চুপটি করে বসে থাকা চোরা কাঁটা সম্পর্কে তারা নিজেরাও অজ্ঞাত ছিল। তাই সবার দোয়া আমি অবশ্যই চাই সবসময়। কিন্তু আমার কষ্ট লাঘব কিংবা কল্যাণ কামনায় কাউকে ব্যতিব্যস্ত দেখতে চাই না।

তুই যখন এভাবে বলিস তখন আমার নিজেকেই সবচেয়ে বড় অপরাধী মনেহয়। ঐ সময় আমি অস্থির হয়ে না উঠলে হয়তো পরিবারের সবাই নূহাকে বিয়ে দেবার জন্য অতটা পাগল হতো না।

জাওয়াদ হেসে বলল, আমার মতো তুইও জানিস কোন ঘটনা একা একা সংঘটিত হতে পারে না। কারো উপর ভর করেই ঘটনা বাস্তবে রূপান্তরিত হয়, পরিণত হয়। তাই নিজেকে অপরাধী ভাবার কিছু নেই তোর। ঐ সময়ে নিজের করণীয় সবচেয়ে বেষ্ট কিছুই করার চেষ্টা করিছিলি তুই। তোর জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো ওরকম কিছুই করার চেষ্টা করতাম, যেমনটা তুই করতে চেয়েছিলি। আমার আসলে কারো উপর কোন অভিযোগ নেই। আমি সবার ভালোবাসাকে বুঝি, মূল্যায়নও করি। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে কারো ইন্টারফেয়ার করাটা খুবই অপছন্দ করি। প্রতেক্যের মানুষের কাছে সুখের ডেফিনেশন আলাদা আলাদা। যেমন, আমার সুখ আমার সন্তানদের মাঝে। ওরা আমার কাছে লাইট হাউজের মতো। নিয়তির ঝড়ে আমি যখন উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম, ওদের কচি কচি হাতের পরশেই আবার খুঁজে পেয়েছিলাম গন্তব্যের সন্ধান। জীবনের ঐ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যদি আমার সন্তানরা না থাকতো। আমি জানি না আদী আমার ঠিক কি হত। হয়তো বেদনার অতলান্তে হারিয়ে যেতাম, বিস্মৃত হয়ে যেতাম নিজের কাছ থেকেই। কিন্তু ওদেরকে পেয়ে আমি যে শুধু বেঁচে থাকার ভরপুর সুযোগ পেয়েছিলাম তাই নয়। সাথে সাথে এটাও ফিল করেছিলাম, যত কঠিন পরীক্ষাই হোক না কেন, সেই পরীক্ষায় যাতে বান্দাহ সফলতা অর্জন করতে পারে সেই ব্যবস্থাও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা করেই দেন। আমরাই প্রশ্নপত্রে এমন ভাবে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রাখি যে পাশে পড়ে থাকা উত্তর কপি করতে পারিনা।

হুমম, ঐ মূহুর্তগুলোতে আমাদের মন নকল প্রতিরোধে সোচ্চার থাকে হয়তো। হাসতে হাসতে বললো আদী।

হাসলো জাওয়াদও। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, বাচ্চারা বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে। অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে অলরেডি। সেজন্যই মূলত আমি চিন্তিত। আমি কখনোই এটা চাই না যে, আমার সন্তানরা ভাববে ওদের কারণে আবার আমি বিয়ে করিনি কিংবা ওদের কারণে কষ্টে আছি। কিন্তু মা-মামণি-খালামণি-ফুপ্পিরা যদি সারাক্ষণ এমন বিয়ের সাইনবোর্ড নিয়ে ঘুরতে থাকে আমার পেছনে। একটা সময়ে বাচ্চারা খেয়াল করবেই, তখন যদি সরাসরি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে নিজেরা নিজেরা ভেতরে ভেতরে কষ্ট পায়। সেটাকে আমি কিভাবে সামাল দেবো? এই ব্যাপারটাই আমি বার বার বোঝাতে চেষ্টা করছি মা-খালামণিদেরকে।

আচ্ছা ঠিকআছে আমি কথা বলবো মা-খালামণিদের সাথে। এভাবে আসলে আমিও এরআগে ভেবে দেখিনি। খুব বেশি সেনসেটিভ জিহাদ, জিশান আর নাবিহা ওদের মায়ের ব্যাপারে। আবার বুঝতে শেখার পর থেকেই ওদের ভুবন তোকে ঘিরেই। ওদের সেই ভুবনে নতুন কারো আগমন ওরা তখনই আনন্দ চিত্তে মেনে নিতে পারবে, যখন নিজেরা কাউকে নিমন্ত্রণ জানাবে। অর্থাৎ, বিয়ে যদি কখনো করিস, সেটা করতে হবে তোর কন্যা আর পুত্রদের পছন্দে।

আর আমার কন্যা এবং পুত্রদের জীবনে ওদের মায়ের স্থানে ওদের মা ছাড়া ভিন্ন কোন অপশন, ভিন্ন কোন চয়েজের কোন অবকাশই নেই।

এতটা শিওর হচ্ছিস কিভাবে? হেসে প্রশ্ন করলো আদি।

জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, আমি যেদিন বাচ্চাদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, এত ছোট ছোট তিনটা বাচ্চা মাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে ভেবে পরিবারের সবাই আপত্তি করেছিলো। কিন্তু নূহা একবারও আপত্তি করেনি। কারণ নূহা আমাকে আমার মতো করেই বোঝে। ও তাই বুঝতে পেরেছিল ঐ অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য আমার শক্ত কোন অবলম্বন প্রয়োজন। যেহেতু ওর নিজের পক্ষে সম্ভব ছিল না আমার পাশে এসে দাঁড়ানোর। বাচ্চাদের দ্বারা সেই কাজটি করতে চেয়েছে। আমিও ঠিক এমনটাই করতে চেয়েছি আদী। নূহার প্রতি ভালোবাসার রঙে তুলি ডুবিয়ে ডুবিয়ে আমি আমার সন্তানদের মনে ওদের মায়ের ছবি এঁকেছি। 

তোর মনটাকে মাঝে মাঝে চিঁড়ে ফেড়ে, উল্টে পাল্টে দেখার খুব শখ জাগে। কোথায় লুকিয়ে রাখিস এত ভালোবাসা বলতো? কিভাবেই বা রাখিস? কোন মানুষ অন্য কোন মানুষকে এতটা ভালোই না বাসে কিভাবে? এত বেশি যে যখন তাদের ভালোবাসার মাঝে নিয়তি, অতঃপর শরীয়ত বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তখনো একে অন্যের কাছে ‘আমি আছি রে তোর পাশে’ এই উপলব্ধি পৌছে দেবার জন্য পবিত্র মাধ্যম খুঁজে বের করে নেয়!   

জাওয়াদ হাসি মুখে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আচ্ছা কোন একদিন সময় করে তোর মাইন্ড ল্যাবে দু’চার ঘন্টার জন্য আমার মনটাকে পাঠিয়ে দেব। তখন নাহয় চিঁড়ে ফেড়ে দেখিস।

আদী হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু তুই যাচ্ছিস কোথায়?

মাদার’স গ্রুপের সাথে কথা বলতে। তুইও চল আমার সাথে।

আদীও তখন উঠে জাওয়াদের পিছু নিলো।  

কয়েক কদম হাঁটার পরই পেছন থেকে জাওয়াদকে টেনে ধরলো আদী। জাওয়াদ ঘুরে তাকালে আদী হেসে বলল, অতীত ভ্রমণে যাবি? চল দু’ভাই ছোট্ট একটা ট্যুর দিয়ে আসি আমাদের সোনা ঝরা শৈশবে।

ঠিক কি বলতে চাইছে বুঝতে না পারলেও আদী যেদিকে তাকিয়ে ছিল সেদিকে তাকিয়ে হাসি ফুটে উঠলো জাওয়াদের মুখেও। এরপর হাসতে হাসতে বলল, আমাদের বয়সের চাকা ফোরটি ফাইভ ক্রস করেছে। এখন বার্ধক্য ঠেকানোর সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে শৈশবকে তাজা করা। তাই কোন রকম অসৎ উদ্দেশ্যে নয়, শুধুমাত্র নিজের বার্ধ্যকে ঠেকানোর লক্ষ্যে তোর সাথী হতে তৈরি আমি।

তাহলে আর অপেক্ষা কিসের? চল হাতে হাত রেখে ছুট লাগাই শৈশবের পানে। হাসতে হাসতে বললো আদী।

জাওয়াদ আর আদী দুজনই পা টিপে টিপে বাগানের এক কোনে বসে থাকা বড় ভাইয়ের দিকে রওনা হলো। এক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে অন্য চেয়ারের উপর দু পা মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে খুব আরাম করে বসে চিন্তাভাবনায় মগ্ন ছিল ফায়েজ। বাগানে পানি দেয়ার জন্য রাখা হোস পাইপটা ট্যাবের সাথে লাগানোই ছিল। পাইপ তুলে নিয়ে ফায়েজের পাশে থাকে গাছের সাথে এমন ভাবে ফিট করে দিলো জাওয়াদ যেন ট্যাব ছাড়লেই পানির ফোয়ারা ছোটে। পাইপ সেট করেই আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। আদী পানি ছাড়ার অপেক্ষাতে ট্যাবের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। জাওয়াদ ঈশারা করা মাত্রই ট্যাব ছেড়ে দৌড়ে আড়ালে চলে গেলো। ঐদিকে গভীর চিন্তারত অবস্থায় হঠাৎ গায়ের উপর ঝপঝপ পানির পতনে লাফিয়ে উঠলো ফায়েজ। প্রথমে ভেবেছিল বৃষ্টি, পর মূহুর্তেই হোস পাইপ দেখে বুঝে গেলো কারো দুষ্টুমি এটা। চারপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখে স্বভাব সুলভ চিৎকার জুড়ে দিলো ফায়েজ। চিৎকার শুনে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির ভেতর থেকে খাদিজা বেগম, মিসেস সুরাইয়া, আরমান সাহেব বেড়িয়ে এলেন। 

মিসেস সুরাইয়া উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন, ফায়েজ কি হয়েছে তোর চিৎকার করছিস কেন? আর তুই এমন ভিজেছিস কিভাবে? হোস পাইপ এখানে ফিট করেছে কে?

আশ্চর্য মা আমি যেসব প্রশ্ন করবো তুমি একের পর এক করে যাচ্ছো। আমিও তো জানতে চাচ্ছি কে করেছে এই কাজ? আদী কোথায়?

খাজিদা বেগম বললেন, আদীকে তো কিছুক্ষণ আগে বাগানের দিকেই আসতে দেখেছিলাম জাওয়াদের জন্য চা নিয়ে।

বাড়ির পেছনের দিক থেকে বেড়িয়ে আসতে আসতে চিন্তিত কন্ঠে জাওয়াদ বলল, কি হয়েছে এখানে?

জাওয়াদের পাশে আদীকে দেখা মাত্র চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো ফায়েজের। ছোটবেলা থেকেই ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুষ্টুমি করার অভ্যাস আদীর। কিন্তু জাওয়াদের সাথে আদীকে দেখার পর মারার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখে ফায়েজ বলল, জাওয়াদ আদী কি তোর সাথে ছিল এতক্ষণ?

চেহারায় ও কন্ঠে স্বাভাবিক গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে জাওয়াদ বলল, আদী আর আমি পেছনের বাগান থেকেই তো এলাম এখন। কিন্তু কি হয়েছে এখানে? তোরই বা এই অবস্থা কেন?

মাথা নাড়তে নাড়তে আপসোসের সুরে আদী বলল, আজকেও টেম্পারেচার ফোরটির উপরে থাকবে সারাদিন। উফ, যে গরম পড়েছে সারাক্ষণ নিজেকে পানিতে ভিজিয়ে রাখা ছাড়া আসলে কোন উপায় নেই। কিন্তু তোর তো আবার কোল্ড এলার্জীর আছে ফায়েজ। তাড়াতাড়ি যা ভেজা ড্রেস চেঞ্জ করে নে। নয়তো এখনই হাঁচি শুরু হয়ে যাবে।   

দুই ভাইয়ের খুবই স্বাভাবিক আচরণ ও কথাবার্তা শুনে এই কান্ড যে দুইজন মিলেই করেছে সেই ধারণা আরো পাকা পোক্ত ফায়েজের মনে। মিসেস সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, মা এখনো কি বলে দিতে হবে এই কান্ড কে বা কারা করেছে? 

খাদিজা বেগম চোখ পাকিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, এই কে করেছে এই বাঁদরামীটা? স্বীকার করলে শাস্তি কম দেয়া হবে। কিন্তু আমাকে যদি অনুসন্ধান করে অপরাধীকে খুঁজে বের করতে হয় তাহলে এক সপ্তাহ তার বাড়িতে থাকা ও খাওয়া বন্ধ। গাছের ডালে বাঁদরের মতো ঝুলে রাত পাড় করতে হবে বাঁদরামোর শাস্তি স্বরূপ।

ছোটবেলায়ও ঠিক এমনি করেই দুষ্টুমির স্বীকারোক্তি আদায়ে মা-খালামণিরা হুমকি দিতেন। সেই স্মৃতি মনে পড়তেই সশব্দে হেসে উঠলো জাওয়াদ। হেসে ফেললো আদী আর ফায়েজও। হাসি ছড়িয়ে পড়লো সবাই মুখেই।

এগিয়ে এসে দুই হাতে জাওয়াদ ও আদীকে দুই ঘুষি লাগিয়ে মিসেস সুরাইয়া হাসতে হাসতে বললেন, বুড়া হয়ে যাচ্ছিস তাও তোদের দুষ্টুমি কমে না। এই বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চারাও তোদের চাইতে ভদ্র-শান্ত।

ওরা এখনো ট্রেনিং সেন্টারে খালামণি। অদূর ভবিষ্যতে ওরাও দুষ্টুমিতে পুরোনোদের রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন গড়বে ইনশাআল্লাহ। 

খাজিদা বেগম হেসে বললেন, তোদের কাছ থেকে বাড়ির বাচ্চাদেরকে দূরে রাখার প্রকল্প হাতে নিতে হবে অতি শিঘ্রীই। নয়তো দুষ্টুমির ভাইরাসে বাড়ি ভরে যাবে। এখন চল নাস্তা করবি। জাওয়াদ তোর কন্যা নাস্তা পাঠিয়েছে তোর জন্য।

জাওয়াদ হেসে বলল, তাই? আলহামদুলিল্লাহ। ঠিকআছে তোমরা যাও। এইসব কিছু গুছিয়ে রেখে  আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি ইনশাআল্লাহ।

মাদার’স গ্রুপ চলে যাবার পর ফায়েজের দিকে তাকিয়ে জাওয়াদ আর আদী দুইজনই সরি বললো।

ফায়েজ হেসে বলল, কামঅন। সরি বলার কি হলো? আমি নিজেও এনজয় করেছি। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই তো আমার চিন্তাশীলতার সাথে তোদের গভীর শত্রুতা। তোরা বার বার এভাবে আমার চিন্তা ভগ্ন না করলে এতদিনে নির্ঘাৎ চিন্তাশীলতায় নোবেল প্রাইজ ট্রাইজ পেয়ে যেতাম আমি।

হেসে ফেললো তিন ভাই একসাথে। জাওয়াদ ফায়েজের কাঁধে হাত রেখে বলল, তুই যা চেঞ্জ করে আয়। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে। আমরা দুইজন গুছিয়ে নেবো সবকিছু।

তোদেরকে করতে হবে কেন? স্টাফদের কাউকে বলে দিলেই ওরা ঠিক করে দেবে সবকিছু।

জাওয়াদ হেসে বলল, ইট’স ওকে। স্টাফরা করলে তো আমাদের ছোটবেলা এনজয় করা হবে না। ছোটবেলায় দুষ্টুমি শাস্তি স্বরুপ আমাদেরকেই সব কাজ করতে হতো।

তাহলে আমিও থাকি তোদের দুজনের সাথে। আরেকটু ক্ষণ ভেজা ড্রেসে থাকলে কিছুই হবে না ইনশাআল্লাহ।

এরপর তিন ভাই মিলে ভিজে যাওয়া সবকিছু মুছে পরিষ্কার করে দিলো যাতে বাড়ির বাচ্চাদের কেউ বাগানে এসে অসাবধানতার কারণে পড়ে গিয়ে ব্যথা না পায়।

ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে এসে বসার পর মেয়ের বানানো নাস্তা দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলেও বুকের ভেতর চিন চিন করে ব্যথা করে উঠলো জাওয়াদের। সব মিলিয়ে ষোল ঘন্টার মতোই হয়েছে বাচ্চারা নূহার কাছে গিয়েছে। কিন্তু জাওয়াদের মনে হচ্ছিলো কয়েক যুগ পেড়িয়ে গিয়েছে বাচ্চাদেরকে দেখেনি, ওদের কথা শোনেনি, ওদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেনি।

আর কি দেবো তোকে? খাদিজা বেগমের প্রশ্ন শুনে নিজের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলো জাওয়াদ। হাসি মুখে বলল, আর কিছু লাগবে না মা।

পেট ঠান্ডা করার জন্য আর কিছু না লাগলেও মন ঠান্ডা করার জন্য মনেহয় এটা লাগবে। তোর বিচ্ছুরা লাইনে আছে। কথা বলবে তোর সাথে। বলতে বলতে কর্ডলেস বাড়িয়ে ধরলেন মিসেস সুরাইয়া।

হাত বাড়িয়ে কর্ডলেস নিয়ে কানের কাছে ধরতে ধরতে না ধরতেই অপর পাশ থেকে চারটি কচি কন্ঠের সম্মিলিত সালাম শুনতে পেয়ে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো জাওয়াদের চেহারা জুড়ে।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন