রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...১২




ড্রাইভ করার ফাঁকে বার বারই নূহার দিকে তাকিয়ে দেখছিল রাহাত। কিন্তু সেদিকে কোন খেয়ালই ছিল না নূহার। সীটে হেলান দিয়ে বসে চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে ছিল। মন ভালো থাকলে প্রচুর কথা বলে নূহা পথে। নূহা পাশে থাকলে তাই অনেক লম্বা সফরও কেমন যেন মূহুর্তেই কেটে যায়। কিন্তু আজ নূহা নিশ্চুপ থাকার কারণে মাত্র আধঘন্টাতেই রাহাতের মনেহচ্ছিলো কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে। ভেবে পাচ্ছিলো না হঠাৎ কি এমন হয়েছিল যে নূহা অস্থির হয়ে উঠলো বাসার ফিরে যাবার জন্য? জাওয়াদ ভাইয়াও তো বাড়িতে ছিলেন না। তাহলে? বিকেলে যখন দেখেছিল খুবই আনন্দিত মনে হয়েছিল নূহাকে। সাধারণত বাবার বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে এমনটা খুব একটা দেখা যায় না। নূহাকে সবার সাথে হাসি মজা করতে দেখে রাহাতেরও খুব ভালো লেগেছিল। যখন জেনেছিল নূহা আজ বাবার বাড়িতে থাকবে খুব বেশি অবাক হবার সাথে সাথে আনন্দিতও হয়েছিল। রাহাতও মনে প্রাণে চায় নূহা ওর পরিবারের সবার সাথে আগের মতোই সহজ, স্বাভাবিক ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক। শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোকে অসম্ভব পছন্দ করে সে। যখনই শ্বশুরবাড়িতে আসে মনেহয় হঠাৎ করে যেন অন্য কোন জগতে ঢুকে পড়েছে। যে জগতের বাসিন্দারা সবাই সারাক্ষণই জ্ঞানানন্দে ডানা মেলে দিয়ে উড়ে বেড়ায়। খুব ছোটবেলাতেই নিজের বাবা-মাকে হারিয়েছে তাই আকুল হয়ে থাকে ভেতরে ভেতরে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সহ এই বাড়ির ফাদারস এন্ড মাদারস গ্রুপের সদস্যদের সাথে সময় কাটানোর জন্য। ভাইয়ারা সবাইও অসাধারণ একেকজন মানুষ। ভীষণ পছন্দ করে রাহাত সবাইকে। কেননা শ্বশুরবাড়ির প্রতিটা সদস্যের কাছ থেকে যে আদর, ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছে নিজ পরিবারের মানুষগুলো থেকে তেমন করে পায়নি কখনোই।    

আবারো নূহার দিকে তাকালো রাহাত। আগের মতোই বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তবে এখন চোখ বন্ধ। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো রাহাত। নূহার মুড ভালো তো এক মূহুর্তেই রোদেলা ক্ষণ, রিমিঝিমি শ্রাবণ, জোছনার আলো সব রূপ নিয়ে একসাথে হাজির হয় মনের মাঝে। আর নূহার মুড অফ মানে তার দুনিয়া ঘোর কালো আঁধারে ঢাকা পড়ে যাওয়া। এই মূহুর্তে ঠিক তেমনটাই অনুভব করছিল রাহাত। নিকষ কালো আঁধারে ঢেকে গিয়েছে তার পৃথিবী। ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়ি পার্ক করলো রাহাত। এতটাই আত্মমগ্ন ছিল নূহা টেরই পেলো না গাড়ি যে চলছে না। আরো কিছুটা ক্ষণ পেরোবার পর নূহার হাতের উপর হাত রাখলো রাহাত।

স্পর্শ পেয়ে রাহাতের দিকে তাকিয়ে নূহা প্রশ্ন করলো, পৌঁছে গিয়েছি আমরা?

রাহাত হেসে বলল, উহু বাসায় পৌঁছেতে এখনো ঘন্টা খানেক লাগবে।  

তাহলে এখানে গাড়ি থামিয়েছো কেন? কোন কাজ আছে তোমার?

হুম, কাজ আছে। ঐ যে সামনে একটা আইসক্রিম পার্লার দেখতে পাচ্ছো। ওখানের আইসক্রিম আমার বৌয়ের ভীষণ পছন্দ। আমার বৌ তো কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। চলো তোমাকেই আজ আইসক্রিম খাওয়াবো।

নূহা হাসলেও ক্লান্ত কন্ঠে বলল, এখন আমার একদম ইচ্ছে করছে না আইসক্রিম খেতে। অনেক বেশি টায়ার্ড ফিল করছি। বাসায় পৌঁছে ঘুম দেবো। অন্য কোন দিন আইসক্রিম দুজন মিলে প্রমিস। কিন্তু আজ না প্লিজ। 

কিন্তু আমার যে খুব বেশি ইচ্ছে করছে তোমার সাথে বসে আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করতে। মুগ্ধ মনে তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে। কথার ফাঁকে তোমার বোনা ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি ছন্দের পরশে সময়টাকে কাব্যেময় করে তুলতে ইচ্ছে করছে। চলো না নূহা কিছুক্ষণের জন্য আজ দূরে কোথাও চলে যাই চলো। তোমার মনেআছে জারিফ যখন আরো ছোট ছিল। প্রায়ই ওকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়েই আমরা দুজন ঘুরতে বেড়িয়ে যেতাম। পাঁচ ঘন্টা ঘুরে বেড়াতাম মনের আনন্দে। বেশির ভাগ সময়ই আশেপাশের কোন গ্রামে চলে যেতাম। হাতে হাত রেখে হাঁটতেই থাকতাম যে পর্যন্ত না তোমার পায়ে ব্যথা শুরু হয়ে যেত। গ্রামের কোন খোলা রেস্টুরেন্টে বসে নাস্তা করতাম। ফেরার পথে তোমার পছন্দীয় তাজা শাকসবজি নিয়ে আসতাম। কিন্তু তুমি হসপিটালে জয়েন করার পর থেকে তোমার ব্যস্ততা, আমার ব্যস্ততা সবকিছু মিলিয়ে বাচ্চাদের সবাইকে নিয়ে মাঝে মধ্যে ঘুরতে বের হলেও, শুধু দুজন মিলে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আজ খুব ইচ্ছে করছে পুরনো সেই দিনগুলোকে আরেকবার উপভোগ করতে। দেখো এমন সুযোগ কিন্তু আজকাল আমাদের জীবনে আসেই না ধরতে গেলে। আমাদেরকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সারাক্ষণ একাই কটর কটর করতে থাকা তোমার ছোট পুত্রও এখন নেই সাথে। উনি সাথে থাকলে তো কথা বলারই সুযোগ পাই না আমি। বডিগার্ডের মতো আগলে রাখে তোমাকে। নিজেকে তখন তোমাদের মা-ছেলের ড্রাইভার ছাড়া আর কিছুই মনেহয় না আমার।  

হেসে ফেললো নূহা। জারিফ কিছুতেই ভাইবোনদেরকে ছেড়ে আসতে রাজী না হওয়াতে ওকে রেখেই চলে এসেছে দুজন। সত্যি জারিফ এত বেশি কথা বলে বাইরে বের হলে যে রাহাতের সাথে আলাদা ভাবে কথা বলার সুযোগই পায়না। জারিফের কথা শুনতে শুনতেই সময় কেটে যায়। একই কান্ড বাসার ভেতরেও করে জারিফ। একমাত্র ঘুমে থাকা সময় ছাড়া এক মূহুর্তের জন্যও নড়ে না বাবা-মার কাছ থেকে। এই কথা সেই কথা বলতেই থাকে, বলতেই থাকে। দশ বছরের একটা বাচ্চা এত কথা কিভাবে বলে ভেবে পায় না মাঝে মাঝে নূহা আর রাহাত।

চলো না নূহা প্লিজ। আবারো অনুরোধের সুরে বললো রাহাত। মনের ভেতরটা খুব বেশি বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল নূহার। নিজের সাথে অনেক লম্বা একটা বৈঠকের খুব প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। গত কয়েকমাসে অনেক কিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলো খুব বেশি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠেছে। যা আজকাল প্রায়ই খুব দুর্বল করে দিচ্ছে তাকে, ভুল পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, বিভ্রান্ত করছে, নিজেকে দোদুল্যমান দেখতে পাচ্ছে। নিজের সাথে শক্ত একটা বোঝাপড়া ছাড়া এসব কিছু ঠিক করা যাবে না। এখন তাই কিছুটা সময় একা থাকবে ভেবেছিল। কিন্তু তার মুখ থেকে হ্যা শোনার প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকা রাহাতকে না বলাও সম্ভব নয়। কারণ জানে না বললে  চুপচাপ মেনে নেবে রাহাত। কিন্তু নীরবে যে আশাহতও হবে, কষ্ট পাবে সেটাও জানে। তাই হাসি মুখে বলল, আচ্ছা ঠিকআছে আইসক্রিম খাবো তোমার সাথে। কিন্তু ভেতরে যেতে পারবো না। তুমি গিয়ে আইসক্রিম নিয়ে এসো। এরপর চলো সামনের ঐ পার্কে গিয়ে বসি দুজন।    

সাথে সাথে বিশাল হাসি ফুটে উঠলো রাহাতের মুখে। জো হুকুম ম্যাম বলে আইসক্রিম আনার জন্য বেড়িয়ে গেলো। নূহাও গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো। টুরিস্ট স্পট তাই এই জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। তারউপর মেঘ মুক্ত চাঁদ-তারা খচিত সুবিশাল আকাশের শামিয়ানা। একটা সময় ছিল যখন চাঁদের দিকে তাকিয়েই চাঁদের বয়স বলে দিতে পারতো নূহা। চাঁদ-তারা-আকাশ-বাতাস-ফুল-পাখী এসবের সাথে ভেসে বেড়াতেও জাওয়াদকে দেখেই আয়ত্ত্ব করেছিল। জাওয়াদের কথা মনে আসার সাথে সাথেই সতর্ক হয়ে উঠলো। মনটাকে এখন কিছুতেই ইচ্ছে ঘুড়ি হতে দেয়া চলবে না। তারচেয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বয়স বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিল না। মন যেন আজ পণ করেছে কোথাও এক মূহুর্ত স্থির হয়ে না বসার। চারিদিকে হাতড়ে বেরাতে লাগলো নূহা কিছু একটাকে আঁকড়ে ধরে পতনের হাত থেকে নিজেকে ঠেকানোর লক্ষ্যে। সমস্যার মাঝেই লুকায়িত সমাধান কথাটার সত্যতা প্রমাণের জন্যই বোধহয় জাওয়াদের বলা একগুচ্ছ শব্দ অঙ্কিত হলো মনের ক্যানভাসে। “প্রবৃত্তির কুমন্ত্রণাকে হারাতে চাইলে উঠে বোসো শরীয়তের রথে, চোরাবালির ফাঁদ ডিঙিয়ে অবিচল লড়ার শক্তি পাবে প্রতিকূলতার সাথে। সম্মুখের সকল আঁধার পেড়িয়ে ছুটতে চাইলে আলোর পথে, তাকদীরের ভাল-মন্দের বিশ্বাসকে বেঁধে নিও অন্তরের সাথে।”

দু’হাতে আইসক্রিম আর মুখে বিশাল হাসি নিয়ে রাহাতকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে নূহার মুখেও ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে নিজেকেই বলল, রাখে যারা আল্লাহর তরে অবিচল বিশ্বাস দিবানিশি, শত প্রতিকূলতার মাঝেও তাদের মুছে যায় না মুখের হাসি। যখনই মন হয় দোদুল্যমান আঁকড়ে ধরে তাকদীরে বিশ্বাস, অন্যের খুশিতে খুঁজে নিলে সুখ দূর হয়ে যায় অকারণ দুঃখবিলাস।  

নূহার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রাহাত হেসে বলল, দেখেছো আইসক্রিমের যাদু? দেখার সাথে সাথে তোমার চেহারায় সত্যিকার হাসি ফুটে উঠেছে।

নূহা কপট রাগের ভাণ করে বলল, সত্যিকার হাসি ফুটে উঠেছে মানে কি? আমি আবার কবে তোমার সাথে মিথ্যা মিথ্যা হাসলাম?

রাহাত নূহার আরেকটু কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আবেগঘন কন্ঠে বলল, তুমি যখন এমন সুরে কথা বলো নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনেহয় আমার।

এই মূহুর্তেও কি নিজেকে তোমার পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনেহচ্ছে?

হুম, হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ।

তাহলে প্লিজ এই মূহুর্তেই তোমার গায়ের শার্টটা খুলে আমাকে গিফট করো। আমার কাছে আসা দুঃখী মানুষগুলোকে তোমার শার্টের মধ্যে একবার করে ঢুকিয়ে ওদের দুঃখবিলাসিতা কিছুটা কমানো যায় কিনা ট্রাই করে দেখা যাবে।

রাহাত হেসে ফেললে নূহাও সাথে যোগ দিলো হাসিতে। এরপর রাহাতের হাত থেকে আইসক্রিম নিয়ে বলল, চলো যাই।

কোথায়?

তোমার না লং ড্রাইভে যেতে ইচ্ছে করছে? ‘চলো হারিয়ে যাই দূর কোন অজানায়, ভালোবাসার নিবিড় আলিঙ্গনে শুধু মোরা দুজনায়। প্রকৃতি মেখেছে আজি সুন্দরতার বাহারি আবির, জোছনার উষ্ণতায় মনেতে জেগেছে ভাবনা গভীর। ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলছে মনের স্বপ্নিল বাতায়ন, জীবনকে সাজাতে চারপাশে ছড়ানো কত্তো আয়োজন’। তাই চলুন দুজনে মিলে সেই আয়োজনে সাড়া দিয়ে আসি কিছুক্ষণ।  

রাহাত হেসে বলল, জ্বি চলুন।  

@

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অনেক অভিমান হলো নাবিহার। আরো আধঘন্টা আগে পাপার আসার কথা ছিল কিন্তু এখনো আসেনি। রুমের এমাথা ওমাথা পায়চারী করতে করতে দুই ভাইকে লক্ষ্যে করে বলল, হুম্ফ! সারাক্ষণ শুধু কাজ আর কাজ। আজ পাপা এলে খুব করে ঝগড়া করতে হবে। বুঝেছো তোমরা দুজন? পেয়েছি কি পাপা? শুনি পেয়েছি কি? আমরা কিছু বলি না তাই বলে কি যা ইচ্ছে তাই করবে? বেশি বেশি আহ্লাদ দেয়া হয়ে গিয়েছে পাপাকে! ব্যাস আর না! আজ একটা বিহিত করতেই হবে। আজ এসে যত কথাই বলুক আমি পটছি না! তোমরা দুইজনও পটবে না আগেই সাবধান করে দিচ্ছি। এসেই দেখবে মিষ্টি মিষ্টি দুষ্টু কথা বলা শুরু করবে পাপা আমাদের সাথে। আমার শুভ্র মেঘকন্যাটার মনে আজ কালো কালো অভিমানের মেঘ কেন? আমার ক্ষুদ্রে বিজ্ঞানী জিশানের কি আজ কোন গবেষণাই ঠিকমতো হয়নি? আমার বীর সেনা জিহাদ সোনা বাচ্চাটাকে এমন নিস্তেজ লাগছে কেন? আমার লিটল লিটল কালারফুল বাটারফ্লাইস এমন স্যাড স্যাড কেন?

জিশান হাসতে হাসতে বলল, উফফ, কত্তো কথা যে জানে পাপা! নাবিহা তুমি দেখে নিও কথা দিয়ে রোজকার মতো আজও আমাদেরকে পটিয়ে ফেলবে পাপা।

কিন্তু আজ আমরা কিছুতেই পটবো না পাপার কথাতে। মামণি বলেছিল আজ আমাদের সাথে থাকবে। কিন্তু হুট করে চলে গেলো। যাবার সময় ঠিকমতো আদরও করে যায়নি আমাদেরকে। আজ আমাদের অনেক বেশি মনখারাপ। পাপাকে আমাদের মন খারাপের কথা জানানোর পরও কিভাবে পাপা আমাদের কাছে ছুটে না এসে পারলো? তোমাদের দুজনের কথা জানি না। কিন্তু আজ আমি কিছুতেই পটছি না। আজ ঝগড়া হবেই হবে। আজ পাপাকে নো ছাড়াছাড়ি! আজ পাপার নো মাফ!

জিহাদ বলল, নাবিহা পাপা হয়তো কোন কাজে আঁটকে গিয়েছেন। নয়তো ঠিক এতক্ষণে চলে আসতেন।

জিশান বলল, হ্যা নাবিহা রাগ করো না পাপার উপর। এসো আমাদের কাছে এসে বোস।

দুই ভাইয়ের দিকে বড় বড় চোখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দুপধাপ পা ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো নাবিহা। এখন যতই রাগ করুক পাপা এলে যে মূহুর্তেই সব অভিমান ভুলে যাবে সেটা নাবিহা নিজেও জানে। কেন জানি রাগ করে থাকতেই পারে না পাপার উপর! আসলে তাদের পাপা এত্তো বেশি সুইট যে রাগ করে থাকা সম্ভবও নয়। আচ্ছা সবার পাপাই কি এত্তো বেশি বেশি সুইট হয়? নাকি শুধু তাদের পাপাই এত্তো বেশি সুইট? সব পাপারাই কি তাদের মেয়েকে এত সুন্দর সুন্দর নামে ডাকে? সল্টি বেবী, টুনটুনি, গুলগুলি, গুন্ডি আম্মা, উপগ্রহ! পাপার ডাকা নামগুলো মনে পড়তেই হাসি ফুটে উঠলো নাবিহার মুখে। বিশেষ করে উপগ্রহ মনে পড়ে। তবে এই উপগ্রহ মানে যন্ত্রণা নয়। উপগ্রহ মানে হচ্ছে চাঁদ! কিন্তু এই নামটা যেদিন পাপা তাকে দিয়েছিল সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। রাতে ঘুমোবার সময় তিন ভাইবোন মিলে পাপার কোলে শোয়ায় জন্য ঝগড়া করতো! তাই পাপা তাদেরকে রুটিন করে দিয়েছিল কে কবে পাপার সাথে ঘুমোবে! যে যেদিন ঘুমোতে সেদিন পাপা তাকে অনেক মজার মজার গল্প শোনাতো। এমন একদিন নাবিহা বলেছিল, পাপা আজ আমি কুরআনের গল্প, হাদীসের গল্প, ইতিহাসের যোদ্ধাদের গল্প শুনবো না! রূপকথার গল্প, বেতালের গল্প, ঈশপের গল্পও শুনবো না। মহাকাশে ঘুরবো না, পরীর রাজ্যে উড়বো না, পাতালের দেশেও নামবো না।

জাওয়াদ হেসে বলেছিল, তাহলে আজ কিসের গল্প শুনবে আমার গোলু গোলু বেবিটা?

সত্যিকার রাজপুত্রের গল্প।

মাতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য। আচ্ছা শোনো তাহলে। এক ছিল রাজপুত্র।

রাজপুত্রের ঘোড়া ছিল পাপা?

উহু, এই যুগের রাজপুত্র তো তাই তার ঘোড়া ছিল না। তবে গাড়ি ছিল।

রাজপুত্র কি শিকারে যেতো পাপা?

না রাজপুত্রের কাজ ছিল শুধু দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানো।

দেশ বিদেশ ঘুরে ঘুরে কি করতো রাজপুত্র?

অনেক কিছু করতো। কাজ করতো, পড়াশোনা করতো। তবে স্পেশ্যাল যা করতো তা হচ্ছে রাজপুত্র তার স্বপ্নসখীকে খুঁজে বেড়াতো।

রাজপুত্র কি খুঁজে পেয়েছিলো তার স্বপ্নসখীকে?

সেটাই তো! কত দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ালো রাজপুত্র কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না তার স্বপ্নসখীকে। খুঁজতে খুজতে ক্লান্ত হয়ে একসময় রাজপুত্র যখন আশা ছেড়েই দিচ্ছিলো ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়ালো তার স্বপ্নসখী।

কিন্তু পাপা রাজপুত্র বুঝলো কি করে যে এটাই তাঁর স্বপ্নসখী?

বুঝতে পেরেছিলো কারণ সে ছিলো এক মায়াবী কন্যা। যার মুখাবয়ে ছিল শিশুর সরলতা, চাহনীতে ছিল বুদ্ধিদীপ্ততা, ব্যবহারে ছিল কোমলতা, পোশাকে ছিল শালীনতা আর কথায় ছিল পবিত্রতা।

তারপর কি হলো পাপা?

রাজপুত্র রাজা-রাণীকে বললো সে তার স্বপ্নসখী রাজকন্যাকে খুঁজে পেয়েছে। রাজা-রাণী তখন ছুটে গেলো পাশের রাজ্যের রাজা-রাণীর কাছে। তারপর দুই রাজ্যের আকাশে যে খন্ড খন্ড রঙেরা ভেসে বেড়াচ্ছিল তা একসাথে মিলে মিশে বিশাল এক রঙধনু হয়ে গেলো। সেই রাজপুত্র ও রাজকন্যার মনের আকাশে অবিরাম ঝরতো রঙের বরষা। সেই বরষায় স্নাত হয়ে উদিত হলো নতুন চারটি নক্ষত্রের। তারমধ্যে তিনটি ছিল গ্রহ আর একটি ছিল উপগ্রহ।        

নাবিহা তখন হেসে বলেছিল, তুমি দুষ্টু ছেলে।

জাওয়াদও হাসতে হাসতে বলেছিল, থ্যাংকস ফর দ্য কমপ্লিমেন্টস।

কিন্তু আমি উপগ্রহ কেন?

জাওয়াদ তখন নাবিহাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল, কারণ চাঁদ নামক উপগ্রহটি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌন্দর্যজনক জিনিসের একটি। চাঁদ যেমন পৃথিবীর উপগ্রহ, তুমি তেমন আমাদের জীবনের উপগ্রহ। চাঁদের মিষ্টি আলো পৃথিবীর শোভা বর্ধন করে আর তোমার মিষ্টি মিষ্টি কথা আমাদের ভুবনে ছড়ায় রাশি রাশি মিষ্টতা।

উপগ্রহ উপাধী অর্জনের কথা ভাবতে ভাবতে খুশিতে ভরে উঠেছিল নাবিহার মন। কিন্তু এখন আর আগের মতো পাপার গলা জড়িয়ে ধরে কোলের মধ্যে ঘুমোতে পারে না ভেবে পর মহুর্তেই আবার প্রচন্ড কান্না পেতে লাগলো। ধূর, কেন যে সে বড় হতে গেলো! ছোটবেলায় কত্তো মজা ছিল। সারাক্ষণ পাপার কোলে উঠে বসে থাকতে পারতো। ইশশ, আবার যদি ছোট হয়ে যাওয়া যেত! এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির মেইন গেটে দৃষ্টি যাওয়া মাত্রই নিজেকে সামলে নিলো নাবিহা। তাড়াতাড়ি ছুট লাগালো রুমের দিকে। পাপা রুমে ঢোকার আগেই দুই ভাইকে আরেকবার সাবধান করে দিতে হবে কিছুতেই যেন আজ পটে না যায় পাপার দুষ্টু মিষ্টি কথাতে।     

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন