রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...১১




ক্ষণে ক্ষণে নিজের মাঝে হারিয়ে যাওয়া, ভাবনার অতল গহ্বর থেকে হঠাৎ চমকে বেড়িয়ে আসা, কথা বলতে বলতে একটু বিরতি দিয়ে শব্দগুলোকে আরেকটু সুন্দর করে সাজিয়ে নেয়া, চোখের উপর ঝুঁকে পড়া স্বর্ণাভ ঢেউ খেলানো চুলগুলোকে হাতের ছোঁয়ায় কানের পাশে গুঁজে দেয়া, নাক ফুলিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে মনের মাঝেই রাগের তীব্র স্রোতকে চেপে রাখা, নাক টেনে টেনে অভিমানের অপ্রতিরোধ্য অশ্রুর বাইরে বেড়িয়ে আসার পথকে রুদ্ধ করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা, আপন মনেই হাসা, চিন্তাযুক্ত অবস্থায় কনিষ্ঠা আঙুলের নখ কুটকুট করে চিবানো! তুমি কি জানো এগুলো কার অভ্যাস?

এমনিতেই রাগে চারপাশের সবকিছু জ্বালাময় লাগছিল নূহার কাছে। জাওয়াদের কথাগুলো কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতই লাগলো। জবাব না দিয়ে চোখ মুখ আরো শক্ত করে বসলো। একে তো এত দেরি করে বাসায় ফিরেছে, ফোন করে জানাওনি আসতে দেরি হবে, উল্টো নূহা যখন ফোন দিয়েছে সেটাও রিসিভ করেনি। জাওয়াদকে দেখে এতক্ষণ ধরে রাখা অস্থিরতার বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাই দরজা খুলেই নূহা হড়বড় করে একসাথে কোথায় ছিলে, ফোন ধরোনি কেন, এত দেরি সেটা জানাওনি কেন? ইত্যাদি অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলেছিল। নূহার কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিরক্ত কন্ঠে জাওয়াদ বলে উঠল, বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে এমন প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসা কোথায় শিখেছো? তারপর চুপচাপ রুমে চলে গেলো। অন্য সময় হলে হয়তো এতটা কষ্ট পেতো না কিন্তু আজ কষ্টের সাথে প্রচন্ড রাগ হলো নূহার। রুমে না গিয়ে তাই খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে চুপ করে বসে ছিল। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে এসে জাওয়াদ এমন ভাণ করলো যেন কিছুই হয়নি। এখন আবার আহ্লাদী টাইপ কথা শুরু করেছে।

নূহাকে চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকতে দেখে জাওয়াদ হেসে বলল, মানুষকে কখনোই সেই ভুলের শাস্তি দেয়া উচিত নয় যা তোমার হিসাবে ভুল। আর শাস্তি দিতে চাইলেও অন্তত আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ তাকে দেয়া উচিত। এমনো তো হতে পারে সুযোগের সদ্ব্যবহারে তোমার মনের ভুলের ক্যাকটাসকে সে রুপান্তরিত করে দেবে ইউক্যালিপটাসে!

হেসে ফেলতে গিয়েও আবার নিজেকে সামলে নিলো নূহা। এই লোক কথার সাগর, শব্দের জাদুকর সেটা খুব ভালো করেই জানা আছে। সবসময়ই এমন কথার জাল বিছিয়ে পটিয়ে ফেলে তাকে। কিন্তু আজ নূহা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কোন মতেই উনার কথার ফাঁদে নিজেকে আটকানো যাবে না।

জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, আসলে কি হয়েছে শোনো। হঠাৎ করেই আমাকে শহরের বাইরে যেতে  হয়েছিল। যেখানে গিয়েছিলাম নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে ফোন দিতে পারিনি তোমাকে। তুমি যখন ফোন দিয়েছিলে রিসিভ করার মত ব্যাটারি ছিল না। তবে আমি যাবার আগে বাড়িতে ফোন দিয়েছিলাম তুমি তখন ক্লাসে ছিলে। বিকেলেও একবার ফোন দিয়েছিলাম তুমি ঘুমোচ্ছিলে। লাস্ট কল দিয়েছিলাম রাত সাড়ে দশটার দিকে। তখন তুমি শাওয়ার নিতে গিয়েছিলে। মজার ব্যাপার হলো আমি তিনবার তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম তিনবারই তানজিনের সাথে কথা হয়েছিল। শেষের বার তানজিন বলল, ভাইয়া আজ মনেহয় ভাবীর সাথে কথা বলা তোমার ভাগ্যে নেই। তাই ট্রাই করা ছেড়ে দাও। আমিও ভাবীকে কিছু বলবো না তোমার বার বার ফোন দেবার ব্যাপারে। তবে খেয়াল রাখবো ভাবীর দিকে। যদি দেখি খুব বেশি টেনশন করছে তখন জানিয়ে দেব তোমার আসতে দেরি হবার ব্যাপারটা। এই হচ্ছে মোটামুটি ঘটনা।

আর বাড়িতে ঢুকে যে চিৎকার করলে সেটা?

সেটারও কারণ আছে।

কি কারণ?

আমি ঐ সময় নরম স্বরে কথা বললে, তোমাকে কাছে টেনে নিতে চাইলেই তুমি নাক টেনে টেনে হাপুস হুপুস কান্না জুড়ে দিতে। তুমি তো জানোই যে কটা জিনিস আমি একদমই সহ্য করতে পারি না তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে তোমার কান্না। তোমার চোখে অশ্রু দেখলে অদ্ভুত গণ্ডগোল শুরু হয় আমার বুকের ভেতর। এমনিতেই সারাদিন তোমার থেকে দূরে থাকার কারণ বুকের ভেতরটা খালি খালি লাগছিল। এর উপর গণ্ডগোলের বোঝা চাপানোটা দুঃসাহস হয়ে যেত। তাই ঐ মূহুর্তে তোমার কান্নার পথ রুদ্ধ করার জন্য তোমাকে রাগিয়ে দেয়া ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা ছিল না আমার সামনে।  

নূহা হাসবে নাকি রাগ করবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো একদম।  

কিছুটা ক্ষণ নীরব থেকে জাওয়াদ বলল, আজ দুপুর থেকেই খুব ইচ্ছে করছিল ছিটা রুটি আর  গরুর মাংস ভুনা খেতে। আচ্ছা তুমি আমার মনের ইচ্ছেগুলো কিভাবে বুঝে নাও বলো তো?

নূহা মৃদু কন্ঠে বলল, আমিই বুঝে নিয়েছি সে কথা কে বললো? এমনও তো হতে পারে মা রান্না করেছেন এসব।

আমি জানি এসব তুমিই রান্না করেছো। তাছাড়া আজ তো প্রথমবার এমন হয়নি। এমনটা প্রায়ই হয় আমি মনে মনে যে জিনিসটা ভাবি তুমি সেটাই করো।

তুমি চিন্তা বা কল্পনাও করতে পারো না এমন কাজও তো আমি প্রায়শই করি তাই না? সুতরাং, এসব নিয়ে এত অবাক হবার তো কিছু নেই।

তুমি মনে মনে একটা জিনিস চাইলে আর তোমার প্রিয়তম মানুষটি সেই জিনিসটিই নিয়ে এলো। এতে মনে মুগ্ধবোধ তৈরির কিছু নেই?

না নেই। এসবেরও নিশ্চিয়ই কোন ব্যাখ্যা আছে। যেমন ধরো, আমার পেয়ারা পছন্দ, তোমারো পছন্দ। এখন একই সময় আমাদের পেয়ারা খাবার ইচ্ছে হতেই পারে। এখানে মুগ্ধ হবার কি আছে?

জগতের সবকিছুর পেছনে ব্যাখ্যা খুঁজতে যাওয়া ঠিক না নূহা। এতে একদিকে যেমন জীবনটা জটিল হয়ে যায়। অন্যদিকে জীবন হারায় আনন্দিত হবার, মুগ্ধ হবার ছোট ছোট উপকরণ গুলো। একজন আরেকজনের মনের কথা বুঝে নেয়া বা অনেক সময় চিন্তা-ভাবনা মিলে যাওয়া। বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা হয়তো খুবই সোজা। কিন্তু যখন আমি তোমার সাথে কথা বলার উদ্দেশ্য সেলফোন হাতে নেই আর ঠিক সেই মূহুর্তেই স্ক্রিনে তোমার নাম্বার ভেসে উঠে। সেই আনন্দের গভীরতাকে আমি কোন ব্যাখ্যার মোহতাজ করতে চাই না। আমি জীবনকে সর্বক্ষেত্রে ব্যাখ্যা, সংজ্ঞা বা উদাহরণের সেলেও বন্দী করতে চাই না। আমি জীবনে আসা প্রতিটি আনন্দকে, আনন্দের মূহুর্তগুলোকে উপভোগ করতে চাই। ছোট্ট ছোট্ট খুব সাধারণত ঘটনা, কথার ভেতর থেকে মুগ্ধতাকে খুঁজে নিয়ে মুগ্ধ হতে চাই।

ভালো কথা। যত ইচ্ছে আনন্দ উপভোগ করো, মুগ্ধ হও। তোমাকে তো কেউ বাঁধা দিচ্ছে না।

কিছুটা বিরক্তির স্বরে জাওয়াদ বলল, মাঝে মাঝে তোমার সাথে কথা বলাটাকে অনর্থক মনে হয়।

তাহলে তখন আমার সাথে কথা বলা থেকে বিরত থাকবে। অনর্থক কাজ যথা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো।

খাবারের প্লেট নিয়ে জাওয়াদ উঠে যাবার উদ্যোগ নিতেই নূহা বলল, যেও না সাথী। চলেছো  একেলা কোথায়। পথ খুঁজে পাবে নাতো আমি বিনে...!

জাওয়াদ চলে যেতে যেতে বলল, পথ খুঁজে না পেলে হারিয়ে যাবো। গোলোকধাঁধায় ঘুরতে থাকবো। তাও তোমার মতো বেয়াদব মেয়ের পাশে বসে খাবো না।

হাসতে হাসতে নূহা বলল, তুমি আমাকে রাগিয়েছো বদলে আমিও তোমাকে রাগিয়েছি। এখন শোধ বোধ হয়ে গিয়েছে। তুমি যাও আমি চা নিয়ে আসছি। চা পান করতে করতে দুজন মিলে গবেষণা করে বের করবো, মুখে না বলেও একে অন্যের মনের কথা বুঝে ফেলার পেছনে রহস্যটা আসলে কি!

রুমে গিয়ে খাওয়া শেষে ইচ্ছে করেই নিজের এঁটো প্লেট নিয়ে নূহার ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো জাওয়াদ। ভয়াবহ রকমের শুচিবায়ুগ্রস্তা নূহা। ড্রেসিং টেবিলের উপর এঁটো প্লেট দেখা মাত্র ইয়াক ইয়াক চিৎকার জুড়ে দেবে। নূহাকে জ্বালানোর, ক্ষেপানোর, খোঁচানোর কোন একটা সুযোগ হেলায় হারাতে দেয় না জাওয়াদ। মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে শাসন করে। সিদ্ধান্ত নেয় আর এভাবে সারাক্ষণ যন্ত্রণা দেবে না। কিন্তু সুযোগ হাতে পাবার সাথে সাথে সব সিদ্ধান্ত ভুলে গিয়ে আবারো নূহার পেছনে লাগে। নূহার আসার শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি পাশ থেকে বই তুলে নিয়ে মুখ গম্ভীর করে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে এমন ভান করলো। কিন্তু তার সকল আশার গুঁড়ে বালি দিয়ে নূহা ড্রেসিং টেবিলের দিকে ফিরেও তাকালো না। চায়ের কাপ নিয়ে সোজ কাছে এসে বসে হাসি মুখে বলল, এই নাও।

এটা কি? 

এটা চা।

কেমন চা?

যেমন চা তুমি পান করো ঠিক তেমন চা।

যেমন চা আমি পান করি তেমন চা পান করার জন্য তো বৌয়ের দরকার নেই।

মানে?

মানে একটা মেয়ে ঠিক কতটা ফাঁকিবাজ স্বভাবের হলে গরম পানির ভেতর শুধু টি ব্যাগ দিয়ে বানানো চা স্বামীকে পরিবেশন করে ভেবে দেখো একটু।

উফফ...কোন একটা কথা যদি এই লোক একটু সোজা করে বলতো। খালি প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে কথাকে ঝগড়ার দিকে নিয়ে যাবার সুযোগ খোঁজে।

যে যেমন তার কাছে সবকিছু তেমনই লাগে। তুমি প্যাঁচালো স্বভাবের তাই আমার সহজ কথাতেও প্যাঁচ দেখতে পাও।

নূহা হেসে বলল, অনেক হয়েছে আজ ঝগড়া এই পর্যন্তই থাক। তোমার যখন এতই বৌয়ের সাথে ঝগড়া করার সাধ আগামীকাল সকালের চা থেকেই শুরু করবো ইনশাআল্লাহ। এখন তুমি আমাকে বলো না কিভাবে একে অন্যের কথা মুখে না বলার পরও অনেক সময় বুঝে ফেলতে পারে মানুষ? এর রহস্যটা কি?

রহস্যটা বললে আমার কি লাভ হবে?

নূহা চোখ বড় বড় করে বলল, ছিঃ জাওয়াদ! আমাদের দুইজনের মধ্যে কি ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক নাকি যে তুমি লাভ ক্ষতির প্রশ্ন আনছো? তোমার প্রশ্ন শুনে আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি।

জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা চলো মর্মাহতের সাথে সাথে তোমাকে খানিকটা জ্ঞানাহতও করি। টেলিপ্যাথির নাম তো শুনেছো তাই না?  

হুমম... মানুষের অনেকগুলো অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার মধ্যে একটি হচ্ছে টেলিপ্যাথি বা অন্যের মনের কথা বুঝতে পারা।

হ্যা। সাইকোলজির একটি শাখা প্যারা সাইকোলজি। প্যারা সাইকোলজিতে বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা বা মানুষের নানান ধরণের ক্ষমতা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয় বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই। প্যারা সাইকোলজিস্টরা মানুষের যেসব ক্ষমতাকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে থাকেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে টেলিপ্যাথি বা মানুষের মনের কথা বুঝতে পারার ক্ষমতা। টেলিপ্যাথি গ্রীক শব্দ টেলি প্যাথিয়া থেকে এসেছে। যার অর্থ দাঁড়ায় দূরবর্তী অনুভূতি। এই যেমন কয়েকদিন আগে তুমি বাবার সাথে কথা বলার জন্য নীচে যাবার কথা ভাবছিলে কিছুক্ষণ পরই বাবা এসে দরজা নক করেছিলেন তোমার সাথে গল্প করার উদ্দেশ্যে। এমনটা প্রায়ই হয় আমি তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম ঠিক  তখনই তোমার ফোন আসে আমার কাছে। আবার তুমি হয়তো ছোটবেলার মজার কোন একটা  স্মৃতির কথা ভাবছিলে। তোমার বোনদের কেউ হাসতে হাসতে সেই ঘটনাই বলতে শুরু করলো তোমাকে। এমন কম বেশি সবার সাথেই ঘটে। এভাবে নিজের অজান্তেই অন্য কারো মনের কথা জানা, বোঝা, অনুমান করা বা বলার এই ক্ষমতাটিই টেলিপ্যাথি হিসেবে পরিচিত।

সত্যিই কি এই সমস্ত ঘটনার একমাত্র ব্যাখ্যা টেলিপ্যাথি? টেলিপ্যাথির কি সত্যিই কোন অস্তিত্ব আছে?

জাওয়াদ হেসে বলল, আমি তো সাইকোলজিস্ট বা প্যারাসাইকোলজিস্ট কোনটাই নই। আমি তোমাকে যা বললাম প্যারাসাইকোলজি নিয়ে সামান্য যে পড়াশোনা করেছি সেই জ্ঞান থেকে বলেছি। টেলিপ্যাথি ঠিক কিভাবে কাজ করে সেটা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে পরিস্কার নয়। বিজ্ঞানীরা তাই ব্যাপকভাবে টেলিপ্যাথিকে স্বীকৃতিও দেননি। তবে এটাও আবার ঠিক যে এসব বিষয়কে কাকতালীয় ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়ারও কিন্তু উপায় থাকে না সবসময়। যখন আমার মনের কথাটিই কাছের বা দূরের একজন বলে দিচ্ছে, তখন ভাবনা জাগাটা স্বাভাবিক। এসব আসলে আমাদের মস্তিষ্কের এক অতীন্দ্রিয় সংবেদনশীলতা। যেখানে আমাদের অবাধ প্রবেশাধিকার নেই। তবে প্রত্যেকেই নিজস্ব ব্যাখ্যা মনেহয় দাঁড় করাতে পারে ভাবনাতে খোঁড়াক যোগানো বা নিজেকে শান্ত করার জন্য।

সেটা কি রকম?

ঐ যে তুমি বললে, আমার পেয়ারা পছন্দ, তোমারো পছন্দ। সুতরাং, একই সময় আমাদের দুজনের পেয়ারা খাবার ইচ্ছে হতেই পারে।

নূহা হেসে বলল, কিন্তু যখন আমি যা ভাবছি সেটাই সংঘটিত হচ্ছে বা আমি যা বলতে চাইছি সেটাই কেউ বলে দিচ্ছে। তখন তো আর এই ব্যাখ্যা খাটবে না।

অবশ্যই খাটবে না।

তাহলে?

তাহলে জ্ঞানার্জন করো টেলিপ্যাথি নিয়ে। লাইব্রেরীতে প্যারা সাইকোলজির বই আছে। নিয়ে এসো। নিজে পড়ো সাথে আমাকেও পড়ে শোনাও।

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা এক্ষুনি নিয়ে আসছি আমি। 

লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে এসে রুমে ঢুকে জাওয়াদকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে নূহা বলল, কি ব্যাপার তুমি এখনো চা খাওনি যে? ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে তো। আবার গরম করে আনবো? কথা বলছো না কেন? এই কি হয়েছে তোমার?

বুঝতে পারছি না। গরম চা মুখে দেবার সাথে সাথে প্রচন্ড ব্যথা করছে দাঁত।

দাঁত কি খুব বেশি ব্যথা করছে? আচ্ছা শোন আমার মাথায় না ফাটাফাটি একটা আইডিয়া এসেছে।

তোমার ফাটাফাটি আইডিয়া মানেই হচ্ছে অতি মাত্রায় যন্ত্রণাদায়ক কিছু। তারপরও বলো শুনছি।

নূহা মিষ্টি করে হেসে বলল, জ্বিনা। আমার এবারের আইডিয়াটা সত্যিই ভীষণ রকম ফাটাফাটি। আইডিয়াটা হচ্ছে আমি বরং ডেন্টালে ভর্তি হয়ে যাই। দেখো বিয়ের পর থেকে গত এক বছরে এই নিয়ে তিন বার তোমার দাঁত ব্যথা হয়েছে। তোমার আসলে একজন ডেন্টিস্ট বউ দরকার। তাহলে যখনই তোমার দাঁত ব্যথা শুরু হবে আমি ফট করে দাঁতটা টেনে তুলে ফেলে দিতে পারবো। কারণ তোমার কষ্ট আমি একদম সহ্য করতে পারি না। তাই যে দাঁত তোমাকে ব্যথা দেয় পৃথিবীতে সেই দাঁতের অস্তিত্বই রাখবো না আমি।

জাওয়াদ হেসে ফেলে বলল, কতটা নিষ্ঠুর হলে একটা মেয়ে তার স্বামীর কষ্টে এমন মজা পেতে পারে। একটা ব্যাপার বলো তো এই যে তুমি এত নিষ্ঠুর স্বভাবের একটি মেয়ে। তারপরও তোমাকে এত ভালোবাসি কেন আমি? 

নূহা হেসে বলল, কারণ আমাকে ভালোবাসা হচ্ছে তোমার মনের এ, বি, সি, ডি, এক কথায় এ টু জেড ভিটামিন। প্লাস ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগ্নেশিয়াম, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে নিয়ে শুরু করে উপকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস আর যা যা আছে সবকিছু। একবার শুধু তুমি আমাকে ভালোবাসা ছেড়ে দেখোই না কি দশা হয় তোমার মনের। রাতকানা, দিনকানা, অপুষ্টি, অ্যাজমা ইত্যাদির প্রকোপে মূহুর্তেই একশো বছরের থুড়থুড়ে বুড়ো হয়ে যাবে তোমার মন। ঝরঝর করে পলকেই সব দাঁত পরে যাবে, চোখে ছানি পড়বে, মাথার চুল উড়ে তেলেতেলে টাক বেরিয়ে যাবে। সারাদিন যে বসে বসে মাসল বানাও সেগুলোও এক ফুট নীচে ঝুলে যাবে।  

জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, ভিটামিন তো তাও বুঝলাম। কিন্তু মনেরও দাঁত, চোখ, চুল আর মাসল আছে? শোনো ডেন্টিস্ট না তুমি সাইকিয়াট্রিস্ট হও। যে লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে তোমার মাঝে তাতে সাইকো ওয়াল্ডকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে এই সমস্ত আবিষ্কারের দ্বারা। এবং নিজেও অনেক উন্নতি করবে।

নূহা চোখ বড় বড় করে বলল, ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে যে আমাকে সাইকো বলা হচ্ছে সেটা খুব মতোই বুঝতে পারছি। কিন্তু তাই বলে আমার কথাগুলোকেও হেসে উড়িয়ে দেবেন না। বিশ্বাস না হলে কিছুক্ষণের জন্য আমাকে ভালোবাসা থামিয়েই দেখেন না।

জাওয়াদ হেসে বলল, আরে নাহ কি দরকার শুধু শুধু মানসিক সৌন্দর্যকে এমন অগ্নি পরীক্ষার দোরগোড়ায় নিয়ে দাঁড় করানোর? তাছাড়া তোমার থিউরী আমার পছন্দ হয়েছে। আমি তো আরো তোমার অটোগ্রাফ নেবার কথা ভাবছিলাম। এসো কাছে এসো অটোগ্রাফ দিয়ে যাও।

জাওয়াদের দুষ্টু চিন্তা আঁচ করতে পেরে ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তারআগেই জাওয়াদ উঠে এসে ধরে ফেলেছিল নূহাকে।

কি রে তুই তো দেখি এখনো ছুঁয়েই দেখিসনি কোন কিছু। ক্ষুধা লেগেছে, ক্ষুধা লেগেছে বলে চিৎকার করে না একটু আগে বাড়ি মাথায় তুললি। আর এখন না খেয়ে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছিস। তাকিয়ে আছিস কেন এভাবে? এই নূহা কি হয়েছে তোর?

মামণির কথাগুলো শুনতে পেলেও কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না নূহা। সত্যিই অনেক ক্ষুধা লেগেছিল বাচ্চাদেরকে নিয়ে পার্ক থেকে ফিরে আসার পর। মাগরীবের নামাজ আদায় করেই তাই খাবারের খোঁজে হাজির হয়ে গিয়েছিল রান্নাঘরে। নূহার খুব পছন্দ তাই ছিটা রুটি আর গরুর মাংস ভুনা রান্না করেছিলেন মামণি। কিন্তু মামণি খাবার এনে সামনে রাখার সাথে সাথেই মন প্রজাপতি হয়ে উড়তে শুরু করেছিল অতীত বাগিচায়। ছিটা রুটি আর গরুর মাংস ভুনা এই একটা খাবারই খুব পছন্দ করে খেতো জাওয়াদ। তাই খাবারগুলো সামনে দেখা মাত্রই মন এক ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল সমস্ত বাস্তবতা ভুলে। এতক্ষণ যে স্মৃতির মিঠা সরোবরে ভেসে বেড়াচ্ছিলো সেই অনুভূতিটুকুই কাজ করছিল না মনে। কিন্তু এই মূহুর্তে প্রচন্ড একটা সংকোচ, একটা অপরাধবোধ ঘিরে ধরলো নূহাকে। ভেতর থেকে কেউ বার বার বলছিল, তুমি অন্যায় চিন্তা করছো, ভুল চিন্তা করছো। তোমার কল্পনার ঐ সময়টা হয়তো শুদ্ধতা ধোঁয়া। কিন্তু ঐ শুভ্রতায় স্নাত হবার অধিকার তোমার নেই। নূহা টের পাচ্ছিলো বাড়িতে আসার পর থেকেই ওর চিন্তা-ভাবনারা অতীতাচ্ছন্ন হয়ে যেতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। খাবারের প্লেট সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, রাহাত কোথায় মামণি? ওকে বলো আমি বাসায় যাবও।  

অবাক মেয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন মিসেস সুরাইয়া। বুকের ভেতরটা হঠাৎ ভারি হয়ে এলেও মুখে কিছুই বললেন না। খুব ভালো করেই নূহার স্বভাব জানা আছে তার। একবার যেহেতু বলেছে বাসায় যাবে কারো সাধ্য নেই এখন ওকে আঁটকে রাখার। তাই নূহাকে কিছু না বলে রাহাতকে কোথায় সেই খোঁজে বের হলেন।       

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন