রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২০



গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে সেই মূহুর্তে জানালায় নক শুনতে পেয়ে দৃষ্টি সামনে থেকে ঘুরিয়ে পাশে তাকালো জাওয়াদ। মুখের সবগুলো দাঁত বের করে হুমায়ূন দাঁড়িয়ে ছিল গ্লাসের ওপাশে। জাওয়াদ গাড়ির লক খুলে দিলে ভেতরে ঢুকে সালাম দিয়ে হুমায়ূন বলল, মিটিং ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছে আমার। তাই চলে এলাম তোমার সাথে বাড়িতে ফেরার জন্য।

জাওয়াদ সালামের জবাব দিয়ে বলল, বুঝলাম। কিন্তু তখন থেকে দাঁত বের করে রাখার কারণটা বুঝতে পারছি না।

হুমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, আজকেই তোমাকে আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটা করার সুযোগ পেয়ে গেলাম তো তাই চেষ্টা করেও দাঁত বন্ধ করতে পারছি না।

তুই চাইলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি। একান্তই যদি বন্ধ করা সম্ভব না হয় অন্তত তোর দাঁত গুলো ঝরিয়ে দিতে পারবো ইনশাআল্লাহ। কি ট্রাই করবো করবো?

হুমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, মাফ চাই ভাই। এবং সাথে আমার প্রশ্নের জবাবটাও চাই।

হুম! কিন্তু সেজন্য আগে প্রশ্নটা তো জানতে হবে আমাকে।

হুমায়ূন হেসে বলল, আমার প্রশ্নটা হচ্ছে তোমার মনের অনুভূতি জানার পর ফায়েজ ভাইয়া, আদী ভাইয়া, সুবহা, রিসাব এবং আমি যখন কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমরা বিষয়টা সহজ ভাবে মেনে নিতে চাইলেও তুমি আপত্তি করেছিলে। বলেছিলে, এমন কিছু হলে আমাদের পারিবারিক অবকাঠামোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যেটা কোন ভাবেই তুমি হতে দিতে চাও না। এবং তুমি সত্যি সত্যিই নিজেকে একদম গুঁটিয়ে নিয়েছিলে এরপর। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে একেবারে বিয়ের ঘোষণা দেবার পেছনে কারণটা কি ছিল?

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জাওয়াদ হেসে বলল, ফার্সিতে একটা প্রবাদ আছে, “সব জিনিসের মূল্য জানো কোনটা কত দামী, নিজের মূল্যেই জানো না তুমি এ কেমন পাগলামী?” হুমায়ূন যখন আমার ভান্ডারে জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল না তখনো আমার মনেহতো, নিজের মূল্য জানাটা মানুষের জন্য খুব বেশি জরুরি। মানুষ ভুলের স্রোতে ভেসে যায়, প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়, অন্যের তরে স্বার্থ বলি দেবার বদলে নিজের জীবনকেই ত্যাগ করে দেয় অহেতুক। ইত্যাদি ইত্যাদি  নানান ধরণের আত্মিক ও শারীরিক জুলুম মানুষ নিজের মূল্য জানে না বলেই করতে পারে নিজের সাথে। নিজ জীবনের মূল্য জানে না বলেই মানুষ অন্যের কারণে নিজের জীবনের সুখ-শান্তি-স্বস্থিকে বিসর্জন করে দিতে পারে। নিজের মূল্য জানে না বলেই মানুষ ছোট্ট একটু লাভের জন্য অনেক বড় কল্যাণকর কিছুকে দূরে সরিয়ে দেয়। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায় মানুষের নিজের মূল্য না বোঝার, না জানার। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ আমি আমার মূল্য জানতাম। আমি জানতাম  আমার জীবন শুধু আমার একার নয়। আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে আরো অনেকগুলো জীবন। একটা পুরো পরিবারের হাসি-আনন্দ। একটি ইসলামী সংগঠনের অসংখ্য ভাইয়ের স্বপ্ন ও আত্মত্যাগ। তাই আমি এটাও জানতাম মানসিক ভাবে আমার শান্ত থাকাটা কতটা জরুরি। নূহার প্রতি ভালো লাগার আত্মোপলব্ধির পর সবদিক বিবেচনা করে সরে যাওয়াটাকেই বেটার মনে হয়েছিল আমার কাছে। কিন্তু নূহার দশ বছর বয়স থেকে নিয়ে পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত কখনো ফোনে, কখনো মেইলে কথা বলা। শিশুসুলভ কথা ছাড়িয়ে মনের অজান্তেই দুজন জ্ঞানোরাজ্যে ঘুরে  বেড়ানো। প্রায় পাঁচ বছরের এই অভ্যস্ততা কাটিয়ে তোলাটা বেশ কঠিন হচ্ছিলো আমার জন্য। তাছাড়া ওয়াসওয়াসা দেবার জন্য শয়তান আর সেটাতে সঙ্গ দেবার জন্য তো প্রবৃত্তি ছিলই। আশেপাশের সবাই তো বটেই আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম কাজকর্মে নিজের অমনোযোগিতা। তবে কিছুটা সময় পেরোলে হয়তো এসব ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু নূহা তো আর আমার অবস্থা জানতো না। তাই নিয়মিতই মেইল করতো। প্রায় দু’মাস আমি ওর কোন মেইলের জবাব দেইনি। ভেবেছিলাম জবাব না পেয়ে একসময় মেইল পাঠানো বন্ধ করে দেবে।

হুমায়ূন হেসে বলল, হুম! আমার মনেআছে নূহা সারাক্ষণ মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াতো তখন। আমার কাছে এসেও জিজ্ঞেস করতো মাঝে মাঝে পিভি ভাইয়ার কি হয়েছে সেটা কি জানো? ভাইয়া কেন আমার মেইলের জবাব দেয় না? বাবা-মামণি, পাপা-মা থেকে নিয়ে শুরু করে বাড়ির সবার কাছেই এই একই প্রশ্ন করতো। বাবা বুঝিয়ে বলেছিল, হয়তো জাওয়াদ ব্যস্ত খুব তাই মেইলের জবাব দেবার সময় করতে পারে না। হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল ঐ সময় নূহা। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে অস্থির করাও ছেড়ে দিয়েছিল বাড়ির সবাইকে। তোমাদের বিয়ের আগ পর্যন্ত ওমন চুপচাপই ছিল। যাইহোক, মেইলের জবাব না পেয়ে কি মেইল করা বন্ধ করে দিয়েছিল?

জাওয়াদ হেসে বলল, উহু, বন্ধ করেনি। তবে নিজের মনের অনুভূতি, উপলব্ধি, কবিতা যে লিখে পাঠাতো। সেসব লেখা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাড়িতে ঘটমান সবকিছু লিখে পাঠাতো প্রতিদিনই। ভাইয়া তোমার কি হয়েছে? কেন মেইলের জবাব দাও না? আমি কি কোন দুষ্টু কাজ করেছি? সেজন্য কি শাস্তি দিচ্ছো? এই ধরণের প্রশ্ন করাও বন্ধ করে দিয়েছিল একদমই। সালাম দিয়ে মেইল  শুরু করতো। এরপর শুধু পরিবারের কথা লিখতো। পুরো দশ মাস আমি ওর কোন মেইলের  জবাব দেইনি। কিন্তু একদিনের জন্যও নূহা মেইল পাঠাতে মিস করেনি। এই ঘটনাটা আমার সামনে একসাথে নূহার চরিত্রের অনেকগুলো দিক উন্মোচন করে দিয়েছিল। যা করণীয় মনে করে তা করবেই। কেউ তাতে উৎসাহ দিক বা না দিক তাতে ওর কাজে কোন প্রভাব পড়বে না। কোন কিছুর পেছনে লেগে থাকার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা। আপন কেউ যদি কষ্টও দেয় তবুও তাকে ভালোবাসা থেকে বিমুখ না হওয়া। ধৈর্য্যশীলতার সাথে প্রতীক্ষা করার ক্ষমতা। শব্দের মাঝে নিজের মনের অবগুন্ঠিত ভাবকে ছড়িয়ে দেয়া। শেষের দিকের প্রতিটা মেইল খোলার সাথে সাথে আমি নূহার রাগ আর জেদের উত্তাপ ফিল করতাম। কখনো পড়ার সময় মনেহতো এই শব্দগুলো অশ্রুসিক্ত। কিন্তু তবুও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। সেজন্যই সাদের বিয়ে উপলক্ষ্যে দেশে যাবার আগে সিরিয়াসলিই বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে বলেছিলাম মা-মামণিদেরকে।

হুমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, কি যে এক অবস্থা হয়েছিল তখন। মাদার গ্রুপের সদস্যরা চলমান বিয়ের আয়োজন ছেড়ে ছুঁড়ে ঝাঁপিয়ে পরেছিল তোমার জন্য পাত্রীর সন্ধানে। কোন কোন দিন তো তিনবেলা তিনটা মেয়ে দেখতে যেতেন। মার একজনকে পছন্দ হয় তো মামণির তাকে মনে ধরে না। মা আর মামণি একমতে আসা মাত্রই আম্মি বলতো, তোমাদের পছন্দকে আমি সম্মান করছি কিন্তু আমাদের রাজপুত্রের সাথে এই মেয়েকে ঠিক মানাবে না। অবশেষে গিয়ে ফুপির চাচাতো দেবরের মেয়ে সাবিতকে সবার মোটামুটি পছন্দ হলো তোমার জন্য। এরপর তোমার দেশে আসার জন্য সবার অধীর অপেক্ষা। কিন্তু তুমি এসে সাবিতের ছবি দেখতেই রাজী হলে না। বরং বললে যে সরাসরিই কথা বলবে বাড়ির বিয়ের ঝামেলা শেষ হবার পর।

জাওয়াদ হেসে বলল, হুম! মা এমনিতেই সারাক্ষণ নূহার কথা বলতো। নূহা এটা করেছে, নূহা ওটা করেছে। বাড়ির একটা মেয়েও নূহার মত না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ঐ সময়টায় আমার কাছে এসে নূহার প্রশংসা করাটাই যেন মার কথা বলার একমাত্র টপিকস ছিল। অবশ্য এর একটা কারণ সম্ভবত এটা ছিল যে, কাজের পাশাপাশি আগে প্রচুর দুষ্টুমিও করতো নূহা। নূহা একদম ছোটবেলা  থেকেই সাংসারিক টাইপ মেয়ে। ছোটবেলাতেও ওর একমাত্র খেলা ছিল ছোট ছোট হাড়ি-পাতিল নিয়ে রান্নাবান্না করা। চার বছর বয়স থেকেই বাবার জন্য আমি চা বানাবো, ভাইয়ার জন্য আমি কফি বানাবো, সবার জন্য আমি প্লেটে ভাত সার্ভ করবো বলে চিৎকার করতো। কাজ করতে পছন্দ করতো, আপনজনদের খেয়াল রাখতে পছন্দ করতো, তাদের ভালো লাগা-মন্দ লাগাকে মূল্য দিতে শিখে নিয়েছিল কিংবা এসবই ওর স্বভাবজাত গুণ ছিল। এসব কারণে আমাদের মা-মামণিদের মনে নূহাই ঘুরে বেড়াবে এটাও স্বাভাবিক ছিল। তবে সারাক্ষণ দুষ্টুমি করতো বলে ওর দিকে আলাদা করে মনোযোগ দেবার কোন সুযোগ ছিল না কারো। কিন্তু ঐ সময় যখন নূহা একদম  চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। যখন থেকে পরিবারে দেয়া ওর অবদান গুলো দুষ্টুমির বাতাসে বয়ে যাওয়া থেমে গিয়েছিল। তখন মা-খালামণিরা আরো গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিল আমাদের আনন্দবাড়ির সর্বত্র নূহার ছোট্ট ছোট্ট হাতের মমতা ছোঁয়া পরশ। আর আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল নূহার ভেতরের মাতৃত্ব। সুবহা মনেহয় শুধু জন্ম দিয়েছিল কিন্তু আওয়ামকে লালন-পালন ধরতে গেলে নূহাই করেছিল। সেবার দেশে যাবার পর একদিন দোতলার করিডোরে এসে দেখি আওয়াম  রঙ পেন্সিল দিয়ে মনের আনন্দে ড্রইংরুমের দেয়াল জুড়ে ছবি আঁকছে। একটু পর নূহাকে আসতে দেখে ভেবেছিলাম হয়তো আদরের সুরেই বললে তুমি এমনটা কেন করলে বাবা, দেয়ালে আঁকতে  হয় না, ইত্যাদি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে নূহা চোখ বড় বড় বলল, এই ফাটাফাটি সুন্দর ছবিগুলো কি আমার আওয়াম সোনা এঁকেছে? মাশাআল্লাহ। কি করে আঁকলো এত্তো সুন্দর ছবি  আওয়াম? ফুম্মাকে কি একটু শিখিয়ে দেবে ছবি আঁকা প্লিজ? আওয়ামের খুশি আর আনন্দ তো মূহুর্তে আকাশ ছুঁয়ে দিয়েছিল। লাফাতে লাফাতে বলল, ফুম্মা আতো থিকিয়ে দেই তোমালে।

হুমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, আওয়ামের কথাগুলো এত সুইট ছিল মাশাআল্লাহ। তোমার মনে আছে ভাইয়া ওই সময় আমরা সবাইও আওয়ামের মতো করে কথা বলতাম?

জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, হুম! নূহা তখন সত্যি সত্যিই আওয়ামের সাথে ছবি আঁকতে বসে গিয়েছিল। মা এসে দুজনকে দেয়ালে ছবি আঁকতে দেখে চিৎকার করে উঠেছিল। নূহা হাসতে হাসতে বলেছিল, খালামণি এটা তোমার কাছে ঘরের দেয়াল। কিন্তু শিশুদের কাছে এটা হচ্ছে বিশাল এক উন্মুক্ত ক্যানভাস। জানোই তো শিশুদের ভুবন ভীষণ রকম কালারফুল। ওরা তাই এমন সাদা, ফ্যাঁকাসে কিছু দেখলেই নিজেদের মনের ভেতর তুলি ডুবিয়ে রাঙিয়ে দিতে চায় চারপাশ। কোথায় আমাদেরকে ধন্যবাদ দেবে, তা না তুমি চিৎকার করছো। তাছাড়া সামান্য কটা টাকা খরচ করে নতুন করে রঙ করলেই এই দেয়ালের দাগ মিনিটে ফেলা সম্ভব হবে। কিন্তু দেয়ালে এই দাগগুলো দেবার সময় আওয়ামের মনে যে আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয়েছে সেটা চির অম্লান থাকবে। শৈশবের আনন্দময় মূহুর্তগুলোর মূল্য কখনোই শব্দে ধারণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আলোকিত শৈশব জীবনের অন্ধকার পথে মশালের কাজ করে। অনেক কষ্ট ভুলে থাকা সম্ভব হয় শৈশবের সুন্দর স্মৃতির মাঝে ডুবে থেকে। তাই অকারণে তুমি আমাদের সৃজনশীলতাকে বাঁধাগ্রস্ত করো নাতো।

শৈশব নিয়ে বলা কথাগুলো নিশ্চয়ই তোমাকে ঘিরেই ছিল!  

হুম! আমারো সেটাই মনে হয়েছিল। এবং ঐদিন প্রথম ফিল করেছিলাম আমি গত দশ মাস ধরে কতটা কষ্ট দিয়েছি নূহাকে। শুধু নিজের দিকটা ভাবতে গিয়ে আমি নূহার মনে কি পরিমাণ শূন্যতা তৈরি হবে সেটা ভেবে দেখিনি। ঐদিন নূহার কলেজের ফাস্ট সেমিস্টারের রেজাল্টও দিয়েছিল। এবং সবসময়ের মতো প্রতিটা সাবজেক্টে টপ মার্কস ছিল নূহার। অথচ আমার অ্যাক্টিভিটিস দারুন ভাবে  প্রভাবিত হয়েছিল মানসিক অস্থিরতার কারণে। ঐদিন তাই আরেকটা ব্যাপারও ফিল করেছিলাম। নূহার সেলফ কন্ট্রোলিং পাওয়ার। মানসিক দুর্যোগের সময় নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য সমূহকে যথাযথ পালন করে যাওয়া ভয়াবহ রকমের কঠিন একটা কাজ। কিন্তু নূহার রেজাল্ট প্রমাণ করে দিয়েছিল মনের শূন্যতাকে মনের এক কোনে বন্দী করে রেখে জীবনের স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখার ক্ষমতা আল্লাহ ওকে দিয়েছেন। এমন আরো অনেকগুলো ছোট ছোট কারণ উন্মোচিত হতে শুরু করেছিল আমার সামনে। যার কোন একটা মিস হয়ে গেলেই হয়তো আমি সামনে এগোনোর কথা চিন্তা করতাম না। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে তখন আমার মনে হয়েছিল, যেহেতু আমার আর নূহার বিয়ের  পারমিশন শরীয়ত আমাদেরকে দেয়। তাহলে কেন শুধুমাত্র মানুষ কি ভাববে সেই চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমাদের জীবনের সিদ্ধান্ত নেবো? মানুষের কাছে তো সর্বাবস্থাতেই কিছু না কিছু বলার মতো থাকে। মানুষের কাজ ওই বলা পর্যন্তই। তাই শুধুমাত্র বেমানান এই কারণে আমার  আর নূহার মধ্যের সুন্দর সম্পর্কটাকে চিরতরে শেষ করে দেবার কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি। আমার মনে নূহার যে অবস্থান গড়ে উঠেছিল সেটা মুছে ফেলাটাও যে খুব সহজ কিছু ছিল না দশ মাসের অভিজ্ঞতায় সেটাও বুঝতে পেরেছিলাম। তারউপর নূহার মধ্যে সেই প্রত্যেকটা গুণাবলী বর্তমান ছিল যেগুলো আমি পেতে আগ্রহী ছিলাম আমার জীবনসাথীর মধ্যে। কিন্তু নুহা ঠিক আমাকে কিভাবে ফিল করে সেটা তখনো আমার জানা ছিল না। জানতে চাচ্ছিলামও না সেভাবে করে। কিন্তু বিয়ের কথা পরিবারকে জানানোর আগে একবার অন্তত ওর ইচ্ছে জেনে নেয়াটা জরুরি মনে হয়েছিল। সেজন্যই আমি আরো সাত মাস অপেক্ষা করেছি। এবং তখনো আমি হান্ডেড পার্সেন্ট শিওর ছিলাম না যে নূহা সম্মতি দেবে আমার কথার সাথে। তাই বিয়ের সম্মতি চেয়ে করা আমার প্রশ্ন শুনে নূহা যতটা অবাক হয়েছিল। ওর সম্মতি পেয়ে আমিও ততটাই অবাক হয়েছিলাম।

হুমায়ূন হেসে বলল, তোমাদের নিয়ে অনেক মজার একটা গল্প লেখা যাবে বুঝলে। শিরোনাম হবে, অবিশ্বাস্য এক ভালোবাসার গল্প। তবে গল্পটা এখনো অসম্পূর্ণ। নায়িকার অনুভূতি জানা ছাড়া সেটা  সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। নূহার কাছে তো আমি জিজ্ঞেস করতে পারবো না। তুমিই বলো নূহার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল ঐ দেড় বছরে।

তাতো জানি না। কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি নূহাকে। আমার মনের অবস্থার কথাও কখনো বলা হয়নি ওকে। আড়াই বছরের সংসার জীবনে অতি যত্নের সাথে আমরা দুজন জীবনের এই অধ্যায়টাকে এড়িয়ে চলেছি।

কেন? বেশ অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো হুমায়ূন।

জাওয়াদ হেসে বলল, আমি ভয়ে এড়িয়ে চলেছি। মনেহতো প্রসঙ্গটা উঠলেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু জটিলতা তৈরি হবে আমাদের মাঝে। এমন অনেক প্রশ্ন নূহা করবে যার জবাব শুনলে আবার প্রচন্ড কষ্ট পাবে। কষ্টের দ্বার তাই অবরুদ্ধ করে রাখাটাই বুদ্ধিমত্তা মনে হয়েছে। নূহা কেন এড়িয়ে গিয়েছে সেটা অবশ্য আমার জানা নেই। নিশ্চয়ই ওর নিজস্ব কোন কারণ আছে। তবে সব কথার এক কথা হচ্ছে আমাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়াটা হয়তো কঠিন ছিল। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাবার পর আমি আমার মনের ভালোবাসার ক্ষমতার শেষ সীমানায় ছাড়িয়ে ওকে ভালোবেসেছি। বিশেষ করে নূহার এক্সিডেন্টটা আমাদেরকে খুব দ্রুত একে অন্যের কাছে নিয়ে এসেছিল। আমি যখন নূহাকে আইসিইউ তে দেখেছলাম। প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম এতদিন ধরে মনের যে আবেগকে অবচেতন মনের ভালো লাগা মনে করতাম। সেগুলো আসলে মনের সেই ভালোবাসা যা কখনো কখনো মন অন্যকোন দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে নোটিশ করতে ভুলে যায়। এক মূহুর্তেই তাই সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝরে পড়ে গিয়েছিল আমার মন থেকে। এবং আবারো একবার নিজেদের অজান্তেই আমরা একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেবার তিন স্বীকারোক্তির ঐশী বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমতের সুশীলত ছায়াতলে সারাজীবনের জন্য একে অন্যের হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। নাহ! ভুল বলে ফেললাম বোধহয়। সারাজীবনের জন্য নয়, অল্প কিছু সময়ের জন্য।

এরপর অনেকটা পথ হূমায়ূন আর জাওয়াদ দুজনই চুপ করে রইলো। এরপর হুমায়ূন বলল, তুমি এভাবে আর কতদিন থাকবে ভাইয়া? এখন মনেহয় তোমার বিয়ে করে নেয়া উচিত।

জাওয়াদ হেসে বলল, চল তোকে একটা গল্প শোনাই। এক পিঁপড়ার খুব শখ সে আকাশে উড়বে। তার ছোট্ট মাটির ঘর থেকে বের হয়ে দূর দূরান্তে ঘুরতে যাবে। অনেক সুখের এবং আনন্দের হবে তার জীবন। একদিন সেই পিঁপড়াটা তার স্বপ্নের কথা বাবা মাকে খুলে বলে। বাবা মা তখন তাকে বুঝিয়ে বলে যে, দূর থেকে যতটা সুন্দর ও আনন্দময় লাগছে বাইরের জগতটা আসলেই অতটা  ভাল না। জলে-স্থলে-আকাশে এমন অনেক ভয়ঙ্কর প্রাণী আছে তাকে আঘাত করে ব্যথা দেবে। আর জ্বলজ্বলে স্বপ্নময় আলো তো সাক্ষাৎ মৃত্যু। কিন্তু বাবা-মার কাছে এত কিছু শোনার পরেও সেই পিঁপড়াটি নিজের মনের স্বপ্নের কথা ভুলতে পারে না। সব সময় মাটির এমন মাটির সান্নিধ্য তার ভালো লাগেনা। নিজের জীবনের সবকিছুকেই তার বিষময় লাগতে শুরু করলো ধীরে ধীরে। অপারেতেই সর্বসুখ আমার বিশ্বাস অনেকটা এমন চিন্তার ঘেরাটোপে আঁটকে গিয়েছিল পিঁপড়া। মাটির ময়লা রঙ আস্তে আস্তে তার অসহ্য লাগতে থাকে। তাই একসময় সে সকল বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে সুখের সন্ধানে ছুটে গেলো বাইরের জগতে। তার জন্য নিষিদ্ধ জাদুর পানি পান করলো। যারফলে এক আশ্চর্য পরিবর্তন এলো তার দৈহিক গঠনে। তার দুই পাশে খুব সুন্দর দুটি পাখা গজিয়ে উঠলো। সুখালোর সন্ধানে সে ডানা মেলে দিলো আকাশ পানে। এখানে সেখানে যেখানেই আলোর খেলা তার নজরে পড়ছিল ছুটে যাচ্ছিলো নেশাগ্রস্থের মত সেদিকে। পেছনে পড়ে রইলো তার ছোট্ট মাটির ঘর। তার ভাই-বোন, যাদের সাথে সে প্রতিদিন খেলা করত। তার বাবা-মা, যারা তাকে অসম্ভব ভালোবাসতো। উড়তে উড়তে দূরের এক গ্রামের এক বাড়িতে প্রবেশ করলো পিঁপড়াটি। দেখলো কিছু ছোট ছোট মানুষ এক আশ্চর্য সুন্দর এক আলোকে ঘিরে খেলা করছে। ঠিক যেমন সে তার ভাই-বোনদের সাথে দুষ্টুমির খেলা খেলত! একজন বড় মানুষ এসে তাদের খেলা থামিয়ে দিয়ে তাদের মুখে খাবার দিতে লাগলো। ঠিক তার মা যেমন তার মুখে খাবার তুলে দেয়। হঠাৎ করে তার প্রচন্ড মার কথা মনে পড়লো। কিন্তু মার কাছে ফিরে যাওয়ার আগে একবার কাছ থেকে আশ্চর্য সুন্দর সেই আলোকে দেখতে চাইলো। আলোর কাছে পৌছেই টের পেলো তার হালকা পাখা গলে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রন হারিয়ে সে আলোর উৎস মোমের মত গলিত অংশের উপর পড়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড গরমে তার শরীরে ফোস্কা পড়ে গেল। এখন শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। সে  বুঝতে পারল, তার মাটির ঘর কত নিরাপদ ছিল, কত সুখের ছিল বাবা-মার সঙ্গ, কতই না আনন্দময় ছিল ভাইবোনের সাথে কাটানো ক্ষণ। অথচ দূরের সৌন্দর্যের মিথ্যা হাতছানিতে সাড়া দিয়ে গিয়ে শুধু যে সুখ আর আনন্দ হারিয়ে গেলো তার জীবন থেকে তাই নয়। সে হারালো তার জীবনটাকেও। বুঝেছিস?

হুমায়ূন হেসে বলল, হুম, বুঝেছি। নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপাড়েতেই সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। তুমি মোটেই তেমন মানুষ হও। তুমি যখন যে পাড়ে থাকো সে পাড় থেকেই সুখ খুঁজে বের করে সুখী হতে চেষ্টা করো।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ এই তো বুঝেছিস। সুখ নিয়ে তোর ভগ্নীর একখানা কবিতা আছে। আমার খুবই পছন্দের। ‘দেখলুম একজনা, সুখকে বেড়াচ্ছেন খুঁজে চারিদিকে আঁতিপাঁতি। ভাবলুম আনমনা, সুখ কি হারানো বস্তু নাকি একটি অনুভূতি? জবাব ছিলই জানা, সুখ নয় গুপ্তধন, নয় কারো নিজস্ব সম্পত্তি। ইতিবাচক ভাবনায়, নিজের মাঝেই মিলবে সুখের খন্ড খন্ড জ্যোতি।” আলহামদুলিল্লাহ আমার জীবনের সর্বত্র জ্যোতিময়। নতুন কোন সম্পর্কের আলোর প্রয়োজন নেই। আমি আপনালোতেই সন্তুষ্ট এবং রবের প্রতি কৃতজ্ঞ।

হুমায়ূন হাসিমুখে আলহামদুলিল্লাহ বললো। এরপর বাকিটা পথ দুজনই চুপ করে রইলো।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন