রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...১৬



নাস্তা শেষ করে প্রভাতী চা নিয়ে বাগানে বসে সবে মাত্র কথা শুরু করতে যাচ্ছিলো রাহা। এই সময় প্রচন্ড চিৎকার ভেসে এলো বাড়ির ভেতর থেকে। চিৎকার শুনে যদিও বুঝতে পেরেছিল ছোটমামার ছয় বছর বয়সী ছেলে উসামা হয়তো কান্না করছে কোন কারণে। রাহা আর নাবিহা দুজনই উঠে তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে ছুটলো। ভেতরে গিয়ে দেখলো বারান্দায় গড়াগড়ি দিয়ে উসামা চিৎকার করে কান্না করছে। পাশে উনাইশাহ দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। আর ছোট মামী ছেলেকে কোলে নেবার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু কিছুতেই পারছিলেন না। ক্রমেই উসামার কান্নার গতি বাড়ছিল। চিৎকার শুনে একে একে নিজ নিজ রুম থেকে সবাই বেড়িয়ে আসতে শুরু করলো। আরমান মামা বেরিয়ে এসে ছেলেকে এমন ভাবে কান্না করতে দেখে ঘাবড়ানো কন্ঠে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, আফরা কি হয়েছে উসামার? এভাবে কান্না করছে কেন?  

আফরা মামীর কাছ থেকে পাওয়া বর্ণনায় জানা গেলো উসামা বারান্দায় বসে তার সবচেয়ে প্রিয় খেলনা গাড়িটা নিয়ে একা একাই খেলছিল। উনাইশাহ এসে গাড়িটা চাইলে উসামা সেটা দিতে কিছুতেই রাজী হয়নি কিছুতেই। বেশ কয়েকবার চাইবারও পরেও গাড়ি না পেয়ে উনাইশাহ উসামাকে বলেছে, তুমি একটা মিষ্টি কুমড়া, তুমি একটা ফুটবল, তুমি একটা গ্যাস বেলুন, তুমি একটা ফ্যাটি, তুমি একটা মোটু, মোটু, মোটু। একসাথে এতগুলো উপাধী সহ্য করতে না পেয়ে উসামার এই অবস্থা। মামী মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে সবার চেহারাতেই হাসি ঝিলিক দিয়েই আবার মিলিয়ে গেলো। রাহাও হাসি চেপে এগিয়ে গিয়ে উসামাকে উঠানোর চেষ্টা করলো। আরো অনেকেই চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতেই উসামার গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করা কান্না থামানো সম্ভব হচ্ছিলো না।

তাইয়্যেবা এগিয়ে এসে উনাইশাহর পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্ত কন্ঠে বলল, কেন তুমি এমন করলে উনাইশাহ। যাও এক্ষুণি সরি বলো উসামাকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় উনাইশাহ নিজেও বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। উসামা অনেক মোটা তাই সে মোটা বলেছে। মিথ্যা বা ভুল তো বলেনি। সত্যি কথা শুনে কেন উসামা এভাবে কান্না করছিল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না উনাইশাহ। কিন্তু তার কথার কারণেই যে উসামা কান্না করছিল এটা বুঝতে পারছিল। তাই এগিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকবার সরি বললো উসামাকে কিন্তু তাতেও কোন লাভ হলো না। বরং উনাইশাহকে দেখে উসামার কান্নার গতি আরেকটু বেড়ে গেলো।

আধ ঘন্টা পেরিয়ে যাবার পরও উসামার কান্না অব্যহত ধারাতে চলতেই লাগলো। পরিবারের সবাই বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো কান্না থামাতে। এদিকে ছেলের এই অবস্থা দেখে আরমান মামা এবং আফরা মামী দুজনেরই মুখ চোখ শুকিয়ে গেলো একদম। নূহাকে খুবই পছন্দ করে উসামা। ভিডিও কল করে নূহাও চেষ্টা করে দেখলো কিন্তু কোন প্রভাবই পড়লো না উসামার উপর। কান্না করেই যেতে লাগলো। জাওয়াদকেও ভিডিও কল করা হলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। এক নাগাড়ে এতক্ষণ কান্না করার কারণে উসামার চিৎকার ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করলো। আরো কিছুক্ষণ পর চোখের পানিও বন্ধ হয়ে গেলো। এরপর থেকে পঁচিশ-ত্রিশ সেকেন্ড পর পর একটা করে হেঁচকির মতো শব্দ করে ডানে-বামে একটু করে গড়িয়ে নিচ্ছিলো উসামা। কিন্তু তখনো তাকে মেঝে থেকে উঠানো সম্ভব হচ্ছিলো না।    

ফজরের পর প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে আদী ঘুমোতে গিয়েছিল তাই এতক্ষণ ডাকতে যায়নি তাইয়্যেবা। কিন্তু উসামার অবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে আদীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ঘটনা খুলে বললো। আদী উঠে এসে উসামার কাছে বসে হেসে বলল, একি আমাদের উসামা বেবিটা এভাবে নীচে শুয়ে আছে কেন? এরপর বেশ জোর করে উসামাকে টেনে উঠিয়ে কোলে নিয়ে বসালো। পাশেই আরমান মামা শুকনো মুখে বসে ছিলেন। আদী মামার কানের কাছে মুখ দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ছেলেকে কি খাওয়াও ম্যান? দুবলা-পাতলা শিশুদের আদ্দু-গাদ্দু বানানোর স্কুল খুলে ফেলো একটা তোমরা জামাই-বউ মিলে।

এমনিতেই ছেলের অবস্থা দেখে দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন আরমান মামা। আদীর কথা শুনে কটমট করে বললেন, এই সাইকোকে কে ডেকেছে এখানে? এই সাইকো তো আমার ছেলেকে আবার কাঁদাবে।

আদী হাসতে হাসতে উসামাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ভাইয়ার সাথে কি মর্নিংওয়ার্কে যাবে আমাদের উসামা সোনা বাচ্চাটা? আদীর ভীষণ ভক্ত উসামা। মর্নিং ওয়ার্কে যাবার কথা শুনে তাই খুব আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকালো। আদী হেসে বলল, ঠিকআছে তাহলে আগে একটু করে জ্যুস খেয়েনি চলো আমরা দুইজন। তাইয়্যেবা জ্যুস দাও আমাদের দুজনকে। জলদি। ছুটে দিয়ে জ্যুস নিয়ে এলো তাইয়্যেবা। জ্যুস খাবার পর তো জগিং করতে করতে উসামাকে নিয়ে পার্কের দিকে চলে গেলো আদী। সবাই তখন স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বসলো।

ঘন্টা খানেক পর উসামাকে নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে এলো আদী। নাস্তার টেবিলে আরমান মামা হাসিমুখে আদীর পাশে এসে বসে বললেন, এমন অসাধ্যটা সাধন করলি কিভাবে তুই? কি বলে ঠান্ডা করেছিস উসামাকে?

আদী বলল, আমি উসামাকে বুঝিয়ে বলেছি যে ভাইয়া তুমি আসলেই অনেক মোটা।

সাথে সাথে আরমান মামার হাসি ভরা মুখটা চুপসে গেলো। আহত চোখে তাকালেন আদীর দিকে।

আদী হেসে বলল, তুমি কি জানো মামা মানুষ সত্যের মুখোমুখী হতে, সত্যকে মেনে নিয়ে ভয় কেন পায়? কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে সত্যের মুখোমুখী হতে শিক্ষা দেয়া হয় না ছোটবেলা থেকে। তাই সত্যকে মেনে নেবার ব্যাপারে মানুষ খুব বেশি দুর্বল হয়। গত কয়েকদিন আগে একজন ব্যক্তিকে সে যা নয় কিন্তু নিজেকে তাই ভাবছে। এই সত্যটা ধরিয়ে দেবার সাথে সাথে অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিলো। অথচ এত ঠিক কিছুক্ষণ আগেই সেই সত্যের ঝান্ডাধারী হিসেবে নিজেকে দাবী করছিল। কিন্তু যেই না তার সম্পর্কে একটা সত্য তাকে বলা হলো। অমনি সে মুখ ফিরিয়ে নিলো সত্য থেকে। এমন মানুষদেরকে দেখে মনে প্রশ্ন জাগে যে, সত্যকে মেনে নিতে যদি এতই কষ্ট  তাহলে নিজেকে মিথ্যার আড়ালে লুকানোর দরকারটা কি? আর মিথ্যার আড়ালে লুকোলে প্রস্তুত থাকা উচিত যে কোন মূহুর্তে সত্য উন্মোচনের। মামা তোমার ছেলে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই মোটা একথা তো তুমিও জানো। তাহলে সেটা ওকে জানাতে সমস্যা কোথায়? যখন নিজের কোন সমস্যা বা দুর্বলতার কথা মানুষের জানা থাকে, তখন অন্যকেউ সেটা বললে মনের উপর ততটা প্রভাব পড়ে না। উসামার যদি জানা থাকতো ও মোটা তাহলে কি আজ সকালে বাচ্চাদের দুষ্টুমি এত বিশাল আকার ধারণ করতো? মামা ছোটবেলা থেকে সন্তানদেরকে শিক্ষা দেয়া উচিত যাতে তারা সমালোচনাকে তাদের উন্নতির জ্বালানীশক্তি বানাতে পারে। উসামা যেমন আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ থেকে প্রতিদিন জগিংয়ে যাবে, স্যালাড খাবে, ফ্রুটস খাবে। এখন থেকে চকলেট, পেস্ট্রি, পিজা সপ্তাহে একদিন করে খাবে। এখন ওর এই ইচ্ছার ধিকিধিকি আগুনকে বাতাস দিয়ে জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার আর মামীর।

আরমান মামা লাজুক কন্ঠে বলল, আমি আসলে তোর ইনটেনশনটা বুঝতে পারিনি। একদম ঠিক বলেছিস তুই। নিজের সম্পর্কে সত্য জানা এবং মেনে নেয়ার শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই দেয়া উচিত প্রতিটি শিশুকে। সেই সত্যটা যদি কষ্টকর হয় তবুও।

আদী বলল, হ্যা। কারণ বাবা-মা যখন সন্তানের সামনে সত্যকে উন্মোচন করে তখন সন্তান যাতে মনে খুব বেশি আঘাত না পায় সেদিকে খেয়াল রাখেন। বাবা-মায়ের ছায়াও ঐ মূহুর্তে সন্তানের মাথার উপর থাকে। তাদেরকে মেনে নিতে, বুঝতে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু বাইরের কেউ যখন কিছু বলে এতকিছু বুঝে, শুনে বলে না। তারা শুধু আঘাত দেয়, উপশম না।

আলহামদুলিল্লাহ আমি বুঝতে পেরেছি। উসামাকে এখন থেকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবো আমি ইনশাআল্লাহ।

আদী হেসে বলল, আর আমিও আমার কন্যাকে আজ বুঝিয়ে বলবো সত্যের সাত কাহন কি জিনিস।

সত্যের সাত কাহন? সেটা আবার কি জিনিস? প্রশ্ন করলেন আরমান মামা।

আদী হেসে বলল, যখন আমার কন্যাকে বলবো একবারে তখনই জেনো। এখন নাস্তা করো।  

জিহাদ হাসি মুখে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আদীব্বা আজকের নাস্তার টেবিলে অনেকগুলো শিক্ষা অর্জন হয়েছে। এক. মানুষ সত্যের মুখোমুখী হতে, সত্যকে মেনে নিয়ে ভয় পায়, কারন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে সত্যের মুখোমুখী হতে শিক্ষা দেয়া হয় না ছোটবেলা থেকে। দুই. মিথ্যার আড়ালে লুকোলে প্রস্তুত থাকা উচিত যে কোন মূহুর্তে সত্য উন্মোচনের। তিন. যখন নিজের কোন সমস্যা বা দুর্বলতার কথা মানুষের জানা থাকে, তখন অন্য কেউ সেটা বললে মনের উপর খুব বেশি প্রভাব পড়ে না। চার. ছোটবেলা থেকে সন্তানদেরকে শিক্ষা দেয়া উচিত যাতে তারা সমালোচনাকে তাদের উন্নতির জ্বালানীশক্তি বানাতে পারে। পাঁচ. সন্তানের মনে ইচ্ছার ধিকিধিকি আগুনকে বাতাস দিয়ে জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব বাবা-মার।

আদী হেসে বলল, মাশাআল্লাহ। লাইক ফাদার লাইক সান। সর্বদা শিক্ষা অর্জনের জন্য মুখিয়ে থাকা মানুষের দলে এখনই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছো বাবা তুমি।

জিহাদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। পাপা বলেছে এই পৃথিবীতে কোন কিছুই অহেতুক নয়। ঝরে পড়া প্রতিটি বৃষ্টি কণা থেকে নিয়ে শুরু করে আকাশ, বাতাস, চাঁদ, তারা, গাছ, পাখী, ফুল-কলি ইত্যাদি সবকিছুই নিঃশব্দে হাজারো শিক্ষার ডালি সাজিয়ে দু’বাহু প্রসারিত করে আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ। শুধু তাদের দিকে একটু মনোযোগ সহকারে শুধু তাকাতে হয়। ব্যাস, শিক্ষাটা আমাদের হয়ে যায়।

হেসে ফেললো তখন নাস্তার টেবিলে বসে থাকা সবাই। এরপর টুকটাক গল্প করতে করতে সবাই নাস্তা শেষ করলো। নাস্তার শেষ পর্যায়ে জাওয়াদও এসে জয়েন করলো সবার সাথে। নাস্তার পর জাওয়াদ আর আদী বারান্দায় বসে কথা বলছিল তখন আরমান মামা এসে গোমড়া মুখে এসে দুইজনের মাঝখানে বসলেন।

আদী হেসে বলল, কি হয়েছে আমাদের আদ্দু গাদ্দু মাম্মুটার?

আরমান মামা বিরক্ত স্বরে বললেন, তোরা সবসময় এমন দুষ্টুমি করিস বলেই তো তোদের বাচ্চাগুলোও এমন দুষ্টু স্বভাবের হয়েছে। ঘুম ভাঙতে শুরু যতটুকু দেরি একেকজনের। ব্যাস শুরু করে দুষ্টুমি।

জাওয়াদ হেসে বলল, সাত সকাল থেকেই তো আনন্দের সন্ধান শুরু করতে হয় মামাজান। প্রতিটা দিনই আনন্দের অসংখ্য উপকরণ নিয়ে উদ্ভাসিত হয় আমাদের সম্মুখে। জাস্ট তাদেরকে খুঁজে নিতে হয়।

আরমান মামা বললেন, আনন্দ পাবো কোথায়? আমি তো কোথাও কোন আনন্দ খুঁজে পাই না। জগতের যেদিকে তাকাই শুধু হতাশা আর নিরাশাই দেখতে পাই। প্রতিটি মানুষই সমস্যাগ্রস্ত। তোরা বলিস পজেটিভ চিন্তা করতে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর যে পরিস্থিতি তাতে কি পজেটিভ চিন্তা করা সম্ভব?

জাওয়াদ বলল, তুমি নেগেটিভ চিন্তা করলে কি পৃথিবীর পরিস্থিতি বদলে যাবে? বরং উল্টো তোমার নিজের জীবনের পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে নেগেটিভ চিন্তার প্রভাবে। মামা নেতিবাচক পরিস্থিতিতে যারা ইতিবাচক চিন্তা করতে পেরেছে তারাই দুনিয়াতে কিছু করতে পেরেছে।

হুমম, কথাটা তো ঠিকই বলেছিস। আমি আসলে পজেটিভ চিন্তা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু একদিন সবকিছু ঠিকঠাক লাগে। এরপর আবার এলোমেলো মনেহয়।

আদী হেসে বলল, পজেটিভ চিন্তা করার অর্থ তো এটা নয় মামা তোমার জীবনে আসা প্রতিটা দিনই একই রকম যাবে। গতকাল খুব আনন্দে কেটেছে আমাদের। আজ যদি কিছু জটিলতার মুখোমুখী হতে হয় এতে তো দুঃখী হবার কিছু নেই। আগামীকাল হয়তো আবারো সুখানুভূতির প্রহর প্রতীক্ষমান আমাদের জন্য ইনশাআল্লাহ।

তোদের কথা শুনলে মন ভালো হয়ে যায় একদম। এজন্যই তো আমি তোদের আশেপাশে থাকতে চাই। হাসি মুখে বললেন আরমান মামা।

জাওয়াদ বলল, আনন্দে থাকার কারণ হিসেবে আমরা নিজেরাই নিজেদের জন্য কিছু প্যাকেজ নির্ধারণ করে ফেলি। এখানেই আসলে মূল সমস্যা বুঝলে মামা! আমরা ভেবে নেই ওটা না হলে আমার চলবে না। বা একমাত্র ঐ জিনিসটাই আমার মুখে হাসি ফোঁটাতে পারে। এসব ভাবনার  দ্বারা আমরা আমাদের জীবনের হাসি-আনন্দ-সুখকে কন্ডিশনাল করে ফেলি। যার ফলে জীবনকে ঘিরে অসংখ্য সুখ আবর্তিত হবার পরেও আমরা নিমজ্জিত থাকি দুঃখবিলাসীতায়। প্রতিটা মনেই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কারণে আনন্দে ডানা ঝাপটানোর ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে। আমরাই নানান কন্ডিশন দিয়ে মনকে আনন্দিত হওয়া থেকে বিরত রাখি। তাই তোমার মনের আনন্দকে কন্ডিশনাল করো  না মামা। আনন্দিত হও সেই প্রতিটা নেয়ামতের কারণে যা তোমার আছে কিন্তু পৃথিবীর অনেকেরই হয়তো নেই। আনন্দিত হও সুন্দর এই পৃথিবীটাকে দু’চোখ ভরে দেখতে পাবার সৌভাগ্যের কারণে। আনন্দিত হও মনের ভাবনাগুলোকে শব্দের দ্বারা প্রকাশিত করতে পারার জন্য। আনন্দিত হও প্রিয় মানুষদের কথা শুনতে পারার জন্য। মামা চোখ বন্ধ করে যদি একটু ভাবো তাহলে নেতিবাচক চিন্তার তুলনায় ইতিবাচক চিন্তা করার কারণই বেশি খুঁজে পাবে।

আমি বুঝতে পারছি বাবা। ইনশাআল্লাহ এখন থেকে আর নেতিবাচক চিন্তা করবো না।

আদী বলল, আসলে কি জানো মামা? সবসময় টুকিটাকি ভালো কাজের উপরে থাকা থাকার চেষ্টা করা উচিত সবার। এতে মন খুব প্রফুল্ল থাকে। তুমি চাইলে এই মূহুর্তে তোমাকে একটা ভালো কাজের সন্ধান দিতে পারি।

আরমান মামা হাসিমুখে বলল, অবশ্যই। তোরা যা বলবি আমি করবো।

আদী বলল, হুযাইফা এখন হাসপাতালে যাচ্ছে। তুমিও ওর সাথে চলে যাও।

আমি? আমি হাসপাতালে গিয়ে কি করবো?

আদী হাসি চেপে বলল, আমাদের ব্লাড ব্যাংকে ‘এ’ নেগেটিভ রক্ত নেই। তুমি যাও এক ব্যাগ রক্ত দান করে এসো। তোমার শরীরে অলস ঘুরে বেড়ানো রক্ত কারো জীবন রক্ষার্ত্রে কাজে লাগতে পারে ইনশাআল্লাহ। একটা দিনকে আনন্দময় করার জন্য এরচেয়ে বেশি আর কি হতে পারে?

জাওয়াদ বাম হাত মুঠ করে ডান হাতের তালুতে ঘুষি দিয়ে বলল, কিছুই হতে পারে না। ইম্পসিবল।

আরমান মামা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, অনেক ধরণের কুলাঙ্গার ভাগ্নের গল্প শুনেছি। কিন্তু তোদের মতো রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার স্বভাবের ভাগ্নেদের কথা জীবনে কোনদিন শুনিনি।

জাওয়াদ আর আদী তখন হেসে স্বশব্দে ফেললো। আরমান মামাও ভাগ্নেদের সাথে হাসিতে যোগ দিলেন।

@

হাসপাতাল থেকে ফিরে নাস্তা করে কিছুক্ষণ চাচ্চুদের সাথে কথাবার্তা বলে রুমে ঢুকে আবারো একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে পাপাকে কাজে বসতে দেখে খুবই বিরক্ত হলো জিশান। তাদের স্কুল ছুটির দিনে কোন কাজ করতে পারবে না এমনটাই কথা হয়েছিল পাপার সাথে। কিন্তু আজকাল সেই কথা মোটেই খেয়াল রাখছে পাপা। আজই এর একটা বিহিত করতে হবে। তারআগে অবশ্য ভাইয়া আর নাবিহার সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে এই ব্যাপারে। আপাতত তাই পাপার সাথে বোঝাপড়া করার চিন্তা বাদ দিয়ে দুষ্টুমি করার পরিকল্পনা নিলো জিশান।

জাওয়াদ বসে কাজ করছিলেন। জিশান উঁকি দিয়ে প্রথমে সালাম দিলো। এরপর বলল, পাপা তোমার কি কিছু লাগবে?

জাওয়াদ সালামের জবাব দিয়ে বলল, না বাবা এখন কিছু লাগবে না। শুকরিয়া।

উফফ, বাইরে কি প্রচন্ড গরম পড়েছে। পাপা তোমার জন্য কি ঠান্ডা কিছু নিয়ে আসবো?

চোখ তুলে ছেলের দিকে ভালো ভাবে তাকালো জাওয়াদ। চোখ মুখের ভাবভঙ্গি আঁচ করতে পারলো দুষ্টুমি গিজগিজ করছে জিশানের মাথায় এখন। নরম সুরে বলল, ঠান্ডা কিছু এনে দিয়ে তুমি কি প্রশ্নের ঝাঁপি বন্ধ করে বিদায় হবে?

তুমি খুশি হলে জিশান অবশ্যই বিদায় হয়ে যাবে পাপা।

তাহলে যাও নিয়ে এসো ঠান্ডা কিছু।

পাপা কি আনবো তোমার জন্য বলো? তরমুজের জ্যুস? পাইনাপেল জ্যুস? নাকি বরফ কুচি গুড়াগুড়া করে ফ্রেশ পানি?

তরমুজের জ্যুসই বেটার।

পাপা জ্যুস কি ফাইবার সহ নাকি ফাইবার ছাড়া আনবো?

মানে?

জিশান আনন্দিত কন্ঠে বলল, পাপা জানো তরমুজের জ্যুস করে রেখে দিলে ফাটাফাটি মজার একটা কান্ড হয়। ফাইবার গুলো আস্তে আস্তে গ্লাসের নীচে চলে যায় আর পানি উপরে উঠে আসে। তোমার জন্য কি শুধু উপরের পানিটুকু ছেঁকে আনবো নাকি ফাইবারের সাথে ঘুটা দিয়ে নিয়ে আসবো?

জাওয়াদ হেসে বলল, ঘুটা দিয়ে নিয়ে এসো। 

আচ্ছা। ওহ! পাপা আরেকটা প্রশ্ন। জ্যুস কি গ্লাসে করে আনবো নাকি মগে করে?

গ্লাসে করেই নিয়ে এসো।

পাপা বড় গ্লাসে করে আনবো নাকি মিনি গ্লাসে করে আনবো?

জাওয়াদ ফাইল থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো সোনা বাচ্চার মতো চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে জিশান। বলল, ছোট গ্লাসে করে নিয়ে এসো।

আচ্ছা। পাপা সুগার ফ্রি আনবো নাকি উইথ সুগার?

সুগার ফ্রি।

পাপা আজ যে তরমুজটা দিয়ে নানুমণি জ্যুস বানিয়েছে। সেটা একেবারেই পানসা। একটু সুগার না দিলে মজা পাবে না খেয়ে।

আচ্ছা তাহলে সুগার দিয়েই নিয়ে এসো।

কতটুকু সুগার দেবো পাপা? হাফ চামচ নাকি এক চামচ?

হাফ চামচ।

পাপা বাগান থেকে ফ্রেশ দুটা পুদিনাপাতা ছিঁড়ে কি কুচিকুচি করে মিশিয়ে দেব জ্যুসের সাথে?

জাওয়াদ হেসে ফেলে বললেন, থাপ্পড় খেতে না চাইলে ভাগো এখান থেকে দুষ্টু ছেলে।

জিশানও হেসে বলল, পাপা ভাগার সময় তুমি কি আমাকে পেছন থেকে তাড়া করবে নাকি করবে না?

জাওয়াদ উঠে দাঁড়ালে জিশান বিশাল এক হাসি দিয়ে ভোঁ দৌড় দিলো। জাওয়াদও হাসতে হাসতে জিশানের পেছনে ছুটলো ওকে ধরার জন্য।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন