রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...১৩



গাড়ির মেইন গেটের সামনে দাঁড় করানোর সময়ই জাওয়াদ খেয়াল করেছিল নাবিহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসার বদলে ভেতরে ঢুকে যেতে দেখে বুঝতে আর বাকি রইলো না আর অনেক কাঠখড় পুড়িয়েই অভিমান ভাঙাতে হবে আহ্লাদী কন্যার। অবশ্য এটাও বুঝতে পারছে আজ বাচ্চাদের মন অনেক বেশিই খারাপ। মনে মনে হয়তো অনেক প্ল্যান নিয়েছিল মায়ের সাথে সারারাত গল্প করবে, অনেক মজা করবে। কিন্তু প্ল্যান নেবার সময় মায়ের অদ্ভুত মুডের হিসাব রাখতে ভুলে গিয়েছিল বাচ্চারা। আজ কেন জানি প্রচন্ড বিরক্তি অনুভূত হচ্ছে সবাইকে থাকবে বলার পরও নূহার এমন হঠাৎ চলে যাবার কারণে। যাদের নিজের মরজির উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, তাদের কখনোই উচিত না কাউকে কোন ওয়াদা করা। নিজের মনের ভাবনারা যাদেরকে মূহুর্তেই এমন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাদের কখনোই উচিত নয় আনন্দের নিমন্ত্রণ দেয়া অন্যদেরকে। নূহার সাথে এসব ব্যাপারে কথা বলাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর সব অদ্ভুত ইচ্ছে, অকারণ জেদ চুপচাপ মেনে নেয়া হয়, তারঅর্থ এটা নয় যে বাচ্চাদের ব্যাপারে ভুল আচরণ গুলোকেও মেনে নেবে। মনের মাঝে ভীষণ রকম তিক্ততার উপস্থিতি টের পেলো। রাগ হচ্ছে নূহার উপর। প্রচন্ড রকম রাগ। তাদের সন্তানদেরকে দুনিয়ার সমস্ত কষ্ট থেকে আড়াল করে রাখার জন্য নিজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার স্মরণ থেকেও পালিয়ে বেড়ায় জাওয়াদ। সেখানে নূহা এমন অবুঝ আচরণ কিভাবে করে? সেলফোন হাতে নিয়ে নূহাকে ডায়াল করতে গিয়েও আবার থেমে গেলো। মেজাজের এই অবস্থায় কথা না বলাই ভালো। কড়া কিছু বলতে না চাইলেও নূহা ওর আঁকাবাঁকা কথার দ্বারা বাধ্য করবে কষ্টকর কিছু বলতে। এমনিতে নিজে নিজে পুরো দুনিয়া বুঝে ফেলবে। কিন্তু কেউ কোন কিছু বোঝাতে চাইলে সেটা কিছুতেই বুঝবে না নূহা। নিজেই সিনক্রিয়েট করবে এরপর নিজেই আবার কান্নাকাটি করে অস্থির এক পরিবেশ সৃষ্টি করবে সবার জন্য। আর ফাদারস গ্রুপ, মাদারস গ্রুপ তাদের আদরের কৈতুরিকে কান্না করতে দেখে আগে পিছে কি হয়েছে কিছুর না জেনে, না শুনে জাওয়াদের সাথে চিৎকার করতে শুরু করবে। এত সব ঝামেলায় যাবার চেয়ে আগামীকাল হসপিটালেই কথা বলার চেষ্টা করবে ভাবতে ভাবতে গাড়ি থেকে বের হলো।    

পাপা, পাপা বলে চিৎকার করতে করতে জারিফ ছুটে এসে জাওয়াদের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো জারিফ। জারিফকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে জাওয়াদ হেসে বলল, কেমন আছে আমার জারিফ বাবা সোনাটা?

জারিফ গাল ফুলিয়ে আহ্লাদের স্বরে বলল, আমি খুব্বি খারাপ আছি পাপা। তুমি শুনবে কি হয়েছে?

অবশ্যই শুনবো বাবা। তুমি বলো কি হয়েছে?

আপ্পি আমাকে কটেজ থেকে কান ধরে বের করে দিয়েছে। বলেছে আমি যদি আবার তোমাদের কটেজে ঢুকি তাহলে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আমার পা ভেঙে দেবে।

চোখ বড় বড় অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে জাওয়াদ বলল, কি বলছো তুমি? কিন্তু আপ্পি তোমাকে কটেজ থেকে কেন বের করে দিয়েছে?   

তুমি যে অনেক দেরি করে ফিরেছো সেজন্য আপ্পি, জিশান ভাইয়া আর জিহাদ ভাইয়া তোমার উপর রেগে আছে। তিনজন মিলে তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে ঠিক করেছে। আমাকেও বলেছিল তোমার উপর রাগ করতে। আপ্পিদের সাথে মিলে তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে। কিন্তু আমি বলেছি, আকাশ আর জমিন এক হয়ে যাবে কিন্তু জারিফ কোনদিন পাপার উপর রাগ করবে না ইনশাআল্লাহ। পাপার সাথে বিদ্রোহও করবে না। নেভার এভার।

হেসে ফেললেও আবারো জাওয়াদ উপলব্ধি করলো বাচ্চারা আসলেই বাবা-মায়ের দেখানো পথেই চলে। চেতনে কিংবা অবচেতনে সন্তানেরা বাবা-মায়ের কথা, কাজ, আচরণকে নিজের মাঝে ধারণ করে ফেলে। নূহার বলা কমন কথাগুলোর একটা হচ্ছে, আকাশ আর জমিন এক হয়ে যাবে তাও আমি এই কাজ করবো না। নেভার এভার। মায়ের সেই কথাই হুবহু কপি করে নিয়েছে জারিফ। নাহ! এই মেয়ের সাথে যত দ্রুত সম্ভব কথা বলতেই হবে তাকে। তবে আপাতত নূহার চিন্তা মাথা থেকে দূর করে জারিফকে আদর করে হেসে বলল, তুমি তো আমার সোনা সোনা বাবাটা। লাভ ইউ।

জারিফ হেসে বলল, লাভ ইউ ঠু পাপা। কিন্তু এখন তুমি আর আমি কোথায় যাবো? রাতে কোথায় ঘুমাবো? আপ্পি তো বলেছে কটেজে গেলে আমার পা ভেঙে দেবে।

জাওয়াদ হেসে বলল, আমরা দুজন মিলে কিছু একটা বুদ্ধি করে আপ্পিকে পটিয়ে ফেলবো ইনশাআল্লাহ। কি করা যায়? তুমি একটা আইডিয়া দাও।

বেশ কিছুক্ষণ চোখ-মুখ বাঁকিয়ে, ভ্রূ কুঁচকে, মাথা একবার ডানে কাত করে, আরেকবার বামে ঝাঁকিয়ে চিন্তাভাবনা করার পর উজ্জ্বল হয়ে উঠলো জারিফের চেহারা। বিশাল হাসি দিয়ে বলল, পাপা পেয়েছি আইডিয়া।

তাই? আলহামদুলিল্লাহ। তাড়াতাড়ি বলো শুনি।

জারিফ বলল, কয়েকদিন আগে আমি একটা দুষ্টু কাজ করেছিলাম। একটু বেশি দুষ্টু কাজ। মা তখন আমার উপর অনেক রাগ করেছিল। আমাকে বকেও দিয়েছিল। যে পর্যন্ত মা না বলবে আমি যেন মার কাছে না যাই একথাও বলেছিল। আমার তখন অনেক মন খারাপ হয়েছিল। আমি কান্নাও করেছিলাম। মার উপর রাগ করে তাই আমার রুমে চুপ করে বসেছিলাম। কিছুক্ষণ পর মা আমার রুমে এসে মজার একটা কাজ করেছিল। আমি তখন সব রাগ ভুলে গিয়েছিলাম।

জাওয়াদ হেসে বলল, কি করেছিল মা?

জারিফের মুখ থেকে নূহার কান্ড শুনে মনের কোণে জমে ওঠা বিরক্তি, তিক্ততা হঠাৎ করেই উবে যেতে শুরু করলো জাওয়াদের। আরেকবার স্বীকার করে নিলো মাঝেমধ্যে নিজের এলোমেলো স্বভাবটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার অদক্ষতার দরুণ কাউকে কষ্ট দিয়ে ফেললেও। স্বভাবগত ভালোবাসার দক্ষতায় সেই কষ্টের অনুভূতিটাকেই মুছে দেবার ক্ষমতাও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নূহাকে দিয়েছেন। এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ যে নূহা করে না তা নয়। তবে প্রয়োগই বেশি করে। জারিফের মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলল, মাশাআল্লাহ আমার বাবাটা তো অসাধারণ একটা আইডিয়া দিয়েছে। চলো আমরা এটাই অ্যাপ্লাই করি তোমার আপ্পি আর ভাইয়াদের উপর।

জারিফকে কোলে নিয়ে কটেজে ঢুকলো জাওয়াদ। এরপর রুমের দরজায় কাছে গিয়ে জারিফকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে চেহারায় কৃত্রিম গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুমে ঢুকলো জাওয়াদ। রুমের ভেতর জিহাদ, জিশান আর নাবিহাকে দেখে খুবই অবাক হয়েছে এমন ভাণ করে সালাম দিয়ে বলল, আরে তোমরা এখানে যে? যাক ভালোই হলো তোমরা এখানে থাকাতে। ভীষণ গুরুত্বপূর্ন একটা জিনিস খুঁজে পাচ্ছি না আমি। তোমরা কি আমাকে একটু সাহায্য করবে প্লিজ?

পাপার সিরিয়াস কন্ঠস্বর আর গাম্ভীর্য ভরা চেহারা দেখে নিজেদের অভিমানের কথা ভুলে গেলো জিহাদ, জিশান আর নাবিহা। এটা অন্তত তিনজন খুব ভালো মতো বোঝে একটুতেই অস্থির হবার মত মানুষ তাদের পাপা হয়। নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছুই খুঁজছে পাপা। ঐদিকে জাওয়াদও অস্থির ভাবে ছুটে বেড়াচ্ছিল রুমের ভেতর। বিভিন্ন ড্রয়ার খুলে খুলে দেখছিল, আলমিরার ভেতর দেখছিল, আবার সোফার কুশন সরিয়েও দেখলো। নাবিহা, জিহাদ, জিশান তিনজনও মূহুর্তেই সিরিয়াস হয়ে গেলো। জিহাদ বলল, পাপা তুমি কি খুঁজছো? আমাদেরকে বলো আমরা সাহায্য করছি তোমাকে।

জাওয়াদ ব্যস্ত কন্ঠে বলল, তোমরা সাহায্য করবে? আচ্ছা তাহলে এক কাজ করো খুব ভালো মতো খুঁজে দেখো রুমের ভেতরটা। কোন অংশই যাতে বাদ না পড়ে যায়। বেডের নীচে দেখো তো একজন। উফ, কি বলছি আমাদের বেডের নীচে তো ফাঁকা নেই। আচ্ছা বালিশের নীচে দেখো। জিহাদ, জিশান তোমরা দুজন মিলে ফোমটা উঠিয়েও একটু দেখো। নাবিহা তুমি ড্রয়ার গুলো আরেকবার চেক করো তো মা।

নাবিহা বলল, জ্বি পাপা আমি এক্ষুণি দেখছি। কিন্তু পাপা কি খুঁজবো ভেতরে?

জাওয়াদ অবাক কন্ঠে বলল, সে কি তোমরা এখনো জানোই না আমি কি খুঁজছি?

জিশান বলল, না। তুমি তো এখনো বলোনি আমাদেরকে।

জিহাদ বলল, হ্যা। শুধু বলেছো ভীষণ গুরুত্বপূর্ন একটা জিনিস খুঁজে পাচ্ছো না।

এটা শুনেই তো তোমাদের বোঝা উচিত ছিল। যাইহোক, বুঝতেই যখন পারোনি তখন আর কি করার। কিন্তু এখনো দেখি দাঁড়িয়ে আছো তোমরা? খুঁজতে শুরু করবে কখন? তাড়াতাড়ি করো।

তাড়া শুনে নাবিহা ছুটে দিয়ে বেড সাইট টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কিন্তু কি খুঁজবো পাপা?

আশ্চর্য তোমরা এখনো বুঝতে পারোনি কি খুঁজতে হবে?

জিহাদ, জিশান আর নাবিহা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভরা দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকালো। তারপর ধীরে ধীরে না সূচক মাথা নাড়লো।

লম্বা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাওয়াদ বলল, তোমরা এখনো তোমাদের পাপার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কি সেটাই জানো না দেখে খুবই ব্যথিত অনুভব করছি। ঠিকআছে আজ তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি। এরপর থেকে যেন সবসময় মনে থাকে।

জিহাদ বলল, জ্বি পাপা অবশ্যই মনে থাকবে আমাদের ইনশাআল্লাহ।

ঠিকআছে। কিন্তু প্রমিস করো রুমের প্রতিটি অংশও যদি খুঁজে দেখতে হয়। তোমরা দেখবে এবং অবশ্যই আমাকে সেই জিনিসটা খুঁজে এনে দেবে। বাড়িতে ঢোকার পর থেকে এখনো পর্যন্ত একবারও সেই জিনিসটাকে দেখতে না পাবার কারণে আমার বুকের ভেতর জ্বালা করছে, খুব অস্থির ফিল হচ্ছে।

তিনজনই একসাথে বলল, জ্বি পাপা আমরা প্রমিস করছি অবশ্যই খুঁজে বের করবো ইনশাআল্লাহ।

জাওয়াদ বলল, আমার জীবনের সেই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা, যেটাকে এক মূহুর্ত না দেখলে আমি পাগল প্রায় হয়ে যাই। সেটা হচ্ছে, জিহাদ, জিশান আর নাবিহার হাসি। এবং আমি যখনই বাইরে থেকে ফিরে আসি এবং জিহাদ, জিশান আর নাবিহা অলিম্পিক রেসের গতিতে ছুটে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। সেই টনিক হাগটাও।

তাদের পাপার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের নাম শুনে জিহাদ, জিশান, নাবিহা তিনজনই কিছুক্ষণ বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পাপার দুষ্টুমি আঁচ করতে পেরে হেসে ফেললো জিহাদ। জিশানের মুখেও ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠলো। এই সময় দৌড়ে রুমে প্রবেশ করলো জারিফ। হাসতে হাসতে বলল, পাপা আমি তোমাকে খুঁজে দিচ্ছি। ঐ দেখো জিহাদ ভাইয়ার হাসি ভাইয়ার মুখেই আছে। জিশান ভাইয়ার হাসিও মুখে। আর আপ্পি হাসি চেপে রেখেছে মুখের ভেতর।  

নাবিহা হেসে ফেলে বলল, জারিফ দুষ্টু ছেলে তোমাকে না বলেছিলাম কটেজে না ঢুকতে। দাঁড়াও এক্ষুণি তোমার পা ভাঙ্গছি আমি।

এক মূহুর্তেই রুমের মৌসুম বদলে গেল। হলুদাভ শুকনো পাতারা মাটিতে ঝরে পরার বদলে ডানা মেলে উড়তে শুরু করলো আকাশ পানে। মেঘের গুড়গুড় ধ্বনির বদলে গুঞ্জিত হতে শুরু করলো কোকিলের পিহু পিহু কলতান। জারিফকে মারার উদ্দেশ্যে নাবিহা কুশন হাতে নিতেই এক লাফে জাওয়াদের কোলে উঠে গেলো জারিফ। কিন্তু তবুও নাবিহা ওর পা ভেঙ্গে দেবার জন্য কুশন নিয়ে ছুটে এলো। কোলের মধ্যে বসেই জারিফের পাপা বাচাও, বাচাও আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে জাওয়াদ রুমের ভেতর ছুটোছুটি শুরু করলো। নাবিহার সাথে তখন জিশান যোগ দিলো। আর জিহাদ হেসে লুটোপুটি খেতে শুরু করলো বিছানায়। কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে সবাই নীচে কার্পেটের উপর বসলো। চার সন্তানকেই তখন কাছে টেনে নিলো জাওয়াদ। কান ধরে সরি বললো কথা দিয়েও দেরি করে আসার জন্য। সমস্ত মান অভিমান ভুলে গিয়ে সবাই তখন আবারো ভাব করে নিলো। বাচ্চাদের সাথে আরো কিছুক্ষণ গল্প ও হাসি আনন্দ করার পর জাওয়াদ বলল, এখন তাহলে তোমরা সবাই তোমাদের রুমে যাও। পাপা সারাদিন বাইরে ছিলাম। ফ্রেশ হয়ে নেই এখন। এরপর ইনশাআল্লাহ সবাই মিলে একসাথে ডিনার করবো।

চারজনই একসাথে হাসি মুখে বলল, ওকে পাপা।

বাচ্চাদের সবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বসা থেকে উঠতে গিয়ে জানালার দিকে দৃষ্টি যেতেই থমকে গেলো জাওয়াদ। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের মামণি এসেছিল আজ আমার রুমে?   

জিশান ভারিক্কী স্টাইলে জবাব দিয়েছিল, বৃক্ষের পরিচয় যেমন হয় তার ফলে, ঘরের সৌন্দর্য তেমনি আমাদের মা’র আগমনের কথা বলে। 

জিশানের ছন্দ শুনে হেসে ফেললো জাওয়াদ। বাড়িতে যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে গত দু’তিন মাস ধরেই সেটা টের পাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে যে আবারো প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসতে শুরু করেছে তাদের আনন্দবাড়িতে সেটাও অনুভব করতে পারছে। গত এগারো বছর ধরে হঠাৎ হঠাৎ শুনতে পাওয়া পাপা-বাবা-বাপীর সম্মিলিত হাসি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মা-মামণি-খালামণি-ফুপ্পিরা একসাথে বসা মানেই ছিল দুঃখবিলাস। কিন্তু আজকাল দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায় মনের আনন্দে এক ঝাঁক কৈতুরি বাড়ির হাল হাকিকত বিষয়ক গসিপে মগ্ন আছেন। বাচ্চাদের দুষ্টুমিও সহ্য সীমা অতিক্রম করতে শুরু করেছে। পরিবর্তনের ধরণই জানান দিয়ে যাচ্ছে নেপথ্যে কোন শিল্পী তার শিল্পকলা প্রাক্টিস করছেন। নূহার এমন হঠাৎ বদলে যাবার পেছনে কারণটা যদিও এখনো ঠিক স্পষ্ট নয় জাওয়াদের কাছে। তবে আনন্দবাড়ির আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ানো অতীত দিনের স্বপ্নময় গুঞ্জরন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে প্রায়শই। তবে নূহার তার রুমে ঢোকাটা এখনো অবিশ্বাস্য লাগছিল জাওয়াদের কাছে। গত এগারো বছরে এমনটা কখনোই হয়নি। তাছাড়া শুধু রুমে ঢোকাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি নূহা। পুরো রুমের সাদা পর্দা চেঞ্জ করে রঙিন পর্দা লাগিয়েছে। নূহার অদ্ভুত সব থিউরির একটি হচ্ছে, পারিবারিক জীবনে পরিবর্তনের শুরু পর্দা থেকে হয়। পর্দার দ্বারা নির্ধারিত হয় সম্পর্কের বন্ধনের দৌরাত্ম কতটুকু ও কতদূর পর্যন্ত হবে। তাই কোন কিছু বদলের ফার্স্ট সিগন্যাল হচ্ছে পর্দার ধরণ বদলে যাওয়া। যখন পর্দার রঙ বদলে যায়, তখন জীবনও সেজে ওঠে নতুন কোন রঙে।    

তোমার জন্য আরো দুটা সারপ্রাইজ আছে পাপা। কথাটা শুনে পর্দার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নাবিহার দিকে তাকালো জাওয়াদ।

একটা প্যাকেট বাড়িয়ে ধরে হাস্যেজ্জল চেহারায় নাবিহা বলল, বিকেলে পার্ক থেকে ফেরার পথে আমি আর মামণি তোমার জন্য এটা কিনেছি।

প্যাকেট নিয়ে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, জাযাকিল্লাহু খাইরান। এর ভেতর কি রঙ-তুলি?

নাবিহা অবাক কন্ঠে বলল, হ্যা। কিন্তু না খুলেই তুমি কি করে বুঝলে পাপা?

জাওয়াদ হেসে বলল, প্যাকেট বন্ধ কিন্তু তোমার আর তোমার মামণির মন দু'খানা আমার সামনে খোলা। তাই বুঝতে পেরেছি। আরেকটা সারপ্রাইজ কোথায়?

জিহাদ, জিশান, জারিফ, নাবিহা তিনজনই হাত তুলে দেয়ালের বোর্ড দেখিয়ে দিলো।  

জাওয়াদ তাকিয়ে হেসে বলল, ঠিকআছে আমি দেখে নেবো ইনশাআল্লাহ।

বাচ্চারা বেরিয়ে যাবার পর বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো জাওয়াদ। নূহার লিখে রেখে যাওয়া শব্দগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেবার পর সেলফোন নিয়ে প্রথমে ছবি তুলে রাখলো। এরপর বোর্ড মুছে ড্রেসিংরুমের দিকে রওনা দিলো।      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন