রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি... ১৮




নক শুনে তাকিয়ে ছোট ভাই রিসাবকে হাসিতে বিকশিত হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সালাম দিয়ে জাওয়াদ বলল, কি চাই?

সালামের জবাব দিয়ে ভেতরে ঢুকে হাসতে হাসতে রিসাব বলল, কিছু চাইতে আসিনি ভাইজান বরং দিতে এসেছি।

কি?

বিশাল একটা সারপ্রাইজ নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।

আচ্ছা! তা কি সেই সারপ্রাইজ?

হাতে ধরে থাকা ম্যাগাজিনটা দেখিয়ে রিসাব বলল, এর মধ্যে বন্দী সেই সারপ্রাইজ।

জাওয়াদ বলল, এটা তো নাবিহাদের স্কুলের কালচারার ম্যাগাজিন। এটার মধ্যে সারপ্রাইজ? নাবিহার কবিতা কিংবা গল্প ছাপা হয়েছে?

রিসাব হাসি মুখে বলল, এটার মধ্যে যা ছাপা হয়েছে সেটা আমি এই নিয়ে কম করে হলেও বিশবার পড়েছি। এবং প্রতিবারই বাঁধ ভাঙ্গা অশ্রুজলে ভিজেছি। তাই তোমার অবস্থা কি হবে সেটা ভেবে আমি শঙ্কিত। কিন্তু তারপরও সবার আগে তোমাকে দেখানোর ইচ্ছেটাকে দমাতে পারিনি।

ওর মাকে নিয়ে কিছু লিখেছে?

রিসাব ম্যাগাজিনটা জাওয়াদের সামনে রেখে বলল, তুমি পড়ে দেখো। আমি নূহাকে দিয়ে আসি আরেক কপি।

না নূহাকে দিস না। এমনিতেই ভীষণ আপসেট।

রিসাব হেসে বলল, এটা পড়লে সকল আপসেট হজম হয়ে গিয়ে নূহার মন ফুল বাগিচায় বর্ণিল প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াবে ইনশাআল্লাহ।

রিসাব বেড়িয়ে যাবার পর ম্যাগাজিন হাতে তুলে নিলো জাওয়াদ। প্রতি বছরই স্কুল ম্যাগাজিনে জিহাদ, জিশান, জারিফ, নাবিহার গল্প, কবিতা ছাপা হয়। রিসাব ওদের স্কুলের ডাইরেক্টর তাই প্রিন্ট হবার সাথে সাথেই ম্যাগাজিনের ফার্স্ট কপিটা জাওয়াদের কাছে পৌছে যায় সবসময়ই। বাচ্চাদের সৃজনশীলতা বিকাশে যথাসাধ্য সহায়তা করার চেষ্টা করে জাওয়াদ। তাই ম্যাগাজিন হাতে পাবার সাথে সাথেই বাচ্চারা কি লিখেছে জানার আগ্রহে অন্য সব কাজ বন্ধ করে পড়তে শুরু করে। কিন্তু আজ রিসাবের সারপ্রাইজের কথা শুনে বুকের মধ্যে কম্পন টের পেলো জাওয়াদ। কি লিখেছে নাবিহা? কোন কষ্টের কথা লিখেনি তো ওর মাকে ঘিরে? এমন আরো নানান প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যেতে শুরু করলো। মনের সব প্রশ্নের জবাব পাবার উপায়টা যেহেতু সামনেই ছিল তাই রিসাবের মার্ক করে রাখা পেজটা ওপেন করলো। “সবার চেয়ে আপন যে জন” শিরোনাম দেখে নাবিহা যে লেখাটা ওর মাকে ঘিরেই লিখেছি বুঝে নিলো জাওয়াদ। কি লিখেছে সেটা জানার তীব্র আগ্রহ জেগে উঠলো মনে। আর দেরি না করে পড়তে শুরু জাওয়াদ।     

“ক্লাস থেকে ফিরে হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছিলাম আজ। প্রফ আজ ভীষণ কঠিন একটা হোমওয়ার্ক করতে দিয়েছেন। বলেছেন প্রথমে প্রিয় মানুষদের একটা লিস্ট করতে। এটা খুবই সহজ মুহুর্তেই করে ফেলেছি। পাপা-মামণি-বাবা-আদীব্বা-দাদুমণি-দাদাভাই-নানুমণি-নানাভাই- বড়মামা-ছোট চাচ্চু, রাহা খালামণি, কাজিন মাঈশা আর ভাইয়ারা হচ্ছে আমার প্রিয়। কিন্তু প্রফ বলেছেন প্রিয়দের মধ্যে থেকে সবচেয়ে প্রিয়জন কে সেটা খুঁজে বের করতে এবং কেন সে প্রিয় সেটা লিখে নিয়ে যেতে। কি বিপদে যে পড়েছি এরপর থেকে। ভেবেই যাচ্ছি ভেবেই যাচ্ছি। ধারণা ছিলো মামণি আমার সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু যতবার চোখ বন্ধ করছি পাপার চেহারাটাই কেন জানিনা ভেসে উঠছে মনের আয়নায়। পাপা একদিন বলেছিলো আমরা যাকে সবচেয়ে ভালোবাসি, যেজন আমাদের সবচেয়ে আপন তাকে নাকি চোখ বন্ধ করলেই নিজের মধ্যে অনুভব করা যায়। আমি বারবার শুধু পাপাকেই অনুভব করছি নিজের মধ্যে। তাহলে কি পাপাই আমার সবার চেয়ে প্রিয় মানুষ? হুম.. যেহেতু চোখ বন্ধ করলেই পাপাকে দেখতে পাচ্ছি। তাহলে নিশ্চয়ই পাপাই আমার সবচেয়ে আপন জন। এখন তাহলে খুঁজে বের করতে হবে কেন পাপা আমার সবচেয়ে প্রিয়।  

আলোচনা করলে নাকি যে কোন জিনিস তাড়াতাড়ি বোঝা যায়। আমি তাই পাপার কাছে রওনা হলাম। এই সময় পাপা একমগ গ্রীনটি পান করেন। আমি গ্রীনটি বানাতে পারি। শুধু গ্রীনটি’ই না আমি অনেক কিছু রান্না করতেও পারি। পাস্তা সেদ্ধ করতে পারি, ডিম হাফ বয়েল্ড করতে পারি, কফি বানাতে পারি, পাপা যখন রান্না করে ঠিক ঠিক মত লবণও চেখে দেখতে পারি। আমি বাসায় না থাকলে পাপার কখনোই রান্না করে না। পাপা বলে যে, আমার ‘সল্টিবেবী’ আসবে তবেই আমি রান্না করবো। পাপা আমাকে সল্টিবেবী বলে। কারণ লবণ ছাড়া সবকিছু যেমন ফিকা, আমাকে ছাড়া তেমন পাপার জীবনের সব হাসি-আনন্দ ফিকা। আমার ভাইয়ারা সবাই সল্টিবেবী হতে চায়। কিন্তু পাপা বলেছে, কে সল্টিবেবী হবে আর কে সুইটবেবী, কিউটবেবী বা নটিবেবী হবে সেটা আল্লাহ নির্ধারন করে দিয়েছেন। তাই অন্যের মত হতে চেষ্টা না করে যে যেটা আছি সেটাতেই ভালো হবার চেষ্টা করতে হবে বেশি বেশি। আমরা সবাই তাই করি। চেষ্টা করতে করতে আমি এখন ভেরি ভেরি সল্টিবেবী।

গ্রীনটি নিয়ে পাপার রুমে নক করতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা। পাপার রুমের দরজা কখনোই খোলা থাকে না। আজ খোলা কেন? 'কারণ তোমার পাপা রুমের ভেতর না তোমার পিছনে।'  কথাটা শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি পাপা দাঁড়িয়ে আছে হাসি মুখে। হাসতে হাসতে পাপা বললেন, কি  দরজা খোলা কেন সে কথাই তো ভাবছিলে তাই না? আমি হেসে মাথা ঝাঁকালাম। পাপা হেসে বললেন, দেখছো পাপা যে তোমার মনের কথা বুঝতে পারি। আমি পাপাকে গ্রীনটি দিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে আমার রুমে চলে এসেছি।পাপার সাথে আলোচনা করতে হয়নি। আমি বুঝতে পেড়েছি পাপা কেন আমার সবচেয়ে আপন জন। কারণ পাপা সবসময় আমার মনের কথাগুলো বলার আগেই বুঝে নেন। আমাকে কখনোই মুখে কিছুই বলতে হয়না। আমার পছন্দ-অপছন্দ, কি ভালো লাগে, কি করতে খুব খারাপ লাগে সব কিভাবে যেন পাপা বুঝে ফেলে। এই তো সেদিন শপিং করতে গিয়ে একটা বারবী ডল আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু সাড়ে তের বছর বয়সে আমি বারবী ডল নিয়ে খেলবো? ভাবতেই লজ্জা লাগছিল তাই পাপাকে বলিনি পছন্দের কথা। কিন্তু খুব খুব খুব ইচ্ছে করছিল ডলটা কিনতে।

রাতে ঘুমোতে যাবার জন্য রুমে ঢুকে দেখি বিছানার উপর সেই বারবী ডলটা বসে আছে। ডলের সাথে একটা কার্ডও ছিল। তাতে লেখা ছিল ‘মাই ডিয়ার সল্টিবেবী লিসেন যতদিন পাপার সামর্থ্য আছে তোমার কোন ইচ্ছে, ভালোলাগা অপুর্ণ থাকবে না ইনশাআল্লাহ। এগেইন লিসেন তোমাকে কখনোই পাপাকে মুখে কিছু বলতে হবে না। ইনশাআল্লাহ পাপা সবসময় বুঝে নেবো তোমার মনের স্বপ্নগুলোকে। কারণ তুমি হচ্ছো এক স্বপ্নালু চোখের কন্যা। আর স্বপ্নালু চোখের কন্যাদের স্বপ্নরা ছোট্ট ছোট্ট ভেলায় করে সারাক্ষণ ভেসে বেড়ায় চোখের সাগরে। জাস্ট তাদেরকে দেখে শুধু তুলে নিতে হয়। আর পাপা ইনশাআল্লাহ সবসময় তোমার মনের স্বপ্নগুলোকে তোমার চোখের সাগর থেকে’। হোমওয়ার্কের খাতাটা টেনে নিলাম আমি। লিখলাম আমার সবচেয়ে আপনজন হচ্ছে আমার পাপা। প্রিয় হবার কারণ হচ্ছে পাপা আমার মনকে বোঝে। আর এই একটি কারণই যথেষ্ট সবার চেয়ে আপন হবার জন্য।”

লেখাটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঠিক কতবার পড়লো নিজের কাছেই অজানা ছিল জাওয়াদের। কিছু যতবারই শেষ লাইনের শেষ শব্দটা পড়ছিল, চোখ ছুটে যাচ্ছিলো প্রথম লাইনের প্রথম শব্দে। লেখাটা হাজার বার পড়লেও মনেহয় আবারো পড়ার সাধ এতটুকু হ্রাস পাবে না জাওয়াদের। লেখাটিকে বুকে চেপে ধরে অশ্রু ভরা ঝাপসা চোখেই কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। হেসে হেসে কথা বলছে নাবিহা রাহাতের সাথে। জাওয়াদের ইচ্ছে হচ্ছিলো এই মূহুর্তে ছুটে যেতে নাবিহার কাছে। বুকে জড়িয়ে ধরে এত্তো এত্তো আদরে ভরিয়ে তুলতে তাদের জীবনের এই এক্সট্রা মিরাকলদের। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা যেদিন পেয়েছিল তাদের জীবনে এই মিরাকলদের আগমনী বার্তা।  

ছোট ফুপি ফোন দিয়ে জরুরী ভিত্তিতে তার চেম্বারে যেতে বলার পর থেকে একমুহুর্ত স্বস্থি পাচ্ছিলো না জাওয়াদ। মিটিং ছিল সেটা ক্যান্সেল করেই ফুপির কাছে ছুটলো। নূহার এক্সিডেন্টের পর থেকে ওর রুটিন  চেকাপ থেকে নিয়ে শুরু করে যাবতীয় সবকিছু ফুপিই দেখেন। নতুন করে আবার কোন সমস্যা দেখা দেয়নি তো নূহার ? গত কয়েকদিন থেকে শরীরটাও বেশ খারাপ যাচ্ছিলো ওর । যাবেই বা না কেন? এই মেয়ে  কারো কোন কথাই শোনে না। নিজের যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই চলে। ঘুম-খাওয়া কোন কিছুর ঠিক নেই, একশো বার বলে বলে মেডিসিন নেয়াতে হয়। কিছু বললে হেসে উড়িয়ে দেয়। এসব ভাবতে ভাবতে ফুপির চেম্বারে পৌছালো। জাওয়াদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন ফুপি। জাওয়াদ ঢুকে সালাম দিলে ফুপি জবাব দিয়ে হেসে বললেন, এতো দ্রুত চলে এলি কিভাবে? তোর না মিটিং আছে শুনলাম।   

মিটিং ক্যান্সেল করে দিয়েছি ফুপি। তুমি এতো জরুরী ভিত্তিতে আসতে বললে যে আমাকে? নূহার সবকিছু ঠিক আছে তো?

তোর জন্য একটা দুঃখের আর একটা সুখের খবর আছে। কোনটা আগে শুনবি বল?

কামঅন ফুপি। কেন শুধু শুধু টেনশন দিচ্ছো আমাকে। বলো না কি হয়েছে?

নাহ বিয়ের পর থেকে তুই কেমন যেন বোরিং হয়ে যাচ্ছিস। আগে এমন কিছু বললে কত দুষ্টুমি করতি মনেআছে?

জাওয়াদ হেসে বলল, আচ্ছা আগে তাহলে দুঃখের খবরটাই বলো শুনি।

দুঃখের খবর হচ্ছে নূহা তোর সাথে আমেরিকা যেতে পারবে না। আর সুখের খবর হচ্ছে আজ তোদের বাড়িতে পার্টি দিয়েছি আমি। রান্না সব তুই করবি। অনেকদিন তোর হাতের সুপার ডেলিসিয়াস রান্না খাওয়া হয়না। কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

তুমি এইকথা বলার জন্য আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছো?

না ঠিক তা না। কেন আজ পার্টি দিচ্ছি সেই কারণটা বলার জন্য ডেকেছি।

কেন দিচ্ছো?

আমাদের বাড়িতে নতুন অতিথির আগমন উপলক্ষে।

নতুন অতিথি? এমন কোন দিন কি আছে যেদিন আমাদের বাড়িতে অতিথি আগমন ঘটে না?

হাসতে হাসতে নাজমা খানম বললেন, ওরে গাধা এই অতিথি সেই অতিথি না। এই অতিথি হচ্ছে জান্নাতি অতিথি। কিন্তু তুই এটা একটা কাজ করলি? আমাদের নূহাই তো এখনো ছোট্ট একটা বাবু।

কিছুক্ষণ তো বিস্ময়ে কথাই বলতে পারেনি জাওয়াদ। তারপর তো আনন্দ ও খুশিতে ছোটখাটো একটা  চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল ফুপিকে।

জাওয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসতে হাসতে নাজমা খানম বললেন, রিপোর্ট পাবার সাথে সাথে তোকে ফোন করেছি আমি। বাড়িতে আর কাউকে বলা হয়নি।    

জাওয়াদ হেসে বলল, জাযাকিল্লাহ ফুপি। ইনশাআল্লাহ রাতে পরিবারের সবাইকে একসাথে জানাবো আমরা। আমি এখন আসি। শুধু নূহাকে আগেই জানাতে চাচ্ছি। ফুপির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নূহার কাছে যাবার জন্য ছুটেছিল জাওয়াদ ।   

ঐদিকে তখন লাগেজ গোছাতে গোছাতে ব্রেনকে সার্চ দিচ্ছিলো নূহা। কিন্তু দক্ষিণ সাগরে মেডিকেল ট্যুরে জাওয়াদের সাথে তার যাওয়া ক্যান্সেল করার কোন বুদ্ধিই বের করতে পারছিল না। বিয়ের পর ছেলেদের বুদ্ধি কমে যায় শুনেছিল কিন্তু এখন তো দেখছে মেয়েদের বুদ্ধিও কমে যায়।আচ্ছা সবারই কমে নাকি শুধু তার একার কমেছে? গবেষণা করে দেখতে হবে। জাওয়াদকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে সত্যিই বিয়ের পর ছেলেদের বুদ্ধি কমে যায় কিনা। তবে প্রশ্নটা করতে হবে যখন জাওয়াদ ভীষণ ব্যস্ত থাকে এমন কোন সময়ে। তাহলে দুষ্টুমি না করে সিরিয়াসলি জবাব দেবে। অবশ্য ধমক দেবার সম্ভাবনাও আছে। কিংবা হয়তো প্রচন্ড বিরক্ত কণ্ঠে বলবে, নূহা এটা কি কোন করার মতো প্রশ্ন? আশ্চর্য তোমার মাথায় এইসব উদ্ভট প্রশ্ন ঢোকায় কে? নাহ তার ব্রেন তো ঠিকই আছে। ওই তো জাহাজ ভর্তি করে বুদ্ধি আসছে জাওয়াদকে বিরক্ত করার নিত্যনতুন ফর্মূলা নিয়ে। আচ্ছা সব মেয়েদেরই কি তার মতো স্বামীকে বিরক্ত করতে এতো মজা লাগে? হুমম...এটাও গবেষণা করে দেখতে হবে।তবে আপাতত চিন্তা-গবেষণা দুটাই বন্ধ থাক। বাবাকে চা দেবার সময় হয়েছে তাই কিচেনে রওনা করলো সে। ছোট ননদ আসমারাকে কিচেনে দেখে  হেসে বলল, আমি কি আসতে দেরী করে ফেললাম?

ইটস ওকে ভাবী। প্রতিদিন তো তুমিই সবকিছু করো আজ নাহয় আমি করলাম। তুমি শুধু বাবা আর ভাইয়াদের জন্য চা বানাও। শুনলাম তোমরা নাকি ঘুরতে যাচ্ছো?

তোমার ভাইয়ার কাছে আমিও এমন কিছুই শুনেছি। একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না আমার কিন্তু তোমার ভাইয়াকে বলার সাহস পাচ্ছি না।

আসমারা হেসে বলল, ঘুরে এসো ভাবী। তাছাড়া তোমাদের একটু একা একা সময় কাটানো উচিত।

এই কথা বলছো কেন?

এই যে সারাদিন ভাইয়া বাইরে বাইরে থাকে আর সারারাত তোমরা দুজন ছাদে বসে ঘুটুর ঘুটুর করো। আচ্ছা তোমরা ঘুমাও কখন?

সে চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। নাস্তা বানান মনোযোগ দিয়ে।

হাসতে হাসতে আসমারা বলল, তোমরা দুইজন এত অদ্ভুত কেন বলো তো? তোমাদের দেখাদেখি আমি আর নাহিয়ানও সারারাত গল্প করার প্ল্যান নিয়ে ছাদে গিয়েছি। কিন্তু ঘণ্টা খানেক পর আর কথাই খুঁজে পাইনা বলার মতো। বলো না কি এমন কথা বলো তোমরা দুজন যে কথার স্টকই মোটে শেষ হয়না।   

নূহা হেসে বলল, তোমার ভাইয়ার সাথে না তোমার মহা ভাব। তাকে গিয়েই জিজ্ঞেস করো কি এতো বলে। কারণ কথা তো সব উনি বলেন।

অবশ্যই জিজ্ঞেস করবো। এখনি যাচ্ছি আমি ভাইয়ার কাছে। পছন্দ করে তাই ভাইয়ার জন্য ডেউয়া নিয়ে এসেছি আমি। কেটে দেবো এখন?

হুম দাও।

তোমার জন্য কাটবো?

উহু, দেখতেই বমি পাচ্ছে আমার।

আশ্চর্য টক-ঝাল-মিষ্টি কিছুই খাও না তুমি। তোমার হবার কথা ছিল মহা পানসা একটা মেয়ে। কিন্তু তুমি এতো সুইট হলে কিভাবে বলো তো?

আলহামদুলিল্লাহ! এটা সত্যিই আল্লাহর বিশেষ একটা রহমত বলতে হবে। কথাটা শুনে তো নূহা আর আসামারা দুজনই কিচেনের দরজার দিকে ঘুরে তাকালো। জাওয়াদকে দাঁড়ানো দেখে আসমারা হেসে  ফেললো। তারপর ভাইয়া ভাবীকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। নূহা বলল, এখানে কি চাই?

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই বাড়ির কিচেন বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেবো।

সেকি কেন?

তারপর উড়াবো লাইব্রেরী। যখনই বাসায় আসি হয় তুমি কিচেনে থাকো নয়তো লাইব্রেরীতে। তোমার সাথে সময় কাটাবো বলে মিটিং ক্যান্সেল করে তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে এলাম। আর তুমি কিনা সারাদিন গায়েব। সমস্যা কি তোমার?

তুমি যে আগেই চলে আসবে সেটা আমাকে তো সকালে বলোনি। আসলে আগামী কাল টিউটোরিয়াল আছে তো তাই ক্লাসের পরে বন্ধুরা মিলে গ্রুপ ওয়ার্ক করেছি।

শোন মেয়ে স্ত্রীদের ক্লাস হচ্ছে সংসার আর টিউটোরিয়াল হচ্ছে স্বামীকে খুশি রাখা। তোমার লেখাপড়া বন্ধ। তুমি এখন থেকে আমার সাথে থাকবে সবসময়। ক্যাঙ্গারুর মত একটা থলি বানাবো, যেখানে যাবো সেই থলিতে ভরে তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো। বেশি বেশি জ্ঞানী হয়ে যাচ্ছ তুমি। জ্ঞানের মেগাশীপের দরকার নাই আমার। আমার তোমাকে দরকার।

আমি তো তোমারই।

আচ্ছা তাই নাকি? আপনার কর্মকান্ড তো তা বলে না। শোন তোমার সাথে আমার বোঝাপড়া করতে হবে। আমি রুমে যাচ্ছি তুমি এসো। সময় পাঁচমিনিট মনে থাকে যেন।

ইশশ...পাঁচমিনিট বললেই হবে নাকি! আমি চা বানিয়ে সবাইকে দেবো তারপর আসবো। যতই টাফ লুক দেন না কেন আমি আমার কাজ শেষ না করে যাচ্ছি না।

দিন দিন যে তোমার অবাধ্যতার মাত্রা বাড়ছে তা কি বুঝতে পারছো?

অবশ্যই বুঝতে পারছি। আমি না বুঝে শুনে কোন কাজ করি না। আলহামদুলিল্লাহ্‌।

জাওয়াদ হেসে বলল, কাজ শেষ করে রুমে এসো দুষ্টু মেয়ে। তোমাকে আজ আমি বোঝাবো অবাধ্য হবার মজা। কতক্ষণ লাগবে আসতে?

আধঘণ্টা লাগবে।

ঠিক আধঘণ্টা মনে থাকবে তো?

তুমি মনেহয় আমার ঐ কবিতাটি ভুলে গিয়েছো।

কোনটা?

সুর্যের লাল আভায় পানি করে চিকচিক, রেলগাড়ি চললে যেমন শব্দ হয় ঝিকঝিক। ফোকলা দাঁতে খোকা হাসে ফিকফিক, সময় যে যাচ্ছে বয়ে জানান দিচ্ছে ঘড়ি টিকটিক। রাতের আকাশে তারারা জ্বলে চিকমিক, কথা দিলে কথাটি আমি রাখি ঠিকঠিক।

হেসে ফেলেছিল জাওয়াদ তখন। রুমে যাবার পর নূহাকে জানিয়েছিল তাদের জীবনের মিরাকলদের আগমনী বার্তা। ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে খুব পছন্দের খেলনা পেলে যেমন আনন্দে চিৎকার করা বাড়ি মাথায় তোলে। নূহাও ঠিক তাই করেছিল। নূহার চিৎকার শুনে মূহুর্তে পুরো বাড়ি হাজির হয়ে গিয়েছিল তাদের রুমে। রাতে সবাইকে একসাথে সারপ্রাইজ দেবার প্ল্যান বিসর্জন দিয়ে তখনই সবাইকে জানাতে বাধ্য হয়েছিল জাওয়াদ। মূহুর্তেই আনন্দবাড়ির আধ পাগল সদস্যরা আনন্দের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল পুরো বাড়ি জুড়ে। সবার আনন্দ দেখে তখন নাক টেনে টেনে কান্না করতে বসেছিল নূহা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের বাকি সদস্যরাও যে যেখানে ছিল সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে বাড়িতে ছুটে এসেছিল। জাওয়াদ আর নূহার জীবনের আরেকটি অনন্য, অসাধারণ দিন ছিল সেটি।  

সেদিন রাতের বেলা ছাদে দাঁড়িয়ে নীচে বাগানে বসে গল্প করতে থাকাপরিবারের সবার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল নূহা। জাওয়াদ পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি এখানে চলে এলে যে? নূহা হেসে জবাব দিয়েছিল, আমের মধ্যে থাকার কারণে নাকি পোকা আমের সুঘ্রাণ ও মিষ্টতাকে ঠিকমতো অনুভব করতে পারেনা। আমি তাই কিছুক্ষণের জন্য বাইরে বেড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছি আমি কতো ভাগ্যবতী একটি মেয়ে। তোমার মনেআছে জাওয়াদ দুই বছর আগে ঠিক এই খানে দাঁড়িয়েই আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমার ভীষণ মন খারাপ হয় ভাবলে যে আমি কেন এই বাড়ির মেয়ে হয়ে জন্মেছি। কতই না ভালো হতো যদি মেয়ে না হয়ে আমি এই বাড়ির বৌ হতাম। তাহলে কখনো আমাকে এই বাড়ি ছেড়ে দূরে যেতে হতো না। তুমি তখন কি বলেছিলে মনেআছে?   

নূহা তোমার কষ্ট দেখে আমার খুবই মায়া লাগছে। আচ্ছা বলো তো পাত্র হিসেবে আমাকে তোমার কেমন লাগে?

নূহা হাসতে হাসতে বলল, এমন একটা কথা তুমি কি করে বলেছিলে? আমি তো পুরো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি এখনো তোমার শুকরিয়া আদায় করিনি তাই না?

শুকরিয়া আদায় কেন?

আমাকে এত বেশি ভালোবাসার জন্য। আমাদের বিয়ে না হলে তো আমাকে পরিবার থেকে দূরে চলে যেতে হতো একদিন। তুমি জানো জীবনে যখন প্রিয় মানুষদের ছড়াছড়ি থাকে তখনই জীবন প্রকৃত অর্থে জীবন্ত হয়ে ওঠে। অদ্ভুত সুখ সৃষ্টি হয় মনের ভেতর। আমি আমার প্রিয়জনদের মাঝে এবং প্রিয়জনদের জন্যই বেঁচে থাকতে চাই। কেন জানো?

জানি কারণ আমার চাওয়াটাও তোমারই মতো। এলোমেলো, অগোছালো, হেয়ালি, খেয়ালি, জোকার, বাস্তবধর্মী, কল্পনাপ্রবণ সবকিছু মিলিয়ে হযবরল একগুচ্ছ মানুষ নিয়ে আমাদের পরিবার। আমাদের আনন্দবাড়ি। যার প্রতিটা সম্পর্কের মধ্যে আছে ব্যাখ্যাতীত সৌন্দর্য। যেখানে অবাস্তব এক কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে অনেককিছু করা যায় মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে। জীবন এই বাড়িতে ভীষণ রহস্যময়। তাই জীবনের সৌন্দর্যও এখানে বর্ণনাতীত। চলো নীচে যাই সবার সাথে আমাদের আনন্দকে উপভোগ করি।

তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার আছে।

কি উপহার?

জাওয়াদে হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে নীচে রওনা করলো নূহা। ভেতরে কি লেখা আছে জানার জন্য কাগজটা খুলে চোখের সামনে ধরলো জাওয়াদ।

আমিও ভিজেছি জোছনার শিশিরে

তোমারই সাথে প্রিয় একান্ত নিবিড়ে

আমিও গড়েছি ভুবন দিয়ে ভালোবাসা

সাথে রবে তুমি সাথী এই মোর আশা

অচেনা জগত থেকে ছোট্ট এক ফেরেশতারে

আমাদের ভালোবাসা এনেছে ধরণী তরে

আলোর মশাল হাতে ছুটবে এই ফেরেশতা

দেখিয়ে যাবে ফুল বিছানো সত্যের রাস্তা

দেখেছি নির্ঘুম চোখে জোছনার আলো

তোমার অগনিত শব্দমালা সাথী হয়ে ছিলো

বন্ধু হয়ে সাথে চলো তুমি নিরবধি

পরকালের সেই অনন্ত জীবন অবধি……….

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন