রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২২



দরজা ঠেলে নায়লাকে ঢুকতে দেখে বেশ অবাক হলো নূহা। এই সময় তো ক্লাসে থাকার কথা নায়লার। তারমানে ক্লাস বাদ দিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছে নূহার সাথে কথা বলার জন্য। স্বাভাবিকের চেয়েও অনেক নীচু স্বরে সালাম দিলো নায়লা।

নূহা সালামের জবাব দিয়ে হেসে বলল, তুমি আসবে জানাওনি কেন? আমি তো এখনই বেরোচ্ছিলাম।

জরুরি কোন কাজে যাচ্ছো আপ্পা?

না বাসায় যাচ্ছিলাম। দুই সপ্তাহের জন্য তোমাদের বাড়ির মেহমান হতে যাচ্ছি ইনশাআল্লাহ। সেটার প্যাকিং করার জন্য বাসায় যাচ্ছিলাম। তোমার কাছে তাই দুটা অপশন আছে। আমার সাথে বাসায় যাওয়া। কিংবা এখন ক্লাসে চলে যাও। আমি তো ইনশাআল্লাহ থাকবোই আজ থেকে তোমাদের সাথেই। রাতে কথা বলা যাবে। কি করবে তুমি বলো?

আমি তোমার সাথে বাসায় যাব আপ্পা।

নূহা হেসে বলল, ওকে তাহলে চলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালের টুকটাক যে কাজগুলো বাকি ছিল সেগুলো কাজ সেরে নায়লাকে সাথে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো নূহা। বেশ কিছুক্ষণ পর নায়লা বলল, ভাইজান সৈকতের ব্যাপারে কি বলেছেন আপ্পা?  

প্রশ্নের জবাব কি দেবে সেটা ভেবে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো নূহা। নূহার পরিকল্পনা ছিল আগে পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, হাসি-আনন্দ, ত্যাগ-ভালোবাসা, সদস্যের একে অন্যের কল্ল্যানকামীতায় ভরসা ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করার পর নায়লাকে ভাইয়াদের অপছন্দের কথা জানাবে। কিন্তু নায়লা আগেই চলে আসার কারণে নূহা যে প্রস্তুতি নিয়েছিল সেটা ভেঙে গিয়েছে। এখন অন্যকোন ভাবে কথা বলা শুরু করতে হবে। ‘পরিকল্পনার বাইরে মানুষের জীবনে যে অংশগুলো আসে, সেগুলোকে দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করতে পারার মাঝেই নিহিত পরীক্ষা জয়ের তৃপ্তি। সাথে ছাতা না থাকার পরও খোলা ময়দানে নামা হঠাৎ বৃষ্টিতে ভেজাকে প্রতিহত করতে পারাই হচ্ছে সাফল্য।’ আচ্ছা এই বাণী খানি কোন মনিষীর? মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নূহা। তার বাণীময় জীবনের সেভেন্টি ফাইভ পার্সসেন্ট বাণীই মনিষী জাওয়াদের বলা। এই লোক কথা কম আর বাণী বেশি বলে। বসে বসে যদি শুধু বাণী বলতো তাও শান্তি ছিল। কিন্তু উনি নিজের পছন্দ-অপছন্দ সবার উপর জাহির করেন। এই যেমন কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত যদি সৈকতকে বাড়ির জামাই হিসেবে পছন্দ করে নিতেন? কিন্তু উনি সেটা তো করেনইনি। উল্টো নায়লাকে বোঝানোর দায়িত্ব তার মাথায় চাপিয়ে দিয়েছেন। এমনিতেই কি কম সমস্যার মধ্যে থাকে সে? তারপরও সবাই জীবন্ত সমাধানের বাক্স মনে করে সারাক্ষণই তাদের সমস্যাগুলো চাপাতে থাকে। সাথে সাথেই আবার মনে পড়লো, " সমস্যা দেখে কভু পেয়ো নাকো ভয়, সাহসী মোকাবেলাই করে সমস্যাকে ক্ষয়। সমস্যা যখনই দল বল নিয়ে দেবে হানা, কখনোই ভেবো না তাদের উটকো যাতনা। সমস্যার মাঝেই লুকায়িত আছে সমূহ সম্ভাবনা। খুঁজে নিয়ে নঁকশা আঁকতে হয় রঙিন আল্পনা।" অর্থাৎ, এখন অস্থির না হয়ে তাকেও নায়লার মনের নকঁশা অনুযায়ী আলপনা আঁকতে হবে।

নায়লার প্রশ্ন শুনতেই পাইনি এমন ভাব দেখিয়ে নূহা বলল, সকাল থেকে মাথাটা এলোমেলো হয়ে আছে একদম। বাসায় পৌছে জটপট প্যাকিং সেরে বাড়িতে পৌছেই সবার আগে ঘুম দিতে হবে।

কেন আপ্পা? কি হয়েছে তোমার?

আর বোলো না সকাল থেকে এমন এক মেয়ের সাথে কথা বলছি যে ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎ করতে করতে আমার মগজ পুরা ফ্রাই করে দিয়েছে। মেয়েটার মনের মধ্যে ভবিষ্যৎকে ঘিরে এমন সব নেগেটিভ চিন্তা-ভাবনা যা আদৌ হবার কোন সম্ভাবনা বর্তমানে অন্তত পরিলক্ষিত হয় না। অথচ এইসব দুশ্চিন্তার ওর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বন্ধ হবার পথে। উদাহরণ স্বরূপ ওর বিয়ের কথাটাই যদি বলি। বিয়ের কথাবার্তা চলছে ওর। এখনো কিছুই ঠিক হয়নি। অথচ এই মেয়ে বিয়ের পর ফুলসজ্জার রাত থেকে শুরু করে সন্তানদের নিয়ে পর্যন্ত চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছে। বিয়ের পর সে এটা করতে চায় না, ওটা করতে চায় না। হাজবেন্ড যদি না মানে তাহলে মনেহয় সংসার করা হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম, দেখো বিয়ে এমন একটা সম্পর্ক এর মাঝে বিরাজমান সবকিছুই যে সবার পছন্দনীয় হবে এমন কোন নিয়ম আসলে নেই। এই বিষয়টা তাই মেনে নেয়ার মাঝেই কল্ল্যাণ। তুমি রিলাক্স হবার চেষ্টা করো আগে। টেনশন যে কোন সমস্যাকে অনেক বেশি বড় আর ভারি বোঝা হিসেবে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। তিলকে তাল হিসেবে দেখে তাই আমরা ঘাবড়ে যাই। পাথরকে পাহাড় ভেবে হাল ছেড়ে দেই। এই দৃষ্টিভ্রম দেখে বাঁচতে চাইলে দুশ্চিন্তার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করতে হবে। আর সেজন্য ভবিষ্যতে কি হবে না হবে এই ভাবনাটার তালা খুঁজে বের করে সেটাকে লক করে দিতে হবে সবার আগে।

আসলেই মনেহয় আমরা অকারণে অনেক বেশি চিন্তা করি আপ্পা।

বেশি বেশি চিন্তা করতে তো দোষ নেই। বরং চিন্তা করাটা বেশ ভালো। কিন্তু দুশ্চিন্তা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো। বিশেষ করে অতীতের ভুল নিয়ে অকারণ দুশ্চিন্তা এবং মনকষ্টে ভোগা। এবং ভবিষ্যৎকে ঘিরে সুখস্বপ্ন কিংবা উৎকণ্ঠায় বিভোর থাকা। ভবিষ্যৎ তো সম্পূর্ণ রূপে অজানা তাই অজানার পেছনে মনের শক্তি ব্যয় করার কোন অর্থই হয় না। তাছাড়া নিজেরা একটু চিন্তা করলেও দেখতে পাবো যে, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের বেশির ভাগই দুশ্চিন্তাই অসংঘটিতই থেকে যায়। চলে যাওয়া প্রতিটা মুহুর্ত অতীত আর আগত প্রতিটা মুহুর্ত ভবিষ্যৎ। দাঁড়িয়ে থাকা মুহুর্তটিই হচ্ছে বর্তমান। অতীত ও বর্তমানের উপর আমাদের কন্ট্রোল নেই। তবে এটাও আবার ঠিক যা ঘটে গিয়েছে তাকে কখনই বদলানো সম্ভব নয়। কিন্তু যা ঘটতে যাচ্ছে তাকে কর্মের দ্বারা বদলানো সম্ভব যদি আল্লাহ চান। কিন্তু সেই বদলটাও নির্ভর করে বর্তমান ইচ্ছা ও চেষ্টার উপর। তাই হাতে থাকা বর্তমানের এই একটি মুহুর্তকে যারা কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। ইনশাআল্লাহ সবকিছু তাহলে অনেক সহজ হয়ে যায় তাদের জন্য। কিন্তু একথাটা বার বার মেয়েটাকে বুঝিয়েও লাভ হয়নি।

মেয়েটা কি বুঝতে পাইছে না তোমার কথা নাকি বুঝতে চাইছে না?

আসলে কি জানো মানুষ বেশির ভাগ সময়ই অন্যের মুখ থেকে সেটাই শুনতে চায়, যেটা সে নিজে চিন্তা করছে। আমরা অন্যেদেরকে হ্যা এর চেয়ে না বেশি বলি। ইতিবাচকের তুলনায় আমাদের নেতিবাচক আচরণই বেশি সহ্য করতে হয় মানুষকে। কিন্তু আমরাই আবার অন্যের মুখে না শুনতে নারাজ থাকি। অন্যদের নেতিবাচক আচরণ মেনে নিতে পারি না। এখানেও ঠিক একই ব্যাপার। মেয়েটা যেহেতু ওর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিন্তা করছে, কথা বলছে তাই চাইছে আমিও যেন সেটাকে একই ভাবে মূল্যায়ন করি। কিন্তু ওর অভিজ্ঞতার বাইরেও যে বিশাল একটা জগত রয়ে গিয়েছে সেটা মানতে চাইছে না কিংবা নেতিবাচক অভিজ্ঞতা ওকে বার বার পেছন থেকে টেনে ধরছে। যাইহোক, ওর কথা থাক এখন। তোমার কথা বলো। পড়াশোনা কেমন চলছে?

আলহামদুলিল্লাহ আপ্পা ভালো চলছে।

তোমাদের ভাইজান কি তোমাদের সবার রিপোর্ট কার্ড দেখেন?

সাথে সাথে অন্ধকার হয়ে গেলো নায়লার চেহারা। শুকনো মুখে বলল, হ্যা আপ্পা। ভাইজান কি তোমাদের রিপোর্ট কার্ডও দেখতেন সবসময়?

নূহা হেসে বলল, হুম। অন্য সবাই এটা নিয়ে আতঙ্কে থাকলেও আমার বেশ ভালো লাগতো। রেজাল্ট খারাপ হলেই কৈফিয়ত দিতে হবে এই ভয়ে ফাঁকি দেবার চিন্তাই আসতো না কখনো মনে। তাছাড়া শুধু দুনিয়াবী পরীক্ষার ব্যাপারে তো না। জীবনকে চির কল্যাণকর জান্নাতের পথে পরিচালিত করার ব্যাপারে আরো বেশি তদারকি করতেন ভাইয়ারা। আলহামদুলিল্লাহ এটা আমাদের অনেক বড় সৌভাগ্য।  

এটা আমিও বুঝি আপ্পা। কিন্তু কখনো যদি কোন কারণে রেজাল্ট খারাপ হয়ে যায় কৈফিয়ত দিতে হয় সবার সামনে। এটা ভালো লাগে না।

পরকালে আমাদের বিচারও সবার সামনেই হবে। আমরা মানুষকে দেখানোর জন্য, মানুষের চোখে ভালো সাজার জন্য অনেক উত্তম কাজ করি। ঠিক তেমনি নিজেদের দোষ, ঘাটতিগুলোকে মানুষের কাছ থেকে আড়াল করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। এভাবেই আমরা ধীরে ধীরে আল্লাহর চেয়েও মানুষের কাছে উত্তম হবার চেষ্টায় লিপ্ত হই। আবার অবলীলায় নানান গোনাহের কাজ করে ফেলি আমরা। কিন্তু আল্লাহ দেখছেন এই বোধের চেয়েও আমাদের মনে বেশি কাজ করে মানুষ যাতে জানতে না পারে। যারফলে আমাদের দ্বারা ছোট ছোট শিরক সংঘঠিত হতে শুরু করে। এই ব্যাপারটাকে ব্যাহত করার জন্যই আমাদের ভাইয়ারা সমালোচনা ও প্রশংসা উভয় ক্ষেত্রই উন্মুক্ত রেখেছেন।

নায়লা হেসে বলল, তুমি যখন বুঝিয়ে বলো তখন সবকিছুই ঠিক মনেহয় আপ্পা।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। চলো তোমাকে আমার ছোটবেলার একটা মজার ঘটনা বলি। যখন ক্লাস সিক্সে পড়তাম ম্যাথ পরীক্ষায় একবার ৯৫ পেয়েছিলাম। রিপোর্ট কার্ড দেখানোর সাথে সাথে ভাইয়ার হাসি ভরা চেহারাটা একটু খানি গোমড়া হয়ে গিয়েছিল। ঐ সময় কিছু বলেননি আমাকে। কিন্তু পরে কেন একটি ম্যাথ ভুল করেছিলাম সেটা জানতে চাইলেন। রাগ করে না খুব সুন্দর করেই ভাইয়া জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি তো সব ম্যাথ পারতে। ম্যাথের নিয়ম কানুনও সব তোমার জানা। তাহলে কেন ভুল হয়েছে? জবাবে বলেছিলাম, আমার নিয়মে ভুল হয়নি ভাইয়া।আমি এক জায়গায় সিক্স হবে কিন্তু বেখেয়ালে নাইন লিখে ফেলেছিলাম। ভাইয়া তখন বললেন, ম্যাথে হান্ডেড পার্সেন্ট মার্কস পাওয়াটা তেমন কোন কঠিন ব্যাপার না। কারণ ম্যাথ যদি তুমি ঠিকমতো  করো তাহলে নাম্বার কম দেবার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং, তোমার ম্যাথ রিপোর্ট আমি সবসময় হান্ডেড পার্সেন্ট দেখতে চাই। ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, যদি কখনো ভুল হয়ে যায় আমার?  যদি আমি হান্ডেড পার্সেন্ট না পাই? ভাইয়া তখন বললেন, ''যদি'' এই শব্দটাকেই মনে প্রবেশ করতে  দেবে না কখনো। তুমি শুধু মনে রাখবে তোমাকে হান্ডেড পেতে হবে। যেভাবেই হোক পেতেই হবে। হান্ডেড পাবার ব্যাপারে তোমাকে আগে হান্ডেড পার্সেন্ট শিওর হতে হবে। হান্ডেড পার্সেন্ট কনফিডেন্ট নিয়েও যখন তুমি হান্ডেড অর্জন করতে ব্যর্থ হবে। মনে করবে ওটাই তোমার জন্য পারফেক্ট। আমি তখন বুঝে গিয়েছিলাম ভাইয়া ঠিক কি বলতে চাইছেন আমাকে। এরপর থেকে জীবনে যখনই আমাকে কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এবং আমি কিছুটা হলেও ভীত হয়েছি বা আমার আত্মবিশ্বাস দোলায়িত ছিল। ভাইয়া আমাকে ম্যাথের হান্ডেড পার্সেন্টের উদাহরণটি মনে করিয়ে দিতেন। আমি তখন শুধু মনে প্রাণে এটা চিন্তা করার চেষ্টা করতাম যে, আমি এটা পারবো। কারণ আমাকে এটা পারতেই হবে। এবং আমি যে জিতবোই এতে কোন সন্দেহ নেই ইনশাআল্লাহ। এরপরও যদি হেরে যাই সেটা আমার ভাগ্য। কিন্তু যেহেতু জানি না ভাগ্যে কি আছে সুতরাং আমাকে আমার হান্ডেড পার্সেন্ট দিতে হবে। দিতেই হবে।

নায়লা হেসে বলল, জ্বি আপ্পা আমিও বুঝতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। চেষ্টা করার পরও যদি আমি ব্যর্থ হই তাহলে সেটাই আমার ভাগ্যে ছিল। কিন্তু চেষ্টা করার আগে কখনোই হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না।

নূহা হাসি মুখে হুম বলে বেশ অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, বিয়ের আগে তোমাদের রাহাত ভাইয়া আমাদের পরিবারের কেউ ছিলেন না সেটা তো জানোই। উনি ভাইয়াদের সংগঠনের একজন দায়িত্বশীল ছিলেন। উনার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎটা বেশ ফ্লীমি ছিল। শুনবে সেই ঘটনা?

নায়লা চোখ বড় বড় করে বিশাল হাসি দিয়ে বলল, সত্যিই আমাকে বলবে আপ্পা?

নূহা হেসে বলল, অবশ্যই বলবো বালিকা। আচ্ছা শোনো সেই কাহিনী। সুইজারল্যান্ডে একটি ইসলামিক কনফারেন্সে গিয়েছিলেন তোমাদের ভাইজান। উনি সাধারণত যেখানেই যেতেন আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতেন। কনফারেন্সে আমাদের ভাইয়ারা ছাড়াও সংগঠনের আরো কয়েকজন ভাইও গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে রাহাতও ছিলেন। কনফারেন্স শেষ করে সুইজারল্যান্ড থেকে ফেরার পথে ভয়াবহ খারাপ ওয়েদারের কারণে এয়ারপোর্টে আটকা পড়েছিলাম প্রায় সাত ঘন্টা। ঐ সময় তোমাদের ভাইজান ওখানে যে কয়জন ভাই ছিলেন তাদের সম্পর্কে বলেছিলেন। কে কেমন, কার সাথে কিভাবে পরিচয় হয়েছিল উনার, প্রত্যেকের স্পেশালিটি ইত্যাদি সবকিছু। রাহাতের সম্পর্কেও সবকিছু বলেছিলেন। কেউ হাফেজ শুনলেই তার প্রতি অন্যরকম একটা শ্রদ্ধা কাজ করে আমার মনে। আল্লাহর পবিত্র কালামকে বুকে ধারণ করা মানুষগুলো কতটা বেশি অসাধারণ হন সেটা পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম বলেই হয়তো এমনটা হয়। এছাড়া ওখানে উপস্থিত সবার চেয়ে বেশি খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন রাহাত আমাদের। বার বার এসে জানতে চাইছিল, ভাইজান আপনাদের কিছু লাগবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।

নায়লা আশাভঙ্গের সুরে বলল, তারমানে তোমাদের চলতে চলতে হঠাৎ একে অন্যের সাথে ধাক্কা লাগা, হাতের বইপত্র পড়ে যাওয়া, তুলতে গিয়ে মাথায় সাথে মাথা লেগে যাওয়া এমন কিছুই হয়নি? তারউপর ভাইজান ছিলেন তখন তোমার সাথে পাহাড়াদার হয়ে। ধূর, এটা বুঝি ফ্লীমি হলো?

নূহা হাসতে হাসতে বলল, এই মেয়ে এইসব সাংঘাতিক কথাবার্তা কোথা থেকে আবিষ্কার করলো? দাঁড়াও তোমার বন্ধুবান্ধব যাচাই বাছাইয়ের মিশনে নামতে হবে অতি শিঘ্রীই।

নায়লাও হেসে বলল, তারপর বলো কি হল।

এরপর আর কিছু হয়নি। কিন্তু ঐ ঘটনার কারণেই রাহাতের সম্পর্কে সবকিছু জানতে পেরেছিলাম। এবং সেই জানার কারণেই আমি মূলত উনাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলাম। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও তোমাদের ভাইজানের প্রতি রাহাতের শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসাকে আমি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। এবং তোমাদের ভাইজানের মুখে শোনা রাহাতের কৃতজ্ঞ স্বভাব, উত্তম চরিত্র সবকিছু মিলিয়ে মনে এই বিশ্বাস জেগেছিল উনি আমাকে আমার মত থাকতে দেবেন। বিয়ের সময় আমরা শুধু রাহাতকেই দেখেছিলাম ওর পরিবারকে নয়। আমাদের বিয়ের বেশ কিছু সময় পর জিশান, জিহাদ আর নাবিহাকে রেখেই আমি কিছুদিনের জন্য রাহাতের পরিবারের সবার সাথে পরিচিত হতে দেশে গিয়েছিলাম। উনাদের বাড়ির পরিবেশ আমাদের বাড়ির পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। ঘরের বাইরে কেউ কেউ হিজাব করলেও ঘরের ভেতর মাহরাম-নন মাহরাম বলে যে কিছু আছে এই বোধটাই অনুপস্থিত। ওখানে যাবার পর আমার মনে হচ্ছিলো আলো, বাতাস হীন কোথাও আটকা পড়েছি। নক ছাড়াই যে কেউ যে কারো রুমে ঢুকে পড়ছে। আমি ঘরের ভেতর হিজাব পড়ে থাকতাম বলেও সবাই বেশ বিরক্ত হতেন। বলতেন, এখানে তো পরিবারের বাইরের কেউ নেই। এটা বাড়াবাড়ি ইত্যাদি। তারপর পুরুষ আত্মীয়তা এসেও আমাকে দেখতে চাইতেন। রাহাত পরিবারের সবার ছোট তাই বড়দেরকে কিছু বলতেও পারতো না। আমি রাহাতের অপরগতাও বুঝতে পেরেছিলাম। তবে সবকিছু মিলিয়ে দুই সপ্তাহেই পাগল হতে বাকি ছিল শুধু আমার। এখনো আমি ভয়তে দেশে যাই না। রাহাত একা একা গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে আসে ওর পরিবারের সাথে। আমরা অনেক ভাবে ওদের পরিবারের সদস্যদেরকে শরীয়ত ভিত্তিক জীবন যাপনের ব্যাপারে দাওয়াত দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তেমন কোন লাভ হয়নি। আবার জারিফ বুঝতে শেখার পর ওকে ওর চাচা-ফুপ্পিদের সাথে পরিচয় করাতে দেশে নিয়ে গিয়েও বেশ বিপদে পড়তে হয়েছিল আমাকে। কাজনিরা কেন মিউজিক শুনছে, পর্দা করে না কেন কেউ, নামাজ কেন পড়ে না। জাফিরের এসব প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বাধ্য হয়েই তাই আমি আর রাহাত এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি জারিফ বড় হয়ে সব বুঝতে শেখার আগে আমরা আর কখনোই ওকে দেশে নিয়ে যাবো না। এই সমস্ত কারণে নিজ অভিজ্ঞতা থেকে মনেহয়েছে আমরা যারা খুব রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছি তাদের কখনোই উচিত না এমন কোন পরিবারে বিয়ে করা যারা শরীয়তের একদম বেসিক বিষয়গুলোও মেনে চলে না।

সৈকতের ফ্যামেলি কি এমন আপ্পা?

নূহা বলল, হ্যা। আর এই কারণেই সৈকতকে ভাইয়াদের কারো পছন্দ হয়নি। আমরা তোমার উপর আমাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাই না। বুঝতে শেখার পর থেকে জীবনকে সুন্দর করে যাপন করার অন্যান্য আর সবকিছুর মতো তোমাদের সবাইকে বিয়ের গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা, কোন কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হয় কাউকে লাইফ পার্টনার করার আগে। এসব কিছুও বলা হয়েছে, বোঝানো হয়েছে। বিয়ে শুধু দুজন মানুষ না, দুটা পরিবারের মধ্যে সেতু স্থাপন করে। এই দুটা পরিবার যদি একে অন্যের থেকে একেবারেই আলাদা হয় তাহলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাটা খুব বেশি কঠিন হয়ে যায়। হয় পরিবার থেকে দূরে সরে যাওয়া, নয়তো ঝগড়াঝাঁটি, মনোমালিন্য নিয়ে সংসার করা কিংবা স্বামী-স্ত্রীই আলাদা হয়ে যাওয়া। আর কোন অপশনই থাকে না। নায়লা বিয়ে সম্পর্কটা এমন নয় যে চাইলেই বদলে ফেলা যায়। তাই শুধু আবেগ দ্বারা সিদ্ধান্ত নেয়াটা ভুল হবে। কেউ আমার সাথী হওয়া মানে তার পুরো পরিবারও আমার সাথে জুড়ে যাওয়া। যেমন ধরো, রাহাত শরীয়তের বিধান বোঝেন, মেনে চলেন বলেই আমাদের দুজনের মধ্যে কোন সমস্যা হয়নি। আমি যখন বলেছি শরীয়তের বিধান মেনে চলতে সমস্যা হয় এমন কোথাও আমি যেতে চাই না। রাহাত বলেছে, ঠিকআছে তোমাকে যেতে হবে না। সবার আগে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আত্নীয়ের হক আমরা দূরে থেকেই যথাযথ আদায় করার চেষ্টা করবো। কিন্তু রাহাত যদি শরীয়তের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ মাইন্ডের হতো তাহলে কিন্তু আমাদের সংসার জীবন এত সুখময় হতো না। তাই আমি তোমাকে অনুরোধ করবো সবদিক বিচার-বিবেচনা করে এরপর সিদ্ধান্ত নাও। সবকিছু চিন্তা-ভাবনা করার পরও যদি তোমার সিদ্ধান্ত পজেটিভ হয়। এবং তোমার পরবর্তী জীবনের সমস্ত দায়ভার নিতে তুমি প্রস্তুত থাকো। আমি ভাইয়াদেরকে রাজী করাবো তোমাদের বিয়ের জন্য ইনশাআল্লাহ।  

কোন জবাব না দিয়ে মাথা নীচু করে বসে রইলো নায়লা। নূহাও আপাতত আর কিছু না বলাটাই ভালো ভেবে চুপ করে রইলো। বাকি পথ নিজের সাথে নায়লাকে বোঝাপড়ার করার জন্য ছেড়ে দিলো।      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন