রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...১৯




উপস্থিত তিনজনকেই অবাক করে দিয়ে দুইবার খুক খুক কাশি দিয়ে ফায়েজ বলল, এভাবে চুপচাপ বসে থাকার জন্য তো মনেহয় না আমরা এখানে এসেছি। কথা যেহেতু বলতেই হবে চুপ করে না থেকে বলে ফেলাটাই ভাল। নূহা!

ডাক শুনে নূহা বলল, জ্বি বড় ভাইয়া।

গতরাতে তুই যে কান্ডটা করেছিস সেটা মোটেই ঠিক হয়নি। বাড়ির প্রতিটা মানুষ আপসেট হয়েছে সেটা অন্য কথা। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, বাচ্চারা সবাই কষ্ট পেয়েছে। যারা বোঝে তারা নিজের মতো করে কিছু একটা ভেবে নিয়েছে। কিন্তু যারা এখনো সেভাবে বুঝতে শেখেনি তারা নানান ধরণের প্রশ্ন করেছে। আসফিন যেমন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ফুম্মা কেন চলে গেলো আমাকে না বলে? ফুম্মা তো কথা দিয়েছিল আমাদের সাথে খেলা করবে। ওয়াদা ভঙ্গ করা ব্যাড কাজ। আল্লাহ নারাজ হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি আরো নানান কথা। এতো গেলো বাড়ির বিষয়ে। গত তিনমাসে হাসপাতালের ডিউটির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অনিয়ম করেছিস তুই। গড়ে প্রায় প্রতিদিনই কারো না কারো অ্যাপয়েনমেন্ট ক্যান্সেল করছিস। যেদিন ইচ্ছে হচ্ছে ডিউটিতে আসছিস, যেদিন ইচ্ছে হচ্ছে না আসছিস না। এর প্রভাব আমাদের রেপুটেশন এবং পুরো স্টাফদের উপরে পড়ছে। নিজেদের হাসপাতালে আমাদের অ্যক্টিভিটিস যদি এমন হয়। তাহলে অন্যেরাও দায়িত্বে অবহেলা করতে শুরু করবে এটাই তো স্বাভাবিক তাই না? এমন তো নয় যে এসব তুই বুঝিস না? জেনে বুঝেই তুই উল্টাপাল্টা কর্মকান্ড করে সবাইকে হয়রানী করিস।

নূহা বলল, আই এম রিয়েলি ভেরি সরি ভাইয়া। কিন্তু অফিসিয়াল দায়িত্ব পালনে আমি এরআগে কখনই কোন অবহেলা করিনি। ইনশাআল্লাহ আজকের পর থেকে আমি খেয়াল রাখবো আমার দ্বারা যেন কোন অনিয়ম না ঘটে।

আর পরিবারের ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্ত কি? প্রশ্ন করলো জাওয়াদ। কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো নূহা। জাওয়াদ আবারো বলল, আমি মোটেই হাসপাতালের ব্যাপারে কথা বলতে আসিনি এখানে। কোন কোন ক্ষেত্রে দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। তাই অনিয়ম সহ্য সীমা অতিক্রম করা মাত্রই এক মূহুর্ত দেরি না করে তোমাকে আমি হাসপাতাল থেকে বের করে দেব। এবং নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো তত্ত্ব অনুযায়ী অন্য কোন সাইকিয়াটিস্ট নিয়োগ দেবো। এটা আসলে কোন ব্যাপারই না। সমস্যা হচ্ছে পরিবার। গত এগারো বছর ধরে তুমি এমন এক কাঁটা হয়ে পরিবারের গলার মধ্যে আঁটকে আছো যাকে না গিলে ফেলা সম্ভব, না বাহির করে ফেলা দেয়া সম্ভব।

হুমায়ূন হেসে ফেলে বলল, তুমি যা বলো না ভাইয়া! নূহা ভাইয়া আসলে রাগিয়ে দিয়ে তোর মুখে কথা ফোঁটাতে চাইছে। তাই চুপ না থেকে কথা বলতে শুরু কর। তাহলেই দেখবি ভাইয়া এসব অদ্ভুত কথা আর বলছে না।

সে যাতে কথা বলে সেজন্যই যে জাওয়াদ ওভাবে বলছে সেটা নূহা নিজেও বুঝতে পারছিল। অন্য সময় হলে হয়তো সত্যিই রেগে উঠে পাল্টা জবাব দিতো। কিন্তু এই মূহুর্তে ভেতরে কোন অনুভুতিই কাজ করছিল না। নিজের মনের কথাগুলো ভাইয়াদেরকে বলার ব্যাপারে সামান্যতম স্পৃহাও কাজ করছিল না। নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রতি অবহেলার স্মরণ তীব্র অপরাধ বোধ তৈরি করেছিল নূহার মনের ভেতর। বিশেষ করে অবুঝ বাচ্চাদের মনে নানান ধরণের প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল জানার পর প্রচন্ড লজ্জাবোধও ঘিরে ধরেছিল অপরাধবোধের সাথে সাথে। সে নিজেই সবসময় সবাইকে বলে, ‘অন্যদের কর্ম ও ভাবনার উপর নেই মোদের নিয়ন্ত্রণ, তবে পুনঃপুনঃ নিজেকে করতে পারি মোরা সংশোধন’। কিন্তু যখন নিজের কর্ম ও আচরণের দ্বারা অন্যের মনের নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়েছে এমন তথ্য এসে হাজির হয় সামনে। তখন খুব অসহায় লাগে। কুরআনে তো সাবধান করে দেয়া হয়েছে, "হে ঈমানদারগণ ! তোমরা এমন কথা কেন বলো যা নিজেরা করো না ? আল্লাহর নিকট বড় ক্রোধের বিষয় এই যে তোমরা এমন কথা বলো যা তোমরা নিজেরা করো না" অথচ সে তো সারাক্ষণই সবাইকে বলে, নিজের কারণে কখনোই অন্যেকে কষ্ট দিতে নেই। খেয়াল রাখা উচিত যাতে আমাদের নিজের কারণে কারো আনন্দময় একটু মূহুর্তও নষ্ট হয়ে না যায়। অথচ সেই কিনা পরিবারের সবার মনো কষ্টের কারণ হয়েছে। সবার আনন্দকে নষ্ট করেছে। এরপরও নিজের হয়ে কিছু বলতে যাওয়া মানে সুস্পষ্ট অজুহাত দাঁড় করানো। নিজের ভুলকে শুদ্ধ প্রমাণিত করার মতো আত্মিক অবনতি এখনো তার হয়নি। তাই চুপ করে থাকাটাকেই ভালো মনে হলো নূহার।  

নূহাকে একদমই নীরব দেখে ওর মনের অবস্থা উপলব্ধি করতে পারছিল জাওয়াদ। প্রচন্ড বিরক্ত লাগছিল ফায়েজের উপর। ফায়েজ কথা বলে না এটাই ভালো। কারণ যখনই কথা বলে যা বলা দরকার সেসব কথা না বলে, যেসব বলা ঠিক না বেছে বেছে সেগুলোই বলে। এই যেমন বাচ্চাদের নানান রকম প্রশ্নের বিষয়টা নূহাকে সরাসরি বলার কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সেটাই ফায়েজ সবার আগে বলেছে। সাধারণত নূহাকে কোন ব্যাপারে সংশোধন করে দেবার প্রয়োজন হলেই জাওয়াদ সবাইকে সাথে নিয়ে কথা বলতে আসে। কিন্তু আজ মোটেই নূহাকে সংশোধন কিংবা শাসন করার জন্য এখানে আসেনি। জাওয়াদ বুঝতে পারছিল নূহার সাহায্য প্রয়োজন বাড়ির পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেবার জন্য। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভয় সবকিছু মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার আন্তরিক ইচ্ছে থাকার পরেও বার বার থমকে যাচ্ছিলো নূহা। এখন পরিবারের সবার আন্তরিক সহমর্মিতা ও সহযোগীতাই কেবল ওকে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে সহয়তা করতে পারে। সেই সহযোগীতাটুকু করার জন্যই দুই ভাইকে সাথে নিয়ে এখানে এসেছিল। কিন্তু প্রথমেই ফায়েজ সব ভেস্তে দিয়েছে। অবশ্য ফায়েজের উপরও রাগ করতে পারছে না জাওয়াদ। কারণ ফায়েজ চেয়েছিল নীরবতা ভেঙে আলোচনাটা শুরু করতে। কিন্তু যে কোন আলোচনা থেকে উপকৃত হতে চাইলে উত্তম উপস্থাপনটা খুব বেশি গুরুত্বপুর্ণ। শুধুমাত্র ভুল উপস্থাপন খুব সুন্দর কিছুকেও এলোমেলো করে দেবার জন্য যথেষ্ট।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূহা বলল, আজ নাহয় থাক ভাইয়া! আমরা অন্য কোন দিন কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। আজ ভালো লাগছে না একদম। আমি চলে যাই প্লিজ?

নূহার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জাওয়াদ বলল, অনেক আগে একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি অনেকটা এমন ছিল যে, একদিন এক শিক্ষক ক্লাসে ঢুকে সব ছাত্রদেরকে প্রথমে একটি করে বেলুন দিলেন। এবং এরপর সবাইকে বললেন বেলুনে নিজ নিজ নাম লিখতে। সবাই নাম লিখে দেবার পর শিক্ষক বেলুনগুলো সবার কাছ থেকে নিয়ে রুমের এক পাশে রাখলেন। এরপর বললেন, তোমাদের সবাইকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। এরমধ্যে নিজ নিজ নাম লেখা বেলুন খুঁজে বের করতে হবে তোমাদেরকে। ছাত্ররা সবাই তখন হুড়মুড় করে ছুটে গেলো এবং হন্যে হয়ে নিজ নিজ নাম লিখিত বেলুন খুঁজতে শুরু করলো। কিন্তু দু’একজন ছাড়া বাকিদের কেউই পাঁচ মিনিটে নিজের নাম লেখা বেলুন খুঁজে পেলো না। উপরন্তু সবার হুটোপুটি, ছুটোছুটির কারণে অনেক বেলুন নষ্ট হয়ে গেলো। এরপর সেই শিক্ষক একই ভাবে আবারো সবাইকে একটি করে বেলুন দিয়ে নিজ নিজ নাম লিখিয়ে রুমের এক পাশে নিয়ে রাখলেন। এবং বললেন, নিজ নিজ নাম লিখিত না তোমরা সবাই যেকোন একটি করে বেলুন খুঁজে নিয়ে এসো। এবার আর কোন হৈ-হুল্লোড় হলো না। সবাই খুব সহজেই একটি করে বেলুন পেয়ে গেলো নিজের জন্য। তখন শিক্ষক সবাইকে বললেন, ঠিক এমনটি আমাদের জীবনেও ঘটে। আমরা সবাই হন্যে হয়ে চারিদিকে সুখ খুঁজে বেড়াই। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই সুখের প্রকৃত সন্ধান আমাদের জানা থাকে না। সবাই নিজের সুখের চিন্তায় এতটাই স্বার্থপর হয়ে যায় যে সেজন্য অন্যেকে দুঃখী করতেও কুন্ঠিত বোধ করে না। কিন্তু তবুও বেশির ভাগ সময় ব্যর্থ হয় সুখের আস্বাদনে। এর মূল কারণ কি বলো তো নূহা?  

নূহা বলল, কারণ মানুষের পক্ষে কখনোই একা সুখী হওয়া সম্ভব নয়। একজন মানুষের সুখ মূলত অন্যজনের সুখের মধ্যে নিহিত থাকে।

জাওয়াদ বলল, হুম! আর এজন্যই এই জগতে তারাই সত্যিকার সুখের সন্ধান পায় যারা অন্যকে সুখী করতে উন্মুখ থাকে। অন্যদেকে সুখী করতে চাওয়ার এই ইচ্ছেটাই সেই মানুষদের জীবনের সুখের অফুরন্ত ভান্ডার নিয়ে আসে। এই গল্পটা জানার পর থেকে কোনদিন আর নিজের নাম লেখা বেলুনটির সন্ধানে সময় নষ্ট করিনি আমি। চলার পথে আসা প্রতিটি ছোট্ট ছোট্ট সুখ কুঁড়িয়ে নিয়ে সুখী হবার ইচ্ছে লালন করেছি মনে। অন্যেকে হাসতে দেখে সত্যিকার অর্থে হাসতে শিখে নিয়েছি ধীরে ধীরে। অন্যের ভার মুক্তিতে সাহায্য করে নিজের বোঝা নেমে গিয়েছে এমন তৃপ্তি অনুভব করেছি। আমাদের পাঁচ ভাইয়ের পুরো শৈশব কেটেছে পূর্বপুরুষদের অন্যায়-অবিচার আর স্বার্থপরতার নিষ্ঠুর সব কাহিনী শুনতে শুনতে। অন্তরের গহীন থেকে ঘৃণা করতে করতে বড় হয়েছি মানুষের চরিত্রের সমস্ত দীনতা-হীনতা ও ম্লানতাতে। আলহামদুলিল্লাহ আমরা জ্ঞানোরাজ্যে প্রবেশ করেছিলাম কুরআনের আহ্বানে সাড়া দেবার মাধ্যমে। খুবই নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে আমাদের বাবা- পাপা, চাচ্চুরা জীবন সফরের মূল গন্তব্য হিসেবে জান্নাত এবং রাহবার হিসেবে রাসূল (সঃ) কে স্থাপন করে দিয়েছিলেন আমাদের মনের মাঝে। কারণ নিজেদের জীবনের অসহনীয় তিক্ত অভিজ্ঞতার দ্বারা উনারা বুঝেছিলেন মানুষ যখন শুধু দুনিয়া নিয়ে মত্ত থাকে, তারা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট কিছুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তাই নিজেদের সন্তানদেরকে কখনোই মানুষ থেকে পশু হতে দেবেন না, এটাই ছিল উনাদের জীবন মরণ পণ। সব ছেড়ে দিয়েছিলেন উনারা। নিজেদের দেশ, পরিবার, পরিচিত গন্ডি সবকিছু। যাতে সন্তানদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কোন কিছুই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে সামনে। আমাদের বাবা-মায়েরা তাদের সমস্ত জীবনী শক্তি আমাদের উপর ইনভেস্ট করেছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা উনাদের স্বচ্ছ ও পবিত্র নিয়্যাত এবং অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগকে বৃথা যেতে দেননি। তাই হয়তো খুব অল্প বয়সেই আমরা ভাইয়েরা জাগ্রত বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষে পরিণত হয়েছিলাম। চলার পথের কোন প্রলোভনই আমাদের গতি রোধ করতে পারেনি। আমরা বাবা-মাদের ইচ্ছেকেই আমাদের জীবনের স্বপ্ন বানিয়ে নিয়ে, সেই স্বপ্ন পূরণে অবিচল সামনে এগিয়ে চলেছি। অনেক কষ্ট করেছি আমরা জীবনে। আলহামদুলিল্লাহ কষ্ট সহ্য করেও লক্ষ্যে অর্জনে দৃঢ় ও সংকল্পবদ্ধ থাকার মতো যোগ্যতা ও ধৈর্য্যশীলতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে দিয়েছিলেন। সেজন্যই হয়তো এতকিছুর পরেও আমাদের পরিবার এখনো সঙ্ঘবদ্ধ। আমরা একে অপরের মত মেনে নিতে না পারলেও কেউ কাউকে ছেড়ে যাবার কথা চিন্তাও করতে পারি না। তাই কখনো যদি কাউকে আঘাতও করি, সে যাতে একা একা কষ্ট না পায় সেজন্য নিজে যদি যেতে নাও পারি অন্য কেউকে তার কাছে পাঠিয়ে দেই একাকীত্ব ও কষ্ট লাঘবের জন্য। কিন্তু এখন প্রশ্ন আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার নয়। এখন প্রশ্ন আমাদের সন্তানদের। এবং জীবনের সাঁঝের বেলায় পৌঁছে যাওয়া আমাদের বাবা-মায়েদের। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকবে হবে যাতে এমন কাজ বা আচরণ করে না ফেলি যা কিনা সন্তানদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং আমাদের বাবা-মায়েরা কষ্ট পেতে পারেন।

নূহা বলল, আমি বুঝতে পারছি ভাইয়া। আসলে গতরাতে হঠাৎ এত বেশি আপসেট হয়ে পড়েছিলাম আমি। অন্য কারো কষ্টের কথা চিন্তা করে দেখার অবকাশও পাইনি।

কিন্তু এটা তো ভুল তাই না নূহা? যখন সবকিছু ঠিক থাকে তখন উত্তম কথা বলা, উত্তম কাজ করা, কাউকে কষ্ট না দেয়াটা এমন কোন মহৎ কিছু নয়। যখন তুমি নিজের সমস্যায় সময় অন্যেদেরকে প্রায়োরিটি দিতে পারবে তখনই না প্রশ্ন আসে ত্যাগের। তাছাড়া খুব সহজ একটা ব্যাপার তুমি কেন ধরতে পারছো না? তুমি হঠাৎ হঠাৎ বাড়িতে যাচ্ছো বলেই অতীত স্মৃতিরা তোমাকে এলোমেলো করে দিতে সফল হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তুমি হাসপাতালে জয়েন করার পরের অবস্থাটা চিন্তা করে দেখো। আমিও একই হাসপাতালে আছি এই চিন্তা প্রথম প্রথম যেভাবে তোমাকে আন্দোলিত করতো এখন কি তেমনটা করে? জানি করে না। কারণ হুবহু একই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমিও সময় পার করেছি তখন। সারাক্ষণই মনের মধ্যে কম্পন টের পেয়েছি তুমি জয়েন করার পর প্রথম দু’এক মাস। হাসপাতালে ঢোকার সময়, বেরোনোর সময়, ওটিতে যাবার সময়, ক্যান্টিনে যাবার সময় সারাক্ষণই মনেহতো এই বুঝি তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু এখন তো বেশির ভাগ সময় মনেই থাকে না তোমার সাথে হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে হাসপাতালের কোথাও। হঠাৎ যদি কোনদিন দেখাও হয়ে যায় সালাম বিনিময়ের পর নিজ নিজ কাজে এগিয়ে যেতেও এখন আর আমাদের কষ্ট হয় না। এর কারণ অভ্যস্ততা। আমরা মানুষেরা খুব দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারি যে কোন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে। এটা মানুষের অসাধারণ একটা ক্ষমতা। বাড়িতে তুমি যখন নিয়মিত যাওয়া আসা শুরু করবে, একটা সময় দেখবে হাসপাতালের মতোই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা দুজনই। তখন বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই আর পুরনো স্মৃতিরা দলে দলে হাজির হবে না তোমার মনে। মনের এই ব্যাপারগুলো তো তুমি আমার চেয়েও ভালো বোঝো তাই না?

অনেকটা স্বস্থি ভরা কন্ঠে নুহা বলল, জ্বি ভাইয়া আমি বুঝতে পেরেছি। জাযাকাল্লাহ।

আরেকটা কথা নূহা। বাচ্চারা যখন ছোট ছিল তোমার বাড়ি থেকে দূরে থাকাটা জরুরি ছিল। কারণ ওরা তখন আমাদের দুজনকে একসাথে কাছে পাবার জন্য জেদ করতো, কান্না করতো। যেহেতু ঐ সময় ওদেরকে শরীয়তের বিধান বুঝিয়ে বললেও ওরা ঠিকমতো বুঝতে পারতো না। উল্টো ওদের মনে এমন চিন্তার উদ্রেক হবার সম্ভাবনা ছিল যে আল্লাহ নিষেধ করেছেন বলেই ওদের পাপা-মা একসাথে ওদের সাথে সময় কাটাতে পারছে না। তাই ওরা যাতে জেদ ধরারই সুযোগ না পায় সেজন্য তোমার বাড়িতে ঘন ঘন না আসাটাকেই বেটার মনেহয়েছিল আমার। আমি যখন বাইরে কোথাও যেতাম তখন তুমি আসতে এমন একটা নিয়ম করে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমাদের বাচ্চারা সব বোঝে। এবং তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, ওরা আমাদের চেয়েও খুশি মনে আমাদের নিয়তিতে মেনে নিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। এখন আর ওদের কারণে বাধ্য হয়ে আমাদের এমন কিছু করার প্রয়োজন পড়বে না যাতে আল্লাহ নারাজ হবার ভয় থাকবে। বরং এখন তো ওরা উল্টো আমাদেরকে আরো সাবধান করে দেয় যাতে কোন ভুল হয়ে না যায়। দু সপ্তাহ আগে যেদিন তুমি বাড়িতে এসেছিলে। বিকেলে বোনদের সাথে বাগানে বসে গল্প করছিলে। আমি যখন কটেজ থেকে বেড়োচ্ছিলাম জিশান ছুটে এসে বলেছিল, পাপা তুমি পেছনের গেট দিয়ে বাইরে যাও। আমি পিভি চাচ্চুকে বলছি তোমার গাড়ি যেন পেছনের গেটে দিয়ে আসে। কারণ জিজ্ঞেস করলে জিশান জবাব দিয়েছিল, বাগানে মা আর খালামণিরা বসে আছে। অনেক সময় তোমাকে কোন প্রয়োজনে ম্যাসেজ পাঠাতে গিয়ে আমাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে দেখে জিহাদ নিজ থেকেই ওদের নিজেদের নাম্বার অ্যাড করে গ্রুপ করে দিয়েছিল। তোমার মনেআছে গ্রুপ করার পর আমি প্রথম যেদিন তোমাকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম। তুমি জবাব দেবার আগেই নাবিহা হাজির হয়ে লিখেছিল, পাপা-মামণি তোমরা কোন চিন্তা করো না তোমাদের দুজনের মাঝে যাতে শয়তান না আসতে পারে সেজন্য আল্লাহ তোমাদের ছোট্ট ফেরেশতা নাবিহাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ। তোমরাও বলো আলহামদুলিল্লাহ।

হেসে ফেললো ফায়েজ আর হুমায়ূন দুজনই। নূহার মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। জাওয়াদও হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমি তো আমাদের সন্তানদের কাছ থেকেও প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু শিখছি। জানো ছোটবেলায় খেলাধূলার প্রতি বেশ ঝোঁক ছিল আমার। ভাইদের চেয়েও বেশি পছন্দ করতাম বাবার সাথে খেলতে। বাবা সবসময় আমাকে একজন প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখতেন। কখনোই ছোট ভেবে ইচ্ছে করে কোন খেলায় হেরে যেতেন না। বুঝতে শেখার পর কারণ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলে বাবা মুচকি হেসে বলেছিলেন, বার বার হারিয়ে আমি আসলে কিভাবে জিততে হয় সেই শিক্ষা দিচ্ছিলাম তোমাকে। প্রতিটা হার তোমার জেতার ইচ্ছেকে একটু করে বাড়িয়ে যেত। এভাবেই ধীরে ধীরে একদিন তুমি আমাকে হারিয়ে দিয়েছিলে। আর একজন পিতা হিসেবে সেদিনই আমি হয়েছিলাম সত্যিকার বিজয়ী। আমাদের সন্তানরা জীবনে আসার পর বাবার কথাটির মর্ম প্রকৃত অর্থে উপলব্ধি করেছিলাম। সন্তানের কাছে সকল কল্ল্যাণময় ক্ষেত্রে হেরে যেতে পারাটা যে কোন পিতার জন্য পরম সৌভাগ্য। আমি প্রায়ই জিহাদের ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার কাছে হেরে যাই। জিশানের উদারতা ও মানবিকতার কাছে হেরে যাই। জারিফের সবকিছুকে এত সহজ ভাবে মেনে নেয়া, ছাড় দেয়ার মানসিকতা আমাকে আরো ত্যাগী হবার স্পৃহা জাগায়। নাবিহার নৈতিক কঠোরতা এবং করণীয় ও বর্জনীয়র ব্যাপারে সুস্পষ্ট যুক্তি বার বার আমাকে মুগ্ধ করে। আর এই প্রতিটা হার আমার জীবনকে করে তুলছে আরো একটু করে ঐশ্বর্যময়। আলহামদুলিল্লাহ।

ফায়েজ, হুমায়ূন আর নূহাও আলহামদুলিল্লাহ বললো।

জাওয়াদ বলল, আমাদের তাই পথ হারিয়ে গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাবার ভয় নেই ইনশাআল্লাহ। আমাদের সন্তানরা আছে আমাদেরকে পথ প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু যেহেতু আমরা মানুষ সবসময় দৃঢ় থাকতে পারবো না এটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে আবেগের সুতীব্র স্রোত আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবেই। আর ওটাই তো আমাদের পরীক্ষা তাই না? সবকিছুই এত সহজ করে দিয়েছেনহ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের জন্য। সেখানে এইটুকু ধৈর্য্যশীলতার প্রমাণ দিতেও যদি আমরা ভয় পাই তাহলে পারিবারিক বন্ধনগুলোকে বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবো না আমরা। নূহা আমাদের সাথে যদি আমাদের পুরো পরিবার এবং মায়াময় অতীত জড়িয়ে না থাকতো তাহলে আসলে এতসব সমস্যার সৃষ্টিই হতো না। পৃথিবীতে রোজ অসংখ্য ডিভোর্স হয়। যাদের অনেকেই আমাদের মতো সন্তানের বাবা-মা। তাদেরকে কিন্তু আমাদের মতো এমন পরীক্ষা দিতে হয় না। কারণ তারা আমাদের মতো একই পরিবারের সদস্য নয়। আবার আমাদের পরিবারটি যদি অন্য আর দশটি স্বাভাবিক পরিবারের মতো তাহলেও এত জটিল হতো না সবকিছু। কিন্তু আমরা যে আনন্দবাড়ির সদস্য। আমাদের কাছে হাসি দুঃখকে জয় করা ছাড়া ভিন্ন কোন অপশন নেই। আমরা বিশ্বাস করি মাইনাসে মাইনাসে যেমন প্লাস হয়। তেমনই দুঃখের সাথে দুঃখ মিলেই সুখের জন্ম হয়। নিজের দুঃখের সাথে যখন আমরা অন্য কারো দুঃখকে মিলাই। এবং তার মুখে হাসি ফোটে। তখন আমাদের মনও সুখের সন্ধান পায়। তাছাড়া আনন্দকে সবাই উপভোগ করে কিন্তু উপভোগ কৃত সব আনন্দ কি ব্যক্তির নিজের হয়? অনেক সময় তো নিজের জীবন বেদনায় ডুবে থাকার পরেও অন্যের আনন্দে শরিক হই আমরা। তাদের সাথে কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে অকৃত্রিম হাসি। যখন আমরা অন্যের আনন্দে আনন্দিত হই সত্যিকার অর্থে, শত বেদনার মাঝেই সেটাই হয়তো একধরণের প্রকৃত আনন্দ। আর এগারো বছর আগে নিজেদের নিয়তিকে মেনে নিয়ে আমরা দুজন তো এই সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম, অন্যেকে সুখী করে সেই সুখের মাঝেই আমরা নিজেদের জন্য সুখ খুঁজে নেবো। তাই না?

নূহা বলল, জ্বি ভাইয়া। আমি প্রমিস করছি গতরাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর কখনোই ঘটবে না। এবং বিগত দিনগুলোকে আমার দ্বারা যা যা ঘাটতি হয়েছে আমি যতটুকু সম্ভব সংশোধন করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

জাওয়াদ বলল, ইনশাআল্লাহ। ঠিকআছে এখন তাহলে তুমি যেতে পারো।

নূহার সাথে সাথে ফায়েজও উঠে দাঁড়ালো। ফায়েজ আর নূহা চলে যাবার পর হুমায়ূন বলল, কঞ্জুস দেখেছি কিন্তু তোমার মতো দেখিনি। আমার বোনটাকে এক কাফ কফিও অফার করলে না তুমি।

জাওয়াদ বলল, জীবনে আরো অনেককিছুই তোমাকে নতুন করে দেখানোর ইচ্ছে আছে আমার ইনশাআল্লাহ। সুতরাং আফসোস না করে নিজেকে সেসবের জন্য প্রস্তুত করো।

হূমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, তুমি যে কি এক আজব মানুষ এত বছরেও কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে ভাইয়া দু’টা অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বহু বছর ধরে মনে চেপে ধরে বসে আছি। যদি সাহস দাও এবং থাপ্পড় দেবে না প্রমিস করো তাহলে আজ প্রশ্ন দুটা করেই ফেলতে চাই তোমাকে।

জাওয়াদ বলল, প্রশ্ন থাকলে করবে। থাপ্পড় দেবার মতো প্রশ্ন হলে আমিও থাপ্পড় দেবো। কিন্তু এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, প্রশ্ন প্রশ্নকর্তার জ্ঞানের ধারক ও বাহক। তোমার প্রশ্ন শুনেই তোমার ধ্যান-জ্ঞান ও মন-মানসিকতা সম্পর্কে আন্দাজ করা সম্ভব।

প্রশ্ন করা তো তাহলে সাংঘাতিক ব্যাপার।

অবশ্যই সাংঘাতিক ব্যাপার। এই তথ্য জানা নেই বলেই তো চারিদিকে এত অকারণ প্রশ্নের ছড়াছড়ি। তবে সবকিছুরই যেমন ভালো দিক আছে। অতি প্রশ্নের ভালো দিক হচ্ছে, আসল এবং নকল জ্ঞানীদের মুখোশ উন্মোচনে অতি কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। যাইহোক, পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হলো তোকে নিজ থেকে সাহস যোগার করে প্রশ্ন করার জন্য।

হুমায়ূন হেসে বলল, আচ্ছা আজ প্রশ্ন দুটা করেই ফেলি তোমাকে। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আমার কাছে ঠিক ক্লিয়ার না কেন তুমি নূহার প্রতি তোমার ভালো লাগার কারণ হিসেবে পর্দার বিধানকে হাকলা ভাবে দেখাটাকে দায়ী করেছিলে। কারণ আমাদের সব বোনেরাই নয় বছর বয়স থেকে ঘরে এবং বাইরে পর্দার বিধান মেনে চলেছে। এমনকি আমার সাথেও যখন নূহা কথা বলতে আসতো হিজাব করেই আসতো। আমার তো মনে পড়ে না সাত-আট বছর বয়স হয়ে যাবার পর নূহা কখনোই আমাদের কারো কোলে উঠার আবদার করেছে বা কখনো কোল ঘেঁষে এসে বসেছে। কিংবা যখন থেকে বাড়ীর ভেতরেও পর্দা করা শুরু করেছিল এরপর তো কখনোই তোমাকে নূহার সাথে বসে গল্প করতে দেখিনি ছোটবেলার মতো। তাহলে সমস্যাটা কোথায় হয়েছিল?

জাওয়াদ বলল, আমি ফিজিক্যাল পর্দার ঘাটতির কথা বলিনি। এটা সবসময়ই পারফেক্ট ছিল আমাদের মধ্যে আলহামদুলিল্লাহ। আমি মূলত মানসিক পর্দার ঘাটতির কথা বলেছি। আমি ফোনে নূহার সাথে প্রচুর কথা বলতাম। ছোটবেলায় নূহার অভ্যাসের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে তোর। প্রতিটা অক্ষর লিখেই দৌড়ে দেখাতে নিয়ে আসতো আমাকে। এরপর গিয়ে আবার পরের অক্ষর লিখতো। ছবি আঁকার সময়ও একই কাজ করতো। একটা ফুলে যদি পাঁচটি পাঁপড়ি দিতো। পাঁচ এসে আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যেতো। এই অভ্যাসটা খুব ভালো ভাবে ধরে রেখেছিল নূহা। ছোট্ট একটা কিছু ঘটলেই আমাকে ফোন করে সেটা বলতো। যখন থেকে কবিতা লেখা শুরু করলো তখনো যাই কিছু লিখতো সবার আগে আমাকে শোনাতো। কখনো যদি আমাকে ফোনে না পেতো মেইল করতো। একটা সময়ে ফোনের চেয়ে মেইলে কথা বলা বেড়ে গিয়েছিল আমাদের। পরিবার থেকে দূরে থেকেও আমি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সমস্ত খোঁজ খবর জানতাম। এর কারণ ছিল প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে নূহা সারাদিনে ঘটমান সবকিছু লিখে আমাকে মেইল করতো। আর আমিও সারাদিনের সমস্ত কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি ভুলে যেতাম নূহার মেইল পড়ে। স্পেশাল করে আমি কখনোই সেভাবে নোটিশ করিনি। কিন্তু নূহা অজান্তেই আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কোনদিন যদি বাসায় ফিরে দেখতাম নূহার মেইল আসেনি আমি এতটাই অস্থির হয়ে যেতাম যে সাথে সাথে দেশে ফোন করতাম। কিন্তু ঐ অস্থিরতার পেছনে আসল কারণ কি সেটা কখনো ভেবে দেখার কথা মনে হয়নি। নূহার যখন দশ বছরের মত বয়স তখন থেকে নিয়মিত ফোনে কথা বলতে শুরু করেছিলাম আমরা। ঐ সময় তো শিশুসুলভ কথাই বলতো। সারাদিন স্কুলে কি হয়েছে, মামণি বকা দিয়েছে, বোনেরা দুষ্টুমি করে ইত্যাদি ইত্যাদি। মূল চেঞ্জটা এসেছিল নূহার বারো বছরের দিকে। হঠাৎ করেই কেমন যেন ভারিত্ব আর গভীরত্ব চলে এসেছিল ওর চিন্তা-ভাবনাতে। ঐ সময় খুব একটা কথা হতো না আমাদের। কিন্তু মেইল করতো নূহা প্রতিদিনই। পরিবারের সবার কথা বলার সাথে সাথে নিজের মনের ভাবনাগুলোও শেয়ার করতো। একটা সময় আমি ভুলেই গিয়েছিলাম নূহা এত ছোট একটা মানুষ। আমিও নিজের চিন্তা, উপলব্ধিগুলো শেয়ার করতে শুরু করেছিলাম ওর সাথে। অন্যরকম একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমাদের মধ্যে। আমি যখন দেশে আসতাম এবং নূহার সাথে কখনো কখনো দেখা হয়ে যেত, কখনো বা চা-নাস্তা নিয়ে আসতো আমার জন্য। তখন কিন্তু ওর সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছে কাজ করতো না আমার মনে। কিন্তু তখনো ঘুমোতে যাবার আগে কিছুক্ষণ মেইলে কিংবা চ্যাটে কথা বলতাম আমরা দুজন। এক কথায় যদি বলতে হয় তাহলে বলবো, একে অন্যের মনোজগতে আমাদের অবাধ বিচরণ ছিল। জ্ঞানার্জনের তীব্র নেশা ছিল নূহার মনে। একই নেশায় আমিও আক্রান্ত ছিলাম। এই নেশাটাই আমাদেরকে একে অপরের খুব কাছে নিয়ে এসেছিল। দেশের বাইরের জীবন তো জানিসই কেমন। সারাদিন নানান কাজের ঝামেলার নিজের দিকে ফিরে তাকানোটাই হয়ে উঠতো না। কিন্তু নূহা প্রতিদিনই গুনে গুনে হিসাব নিতো আমি সারাদিন ঠিক মতো খেয়েছি কিনা। অনিয়ম করলে মা-পাপার কাছে বিচার দেয়ায় হুমকি দিতো। আরো নানান রকমের কথা বলতো। কত কথা বলতে পারতো সেটা তো নিশ্চয়ই মনে আছে তোর।

হুমায়ূন হেসে বলল, হুম, মনেআছে। তারমানে নূহার কথার জালে আটকা পরেছিলে তুমি?

জাওয়াদ হেসে বলল, আসলেই তাই। আমি ওর সাথে কথা বলাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার চেতন মনে নূহার অবস্থা বোনের মতো থাকলেও। অবচেতন মন ওকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল। তেমন স্বপ্ন যেমনটা একটি ছেলে একটি মেয়ের জন্য বোনে। মা-মামণি-আম্মি-ফুপি আর সুবহা ছাড়া আমি কোনদিনও খুব প্রয়োজন ছাড়া কোন মেয়ের সাথে কথা বলিনি। নিজের চিন্তা-ভাবনার আদান-প্রদান তো অনেক পরের ব্যাপার। নূহা একমাত্র মেয়ে যার সাথে মেইলের মাধ্যমে হলেও আমার ভাব বিনিময় হতো। আমি নূহার সাথে মেন্টালি ইনভলব হয়ে গিয়েছিলাম। অন্যথায় ফিজিক্যাল অ্যাটাকশনের কোন সুযোগই ছিল না। ইনফ্যাক্ট, বিয়ের পরও বেশ অনেকটা সময় আমি খুব অর্ড ফিল করতাম নূহাকে নিয়ে বাইরে বেরোতে। সারাক্ষণই মনেহত কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আমি কিভাবে বলবো, এই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটা আমার বৌ।

হুমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, তুমি তো দেখছি এখনো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছো।

জাওয়াদ হেসে বলল, আমি এখনো লজ্জা পাই সিরিয়াসলি।

আসলে ভাইয়া তোমাদের ভাগ্যে এভাবেই ছিল সবকিছু। নয়তো সব ব্যাপারে এত সতর্ক থাকার পরও এমন ভুল হতো না তোমার দ্বারা। কিন্তু পাঁচ মিনিট তো ওভার হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন তাহলে আরেকদিন করবো ইনশাআল্লাহ।

জাওয়াদ হেসে বলল, সেটাই ভালো। চল উঠি বাড়িতেও তো আবার বৈঠক আছে আদীর দুষ্টু ছোট কন্যার সাথে। বাড়ির ছোট কন্যাগুলো শান্তিতে থাকতে দিলো না আমাদেরকে একটু।

হেসে ফেললো হুমায়ূন। জাওয়াদও হাসলো। এরপর দুজনই উঠে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।           

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন