রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি......১১




ছোটবেলায় খালামণি কেমন ছিল বাপী? চায়ের কাপ আফজাল সাহেবের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করলো নূহা।

চায়ের কাপ নিয়ে হাসি মুখে আফজাল সাহেব বললেন, আমাদের বাড়ির সব বাচ্চাদেরকে ব্লেন্ডারে রেখে ঘুটা দিলে যে অস্থিরতা তৈরি হবে। তাও তোর খালামণি ছোটবেলায় চঞ্চলতার মোকাবিলা করতে পারবে কিনা সন্দেহ।

নূহা হেসে বলল, এত্তো দুষ্টু ছিল খালামণি?

দুষ্টু মানে কি? দুষ্টুর মহারাণী ছিল ছোটবেলায় নুসরাত। এক মূহুর্ত নিজে তো কোথাও স্থির থাকতো না, আমাকেও থাকতে দিতো না। আমাদের বাড়ি একদম পাশাপাশি ছিল। আমি কোনদিনও সাহস করিনি কিন্তু তোর খালামণি ঠিকই ওদের বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে আমাদের বাড়ির ছাদে চলে আসতো। এরজন্য তোদের নানাভাই আর নানুমণির কাছে কম বকা খায়নি। কিন্তু পাত্তাই দিতো না কারো কথা নুসরাত।

কারো কথা পাত্তা না দেবার স্বভাব তাহলে খালামণির ছোটবেলা থেকেই? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো নূহা।

এখনো তো সেই একই অভ্যাসের উপর স্থির তোর খালামণি। নিজে যা বলবে, যা বুঝবে সেটাই ঠিক।

আবারো আফজাল সাহেব স্ত্রীর বদনাম করতে শুরু করবেন বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি নূহা বলল, নানাভাই আর দাদাভাই বেঁচে থাকলে আজ অনেক খুশি হতেন। ছোটবেলা থেকে দুইজন জানের জান বন্ধু ছিলেন। সেই বন্ধুত্বকে অটুট রাখার জন্য নিজ নিজ সন্তানদেরকে একে অন্যের সন্তানদের সাথে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তার বন্ধন আবদ্ধ হয়েছিলেন। নানাভাই তার তিন কন্যার বিয়ে দাদাভাইয়ের তিন পুত্রের সাথে দিয়েছিলেন। ছোট খালামণির তোমাকে পছন্দ ছিল কিন্তু তোমরা সমবয়সী ছিলে বলে মেজাজ চাচ্চুর সাথে বিয়ে হয়েছিল। আরশাদ চাচ্চু মারা যাবার পরে খালামণি আর বিয়ে করতে রাজী হলেন না। মৃত্যুর আগেও দাদাভাই আর নানাভাই দুজনকেই ছোট খালামণির জন্য মন খারাপ করতে দেখেছি। তোমার সাথে ছোট খালামণির বিয়ে দেখে যেতে পারলে অনেক শান্তি পেতেন দুজন।

উনারা বেঁচে থাকলে মন্দ হতো না। আমিও মন খুলে আমার উপর তোর খালামণির অত্যাচারের কথা বলার মতো মানুষ পেতাম। তোদের কাছে কিছু বলে তো লাভ নেই। চাচার চেয়ে খালার প্রতি তোদের সবারই দরদ বেশি।

নূহা হেসে বলল, চাচার প্রতিও অনেক দরদ আছে। সেই দরদ খালামণির সামনে দেখানো হয়। যার যার দরদ তার পার্টনারকে দেখানো হচ্ছে আমাদের স্টাইল বুঝেছো?

হুমম, লেকচারার নূহার কবলে পড়লে না বোঝার কি কোন উপায় আছে?

আচ্ছা বাপী তোমার কখনো মনেহয়নি তোমাদের বিয়ের পর খালামণির মধ্যে আগের সেই চঞ্চলতা ফিরে এসেছে? আমার কিন্তু এমনটাই মনেহয়। হাসতে হাসতে বললো নূহা।

এমন মানে কেমন?

স্বপ্ন অনেক রকমের হয় বাপী। এরমধ্যে কিছু কিছু স্বপ্নের বসবাস হয় আমাদের অন্তরের গহীনে। সেই স্বপ্নগুলো শুধু স্বপ্ন থাকে না, সেই স্বপ্নগুলোর সাথে জড়িয়ে সাথে স্বভাবজাত উচ্ছলতা, আনন্দময়তা। কারো মনের এমন কোন স্বপ্ন যখন ভেঙে যায়, বেশির ভাগ সময়ই সেই ব্যক্তি ছিটকে পড়ে নিজের কাছ থেকে। তার অন্ত্রের গহীনে তৈরি হয় বিশাল শূন্যতার। যে শূন্যতার হাহাকারে নতুন করে স্বপ্ন দেখার স্পৃহাও হারিয়ে যায়। এমন কোন ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন যখন বাস্তব হয়ে কারো সামনে এসে দাঁড়ায়, মানুষ নিজেই নিজেকে শক্ত করে একটা চিমটি কেটে দেখে আসলেই সত্যি দেখছে তো? চিমটি খেয়ে যখন চমকে উঠে স্বপ্ন ভঙ্গের বদলে, মুখ থেকে ব্যথার উফফ ধ্বনি বেরিয়ে আসে, তখন সেই মানুষটি আনন্দে আত্নহারা হয়ে যায়। খালামণিও ঠিক তেমনই আত্নহারা দিন কাটাচ্ছে।  

তিন বছর ধরে আত্মহারা দিন কাটাচ্ছে?

বাপী তুমি একবার নিজের দিকে ভালো মতো তাকিয়ে দেখো।

কি দেখবো নিজের দিকে তাকিয়ে?

তুমি একজন আর্মি পারসন ছিলে। এখনো তোমাকে দেখে বোঝার কোন উপায়ই নেই যে তোমার বয়স পঁয়ষট্টি বছর। বড় জোর ফোরটি ফাইভ মনেহয়। তেষট্টি বছর বয়সে তোমার মতো ইয়াং, হান্ডসাম, সিক্সপ্যাক হাজবেন্ড পেয়ে কোন মেয়ের কি নিজের মাঝে ফিরে আসার কোন সুযোগ আছে? নো ওয়ে বাপী নো ওয়ে।

আফজাল সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তোদের ভাইবোনদের মধ্যে মানুষকে পটানোতে তুই যে সবচেয়ে ডেঞ্জেরাস সেটা আসলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। নয়তো কি আর তোর কাছে বৌয়ের বিচার নিয়ে আসি। তুই বৌয়ের কোন দোষ তো ধরলিই না, উল্টো তাকে আমাকে বিমুগ্ধ প্রেমিকা প্রমাণ করে দিলি।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এখন তাহলে গুড বয়ের মতো তুমি বৌয়ের বিমুগ্ধ প্রেমিক হয়ে যাও। কি দরকার একে অন্যের আচরণ থেকে ভুল খুঁজে বের করে জীবনে অশান্তি ডেকে আনার? বাপী আমরা না চাইলেও নানা ধরণের সমস্যা, জটিলতা আমাদের জীবনে হাজির হয়েই যায়। কিন্তু ভালো থাকার, খুশি হবার, আনন্দিত হবার কারণ বেশির ভাগ সময়ই আমাদেরকে খুঁজতে হয়। তাই জীবনে যদি আমাদেরকে অজুহাত তৈরি করতেই হয়, বাহানা যদি বানাতেই হয়। তাহলে দুঃখের কেন? সুখের নয় কেন? আমার তাই মনেহয় সারাক্ষণই আমাদের এক কান খাঁড়া করে রাখা উচিত যাতে পা টিপে টিপে আশপাশ দিয়ে কোন সুখ লুকিয়ে চলে যেতে না পারে।

আচ্ছা যা আজ থেকে আমিও সুখের বাহানাই তৈরি করবো। কিন্তু তোর খালামণিকেও বুঝিয়ে বলিস এত যন্ত্রণা যেন না করে। বিয়ের আগে তো কত খেয়াল রাখতো দূর থেকে। এখন কাছে চলে এসেছি বলে কি ভালোবাসা সবসময় ঝগড়ার আড়ালেই প্রকাশ করবে নাকি?

নূহা হেসে বলল, বাপী তুমিও কি মনে করো দূরে থাকলেই সম্পর্ক সুন্দর থাকে?

ভালো একটা প্রশ্ন করেছিস। আচ্ছা মা তোর কি মত এই ব্যাপারে? কাছে এলে কি সত্যিই সম্পর্কের মাধুর্য্য কমে যায়?

একটূ ক্ষণ চুপ থেকে নূহে হাসি মুখে বলল, বেশ কয়েকমাস আগে আমাদের কলিগদের একজন ভীষণ হতাশ কন্ঠে বলেছিলেন, দূর থেকে আকাশটা যেমন সুন্দর লাগে, কাছে গেলে আর তেমন সুন্দর লাগে না। আমাদের জীবনের সম্পর্কগুলোও এরকম। দূরে থাকলেই সম্পর্ক গুলো সুন্দর থাকে। জবাবে বলেছিলাম, হুম ঠিক বলেছো দূরের আকাশের সৌন্দর্য আর কাছের আকাশের সৌন্দর্য একে অন্যের থেকে একদম আলাদা। কিন্তু এটা আকাশের দোষ না। সৌন্দর্যের তারতাম্যের কারণ হচ্ছে, দূর থেকে আর কাছ থেকে দেখা জিনিসকে একই রকম দেখাবার কোন সুযোগ নেই। আমি দূর থেকে যখনই আকাশকে দেখী মুগ্ধ হই। কিছুটা কাছে অথাৎ, বিমানের জানালা দিয়েও যতবার দেখেছি মুগ্ধ হয়েছি। দূরের আকাশ আর কাছের আকাশ মানে হচ্ছে আকাশের ভিন্ন দুটা কন্ডিশন। আর ভিন্ন দুটা কন্ডিশনে একই জিনিস আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই দুটি ভিন্ন কন্ডিশনে কোন জিনিসকে একই রকম দেখতে চাওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক।
তাই তো! এভাবে তো ভেবে দেখিনি।

নূহা হেসে বলল, আসলে বাপী সমস্যাটা কাছের বা দূরের না। সমস্যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে।  আমরা  অবস্থা ও অবস্থান ভেদে কোন কিছু বদলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক জানার পরও বদলটাকে মেনে নিতে পারি না। উল্টো দোষ দেই জিনিসটার সেই অবস্থাটাকে, যে অবস্থায় তার বদলে না যাওয়াটাই অস্বাভাবিক ছিল। প্রতিটা জিনিসের সৌন্দর্য যেখানে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় আলাদা হবে। সেখানে দূরের আকাশ বেশি সুন্দর বলে কি কাছের আকাশকে অবমূল্যায়ন করা সঠিক হবে? মাঝে মাঝে মনেহয় কম্পেয়ার করাটা মানুষের একটি ভয়াবহ চারিত্রিক দুর্বলতা। এই কম্পেয়ার করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের মনের শান্তির বিঘ্ন ঘটাই ভীষণ ভাবে। কোন জিনিস হোক কিংবা মানুষ তাকে সেই অবস্থান থেকেই দেখা ও বিবেচনা করতে পারলে দুটা লাভ হয়। এক. মানুষটার প্রতি অবিচার করা হয় না। দুই. নিজের মনের মাঝে অকারণ অস্থিরতা, জটিলতা তৈরি হয় না। সম্পর্কেও ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমনই। কাছাকাছি থাকলে সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষগুলো একে অন্যেকে ভালোবাসা যেমন বেশি দেয়। তাদের কষ্ট দেবার সম্ভাবনাও একটু বেশিই থাকে।

হুম, ঠিক কাছে থাকার কারণে ভালোবাসা দেবার সুযোগ যেমন বেশি থাকে, তেমনি কষ্ট দেবার কারণও তৈরি হয়েই যায়। জীবন যখন যেভাবে আমাদের কাছে হাজির হয়, তখন তাকে সেভাবে মেনে নিতে পারাটাই আসলে সুখ।

নূহা হেসে বলল, এই তো এতক্ষণে না মনে হচ্ছে আমাদের বাপীর সাথে কথা বলছি। এখন বলো তোমার জন্য কি রান্না করবো দুপুরে? এক কাজ করি চলো ফোন করে খালামণিকে ইনভাইড করি। তারপর চলো তুমি আর আমি মিলে খালামণির পছন্দের কোন একটা থাই ডিশ রান্না করি।

থাই স্যুপ কর। বেশি করে চিংড়ী মাছ দিয়ে। খুব পছন্দ করে তোর খালামণি।

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা ঠিকআছে। এখন বলো খালামণিকে ফোন কি তুমি করবে নাকি আমি করবো?

আফজাল সাহেব হেসে বললেন, তুই’ই কর। আমি বরং তোকে সবজি কেটে দেই।

বাপীর হাতে ছুরি ধরিয়ে দিয়ে নূহা তখন খালামণিকে ফোন করতে ছুটলো।

@  

বাইরে যাবার উদ্দেশ্যে গাড়িতে ঢুকতে গিয়ে ড্রাইভিং এর পাশের সীটে মুখের সামনে ম্যাগাজিন ধরে গাঁট হয়ে ছোট খালামণিকে বসে থাকতে এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলো জাওয়াদ। এরপর চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে সালাম দিলো।

সালামের জবাব দিয়ে মিসেস নুসরাত বললেন, আমাকে নূহার বাসায় নামিয়ে দেবার পর তুই বনের পাখীর মত মুক্ত। যেখানে ইচ্ছে চলে যাস উড়তে উড়তে।

খালামণিকে না বলে কোনই লাভ নেই সেটা ভালো মতনই জানা আছে জাওয়াদের। একবার যেহেতু গাড়িতে চেপে বসেছেন নূহার বাসার গেটে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত সিন্দাবাদের ভূতের মতই চেপে বসে থাকবেন। তারপরেও জাওয়াদ বলল, খালামণি ঘন্টা খানেক পর আমার জরুরি একটা মিটিং আছে। নূহার বাসায় যেতেই দেড় ঘন্টা লেগে যাবে। বাড়িতে মুহিত, মঈন দুজনই আছে। তুমি নাহয় ওদের যে কোন একজনকে নিয়ে নূহার বাসায় যাও।

মুহিত তিন মাস আগে একবার গাড়ি ঠুকে দিয়েছিল মনেআছে? আর মঈন তো দুধের শিশু। তুই কি চাস ওদের পাশে বসে যেতে যেতে টেনশনে আমি হার্টফেল করি?

বাড়িতে ড্রাইভারও তো আছে খালামণি?

কি বললি তুই? ঠাস করে হাতের ম্যাগাজিন পাশে রেখে চোখ বড় বড় করে তাকালেন মিসেস নুসরাত। বাড়ি ভর্তি ছেলে থাকতে আমি ড্রাইভারের সাথে বাইরে যাবো? এই কথা বলতে গিয়ে তোর জবান একটু কাঁপলও না? তোর ভেতরে কি বিবেক বলে কিছু নেই?

কিছু না বলে হাসতে হাসতে গাড়ি স্টার্ট করলো জাওয়াদ।

এক ঘন্টা পরে যে মিটিং আছে সেটা পিছিয়ে আরো দুই ঘন্টা পরে করে দে। তাহলেই আর কোন টেনশন থাকবে না।

হুট করে মিটিং পিছিয়ে দেব কিভাবে?

মিটিং মানুষ হুট করেই কিছু পিছায়। আগে থেকে পরিকল্পনা করে ফিক্সড করে। বুঝেছিস? জরুরি কাজে আটকা পরেছিস বলে দে।

আচ্ছা বলে দেব ইনশাআল্লাহ। তুমি রিলাক্স হয়ে বোস।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিসেস নুসরাত বললেন, কেমন আছিস তুই?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, আনন্দে আছি, সুখে আছি, শান্তিতেও আছি।

হ্যা সেটা তোর জবাব শুনেই বোঝা যাচ্ছে। মানুষ যখন কেমন আছো্’র জবাবে এমন হড়বড়  করে নিজের সুখ-শান্তি-আনন্দের বর্ণনা দিতে শুরু করে। তারমানে তার কোন কিছুই স্বাভাবিক নেই। 

জাওয়াদ হেসে বলল, জীবনে সুখী হবার সবচেয়ে সহজ মূলমন্ত্রটা কি জানো খালামণি? যদিও একেকজনের কাছে অবশ্য একেকটা হবার কথা। যার যার দৃষ্টিভঙ্গী, অভিজ্ঞতা ও বিবেচনার উপর নির্ভর করে সুখের সংজ্ঞা। তবে জীবন যখন যেভাবে হাজির তখন সেভাবেই তাকে মেনে নিলে এবং যা কিছু আনঅ্যটেইনেবল তার জন্য আহাজারি না করলে সুখী হওয়াটা খুব সহজ হয়ে যায় বোধকরি! তাই নিজের জন্য সবসময় দোয়া করা উচিত যে, আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তায়ালা আমাদের সবাইকে যা দিয়েছেন তার মাঝেই তৃপ্তি খুঁজে পাবার, এবং যা কিছু থেকে দূরে রেখেছেন সেসবকে ঘিরে অতৃপ্তিতে না ভোগার তাওফীক দিন। যা কিছু ঘটছে তা যদি কষ্টদায়ক ও বেদনাদায়কও হয়, এরমধ্যেই যে নিহিত আছে কল্যাণ এই বিশ্বাস রাখার তাওফীক দিন।আল্লাহর হিকমাহ ও মোহাব্বত বোঝার তাওফীক দিন আমাদেরকে।

কিছু না বলে আবারো ম্যাগাজিন খুলে মুখের সামনে ধরলেন মিসেস নুসরাত।

কষ্ট দেবার জন্য কিছুই বলেনি কিন্তু তারপরও যে তার কথা থেকে খালামণি কষ্ট তুলে নিয়েছেন বুঝতে পেরে ব্যথিত অনুভব করলো জাওয়াদ। মনে প্রশ্ন জাগলো, কারো আবেগের মূল্যায়ন কতটা জরুরি? কারো আবেগের মূহুর্তে উদাসিনতা বা কঠোরতা কতটা সমর্থিত কিংবা মানবিক? ইমোশনের মূল্যায়ন করতে পারাটাই কি সম্পর্কের ভীতকে মজবুতি দান করে না? কিন্তু অতি আবেগপ্রবণ কাউকে আবেগ নিয়ে বোঝাতে যাওয়াটাও তো খুব সহজ কিছু নয়। তার আবেগের প্রবাহমান স্রোতে যুক্তি ভেসে যায় বাঁধ ভাঙা জলের মতোই। তবে খুব সহজ একটা হিসাব হচ্ছে, যখন মানুষ  অন্যের আবেগকে মূল্যায়ন করে, তখন তার নিজের আবেগও মূল্যায়িত হয়। কিংবা অন্তত মুল্যায়িত হবার সম্ভাবনা প্রকট হয়! আর নিজের মনের আবেগের দিকে ভালো ভাবে তাকালেই মানুষ বুঝতে পারে যে, কোন পরিস্থিতিতে আবেগটা কিভাবে দানা বাঁধে তার মনে। এমনটাই হয় অন্য সবার ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ, মনের অবস্থাটা নির্ধারিত বা প্রকাশিত হয় আবেগের দ্বারা।কারো বেদনাক্ত কিংবা আনন্দিত আবেগে যদি কেউ খুব স্বাভাবিক আচরণ করে, তাহলে সেই আচরণ ব্যথা আরো বাড়িয়ে দেয়, আনন্দে ঘাতটি নিয়ে আসে। এমনটা সবার ক্ষেত্রেই হয়। তাই অন্যের আবেগকে মূল্য দেয়া উচিত। জাওয়াদও আপ্রাণ চেষ্টা করে সবার আবেগের যথাযথ মূল্য দিতে। কখনো যদি কারো আবেগে বাঁধ দেবার প্রয়োজন হয় শরীয়তের দ্বারাই সেটা দেয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, খুব কম সময়ই  আবেগপ্রবণ ব্যক্তিদের আবেগ শরীয়তের বাউন্ডারিতে গিয়ে থেমে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছলকে ছলকে বেড়িয়ে যেতে চায়।

বেশ অনেকটা পথ নীরব থাকার পর জাওয়াদ বলল, আমার কি মনেহয় জানো খালামণি? কখনো কখনো অসম্পূর্ণ কিছুর মাঝেও খুঁজে পাওয়া যায় পরিপূর্ণতার ভরপুর সৌরভ। জীবনের অসম্পূর্ণ গল্পগুলোর তাই ছড়িয়ে যায় রঙ-বেরঙয়ের স্বপ্ন, ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তোলে এক টুকরো হাসি। আবার কারো কারো সাথে কাটানো অসম্পূর্ণ মুহুর্তগুলোও এতটাই প্রাণশক্তিতে ভরপুর থাকে, সেসবকে অবলম্বন করে কাটিয়ে দেয়া যায় এক জীবনের পুরোটা সময়।

এসব সিনেম্যাটিক কথা আমাকে শোনাতে আসিস না। বিরক্ত কন্ঠে বললেন মিসেস নুসরাত। জীবন সম্পর্কে বিশাল অভিজ্ঞতার ভান্ডার আমার কাছেও আছে। তোর চেয়ে কম দেখিনি আমি জীবনকে। তাই অসম্পূর্ণ কিছুর সৌরভের সাথে যেমন আমি পরিচিত, তেমনি কারো স্মৃতি মনের মাঝে লালন করে দিন পাড় করার যাতনা সম্পর্কেও অজ্ঞাত নই।

জাওয়াদ হেসে বলল, তোমার আর আমার অভিজ্ঞতার মাঝে কিন্তু বিশাল একটা পার্থক্য আছে খালামণি। তুমি তোমার সাথে সংঘটিত নেতিবাচক ঘটনা গুলোকে কখনোই মন থেকে মেনে নাওনি। ফলে মানিয়েও চলতে পারোনি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চললেও প্রচন্ড কষ্ট হয়েছে তোমার। কিন্তু আমার নিয়তিকে আমি শুধু খুশি মনে মেনেই নেইনি। এর মাঝেই নিহিত আছে আমাদের কল্যাণ এই দৃঢ় বিশ্বাসও আমার আছে। খালামণি যদি নিজের নিয়তিকে ঘিরে আক্ষেপ করলে, দুঃখবিলাশ করলে, হা হুতাশ করলে সবকিছু বদলে যেত, যেমন চাই তেমন হয়ে যেত। তাহলে রাত-দিন বসে আমি তাই করতাম। কারণ আমিও ফিরে পেতে চাই চলে যাওয়া সময়কে, অতীতের ভালোবাসাময় দিনগুলোকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের রিঅ্যাকশনে জীবন তার গতিপথ বদলায় না। জীবন চলতে থাকে তার নিয়মেই। আমরা যদি সে নিয়ম মানতে অস্বীকার করি, জীবন আমাদেরকে পেছনে ফেলেই চলার গতি অব্যহত রাখে। এবং ধীরে ধীরে নিজ জীবনের সাথেই আমাদের তৈরি হতে থাকে দুরুত্ব। একটা সময়ে গিয়ে আমরা নিজেরাই অজ্ঞাত হয়ে যাই নিজের জীবন সম্পর্কে।

এত ভাবুক কথা শিখেছিস কোথায়? অসহ্য লাগে তোর এসব কথাবার্তা। চুপ করে থাক একদম। নয়তো চলন্ত গাড়ি থেকেই লাফ দিয়ে নেমে যাবো।

হেসে ফেললো জাওয়াদ স্বশব্দে। কিন্তু খালামণিকে আজ কোন কিছু বলেই বোঝানো যাবে না বুঝতে পেরে চুপ করে রইলো অনেকক্ষণ। এরপর বলল, প্রতিটা জিনিসেরই কিছু না কিছু নিয়ম থাকে। যা সেটাকে সহজবোধ্য করে তোলে। নিয়ম জানা থাকলে তাই সবকিছুই অনেক সহজ হয়ে হয়ে যায়।  ঠিক তেমনি কারো জন্য অপেক্ষা করারও কিছু নিয়ম আছে। সেই নিয়মটা জানা থাকে না বলেই অপেক্ষা কষ্টকর হয়ে ওঠে। যারা জানে কিভাবে করতে হয় অপেক্ষা,তারা ঠোঁটের কোনে হাসি মেখে নিরন্তন করতে থাকে প্রতীক্ষা প্রিয়তম কারো তরে।

সেই নিয়মটা কি শুনি?

জাওয়াদ হেসে বলল, নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই আসলে। কিছু কিছু আবেগের ক্ষেত্রে প্রতেক্যেই নিয়ম তৈরি করে নিতে হয় নিজের মতো করে। অপেক্ষা করাটাও তেমন। আসলে অপেক্ষা করাটা শিখতে হয়, জানতে হয়। শেখার ও জানার চেষ্টা করার সময় আমার মনে হয়েছিল, বিশেষ মানুষটির সাথে কাটানো সুন্দর মূহুর্তগুলোর কথা ভাবতে ভাবতেই অপেক্ষার প্রহর গুলো কাটিয়ে দেয়া সম্ভব হয় মুগ্ধতার আবেশে।

কিছু না বলে খালামণিকে নীরব থাকতে দেখে জাওয়াদ হেসে বলল, আইসক্রিম খাবে খালামণি? তোমার ফ্রেব্রেট আইসক্রিম পার্লার হয়ে যাই চলো। তোমার সাথে আজ আমিও আইসক্রিম খাবো। নূহা আর বাচ্চাদের জন্যও আইসক্রিম নিয়ে নেয়া যাবে। ঘোরাবো গাড়ি?

মাথা সামান্য ঝাঁকিয়ে হুমম বললেন মিসেস নুসরাত।

জাওয়াদ তখন গাড়ি ঘুরিয়ে আইসক্রিম পার্লারের দিকে রওনা দিলো।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন