রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...৯




রুমে ঢুকে এক মূহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে গেলো নূহা। বিশাল রুমের কোথাও এক বিন্দু রঙের ছিটাও নেই। রুমের দেয়াল, ছাদ, ফার্নিচার থেকে নিয়ে শুরু করে জানালার পর্দা এমনকি নয়নাভিরাম করে ফুল দিয়ে যে বিছানাটা সাজানো হয়েছে সেই ফুলগুলো, বিছানার চাদর সবকিছু ধবধবে সাদা। চারিদিকে সারা রঙের ছড়াছড়িতে পুরো রুমে অদ্ভুত একধরণের শুভ্রতা ছেয়ে গেলেও, খুব বেশি প্রাণহীন লাগছিল সবকিছু। অবাক হয়ে পাশে দাঁড়ানো জাওয়াদের দিকে তাকালো নূহা।

খুব সিরিয়াস কন্ঠে জাওয়াদ বলল, যেভাবে আছো ঠিক এমন করেই দাঁড়িয়ে থাকো। একদম নড়াচড়া করবে না। কোন কথাও বলবে না। তাকাও আমার দিকে। তোমার মন সমুদ্রে ঢেউ তোলা শব্দরা স্রোতের টানে চোখের নদীর কূলে এসে ভিড়তে শুরু করেছে। সযতনে মোতিগুলোকে তুলে নিতে দাও আমাকে। তাদের একটির সাথে অন্যটিকে গেঁথে নিতে দাও। হুমম, মিশন কমপ্লিট। এখন তুমি চোখের পলক ফেলতে পারো, নড়াচড়াও করতে পারো। তোমার মনের শব্দরা চোখের দুয়ারে এসে উন্মুখ হয়ে জানতে চাইছে, এই ঘরের সবকিছু রঙহীন কেন?

নূহা হেসে বলল, আমি একটু দুষ্টুমি করলে তো হাজারটা কথা শোনান আমাকে। আর নিজে যে সারাক্ষণ ফান করেন সেটা যেন কিছুই না। কিন্তু রুমের সবকিছু এমন সাদা কেন? অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে আমার।

সেকি তুমি জানো না রুমের সবকিছু সাদা কেন?

জানতে কি এত অবাক হতাম নাকি জিজ্ঞেস করতাম?

জাওয়াদ হেসে বলল, তাও অবশ্য ঠিক। আচ্ছা শোনো বলছি কেন রুমের সবকিছু সাদা। প্রথম কারণ হচ্ছে, সাদা শান্তির প্রতীক। আলহামদুলিল্লাহ আমি প্রচন্ড রকম শান্তিবাদী মানুষ। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে এমন শান্তিময় আবহ বজার রেখে চলতে আপ্রাণ চেষ্টা করি। শান্তি বজায় রাখার জন্য সহনশীলতার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতেও সর্বদা প্রস্তুত থাকি। কিন্তু তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে, সহনশীলতা মানে সকল অন্যায়-অবিচার মুখ বুঝে মেনে নেয়া নয়। মন ও মস্তিষ্কের সমন্বয়ে সঠিক পন্থায় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং অন্যায্য প্রতিরোধের মুখে বেসামাল না হওয়া হচ্ছে সহনশীলতা। তাই শান্তিবাদী হলেও আমি কখনোই কারো অন্যায় মেনে নেই না। কেউ যদি বাধ্য করে আমি তার জীবনের চরম অশান্তির কারণও হয়ে যেতে পারি অতি নিপুণতার সাথে।

এটা কি হুমকি?

জাওয়াদ হেসে বলল, উহু, এটা হচ্ছে আমার শান্তিবাদীতার ডেফিনেশন। এবার তুমি আসল কারণ শোনো। এই রুমের সবকিছু সাদা কারণ আমি চাই আমাদের যুগল জীবনের সবকিছু দুজন মিলে একসাথে রাঙাতে। এবং রঙহীন থেকে রঙিন জীবনের আমাদের সেই সফর এই রুম থেকেই শুরু হবে। আজ সারারাত আমরা দুজন মিলে এই প্রাণহীন ঘরে রঙের গুঞ্জরন তুলে দেবো। পৃথিবীর বুকে নতুন একটি সংসারের জন্ম হতে যাচ্ছে। সামথিং স্পেশাল কিছু তো দাবী করে সময় আমাদের কাছে তাই না? তাছাড়া জীবনের সাঁঝের বেলায় আমাদের কাছে আদুরে কন্ঠে গল্প শোনার আবদার নিয়ে বসে থাকা নাতী-নাতনীদের জন্য গল্পের সুন্দর সুন্দর প্লট রচনা করার সময় তো এখনই। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আজ আমরা রচনা করবো আমাদের যুগল  জীবনী গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পৃষ্ঠা। আলমিরার ভেতরে দেখো কালারফুল সবকিছু আছে। এখন বলো কোথা থেকে শুরু করবে আমাদের রঙিন কাব্যগ্রন্থের রচনা?

নূহা হেসে বলল, জানালার পর্দা থেকে। তবে আমি সাদা রঙেরও সরব উপস্থিতি চাই আমাদের কাব্যগ্রন্থে। তাই সবকিছুতেই হোয়াইট শেড থাকবে।

জাওয়াদ হেসে বলল, ঠিকআছে তাহলে চলো শুরু করি নতুন এক গল্পের। হাসি মুখে নূহা জাওয়াদের বাড়িয়ে ধরা হাতে হাত রাখলো।

জাওয়াদের রুমে পা দিতেই ষোল বছর আগের স্মৃতি নূহার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। এক্সিডেন্টের কারণে হসপিটালে বিয়ে হবার পর পুরোপুরি সুস্থ হতে প্রায় তিন মাস লেগেছিল নূহার। সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসার পর পুরো পরিবারের উপস্থিতিতে অনেক আনন্দের মধ্যে দিয়েই নূহা আর জাওয়াদের বিয়ের ওলীমা হয়েছিল। ওলীমার দুই সপ্তাহ পরেই নূহাকে নিয়ে অরেগানোতে চলে গিয়েছিল জাওয়াদ। যদিও মাত্র চারমাসই থাকা হয়েছিল কিন্তু ওখানেই শুরু হয়েছিল দুজনের দাম্পত্য জীবনের। ভালোবাসার ছোঁয়ায় গড়ে তুলেছিল মায়াঘেরা এক নীড়। মনের আনন্দে দু’হাতে রঙ ছড়িয়েছিল দুজন মিলে জীবনের চারিপাশে। নূহার কল্পনাতেও ছিল না কোনদিন আবারো জাওয়াদের রঙহীন ঘর তাকে স্বাগত জানাবে।  

জিহাদ, জিশান আর নাবিহা ছুটে রুমের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। পেছন ফিরে নূহাকে দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারো এগিয়ে এলো নাবিহা। নুহার হাত ধরে টেনে বলল, তুমি দরজায় দাঁড়িয়ে আছো কেন মামণি? ভেতরে এসো।

ধীর পায়ে রুমের ভেতরে ঢুকলো নূহা। জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমাদের পাপার রুমের সবকিছু এমন সাদা কেন?

নাবিহা বলল, পাপার রুমের সবকিছু সবসময়ই সাদা। আমি একবার একটা স্কাই কালারের বেড কাভার বিছিয়ে ছিলাম। পাপা অনেক বিরক্ত হয়েছিল আমার উপর। পাপার মনেহয় অন্য কালার পছন্দ না।

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা যাইহোক। কিন্তু কোথায় তোমাদের সেই মজার জিনিস?

জিশান নূহার হাত ধরে টেনে দেয়ালের একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, এই হোয়াইট বোর্ডটা। এটা পাপা কেন লাগিয়েছে জানো মা?

নূহা বলল, কেন?

জিহাদ হেসে বলল, পাপা বলেছেন আমাদের মনে যখনই পাপার সম্পর্কে কোন অভিযোগ জাগবে আমরা যেন সাথে সাথে সেটা এখানে লিখে রাখি। কারণ অনেক সময় আমাদের মনে অনেক ছোট ছোট অভিযোগ তৈরি হয় প্রিয়জনদেরকে ঘিরে। আমরা যেগুলোকে তেমন গুরুত্বের সাথে দেখি না, কখনো বা ভুলে যাই বলতে। কিন্তু এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র না বলা অভিযোগ গুলো সম্পর্কের মাধূর্যকে ধীরে ধীরে ম্লান ও ক্ষয় করে দেয়। এবং এগুলোই একসময় একসাথে অনেক বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সম্পর্কের মাঝে যাতে কখনোই এমনটা না হয় তাই পাপা এই হোয়াইট বোর্ডটা লাগিয়ে দিয়েছে। পাপার ব্যস্ততা থেকে নিয়ে শুরু করে যে কোন বিষয়ে অভিযোগ এখানে লিখে রাখি আমরা। পরে বাবা আমাদেরকে নিয়ে আলোচনা করে সেটার সমাধান করেন। নানুমণি, দাদীও মাঝে মাঝে এসে এটা সেটা লিখে রেখে যান। গত সপ্তাহে দাদী কি লিখেছিল জানো?

নূহা হেসে বলল, কি লিখেছিল?

নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, ফাজিল ছেলে আমার ইচ্ছে করছে তোকে ধরে ঠাস ঠাস করে দুইটা থাপ্পড় মারতে। বাড়ি ফিরে তুই সবার আগে আমার রুমে এসে থাপ্পড় খেয়ে যাবি।

খিলখিল করে হেসে ফেললো নূহা। জিহাদ আর জিশানও হাসিতে যোগ দিলো। নাবিহা তো আগেই হাসতে হাসতে দাঁড়ানো থেকে নীচে বসে পড়েছিল। হাসতে হাসতে নূহা বলল, তোমাদের পাপা বাড়িতে ফিরে কি দাদুমণির রুমে গিয়েছিলেন?

জিহাদ হেসে বলল, হ্যা গিয়েছিলেন। দাদী দুইটা থাপ্পড় মেরেছিলেন পাপাকে। আমাদের চেয়ে দাদী আর নানুমণিই বেশি অভিযোগ লেখে। কয়েকদিন আগে জাল দাদাভাইও এসে অভিযোগ লিখে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা যাতে বুঝতে না পারি তাই কোড অক্ষরে লিখেছিলেন। পাপা ফিরে এসে জাল দাদাভাইয়ের ম্যাসেজ দেখে অনেক হেসেছিলেন। কিন্তু আমাদেরকে বলেননি কি লিখেছিলেন জাল দাদাভাই কোড অক্ষরে।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, তোমাদের জাল দাদাভাই হচ্ছেন বিরাট এক মজার মানুষ বুঝলে। আচ্ছা মজার জিনিস তো দেখা হয়ে গিয়েছে। এখন চলো আমরা যাই। আমাদের পিজ্জাও মনেহয় প্রায় হয়ে গিয়েছে।

নাবিহা বসা থেকে উঠে বলল, মামণি এই নাও মার্কার।

মার্কার দিয়ে আমি কি করবো?

তোমার যদি পাপার বিরুদ্ধে কোন অবজেকশন থাকে লিখে দাও বোর্ডে। আমরা তিনজন দেখবো না প্রমিস।

জিশান হেসে বলল, হ্যা মা তুমি লিখো। আমরা তিনজন কিচেনে চলে যাচ্ছি।

নূহাকে কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে হাতে মার্কার গুঁজে দিয়ে জিহাদ, জিশান আর নাবিহা ছুটে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ ঠিক কি করবে আর কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারলো না নূহা। বোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইলো আরো কিছুটা সময়। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বোর্ডের সামনে। গুটিগুটি অক্ষরে লিখলো, মনটা যখন হয়ে ওঠে খুব বিক্ষিপ্ত, বড় বেশি অশান্ত, আপন প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতাই করতে পারে তাকে শান্ত। নিজ অবস্থানে অসন্তোষ বেদনাকে করে সঞ্চিত, পক্ষান্তরে কৃতজ্ঞ অন্তরে আল্লাহর রহমত হয় প্রবাহিত। সর্বাবস্থায় করে যারা রবের ভক্তিভরা আনুগত্য, তারাই উন্মোচন করতে পারে জীবনের প্রকৃত সত্য.......     

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন