রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি-২১




স্ক্রিনে ছোট খালামণিকে সবার দিকে পেছন ফিরে এক কোণায় চুপ করে বসে থাকতে দেখে মন খারাপের মাত্রা আরেকটু বেড়ে গেলো জাওয়াদের। সকালে নূহার বাসায় পোঁছে দেবার সময়ই খেয়াল করেছে আজ খুব বেশি আপসেট ছোট খালামণি। আইসক্রিম পার্লারে গিয়ে সবসময়ই একদম ছোট  বাচ্চাদের মত হয়ে যান ছোট খালামণি। সবাই একটা আইসক্রিম খেতে খেতে দেখা যায় খালামণি দু’তিনটা খেয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আজ জাওয়াদ যখন আইসক্রিম পার্লারে বিয়ে গিয়েছিল। অর্ডার করা আইসক্রিম আসার পরেও একবার একটু মুখে দিয়ে উদাস মনে চামচ নাড়াচাড়া করছিলেন শুধু। তাদের মাদার’স গ্রুপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হৈচৈ করার স্বভাব ছোট খালামণির। বাড়ির ছেলেমেয়েদের সাথে তাই উনার ঝগড়া, কথা কাটাকাটি, মনোমালিন্য যেমন সবচেয়ে বেশি হয়। তেমনি সবার সাথে হাসি-মজা, গল্প-গুজবও বেশি হয়। ব্যস্ততার কারণে জাওয়াদের সাথে মন ভরে খুব করে আড্ডা দেয়া হয় না এই আফসোস গড়ে প্রায় প্রতিদিনই করতে শোনা যায় খালামণিকে। সেখানে জমিয়ে গল্প করার এমন একটা সুযোগ আসার পরেও কথা না বলে খালামণির চুপ করে বসে থাকাটা মোটেই স্বাভাবিক মনে হয়নি জাওয়াদের কাছে। খালামণির নীরবতা ভাঙার উদ্দেশ্যে তাই বলেছিল, ভালো লাগছে না এই ফ্লেবারটা? অন্য কোন ফ্লেবার অর্ডার করবো তোমার জন্য?  

জাওয়াদের প্রশ্ন শোনার পরও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন মিসেস নুসরাত। এরপর ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন, আমি নূহাকে সবচেয়ে বেশি মিস কখন করি জানিস?

জাওয়াদ হেসে জবাব দিয়েছিল, হুম, জানি। আইসক্রিম খাওয়ার সময়। আমাদের বিয়ের পর আমি যতবার নূহাকে নিয়ে কোন আইসক্রিম পার্লারে গিয়েছি। আইসক্রিম খাবার সময় তোমার কথা বলেনি এমনটা কখনোই হয়নি।

আমারো একই অবস্থা। কিছু কিছু জিনিস দেখার সাথে সাথে সবার আগে আমার নূহার কথা মনে পড়ে। আইসক্রিম সেগুলোর মধ্যে একটা। আর কি কি দেখলে প্রথমেই নূহার কথা মনে পড়ে আমার বলতে পারবি?

জাওয়াদ হেসে বলল, টম এন্ড জেরি কার্টুন, চাচা চৌধুরীর কমিকস, রুপকথার গল্প। এছাড়া জাম্বুরা ভর্তা, বেশি করে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ আর ধনেপাতা দিয়ে মচমচ করে ভাঁজা ডিম। এই সবকিছুই তোমাদের দুইজনেরই ভীষণ প্রিয়। দেখলেই একে অন্যের কথা মনে পড়ে যায়।

আজকের দিনে ঐ প্রথম মন খুলে হেসেছিলেন মিসেস নুসরাত। হাসতে হাসতে বললেন, নূহার বয়স তখন সাড়ে চার বছরের মতো হবে। মেঝপা একদিন আমাকে দায়িত্ব দিলো ওকে দুধ খাওয়ানোর। কি পরিমাণ যন্ত্রণা করতো খাওয়া নিয়ে সেটা তো জানিসই। চল্লিশ মিনিটে চল্লিশ হাজার কথা শোনালো আমাকে কিন্তু দুধের গ্লাস মুখের কাছে নিলেই বলছিল, অনেক গরম নূহার মুখ পুড়ে যাবে তো। বিরক্ত হয়ে আমি আইসক্রিমের বক্স থেকে দুই চামচ আইসক্রিম নিয়ে দুধে মিশিয়ে দিয়ে বললাম, এখন খাও একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। দুধ মুখে দিয়েই ভিন্ন স্বাদের কারণে খেয়ে নিলো পুরোটা। এরপর থেকে তো মেঝপা দুধ খাওয়াতে গেলেই চিৎকার করতো, আমি ছোটাম্মির হাতে দুধ খাবো। আর সব দুধ পঁচা। শুধু ছোটাম্মির হাতে দুধ মজা। মেঝপা বাধ্য হয়ে নূহাকে দুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব পার্মানেন্টলি আমাকে দিয়ে দিলো। আমিও দুধের সাথে আইসক্রিম মিশিয়ে মূহুর্তেই খাওয়ে দিতাম ওকে।

জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, তোমার এই ক্রাইম ধরা পড়লে মামণি তোমার কি অবস্থা করতো আমি সেই চিন্তা করে আমি এখনো শঙ্কিত হচ্ছি।

নুসরাত খালামনিও মুখের হাসি আরো বিস্তৃত করে বললেন, আরেকদিন মেঝপা দিলো নূহাকে ডিম খাওয়াতে। নূহা ডিমের শুধু সাদা অংশ খেতো। কুসুম কেউ খাওয়াতে পারতো না ওকে। আমি ভাবলাম সেদ্ধ কিংবা পোচ করলে যেহেতু কুসুম খায় না। ভালো মতো ফেটিয়ে ভাঁজি করে দিয়ে দেখি। সাথে অল্প করে ভাতও মাখিয়ে দিয়েছিলাম। ঐদিন থেকে শুরু হয়েছিল ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাওয়া।

আলহামদুলিল্লাহ। আমার আসলে এজন্য তোমাকে স্পেশাল থ্যাংকস দেয়া উচিত।

সেটা আবার কেন?

নূহা যখন কন্সিভ করেছিল প্রথম চার মাস প্রচন্ড খাওয়ার কষ্ট করেছে। কিছুই খেতে পারতো না। একমাত্র ডিম ভাজি ছাড়া বাকি সব ধরণের খাবার দূর থেকে দেখলেই নাকে হাত চাপা দিতো। মায়ের মধ্যে বসে তাই মাঝে মধ্যে ডিম খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার বাচ্চাগুলোর। 

মিসেস নুসরাত হেসে বললেন, হুমম, অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে নূহা প্রেগ্ন্যান্সির সময়টাতে। তবে বাড়িতে যখনই মেয়ে বা বৌদের কেউ কন্সিভ করে তোর কথা ওদের স্বামীদেরকে বলি। কিছুই খেতে পারতো না নূহা বমির জন্য। একদিন চানাচুর থেকে কয়েকটা বাদাম খেয়ে যেই বললো খেতে মজা লেগেছে। অমনি তুই একগাদা চানাচুরের প্যাকেট কিনে এনে বাদাম বেছে জার ভর্তি করে নূহার কাছে নিয়ে গিয়েছিলি। কিন্তু নূহা সেখান থেকে একটা বাদামও ছুঁয়ে তো দেখলোই না উল্টো দেখেই বমি পাচ্ছে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল। তুই একটুও মন খারাপ না করে হাসি মুখে বলেছিলি, কোন সমস্যা নেই। ইচ্ছে না করলে খেতে হবে না তোমাকে। আরেকদিন নূহার শখ হলো রাস্তায় ভ্যান গাড়িতে বিক্রি করা চটপটি আর ফুসকা খাবে। তুই তখন নিজে চটপটি, ফুসকার সমস্ত উপকরণ কিনে দিয়ে, সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়ে এক চটপটি ওয়ালার ভ্যান ভর্তি করে নিয়ে এসেছিলি। নূহা ফুসকায় একটা কামড় দিয়েই ইয়াক খাবো না বলে উঠে চলে গিয়েছিল। ঐ সময়টাতে নূহা তোকে যে পরিমাণ যন্ত্রণা করেছে। সেসব দেখে আমরা মা-খালা্রা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে যেতাম মাঝে মাঝে। কিন্তু তুই নূহা মুখ দিয়ে লটকন খাবো বের করা মাত্র পুরো ঢাকা চষে ঠিকই লটকন সামনে হাজির করেছিস ওর সামনে। রাতে ওর ঘুম আসতো না তাই তোর উপরও ঘুম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তুই বাধ্য স্বামীর মতো সারারাত বৌয়ের পাশে বসে থাকতি। আমার মাঝে মাঝে মনেহতো আজ মনেহয় তুই বিরক্ত হয়ে ধমক লাগিয়ে দিবি নূহাকে। কিন্তু তোর মুখে শুধু একটা লাইনই বাজতো, নূহার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি কি করলে ওর কষ্ট একটু কম হবে তোমরা কেউ বলে দাও প্লিজ।

জাওয়াদ বলল, সত্যি সত্যিই তো অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে নূহা ঐ পিরিয়ডটাতে।

হ্যা তা পেয়েছে। তবে অনেক মেয়েরা নূহার চেয়েও বেশি কষ্ট পার ঐ পিরিয়ডটাতে। কিন্তু বেশির ভাগ মেয়েই তোর মতো দরদী হাজবেন্ড পায় না। তবে নূহা যন্ত্রণা করা একদমই ছেড়ে দিয়েছিল তুই চলে যাবার পর। তখন তো...!  কথার মাঝখানেই থেমে গেলেন মিসেস নুসরাত। না চাইতেও হৃদয় বিদীর্ণ করা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুকের ভেতর থেকে।

জাওয়াদের বুকের ভেতরেও চিনচিন করে উঠলো। অতীতের স্মরণে জ্বালা করে উঠলো দু’চোখ।  অনেকক্ষণ দুজনই নিশ্চুপ বসে রইলো। এরপর জাওয়াদ বলল, গত এগারো বছরে আমার কখনোই সাহস হয়নি কাউকে জিজ্ঞেস করার কি ঘটেছিল আমি চলে যাবার পর? কখনো প্রসঙ্গ উঠলে কেউ কিছু বলতে চাইলেও এড়িয়ে গিয়েছি। মনেহতো নূহার যে কষ্টের কারণ আমি ছিলাম, যে কষ্টের মূহুর্তে আমি জীবনসাথী হবার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি, ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। যে কষ্টকে ভাগ করে নেবার কোন ক্ষমতা আমার নেই। সেই কষ্টকে জানার কোন রাইটও আমার নেই। কিন্তু আজকাল মাঝে মধ্যে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কেমন ছিল নূহার দিনগুলো তখন? আমাদের সন্তানদেরকে পরিবারে স্বাগত জানানোর কত ধরণের প্ল্যান ছিল আমাদের দুজনের। সেসব প্ল্যানের কি বাস্তবায়ন হয়েছিল? ফার্স্ট সনোগ্রাফীর পর যখন আমরা দুজন  জেনেছিলাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের জন্য একসাথে তিনটি জান্নাতি ফুল পাঠাচ্ছেন। কয়েক মূহুর্তের জন্য আমরা দুজন কথা বলতে, আবেগ প্রকাশ করতেই ভুলে গিয়েছিলাম যেন। বড় ফুপ্পির চিৎকার শুনে স্বাভাবিক হয়েছিলাম দুজন। আমাদের বাড়িতে একজন নয় তিনজন জান্নাতি মেহমান আসছেন এই তথ্য গোপন রাখার জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আর নূহা ফুপ্পিকে চেপে ধরে রেখেছিলাম দমবন্ধ হয়ে যে পর্যন্ত না ফুপ্পি বলেছিলেন, আচ্ছা যা বলবো না। এখন অন্তত তোরা আমাকে শ্বাস নিতে নে। তোদের ত্রিরত্নকে না দেখে আমি মরতে চাই না।

মিসেস নুসরাত বললেন, তোদের সারপ্রাইজ দেবার প্ল্যান কিন্তু সফল হয়েছিল। এত সব ঝড়-ঝাপ্টার মধ্যে তোদের ফুপ্পি বা নূহা কেউই আমাদেরকে আর জানায়নি এই তথ্যটা। নূহার ডেলিভারির দিন আমরা সবারই তাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আনন্দ করবো নাকি দুঃখ করবো সেই বোধটাও কাজ করছিল না আমাদের ভেতর।

আর নূহা? বাচ্চাদের দেখে নূহা কি করেছিল?

নূহা? নূহা আর একটি জীবন্ত লাসের মধ্যে কোন পার্থক্যই ছিল না ঐ সময়। আমরা সবাই ভেবেছিলাম বাচ্চাদের পেয়ে মনেহয় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করবে নূহা। কিন্তু প্রায় বছর খানেক পেড়িয়ে যাবার পরেও নূহা ঠিক তেমনই ছিল যেমন এক্সিডেন্টে তোর মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর হয়েছিল। ঐদিন পরিবারের সবাই মিলে গল্প করছিলাম। এমন সময় আমেরিকা থেকে ফোন এলো যে, উপজাতিদের দ্বীপ থেকে ফেরার পথে মাঝ সমুদ্র তোদের জাহাজে আগুন লেগে গিয়েছিল। যারফলে জাহাজ ডুবে গিয়েছে। এবং জাহাজে যারা ছিল তাদের কেউই বেঁচে নেই। নূহা কিছুতেই মেনে নিতে রাজী হয়নি। উল্টো ঐ দ্বীপে যাবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। বাধ্য হয়ে দুলাভাই, ফায়েজ আর আদী মিলে নিয়ে গিয়েছিল নূহাকে। ওখান থেকে ফিরে এসে একদম চুপ হয়ে গিয়েছিল। যেখানে বসে থাকতো বসেই থাকতো। আশেপাশে যে কিছু ঘটছে, কেউ আছে কিছুই ওর খেয়াল থাকতো না। এমন প্রায় হতো জিহাদ, জিশান বা নাবিহা ওর কাছে শুয়ে চিৎকার করে কান্না করছে কিন্তু কেউ ধাক্কা দিয়ে বলে দেবার আগে বাচ্চাকে যে কোলে নিতে হবে সেটাই খেয়াল থাকতো না নূহার। তুই ফিরে আসার আগ পর্যন্ত আড়াই বছর ওরা তিনজন আদীর কাছেই ছিল সবচেয়ে বেশি সময়। আদী বাবা-মা দুজনই ছিল ওদের জন্য।

নিশ্চুপ বসেছিল জাওয়াদ কিন্তু চোখের কোন বেয়ে নেমে এসেছিল অঝোর অশ্রুধারা। এক সময় ফুঁসে ওঠা কন্ঠে মিসেস নুসরাত বললেন, তোর ছোট চাচ্চুকে যদি হাতের কাছে পেতাম তাহলে পিটিয়ে ওকে এখনই মেরে ফেলতাম আমি। 

চোখ মুছে মুখে হাসি টেনে জাওয়াদ বলল, ছোট চাচ্চু আবার কি করলো তোমাকে?

সব দোষ তোদের ছোট চাচ্চুর। নিজে তো ছন্নছাড়া, বাউণ্ডুলেই থেকে গেলো সারাটা জীবন। তোদের মাথার মধ্যেও অভিযাত্রী হবার পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ছোটবেলায় যখনই তোদের স্কুল বন্ধ হতো কোন কারণে তোদেরকে নিয়ে এদিক সেদিক চলে যেত দু'তিন দিনের জন্য। তখনই আমি বড়পা আর মেঝপাকে সাবধান করে বলেছিলাম যাতে দূরে রাখে তোদেরকে মাহমুদের কাছ থেকে। কিন্তু আমার কথা কেউ কানেই তোলেনি। যারফলে মাহমুদ তোদের ভেতরেও ওর বাউণ্ডুলে স্বভাব ঢুকিয়ে দিয়েছিল। যদি তোকে দেশ বিদেশের বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে দাওয়াতী কাজ করার নেশায় পেয়ে না বসতো। তাহলে ছয়  মাসের প্রেগন্যান্ট বৌকে রেখে জংলীদের চিকিৎসা করার জন্য যেতিও না আর ঐ এক্সিডেন্টও হতো না।

জাওয়াদ হেসে বলল, খালামণি জঙ্গলের ঐ জংলীরা ছিল বলেই কিন্তু আমি এখন তোমাকে পাশে বসে আছি আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তুমি এভাবে কতদিন আর একেকদিন একেকজনের ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে মনে মনে তাকে পিটিয়ে মারবে?

হয়েছে ফান করিস না এখন। আমি মোটেই তোর ফান শোনার মুডে নেই। আমার কি ইচ্ছে করে জানিস?

হুম, জানি তো। যদি একটা জাদুর ছড়ি থাকতো তাহলে সেটা ঘুরিয়ে মূহুর্তেই সবকিছু ঠিক করে দিতে।

মুখে কিছু না বলে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সীটে হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন মিসেস নুসরাত।

জাওয়াদ হেসে বলল, আমার কি মনেহয় জানো খালামণি?

কি?

প্রতিটি মানুষের কাছেই একটা করে জাদুর ছড়ি আছে। যা ঘুরিয়ে অন্যকে যেমন মুগ্ধতার সন্ধান দেয়া যায়, তেমনি ছুমন্তর করে দেয়া যায় নিজের সমস্যাগুলোকেও। সেই জাদুর ছড়িটি হচ্ছে, সর্বাবস্থায় আল্লাহ প্রতি বিশ্বাস ও ভরসা। জীবনে আমি অসংখ্য বার নানান ধরণের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। সমস্ত সমস্যার ম্যাজিক্যাল সমাধান একটাই পেয়েছি। সেটা হচ্ছে, অস্থির না হয়ে বিশ্বাস রাখা নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন কল্যাণ নিহিত আছে। ভরসা রাখা ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। এবং পরিবর্তীতে যা কিছুই ঘটে আলহামদুলিল্লাহ বলে সেটাকে মেনে নেয়া। এই বিশ্বাস, ভরসা এবং মেনে নেবার মাঝে যে কি প্রশান্তি লুকায়িত সেটা শব্দে ধারণ করা সম্ভব নয় কখনোই। তাই কোন কিছুর জন্য অন্য কোন মানুষকে দায়ী না করে তুমি এই বিশ্বাস, ভরসা এবং মেনে নেবার পদ্ধতিটা ট্রাই করে দেখো। দেখবে অকারণ অস্থিরতা, অশান্তি সব ঝরে পড়ে যাবে মন থেকে।

নিসেস নুসরাত হেসে বললেন, আচ্ছা ট্রাই করে দেখবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সত্যিই তোর কখনো কাউকে দায়ী মনেহয় না? কারো উপর রাগ হয় না? তোর মেঝ মামার উপরও না?

অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল জাওয়াদ। এরপর বলল, রাগ হয়। মাঝে মাঝে প্রচন্ড রাগ হয়। তবে সেটা নানাভাইয়ের উপর। খালামণি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবকিছুকে সুন্দর ভাবে পরিচালনা করার ছক কেটে দেয়া আছে ইসলামে। মানুষ ইচ্ছে করে সেই ছকের বাইরে গিয়ে নিজের এবং তার সাথে জড়িত আরো অনেকের জন্য সমস্যা ডেকে আনে। নানাভাই কখনোই একজন আদর্শ পিতা ছিলেন না উনার সন্তানদের জন্য। মুসলিম হয়েও মেঝ মামা একজন কাফিরের জীবন যাপন করে এসেছে সবসময়। সন্তানকে সঠিক ও ভুল পথের জ্ঞান না দিয়ে, ভুল পথে চলছে সেই উপলব্ধি জাগ্রত করার চেষ্টা না করে নানাভাই সরাসরি শাস্তির বিধানে চলে গিয়েছিলেন। সিনেমাটিক স্টাইলে মেঝ মামাকে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করেছিলেন। এটা যেমন নানাভাইর ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এরচেয়েও বড় ভুল ছিল দেশে বিদেশে যেখানে যত প্রপার্টিস, বিজনেস ছিল সব আমাদের অনাগত সন্তানদের নামে উইল করে দেয়াটা।

ওটা বাবা তোর আর নূহার প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসার কারণে করেছিল।

জানি। ঠিক তেমনি নানাভাইও জানতো এই সংবাদ শোনা মাত্রই মেঝ মামা রাগে পাগল উঠবে। মূলত এই কান্ডটা মেঝ মামাকে ক্ষেপানোর লক্ষ্যে নানাভাইর একটা প্ল্যান ছিল। এমনটা হয় অনেক সময় মানুষের সাথে। বিশেষ করে তখন যখন ভুল করার পরেও নিজের ভুলটাকে মানুষ মেনে নিতে চায় না। তখন মানুষ নিজের ক্ষমতার জোড়ে নিজের বদলে ভুলটিকেই শাস্তি দেবার, নিশ্চিহ্ন করে দেবার চেষ্টা করে। নানাভাইও ঠিক এমনটাই করতে চেয়েছিলেন মেঝ মামার সাথে। উনি পিতার হক আদায় করেননি এটা স্বীকার না করে উল্টো পিতা হবার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। একজন দুনিয়া স্বর্বস্ব মানুষকে অর্থ-সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা অনেকটা নিশংস কোন প্রাণীর মুখের সামনে থেকে আহার ছিনিয়ে নেবার মতো। নানাভাই এটা কিভাবে আশা করেছিলেন যে উনার মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত সন্তান মুখ বুজে চুপচাপ দুনিয়াবী এত বড় ক্ষতি মেনে নেবে? বরং দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় নানাভাইর প্রস্তুত থাকা উচিত ছিল এর বদলে সবচেয়ে দুর্বল কোন জায়গায় পাল্টা আঘাতের জন্য।

আসলেই অনেক বড় ভুল করেছিলেন বাবা। আর বাবার সেই ভুলের মাশুল তোকে আর নূহাকে দিতে হয়েছিল। এখনো দিয়ে যাচ্ছিস।

সেই ভুলের মাশুল আরো অনেকেই দিতে হয়েছিল খালামণি। আমাদের সেই মেডিকেল ট্যুরে আমি ছাড়াও সিনিয়র-জুনিয়র মিলিয়ে আরো নয়জন ডক্টর ছিল। খালামণি এখনো যখন আমি চোখ বন্ধ করি আমার সামনে মাশফির হাস্যেজ্জল চেহারাটা ভেসে ওঠে। ক্যাম্প থেকে ফিরে দেশে যাবার প্ল্যান ছিল ওর। ডক্টর হয়েছে, বাবা-মার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন পূরণ করেছে। দেশে পাত্রী খোঁজা হচ্ছে বিয়ের জন্য। আরো কত শত প্ল্যান ছিল ছেলেটার। আমাদের গ্রুপের একজন প্রেগন্যান্ট ছিল। দুইজনের স্ত্রী ও সন্তানরা অপেক্ষায় ছিল তাদের ফিরে আসার। তাদের কথা যখন চিন্তা করি তখন নিজের ভাগ্যেকে অনেক বেশি প্রসন্ন মনেহয়। মেঝ মামার ষড়যন্ত্রে করা ওই এক্সিডেন্টে আমি যদি সত্যি সত্যিই মারা যেতাম আমাদের পরিবারের সদস্যদের কষ্ট হলেও সবাই ঠিকই মানিয়ে নিতো একসময়। ইনফ্যাক্ট, তোমরা সবাই আমাকে ছাড়া নিজ নিজ জীবনে অভ্যস্ত হয়েও গিয়েছিলে। আড়াই বছর পর যদি আমি ফিরে না আসতাম এতদিনে হয়তো তোমাদের মনের এক কোণে আমার স্মৃতিরা শীত নিদ্রায় চলে যেতো। আমার চলে যাওয়াতে নয়, মূলত আবার ফিরে আসাতে আমাদের পরিবারকে প্রচন্ড এক ঝড়ের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কিন্তু ফিরে আসার পর নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে যখন আমি আমার সাথীদের পরিবার খোঁজ নিয়েছিলাম। তখন ফিল করেছিলাম কতটা অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন প্রতিটা পরিবার।  

কিন্তু এখন তো সবাই ভালো আছে। সবার পরিবারের যাবতীয় সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তো তুই পালন করেছিলি। কারো কারোটা এখনো করে চলছিস।

আলহামদুলিল্লাহ্‌ সেজন্যই তো আমার বার বার শুধু একথাটাই মনেহয় আল্লাহ আমাকে এই পরিবারগুলোর জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। নয়তো জাহাজে আমরা মোট চৌদ্দজন ছিলাম। এবং যেভাবে জাহাজটাকে ধ্বংস করা হয়েছিল। তাতে কারোরই বেঁচে যাবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কেউ বেঁচে নেইও, একমাত্র আমি ছাড়া।

আমাকে একবার দক্ষিণ সাগরের ঐ দ্বীপটাতে নিয়ে যাবি? আমি দ্বীপের মানুষগুলোকে নিজ মুখে শুকরিয়া আদায় করতে চাই। মাঝে মাঝে মনেহয় দ্বীপের মানুষগুলো ঐ এক্সিডেন্ট থেকে তোকে যেভাবে সাহায্য করেছিল। সেভাবে যদি মেঝ ভাইয়ের কাছ থেকেও তোকে রক্ষা করতে পারতো। যদি তোকে মেঝভাইয়ের হাতে তোকে তুলে না দিতো। তাহলে হয়তো আজ সবকিছু অন্য রকম হতো।  

জাওয়াদ বলল, যা আমাদের ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে খালামণি। তাই এটা হলে কি হতো, ওটা হলে কি হতো এমন ভাবনাগুলোকে প্রশ্রয় না দেয়াটাই উত্তম। বরং যা ঘটেছে তারচেয়ে খারাপ কিছু যে ঘটেনি সেজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। মেঝ মামা আমাকে বন্দী করে রেখেছিল নানাভাই আর পুরো পরিবারের সবার জীবনের সুখ শান্তি কেড়ে নেয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু একটা সময় মামা যখন দেখলো পরিবারের সবাই ধীরে ধীরে শোক কাটিয়ে উঠেছে। আমাকে ছাড়াই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে শুরু করেছে। তখন ক্ষুব্ধ হয়ে চিৎকার করতো আমার সামনে। বলতো, দেখেছো কাদের জন্য দিনরাত এক করে পরিশ্রম করেছো বুঝতে শেখার পর থেকে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তোমাকে সবাই বেমালুম ভুলে গিয়েছে। আগে শুধু জানতাম কিন্তু ঐ সময় আমি গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলাম যে, জীবন আসলেই কারো জন্য থেমে থাকে না। বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে অত্যাবশ্যক যাকে আমরা মনে করি। তাকে ছাড়াও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারি। প্রায় সব মানুষের জীবনেই মনেহয় এমন কোন না কোন ঘটনা ঘটে, যা তাদেরকে এমন অভিজ্ঞতার ভান্ডার উপহার দিয়ে যায়, যা কিনা হাজার হাজার বই পড়েও অর্জন করা সম্ভব হয় হয় না। যে অভিজ্ঞতা জীবন সম্পর্কে তাদের উপলব্ধিকে এক ঝাটকাতেই অনেক গভীরে পৌঁছে দেয়। যারফলে বেড়ে যায় তাদের মনের ল্যান্সের পাওয়ার। চারপাশের ঘটনা প্রবাহকে দেখতে পারে আরো একটু কাছ থেকে। বুঝে নিতে পারে এমন অনেক কিছুই যা হয়তো সাধারণের বোধগম্যতার বাইরে। আড়াই বছরের বন্দী জীবন আমাকেও উপলব্ধির বিশাল ভান্ডার উপহার দিয়ে গিয়েছে।

আমাদের প্রতি কি তোর খুব অভিমান হয়েছিল তখন?

জাওয়াদ হেসে বলল, আমি কি অবুঝ কোন শিশু ছিলাম খালামণি? তখনো আমার জানা ছিল কারো মৃত্যু সবচেয়ে অপূরণীয় ক্ষতি এটা যেমন সত্য। ঠিক তেমনি কারো মৃত্যুটাকেই মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়। যাইহোক, মেঝমামা কখনোই আমাকে শারীরিক কোন কষ্ট দেয়নি। মাঝে মাঝে পরিবারের টূকটাক খোঁজ খবরও দিতো আমাকে। কিন্তু রাহাতের সাথে নূহার বিয়ের সংবাদটা দেয়নি। বিয়ের পর রাহাতের সাথে নূহার মানিয়ে নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে মামা। এরপর আমাকে মুক্ত করে দিয়েছেন। কারণ মামার জানা ছিল আমি বাড়িতে যাওয়া মানেই সবকিছু এলোমেলো যাওয়া। আমি আবারো শিওর হয়েছিলাম একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য একজন ভুল মানুষই যথেষ্ট।  

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিসেস নুসরাত বললেন, আমার তো সবচেয়ে বেশি রাগ হয় তোর আর নূহার উপর।এক্সিডেন্টের সবাই মারা গিয়েছিল। তাই আমরা ধরে নিয়েছিলাম তুইও আর নেই। সেজন্য নূহাকে জোর জবরদস্তি করে আবারো বিয়ে দিয়েছিলাম সবাই মিলে। এছাড়া ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার অন্য কোন চয়েজ ছিল না আমাদের কাছে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরুও করেছিল নূহা। এরমধ্যে তুই ফিরে এলি। এখনো আমার বুঝে আসে না ফিরে এসে নতুন করে একসাথে জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত না নিয়ে তোরা দুইজন একে অন্যের থেকে আলাদা কেন হয়ে গেলি?

আমরা দুইজন আবার নতুন করে শুরু করলে রাহাতের কি হতো? খালামণি এতটা স্বার্থপর না আমার পক্ষে হওয়াটা সম্ভব ছিল, না নূহার পক্ষে। আমি কিভাবে সেই ছেলেটির কাছ থেকে ওর জীবনসঙ্গিনীকে কেড়ে নিতাম, যে আমার অবর্তমানে আমার স্ত্রী-সন্তানের দায়িত্ব বুক পেতে গ্রহণ করেছিল? একজন স্বার্থপর মানুষের যে ভয়ংকর চিত্র মেঝ মামা আমার মনে এঁকে দিয়েছেন। এরপরে আমার পক্ষে আর যাই কিছু হোক নিজের কারণে স্বার্থপর হওয়া সম্ভব না। তাছাড়া উপকারী কারো অপকার করার শিক্ষা তো তোমরা কখনোই আমাদেরকে দাওনি। বরং উত্তম প্রতিদান দেবার শিক্ষা দিয়েছো। ইসলামও আমাদেরকে এমন দিক নির্দেশনাই দেয়। তাই অকৃত্রিম ভালোবাসার বদলে রাহাতকে আঘাত করা আমাদের একজনের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। দোয়া করি আল্লাহ যেন কোনদিন আমাদের মনটাকে এতটা সংকীর্ণ না করেন। যাতে অন্যের কষ্টের বদলে আমাদেরকে নিজেদের জন্য সুখ কিনতে হয়।

নূহা আর জাওয়াদের প্রতি অপ্রতিরোধ্য অভিমানে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন তখন মিসেস নুসরাত। সারাপথ আর একটি কথাও বলেননি জাওয়াদের সাথে। জাওয়াদ আর নূহার আলাদা হয়ে যাবার সিদ্ধান্তে পরিবারের প্রতিটি সদস্য অসন্তুষ্ট হয়েছিল। সবার মনের কোনে সেই অসন্তোষ এখনো যে চুপটি করে বসে রয়েছে সেটাও বুঝতে পারে জাওয়াদ। কিন্তু ঐ সময় যেমন এছাড়া করার কিছুই ছিল না, এখনো নেই। পরিবারের এত দরদী মনের মানুষ গুলো কেন তাদের সিদ্ধান্তটাকে উদার চিত্তে মেনে নিতে পারেনি। সেই ভাবনাটা মাঝে মাঝে বেশ অবাক করে জাওয়াদকে। অথচ নূহা আর জাওয়াদের সিদ্ধান্তটাই তো সঠিক ছিল। রাহাতের সমস্ত ত্যাগ, ভালোবাসা ভুলে গিয়ে যদি জাওয়াদ আর নূহা আবারো নতুন করে শুরুর সিদ্ধান্ত নিতো। সেটা হতো ভীষণ রকম স্বার্থপর একটি সিদ্ধান্ত। তবে পরিবারের বাকি সদস্যরা যাই বলুক। নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে জাওয়াদ আর নূহার মনে কোন দ্বীধা-দ্বন্দ্ব বা আফসোস নেই। বরং নিজ নিজ বিবেকের কাছে স্বচ্ছতা আছে। এখন বাচ্চারা যাতে তাদের সিদ্ধান্তকে বুঝে, মেনে নিতে পারে মনে মনে আল্লাহর দরবারে সেই প্রার্থনাই করতে লাগলো জাওয়াদ।    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন