রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২




জাওয়াদের কাছ থেকে শুনে আসা কথাগুলোই গড়গড় করে পাঁচ বোন বলে দিলো নানাভাইকে। চুপচাপ বসে পাঁচ নাত্নীর বক্তব্য শোনার পর ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠলো আজাদ সাহেবের মুখে। হাসতে হাসতে বললেন, তোমাদের কথাতে তো নকলের গন্ধ পাচ্ছি আমি। নিশ্চয়ই আমি বাগান পরিচর্যার কাজে যাবার সুযোগে তোমাদের পাপার সাথে বৈঠক করে এসেছো তোমরা?

নাবিহা, মাঈশা, মুবাশ্বারা, কাশফিয়া, ইমামা পাঁচজনই হেসে কুটিকুটি হলো। আজাদ সাহেবও নাত্নীদের সাথে হাসিতে যোগ দিয়ে বললেন, তবে নকল করে বললেও তোমাদের কথাগুলো আমার অন্তর ছুঁয়ে দিয়েছে। আসলেই জীবনে শুধু এক জায়গায় আঁটকে থাকার সুযোগ নেই। সবাইকেই তাই সময়ের সাথে সাথে নিজ নিজ প্রয়োজন খুঁজে নিয়ে, বুঝে নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে জীবনের পথে। চলার পথেও জারি থাকে জীবনের রঙ বদলের খেলা। যারা সেই রঙ বদলের সাথে নিজেদেরকে রাঙিয়ে নিতে পারে তারাই পারে সহজ ও সুন্দর করে জীবনকে উপভোগ করতে। জীবনের সুহাসিনী ভোরের স্বাগত জানাতে তাই সবার আগে উন্মুক্ত করতে হবে অন্তরের রুদ্ধ দুয়ার। জ্ঞানের আলোয় স্থাপন করতে হবে আলোকিত বাতায়ন। সেই আলোকে রাহবার করে মনের আশা জাগানিয়া সত্ত্বাকে আঁকড়ে ধরে অক্লান্ত চলতে হবে সুবহে সাদিকের সন্ধানে। আলো আর আঁধারের সংমিশ্রণেই তাহলেই কেবল জীবন সেজে উঠবে রঙধনু সাজে ইনশাআল্লাহ।পাঁচজনই একসাথে ইনশাআল্লাহ বললো।

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, ছোটবেলা থেকে তোমাদের পাপা, মামণির চাচ্চুদের সবচেয়ে বড় স্পেশালিটি কি ছিল জানো?

পাপা, মামণির চাচ্চুদের সবচেয়ে বড় স্পেশালিটি কি ছিল দাদাভাই? প্রশ্ন করলো মুবাশ্বারা।

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, একদম ছোটবেলা থেকেই ওরা সবাই পরের তরে স্বার্থ দিয়া বলি স্বভাবের মানুষ। তোমরা নিশ্চয়ই জানো তোমাদের পাপা আর আদীব্বা বয়সে মাত্র কয়েকদিনের ছোট বড়। আদী ছোটবেলায় বেশ অসুস্থ থাকতো তাই বেশ কান্নাকাটি করতো। যখন মাত্র কোন কিছু দু’হাতে ধরতে শিখেছিল জাওয়াদ তখন থেকেই আদী কান্না করলেই নিজের হাতের খেলনাটা নিয়ে আদীর হাতে দিয়ে দিতো। দুজনকে পাশাপাশি শুইয়ে রাখা হতো সবসময়। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কত কথা যে বলতো দুই ভাই মিলে। ঐ সময় আমাদের আনন্দের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল ওদের দুই ভাইয়ের কর্মকান্ড। আরেকটু বড় হবার পর জাওয়াদকে কোন খাবার দিলে ততক্ষণ পর্যন্ত হাত বাড়াতো না নেবার জন্য যতক্ষণ না আগে আদীকে দেয়া হতো। ফায়েজ ওদের দুজনের চেয়ে এক বছরের বড় ছিল। দুহাতে দুই ফিডার নিয়ে জাওয়াদ আর আদীকে খাওয়াতো। মাঝে মাঝে আবার নিজেও দুইজনের ফিডার থেকেই একটু একটু করে ভাগ বসাতো।

খিলখিল করে হেসে ফেললো মেয়েরা। আজাদ সাহেবও হাসতে হাসতে বললেন, জাওয়াদ আর আদী হাঁটতে শেখার পর তিনজন একে অপরের হাত ধরে বাড়ি ভরে ঘুরে বেড়াতো। কাউকে বিরক্ত করতো না কখনোই। এরপর আমাদের জীবনে রিসাব, হুমায়ূন আর সুবহা এলো এক এক করে। ফায়েজ, জাওয়াদ আর আদী তখন তিনটা জীবন্ত খেলনা পেয়ে গিয়েছিল নিজেদের জন্য। এখনকার মতো এত স্বাচ্ছন্দময় জীবন ছিল না তখন আমাদের। সম্পর্কের বন্ধনগুলোও এত মায়াময় ও মজবুত ছিল না। কিন্তু ওদের ছয় ভাইবোনকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মায়ার এক ডোরে বেঁধেই দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন যেন। ঐ সময়টাতে অনেক ঝড় তুফান মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়েছে আমাদেরকে। ওরা ছয়জন সব ঝড় তুফানে আমাদের সবার অংশীদার ওবং সহযোগী হবার চেষ্টা করেছে। যখন একসাথে কয়েকজন চলে তখন নিজ যোগ্যতায় একজন নেতৃত্বের অবস্থান নির্ধারণ করেই ফেলে নিজের জন্য। জাওয়াদও তেমনি ওর স্বভাবগত উদারতা, বুদ্ধিমত্তা, সবাইকে বোঝা ও বোঝানো ইত্যাদি ক্ষমতা গুণে ওদের সবার মনে এবং পরিবারের বড়দের মনেও নিজের জন্য একটা স্পেশাল অবস্থান তৈরি করে ফেলেছিল নিজের জন্য। এরপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছিল আমাদের জীবনে। ঝড়, তুফান ছাড়িয়ে আমাদের পরিবার রোদেলা দিনের সন্ধান পেয়েছিল ততদিনে। এরমধ্যে পরিবারের আরো অনেক নতুন নতুন সদস্যের আগমন হয়েছিল। কিন্তু পরিবারের আরেকবার বদলের ছোঁয়া লেগেছিল যখন নূহা এসেছিল আমাদের জীবনে।

নাবিহা উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল, কি হয়েছিল তখন নানাভাই? আমাদেরকে ডিটেইল বলো প্লিজ। বাকি চারজনও নাবিহার কন্ঠে কন্ঠ মিলালো।

আজাদ সাহেব বললেন, পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্মায় শান্তির শ্বেত কবুতর উড়িয়ে পরিবর্তনের শুভ্র ঝাণ্ডা হাতে। এমন মানুষেরা জন্ম নেবার সাথে সাথেই চারপাশে বদলে যাও, বদলে যাও ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। এদের কেউ সমাজে লাগায় পরিবর্তনের ছোঁয়া, কেউ রাষ্ট্রে, কেউ বা দেশের গন্ডিকে ছাড়িয়ে শান্তির শ্লোগান কন্ঠে নিয়ে ছুটে যায় বহুদূর। আর কেউ কেউ আল্লাহ প্রদত্ত এই পরশ পাথরীয় ক্ষমতার মায়াবী স্পর্শে রাঙিয়ে দেয় নিজ পরিবার ও আশেপাশের মানুষদের বেরঙ ভুবনকে। নিজের রঙে চারপাশকে রাঙিয়ে দেয়ার এমনই বর্ণিল রঙের বাহার নিয়ে আমাদের জীবনে হাজির হয়েছিল নূহা। এরপর আমাদের জীবনে কখনোই নির্মল হাসি-আনন্দ ও অকৃত্রিম সুখের অভাব দেখা দেয়নি আলহামদুলিল্লাহ। ফায়েজ, জাওয়াদ, আদী, রিসাব, হুমায়ূন আর সুবহার চেয়ে বয়সে প্রায় পনেরো-ষোল বছরের ছোট ছিল নূহা। কিন্তু সমবয়সী ভাইবোনদের সাথে খেলাধূলা করার চাইতেও বড় ভাইয়া-আপুদের মাঝে চুপ করে বসে থাকাটাই বেশি পছন্দ ছিল নূহার। এভাবেই একসময় পরিবারের মূল স্তম্ভদের একজন হয়ে গিয়েছিল নূহা। ফায়েজ, জাওয়াদ, আদী, রিসাব, হুমায়ূন, সুবহা আর নূহাকে আমার রঙধনুর সাত রঙ মনেহয়। একে অন্যেকে ছাড়া যারা অসম্পূর্ণ। আর যাদের সাতজনকে ছাড়া আমাদের আনন্দবাড়ি বেরঙ, ফিকা, একদম সাদা-কালো।

কাশফিয়া বলল, আমরাও পাপা-মামণিদের মতো হবো ইনশাআল্লাহ।

ইমামা বলল, তোমাকেই কিন্তু আমাদেরকে গাইড করতে হবে দাদাভাই।

মাঈশা বলল, হ্যা দাদাভাই। কারণ তুমি পাপা-মামণিদেকেও সবসময় গাইড করেছো। মামণির যখনই কথা বলে সবসময় শুরু বলে বাবা এটা বলেছে, বাবা ওটা বলেছে। বাবার কাছ থেকেই আমি সবকিছু শিখেছি। আমরাও তোমার কাছ থেকে সবকিছু শিখে নিতে চাই ইনশাআল্লাহ।

তুমি আমাদেরকে শেখাবে তো দাদাভাই? আবদার ভরা আদুরে কন্ঠে প্রশ্ন করলো মুবাশ্বারা।

আজাদ সাহেব হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ। তোমাদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্যই তো একসাথে সবাকে নিয়ে বসা। অনেক বছর আগে আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে বলেছিলাম, যদি শুধু নিজের জন্যও উত্তম কিছু করতে চাও। তাহলে সবার আগে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে তোমাদেরকে। ভালো মানুষ হবার জন্য, ঠিকমতো নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করার জন্য তোমাদেরকে ভারসাম্য পূর্ণ চরিত্রের মানুষ হতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ভারসাম্যপুর্ন জীবন গড়ে তোলার নির্দিষ্ট কোন নিয়ম বা পদ্ধতি মানুষের হাতে নেই। এজন্যই পৃথিবী জুড়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন কোন অভাব নেই, তেমনি নব নব নিয়ম ও পদ্ধতিরও অভাব নেই। তবে আমরা মুসলিমরা অত্যাধিক সৌভাগ্যবান। কারণ আমাদের কাছে শুধু যে ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ হবার নিয়ম ও পদ্ধতি আছে তাই নয়, কিভাবে সেই সেই নিয়ম মেনে চলতে হবে সেই ব্যাপারে দিক নির্দেশনাও রয়েছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে শুধুমাত্র শরীয়তের বিধি-নিষেধ মেনে চলতে পারলেই নিজেকে একজন ভারসাম্য পূর্ণ চরিত্রের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

ইনশাআল্লাহ আমরা অবশ্যই জীবনের সর্বক্ষেত্রে শরীয়তের বিধি-নিষেধ মেনে চলবো দাদাভাই। দৃঢ় কন্ঠে বললো মুবাশ্বারা। তুমি বলো এজন্য সর্বপ্রথম আমাদেরকে কি করতে হবে?

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, তাহলে আজ থেকেই গড়িমসি না করে জীবনে, আত্মনিয়োগ করো জ্ঞানার্জনে। জ্ঞানের মাঝেই নিহিত আলো, জ্ঞানের পথে তাই দৃপ্তপদে এগিয়ে চলো। জীবনের নামও এগিয়ে চলা, কারো সাথে হোক কিংবা একলা। পথে পথে পাবে ছড়ানো বাঁধা, কখনো আনন্দময় জীবন কখনো বা ধাঁধা। আঁধারে হয়ে যেও সবে ছোট্ট জোনাকি, কখনো বা সুরেলা ভোরের পাখী। নিভু নিভু প্রাণে আলোর রংয়ে দিও নতুন ভুবনের স্বপ্ন আঁকি।

চিৎকার করে পাঁচজন ইনশাআল্লাহ বললো। সবাইকে আদর করে দিয়ে আজাদ সাহেব বললেন, তাহলে আমাদের আজকের বৈঠক এখানেই শেষ করি চলো। মাগরীবের সময় হয়ে যাচ্ছে প্রায়। আমি মসজিদে যাচ্ছি। তোমরা সবাইও নামাজের জন্য তৈরি হয়ে মসজিদে এসো।

আজাদ সাহেবকে বিদায় জানিয়ে নামাজের প্রস্তুতি নেবার জন্য মেয়েরা সবাই তখন বাড়ির অন্দর মহলের দিকে কদম বাড়ালো।    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন