রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি.....৭




কি রে মা এমন আত্মমগ্ন হয়ে কি ভাবছিস? নূহার পাশে বসতে বসতে প্রশ্ন করলেন আরমান সাহেব।

রাহাত আর বাচ্চারা অনেকটা জোড় করেই হসপিটালের পাশের পার্কে নিয়ে এসেছিল নূহাকে। কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ানোর পর বাচ্চারা ফুটবল খেলার বায়না ধরলে রাহাত গিয়ে বল কিনে নিয়ে এলো। এরপর সবাই মিলে ফুটবল খেলতে শুরু করলে নূহা একপাশে বসে খেলা দেখছিল।

প্রশ্ন শুনে মামার দিকে তাকিয়ে নূহা হেসে বলল, সবার খেলা দেখছি মামা। কিন্তু তুমি আমাদের খুঁজে পেলে কিভাবে?

আরমান সাহেব হেসে বললেন, রাহাতকে ফোন করেছিলাম। তখন জানালো পার্কে ফুটবল খেলা হচ্ছে। শুনে আমিও খেলার জন্য ছুটে এসেছি।  

তাহলে খেলতে না গিয়ে এখানে বসে আছো কেন?

কিছুক্ষণ বসি তোর কাছে। দূর থেকে দেখে মনেহচ্ছিলো গভীর কোন ভাবনায় নিমজ্জিত। কি ভাবছিলি এমন করে?

জানি না মামা ঠিক কি ভাবছিলাম।

কি ভাবছিলি সেটা নিজেই জানিস না? এমন সব অদ্ভুত কথা শুরু তোদের কাছে এলেই শোনা যায়। হাসি মুখে বললেন আরমান সাহেব।  

হাসলো নূহাও। একটু ক্ষণ চুপ থেকে বলল, আসলে ভাবনাতে আলো ফেলতে চাইছি না এই মূহুর্তে। মনের কিছু কিছু ভাবনা আঁধারে থাকাই ভালো। জানো মামা অবচেতনে নানান ধরণের ভাবনা আমাদের মনে প্রবাহিত হতেই থাকে। চেতন মনের ল্যান্সে সেখান থেকে অল্প কিছু ভাবনাই ধরা পরে। অতঃপর সেগুলো ডেভলপড হয়ে আমাদের সামনে আসে। কিন্তু কিছু কিছু ভাবনাকে  ডেভলপড করতে নেই মামা। সেগুলো নেগেটিভ হয়ে ক্যামেরার মধ্যে বন্দী থাকাই উত্তম।

হয়তো বা। কিন্তু আমার তবুও খুব জানতে ইচ্ছে করে তোর মনের অনুভূতিগুলোকে।

নূহা হেসে বলল, নিজের মনের অনুভূতিগুলোকেও সবসময় প্রকাশ করতে নেই মামা। এবং প্রকাশ করার আগে হিসাব-নিকাশ করে দেখা উচিত কাকে বলছি, কেন বলছি, বলার ফলাফল কি দাঁড়াবে। কারণ  সব কথা সবাইকে বলা যায় না, বলা উচিতও না। আর মনের কিছু কিছু অনুভূতিকে নিজের কাছেও কথাতে রূপান্তর করা ঠিক না। কিছু অনুভূতিকে হারিয়ে যেতে দিতে হয় মনের অতলান্ত সাগরে, গহীন গহ্বরে কিংবা ব্ল্যাক হোলে।

আরমান সাহেব হেসে বললেন, তোদের সাথে কি আর আমি কথায় পারবো। তারচেয়ে চল বাদাম খাই মামা-ভাগ্নী মিলে। তোর জন্য নিজ জাতে বীট লবণ দিয়ে আমন্ড ফ্রাই করে দিয়েছে তোর মামী। সেই কখন থেকে প্যাকেট সাথে নিয়ে ঘুরছি।  

হেসে মামার হাত থেকে বাদামের প্যাকেট নিলো নূহা। কিছুক্ষণ চুপচাপ বাদাম খাবার পর বলল,বাবা একদিন বলেছিলেন, ক্ষেতে কৃষক যে বীজ বোনে সেই ফসলই ঘরে তোলে। ঠিক তেমনি মানুষের মনেও তুমি যা বুনবে তাই ফিরে পাবে। আমার নিজ অভিজ্ঞতায় মনের ব্যাপারে বাবার কথাটা অবশ্য সবসময় সত্য বলে প্রমানিত হয়নি। ভালো কিছু বোনার পরেও অনেক সময় একদম বিপরীত কিছু ফিরে পেতে হয়েছে অনেক মনের কাছ থেকেই। একসময় ব্যথিত হতাম খুব এটা  নিয়ে। মনেহতো আমি এত ভালো ব্যবহার করছি তাহলে মানুষ কেন আমাকে কষ্ট দেয়? কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি যে, অনাবাদী জমির মত কিছু কিছু অনাবাদী মনও আছে। সেইসব মনে যত ভালো কিছুই বোনা হোক না কেন অনুর্বরতার কারণে অবিকশিতই থেকে যায়। যার ফলে উত্তম কিছু ফিরে আসার কোন সুযোগই থাকে না। আবার কত সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি কারণে উর্বর জমিরও তো ব্যর্থ হয় ফসল ফলাতে। তেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্বীকার তো মানুষের মনকেও হতে হয় অনেক সময়। তাই দোষ-গুণ যাচাই বাছাই ইত্যাদি ঝামেলাতে এখন আর যেতে চাই না। ভালোটা দিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করি। কারণ উত্তম প্রতিদান দেবার একমাত্র মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। প্রতিদান একমাত্র তাঁর কাছেই আশা করা উচিত।

একদম ঠিক বলেছিল। কিন্তু হঠাৎ এই কথা কেন মা?

খুব গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নূহা বলল, রাহাতের ভালোবাসার কাছে নিজের মনটাকে আমার মাঝে মাঝে অনুর্বর, অনাবাদী জমি মনেহয় মামা। নানান প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে লড়তে লড়তে যে মন প্রায় সবসময়ই ব্যর্থ হয় রাহাতের অফুরন্ত ভালোবাসার বদলে খুব আটপৌরে ভালোবাসা দিতেও। আর ফ্যাক্ট হচ্ছে, রাহাত সেটা বোঝে। খুব ভালো করেই বোঝে। কিন্তু সেটা ওর ভালোবাসাতে কোন প্রভাব ফেলে না। কখনো কোনদিন অবজেকশন করেও কিছু বলে না আমাকে। নীরবে, নিভৃতে ভালোবেসে যায় অবিচল। আর রাহাতের এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা শুধু আমাকে ঘিরেই না, আমার সন্তানদেরকে ঘিরেও আবর্তিত হয় সর্বক্ষণ। নিজেকে মাঝে মাঝে খুব স্বার্থপর মনেহয় মামা। খুব বেশি স্বার্থপর মনেহয়।  

কি বলবেন বুঝতে না পেরে নূহার হাতের উপর নিজের হাত রাখলেন আরমান সাহেব।  

মূহুর্ত খানিক চুপ থেকেই হাসলো নূহা। তারপর বলল, তবে কি জানো মামা এক শ্রেণীর মন আছে যাদের কাছ থেকে বিপরীত কিছু ফিরে পাওয়ার সুযোগ খুবই কম থাকে। বরং তাদেরকে যতটা ভালো বীজ দেয়া হয় তারা তারচেয়েও অনেক গুণ উন্নত মানের ফসল ফিরিয়ে দেয় বেশির ভাগ সময়ই। সেই মনগুলো ফুলের মত নরম, কোমল আর পবিত্র। মৌ মৌ মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে চারপাশকে বিমোহিত করে দেবার ক্ষমতা রাখে সেই কচি মনগুলো।

আরমান সাহেব হেসে বললেন, বাচ্চাদের কথা বলছিস?  

হুমম... বাচ্চাদের কথাই বলছি। বাচ্চাদেরকে প্রতিচ্ছায়া বা প্রতিচ্ছবিও বলা হয়ে থাকে। কারণ একজন মানুষের প্রতিচ্ছায়ার ক্ষমতা থাকে না এমন কোন কিছু করার যা সেই মানুষটির দ্বারা সংঘটিত না হয়। ঠিক তেমনি বেশির ভাগ সময়ই একটি শিশুকে যা করে দেখানো হয়। সে সেটাই করতে চেষ্টা করে বা করে দেখায়। জিহাদ, জিশান, নাবিহা, জারিফ ওরা ওদের পাপার সাথে যেমন উচ্ছল, প্রাণবন্ত এবং হাসি-আনন্দে মেতে থাকে, ওদের বাবার সাথেও ঠিক তেমনটাই। কারণ ওরা জানে এবং বোঝে ওদের প্রতি পাপা এবং বাবা উভয়ের ভালোবাসাই অনেক গভীর। ওরাও তাই ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা বড়রা এত সহজে কারো ভালোবাসাকে মূল্যায়ন করতে পারিনা। কারণ আমাদের মনটা শিশুদের মতো নরম, কোমল আর পবিত্র নয়। কাউকে ভালোবাসার পেছনে যেমন আমাদের অনেক কন্ডিশন থাকে, তেমনি কারো ভালোবাসা মেনে নেবার ক্ষেত্রেও আমাদের মন নানান কন্ডিশন সেট করে রাখে।

তোর মনটা আজ খুব বেশি খারাপ তাই না মা?

নূহা হেসে বলল, মন যে আকাশের মতো মামা। কেউ শত চেষ্টা করলেও সবসময় একই অবস্থায় স্থির রাখতে পারে না মনকে, এটা সম্ভব নয়। তাই মনে কখনো বেদনা জমবে, কখনো মন  অঝোর কাঁদবে, কখনো মেঘে ঢেকে যাবে মনের আকাশ, চলবে সূর্যের সাথে লুকোচুরি খেলা। কখনো  আবার মন থেকে ভেসে আসবে গুড়গুড় ধ্বনি, চমকাবে বিজলী, ভাসবে বাতাসের সাথে, ঝরবে জোছনার শিশির, ফুটবে তারার ফুল। আড়মোড়া ভেঙে হাজির হবে সুহাসিনী ভোর হয়ে, আবার শুকনো পাতার মত টুপ করে ঝরে যাবে সূর্যাস্তের গহীনে। সো মামাজ্বি জাস্ট চিল হয়ে যাও।

আরমান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তুই আসলেই পাগলী বুঝেছিস।  

পাগলী কিনা জানি না। তবে মামা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আমার সাথে অতীতে যা ঘটেছে, বর্তমান যে সময়ের মধ্যে দিয়ে পেরোচ্ছি, ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটার অপেক্ষায় দন্ডায়মান, সবকিছুর মাঝেই আমার এবং আমাদের সবার জন্য কল্যাণ নিহিত আছে ইনশাআল্লাহ। চিন্তার সীমাবদ্ধতা ও দূরদৃষ্টির অভাবে আমরা এখন কল্যাণ খুঁজে নিতে পারছি না। কিন্তু কখনো না কখনো কল্যাণ আমাদের সামনে উন্মোচিত হবেই। আর যদি নাও বা হয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে এসবের উত্তম প্রতিদান দেবেন।  

ইনশাআল্লাহ। তুই সত্যিই অনেক আশাবাদী স্বভাবের মানুষ মা।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমি নিজেও এটা ফিল করি মামা যে, ভয়াবহ রকমের আশাবাদী মানুষ আমি। রূপক অর্থে কবি বলেছেন-"আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি।” আমিও আল্লাহর অশেষ রহমতে বেদনার চোরাবালিতে আকণ্ঠ ডুবে থেকেও দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে  আশার গান গাইতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ। শুধু একটা সমস্যা আমার।

কি?      

কারণে অকারণে চারপাশে ডালপালা ছড়ানো বদভ্যাস আছে আমার চিন্তা-ভাবনাদের। চিন্তার বীজ শুধু বপন  করতে দেরি, মূহুর্তেই ডালপালা ছাড়িয়ে মহীরুহতে পরিণত হয়ে যায়। তারপর এই ডাল থেকে সেই ডালে দোল খেতে থাকে। এক পাতা থেকে আরেক পাতায় লাফিয়ে বেড়ায়, লুকোচুরি খেলে। এখন তাই চিন্তাদের ফিউজ উড়িয়ে দিয়ে চলো ফুটবল খেলতে যাই।

তুই ফুটবল খেলবি? চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলেন ওসমান সাহেব।

আমার কাছাকাছি চলে এলে দু’একটা কিক না দিয়ে কি আমি ছেড়ে দেব নাকি বলকে। কথায় আছে না, সুযোগ পেলে পিপড়াও লাথি মারে হাতিকে। এখানে বলের তুলনায় আমিই তো হাতি।   
স্বশব্দে হেসে ফেললেন ওসমান সাহেব। এরপর মামা-ভাগ্নী খেলোয়াড়দের উদ্দশ্যে রওনা দিলো। 

@

বেডরুম, বাগান কোথাও জাওয়াদকে না পেয়ে এত রাতে আবার কোথায় গেলো ছেলেটা ভাবতে ভাবতে বাচ্চাদের রুমে উঁকি দিয়ে জাওয়াদকে দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন খাদিজা বেগম। আগেই বোঝা উচিত ছিল আজ জাওয়াদকে এখানেই পাওয়া যাবে। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে সারাক্ষণই বাচ্চাদের আশেপাশে থাকার চেষ্টা করে জাওয়াদ। আজ বাচ্চাদের কেউই বাড়িতে নেই তাই মনের  অস্থিরতা কমানোর জন্য ওদের রুমে এসে বসে থাকাটাই স্বাভাবিক জাওয়াদের জন্য। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা কষ্টের দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখেই খাদিজা বেগম বললেন, তুই এখানে? আমি আরো পুরো বাড়ি খুঁজে এলাম তোকে! 

ভেতরে এসো মা। হাসি মুখে বললো জাওয়াদ।

ভেতরে ঢুকে ছেলের পাশে বসতে বসতে খাজিদা বেগম বললেন, ভেতরে তো তুই মানা করলেও ঢুকবো। এখানে এমন চুপ করে বসে আছিস কেন? বাচ্চাদের জন্য খারাপ লাগছে? একসাথে তিনজনকে নূহার সাথে ওর বাসায় পাঠিয়ে দেবার কি দরকার ছিল?  

বিছানা থেকে নেমে নীচে কার্পেটে বসে মায়ের কোলে মাথা রেখে জাওয়াদ বলল, তোমার বোনের কন্যাকে খুব বেশি আপসেট দেখাচ্ছিল মা। বাচ্চারা কাছে থাকলে ওর মন ভালো থাকবে, সময় ভালো কাটবে। নিজে অস্থির হবে না, অন্যদেরকেও অস্থির করবে না।  

খাদিজা বেগম হেসে বলল, হ্যা নূহাকে কিভাবে শান্ত রাখতে হবে সেটা তোর চেয়ে ভালো আর কেই বা জানে। কিন্তু নূহাকে স্থির রাখতে গিয়ে তুই নিজে যে অস্থির হয়ে যাচ্ছিস সেটার কি হবে?

আমি তো আর তোমার বোনের আধ পাগল কন্যার মতো নিজের অস্থিরতা চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছি না। আমি সন্তানদের জন্য আমার এই অস্থিরতাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছি।
উপভোগ করার চেষ্টা করছিস?

হুম, বুঝলে মা জীবন যখন আমাদের জন্য অ্যাকশন সিন ক্রিয়েট করে। আমাদের উচিত রিঅ্যাকশন না দেখিয়ে সেটাকে বরং এনজয় করা।

আদর করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন খাদিজা বেগম। অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন বিষয়ক কথা শুনে খপ করে এক মুঠো চুল চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, তোর শখ যত ইচ্ছে অ্যাকশনকে এনজয় কর। আমি তো রিঅ্যাকশনই করবো।কিছু না বলে হাসতে শুরু করলো জাওয়াদ। চুল ছেড়ে এবার খপ করে ছেলের কান চেপে ধরে খাজিদা বেগম বললেন, এই সারাক্ষণ নূহাকে আমার বোনের কন্যা, বোনের কন্যা বলিস কেন?  

জাওয়াদ হেসে বলল, মা তোমার বোনের কন্যাকে ফোন করে একটু খোঁজ খবর নাও। বাচ্চাদের পেয়ে সে নিজেও তো বাচ্চা হয়ে যায়। দেখা যাবে নিজেও কিছু খাবে না, আমার বাচ্চাদেরকেও কিছু খেতে দেবে না। চিল্লাপাল্লা করতে করতে একসময় সবাই না খেয়েই ঘুমিয়ে যাবে। 

কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিলাম। রাহাতের সাথে কথা হয়েছে আমার। বললো, রাতে সবাই মিলে বাইরে খেতে গিয়েছিল। ক্লান্ত তাই সবাইকে নিয়ে নূহা ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন তুইও ঘুমোতে যা।  

তুমি যাও মা শুয়ে পড়ো। আমি আরো কিছুক্ষণ এখানে থাকবো।

উঠতে গিয়েও আবার বসে খাজিদা বেগম বললেন, তুই নাকি আরমানকে বলেছিস আমাদের ভাইবোনদের সাথে বৈঠকে বসবি?

হ্যা তোমাদের পাঁচ ভাইবোনের সাথে কথা বলাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে মুয়াজ মামা আর ছোট খালামণির সাথে। উনারা দুইজন সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করেন নূহাকে। উনাদের দুজনের সমস্যাটা কি মা বলো তো? অসংখ্যবার উনাদেরকে বুঝিয়ে বলেছি আমার আর নূহার ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার না করতে। তুমি আর মামণিও ভালো থাকো থাকো হঠাৎ ক্ষেপে ওঠো। মা তোমরা সবাই মিলে কেন আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দাও না?

কারণ আমরা সবাই তোদেরকে ভালোবাসি। তোদেরকে সুখী দেখতে চাই।

আমি কি কোনদিন তোমাদের কাউকে বলেছি খুব কষ্টে আছি? নাকি নূহা কখনো বলেছে? তাহলে?

মুখে বলতে হবে কেন? আমরা কি দেখে বুঝি না?

চোখ তো এক্সরে মেশিন না মা। বাইরে থেকেই দেখেই সবসময় তাই মানুষের ভেতরের অবস্থা বোঝা যায় না। যারা মানুষের বাইরের অবস্থা দেখে ভেতরকে আন্দাজ করার চেষ্টা করে, তারা বেশির ভাগ সময়ই ভুল বোঝে মা। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা কি জানো? প্রায়ই সময়ই সন্তানদেরকে বেশি সুখী করতে গিয়ে বাবা-মা কিংবা অভিভাবকেরা তাদের জীবনে দুঃখকে ত্বরান্বিত করে। আমার আর নূহার ক্ষেত্রেও ঠিক এই কাজটিই করছো তোমরা। মা আমাদের দুজনের সাথে যা কিছু ঘটেছে নিয়তির লিখন মনে করে আমরা সেটাকে মেনে নিয়েছি। পরীক্ষা মনে করে উত্তীর্ণ হবার লক্ষ্যে নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু তোমরা বার বার আমাদেরকে বাঁধাগ্রস্ত করছো, আমাদেরকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছো।

আমরা তোদের জীবনে দুঃখকে ত্বরান্বিত করছি? তোদেরকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছি? আহত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন খাদিজা বেগম। 

সরি মা আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু মা তোমরা কেন বোঝার চেষ্টা করছো না সুখ কিংবা দুঃখের নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে নেই। যত যাই কিছু করো না কেন তোমরা আমাদের নিয়তিকে বদলাতে পারবে না। যতটুকু পরিমাণ কষ্ট আমাদের ভাগে আছে তার সবটুকু আমাদেরকে  ভোগ করতেই হবে। তোমাদের দেয়া বাঁধ আমাদের জীবনের কষ্টের স্রোতকে রুখতে পারবে না। আর তাই যখন আমরা কোনকিছুকে বদলাতে পারবো না, আটকাতে পারবো না। তখন সেটাকে মেনে নেবার মাঝেই কল্যাণ। তাছাড়া এই মেনে নেবার ফলে জীবনটাও অনেক সহজ হয়ে যায়। চলার পথের অনেক গর্ত এমনিতেই ভরাট হয়ে যায়।  

তুই আবার বিয়ে করতে রাজী হয়ে যা। তাহলে আমরা আর কিছুই বলবো না।  

জাওয়াদ হেসে বলল, একেই মনেহয় বলে সারারাত সাপ মারলাম এখন দেখি দড়ি।

তোর সমস্যাটা কি বিয়ে করতে? এখন তো তোর বাচ্চারা বড় হয়ে গিয়েছে।

সেটাই তো কথা। আলহামদুলিল্লাহ বাচ্চাদেরকেই যেখানে আমি একা একা বড় করে ফেলেছি। তাহলে বিয়ে করতে যাবো কোন দুঃখে? মা বিয়ে করলে আমি এগারো বছর আগেই করতাম। তখন যেহেতু করিনি এখন তো প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া কোথায় আমি আমার মেয়ের বিয়ের স্বপ্ন বুনছি, আর তুমি কিনা কি সব উল্টো পাল্টা চিন্তা করছো।

মেয়ের বিয়ের স্বপ্ন বুনছিস? ফাজিল তোর মেয়ের বয়স মাত্র সাড়ে তেরো বছর।

ওহো মা আমি তো বলছি না এখনই মেয়ের বিয়ে দেবো। স্বপ্নকে আঁকার জন্য মাত্র সাদা ক্যানভাস আর রঙ-তুলি জোগাড় করা হয়েছে। জানোই তো মেয়েদের ব্যাপারে বাবারা কতোটা বেশি সেন্সেটিভ হয়। তাই প্রথমেই রঙের ব্যবহারে যেতে চাই না। পেন্সিলে আগে আলতো করে এঁকে নিয়ে চাই স্বপ্নটাকে। যাতে প্রয়োজনে কোন অংশ চাইলে মুছে নতুন ভাবে আঁকা যায়। এরপর আরো কত শত কাজ। সবকিছু মিলিয়ে গুছিয়ে আনতে তো তিন-চার তো লেগেই যাবে।    

খাদিজা বেগম হেসে বললেন, তিন-চার বছরে কতটুকুই বা বড় হবে তোর মেয়ে? নূহার কানে একবার গেলে তোর কি দশা করবে জানিস?

জাওয়াদ হেসে বলল, তাহলে এক কাজ করো মা। আগামীকাল হসপিটালে গিয়ে কৌশলে আমার স্বপ্নের কথা তোমার বোনের কন্যার কানে পৌঁছে দিয়ে এসো। আজকাল সারা হসপিটাল ঘুরে ঘুরে এই মেয়ে শুধু কান্না করে। আমার এত সাধের হসপিটাল না শেষে ওর চোখের নোনা পানির স্রোতে ভেসে যায়। আমি খুবই আতঙ্কে দিনকাল কাটাচ্ছি। তাছাড়া কাউকে অকারণে নাক টেনে টেনে কান্না করতে দেখলে কি পরিমাণ মেজাজ গরম হয় বলো! এরচেয়ে লেডি টারজান হয়ে ক’দিন চিৎকার-চেঁচামেচি করুক সেও ভালো।

এত না প্যাঁচিয়ে সরাসরি বললেই পারিস নূহা যাতে কান্না না করে সেই ব্যবস্থা করে দাও মা। হাসতে হাসতে বললেন খাদিজা বেগম।

প্যাঁচিয়ে বলে তোমার নিউরণে অনুরণন হতে সহায়তা করছি মা। একজন নিউরো সার্জন হিসেবে মায়ের নিউরনকে দৌড়ের উপর রাখাটাও আমার ডিউটি।   

জাওয়াদকে মেরে উঠে দাঁড়িয়ে খাদিজা বেগম বললেন, তোর আগডুম বাগডুম কথা শোনার চেয়ে ঘুমানো ভালো। গেলাম আমি। তুইও যা শুয়ে পর।

জাওয়াদ হেসে বলল, ওকে মা তুমি যাও। আমিও যাচ্ছি কিছুক্ষণের মধ্যেই ইনশাআল্লাহ।

খাদিজা বেগম চলে যাবার উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রায় সাথে সাথে মোবাইলে ম্যাসেজের শব্দ শুনতে পেলো। অনেকক্ষণ ধরে এই ম্যাসেজটির অপেক্ষাই করছিল জাওয়াদ। তাই ওপেন না করেই বুঝতে পারছে লেখা আছে, বাচ্চারা ঘুমিয়ে গিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ ওরা ভালো আছে, আনন্দেই ছিল সারাদিন। টেনশন না করে ঘুমিয়ে পড়ো। ফী আমানিল্লাহ।  

জানা থাকার পরও হাত বাড়িয়ে মোবাইল তুলে নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করলো জাওয়াদ। হাসলো আপন মনেই। কতটা অলস হলে একই ম্যাসেজ কপিপেস্ট করে বছরের পর বছর পার করে দিতে পারে কোন মেয়ে? নতুন একটি শব্দও থাকে না কিন্তু তারপরেও প্রতিবারই বাচ্চাদের দুরুত্বের কারণে জাওয়াদের অশান্ত মনে প্রশান্তির ফল্লুধারা নিয়ে আসে নূহার ছোট্ট ম্যাসেজটি। নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে যেতে পারে। আজও ব্যতিক্রম হলো না। ম্যাসেজ পড়ার পর শান্ত মনে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো জাওয়াদ। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন