রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি... শেষ পর্ব





চোখ খুলে ফুলের তোড়া হাতে নূহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেলেন আজাদ সাহেব। প্রশ্ন জাগলো, সত্যিই কি হাসি মুখে নূহাকে তাকিয়ে আছে তার দিকে নাকি স্বপ্ন দেখছেন? না নড়েই চোখ চারপাশে ঘুরিয়ে এনে আবারো তাকালেন। নাহ ঐ তো এখনো নূহা সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তারমানে তিনি মোটেই স্বপ্ন দেখছেন না। কিন্তু নূহা এত ছোট হয়ে গেলো কিভাবে?

নানাভাই কি হয়েছে তোমার? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে?

নাবিহার কথাগুলো কানে যেতেই হেসে ফেললেন আজাদ সাহেব। এতক্ষণে তার ভুল ভাঙলো। ঘুমের ঘোরে নাবিহাকে নূহা ভেবে ভুল করেছেন।

আশ্চর্য এখন আবার হাসছো কেন? নানাভাই তোমার কি হয়েছে? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? পাপাকে ডাকবো? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো নাবিহা।

হাসতে হাসতে শোয়া থেকে উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলেন আজাদ সাহেব। হাত নেড়ে নাবিহাকে কাছে ডাকলেন।

নানাভাইয়ের কর্মকান্ড মোটেই স্বাভাবিক লাগছিল না নাবিহার কাছে। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি  নানাভাই জানে আছে। এক সপ্তাহ আগে কমা থেকে উঠলেও এতদিন হসপিটালেই ছিলেন। গতকাল বিকেলে এক রকম জোর করেই বাড়িতে চলে এসেছেন নানাভাই। কিন্তু অনেক বেশি সাবধানে থাকতে হবে সেকথা বার বার করে বলে দিয়েছেন ডক্টর আংকেলরা। ছুটে গিয়ে পাপাকে খবর দিবে কিনা ভাবছিল। নানাভাই হাত বাড়িয়ে ডাকলে কাছে গিয়ে বসলো নাবিহা।

নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে আজাদ সাহেব হেসে বললেন, চেহারা দেখে তো মনেহচ্ছে ঘাবড়ে গিয়েছো। টেনশনের কিছু নেই নানুমণি। আমি ঠিক আছি। আসলে কি হয়েছো জানো? চোখ খুলে হঠাৎ তোমাকে দেখে ভেবেছিলাম তোমার মা বুঝি দাঁড়িয়ে আছে। পর মূহুর্তেই আবার চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম তোমার মা এত ছোট হয়ে গেলো কিভাবে।

নানাভাইর কথা শুনে দুশ্চিন্তা উবে গেলো নাবিহার। হেসে ফেললো খিলখিল করে। হাসতে হাসতে বলল, আমি যে ড্রেসটা পড়েছি এটা মামণির ছোটবেলার ড্রেস। নানুমণির সিন্দুকে তোলা ছিল। আমি গতরাতে দেখে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছি। আর মামণি এমন করে চুল দুই বেণী করে সামনে ঝুলিয়ে দিতো ছোটবেলার ভিডিওতে দেখেছিলাম। তাই আমিও আজ এভাবে চুল বেঁধেছি। সেজন্যই মনেহয় তোমার ভুল হয়েছে নানাভাই। একটু আগে যখন পাপার কাছে গিয়েছিলাম পাপাও বলেছিল, আজ আমার সল্টি বেবীটাকে তো দেখি একদম তার মামণির মতো দেখাচ্ছে।

নাবিহার মাথার, চেহারায় হাত বুলিয়ে একটা হাত তুলে নিয়ে আদর দিয়ে আজাদ সাহেব বললেন, আলহামদুলিল্লাহ সত্যিই আজ তোমাকে একদম আমার মায়ের মতো লাগছে।  

নাবিহা হেসে বলল, শুধু তোমার না আমারো মামণি। নানাভাই এই নাও তোমার জন্য আমি নিজ হাতে ঘাসফুল আর পাতাবাহার দিয়ে তোড়া বানিয়ে এনেছি। কেমন হয়েছে?

ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে আজাদ সাহেব বলল, মাশাআল্লাহ ভীষণ সুন্দর হয়েছে। জাযাকিল্লাহ। কিন্তু এত ধরনের ঘাসফুল কোথায় পেলে?

নাবিহা হেসে বলল, গতকাল পাপা আর আদীব্বার সাথে আমরা এখান থেকে চারশো কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ঘাসফুল গুলো ওখান থেকে নিয়ে এসেছি। তবে পাতাবাহার আমাদের বাগানের।

তোমাদের মা গিয়েছিল সাথে?

চেহারা আঁধার করে নাবিহা বলল, কত করে বলেছিলাম কিন্তু মামণি যেতে রাজীই হলো না। তবে জারিফ আর বাবা গিয়েছিল আমাদের সাথে।

একটু ক্ষণ চুপ থেকে মুখে হাসি ফুটিয়ে আজাদ সাহেব বললেন, আজ তো তোমাদের মামণির আসার কথা ছিল। এসেছে?

নাবিহা হেসে বলল, সেটাই তো বলতে এসেছি। তুমি তো এখনো জানোই না নানাভাই আমাদের আনন্দবাড়িতে আজ পৃথিবীর হাফ সেঞ্চুরিতম আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে। আর তুমি কিনা ঘুমিয়ে আছো।

আজাদ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, পৃথিবীর হাফ সেঞ্চুরিতম আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে? কি সেই ঘটনা?

ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো আমি পাপা, আদীব্বা, মামা, চাচ্চুদের জন্য গ্রীণ টি আনতে গেলাম। যেয়ে কি দেখি জানো? নানুমণি, দাদী আর চাদী মণি এক পাশে বসে গল্প করছে। সকালের নাস্তার আয়োজন কে করছিল জানো?

আজাদ সাহেব চোখ বড় বড় করে বললেন, নূহা?

হ্যা। চিন্তা করে দেখো নানাভাই কতটা অবাক হয়েছিলাম আমি এই দৃশ্য দেখে?

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, এটা তো পৃথিবীর হাফ না ফুল সেঞ্চুরিতম আশ্চর্যজনক ঘটনা। কিন্তু এত ভোরে নূহা এলো কিভাবে?

ফজরের নামাজ আদায় করেই জারিফকে নিয়ে বাবা আর মামণি চলে এসেছিল। সারপ্রাইজ দেবার জন্য আমাদেরকে ডাকেনি। কিন্তু তুমি এখনো শুয়ে আছো কেন নানাভাই? আজ সব নাস্তা মামণি বানিয়েছে। তাড়াতাড়ি ওঠো সবাই একসাথে নাস্তা করবো আমরা।

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, ঠিকআছে তুমি যাও আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।

উঠে দরজার কাছে গিয়েও আবার ফিরে এসে নাবিহা বলল, আমাদের প্ল্যানের কথা তোমার মনেআছে তো নানাভাই?

আমার মনে আছে নানুমণি। ইনশাআল্লাহ আজ থেকেই আমাদের প্ল্যান কার্যকর শুরু হবে।

আনন্দ আর খুশি ঝিকমিক করে উঠলো নাবিহার চেহারায়। নক্ষত্রের মতোই আনন্দে ঝিলমিল করতে করতে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

ধীরে ধীরে উঠে বসলেন আজাদ সাহেব। গত দু’দিন আগে জিহাদ, জিশান আর নাবিহা হসপিটালে গিয়েছিল দেখা করার জন্য। ছোট ছোট তিনটি বাচ্চার মুখে সেদিন এমন কিছু কথা শুনেছিলেন। যা তার চিন্তার জগতকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল ভীষণ ভাবে। মনের ঝিমিয়ে পড়া উৎসাহ, উদ্যম হঠাৎ করেই যেন আবার মমতা মাখা নিড়ানি, শীতল পানি আর মিষ্টি রোদের স্পর্শে চনমনে হয়ে উঠেছিল। নাবিহা প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা নানাভাই পাপা-মামণিদের যে মেঝমামা ছিলেন। উনি কি উদ্দেশ্যে পাপাকে আড়াই বছর বন্দী করে রেখেছিলেন? উনার উদ্দেশ্যে তো আনন্দবাড়ি থেকে আনন্দকে বিতাড়িত করাই ছিল। তাই না? আনন্দবাড়ির সদস্যদের ভালোবাসাময় সম্পর্কগুলো এলোমেলো করে দেয়া। সহজ ও সুন্দর বন্ধনগুলোর মধ্যে জটিলতা তৈরি করে দেয়া। সারাক্ষণ হাসি-আনন্দে মেতে থাকা মানুষগুলোকে বিষাদে ডুবিয়ে দেয়া। তাই না?

আজাদ সাহেব বলেছিলেন, হ্যা এসবই আশফাকের মূল উদ্দেশ্যে ছিল। পরিবারের ভীতটাকে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিল। সুন্দর সম্পর্কগুলো এলোমেলো করে দিতে চেয়েছিল।

জিহাদ বলেছিল, আমাদের বর্তমান আনন্দবাড়ির দিকে তাকালে তোমার কি মনেহয় নানাভাই? উনার অসৎ উদ্দেশ্যে কি সফল হয়েছিল নাকি বিফল হয়েছিল?

প্রশ্নটা শুনে থমকে গিয়েছিলেন আজাদ সাহেব। এক মূহুর্তেই ভাবনারা পাড়ি জমিয়েছিল এগারো বছর আগেও সেই দিনটিতে যেদিন জাওয়াদ আবারো ফিরে এসেছিল তাদের জীবনে। জন্মের পর থেকে নূহার হাসি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে আনন্দবাড়ির প্রতিটি কোণায়। কিন্তু সেদিন নূহার আর্তচিৎকারের হাহাকারে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল আনন্দবাড়ি এবং বাড়ির প্রতিটি সদস্যের অন্তঃরাত্মা পর্যন্ত। একজন পিতা হিসেবে জীবনে আর কোনদিন এমন ভয়ঙ্কর অসহায়ত্বের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়নি আজাদ সাহেবকে। হতবিহবল হয়ে গিয়েছিল একদম। ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে ছিলেন নূহা, জাওয়াদ আর রাহাতের দিকে। কি করা উচিত, কি বলা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ছোট থেকে ছোট সিদ্ধান্তও যেখানে পরিবারের সবাই মিলে একসাথে আলোচনা, পর্যালোচনার মাধ্যমে নিতেন। যে পরিবারের কোন সদস্য কখনোই অন্য কোন সদস্যের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিতো না, যে যাই বলতো আগে মনযোগ দিয়ে শুনতো এরপর নিজের মত প্রকাশ করতো। কিন্তু তখনো সজাগ ও সচেতন থাকতো কখনোই যাতে একে অন্যেকে আঘাত বা কষ্ট দিয়ে না ফেলে নিজের মত প্রকাশ করতে গিয়ে। কিন্তু সেদিন এক মূহুর্তের মধ্যেই সবকিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল। কেউ কারো কথা মেনে নিতে পারছিল না। ভালোবাসার সুতোয় গাঁথা সম্পর্কের মোতি গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। আর আজাদ সাহেব চোখের সামনে তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন আনন্দবাড়িকে ভাগ ভাগ হয়ে যেতে দেখেও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। জাওয়াদ যখন তিন সন্তানদের দাবী নিয়ে নূহার সামনে দাঁড়িয়েছিল প্রচন্ড ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও জাওয়াদকে বলতে পারেননি, নিয়তি যে চরম পরিহাস করেছে আমার মেয়েটার সাথে, তারউপর আবার সন্তানদের বিচ্ছেদের অসহনীয় যাতনা চাপিয়ে দিয়ো না ওর উপর। নূহা যখন রাহাতের হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলো তখনো বাঁধা দিয়ে বলতে পারেননি, মারে তুই তো এই বাড়ির আত্না। তুই চলে যে নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে আমাদের আনন্দবাড়ি।  

বেদনাক্ত অতীতের স্মরণে নোনা পানি ছলকে ছলকে বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছিল আজাদ সাহেবের চোখ দিয়ে। পরম আদরের সাথে নানাভাইয়ের চোখ মুছিয়ে দিয়ে জিশান বলেছিল, কান্না করো না নানাভাই। তুমিই না আমাদেরকে বলেছিলে, মানুষের যখন করার কিছুই থাকে না তখন কান্না করতে বসে। কিন্তু আমাদের তো অনেক কিছু করার আছে ইনশাআল্লাহ। এবং আলহামদুলিল্লাহ আমরা সেই অনেককিছু করার জন্য প্রস্তুতও নানাভাই।

জিহাদ হাসি মুখে বলেছিল, নানাভাই তুমিই তো আমাদেরকে আনন্দবাড়ি গড়ে তোলার গল্প বলার সময় বলেছিলে পাপা, আদীব্বা, বড়মামা, রিসাব চাচ্চু, ছোট চাচ্চু যখন মাত্র বারো বছর বয়স ছিল তখন থেকে আনন্দবাড়ি গড়ার কাজে তোমার সাথে অংশগ্রহণ করেছিল। আমাদের তিনজনের তো প্রায় চৌদ্দ বছর হয়ে গিয়েছে। এবার তাই আমরা অংশগ্রহণ করতে চাই তোমার সাথে। ছড়িয়ে পড়া মোতিদের একসাথ করে আবারো আমরা ভালোবাসায় সুতোয় সবাইকে গাঁথবো ইনশাআল্লাহ। আমরা আবারো আগের সেই স্বপ্নের আনন্দবাড়ি গড়ে তুলবো। আবারো আনন্দবাড়ির আকাশে জ্বলজ্বল করবে দুষ্টু মিষ্টি নক্ষত্ররা। পূর্ণিমার চাঁদের বুক থেকে ঝরবে স্বপ্নের শিশির। সারাক্ষণ বাড়ি জুড়ে খুনসুটি উড়ে বেড়াবে বাঁধনহারা। যেখানে ঝগড়াও হবে ছন্দে ছন্দে নয়তো শিক্ষণীয় গল্পে গল্পে।

নাবিহা হেসে বলল, আমাদের বাড়ির দেয়ালে ছোট্ট কোন দাগ দেখলেও দাদাভাই অস্থির হয়ে যান। সাথে সাথে রঙের কৌটা আর ব্রাশ নিয়ে সেই জায়গাটা ঠিক করে তারপর ঠান্ডা হোন। দাদী অনেক বিরক্ত হয় রোজ রোজ দাদাভাইকে এসব কান্ড করতে দেখে। দাদাভাই তখন হাসেন আর বলেন, ছোট্ট একটা আঁচড় থেকেই বাড়ির চুন-সুড়কি ঝরতে শুরু করে। এরপর একসময় শ্যাওলা বাসা বাঁধে, ধীরে ধীরে ফাটল ধরে। বুড়ো শরীরে ফাটল সারানোর ক্ষমতা নেই বলেই, আঁচড় পড়ার সাথে সাথেই সেটাকে ঠিক করে ফেলি। চোখের সামনে আঁচড় দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারি না। নানাভাই অনেক হয়েছে চুপচাপ নীরবে সবকিছু মেনে নেয়া। আমরা আর চুপ করে বসে থাকবো না। এটা ঠিক এগারো বছর আগে আমাদের আনন্দবাড়ির সম্পর্কের বন্ধনে যে আঁচড় লেগেছিল, চুন-সুড়কি ঝরিয়ে শ্যাওলায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে এতদিনে। বিভিন্ন জায়গায় হয়তো বড় বড় ফাটলও তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের গায়ে তো এখন অনেক শক্তি আলহামদুলিল্লাহ। সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমরা সবকিছু আবার আগের মতো করে তুলতে পারবো ইনশাআল্লাহ। আমরা আবারো নতুন করে আনন্দবাড়ি গড়ে তুলতে চাই। বলো নানাভাই তুমি থাকবে তো আমাদের সাথে?

অপলক তিন নাতি-নাতনির দিকে তাকিয়ে ছিলেন আজাদ সাহেব। মনেই হচ্ছিলো না তার সামনে ছোট ছোট তিনটি শিশু বসে আছে। পুরোনোকে নতুন করে গড়ার যে আত্নপ্রত্যয় ওদের চোখে ঝিলিক তুলে যাচ্ছিলো। আজাদ সাহেবের মনে প্রতিফলিত হয়ে এক ঝাটকায় জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তাকে। দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিয়েছিল নাতি-নাতনিদেরকে। হাসতে হাসতে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমরা এমন বড়দের মতো কথা বলতে, চিন্তা করতে কবে শিখে ফেললে? নাবিহা জেসে জবাব দিয়েছিল, বাড়ির বড়রা যখন ছোট আর অবুঝদের মতো আচরণ করা শুরু করে। তখন ভারসাম্য রক্ষার্থে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ছোটদেরকে সমঝদার বানিয়ে দেন। আরেক রাউন্ড হাসির ঝড় উঠেছিল তখন। এরপর চারজন মিলে সংঘবদ্ধ হয়ে হাতে তুলে নিয়েছিল মিশন “আনন্দবাড়ি রিটার্নস”।

শরীর ও মন দুটাই ভীষণ সতেজ ও ঝরঝরে মনে হচ্ছিলো আজাদ সাহেবের। মনের আশাহত অবস্থাটা অনেকটা ধূসর গোধূলি বেলার মতো। সাঁঝের বেলায় নিভু নিভু সূর্যের প্রদ্বীপ চারিদিকে অন্ধকারচ্ছন্ন করে দেয়। সূর্যকে যেমন চারিদিকে আলোর ঝর্ণাধারা ছড়িয়ে দেবার জন্য  প্রতিটি দিনের সমাপ্তিতে একেবারে ডুবে যেতে হয়। মনের আশাহয় অবস্থাটাকেও ফুঁ দিয়ে একবারে নিভিয়ে দেয়া উচিত । যাতে পূর্ণ আলো নিয়ে আশা জাগানিয়া রূপে আবারো হাজির হতে পারে। গত এগারোটা বছর আশাহতের মতোই কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। কয়েকদিন আগে নূহার কথাগুলো সম্পূর্ণ রূপে নিরাশায় ডুবিয়ে দিয়েছিল তাকে। আর নাতি-নাতনীরা তার সেই নিরাশায় আঁধারে জ্বালিয়ে দিয়েছে ছোট্ট একটি আশার প্রদ্বীপ। যার আলোতে আজাদ সাহেব আবারো প্রশান্তিকর নব প্রারম্ভের স্বপ্ন দেখতে সাজাতে পারছেন। এটা ঠিক জীবনে কখনো কখনো মানুষের দ্বারা ভুল হয়ে যায়। কিন্তু যখন সেই ভুলের উপলব্ধি হয় তখন উচিত থমকে দাঁড়ানো এবং চিন্তা করে দেখা যে, এরফলে জীবন কি পেল আর কি হারালো। হারটাকে ভুলের প্রায়শ্চিত মনে করে, পাওয়াটাকে সাথে নিয়ে যারা সামনে এগিয়ে যেতে পারে। তারাই কেবল জীবনের স্বাভাবিকত্বকে আবারো ফিরিয়ে আনতে পারে। এগারোটা বছর নীরব দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় জীবনের ভুলের ভান্ডারকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন তাই আর সময় নেই চুপ করে বসে থাকার। এখন টুপ করে লাফিয়ে নেমে পড়তে হবে ভুলের সেই ভান্ডারের মাঝে। তারপর খুঁজে নিতে হবে ভুলের মাঝে লুকায়িত শিক্ষাগুলোকে। ভুলগুলোকে ফুল করে তোলার চিন্তাটা মনের জোড় আরো অনেকখানি বাড়িয়ে দিলো আজাদ সাহেবের। আনন্দিত মনে পরিবারের সবার সাথে বসে নাস্তা করার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হলেন। বারান্দায় পাতাবাহারের টবের পাশে নূহাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত রাখলেন।  

আজাদ সাহেবের দিকে না তাকিয়েই নূহা বলল, দেখেছো বাবা পাতাগুলো কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির কেউ মনেহয় যত্ন করে না ওদের।

আজাদ সাহেব মৃদু কণ্ঠে বললেন, যারা যত্নের অভাবে নিজেদের সম্পর্কগুলোকেই প্রতিনিয়ত একটু করে শুকিয়ে যাবার সুযোগ করে দিচ্ছে। তাদের কি আর গাছগাছালির যত্ন করবার কথা মনে থাকবে বল?

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো নূহা। ইচ্ছে করছিল বাবার দু’হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলতে, আই এম সরি বাবা। আমাকে ক্ষমা করে দাও সেই প্রতিটা কথা, কাজ ও আচরণের জন্য যা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। আসলে কি জানো বাবা? সবকিছু মেনে নেবার পরও মনের এক কোনে তোমাদের প্রতি অভিমান চুপটি করে বসে ছিল। সেজন্যই হয়তো এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরও আমি কখনোই তোমাদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারিনি। কিন্তু গত কয়েকদিন আগে যখন আদী ভাইয়া জিহাদ, জিশান, নাবিহা আর জারিফকে আমাদের জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা-দুর্ঘটনা, আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির গল্প শোনাচ্ছিল, তখন অনেক সাহস করে আমিও সেই গল্পের সাথী হয়েছিলাম। পেছনে তাকাতে প্রচন্ড ভয় হতো আমার। দুর্বল হয়ে যাবার ভয়, নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে যাবার ভয়, রাহাতের প্রতি কোন অন্যায় করে ফেলার ভয়ে এতগুলো বছর শুধু সামনের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। সাহস করে যখন আবারো পেছনে তাকিয়েছিলাম আমার জীবনের প্রাপ্তির সম্ভার দেখে রবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় অন্তর সিক্ত হয়ে উঠেছিল। সাথে সাথে অনুধাবন করতে পেরেছিলাম আমার নিজের মাঝে গড়ে ওঠা ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে। আমার ছোট ছোট বাচ্চাগুলো কত সুন্দর ভাবে সবকিছু মেনে নিয়েছে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম বাবা নাবিহাকে যখন বলতে শুনেছিলাম, যদি পাপার ঐ এক্সিডেন্টটা না হতো তাহলে আমরা আমাদের বাবাকে কোথায় পেতাম? আদীব্বাকেও তো এভাবে পেতাম না আমাদের জীবনে। হ্যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে কিছুদিনের জন্য পাপার কাছ থেকে আমাদেরকে দূরে রেখেছিলেন। কিন্তু যাতে আমরা পাপাকে একটুও মিস না করতে পারি সেজন্য আদীব্বা আর বাবাকেও তো পাঠিয়েছিলেন আমাদের কাছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সত্যিই অনেক মহান। কিন্তু আমরা মানুষেরা এত বেশি ক্ষুদ্র চিন্তার যে, আল্লাহর মহত্ত্বকে বেশির ভাগ সময়ই বুঝে নিতে পারি না। নাবিহার মুখে এই কথাটি শুনে ঝরঝর কেঁদে ফেলেছিল রাহাত। আদী ভাইয়া অশ্রু দেখাতে চায়নি তাই ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ঐ মূহুর্তে তীব্র একটা অপরাধ বোধ চেপে বসেছিল মনের মাঝে। আমি কেন পারিনি বাবা আমার জীবনকে ঘিরে আবর্তিত ভালোবাসাময় মানুষগুলোর অকৃত্রিম ভালোবাসাকে নাবিহার মতো করে মূল্যায়ন করতে। আমার বাচ্চারা শুধু আমার ভুল ভাঙ্গায়নি। ওরা আমার করণীয়ও আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। বাবা তাদের চেয়ে দূর্ভাগ্যবান মনেহয় কেউ নেই যারা অতীতের মোহে বর্তমানে সুন্দর সময়গুলোকে মূল্যায়ন করে না। আমি আমার নিয়তিতে মেনে নিয়েছিলাম বাবা। কিন্তু আমার মন জমে শক্ত হয়ে রয়ে গিয়েছিল অতীত স্মৃতির হিমাগারে। তাই জীবনের স্বাভাবিকত্ব ও অস্বাভাবিকত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজার রেখে চলতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। শুধুমাত্র একজন মানুষের দূরে চলে যাবার কারণে, আমি আমার চারপাশের সবাইকে দুহাতে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। এমন অসংখ্য ভুলের উপলব্ধির উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। বুঝতে পারছিলাম না কোথা থেকে শুরু করবো ভুলের প্রায়শ্চিত্র। আল্লাহ আমার প্রতি এত বেশি মেহেরবান যে সেই পথও দেখিয়ে দিয়েছিলেন। গত কয়েকদিন আগে হসপিটালে জিশান, জিহাদ, নাবিহা আর তোমার কথা শুনে আমি নতুন শুরুর দিশা খুঁজে পেয়েছিলাম। আনন্দবাড়িকে এলোমেলো করে দেবার ব্যাপারে মেঝমামা ইচ্ছে কখনোই সফল হতো না যদি আমি স্বাভাবিক থাকতে পারতাম। যদি আমি বাড়ি ছেড়ে চলে না যেতাম। তাই তোমাদের মিশন ‘আনন্দবাড়ি রিটার্নস’ যাতে সফল হতে পারে সেজন্য আড়ালে থেকে নিশ্চুপে কাজ করে যাবো আমি তোমাদের সাথে। প্রচন্ড ইচ্ছে করছিল কিন্তু পর্দার আড়ালে থেকেই নিজের করণীয় করতে চায় তাই বাবাকে এসব কথা বললো না। উল্টো মুখ আঁধার করে বলল, বিরাট বড় একটা ভুল হয়ে গেলো যে?

কি হয়েছে? চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন আজাদ সাহেব।

এই যে সালাম না দিয়েই গল্প জুড়ে দিয়েছি আমরা। এটা কি ঠিক হলো?

আজাদ সাহেব হেসে ফেলে বললেন, আমার মা বুঝি আজ খুব ফানের মুডে আছে?

হুম, তা কিছুটা আছি। আচ্ছা আগে তোমাকে সালাম দিয়ে নেই। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বাবা।

আজাদ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। চল সবজি বাগানে যাই। আমি তোর জন্য কয়েক রকমের শাকের বীজ বুনেছিলাম। সেগুলোর কি অবস্থা হয়েছে এতদিনে দেখে আসি।

ঐদিকে ভাইয়ারা সবাই বসে কথা বলছেন। নাস্তার পরে যেয়ে দেখবো ইনশাআল্লাহ। আগে বলো উঠে আসাতে তোমার শরীর খারাপ লাগছে নাতো?

আলহামদুলিল্লাহ শরীর যতটুকুন খারাপ ছিল তোকে দেখার পর সমস্ত অসুস্থতা দূর হয়ে গিয়েছে। কত বছর পরে তোর এমন প্রস্ফুটিত পুষ্পিত হাসি মাখা চেহারাটা দেখার সৌভাগ্য হলো বলতো?

নূহা হেসে বলল, তা তো জানি না। তবে এখন থেকে এই সৌভাগ্য অটুট থাকবে ইনশাআল্লাহ। এখন কথা বন্ধ। চলো নাস্তা করতে যাবে। আজ আমি সব তোমার আর আমার পছন্দের নাস্তা বানিয়েছি। বাড়ির বাকি সবাই বিদ্রোহ করবে কিন্তু তাদের হৈচৈ শুনতেই পাচ্ছি না এখন ভঙ্গীতে আমরা গপাগপ খেতেই থাকবো।

স্বশব্দে হেসে ফেললেন আজাদ সাহেব। নূহাও হাসিতে যোগ দিলো বাবার সাথে। এরপর একে অপরের হাত আঁকড়ে ধরে সম্মুখ পানে কদম বাড়ালো পিতা ও কন্যা।

...

(নতুন একটি সম্পর্কের সুবহে সাদিকে আলোকিত একটি দিনের স্বপ্ন ও আশা নিয়ে দুজন মানুষ পথ চলতে শুরু করে। কারো সফর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই শেষ হয়ে যায়! কারো কারোটা দেখা পায় দ্বিপ্রহরের। কেউ কেউ স্নাত হয় বিকেলের মিষ্টি রোদে। হাত হাত রেখে কেউ কেউ আবার পৌছে যায় গোধূলি লগ্নে। উপভোগ করে সূর্যাস্ত......

স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনটা সত্যিই অন্যরকম অধরা কিছু অনুভবের সমন্বয়। একে অন্যের যে স্বভাব বা কাজগুলো মনে বিরক্তির উদ্রেক করে। দেখা যায় দূরে গেলে সেই স্বভাব না কাজগুলোর জন্যই তাকে বেশি মিস করা হয়। দুরুত্ব বুঝিয়ে দেয় জীবনে একে অন্যের গুরুত্ব......

অবশ্য এটা সব সম্পর্কের ক্ষেত্রেই মনেহয় হয়। দূরে চলে গেলে ছোট ছোট বিষয়গুলোও খুব যত্নের সাথে মনে রাখা হয়, মনে পড়ে যায়। কিন্তু কাছে থাকলে হয়তো অনেক বড় কিছুও এড়িয়ে যায় চোখ থেকে......

আমাদের তাই সম্পর্কগুলোর হক আদায়ে সবসময়ই সচেষ্ট থাকা উচিত। কেননা কেউ জীবন থেকে অতীত হয়ে যাওয়া......??!! সেতো সময়ের ব্যাপার মাত্র......)

...
...
...

পরবর্তী গল্প “আমাদের আনন্দবাড়ি” 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন