রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২৪



রান্নাঘরের ঢুকেই দু'হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে তওবা, তওবা, তওবা বলে ছোট খাট একটা চিৎকার দিলো নূহা।

খাদিজা বেগম বিকেলের নাস্তা বানাচ্ছিলেন আর রায়হান সাহেব পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। হঠাৎ নূহার চিৎকার শুনে দু'জনেই খানিকটা চমকে উঠলেন।

চোখের সামনে থাকে হাত না সরিয়েই নূহা বলল, আমি তো এসেছিলাম বিকেলের নাস্তার আয়োজন দেখতে। কিন্তু কিচেন যে লাভার পয়েন্ট হয়ে গিয়েছে সেটা তো জানাই ছিল না। দুঃখিত মিস্টার এন্ড মিসেস কোপত-কপোতি। আপনারা মনের আনন্দে বাক বাকুম করেন। আমি প্রস্থান করছি।

রায়হান সাহেব স্বশব্দে হেসে ফেললেন। খাদিজা বেগমও হেসে বললেন, থাপ্পড় খাবি একটা দুষ্টু মেয়ে। যাচ্ছিস কোথায়? এদিকে আয় চায়ের পানি বসা।

রায়হান সাহেব হেসে বললেন, হ্যা মা চা কর বেশি করে। কতদিন রান্নাঘরে বসে গল্প করতে করতে তোর হাতের চা খাওয়া হয়নি।

নূহা হেসে বলল, এক্ষুণি করছি পাপা। কিন্তু মা তুমি কেন নাস্তা বানাচ্ছো? বাড়ি ভর্তি বৌ। গেলো কোথায় সব গুলা একসাথে?

খাদিজা বেগম বললেন, ওরাই বানায় নাস্তা। আজ আমিই ইচ্ছে করে এসেছি। আমাদের বাড়িতে নাক বোঁচা, লিলিপুট সাইজের একজন মেহমান এসেছে। তার আবার আমার হাতের বুন্দিয়া আর নিমকি খুব পছন্দ। তাই বানাচ্ছি।

নূহা হেসে ফেললো। এরপর খাদিজা বেগমকে জড়িয়ে ধরে আদর করে চায়ের পানি চাপালো।

খাদিজা বেগম মৃদূ হেসে বললেন, আজ যে বললি না?

নূহা তাকিয়ে বলল, কি?

আমি লিলিপুট না তোমার ছেলে ল্যাম্পপোস্টের মতো লম্বা। আমার নাক একদম পারফেক্ট। তোমার ছেলের নাক আদিবাসীদের বর্শার মত।

নূহা হেসে বলল, জানোই তো সব শুধু শুধু বলার দরকার কি?

খালা-ভাগ্নীকে এখনই বাঁধা না দিলে ইমোশনাল হয়ে দুজন হয় কান্না করবে নয়তো ঝগড়া করবে সেটা জানা থাকার কারণে রায়হান প্রসঙ্গ অন্যদিকে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে বললেন, নূহা মা আজ রাতে তোর সেই বিখ্যাত ককটেল বিরিয়ানী রান্না করার আইডিয়াটা কেমন হয় বলতো?

নূহা কিছু বলার আগেই খাদিজা বেগম বিরক্ত কন্ঠে বললেন, মেয়েটা আসতে না আসতেই তোমার ফরমায়েশ শুরু। আর রাতের বেলা বিরিয়ানী খাবে? প্রেশার আর ডায়াবেটিসের কি দশা সেটা খেয়াল আছে?

রায়হান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আছে আছে সবই খেয়াল আছে। কিন্তু আমার নূহা মার হাতের রান্নায় স্পেশাল বরকত আছে বুঝলে। যতই খাই না কেন প্রেশার আর ডায়াবেটিস ঠিক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকবে। তাই নারে মা?

নয়তো আবার কি? মা শোনো পাপার প্রেশার আর ডায়াবেটিসকে শুধু মিষ্টি করে বলতে হবে স্ট্যাচু। দেন খাওয়া-দাওয়া এন্ড দেন ওভার। এমন কত্তো করেছি আমি আর পাপা আগে।

সেটাই তো! তুমি বুঝলে না খাদিজা। মাথা নাড়তে নাড়তে আফসোসের সুরে বললো রায়হান সাহেব।

খাদিজা বেগম হেসে বললেন, আনন্দবাড়ির সব বুঝ তো তোমাদের চাচা-ভাতিজির মাথায়। আমরা ভাগে পেলেই না কিছু বুঝবো।

এই সময় মা মা বলে চিৎকার করতে করতে জিশান আর জারিফ ঢুকলো। এবং কাউকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুইজন দুইপাশ থেকে নূহাকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে বেড়িয়ে গেল।

রায়হান সাহেব হাসি মুখে বললেন, নূহা মা এসেছে দুই ঘন্টাও হয়নি। অথচ দেখো পুরো বাড়ির পরিবেশটাই কেমন আনন্দময় হয়ে উঠেছে আলহামদুলিল্লাহ।

খাদিজা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, বাড়ির সব পাপেট আর তাদের সুতো নূহার আঙ্গুলে জড়ানো। বুঝলে?

রায়হান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তোমাদের সব কয়টা বোন আর তাদের কন্যাদের এই একটা জায়গাতেই সবচেয়ে বেশি মিল। তোমরা সবাই কথার সম্রাজ্ঞী। আমাদের বিয়ের পর তুমি অনর্গল কথা বলতে আর আমি বিমোহিত হয়ে শুনতাম তোমার কথা। নূহা মা আর জাওয়াদের বিয়ের পরও প্রায়ই দেখতাম নূহা মা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে আর জাওয়াদ ঠোঁটের কোণে হাসি মেখে চুপচাপ বসে কথা শুনে যাচ্ছে।

কি সাংঘাতিক কথা! তুমি কি ছেলে আর ছেলের বৌয়ের দিকে নজর রাখতে নাকি?

রায়হান সাহেব হাসতে হাসতে বলল, তোমার চেয়ে মনেহয় একটু কমই রাখতাম। তাছাড়া তোমার ছেলে আর ছেলের বৌ তাদের রুমে কম আর বাগানে, ছাদে, লনে নয়তো বারান্দায় বসে কথা বেশি বলতো। সেই কথা কি মনে আছে?

খাদিজা বেগম হেসে বলল, রান্নাঘরেও। জাওয়াদ যে এমন বৌ পাগল স্বভাবের হবে আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। বাড়িতে থাকলে নূহা যেখানে যেত পিছু পিছু সেখানেই হাজির হয়ে যেত। কতদিন যে আমি ধমক দিয়ে রান্নাঘর থেকে ওকে তাড়িয়েছি। তবে আমি সবচেয়ে বেশি কি মিস করি জানো?

হুম, ওদের মায়ায় জড়ানো খুনসুটি।

হ্য ননস্টপ চলতেই থাকতো দুইজনের খুনসুটি। সকালে নাস্তার টেবিলে বসে শুরু করতো রাতে বাড়ি নীরব হয়ে যাবার পরও জাওয়াদের হাসির শব্দ ভেসে আসতো মাঝে মাঝে। সারা জীবনে আমি আমার ছেলেকে যতটা না হাসি-আনন্দে দেখেছি, তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি ঐ আড়াই বছরে দেখেছি। এখনো জাওয়াদ সারাক্ষণই হাসে, দুষ্টুমি করে কিন্তু কি যেন একটা নেই ওর এই হাসিতে যা তখনকার হাসিতে ছিল। আজকাল প্রায়ই মনেহয় দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেবার আগে কি আবারো আমার ছেলের ওমন অন্তর শীতল করা হাসি শুনতে পাবো?

স্ত্রী কাঁধে হাত রেখে রায়হান সাহেব বললেন, এসব কথা ভেবে শুধু শুধু মন খারাপ করো না খাজিদা। আর নূহা মাকে আবার এসব বলতে যেও না। মেয়েটা এত বছর পর সবার সাথে কয়েকটা দিন থাকতে এসেছে। ওকে হাসি-আনন্দে কাটাতে দিও সময়টা তোমরা। সুরাইয়া, নুসরাত, শরীফা ওদেরকেও বলে দিও যেন এমন কিছু না বলে যাতে নূহা আপসেট হতে পারে। আর রাহাতের আদর-যত্নেও যেন কোন অবহেলা না হয়। মনে আছে তো নূহার সাথে বিয়ের সময় রাহাতকে আমরা আমাদের ছোট ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছিলাম সবার কাছে।

আমার সব মনেআছে। ইনশাআল্লাহ রাহাতেরও কোন অযত্ন হবে না। তুমি যাও দেখো কি করছে তোমার নাতী-নাত্নীরা মিলে ওদের মায়ের সাথে।

রায়হান সাহেব বেরিয়ে যাবার পর এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ধীরে ধীরে ছাড়লেন খাদিজা বেগম। নূহা বাড়িতে এলে খুশি যেমন হন, তেমনি ক্ষণে ক্ষণেই মনটা অতীতের আনন্দময় দিনগুলোতে ছুট লাগায়। এখন যেমন মনে হচ্ছিলো ঐ তো জাওয়াদ আর নূহা নাস্তার টেবিলে বসে নিত্যদিনের মতো কোন একটা টপিক নিয়ে তর্ক জুড়ে দিয়েছে। এক পর্যায়ে তোমার সাথে কথা বলাটাই অর্থহীন বলে রাগ করে উঠে বাইরে চলে গেলো জাওয়াদ। নূহা কিছুক্ষণ গুম ধরে বসে থেকে ধুপধাপ করে নিজের চলে গেলো। বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই পুত্র আর পুত্র বধূর এইসব কর্মকান্ড গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল খাদিজা বেগমের। প্রথম প্রথম কিছুটা চিন্তিত, এরপর কিছুদিন বিরক্ত হলেও শেষের দিকে ব্যাপক মজা পেতেন ওদের ঝগড়াঝাঁটি দেখে।      

আদরের বৌয়ের সাথে রাগ করে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা সম্ভব হতো না জাওয়াদের। কিন্তু একদিন ঝগড়া করে বেরোনোর পরও একদম বিকেলে বাসায় ফিরলো। খাদিজা বেগম জাওয়াদকে দেখে বললেন, অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে সারাদিন তোর বৌ বেডরুম থেকে বের হয়নি। কিছু খায়ওনি। আমি বেশ কয়েকবার তেল মেজেছি কিন্তু কোন কাজ হয়নি।

জাওয়াদ জবাবে বলেছিল, পিচ্ছিল পদার্থকে তেল মাজলে কাজ না হওয়াটাই স্বাভাবিক মা। কিছু কিছু মানুষ হচ্ছে বাইম মাছের মতো। তাদেরকে ছাই দিয়ে ধরতে হয়। আমার সাথে চলো মা তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি কিভাবে ধরতে হয়।

খাদিজা বেগম হাসতে হাসতে বললেন, হয়েছে আমাকে শেখাতে হবে না। তোর বাইম মাছ তুই ধরতে পারলেই যথেষ্ট। যা গিয়ে ধরে নিয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।

নাহ খাবার বরং আমি সাথে করে রুমে নিয়ে যাই। মাছ এখন নদীতে তাকে ডাঙ্গায় উঠানোর জন্য খাদ্য দরকার।

খাদিজা বেগম খাবার রেডি করে দিলে জাওয়াদ রুমে গেলো। খাবারের প্লেট হাতে জাওয়াদকে রুমে ঢুকতে দেখার সাথে সাথে চোখ-মুখ গম্ভীর করে ফেলেছিল নূহা। জাওয়াদ খুব স্বাভাবিক ভাবে পাশে গিয়ে বসে বলল, সুন্দর সুন্দর করে একটু হা করো তো নূহা বেবী! এসো তোমাকে খাইয়ে দেই। মা বললো তুমি নাকি সকাল থেকে কিছুই খাওনি? এটা কিছু হলো? তোমার সাথে শেষ বোঝাপড়া করার স্বিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি ফিরেছি আমি। কঠিন কিছু কথা বলবো আজ তোমাকে। সেসব শুনে যাতে ফিট না খাও। সেজন্য আগে খাদ্য খেয়ে ফিজিক্যালি ফিট হতে হবে তোমাকে। সকালের কথাই ভেবে দেখো। নাস্তা করেছিলে বলেই তো ঐভাবে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পেরেছিলে।  

আমি চিৎকার-চেঁচামেচি করছি? নাকি তুমি আমাকে উল্টো পাল্টা কথা বলেছিলে?

আমি তোমাকে উল্টো পাল্টা কথা বলেছি? আমি? কখন?

কখন মানে? সকালে। আমাকে ব্লক হেডেড গার্ল বলেছো। আরো বলেছো আমি ইগোইস্ট, অ্যারোগেন্ট।

এসব তো সঠিক কথা। উল্টো পাল্টা কি বলেছি সেটা শুনি?

সামনে থেকে যাও। কথা বলবে না আমার সাথে তুমি। খবরদার বলছি।

ঠিকআছে এই কথাগুলোই যদি তোমার কাছে উল্টো পাল্টা মনে হয়ে থাকে। তাহলে ভেবে চিন্তে বলো যে, এই কথাগুলো বলতে আমাকে বাধ্য কে করেছিল?

তোমাকে আবার বাধ্য করা লাগে নাকি? তোমার তো জন্ম থেকেই বিষ জবান। 

আচ্ছা ঠিকআছে কার জবানে মধু আর কার জবানে বিষ সেটা নিয়েই আজ ডিবেট হবে। এখন আগে তুমি খেয়ে নাও। আরে এখনো মুখ করে রেখেছো বন্ধ কেন? হা করো।

নূহা তখন বাধ্য মেয়ের মতো হা করলো।

নূহাকে খাইয়ে দিতে দিতে জাওয়াদ বলল, চোখ মুখ এমন ফোলা ফোলা কেন তোমার? কান্না টান্না করেছো নাকি?

করলে করেছি। তাতে তোমার কি?

আমার কিছুই না। জাস্ট কি পরিমাণ লবণ পানি শরীর থেকে বের হয়েছে সেই সম্পর্কে অবগত হতে চাইছি। আমি এক গ্লাস লবণ পানি নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। সমান সমান হবে তো নাকি আরো আনতে হবে?

ব্যাস একটুকু কথাতেই রাগ ভুলে হেসে ফেললো নূহা। তারপর জাওয়াদকে ঢিসুম করে ঘুষি লাগিয়ে বলল, তুমি একটা অসহ্য। যাও তোমার হাতে আমি খাবো না। এতক্ষণ যা খেয়েছি সব এখন গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করে ফেলে দেব।

জাওয়াদ হেসে ফেলেছিল তখন। হাসির আভা ফুটে উঠেছিল নূহার চেহারা জুড়েও।

বাগান থেকে বাচ্চাদের প্রচন্ড রকম হৈ চৈ ভেসে এসে খাজিদা বেগমের দিবা স্বপ্নকে ভেঙে দিয়ে গেলো হঠাৎ করেই। বুন্দিয়া ভাঁজাও শেষ হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। নাস্তা বানানোর কাজে সমাপ্তি টেনে নাতী-নাতনীদের আনন্দ উল্লাসে শরিক হবার জন্য বাগানের দিকে রওনা দিলেন তিনি।

@

বাড়িতে আসার পর থেকেই আত্মজা ঘুরে ঘুরে একটু পর পর শুধু একই প্রশ্ন করছিল, আপ্পা বাপীর সাথে কখন কথা বলবে? তোমার কোন ঠিক ঠিকানা নেই দেখা যাবে একটু পরেই দুই সপ্তাহ থাকার প্ল্যান ক্যান্সেল করে তুমি ছুট লাগাবে। সবার আগে তাই বাপীর সাথে কথা বলতে হবে তোমাকে। নয়তো আমি এক মূহুর্তের জন্যও তোমাকে শান্তিতে কোথাও বসতে দেবো না। আত্মজার সামনে হাসলেও মনে মনে নিজের ইমেজের কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে বাড়ির ছোটদের কাছে ভেবে খুবই লজ্জা লাগছিল নূহার। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো। পর মূহুর্তেই আবার মনেহলো এখন নিজের উপর রাগ করার নয়, নিজের হারানো ইমেজকে ফিরিয়ে আনার সময়। একসময় খুব দৃঢ়তার সাথে বলতো, আলহামদুলিল্লাহ নূহা যা বলে তাই করে। কিন্তু সেই নূহা যে নিজের মাঝেই কোথাও গুম হয়ে গিয়েছে সেটা আজকাল খুব ভালো ভাবেই টের পাচ্ছিলো। তাকে খুব দ্রুত ফিরিয়ে আনার তাগিদও অনুভব করছিল। মাগরীবের নামাজ আদায় করার পর বাচ্চাদের কাছ থেকে এক ঘন্টার ছুটি নিয়ে বাপীর সন্ধানে বের হলো নূহা। নুসরাত খালামণির ছোট কন্যা জুয়াইরিয়াকে একা একাই গজগজ করতে করতে বারান্দার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় পায়চারী করতে দেখে দাঁড়িয়ে ওকে টেনে ধরে থামালো নূহা। জুয়াইরিয়া থেমে নূহাকে দেখে বলল, ওহ! সরি আপ্পা তুমি কখন এসেছো? খেয়াল করিনি একদম। কিন্তু বেখেয়াল হবো না কেন বলো? চারপাশের মানুষগুলোর কর্মকান্ড দেখলে মাথা ঠিক থাকে না। 

হাসি মুখে নূহা বলল, চারপাশের মানুষ আবার কি করলো তোকে?

প্রচন্ড বিরক্তি মেশানো কন্ঠে জুয়াইরিয়া বলল, মানুষের মুখে এক কথা আর অন্তরে আরেক কথা। এদের দেখে মনেহয় দুনিয়াটা আসলেই একটা নাট্যশালা আর এরা সবাই অভিনেতা-অভিনেত্রী। তাই সর্বক্ষেত্রে অভিনয় করে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করার চেষ্টা করে।

হেসে ফেললো নূহা। ছোট বোনের স্বভাব অজানা নয় মোটেই। কথা ও কাজের অমিল একটুও পছন্দ করে না। মেনে নিতে পারে না কথা ও আচরণের পার্থক্যকে। নিজেও খুব সতর্ক এই ব্যাপারে। কিন্তু অনেক সময় যে মানুষ ইচ্ছের বিরুদ্ধেও কথা ও কাজের গড়মিল করতে বাধ্য হত এটা কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। 

নূহাকে হাসতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো জুয়াইরিয়া। বিষাদ জড়ানো কন্ঠে বলল, জানো আপ্পা আজকাল মনেহয় জীবনটা আসলেই এক নাট্যশালা। আর মানুষ বিভিন্ন দৃশ্য প্রতিনিয়তই শুধু অভিনয় করে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূহা বলল, মানুষকে অভিনয় করতে হয় এটাকে কি ভয়াবহ কোন সমস্যা মনেহয় তোর?  

তোমার হয় না?

আমার কেন জানি এমনটা মনেহয় না বরং মনেহয় এটাই স্বাভাবিক। জীবনে যেহেতু অসংখ্য চরিত্র, অসংখ্য দৃশ্য তাই সর্বক্ষেত্রে একই রকম আচরণ করা সম্ভব নয়। সেহেতু দৃশ্য ভেদে কার্যকলাপ ভিন্ন ভিন্ন হতেই হবে। ভেবে দেখ, একজন নাটকের অভিনেত্রী যখন কোন দৃশ্য অভিনয় করে যে সর্বান্তক চেষ্টা করে সেই মুহুর্ত ও চরিত্রের সাথে মিশে যেতে। কারণ সে জানে যে তার অভিনয় ভালো না হলে পুরো পরিশ্রম বৃথা যাবে। তার নাটক ফ্লপ করবে। সে সম্মানী পাবে না, সম্মানী পেলেও খ্যাতি পাবে না। অথচ অভিনয় ভালো হলে বিখ্যাতও হয়ে যেতে পারে। তাই বার বার সে চেষ্টা করে অভিনয়কে নিখুঁত থেকে নিখুঁততর করতে।

হুম! তা ঠিক।  

মানুষ ভাবুক মনের ছন্দে কল্পে শব্দে বিজ্ঞের ছলে বলে তো ফেলে জীবন এক অভিনয় ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু নিজ নিজ দৃশ্য অভিনয় করতে অপারগতা প্রকাশ করে। যেমন, অফিসের দৃশ্য মন থাকে বাসায়, আবার ক্লাসের দৃশ্য মন বের হয় বিশ্বভ্রমণে। তাই তোর যদি মনেহয় জীবন এক নাট্যশালা। তাহলে আপসোস আর দীর্ঘশ্বাসের বদলে যখন যে দৃশ্য এসে হাজির হবে, তখন সেই চরিত্রে নিখুঁত অভিনয় করার চেষ্টা করবি। এখন যেহেতু আমার সামনে আছিস পারফেক্ট ছোট বোন হতে চেষ্টা কর। যা আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আয়। তারআগে বলে দে ঠিক কোথায় গেলে তোর বিপিতাকে পাওয়া যাবে?

জুয়াইরিয়া হাসতে হাসতে বলল, বাপীকে কিছুক্ষণ আগে মসজিদ থেকে বের হয়ে লাইব্রেরীর দিকে যেতে দেখেছি। জানো আপ্পা তোমার সাথে কথা বললে মনের ক্ষোভ উবে যায়। তখন মনেহয় চারপাশের সবাই ঠিক আছে। আমিই মনেহয় বুঝতে ভুল করি।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। সূরা আনআম এর ৩২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,“আর দুনিয়ার জীবন? এ তো খেল তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। পরকালের বাড়ী ঘর তাদের জন্য উত্‍কৃষ্ট যারা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে। তোমরা কি তা অনুধাবন করনা?” আমার কি মনেহয় জানিস? জীবনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং নিজ নিজ দায়িত্ব-কর্তব্যকে সুষ্ঠভাবে পালন করার জন্য মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজনীয়তা অনিস্বীকার্য। কেননা যে কোন কাজের সুষ্ঠ সম্পাদনের পূর্বশর্ত হচ্ছে মানসিক স্থিরতা। এই মানসিক স্থিরতা আসে মনের আনন্দময়তা থেকে। আনন্দময়তা আসে ভালো লাগা থেকে। ভালো লাগা আসে মনের চাহিদা পূরণের তৃপ্তি থেকে। আর এই তৃপ্তি পেতে গিয়েই আমরা ভুলে যাই মানব জীবনের শেষ পরিণতি হচ্ছে পরকালের জীবন।  

হ্যা আপ্পা ঠিক বলেছো।  

সেই উপলব্ধি দিয়ে কি হবে বল যা আয়না তো হতে পারেই না উল্টো ভুল প্রতিচ্ছবি দেখায়? পৃথিবীর জীবন হচ্ছে পরকালের জীবনের পূর্বশর্ত। আর পরকালের জীবন হচ্ছে পৃথিবীর জীবনের আয়নায় প্রতিচ্ছবি। এই জীবনে আমরা যাই করবো পরকালের জীবনে সেটাই পাবো। এই জীবনের ধ্বনিত শব্দরাই প্রতিধ্বনি তুলবে পরকালে। এই জীবনের অভিনয় যত ভালো হবে, পরকালে মূল্যায়ন তত বেশি হবে। তাই পরকালের জীবনে পুরষ্কার পেতে চাইলে পৃথিবীর জীবনে করা অভিনয়ের মাধ্যমেই তা লাভ করতে  হবে। তাই জীবনকে যদি তোর অভিনয় মনেহয় তাহলে নিজেকে ভালো অভিনেত্রী হিসেবে গড়ে তোল। জীবন যখন যে দৃশ্যের অবতারণা করবে তার সামনে, সেই দৃশ্যকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা। কখনো বাবা-মা, কখনো সন্তান, কখনো ভাই-বোন, কখনো প্রতিবেশী, কখনো ছাত্র-ছাত্রী বা শিক্ষক, কখনো বা পথচারী। চরিত্র যেটাই হোক অভিনয় হতে হবে একদম খাঁটি। অ্যাওয়ার্ড না পেলেও অন্তত নমিনেশন পাওয়ার মত।কারণ প্রতি মুহুর্তেই পড়ছে আয়নায় প্রতিচ্ছবি। বুঝেছিস?

জুয়াইরিয়া হেসে বলল, জ্বি আপ্পা। আলহামদুলিল্লাহ। ঠিকআছে তুমি যাও বাপীর কাছে। আমি এক্ষুণি তোমার জন্য কফি নিয়ে আসছি ইনশাআল্লাহ।

বোনের গাল টেনে আদর করে দিয়ে লাইব্রেরীর দিকে হাঁটতে শুরু করলো নূহা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন