রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি... ১৬




ছোটবেলা থেকে যখনই কোন কারণে মনের ভেতর ভীতির সঞ্চার হয়েছে দু’হাতে শক্ত করে বাবার হাত আঁকড়ে ধরেছে নূহা। বাবার স্পর্শে মূহুর্তেই সমস্ত ভীতি কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়ে সেখানে শান্তি, স্বস্থি আর সাহস ঝঙ্কার তুলে যেত। আজও মনের মধ্যে প্রচন্ড ঝড় প্রবাহিত হচ্ছিল, যা বার বার কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো অন্তঃরাত্মা, নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল আপনও আঁধারে। আলোর সন্ধানে তাই বাবার কাছেই ছুটে এসেছিল নূহা। বাবার একটি হাত নিজের দু’হাতের মুঠোতে পুরে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল বাবার দিকে। জগতে তো কত বড় বড় মিরাকল ঘটে। এই মূহুর্তে যদি তার সাথে একটা মিরাকল ঘটতো। যদি বাবার নিশ্চল হাতটি হঠাৎ সচল হয়ে উঠতো, নিশ্চুপ ঠোঁট দুটি নড়ে উঠতো! যদি হাত চেপে ধরে বাবা বলে উঠতেন, সত্যি করে একটা কথা বলতো মা নূহা। আচ্ছা তুই কি পণ করেছিস আমার সব কথা সবসময় অমান্য করবি? এই নিয়ে তোকে কত হাজার বার বলেছি আমার সামনে কখনো কান্না না করতে। তুই জানিস না পাহাড় সম বেদনাও তোর বাবাকে টলাতে পারে না। কিন্তু তোর চোখের নদীতে বেদনার ঢেউ ওঠার আগেই তোর বাবার অন্তর গুমরে কেঁদে ওঠে? ভীষণ দুর্বল করে দেয় তোর অশ্রুরা তোর বাবাকে। অথচ আমি তো সারাজীবন তোকে আমার শক্তি হিসেবে পেতে পেয়েছি। মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছি আলোর পথের যাত্রী আমার নূহা। সব বাঁধা ডিঙিয়ে সবাইকে নিয়ে যে আলোর দিকে ছুটে চলবে অবিরত, অবিচল। কেউ দুর্বল হয়ে হাল ছেড়ে দিতে চাইলেও তুই তার ভুলটাকে ভাঙিয়ে ফিরিয়ে আনবি আলোর পথে। কোনভাবেই কাউকে আঁধারে ডুবে যেতে দিবি না। আর এটা শুধু আমার না আমাদের আনন্দবাড়ির প্রতিটি সদস্যের চাওয়া তোর কাছে। তাই আর কখনো এভাবে দুর্বল করিস না আমাকে। তা না হলে কিন্তু আমি রাগ করবো তোর উপর। এবং ইয়া বড় সদ্য প্রসূত কবিতা উপহার দিয়ে সেই রাগ তোকে ভাঙাতে হবে।  

কোন পরিস্থিতিতে বাবা কি বলবেন সবই নূহার মুখস্ত। তাই এই মূহুর্তে উঠে যে এই কথাগুলোই বলতেন বাবা তাতে কোনই সন্দেহ নেই। অশ্রু সিক্ত চোখে হেসে ফেললো নূহা। মাথা ঝুঁকিয়ে বাবার হাতে আদর দিয়ে বলল, আই এম সরি বাবা। আমি সত্যিই কান্না করতে চাইছি না। কিন্তু স্টুপিড চোখের পানি কেন জানি না চাইতেও ঝরেই যাচ্ছে বিনা ইনভাইটেশনে আসা হঠাৎ বৃষ্টির মতো। তুমি রাগ করো না প্লীজ। কি করবো বাবা বলো? আমার ভাবনারা যে আজকাল খুব বেশি স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে। শুধু নিজেকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। জানো বাবা এই হসপিটাল টাকে আমার খুবই শান্তির জায়গা মনেহয়। যখন এখানে আসি, বিভিন্ন ধরণের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সাথে কাউকে যুদ্ধ করতে দেখি, কাউকে রুখে দাঁড়াতে দেখি, কাউকে জয়ী হতে দেখি, আবার কাউকে সমঝোতা করে নিতে দেখি সমস্যার সাথে। অনেক প্রেরণা পাই। এই তো গতমাসেই বিয়ের সাড়ে আট বছর পর এক দম্পত্তি পিতা-মাতা হতে যাচ্ছিলেন। কি আনন্দই না ছিল তাদের  চোখে মুখে। সব কিছু স্বাভাবিক ছিল কিন্তু তারপরেও বেবীটা মায়ের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলো নিষ্প্রাণ, নিথর দেহে। সন্তানের নিষ্প্রাণ দেহ সহ্য করার মত ক্ষমতা ঐ মায়ের ছিল না। সেও চলে গেলো সন্তানের পিছু পিছু। তোমার মনে আছে বাবা আড়াই মাস আগে আমার দুই স্টুডেন্ট বিয়ে করেছিল। তুমি ওদের দেখে বলেছিলে, একেবারে টুনাটুনি। টুনা আর টুনি মিলে আমাদেরকে একদিন দাওয়াতও খাওয়াতে চেয়েছিল তাদের ছোট্ট মায়াবী নীড়ে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে কিনা জানা নেই। কারণ গত সপ্তাহে টুনি’টার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। মানুষের জীবনের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বেদনাগুলো যখন দেখি নিজের সমস্যাগুলোকে খুব ছোট মনেহয়। খুব বেশি ছোট মনেহয়। তখনো চোখে অশ্রু আসে তবে সেটা রবের প্রতি কৃতজ্ঞতার। মনেহয় ঐসব মানুষের তুলনায় আমার পরীক্ষাটা খুবই সহজ।

কিন্তু আজ কেন জানি না হসপিটালে এসেও স্বস্থি খুঁজে পাচ্ছে না মন। মনের মধ্যে শুধু খচখচ করছে আদী ভাইয়া পারবে তো আমাদের বাচ্চাদেরকে সুন্দর করে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে? আদী ভাইয়া সবসময় আমাদের জীবনের উত্থান-পতনের সাথী ছিলেন, সহযোগী ছিলেন। আমাদের মানসিক অবস্থা উনার চেয়ে ভালো আর কেউ বোঝেন না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোন কিছু নিজে বুঝা আর অন্যেকে বুঝানোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। প্রায়ই সময়ই কোন কিছু খুব ভালো করে বুঝার পরও, আমরা সেটা অন্যেকে বুঝিয়ে বলতে ব্যর্থ হই। এই ব্যর্থতার ভয়েই আমি কিংবা
জাওয়াদ বাচ্চাদের সাথে কথা বলার সাহস করিনি। ইমোশনাল হয়ে যাবার ভয়টা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে আমাদের। সেজন্যই বাচ্চাদের সাথে কথা বলার দায়িত্বটা আমরা আদী ভাইয়াকেই দিয়েছিলাম। বিশ্বাস ও ভরসা সবই আছে আদী ভাইয়ার উপর কিন্তু তারপরও কেন জানি না মন স্থির হতে পারছে না। আমি তোমার মন আরো বেশি খারাপ করে দিচ্ছি তাই না বাবা? আচ্ছা ঠিকআছে চলো অন্য কথা বলি। চলো তোমাকে কবিতা শোনাই। সদ্য প্রসূত মনের ভাবনাগুলো তোমাকে বলি। জানো বাবা অনেক দিন পেরিয়ে গিয়েছে মনের গহীনে চোখ রাখা হয়নি। দেখা হয়নি নতুন নতুন স্বপ্নের কলিদের আলোকের ঝর্ণাধারা হয়ে অবিরাম ঝরে পড়ার স্বপ্ন! শুক্লা দ্বাদশীর বাসন্তি রোশনির চারিধারে বিচ্ছুরিত হবার স্বপ্ন! নিশি রাতে হাসনাহেনার উজার করে গন্ধসুধা ঢালার স্বপ্ন! সুবহে সাদিকের সন্ধানে অক্লান্ত আরোহী হবার স্বপ্ন! শুকনো পাতায় মর্মর ধ্বনি তুলে সুহাসিনী ভোরে টিমটিমে শুকতারা রূপে আগমনের স্বপ্ন! ছোট্ট পাখী টুনটুনির ডানা ঝাপটানো কিচির মিচির তোলা স্বপ্ন! বইয়ের পাতায় ঝিলমিলে রোদের আলোর লুকোচুরি খেলার স্বপ্ন। মানবতার সেবায় আশা জাগানিয়া হবার নিভৃতচারী স্বপ্ন।

বাবার সাথে কথা বলাতে এতটাই নিমগ্ন ছিল নূহা হঠাৎ দরজার নক হবার শব্দ শুনে বেশ চমকে উঠলো। ঘুরে তাকিয়ে ফায়েজকে দাঁড়ানো দেখে চোখ মুছে সালাম দিয়ে বলল, জ্বি ভাইয়া?

সালামের জবাব দিয়ে ফায়েজ বলল, জাওয়াদ ফোন দিতে চাইছে। কথা বলবি এখন?

একটুক্ষণ চুপ থেকে নূহা বলল, উনাকে বলে দাও দশ-পনেরো মিনিট পর আমি ফোন দিচ্ছি ইনশাআল্লাহ।

ফায়েজ চলে যাবার পরও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বাবার পাশে বসে রইলো নূহা। এরপর বাইরে করিডোরে এসে দাঁড়িয়ে ফোন দিলো জাওয়াদকে। সালাম বিনিময়ের পর জাওয়াদ বলল, তুমি মনেহয় খুব বেশি টেনশন করছো নূহা। আমাদের দুজনের চাইতেও আদীর সাথে বাচ্চারা আনন্দময় সময় বেশি কাটায়। আদী ওদের কাছে অনেকটা খেলার সাথীর মতো। তাই আমাদের চেয়ে আদীই ওদেরকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবে ইনশাআল্লাহ। এরপর ওদের মনে সেসব প্রশ্নের জন্ম হবে সেসবের জবাব দেবার জন্য তো আমরা দুজন আছিই।

নূহা বলল, আমি আসলে ওদের কষ্টের কথা ভেবে বেশি অস্থির ফিল করছি। ওরা নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পাবে।

হ্যা অনেক কষ্ট পাবে। এতে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু তাৎক্ষনিক ভাবে সত্য যত কষ্টকরই হোক না কেন, কিছুটা সময় পেরোলে মানুষ সেটা ঠিকই মেনে নিতে পারে। আর সত্যের সবচেয়ে ম্যাজিকাল দিক তো এটাই। সত্য আঘাতের সাথে সাথে উপশমের কাজও করে। আমরা তো সবসময়ই আমাদের সন্তানদেরকে সত্যের পথে চলতে শিখিয়েছি তাই না? সর্বাবস্থায় সত্য বলার, যত কঠিনই হোক সত্য মেনে নেবার শিক্ষা তো আমরা ওদের প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যেই অন্তঃর্গত  করে দিয়েছিলাম। তাই ওদের কষ্টের কথা ভেবে তুমি অস্থির হয়ো না। এই বিষয়ে তো তুমি আমার চেয়েও বেটার জানো যে, বাচ্চারা কোন কিছুকে কিভাবে গ্রহণ করবে, কিভাবে বর্জন করবে। ওদের অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন কেমন হবে। এসব মূলত নির্ভর করে পিতা-মাতাকে ওরা  কিভাবে সমস্যা মোকাবিলা করতে দেখে সেটার উপর। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের সন্তানরা সর্বাবস্থায় ওদের বাবা-মাকে ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতেই দেখেছে। আল্লাহর উপর ভরসা করতে দেখেছে, বিশ্বাসে অটল থাকতে দেখেছে। ইনশাআল্লাহ ওরা সেই পথেই চলবে।

ইনশাআল্লাহ তাই যেন হয়। সত্য যেন ক্ষত তৈরির সাথে সাথে উপশমও দিয়ে যায় ওদেরকে। বাসার ঢুকে যেন আমাকে কারো চোখে অশ্রু দেখতে না হয়।

কখনো কখনো খুব ভালোবাসার কারো অশ্রুকেও ঝরে দেবার সুযোগ করে দিতে হয় নূহা। কারণ সত্যের দেয়া ক্ষতে অশ্রু অ্যান্টিসেপ্টিকের কাজ করে।

হেসে ফেলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে নূহা বলল, আমি রাখছি তাহলে এখন?

নূহা!

হুমম!

কখনো কখনো বেশ কয়েকটা জীবন এমন ভাবে একে অন্যের সাথে জট পাকিয়ে যায় যে সবার জীবন অক্ষত রেখে সেই জট খোলা অসম্ভব হয়ে যায়। জট খুলতে গেলে সেই জীবনগুলো সাথে জড়িত বন্ধন ছিঁড়ে যাওয়াটা এক রকম নিশ্চিত হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সেই জট না খুলতে যাবার মাঝেই বুদ্ধিমত্তা। সবচেয়ে কঠিন এই ব্যাপারটা বাচ্চাদেরকে বোঝানো। আজ রাতে যেহেতু ওরা তোমার কাছে থাকবে। ওদের প্রশ্নের জবাবে এই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করো।

জ্বি ইনশাআল্লাহ। রাখছি এখন। জাওয়াদের সাথে কথা বলার পর বেশ অনেকটা স্বস্থি ফিল করলো নূহা। মনের ঝিমিয়ে পড়া ভাবনারা আবারো সতেজ হয়ে উঠলো। গত এগারো বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে জাওয়াদ, নূহা, রাহাত আর আদী বাচ্চাদের ইতিবাচক চিন্তা-চেতনার অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। সেই হিসেবে আজ ছোট্ট একটা পরীক্ষার দিন। দেখা যাক অভিভাবক হিসেবে তারা আসলেই কতটা সফল। ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো নূহার। হঠাৎ মনে পড়লো গত এক সপ্তাহের সমস্ত অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করে দিয়েছিল সে। একজন ডক্টর হিসেবে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। পরিস্থিতি বিরূপ তাই জাওয়াদ কিছু বলছে না। কিন্তু বিষাক্ত কথার মোড়কে বিশাল এক লেকচার যে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে আসছে তার দিকে এতে কোনই সন্দেহ নেই। ভাবনা-চিন্তায় আর সময় নষ্ট না করে নিজের কেবিনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো নূহা।

নূহার সাথে কথা শেষ করে ফোন রেখে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো জাওয়াদ। হঠাৎ বুকের উপর কিছু একটা চেপে বসেছে যেন। জানালার কপাট খুলে দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে শ্বাস নেবার চেষ্টা করলো। নূহাকে সান্ত্বনা দিলেও বাচ্চাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে না চাইতেও বার বার সিক্ত হয়ে উঠছিল জাওয়াদের চোখ। এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরেও, এত কিছু বোঝার পরও, খুশি মনে সবকিছু মেনে নেবার চেষ্টা করার পরেও যেই স্মৃতির স্মরণ এখনো তার মনে হুবহু প্রথম দিনের সেই তীব্রতা নিয়েই প্রবাহিত হয়। কতটা কষ্ট পাবে সেই কথাগুলো যখন ঐ কচি প্রাণ গুলোর মাঝে প্রতিধ্বনি তুলবে? বাচ্চাদের চিৎকার শুনতে পেয়ে ঘুরে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। আদীর সাথে কথা বলার সময় বাচ্চাদের এক্সপ্রেশন, রিঅ্যাকশন কেমন হয় সেটা নিজ চোখে দেখতে চেয়েছিল জাওয়াদ। তাই আদীকে বলে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে নিয়েছিল যাতে দূরে থেকে হলেও দেখতে পায় সবাইকে। বিকেলের নাস্তার ব্রেক চলছিল এতক্ষণ অতীত ভ্রমণে। নাস্তা শেষ করেই চারজন আবারো ভ্রমণ শুরু করার জন্য চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। হেসে ফেললো জাওয়াদ। আদীর আইডিয়াটা বেশ মজার। বাস্তবেও এমন অতীত ভ্রমণে চলে যেতে পারলে মন্দ হতো না। অতীতের রিমিঝিমি বরষায় সিক্ত করে নেয়া সহজ হতো শুষ্ক, মরুময় অন্তরটিকে।

জাওয়াদ আর নূরির বিয়ের দিনে স্পেশশীপ নিয়ে যাবার জন্য চিৎকার করছে বাচ্চারা। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করলো জাওয়াদ। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। এই দিনটিকে মনেহয় তারচেয়ে ভালো করে আর কারো পক্ষেই বর্ণনা করা সম্ভব নয়। যদিও সেই  দিনটিকে ঘিরেও জাওয়াদ ঠিক যেভাবে স্বপ্ন দেখেছিল, প্রস্তুতি নিয়েছিল সেভাবে সংঘটিত হতে পারিনি কিছুই। দিনটির জন্য কত শত স্বপ্নই না বুনেছিল জাওয়াদ। পৃথিবীর কাউকে সে বলেনি সেই স্বপ্নের  কথা। এমনকি যাদের কাছে মনের কোন কথা কখনোই গোপন করে না সেই মা আর খালামনিদেরকেও কিছু বলেনি, আঁচ করতেও দেয়নি কিছু। কারণ তার মনের সেই কথাগুলো নূহাকেই প্রথম বলতে চেয়েছিল এবং অবশ্যই সেটা বিয়ের পর। নূহাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত মোটেই হুট করে নেয়নি জাওয়াদ। বরং বিয়ের সিদ্ধান্ত তো আরো অনেক আগেই নিয়েছিলো। শুধু অপেক্ষা করেছে সঠিক সময় আসার পর পরিবারকে নিজের ইচ্ছে কথা জানানোর। সবকিছু  যেভাবে চেয়েছিল, যেভাবে পরিকল্পনা করেছিল, ঠিক সেভাবেই হচ্ছিলো এবং সেভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্তু মানুষ হাজারো পরিকল্পনা নিতে পারে কিন্তু বাস্তবায়ন শুধু সেটাই হয় যেটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চান। আর আল্লাহর সিদ্ধান্ত ভিন্ন ছিল জাওয়াদ আর নুহার বিয়ের ব্যাপারে। ২৩ শে সেপ্টেম্বর যেদিন তাদের বিয়ে হবার কথা ছিল। সেদিন হসপিতালের বেডে শুয়ে থাকা নূহার দিকে তাকিয়ে এসব কথাই ভেবেছিল জাওয়াদ। তার পরিকল্পনা মতো সেদিন নূহার বধূ বেশে তার জীবনে প্রবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু একটা এক্সিডেন্ট সবকিছু ওলট পালট করে দিয়েছিল।  

শপিংয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রচন্ড আপত্তি নূহার। শপিংয়ে যাবার ভয়ে পুরোনো ড্রেস পড়েই বিয়ে করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু নূহার মামণি, খালামণিরা আর ফুপিরা কি আর সেই প্রস্তুতি মেনে নেবার মতো লোক? জোড় করে টেনে হিঁচড়ে ঠিকই নূহাকে শপিংয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শপিংয়ে যাবার পথেই এক্সিডেন্ট করে গাড়ি। অন্য সবাই কম বেশি আঘাত পেলেও ড্রাইভিংয়ে বসা ফায়েজ আর পাশের সীটে বসা নূহা আঘাত পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি। প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিল নূহা মাথায় এবং মেরুদন্ডে। ডাক্তাররা অবশ্য আশ্বস্ত করে বলেছিল ভয়ের কিছু নেই। শুধু মেরুদণ্ডের হাড় ফেটে যাবার কারণে হয়তো অনেকটা সময় বেড রেস্টে থাকতে হবে নূহাকে। অবশ্য এক্সিডেন্টের পর প্রায় তিন মাস বেড রেস্টেই ছিল নূহা। কিন্তু এক্সিডেন্টের ধকল সবাই কাটিয়ে উঠলেও বিয়ের জন্য নির্দিষ্ট দিনটি এসে পৌছুলে বাবা-মা, খালামণি-চাচ্চু কারো দিকে তাকাতে পারছে না জাওয়াদ। কেমন যেন থমকে গিয়েছিল চারপাশের সবাই, সবকিছু। জাওয়াদও গ্লাসের দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ তাকিয়ে ছিল নূহার দিকে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো নূহার পাশে গিয়ে বসতে। ‘আমি আছি তোমার পাশে সবসময়, সর্বাবস্থায়।’ এই কথাটি মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না সর্বদা। একটু স্পর্শ অনেক কিছু বলে দেয় মানুষকে। কিন্তু নূহাকে স্পর্শ করবে সেই অধিকার তো জাওয়াদের ছিল না । কিন্তু নূহার কাছে যাওয়ার, ওর মাথায় ভালোবাসা সিক্ত হাত বুলিয়ে দেয়ার অদম্য ইচ্ছাটা হঠাৎ করেই জাওয়াদের মনে নতুন একটা সিদ্ধান্তের জন্ম দিয়েছিল। বাবা-মা, চাচ্চু-খালামণি আর ফুপিদের ডেকে এনে বলেছিল, আমি তোমাদের সবাইকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি। আজ আমার আর নূহার বিয়ে হবার কথা ছিল। এবং আমি চাইছি আজই আমাদের বিয়ে হবে।

পরিবারের যে কয়জন সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিল সবাই অবাক চোখে তাকিয়েছিল জাওয়াদের দিকে। কিছুক্ষণ কারো মুখ দিয়েই কোন কথা বেড়োলো না। অনেকক্ষন পর জাওয়াদের বাবা রায়হান সাহেব বললেন, নূহা মার এই অবস্থায় বিয়ে? তুমি কি চিন্তা ভাবনা করে কথা বলছো তো জাওয়াদ?    

জবাবে জাওয়াদ বলেছিল,আমি চিন্তা ভাবনা করেই কথা বলছি বাবা। এই সময় নূহার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাকে। আর বিয়ে ছাড়া আমি সেভাবে ওর কাছে যেতে পারবো না যেভাবে যাওয়া উচিত। তোমরা সবাই সবসময় আমার সবকথা মেনে নাও। আজ আমি অনুরোধ করছি প্লীজ তোমরা কেউ আপত্তি করো না।

আজাদ সাহেব বললেন, কিন্তু নূহাকে আরো সপ্তাহ খানেক হসপিতালেই থাকতে হবে। এখন এখানে বিয়ে কিভাবে হবে?

সেই সব ব্যবস্থা আমি করবো চাচ্চু। তোমরা শুধু আমার সাথে থেকো। এবং জাওয়াদের অসাধারণ পরিবারের অসাধারণ সদস্যরা অন্য আর সব ব্যাপারেও মতো সেদিনও চুপচাপ জাওয়াদের কথা মেনে নিয়েছিল। সম্মতি দিয়ে দিয়েছিল সবাই। কিন্তু বেঁকে বসেছিল নূহা। পরিবারের সবাই ব্যর্থ হয়ে নূহাকে রাজী করানোর দায়িত্ব জাওয়াদের হাতেই তুলে দিয়েছিল। জাওয়াদকে ঢুকতে দেখেই চাদর মুখের উপর টেনে নিয়েছিল নূহা। তারপরও পাশে গিয়ে বসে জাওয়াদ বলেছিল, আমি জানি যা করতে চাইছি তা মোটেই স্বাভাবিক না। কিন্তু তবুও আমি অনুরোধ করবো আমার কথাটা তুমি বিনা যুক্তি তর্কে মেনে নাও। আমাকে আমার পুর্ণ অধিকার নিয়ে তোমার কাছে আসার সুযোগ করে দাও। নূহা কথা বলো প্লীজ।  

এই অবস্থায় বিয়ের কোন মানেই হয় না।

তুমি তো যুক্তি তর্ক শুরু করতে চাইছো। কিন্তু আমি শুধু চাইছি একসাথে আমাদের জীবনের পথ চলাটা শুরু করতে। হয়তো যেভাবে আমরা চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবে হচ্ছে না। হয়তো একটু অন্যরকম ভাবে হতে যাচ্ছে। এতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি শুধু আমাদের একাকার হওয়ার এই সুযোগটিকে হেলায় হারাতে চাইছি না। আমাদের যুগল জীবনে শুরুটাকে আমি থামিয়ে রাখতে চাইছি না। তাছাড়া এটা কিন্তু তোমার জন্য অনেক বড় একটা সুযোগ।   

সুযোগ? সেটা কিভাবে?

আচ্ছা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। বিয়ের প্রথম দিকে ভালোবাসার আবেগে অন্ধ থাকার কারণে স্বামী-স্ত্রী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একে অন্যের ব্যক্তিত্ব ও আটপৌরে স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে পারে না। অর্থাৎ, জীবনের পরবর্তি সময়ে দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা-বেদনা-অসুস্থতা-পুর্ণতা ইত্যাদির সময় সঙ্গী ঠিক কেমন আচরণ করবে সেটা বিয়ের প্রাথমিক স্টেজে বোঝা যায় না সচারচর। কিন্তু তোমার কাছে সুযোগ আছে যাচাই করে দেখার জীবনের দুঃখের সময়গুলোতে তোমার সঙ্গী কেমন আচরণ করবে তোমার সাথে। তোমার জায়গায় আমি হলে কখনোই এই সুযোগ ছাড়তাম না। আর বুদ্ধিমতি মেয়ে হিসেবে তোমারও ছাড়া উচিত না এই সুযোগ।

জাওয়াদের কথা শুনে মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে নিয়েছিল নূহা। চাপা হাসির বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে পড়েছিল নূহার পুরো চেহারা জুড়ে। মুগ্ধতা আর ভালোবাসা মেশানো কন্ঠে মিষ্টি হেসে প্রশ্ন করেছিল, তুমি সব কথা এতো সুন্দর করে কিভাবে বলো?  

জাওয়াদ হেসে জবাব দিয়েছিল, আলহামদুলিল্লাহ্‌! এসব আমার সিক্রেট কাউকে বলি না।

আমাকেও বলবে না?

যে কথা কাউকে বলি না সে কথা তোমাকে বলবো কেন? তুমি কি স্পেশাল কেউ নাকি? হ্যা এটা ঠিক যে আমি চাইছি তুমি আমার স্পেশাল কেউ হও। কিন্তু আপত্তি তো তুমিই করছো। কিছুক্ষণ নীরবতার পর আবারো জাওয়াদ বলেছিল, নূহা আমি বিশ্বাস করি তুমি আমাকে সারাজীবন অনেক সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত উপহার দেবে। আমার মন বলে কোনদিন তোমার কাছ থেকে আমাকে চেয়ে কিছু নিতে হবে না, তার আগেই তা তুমি আমাকে দেবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আজ অন্যরকম বিয়ের অন্যরকম একটি মুহুর্ত আমি তোমার কাছে চাইছি। তুমি দেবে না আমাকে?

কান্না ভেজা কন্ঠে নূহা জবাব দিয়েছিল, শুধু একটি কেন আমি আমার জীবনের সব মুহুর্ত শুধু তোমাকেই দিতে চেয়েছি সবসময়। আমার একটুও আপত্তি নেই বিয়েতে। কেন জানো?

কেন?

কারণ আমি খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে। আর সঙ্গীকে যাচাই করার এতো বড় সুযোগ ছাড়তে আমি নারাজ।

দু’চোখ ভর্তি অশ্রু ছিল কিন্ত হেসে ফেলেছিল দুজনই। এরপর যতবারই জীবনের সেই মাহেন্দ্র ক্ষণে গিয়ে দাঁড়িয়েছে জাওয়াদ। প্রতিবারই আনন্দ-বেদনার মিশ্র স্রোতে ভেসেছে। আজও ব্যতিক্রম হলো না। সেদিনের সেই স্মৃতি আজও জাওয়াদের মনে একই সাথে জোছনার শিশির ঝরানো মরুঝড় তুলে দিয়ে গেলো।      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন