রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি......৪


 

মামণির জন্য খাবার প্যাক করে নিয়ে হসপিটালে যাবার উদ্দেশ্য গাড়ির কাছে এসে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে ভাইকে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো নাবিহার। চোখ বড় বড় করে বলল, জিশান বেরোও ওখান থেকে। এক্ষুনি বেরোও বলছি। পাপার পাশে আমি বসবো।  

বোনের কথা শুনতেই পাইনি এমন ভঙ্গী করে যেভাবে বসে ছিল ঠিক সেভাবে বসেই হাতে ধরে থাকা মোবাইল টিপতে লাগলো জিশান।  

সবসময়ের মতো এখনি তার দুই ভাইবোন ঝগড়া শুরু করবে বুঝতে পেরে পেছনের সিটে বসে থাকা জিহাদ গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে হাসি মুখে বলল, নাবিহা তুমি আমার কাছে চলে এসো। আমরা দুইজন সারা পথ গল্প করতে করতে যাব। জিশান একা একা মোবাইল নিয়ে থাক।    

জিশানকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো নাবিহা। কিন্তু ভাইয়ার কথা কখনোই অমান্য করতে ইচ্ছে করে না। তাই জিশানকে মারার ইচ্ছে পরিত্যাগ করে চুপচাপ গাড়ির পেছনে দরজা খুলে ভাইয়ার পাশে বসলো।  

মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি হেসে জিশান বলল, থ্যাংকইউ ভাইয়া। থ্যাংকইউ ভেরি ভেরি মাচ এই ঝগড়াটির হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য।

আর নীরবে সহ্য করতে পারলো নাবিহা। সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে জিশানের পিঠে ঘুষি লাগিয়ে দিলো। চুপচাপ সেই ঘুষি মেনে নেবার ছেলে মোটেও নয় জিশান। প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে ঘুরে  নাবিহাকে মারার চেষ্টা করলো। দুই ভাইবোনে মারামারির সেশন শেষ হবার আগেই জাওয়াদ এসে বসলো গাড়িতে। পাপাকে দেখা মাত্রই জিশান আর নাবিহা একদম শান্তশিষ্ট বাচ্চা হয়ে গেলো। দুই ভাইবোনকে মূহুর্তেই ভাব করে ফেলতে দেখে হেসে ফেললো জিহাদ।

কন্যা ও পুত্রদের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জাওয়াদ বলল, কি হচ্ছিলো এতক্ষণ এখানে?

জিশান দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, ব্ল্যাক স্যূট! পাপ্পা ইউ লুক ড্যাসিং। আজকে বাসা থেকে হসপিটাল যাবার পথে কত মানুষ হার্টফেল করবে আল্লাহ জানেন।   

ছেলের এইসব কথার সাথে মোটেও অপরিচিত নয় জাওয়াদ। তারপরও ধমকের সুরে বলল, জাস্ট শ্যাটাপ। ফালতু কথা বললেই কান ধরে গাড়ি থেকে বের করে দেবো। বুঝেছো?

হাসতে হাসতে পাপার গায়ের উপর ঢলে জিশান। পেছনে বসে থাকা নাবিহা আর জিহাদও যোগ দিলো হাসিতে।

জিশানকে গায়ের উপর থেকে ঠেলে সরিয়ে জাওয়াদ বলল, তোমাদের তিনজনকে নিয়ে বাইরে বের হওয়াই বন্ধ করে দিতে হবে। যতই বড় হচ্ছো ইমপসিবল হচ্ছো তোমরা তিনজন।
পাপা আমি কিন্তু কখনোই তোমাকে বিরক্তি করি না। পেছনের সীট থেকে বললো জিহাদ।

তুমি তো হচ্ছো মিশরির ছুরি। নিজে কিছু করো না কিন্তু অন্য দুইজন যাই করে নীরব সম্মতি দাও। তাই আমার অভিজ্ঞতা বলে, তোমার কাছ থেকে সবার চেয়ে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন।

হেসে ফেললো জিহাদ, জিশান, নাবিহা তিনজনই। এবার কন্যা আর পুত্রদের সাথে জাওয়াদও কন্ঠ মিলালো হাসিতে।  

বাড়ির মেন গেটের সামনে দু’হাত দুদিকে প্রসারিত করে ছোট মামাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশে বসা জিশানের দিকে তাকিয়ে জাওয়াদ প্রশ্ন করলো, তোমাদের মানাভাই গেটের কাছে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

পাপা মানাভাই মনেহয় চাইছে তুমি উনাকে উড়িয়ে দাও।

মানে?

জিশান হেসে বলল, মানে তুমি তো গত দুই সপ্তাহ বাড়িতে ছিলে না তাই জানো না। গত চার-পাঁচ দিন ধরেই মানাভাই দাদুমণিকে বলছে বৌয়ের অত্যাচারে নাকি দুনিয়াতে আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।

কথা অতি সত্য পাপা। পেছন থেকে বললো নাবিহা। দুই ভাইবোনের সমর্থনে হাসি চেপে ধরে জোড়ে জোড়ে মাথা ঝাঁকালো জিহাদ। 

জাওয়াদ হেসে বলল, তোমাদের কথাও উপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে। কিন্তু তারপরও উড়িয়ে দেবার আগে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করে নেই আসলেই উড়তে চায় কিনা তোমাদের মানাভাই।
জাওয়াদকে গাড়ি থামাতে দেখেই ছুটে এসে জানালা দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে আরমান সাহেব বললেন, আমিও তোদের সাথে যাবো।

জাওয়াদ হেসে বলল, শিওর। আমাদের গাড়িতে একটা সীট ফাঁকাও আছে।

ঘুরে এসে সামনে দরজা খুলে আরমান সাহেব বলল, এই নাবালক সামনের সীটে কি করে? এই যা পেছনে গিয়ে বস।  

জিশান নিজের ডান হাতের তালুতে বাম হাত দিয়ে ঘুষি দিয়ে বলল, আমি মোটেই নাবালক নই। আমার বয়স তেরো বছর নয় মাস।

আচ্ছা ঠিকআছে তেরো বছর নয় মাসের সাবালক দয়াকরে গিয়ে ভাইবোনের সাথে বোস। তোমাদের পাপার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।

অনিচ্ছা স্বর্ত্বেও বেরিয়ে হেলতে দুলতে পেছনে গিয়ে বসলো জিশান।

এবার বিজয়ীর হাসি হেসে নাবিহা বলল, থ্যাংকইউ মানাভাই। থ্যাংকইউ ভেরি ভেরি মাচ।

থ্যাংকইউ আবার কেন? প্রশ্ন করলেন আরমান সাহেব।  

নাবিহা হেসে বলল, টপ সিক্রেট মানাভাই। পরে তোমাকে চুপিচুপি বলবো।

বোনের খোঁচা গায়ে না মেখে গেমস খেলাতে মন দিলো জিশান। জিহাদও হেসে বই খুলে বসলো।

পেছনে ফিরে বাচ্চারা ঠিকমতো সীটবেল্ট বেঁধেছে কিনা আরেকবার দেখে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো জাওয়াদ।


‘আস্তে ব্যথা পাবে তোমরা’ জাওয়াদের বলা এই সাবধান বাণীর প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে হসপিটালে পৌঁছেতেই হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে বের হয়ে আইসিও এর দিকে ছুট লাগালো জিহাদ, জিশান আর নাবিহা। জাওয়াদ গাড়ি থেকে বের না হয়েই ছুন্তত বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

পাশের সীটে বসা  আরমান সাহেব হেসে বললেন, তোর কখনো মন খারাপ হয় না? আইমিন, এত কষ্ট করিস এই বাচ্চা তিনটার জন্য। কিন্তু মায়ের কাছে এলেই এরা তোকে বেমালুম ভুলে যায়।

জান্নাতের পানে ছুটে চলা সন্তানদের দেখে কোন পিতার কি কখনো মন খারাপ হতে পারে মামা?

মানে? ঠিক বুঝিনি তোর কথাটা?

জাওয়াদ হেসে বলল, মা সন্তানের জন্য জান্নাত মামা। আর জান্নাত পেলে মানুষ তো দুনিয়া ভুলে যাবেই।

আরমান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, বাহ! কি দারুন যুক্তি। চল বেরোই।

তুমি যাও আমি আসছি কিছুক্ষণ পর ইনশাআল্লাহ।

আরমান সাহেব জাওয়াদের কাঁধে হাত রেখে বললেন, এতগুলো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। অথচ এখনো তোদের মধ্যে সেই প্রথম দিনের মতোই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব একে অন্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ব্যাপারে। আচ্ছা আমি যাচ্ছি।  

মামা বেড়িয়ে যাবার পরও চুপচাপ গাড়ির ভেতরেই বসে রইলো জাওয়াদ। এই একটি সময়েই   জীবনকে খুব বেশি জটিল-কঠিন মনেহয় জাওয়াদের কাছে। জীবনে আসা প্রতিটা মূহুর্তকে কিভাবে সুন্দর ভাবে ফেস করতে হয়। সেই ব্যাপারে সবাইকে পরামর্শ দেয়া জাওয়াদ এই একটি মূহুর্তকে কিভাবে ফেস করতে হবে নিজেকে বোঝাতে বার বার ব্যর্থ হয়। এবং প্রতিবারই নতুন করে উপলব্ধি করে জগতে সবচেয়ে সহজ কাজ অন্যেকে বোঝানো, অন্যেকে পরামর্শ দেয়া। আর সবচেয়ে কঠিন নিজেকে বোঝানো, নিজেকে কনভিন্স করা। সেজন্যই হয়তো জগতে যে কিছুই পারে না, সেও একজন উত্তম পরামর্শদাতা। আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে গাড়ি থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে আইসিও এর দিকে রওনা দিলো জাওয়াদ।

দূর থেকেই জাওয়াদ দেখতে পেলো জিহাদ আর নাবিহা খুব আনন্দিত ভঙ্গীতে তাদের মামণির সাথে গল্প করছে। জিশানকে সবার সাথে দেখতে না পেয়ে আশেপাশে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছিল কোথায় সেই দুষ্টু ছেলেটা। এমন সময় পেছন থেকে জাওয়াদকে জাপটে ধরে জিশান বলল, পাপ্পা আমি এখানে।    

কোথায় ছিলে তুমি? প্রশ্ন করলো জাওয়াদ।

জিশান হাসতে হাসতে বলল, তুমি আসছো না দেখে তোমার খোঁজে গিয়েছিলাম। পাপা হেল্প লাগবে হেল্প?

মানে?

মানে সাহায্য।

কিসের সাহায্য?

জিশান ঠোঁট টিপে হেসে বলল, মা’র সাথে কথা শুরু করার ব্যাপারে। আমি জানি দেখা হলে  কিভাবে মা’র কথা শুরু করবে সেটা বুঝতে পারো না তুমি। পাপা তুমি চাইলে আমি কথা শুরু করিয়ে দিতে পারি।

শ্যাটাপ এন্ড গেটলষ্ট বলে সামনে দিকে পা বাড়াতেই ‘মাআআআআ’ বলে জিশানের চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো জাওয়াদ।

জিশানের চিৎকার শুনে ছুটে নূহা। কি হয়েছে জিশান? ঘাবড়ে যাওয়া কন্ঠে প্রশ্ন করলো নূহা।  জবাবে কিছু না বলে শক্ত করে দু’হাতে মাকে জড়িয়ে ধরলো জিশান। কি হয়েছে ওর? এমন করছে কেন? ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জাওয়াদকে প্রশ্ন করলো নূহা।

কি জবাব দেবে বুঝতে না পেরে জাওয়াদ বলল, আমি আসলে ঠিক জানি না।

কিন্তু তুমি তো ওর পাশেই ছিলে। ব্যথা পায়নি তো?

এখানে কোথায় ব্যথা পাবে? আচ্ছা ওকেই বরং জিজ্ঞেস করি চলো। জিশান কি হয়েছে তোমার? দেখো তোমার মা টেনশন করছে।

জিশান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, পাপা, মা আমার কিছু হয়নি তো।

তাহলে চিৎকার করলে কেন? অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো নূহা।

জিশান হেসে বলল, মা তোমাকে দেখেই চিৎকার করে মাআআআআআআ ডাকতে ইচ্ছে করলো  হঠাৎ। এখন আবারো ইচ্ছে হচ্ছে। আরেকবার ডাকি প্লিজ?  

নূহার মুখে হাসি ফুটে উঠলেও। বিরক্ত কন্ঠে জাওয়াদ বলল, জিশান এটা আইসিইউ।

সরি পাপা। আর কখনো এমন হবে না ইনশাআল্লাহ। দু’ হাতে দু’কান ধরে বললো জিশান।

ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে জাওয়াদ বলল, বাবার কি অবস্থা এখন নূহা?

আগের মতোই আছেন। তুমি কি বাবাকে একটু দেখবে প্লীজ? 

হ্যা অবশ্যই। এখনই যাচ্ছি আমি।  

চলো আমিও যাচ্ছি সাথে।

পাপা আর মাকে কথা বলতে দেখে আনন্দে জিশানের চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। অনেক কষ্টে ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে পাপা আর মায়ের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন