রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি......২



নূহা তোমার জন্য কফি আর স্যান্ডুইচ নিয়ে এসেছি। সকাল থেকে কিছুই খাওনি তুমি। এভাবে চললে তো তুমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমি রেখে যাচ্ছি খাবার। প্লিজ খেয়ে নিও।

আদীর কথাগুলো শুনতে পেলেও যেমন দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে রইলো নূহা। খাবার রেখে চলে যাবার পদধ্বনি শুনতে পেয়েও নড়লো না। বাবার রুম থেকে বেড়িয়ে হসপিটালের করিডোরে এসে দাঁড়িয়েছিল। কান্না করতে চাইছিল না কিন্তু অনেকদিনের জমে থাকা মেঘ বৃষ্টি হবার সুযোগ পেয়েছে যেন, ঝরেই চলছিল অবিরাম। আকাশের দিকে তাকালো নূহা। চাঁদ নেই কিন্তু ঝকঝকে তারা ভরা আকাশ। এমন আকাশ বাবার খুব পছন্দের। বাবার কথা মনে হতে আবারো বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ছলকে উঠলো চোখের নদী। কারো এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেয়ে চোখ মুছে পেছন ফিরে তাকালো। নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলো নূহা। রাগ আর বিরক্তি মেশানো কন্ঠে বলেই ফেললো, আচ্ছা তোমার সমস্যা কি? সেই দুপুর থেকে আমার পেছনে লেগে রয়েছো কেন? তোমার আর কোন কাজ নেই? কাজ না থাকলে বাসায় গিয়ে ঘুমোও। কিন্তু দয়া করে আমার পিছন পিছন ঘুরঘুর করা বন্ধ করো।

খেয়ে নাও। তাহলেই আর বিরক্ত করবো না তোমাকে। বললো আদী। 

খাবো না আমি। কি করবে তুমি?

আস্তে কথা বলো নূহা। এটা হসপিটাল ভুলে যেও না।

আমি কিছুই ভুলিনি। বরং তুমি ভুলে গিয়েছো এটা হসপিটাল এবং তুমি এখানকার একজন ডক্টর। তাই তুমি ডক্টরের মতো আচরণ করো। তাহলে আমিও পেশেন্টের ফ্যামেলি মেম্বারের মতো আচরণ করবো। 

ডক্টর হবার সাথে সাথে আমিও সেই পেশেন্টের ফ্যামেলি মেম্বার। তাই চাইলেও শুধু ডক্টরের মতো আচরণ করা সম্ভব নয়।   

সকাল হলেই আমি বাবাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। ক্ষোভ মেশানো স্বরে বললো নূহা।

আচ্ছা ঠিকআছে নিয়ে যেও। কিন্তু সেজন্য আগে সকাল তো হতে হবে তাই না? সেই পর্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ করো। সকাল থেকে ফ্যামেলির সবার সাথে তুমি হৈচৈ করছো। তুমি হৈচৈ করলে কি বাবা সুস্থ হয়ে যাবেন? তাহলে কেন এমন করছো? তুমি তো সবই বোঝ নূহা।

আমি আর কিছু বুঝতেও চাই না। এই দুনিয়াতে বুঝদার হওয়াটাও এক ধরণের অন্যায়। প্রতি মূহুর্তে তার উপর নিত্য নতুন বোঝা চাপিয়ে, সেই অন্যায়ের শাস্তি দেয়া হয়। তাই তুমি এখন কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করো না আমাকে। আমি কিছুই বুঝবো না। এবং দয়াকরে আমার সামনে থেকে যাও তুমি।   

এই মূহুর্তে নূহাকে কিছুই বোঝানো যাবে না সেটা অজানা নয় আদীর। তাই বাঁধা দেবার চেষ্টা না করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সমঝদার মানুষেরা যখন কোন কিছু বুঝতে না চাইবার পণ করে বসে তখন তাদেরকে কোন কিছু বোঝাতে যাওয়াটা যে কতটা অর্থহীন নূহাকে দেখেই সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছে আদীর। কফি আর স্যান্ডুইচের ট্রে হাতে তুলে নিয়ে নিজের কেবিনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। খালামণিকে ফোন করে হসপিটালে আসতে বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মায়ের সাথে অন্তত নূহা হৈচৈ করবে না।    

নিজের কেবিনে এসে খালামণিকে ফোন করার উদ্দেশ্যে সেলফোনের দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলো দরজায় নক শুনে ঘুরে তাকালো আদী। নূহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হলেও বুঝতে পারলো কোন কারণে দপ করে মেজাকের লন্ঠন নিভে গিয়েছে। এটা অবশ্য নতুন কিছুই না। নূহার স্বভাবই হচ্ছে, এই মূহুর্তে রিমঝিম নূপুর তো পরমূহুর্তেই আঁধার মেঘের গুড়গুড়। বয়সে বেশ অনেকটা বড় হলেও অন্য আর সব সম্পর্ক ছাড়িয়ে নূহার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই সবচেয়ে বেশি জোড়ালো আদীর। চমৎকার বোঝাপড়াও দুজনের মধ্যে।    

তুমি নিশ্চয়ই মামণিকে ফোন করতে যাচ্ছিলে? 

প্রশ্ন শুনে আর প্রশ্নকর্তার প্রশ্ন করার ধরণ দেখে না চাইতেও হেসে ফেললো আদী। হাসতে হাসতে বলল, তুমি তো নিশ্চয়ই ভেতরে আসবে না? এক কাজ করি চলো ক্যান্টিনে গিয়ে বসি। আমারো বেশ ক্ষুধা লেগেছে।

হ্যা বা না কিছু না বলে নূহা হাঁটতে শুরু করলে আদী বুঝতে পারলো তার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। হাসি মুখে তাই নূহার পিছু নিলো।  

খাবারের অর্ডার দিয়ে এক কোনায় গিয়ে বসলো নূহা। কিছুক্ষণ পর আদী এসেও বসলো। নূহার সামনে এক গ্লাস পানি রেখে বললো, আজ আইস কিউব দুটার বদলে তিনটা দিয়েছি। একটা এক্সট্রা তোমার মেজাজের এক্সট্রা ভারসাম্যহীনতার জন্য।

মেজাজের এক্সট্রা ভারসাম্যহীনতা মানে? তুমি কি বলতে চাইছো? আমার মেজাজ সবসময় ভারসাম্যহীন থাকে?

একদম এটাই বোঝাতে চেয়েছি আমি। হাসতে হাসতে বললো আদী।

নূহার মুখেও এক টুকরো হাসি ফুটে উঠে সাথে সাথেই আবার মিলিয়ে গেলো। ক্লান্ত স্বরে বলল, বাবা সুস্থ হয়ে যাবে তো ভাইয়া? এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। এখনো বাবা উঠছে না কেন?

একথা তো তুমিও জানো নূহা কমা’র পেশেন্টদের ব্যাপারে শিওর করে কিছুই বলা সম্ভব নয়। আমাদের পক্ষে যা যা করার ছিল, আছে আমরা করছি বাবার জন্য। সব তো আল্লাহর ইচ্ছে তাই না? এখন তাই আমাদের একটাই করণীয় বেশি বেশি করে দোয়া করা। সেজন্য আমাদের নিজেদের সুস্থ থাকাটা জরুরি। ভেবে দেখো গত এক সপ্তাহ ধরে কি পরিমাণ অনিয়ম করছো তুমি?

হয়েছে লেকচার দিতে হবে না আমাকে। তোমার কাছে লেকচার শোনার জন্য আসিনি আমি।

আদী হেসে বলল, আমি তো সাধারণত লেকচার দেইও না কাউকে। আমি কাউকে বোঝানোর চাইতে, তাকে বুঝে চুপচাপ তার পাশে থাকতে পছন্দ করি।

আর এইজন্যই তোমাকে আমি এত পছন্দ করি। কেউ যখন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে আমার ভয়াবহ রকমের মেজাজ গরম হয়। একজন মানুষ যখন কোন কারণে অস্থির হয় তখন তাকে বোঝানোর চাইতেও, তাকে বোঝাটা জরুরি। আর তুমি ঠিক এমনটাই করো সবসময়। আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। আমি হান্ডেড পার্সেন্ট কনফিডেন্টের সাথে নিজেকে যে বাক্যগুলো বলি তারমধ্যে এই বাক্যটিও আছে যে, নূহা এই পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যদি তোমাকে ভুল বুঝে, তখনো আদী ভাইয়া নীরবে নিভৃতে তোমার পাশে এসে দাঁড়াবে, তোমাকে বোঝার চেষ্টা করবে। আর এই কনফিডেন্টের জন্যই আমি অকারণে চিৎকার চেঁচামেচি করে ফেলি তোমার সাথে। যে রাগ কারো সাথে দেখাই না সেটাও তোমার উপর ঢেলে দেই।  কিছুক্ষণ আগের আচরণের জন্য আই এম রিয়েলি ভেরি সরি ভাইয়া।  

আদী হেসে বলল, সরি বলার কিছুই নেই। এটা তো আর নতুন কিছু নয়। সেই পনেরো-ষোল বছর বয়স থেকে তুমি আমার সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করা শুরু করেছো। আর গত দশ-এগারো বছরে তোমার চিৎকার চেঁচামেচি আমার জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে। এখন তো কোনদিন যদি তুমি চিৎকার না করো আমার সাথে, মনেহয় সবচেয়ে আনন্দময় কি যে আজ সংঘটিত হয়নি আমার সাথে।  

আমি তোমাকে অনেক যন্ত্রণা দেই তাই না? বুঝতে পারছি কতটা অতিষ্ট হয়ে এমন বলছো তুমি।

আদী হেসে বলল, আরে তুমিই না বলো, যখন সম্পর্কটা হয় আত্মার বন্ধুত্ব, তখন হিসেবী মনকে নিতে হয় মেনে অন্ধত্ব। আসলেই কিন্তু তাই। বন্ধুত্বে একসাথে জীবনের সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। কি দিলাম আর কি পেলাম এমন হিসাবের সুযোগ নেই বন্ধুত্বে। তাছাড়া যখন বন্ধুর কষ্টের সময় তখন তার কাছ থেকে কষ্ট আশা করাটাই বন্ধুত্বের শর্ত।            
নূহা হেসে বলল, এমন শর্তের কথা তো আগে কখনো শুনিনি। 

কিভাবে শুনবে? শর্তটা তো মাত্রই রচিত হলো। তবে কখনোই যে কাজটা করিনা আজ আমি সেটা করবো। 

কি?

আমি কখনোই তোমাকে কোন ব্যাপারে প্রশ্ন করি না। তুমি যা বলো সেটুকুই শুনি। নিজ থেকে কিছুই জানতে চাই না। কিন্তু আজ জানতে চাইবো। নূহা তোমাকে আমি একদম ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। এমনিতে তুমি ছোট থেকে ছোট কারণেও বিরক্ত হও, রাগ করো, মেজাজ দেখাও। কিন্তু যখনই তোমার নিজের জীবনে কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কারো জীবনে সমস্যা আসে, তুমি সবার চেয়ে বেশি ধৈর্য্যের পরিচয় দাও সবসময়। তুমি অস্থির না হয়ে সমস্যাটার মোকাবিলা করার চেষ্টা করো। অন্যদেরকে বোঝাও ভুল সময়ে ভুল রিঅ্যাকশন ভুলকে ত্বরান্বিত করে। যারফলে, যেখানে সমস্যা নেই সেখানে সমাধান খুঁজে বেড়ানোর কারণে জীবনের সমস্যাগুলো ব্যক্তিকে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এবার বাবা অসুস্থ হবার পর থেকে তুমি এত অস্থির কেন?  

বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকার পর নূহা বলল, গত সপ্তাহে বাবার সাথে আমি খুব সামান্য কারণে অনেক হৈচৈ করেছিলাম। বাবার সাথে এমন আচরণ আমি এরআগে কোনদিন করিনি। বাবার সাথে এমন আচরণ করার কথা চিন্তাও করতে পারিনা। কিন্তু বাবা এমন একটা প্রসঙ্গ তু্লেছিলেন, আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। ঐ সময় বাবার সাথে রাগ করলেও পরে বাসায় ফিরে খুব গিল্টি ফিল হচ্ছিলো। বাবার কাছে যেয়ে ক্ষমা চাওয়া উচিত এমনটাই ভাবছিলাম। তখন ফোন এলো বাবা ব্রেন স্ট্রোক করেছেন। আমি যতবার বাবাকে দেখছি শুধু এটাই মনেহচ্ছে, আমার জন্যই বাবার এমনটা হয়েছে। আমার জন্যই মামণি এত কষ্ট পাচ্ছে।

নূহা এই কথাটা তো তুমিই সবসময় সবাইকে বলো, এই পৃথিবীতে কারো জন্য কিছুই হয় না। যা হবার থাকে সেটাই হয়। তাই কোন ঘটনার দায় নিজের উপর টেনে নেয়া মানে হচ্ছে, নিজের উপর বাড়তি বোঝা চাপানো। তাহলে তুমি কেন নিজের উপর সেই বোঝা চাপাচ্ছো যা আল্লাহ তোমাকে দেননি?

আমি জানি না। প্লিজ এই বিষয়টা থাক। অন্য কিছু বলো।

আগামীকাল জাওয়াদ আসছে। ওর মেডিক্যাল কনফারেন্স চলছিল তাই বাবার কথা জানানো হয়নি। গতকাল জানিয়েছি আমি।  

মূহুর্ত খানেক নীরব থেকে নূহা বলল, আচ্ছা খাবার আসছে না কেন? জিজ্ঞেস করে আসো তো ক্যান্টিন ম্যান কি ধমক খেতে চায় কিনা আমার কাছে?

ক্যান্টিন ম্যানদের কি দোষ বলো? চারপাশে তাকিয়ে দেখো মনেহবে ডক্টর’স আর ইন্টার্নদের নাইট ডিউটি না খাবারের পার্টি চলছে। এবার জাওয়াদ এলে বলতে হবে হসপিটালের উন্নতি চাইলে সবার আগে ক্যান্টিন বন্ধ করতে হবে। 

নূহা হেসে বলল, হয়েছে এত বাড়িয়ে বলো না। একটু রিলাক্স করতে দাও। উনারাও মানুষ। 

আদীও হেসে বলল, বোস আমি দেখছি খাবার আসছে না কেন।     

আদি উঠে যাবার পর নূহাও উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আগামীকাল জাওয়াদ আসছে। বাক্যেটা কেমন যেন গুঞ্জন তুলে যাচ্ছিলো মনের মাঝে। নূহা জানে এই গুঞ্জন থামিয়ে দেবার ক্ষমতা তার নেই। তাই চুপ করে তাকিয়ে রইলো সামনে নতুন দিনের শুরু আয়োজনে ব্যস্ত আকাশের দিকে। যদিও ভাবনারা মনের মাঝে গুঞ্জরন তুলেই যাচ্ছিলো...   

এক মুঠো সুবহে সাদিকের তন্দ্রালু আকাশ
আড়মোড়া ভেঙে নতুন স্বপ্নালু দিনের প্রকাশ  

ঘোমটার ফাঁকে উঁকি দেয় অবগুণ্ঠিত কথা
আলোর ছোঁয়ায় তিক্ত হাসে জমে থাকা ব্যথা 

অতীত ভাবনা পেখম ছড়ায় রক্তিম আভা মেখে
ভোমড়া তোলে গুঞ্জরন কাজল আঁকা চোখে

ফুল বাগিচায় উড়ন্ত রঙিন প্রজাপতি
মুচকি হেসে হাতছানি দেয় অমোঘ নিয়তি..... 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন