রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...১৮




গাড়িতে বসেই ছোট ভাইয়াকে হাসপাতালের নীচের বাগানে দাঁড়ানো দেখতে পেয়েছিল নূহা। সাথে সাথেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো মন। ছোট ভাইয়া মানেই সারাটা সময় আড্ডাময়। ভাইয়া যে তার কথার স্রোতে ভাসিয়ে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় তার কোন ইয়াত্তাই থাকে না। যারা বলে মেয়েরা বেশি কথা বলে তাদের সবাইকে একবার করে ছোট ভাইয়াকে দেখাতে ইচ্ছে করে নূহার। দশটা মেয়েকে ব্লেন্ডারে দিয়ে মিক্স করার পরেও ছোট ভাইয়ার মতো একজন কথা বলা ছেলে বের হবে কিনা সন্দেহ। গাড়ি পার্ক করে ছোটবেলার মতোই লাফাতে লাফাতে ছোট ভাইয়ার দিকে ছুট লাগালো। অবশ্য কিঞ্চিৎ পার্থক্য ছিল ছোটবেলার সাথে। ছোটবেলায় নূহার লাফ গুলো ছিল শারীরিক আর এখনের গুলো মানসিক।

নূহাকে দেখে হুমায়ূনও হাসি মুখে এগিয়ে এলো। দুই ভাইবোনের সালাম ও কুশলাদী বিনিময়ের পর হুমায়ূন বলল, চল আমার সাথে।

নূহা বলল, কোথায়?

হুমায়ূন বলল, জাওয়াদ ভাইয়া কথা বলবে তোর সাথে। অপেক্ষা করছে রেস্টুরেন্টে।

জাওয়াদের কথা বলতে চাইছে শোনার সাথে সাথে আনন্দাভাব কেটে গিয়ে উদ্বিগ্নতা ঘিরে ধরলো নূহাকে। গতকালের ঘটনায় উনি যে বিরক্ত হবেন সেটা জানাই ছিল। হাসপাতালে আসার উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠে বসার পর থেকেই মনের কোনে ভীতি ভাব উঁকি দিয়ে গিয়েছিল। বাচ্চাদের ব্যাপারে খুব বেশি সতর্ক থাকেন জাওয়াদ। নিজে হাজারটা সমস্যা ফেস করেও বাচ্চাদেরকে সবকিছু থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করেন। সেখানে তার গতকালের কান্ডে বাচ্চারা অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া শুধু গতকালই যে ভুল হয়েছে তাই নয়। বাবা অসুস্থ হবার পর থেকে সেই যে তার কাজকর্ম সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবার প্রায় তিন মাস পেরিয়ে যাবার পরেও নিজের রুটিন ঠিক করতে পারেনি নূহা। শুধুমাত্র সপ্তাহে চার দিন ইন্সটিটিউটে ক্লাস নেয়া ছাড়া আর কিছুই করছে না নিয়মিত। যে কোন সময়েই জাওয়াদ তাকে ধরবে সেটার জন্য অবশ্য অবচেতনেই একটা প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু তারপরও হৃদকম্পনের গত বেড়ে গিয়েছে টের পেলো। পার্সোনাল আর প্রফেশনাল লাইফে মিক্সিং তাদের পরিবারের সবাই এড়িয়ে চলে। কিন্তু জাওয়াদ সবচেয়ে বেশি দৃঢ় এই ক্ষেত্রে। এমন কড়া কথা বলবে, না চাইতেও চোখে পানি চলে আসবে। কিন্তু চোখের পানি ঐ সময় বিন্দুমাত্র বিচলিত করবে না জাওয়াদকে। জাওয়াদের এই রূপকে খুব ভয় পায় নূহা। ছোটবেলা থেকেই পেয়ে আসছে। ছোট্ট মনের মাঝে ঢুকে যাওয়া ভয় বলেই মনেহয় জাওয়াদের কঠোরতার স্মরণ এখনো খুব ভীত ও শঙ্কিত করে।  

হুমায়ূন নূহার হাত ধরে টেনে বলল, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি চল। কিছুক্ষণ পর আবার ভাইয়ার ফ্লাইট আছে।

কোথায় যাচ্ছেন আবার?

স্কটল্যান্ডে।

উনি কি কথা বলবেন আমার সাথে?

নূহার মনের ভয়ের কথা অজানা নয় হুমায়ূনের। হেসে ফেলে বলল, আরে এত ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি তো থাকছিই তোর সাথে। তবে কি ব্যাপারে কথা বলবে আমাকে কিছু জানায়নি ভাইয়া। শুধু বললো তোর সাথে কথা বলবে। আমি যেন তোকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরের রেস্টুরেন্টে চলে আসি।

উনি আমাকে বকা দেবেন পিভি।

হুমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, এতই যখন ভয় পাস তাহলে বকা খাওয়ার কাজ না করলেই পারিস। এখন যেহেতু করেই ফেলেছিল তাই ঘ্যানঘ্যান করে কোন লাভ নেই। তাড়াতাড়ি চল নয়তো আবার দেরি করার জন্য তোর সাথে সাথে আমাকে বকা খেতে হবে।

দুরুদুরু মনে ভাইয়ের হাত ধরে রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকলো নূহা। রেস্টুরেন্টের টেরেসেও বসার ব্যবস্থা আছে। কখনো যদি সরাসরি কথা বলতে চায় এখানে বসেই বলে জাওয়াদ। এবং সবসময় সাথে করে ফায়েজ ভাইয়া আর হুমায়ূন ভাইয়াকে নিয়ে আসে। ফায়েজ ভাইয়াকে দেখতে পাচ্ছিলো নূহা দূর থেকেই। পাশে জাওয়াদ আছে সেটাও বুঝতে পেরেছিল। জাওয়াদ সবসময়ই ফায়েজ ভাইয়াকে আড়াল করে এমন ভাবে বসে যাতে উনার উপস্থিতি তো বোঝা যায় কিন্তু সরাসরি দেখার উপায় থাকে না।

চেয়ার টেনে নূহাকে বসতে দিয়ে নিজে ফায়েজের পাশে বসতে বসতে সালাম দিলো হুমায়ুন। নূহাও সালাম দিলো সবাইকে উদ্দেশ্যে করে। সালাম বিনিময়ের পর সবাই চুপ করে রইলো। বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবার পরও ভাইয়া আর নূহাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে হুমায়ূন বুঝতে পারলো কথা তাকেই শুরু করতে হবে। কারণ ফায়েজ ভাইয়া এমনিতেও কথা কম বলেন। নূহা আর জাওয়াদের বৈঠকেরও সবচেয়ে নীরব অংশগ্রহণকারী ফায়েজ। আরেকটু সময় অপেক্ষা করে হুমায়ূন বলল, আলহামদুলিল্লাহ তোমরা কি খেয়াল করেছো বাড়ির পরিবেশে বেশ পরিবর্তন এসেছে গত দু'তিন মাসে। ফাদার এন্ড মাদার গ্রুপের সদস্যদের আজকাল বেশ হাসি-খুশি, শান্ত-স্বাভাবিক মনেহয়। মা-মামণিরা বকাঝকা, মারধোরও কম করছে আমাদেরকে। বাপীকেও খিটপিট কম করতে দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাগুলো আরো বিচ্ছু হচ্ছে। কিন্তু আমরা সবাই তো যেমন ছিলাম তেমনই আছি। তারপরও সবার এই পরিবর্তনের পেছনে কারণ তাহলে একটাই হতে পারে। নূহার ঘন ঘন বাড়িতে যাওয়া। শোন নূহা আবার কিন্তু এই নিয়ম ভঙ্গ করিস না। খুব ভালো লাগছে আমাদের আনন্দবাড়িকে আবারো এমন আনন্দোচ্ছল দেখতে।

তোমাদের আদরের বোন নিয়ম অলরেডি গতরাতে ভঙ্গ করে ফেলেছেন একবার। ধীরে ধীরে বললো জাওয়াদ।  

মনে মনে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে আরেকটু হেলান দিয়ে বসলো হুমায়ূন। তার কথা শুরু করানোর মিশন সাকসেস ফুল। এখন শুধু নীরবে শুনে যেতে হবে জাওয়াদ আর নূহার কথা। এবং মাঝে একটু আধটু হুম, উহু ধ্বনির প্রয়োগে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হবে। নূহার দিকে তাকিয়ে দেখলো জাওয়াদের একটি বাক্যেই কাঁদো কাঁদো করে দিয়েছে চেহারা। বুকের ভেতর ব্যথা করে উঠলো হুমায়ূনের। তার সবচেয়ে আদরের বোন নূহা। ওর কষ্টের চিন্তাও তাই কষ্ট দিয়ে যায়। নূহাকে বাবা-মামণি মিলে যতটা না লালন-পালন করেছে তারচেয়ে বেশি করেছে তারা ভাইয়েরা নিলে। তাদের হাত ধরেই নূহা প্রথম এক পা, দু পা করে হাঁটতে শিখেছিল। যখন আধো আধো কথা বলতে শিখেছিল গোল হয়ে বসে ভাইয়া ডাক শেখাতো সবাই মিলে নূহাকে। হুমায়ূন কঠিন শব্দ ভেবে পরিচয় দেবার সময় নূহাকে নিজের ডাক নাম উল্লেখ করে বলতো, আমি হচ্ছি তোমার পল্লভ ভাইয়া। পল্লভকে নূহা উচ্চারণ করেছিল পভ। পভ বলেই ডাকতো প্রায় তিন বছর বয়স পর্যন্ত। এরপর প এবং ভ এর সাথে একটা করে ই-কার যুক্ত করে পিভি বানিয়ে নিয়েছিল নূহা। তারপর অনেক বছর পেরিয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনো নূহা পিভিই ডাকেই ডাকে। নূহার মুখে অন্য কোন ডাক অবশ্য শুনতেও চায় না হুমায়ূন। যখনই নূহার মুখে এই ডাক শোনে মনেহয় এখনো বুঝি সেই ছোট্টটিই রয়ে গিয়েছে নূহা। এখনই হয়তো অদ্ভুত কোন জেদ আঁকড়ে ধরবে। যেটা পালন করতে গিয়ে তাদের পাঁচ ভাইয়ের নাভিশ্বাস উঠে যাবে। যদিও এখন আর জেদ করে না নূহা। আর কোনদিন জেদ করবে না এই ওয়াদা করেছিল ভাইয়াদের কাছে সাড়ে এগারো বছর আগে। যেদিন রাহাতের সাথেই জীবনে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সবার অমত উপেক্ষা করে। যেদিন সেই বন্ধনটা ভেঙে গিয়েছিল, যেটা কিনা জন্মলগ্ন থেকে তাদের আনন্দবাড়ির আকাশে স্থায়ী পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে অবিরাম ঝরাতো জোছনার শিশির। যেদিন সেই দুজন মানুষ আলাদা হয়ে গিয়েছিল, যারা নিজেদের অজান্তেই একে অন্যের হয়ে গিয়েছিল।  

যখনই সেদিনের কথা মনে পরে যেদিন জাওয়াদ উপলব্ধি করেছিল জীবনসাথী হিসেবে নূহাকে ছাড়া অন্য কাউকেই ভাবতে পারে না। অজান্তেই স্বশব্দে হেসে ফেলে হুমায়ূন। এর আগে এত আপসেট কখনোই দেখেনি জাওয়াদকে। নিজের ব্যাপারে খুব বেশি সাবধানী স্বভাবের জাওয়াদ। নিজেই নিজের পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করা মানুষ। অন্যের ব্যাপারে সর্বদা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি রেখে চললেও, নিজের সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিও খুব যত্নের সাথে সংশোধন করে নিতো। জাওয়াদের যুক্তি ছিল একটি পরিবার এবং একটি সংগঠনের হেড আমি। আমার মধ্যেই যদি দোষ আর ঘাটতির ছড়াছড়ি থাকে, তাহলে বাকিরা কিভাবে নিজেদের ব্যাপারে সজাগ, সচেতন ও সতর্ক হবে। তাই ভুল করাটাকেও নিজের জন্য একরকম ভুল মনে করতো। জাওয়াদের প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণ ছিল একদম পারফেক্ট। বহু সাধনায় তিল তিল করে নিজেকে এমন করে গড়ে তুলেছিল। এবং তারচেয়েও কঠিন সাধনায় নিজের অবস্থান টিকিয়ে রেখে পথ চলতো। তাই নিজের ছোট বোনের মত করে যে মেয়েটিকে বড় করেছে, তাকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পেতে চেয়ে যখন মন বায়না ধরেছিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল জাওয়াদের জন্য। মনের এই চাওয়ার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জায় কুঁচকে যাচ্ছিলো বিবেক। বাবা-মায়েরা যখন তার এই চাওয়ার কথা জানবে কতটাই না বিস্মিত হবে। ছোট ভাইবোনেরা কি ভাববে তার সম্পর্কে? পরিবারের ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাকর ঘটনা হয়ে হয়তো জ্বলজ্বল করবে এটি। এমন আরো নানান ভাবনায় একদম ভেঙে পড়েছিল জাওয়াদ।


ছোটবেলা থেকেই তাদের জীবনের চলার পথ কখনোই খুব মসৃণ ছিল না। কিন্তু শত সমস্যার মাঝেও অনঢ়-অটল, সর্বদা সবার চেয়ে বেশি ইতিবাচক ছিল জাওয়াদ। হঠাৎ করে জাওয়াদের দুর্বল অভিব্যক্তি তাই নজর এড়িয়ে যায়নি ফায়েজ, আদী, রিসাব, সুবহা আর হুমায়ুনের। সবাই মিলে একদিন তাই ঘিরে ধরেছিল জাওয়াদকে কি হয়েছে সেটা জানার জন্য। প্রথমে তো কিছুতেই বলতে রাজী হয়নি কিন্তু তারা সবাই নাছোড় বান্দার মতো লেগে থাকার কারণে বাধ্য হয়ে জাওয়াদ বলেছিল, গত কয়েকদিন আগে ছোট নানাভাই এসেছিলেন। সবসময়ের মতোই কথায় কথায় বিয়ের প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন। আমি যখন বললাম বিয়ে করার মত কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। নানাভাই হাসতে হাসতে বললেন, 'চোখের দৃষ্টিতে মিলবে না তার সন্ধান, খুঁজে খুঁজে শুধুই হতে হবে তোমায় হয়রান। পেতে যদি চাও তুমি তার দেখা, অন্তরও মাঝে তাকাও ছবি আছে তার আঁকা'। ঐ সময় আমিও নানাভাইয়ের সাথে মজা করেছি। কিন্তু নানাভাই চলে যাবার পর কেন জানি মনেহল, সবাই যখন এত করে চাইছে আমি বিয়ে করি। আমারো বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত। কেন কোন মেয়েকেই আমার পছন্দ হয় না নিজের জন্য সেটার কারণও অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। এবং যখন আমি কারণ অনুসন্ধান করতে গেলাম। নানাভাইয়ের কথামতো নিজের মনের ভেতরটাতে ভালো ভাবে চোখ রাখলাম। আমি কোথাও কিছুই খুঁজে পাইনি, একমাত্র এবং শুধুমাত্র নূহাকে ছাড়া।  

জাওয়াদের এই স্বীকারোক্তি চমকে ও থমকে দিয়েছিল ঐ সময়ে ওখানে উপস্থিত প্রতেক্যেই। অস্ফুট স্বরে আর ইউ সিরিয়াস? বলে আবার নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল ফায়েজ। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে জাওয়াদ বলেছিল, তোদের মনেআছে দশ বছর আগে আমরা চাইল্ড সাইকোলজির উপর একটা শর্ট কোর্স করেছিলাম। তখন থেকেই চাইল্ড সাইকোলজির উপর আমার ভীষণ আগ্রহ। মূলত একটা শিশু কিভাবে চিন্তা করে, তার আশেপাশের জগতকে দেখে, পরিবারের মানুষদের আচরণ থেকে কিভাবে শিক্ষা নেয়। এক কথায় একটি শিশুকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমি নূহাকে বেছে নিয়েছিলাম। যদি একটা শিশুকে বুঝতে শেখার পর থেকেই উন্নত মূল্যবোধের আলোকে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। তাহলে তার ফলাফল কেমন দাঁড়াবে। এই এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে চেয়েছিলাম আমি। নূহার মধ্যে আমি প্রায়ই আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। কারণ ওকে আমি হুবহু আমার মনের ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা-প্রত্যাশার আলোকে গড়ে তুলেছি একদম ছোটবেলা থেকে। আর এখানেই আমার সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। পরিবারে কিংবা পরিবারের বাইরে সবার সাথে পর্দার বিধান মেনে চললেও নূহার সাথে সেভাবে মেনে চলা হয়নি আমার। নূহা বড় হয়ে গিয়েছে, আমরা একে অন্যের জন্য মাহরাম নই এই চিন্তারই উদ্রেক হয়নি কখনো মনে। তাই যতটা কাছ থেকে নূহাকে দেখার সুযোগ হয়েছে এমনটা আর কারো ক্ষেত্রেই হয়নি। সম্ভবও ছিল না। আমার মন তাই নূহাকে ছাড়া আর কাউকেই চেনে না। নূহা ছাড়া আর কেউ না কোন প্রভাব ফেলতে পারে আমার মনে, না মনকে আন্দোলিত করতে পারে। আমি জানি না এটা আমাকে দেয়া আল্লাহর শাস্তি কিনা। কেননা মুমিন তো মুখে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের ব্যাপারে নিজের কাছে স্বচ্ছ ও দায়মুক্ত থাকে। অথচ আমি পুরো বাড়িতে পর্দার বিধান কায়েম করার পর, নিজেই সেটা মেনে চলতে ভুলে গিয়েছি। নূহা তো ওর বাবা-মা-ভাই-বোন-বন্ধু সবকিছু মনে করে আমাকে। এত বেশি আদরে থাকে যে বড় হয়েছে সেই উপলব্ধি ওর মধ্যে না আসাটাই স্বাভাবিক। নূহা তাই ছুটে আসবেই আমার কাছে। আমার উচিত ছিল সতর্ক হওয়ায়, ততটুকুন দুরুত্ব তৈরি করা আমাদের মাঝে যা শরীয়ত বেঁধে দিয়েছে।  

জাওয়াদকে সান্ত্বনা দেয়া বা কিছু বুঝিয়ে বলার মত অবস্থাতে সেদিন কেউই ছিল না। হুমায়ূন নিজেও মানতে পারছিল না ব্যাপারটা। নূহার বয়স তখন পনেরোও হয়নি আর জাওয়াদের বয়স ছিল একত্রিশ। তবে শুধু বয়সেই তো নয় অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, পারিবারিক অবস্থান সবদিক দিয়েই বেমানান ছিল জাওয়াদের সাথে নূহা। সহজ ভাবে মেনে নেয়াটা তাই কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। সেদিন বাড়িতে ফেরার পর নূহাকে যখন দেখেছিল লাফাতে লাফাতে জাওয়াদের জন্য চা নিয়ে যাচ্ছে। জীবনে সেই প্রথম প্রচন্ড এক ধমক দিয়েছিল হুমায়ূন নূহাকে। জাওয়াদ পরের দিনই চুপচাপ নিউজিল্যান্ড চলে গিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই জাওয়াদ যখন দেশের বাইরে থাকতো প্রতিদিন একাধিক বার ফোনে কথা বলার অভ্যাস ছিল নূহার। কিন্তু নিজেকে নূহার কাছ থেকে একদমই গুঁটিয়ে নিয়েছিল জাওয়াদ। সবার ভালোর চিন্তায় সৃষ্টি করা এই দুরুত্বই নূহাকে উপলুব্ধ করিয়ে দিয়েছিল ওর জীবনে জাওয়াদের শূন্যতা। আবার যাতে তার দ্বারা কোন ভুল হয়ে না যায় এই ভয়ে ধীরে ধীরে পরিবার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছিল জাওয়াদ। আর হঠাৎ করে নিজেকে ঘিরে আবর্তিত সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটিকে দূরে সরে যেতে দেখে নিষ্প্রভ হয়ে যেতে শুরু করেছিল নূহা। যারফলে, একসময় ফায়েজ, আদী, রিসাব, সুবহা আর হুমায়ুনকে নিজেদের অমত বিসর্জন দিয়ে জাওয়াদকে বুঝিয়েছিল, আমরা সবাই যদি সম্মতি দেই তাহলে পরিবারের বড়রা সহজ ভাবেই মেনে নেবে ব্যাপারটা। কিন্তু রাজী হয়নি জাওয়াদ। তবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে এসেছিল। এবং পরিবারের অন্যান্য সবার মতো নূহার সাথেও পর্দার বিধান কঠোর ভাবে মেনে চলতে শুরু করেছিল।  

এরপর প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গিয়েছিল। তারা সবাই ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। পরিবারের সবাই মিলে হাসি-মজা ও গল্পগুজব করছিল এমন একদিন হঠাৎ পুরো পরিবারের সামনে জাওয়াদ নূহাকে বিয়ে করতে চায় এই ঘোষণা দিয়েছিল। শোনা মাত্রই বাবার হাত থেকে চায়ের কাপ নীচে পড়ে গিয়েছিল। বাকি সবাইও হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল জাওয়াদের দিকে। তবে আপত্তি করেনি কেউই একমাত্র নুসরাত খালামণি ছাড়া। কিছুদিন পরে অবশ্য খালামণিও রাজী হয়ে গিয়েছিলেন। এবং সবার চেয়ে বেশি দৌড় ঝাঁপ করেছেন বিয়ের আয়োজনে। আজকাল প্রায়ই হুমায়ূনের মনেহয় কতই না ভালো হতো ঐ সময় পরিবারের কেউ এই সম্পর্কটাকে মেনে না নিলে। কতই না ভালো হতো ভালোবাসার এমন উপাখ্যান গড়ার পর ভেঙে যাবার চেয়ে। শুরুই যদি না হতো এই গল্পের।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন