রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...৫




সামনে বসে থাকা পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উপর বেশ কয়েকবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনেছেন আজাদ সাহেব। পর্দার অন্য পাশে থাকার কারণে মেয়েদের কাউকে যদিও দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু তাতে আজাদ সাহেবের মনে ভালো লাগার মাত্রা মোটেই কমে যায়নি। যদিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যেই পরিবারের সবাই একসাথে হয়েছে। কিন্তু বেশ অনেক বছর পর পারিবারিক বৈঠকে একসাথে ফায়েজ, জাওয়াদ, আদী, রিসাব, হুমায়ূন, সুবহা আর নূহার উপস্থিতি সমস্যা, জটিলতা সবকিছু ছাপিয়ে আনন্দই বেশি কাজ করছিল আজাদ সাহেবের মনে। পুত্র-কন্যাদের এই রঙধনু গ্রুপের সাথে শেষ পারিবারিক বৈঠক করেছিলেন চৌদ্দ বছর আগে। জাওয়াদের মেডিকেল ট্যুরে যাবার আগের দিন সন্ধ্যায়। এরপর তাদের জীবনে ওঠা ঝড়ে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। জাওয়াদের ফিরে আসার পরেও পরিবারের আগের সেই নিয়মনীতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। অন্তত মাসে একবার পরিবারের সবাই মিলে বসার গুরুত্বের কথা চিন্তা করে সবাই পারিবারিক বৈঠকটা অন্তত আবার শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু নূহার আপত্তির কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। জাওয়াদ চলে যাবার পর এক পারিবারিক বৈঠকে বসেই পরিবারের সবাই মিলে নূহাকে একরকম বাধ্য করেছিল রাহাতের সাথে বিয়েতে রাজী হতে। অনেকটা ঘোরের বশেই নূহা সম্মতি দিয়ে দিয়েছিল বিয়ের। এত বড় সুযোগটা কেউ হাত ছাড়া করতে চাননি তাই ঐ সময়ই ঘোরায়া ভাবে রাহাত আর নূহার বিয়ে আয়োজন করেছিল। এরপর থেকে পারিবারিক বৈঠকের নাম শুনলেই ক্ষেপে যায় নূহা।

কিন্তু আজ নূহা যখন নিজ থেকে বললো সবাই মিলে পারিবারিক বৈঠকে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নায়লার ব্যাপারে। শোনা মাত্র এক মূহুর্তও দেরি না করে ছেলেদের সবাইকে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে বাড়িতে চলে আসতে অনুরোধ করেছিলেন আজাদ সাহেব। ফায়েজ আর রিসাব বাড়িতেই ছিল। ফোন করার ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই জাওয়াদ, আদী, রিসাব, সুবহাও পৌছে গিয়েছিল। সবাই এসে পৌঁছানোর পর আরো একবার নায়লার কথাগুলো সবাইকে খুলে বললো নূহা। শোনার পর সবাই চুপ করে রইলো। ছেলেমেয়েদের চিন্তা-ভাবনা কোন ধারায় প্রবাহিত হয় সেই সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা আছে আজাদ সাহেবের। তাই জানেন তার মতো ছেলেমেয়েরা সবাইও ভাবছে, মানুষের ভালো এবং মন্দ উভয় প্রকার কাজই তার নিজের সাথে সাথে আশেপাশের মানুষদেরকেও প্রভাবিত করে। সেজন্যই একজন উত্তম মানুষের প্রভাবে তার পরিবারের মর্যাদা যেমন অনেক উচ্চে উঠে যেতে পারে, ঠিক তেমনি কারো নেতিবাচকতার প্রভাবে তার পরিবার সমাজের চোখে হয়ে উঠতে পারে নিন্দনীয়। কেউ যতই মনে করুক না কেন তার জীবন শুধুই তার। কিন্তু কারো কর্মকান্ড শুধু তাকে ঘিরেই আবর্তিত হওয়াটা আসলে খুব কম সময়ই সম্ভব হয়। মানুষের কর্ম হয় সুগন্ধ ছড়ায়, নয়তো দুর্গন্ধ। কর্ম তাই যাই ছড়াক আশেপাশে ছড়িয়ে যাওয়াটাকে ব্যহত করা সম্ভব হয় না। পরিবারিক সম্পর্ক গুলোর ক্ষেত্রে তাই স্বার্থপর হবার কোন উপায় নেই। নিজের সমস্যা,  ব্যথা, অপরগতাকে বড় করে দেখার কোন সুযোগ নেই। কেউ যখনই এমনটা করে। পুরো  পরিবারকেই এর প্রতিফল ভোগ করতে হয়।

প্রচন্ড রকম অপরাধবোধ চেপে বসেছিল নূহার মনে এসব ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়ে। বিবেকের কাঠগড়ায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে ধূলো ধূসারিত মনে হচ্ছিলো। বিবেক একেক পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিলো, কেন নিজের কষ্টটা তোমার কাছে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল যে, পরিবারের অন্য সবার ভালো-মন্দ চিন্তা করার ব্যাপারে তুমি বোধহীন হয়ে পড়েছিলে? কেন তুমি পরিবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলে একথা খুব ভালো মতো জানা থাকার পরেও যে, তোমার সাথে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে তাতে পরিবারের কারোরই কোন হাত ছিল না? নিয়তির যে ঝড় উঠেছিল তাতে পরিবারের প্রতিটি সদস্য কম-বেশি আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল। তাহলে তুমি কেন শুধু নিজের ক্ষতের দিকেই দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে রেখেছিলে? এমন অসংখ্য কেন’র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল নূহার। পর মূহুর্তেই আবার মনেহলো সে নিজেই তো সবাইকে বলে, ভুলের উপলব্ধির পরের ধাপ কখনোই অনুশোচনায় ডুবে যাওয়া নয়। পরের ধাপ হচ্ছে প্রায়শ্চিত্ত। অর্থাৎ, ভুলটাকে শুধরানোর চেষ্টা করা।

আরো কিছুক্ষণ সবার সাথে নীরবতায় শরিক হবার পর নূহা বলল, আমরা সবাই এমন চুপ করে বসে থাকলে তো সমাধান হয়ে যাবে না নিশ্চয়ই? কি করা যায় নায়লার ব্যাপারে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত মনেহয় আমাদের।

শরিফা খানম বললেন, সমাধান একটাই নায়লাকে বিয়ে দেয়া। রিফাত, মুহিব, আরশ আছে। ওদের যে কোন একজনের সাথে নায়লাকে বিয়ে দিয়ে দেয়াটাই সমাধান। 

বোনের বলা পাত্রদের লিষ্টে নিজের ছেলের নামও শুনতে পেয়ে একটু নড়েচড়ে বসলেন আফজাল সাহেব। আদীর কনুইয়ের মৃদু খোঁচা টের পেয়ে হাসি চাপলো জাওয়াদ। আফজাল সাহেবের নাড়াচাড়া সে নিজেও লক্ষ্য করেছে। কিন্তু এখন মোটেই বাপীর সাথে দুষ্টুমির সময় নয়। তাই কন্ঠস্বরে হেড অব দ্য ফ্যামেলির গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে বলল, বাপী মনেহয় কিছু বলতে চাইছো?

আফজাল সাহেব বললেন, হ্যা বলতে চাইছি। শরিফা যেটা বলছে এটা তো আসলে সমস্যার কোন সমাধান হলো না। বাড়িতে তো নায়লাই একমাত্র মেয়ে না। আত্মজা আছে, জুম্মি আছে, জুয়াইরিয়া আছে। এতো গেলো শুধু বাড়ির মেয়েরা। এরপর আমাদের নাতনীদের লম্বা লিষ্ট তো আছেই। সমস্যার সমাধান এমন হওয়া উচিত যাতে বাকি যারা আছে তারা সজাগ ও সচেতন হয়ে যায় এই ব্যাপারে। তাছাড়া নায়লায় মনে একটা নেতিবাচক ছায়া তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় কারো সাথে জোড় করে বিয়ে দেয়াটা নতুন আরেকটা ভুলের দরজা উন্মুক্ত করা। মুহিব, রিফাত কিংবা আরশ তিনজনের কেউই আমাদের উপরে কথা বলবে না। তাই চুপচাপ হয়তো বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাবে। কিন্তু মন থেকে যদি সুন্তুষ্ট না থাকে তাহলে?

জাওয়াদ বলল, বাপীর সাথে আমি সম্পূর্ণ রূপে একমত। এটা ঠিক যে আমাদের কাছে নায়লার সমস্যাটার সহজ সমাধান ওকে বিয়ে দেয়া। কিন্তু যেভাবে ফুপি বলছেন সেভাবে বিয়ে দিলে আমাদের সমস্যার সমাধান হলেও নায়লা এবং যার সাথে ওকে বিয়ে দেয়া হবে ওদের জীবনে বিয়েটাই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যার দায় পরবর্তীতে আবার আমাদেরকেই বহন করতে হবে। আমার কাছে এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে বাপী যেটা বললেন। নায়লা ছাড়াও আমাদের পরিবারে আরো অনেক মেয়ে আছে। আমাদেরকে তাই এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেটা বাকিদের জন্যও গাইড লাইন হিসেবে কাজ করবে।

শরিফা খানম বললেন, সেই সমাধানটা কি হবে? ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দেবার চিন্তা করছো নাতো আবার? এটা কিন্তু ভয়াবহ এক গাইড লাইন হবে আমি আগেই বলে রাখছি। পরের জেনারেশন ধরেই নেবে যাকে পছন্দ করবে তার সাথেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে। তখন ইউরোপিয়ান কাউকে ধরে নিয়ে এসে সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেও দ্বিধা করবে না।

ফুপি অনেক রেগে আছেন সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিল জাওয়াদ। ঝামেলা এড়িয়ে চলা স্বভাবের মানুষদের জীবনে হঠাৎ কোন ঝামেলা এসে উপস্থিত হলে, তারা অস্থির হয়ে যায় কিভাবে  যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে মুক্ত করা যায় সেই ঝামেলা থেকে। এরফলে বেশির ভাগ সময়ই অন্যদের জীবনকে তারা ঝামেলা পূর্ণ করে তোলেন। ফুপিও ঠিক এই কাজটিই করতে চাইছেন। নিজেকে ঝামেলা মুক্ত করতে যেয়ে যে মেয়ের জীবনে জটিলতাকে স্বাগত জানাচ্ছেন সেটা বুঝতে পারছেন না। এখন বোঝাতে গেলেও খুব একটা লাভ নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের বুঝকে আঁকড়ে ধরে থাকার কারণেই মানুষ অন্যেকে বুঝতে পারে না কিংবা অন্যেরা যে তাকে বোঝাবে সেই সুযোগও দেয় না। ফুপিও এখন এমনই এক অবস্থায় অবস্থান করছে। তাই ফুপির সাথে তর্ক বিতর্ক করে অনর্থক সময় নষ্ট না করাটাই উত্তম মনেহলো জাওয়াদের। ফুপিকে কিছু না বলে তাই নূহাকে উদ্দেশ্যে করে বলল, তোমার সাথে কথা বলার সময় নায়লার আচরণ কেমন ছিল নূহা? ওর চিন্তা-ভাবনা কোন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে সেটাও তোমার বুঝতে পারার কথা। সবকিছু মিলিয়ে কি মনে হয়েছে তোমার?

নূহা বলল, কথা বলার সময় আমি খুব পজেটিভ এবং সাপোর্টিভ থাকার চেষ্টা করেছি নায়লার সাথে। তাই ওর আচরণ, চিন্তা-ভাবনাও পজেটিভ ছিল। আইমিন, মানুষকে যখন সরাসরি তার ভুল ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয় কিংবা তার কাজের সমালোচনা করা হয়। বেশির ভাগ সময়ই মানুষ নিজের ভুলের সাপোর্টে যুক্তি পেশ করার চেষ্টা করে। আবার কখনো কখনো কেউ কেউ সমালোচনায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ভুলটাকেই সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তার দ্বারা ভুল হয়েছে সেটা মানতেই অস্বীকার করে। তাই নিজ অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনেহয়েছে, কাউকে তার ভুলের  উপলব্ধি করানোর সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে, বোঝানোর চেষ্টা না করে তাকে বোঝার চেষ্টা করা। সরাসরি ভুল বা অন্যায় হয়েছে এমন মন্তব্য না করে ভুলের পেছনে যে মানবিক দুর্বলতা, পরিবেশ, পরিস্থিতি, অবস্থান কাজ করেছে সেগুলোকে ধীরে ধীরে উন্মোচন করা তার সামনে। এবং তার মনে এই বিশ্বাস জাগানো যে, মনের দুর্বল মূহুর্তে যেমন আমাদের দ্বারা ভুল হয়ে যেতে পারে। ঠিক তেমনি মনের সবলতার দ্বারা আমরা সেই ভুল থেকে বেরিয়েও আসতে পারি ইনশাআল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ নায়লা বুঝতে পেরেছে যে ওর দ্বারা অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। ওর মনে এটাকে ঘিরে অনুশোচনাটাও বেশ গভীর। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ওর কাজটা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় এই উপলব্ধি ওর মনে জাগ্রত। পরিবারের সবাই জানার পর কষ্ট পাবে সেই চিন্তাটাও ওকে খুব ব্যথিত করছে।

সবাইকে কষ্ট দিয়ে ব্যথিত হয়ে লাভটা কি? পরিবারের সবার কষ্টের ভাবনা মনে থাকলে এমন কাজই করতে পারতো না। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন শরিফা খানম।

সুবহা বলল, এটা কিন্তু তোমার রাগের কথা খালামণি। তুমি নিজেই শান্ত মাথায় চিন্তা করলে বুঝতে পারবে ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। অনেক সময় পরিবারের প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা থাকার পরেও আমরা পরিবারের কষ্টের কারণ হয়ে দ্বারাই। কখনো অজান্তে, কখনো বা অপরাগতার কারণে।

কিন্তু আমাদের ভাই-ভাবীরা, আমরা দুই বোন, আমাদের নিজ নিজ হাজবেন্ড। আমরা সবাই আমাদের সারাটা জীবন তোদেরকে গড়ার পেছনেই ব্যয় করেছি। সন্তানদেরকে আখিরাত মুখী করার লক্ষ্যে, দুনিয়াবী সকল ম্লানতা থেকে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে এত কষ্ট করার পরও যদি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী দাঁড়াতে হয়। তখন নিজেদেরকে ব্যর্থ মনে করা ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। খুব ব্যথিত কন্ঠে বললেন নাজমা খানম।

আদী বলল, এটা তোমার ভুল চিন্তা বড় ফুপি। পিতা-মাতার হক আদায়ে তোমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছো। এরপরেও যদি তোমাদের কোন সন্তান ভুলের পথে চলতে শুরু করে সেই দায় সম্পুর্ণ তার, তোমাদের নয়। ইনশাআল্লাহ এরজন্য আল্লাহর দরবারেও তোমাদেরকে দায়ী হতে হবে না। কারণ আমলের বিচার হবে নিয়্যাতের ভিত্তিতে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দাহর অন্তরের খুলুসিয়াতকে দেখেন, তার সফলতা কিংবা ব্যর্থতাকে নয়।

ফায়েজ বলল, তাছাড়া নিজেদেরকে ব্যর্থই বা কেন ভাববে তোমরা? নায়লার ভুলের উপলব্ধিটা কি তোমাদের সফলতার প্রমাণই বহন করে না? ফুপি সন্তানদেরকে সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে শেখানোর অর্থ এটা নয় যে, জীবনের সর্বাবস্থাতে তারা সফল হবে অসুন্দরের ছায়া থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হবে। নফস আর শয়তানের ওয়াসওয়াসার গোলকধাঁধায় বিভ্রান্ত হয়ে কখনো কখনো তারা ভুল পথে চলে যেতেই পারে। কিন্তু যেহেতু সঠিক পথের সংজ্ঞা তাদের জানা থাকে তাই কিছু দূর চলার পরই তারা বুঝতে পারে যে ভুল পথে চলে এসেছে। তখন সঠিক-বেঠিক, শুদ্ধ–অশুদ্ধের বোধসম্পন্ন জাগ্রত বিবেক তাদেরকে স্থির থাকতে দেয় না ভুলের উপর। আত্নদহনের জ্বালা সইতে না পেরে একসময় তারা আবারো সত্য ও সুন্দরের পথে ফিরে আসে। আর এখানেই পিতা-মাতার শেখানো শিক্ষার সার্থকতা লুকায়িত। কেননা পিতা-মাতা সঠিক-বেঠিকের শিক্ষা দিয়েছিলেন বলেই  তো সন্তান বুঝে নিতে পেরেছিল যে পথে চলছে এই পথের সমাপ্তি আলোকিত মঞ্জিল নয়।

বেশ কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে এলো আবারো বৈঠকে। নীরবতা ভেঙে ছোট ফুপা নাজমুল  আলম বললেন, ছেলে হিসেবে অবশ্য সৈকত বেশ ভালোই। তবে পরিবারের সদস্য বানাতে চাইলে ওকে গড়ে নিতে হবে আমাদের। তোমাদের ফুপি যদি আপত্তি না করেন তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই নায়লার সাথে সৈকতের বিয়েতে। আমি আমার সম্মতি জানিয়ে দিলাম। এখন তোমরা সবাই মিলে যা সিদ্ধান্ত নেবার নাও।

কিন্তু এই বিয়ে হলে কি বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না? ওরা তো সাহস পেয়ে যাবে ভুল পথে চলার। যেহেতু সিদ্ধান্ত ওদের সাপোর্টে যাবার উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। কন্ঠস্বরই বলে দিচ্ছিলো স্বামীর কথা শুনে খুবই বিরক্ত হয়েছেন শরিফা খানম।

রিসাব বলল, তুমি পুরো ব্যাপারটাকেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছো মা। নায়লার বিয়ে সৈকতের সাথে হলে বরং বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েরা বুঝবে কখনো যদি তাদের দ্বারা কোন ভুল হয়ে যায় পরিবারের বড়রা তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করবে, এবং মূল্যায়ন করার মতো হলে তাদের উপর জোর করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হবে না। এই বিশ্বাস একদিকে যেমন ওদেরকে ভুল থেকে দূরে থাকার শক্তি যোগাবে, অন্যদিকে কখনো যদি ভুল হয়ে যায় সহজ স্বীকারোক্তির সাহস দেবে।

হুমায়ূন বলল, তাছাড়া একই ধরণের ঘটনার একাধিক পুনরাবৃত্তি ঘটবে এমনটাই বা ভাবছি কেন আমরা? নায়লার ঘটনাটিকে কি আমাদের রিমাইন্ডার হিসেবে নেয়া উচিত নয়? এই দুর্ঘটনার পেছনে আমাদের নিজের কি কি ভুল ছিল সেটা খুঁজে বের করে সংশোধনের চেষ্টা করার সাথে সাথে অন্যান্যদের ব্যাপারে আরো সচেতন হয়ে উঠতে হবে। তুমি এখন যতই রাগ দেখাও না কেন ফুপি। নিজের ভুলকে তোমার মেনে নিতেই হবে। সৈকতের সাথে নায়লার সম্পর্ক তোমার গন্ডির ভেতরই দানা বেঁধেছে। তুমি হয়তো যুক্তি দেখাবে মেয়েকে তো শরীয়তের বিধি-নিষেধ, সীমা সম্পর্কীয় জ্ঞান দিয়েছো। কিন্তু শুধু জ্ঞান দেয়ার পরেই বাবা-মা’র দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। শেখানো পথে সন্তানরা ঠিক মতো চলছে কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। মাঝে মাঝে খোঁজ নিয়ে দেখতে হয়।

ফায়েজ বলল, আজকের সকালের একটা মজার ঘটনা বলি তোমাকে ফুপি। মামণি, মা আর আম্মি  খুবই খোশ মেজাজে একসাথে বসে গল্প করতে করতে নাস্তা করছিলেন। নূহা একা ড্রাইভ করে ওর  বাসা থেকে তোমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে শোনার সাথে সাথে মা, মামণি আর আম্মির খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নূহার গাড়ি তোমার গেটে ঢোকার পর, নূহাকে সুস্থ শরীরে গাড়ি থেকে বের হতে দেখার পর আমাদের মায়েরা তিনজন বাগান জুড়ে অস্থির পায়চারী বন্ধ করে স্বস্থির শ্বাস ফেলে বসেছিলেন। এর আগ পর্যন্ত একবার রাহাতকে ফোন করে বকাঝকা করছিলো কেন  নূহাকে নিজে এসে পৌঁছে দিয়ে গেলো না। আরেকবার আমাকে আর রিসাবকে বলছিল এগিয়ে গিয়ে দেখতে নূহা কতদূর এসে পৌঁছেছে। সত্যি বলতে আমার নিজের হার্টবিটও ফার্স্ট হয়ে গিয়েছিল। অথচ আমাদের সবারই কিন্তু জানা ছিল নূহা খুব ভালো ড্রাইভ করে। আর এটাই হচ্ছে পয়েন্ট ফুপি। যখন বাবা-মা’র জানা থাকে তাদের সন্তান খুব ড্রাইভার। কিন্তু তারপরও তারা শঙ্কিত হয় গাড়ি নিয়ে সন্তান পথে নামার পর।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরিফা খানম বললেন, ঠিকআছে আমার আর কিছুই বলার নেই এই ব্যাপারে। তোমরা যা ভালো মনে করো তাই করো।

জাওয়াদ বলল, তাহলে ফায়েজ, আদী, রিসাব, হুমায়ূন আর আমি কথা বলে দেখি সৈকতের সাথে। ওর সাথে কথা বলার পর যদি ভালো মনেহয় আমাদের কাছে। তাহলে প্রথমে ওদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো। সবকিছু মোটামুটি ঠিক থাকলে এরপর সিদ্ধান্ত নেবো ইনশাআল্লাহ। ঠিকআছে ফুপাজান?

নাজমুল সাহেব বললেন, হ্যা জাওয়াদ তুমি যেটা ভালো মনে করো।

তাহলে সন্ধ্যার পর সৈকতকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিও। আমরা কথা বলে দেখবো ইনশাআল্লাহ। আর এখন আমাকে আর ফায়েজকে উঠতে হচ্ছে। হসপিটালে যেতে হবে অপারেশন আছে আমাদের।

জাওয়াদ আর ফায়েজ বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর পরিবারের বাকি সবাইও ধীরে ধীরে উঠে নিজ নিজ কাজে রওনা দিলো।     

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন