রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২১



বাড়িতে ঢুকতেই বাগান বাচ্চাদের বেশ কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবং হুমায়ূন এর ছেলে তালহার কান্না শুনতে পেয়ে জাওয়াদ হুমায়ূনের দিকে তাকিয়ে বলল, কি হয়েছে ওখানে দেখে আয় তো!

হুমায়ূন দেখে ফিরে এসে বলল, বাগানে খেলতে গিয়ে পায়ে কাঁটা ফুটেছে তালহার পায়ে। কিন্তু কাউকেই হাত লাগাতে দিচ্ছিলো না পায়ে। যার ফলে কাঁটাটা পা থেকে বের করাও সম্ভব হচ্ছে না। আমিও গিয়েছিলাম কাঁটা বের করে দিতে কিন্তু তালহা বলছে, এক কথা কাঁটা বের করতে  গেলে সে ব্যথা পাবে। তাই কাঁটা বের করতে দেবে না। তুমি কি একটু দেখবে ভাইয়া? আমি রামিছাকে ভেতরে যেতে বলছি।

বাগান থেকে হুমায়ূনের স্ত্রী রামিছা বাড়ির ভেতরে চলে যাবার পর জাওয়াদ তালহার কাছে এলো। জিহাদ সালাম দিয়ে বলল, কাঁটাতে হাতই দিতে দিচ্ছে না পাপা।

সালামের জবাব দিয়ে জাওয়াদ বলল, ঠিকআছে আমি দেখছি।

জিশান হেসে বলল, কিন্তু পাপা তুমি তো দেরি করে ফেলেছো। উনাইশাহ তো নিজে নিজেই ওর বিচার কার্য সমাধান করে ফেলেছে।

তোমরা সবাই রুমে যাও আমি তালহাকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি ইনশাআল্লাহ। এরপর উনাইশাহর কান্ড শুনবো। হাসতে হাসতে বললো জাওয়াদ। বাচ্চারা সবাই চলে যাবার পর তালহার পাশে বসলো জাওয়াদ। কান্না বন্ধ করে কাঁটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসেছিল তালহা। কিন্তু জাওয়াদকে দেখা মাত্রই দু’হাত বাড়িয়ে আবারো ঠোঁট বাঁকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু হলো। আঙ্গুল দিলে ঈশারায় দেখালো কোন গাছ থেকে তার পায়ে কাঁটা ফুটেছে।    

জাওয়াদ তালহাকে কোলে তুলে নিয়ে সেই গাছের দিকে তাকিয়ে বলল, দুষ্টু গাছ তুমি খুবই পঁচা একটা কাজ করেছো। এত সোনা সোনা একটা বাচ্চার এত্তো সুন্দর পায়ে কেউ কাঁটা ফোঁটায়? শেম অন ইউ। এই অন্যায়ের জন্য তোমাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। বুঝেছো? আর তোমাকে শাস্তি দেবে আমাদের তালহা সোনা। তালহা সোনা বলো কি শাস্তি দেয়া যায় এই দুষ্টু গাছকে? চলো দুষ্টু গাছের গায়ে তুমি আর আমি মিলে দুইটা কাঁটা ফুটিয়ে দেই।

আনন্দিত হয়ে উঠতে গিয়েও আবার একটু চিন্তা করে তালহা বলল, কিন্তু পাপা তুমি যে বলেছিলে গাছের প্রাণ আছে। কাঁটা ফুটালে গাছ ব্যথা পাবে না?

একটু ব্যথা তো সেই হিসেবে পাওয়ার কথা।

তালহা বলল, তাহলে শুধু ধমক দিয়ে দাও। আবার যদি কারো পায়ে কাঁটা ফুটিয়ে দেয় তখন দুষ্টু গাছের গায়েও কাঁটা ফুটিয়ে দেব বলে দাও।   

জাওয়াদ সাথে সাথে তালহার আদেশ আদেশ পালন করলো। জোড়ে করে দুষ্টু গাছকে ধমক দিয়ে দিলো। এরপর বলল, দেখি তো বাবা তোমার পায়ে দুষ্টু গাছটা কোথায় কাঁটা ফুটিয়েছে।

তালহা দেখিয়ে বলল, ধরো না কিন্তু নয়তো আমি ব্যথা পাবো।

কাঁটা বের না করলে তো ব্যথা কমবে না বাবা।

কিন্তু বের করতে গেলেও তো আমি ব্যথা পাবো।

হ্যা তুমি একটু বেশি ব্যথা পাবে বের করতে গেলে।কিন্তু তুমিই ভেবে দেখো সারাক্ষণ ব্যথা নিয়ে থাকবে নাকি একবার একটু বেশি ব্যথা সহ্য করে কাঁটাটা বের করে ফেলবে। তালহা তো তখন গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো। জাওয়াদ হেসে বললেন, তুমি কি জানো কোন কিছু তোমাকে ততক্ষণই ভয় দেখাতে পারবে যতক্ষণ তুমি সেটাকে ভয় দেখানোর ক্ষমতা দেবে। এই যেমন তুমি ব্যথার ভয় পাচ্ছো বলেই কাঁটাটিকে তোমার পা থেকে আলাদা করতে পারছো না। তালহা তখনও দোদুল্যমনতায় ভুগতে লাগলো। জাওয়াদ বলল, যখন মনখারাপ লাগে, ভয় লাগে তখন কি করতে হয় বলো তো তালহা?

তালহা বলল, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হয়।

তাহলে তুমি চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও।

তালহা সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে শুরু করলো। এক সুযোগে জাওয়াদ ওর পা থেকে কাঁটা বের করে নিলেন। তালহা ব্যথা পেয়ে জোড়ে চিৎকার করে উঠলো।  কিন্তু জাওয়াদ জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে গেলো। আরো কিছুক্ষণ পরে চোখ বড় বড় করে বলল, পাপা ব্যথা চলে গেলো তো।

জাওয়াদও চোখ বড় বড় করে বলল, তাই? ব্যথা চলে গেলো? কোথায় গেলো দুষ্টু ব্যথাটা?

তালহা হেসে বলল, আল্লাহ নিয়ে গিয়েছে। আমি যে সাহায্য চেয়েছিলাম সেজন্য।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। দেখেছো তুমি যদি কাঁটাটা তুলতে না দিতে তাহলে কি ব্যথা যেত বলো? তাই যখনই কোন ব্যথা আসবে তোমার কাছে একটুও ঘাবড়ে যাবে না। তুমি তখন আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে এবং সেই ব্যথাটা দূর করার জন্য নিজেও চেষ্টা করবে। কেমন?

তালহা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ইনশাআল্লাহ পাপা।

তালহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আপন মনেই জাওয়াদ বলল, দুনিয়া জুড়ে নানান ধরণের কষ্ট ছড়ানো রয়েছে বুঝলে বাবা। কষ্ট থেকে বেঁচে থাকার তাই কোন উপায় নেই। বরং কষ্ট থেকে বাঁচতে চাইলে আরো বেশি করে ঘিরে ধরে কষ্ট। তাই পালিয়ে না গিয়ে, ভয় না পেয়ে কষ্টকে মোকাবিলা করতে হবে। এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।

সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী তালহা এত কঠিন কথা না বুঝলেও মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আচ্ছা।

জাওয়াদ তালহাকে আদর করে হেসে বলল, চলো আমরা আমরা খুঁজে দেখি তোমার আপ্পিরা আর ভাইয়ারা সবাই কোথায় গেলো।

নিজের কটেজে যাবার সময় বাচ্চাদের হলরুমে উঁকি দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল জাওয়াদ। বাড়ির যথাক্রমে সাড়ে তিন, চার এবং পাঁচ বছর বয়সি চারজন সোনামণিকে হলরুমের গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ হা করে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জাওয়াদের মনেহলো বাচ্চারা হা করে নিজেদের মুখের ভেতর দেখা হয়তো উনাদের নতুন আবিষ্কৃত কোন খেলা। কিন্তু ছোট্ট ছোট্ট শরীরগুলোকে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে, ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে যেভাবে তারা বিশাল আকৃতির হা করে মুখের ভেতরে কিছু দেখার চেষ্টা করছিল। তাতে কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বাচ্চাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, আমার সোনা পাখীগুলো কি করছে?

সালামের জবাব দিয়ে মানারা বলল, পাপা এখন বিরক্ত করো না। দেখছো না আমরা স্টার খুঁজছি।

স্টার? কিসের স্টার সোনা?

মাওয়ারা বলল, ওহহো পাপা তুমি তো কিছুই জানো না দেখছি। আজকে আমরা অনেকগুলো ভালো কাজ করেছি। সেগুলো স্টার হয়ে গিয়েছে মনের আকাশে। আমরা সেই স্টার খুঁজছি বুঝেছো। যাও যাও আমাদেরকে বিরক্ত করো না।

বাচ্চাদের কথা ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও হাসি মুখে ওদের তাকিয়ে ওদের কর্মকান্ড দেখতে লাগলো জাওয়াদ। কিছুক্ষণ পর কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে আদীকে দেখে জাওয়াদ হেসে বলল, কিসের স্টার খুঁজছে ওরা?

আদী হেসে বলল, এসব আমাদের সাইকো মাস্টানীর ঘনঘন বাড়িতে আসার সুফল। দুই সপ্তাহ আগে এসে উনি বাচ্চাদেরকে বলে গিয়েছেন, মানুষ যখন কোন ভালো কাজ করে তখন সেটা একটা স্টার হয়ে যায়। আর মনের আকাশে গিয়ে সেটা ঝিলমিল করে আলো ছড়ায়। যেদিন ঘোর আঁধারে ঢেকে যাবে তোমাদের জীবন, সাহায্য করার কেউই থাকবে না। সেদিন এই ভালো কাজ রূপি ঝিলমিলে স্টারগুলো তোমাদেরকে জোনাকির মত বিন্দু বিন্দু আলোর মত জ্বলে পথ দেখাবে ইনশাআল্লাহ। আর তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে আলোকিত এক জগতে নিয়ে যাবে। যেখানে তোমরা যা চাইবে পাই পাবে। তাই তোমাদেরকে এখন বেশি বেশি স্টার জমাতে হবে। আর যত বেশি ভালো কাজ করবে তত বেশি স্টার জমা হবে তোমাদের কাছে। আল্লাহ যা করতে বলেছেন সবকিছু মেনে চলা, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করা, আম্মুকে যন্ত্রণা না করা, সময়মত পড়তে বসা, নিজের খেলনা গুছিয়ে রাখা এই সবকিছু ফাটাফাটি একেকটা ভালো কাজ। আজ উনারা চারজন ফাড়াফাটি কিছু ভালো কাজ করেছেন। এখন তাই স্টার খুঁজছেন।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ এজন্যই হলরুমের সবকিছু এত সাজানো গোছানো। উনাদের এত বেশি বেশি সোনাবাচ্চা হয়ে যাবার কারণ তাহলে এটা। উনারা স্টার সংগ্রহে ব্যস্ত। যাইহোক, উনারা স্টার খুঁজতে থাকুক। চল আমরা যাই। কিন্তু উনাইশাহ নাকি নিজের সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে?

আদী হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। কিছুক্ষণ আগে উসামা বাগানে বসে খেলছিল। উনাইশাহ গিয়ে হাজির হলো সেখানে। উনাইশাহকে দেখার সাথে সাথেই তো উসামার চেহারা কালো হয়ে গেলো একদম। কিন্তু উনাইশাহ পাশে বসে বলল, মামা আমি তোমাকে সরি বলতে এসেছি। এই দেখো সরি কার্ড নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। এটা আমি নিজে বানিয়েছি। কাশফিয়া আপ্পি শুধু একটুখানি হেল্প করেছে। মামা সরি। আমি আর কখনো তোমাকে দুষ্টু কথা বলবো না। কার্ড দেখে আর কথা শুনে উসামার চেহারা একদম খুশি খুশি হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুইজন সবকিছু ভুলে গলায় গলায় খাতির করে ফেললো। একবারে মামা-ভাগনী যেখানে, সব সমস্যার সমাধান সেখানে যাকে বলে। সেহেতু ওরা নিজেরাই ভাব করে ফেলেছে তাই আজ আর কিছু বোঝাতে চাইছি না উনাইশাহকে। পরে কখনো বুঝিয়ে বললেই হবে।

হ্যা সেটাই ভালো। আমাদের আসলে বাচ্চাদের কাছ থেকে শেখা উচিত কত সহজে একে অন্যেকে ক্ষমা করে দিয়ে আপন করে নেয়া যায়। কোন হিসাব-নিকাশ, যুক্তি-তর্কে না জড়িয়ে কিভাবে জীবনটাকে সহজ, সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলা যায়। বাচ্চারা উন্মুখ হয়ে থাকে কিভাবে তাড়াতাড়ি মান-অভিমান দূর করে আবার খেলায় মেতে উঠবে সবাই মিলে। আর আমরা বড়রা অনুসন্ধান করি কিভাবে মান-অভিমানকে আরো ঘনীভূত করে তিলকে তালে রূপান্তরিত করা যায়। তবে ছোটরা যাদের ওদের ভুলগুলোকে বুঝতে পারে সেই পদক্ষেপ বড়দেরকেই নিতে হয়। ওদেরকে বুঝিয়ে বলতে হয় সমস্যার কথা। দেখিয়ে দিতে হয় সমাধানের সুন্দর পথ। বাচ্চারা তো মূলত নতুন কিছু শেখার জন্য উন্মুখ হয়েই থাকে। বাচ্চারা খুব অল্পেই খুশি হয়ে যায়। খুব অল্প জিনিসে  খুশি হবার ক্ষমতাটা ধীরে ধীরে বড় হবার পথে চলতে চলতে হারিয়ে ফেলে মানুষ। এই ক্ষমতাটা যেন কখনোই হারিয়ে না যায় মন থেকে সেজন্য বাবা-মাদেরকে সতর্ক থাকা উচিত। কারণ মানুষের আনন্দিত হবার উপকরণ যত বড় হতে থাকে, তার জীবনে নিরান্দদ ততই জায়গা করে নিতে থাকে। আর সবচেয়ে ভালো হচ্ছে ছোট বেলা থেকেই ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে বাচ্চাদেরকে আনন্দ খুঁজে নিয়ে আনন্দিত হতে উদ্বুদ্ধ করা। যেমন বৃষ্টি। আনন্দের সাথে সাথে বৃষ্টি একটা নিয়ামত। এই সময় দোয়া কবুল হয়। বৃষ্টিকে উপভোগ করতে শেখানোর পাশাপাশি বৃষ্টির দোয়াটাও শিখিয়ে ফেলা যায় খুব সহজেই।  

আদী হেসে বলল, বাচ্চা লালন-পালনের একটা স্কুল খুলে ফেল তুই আর সাইকো মাস্টারনী মিলে। জগতবাসী অনেক উপকৃত হতে পারবে ইনশাআল্লাহ। যাইহোক, কথা হয়েছে নূহার সাথে?

হুম, আলহামদুলিল্লাহ হয়েছে। চুপচাপ মেনেও নিয়েছে সব কথা। ইনশাআল্লাহ নিজেকে সামলে নেবে নিজেকে। আর কখনো যদি বেসামাল হয়ে যায় সেজন্য তো আমরা আছিই তাই না? আচ্ছা তুই তালহাকে রুমে দিয়ে আয়। আমি যাই প্যাকিং সেরে ফেলি। বেরোতে হবে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই।

তালহাকে আদীর কাছে দিয়ে বাচ্চাদের রুমে ঢুকলো জাওয়াদ। জিশান আর জারিফ নীচে বসে পাজেল মিলাচ্ছিলো। জিহাদ বই নিয়ে এক পাশে বসে পড়ছিল। আর নাবিহা মুখে হাসি আর চোখে অশ্রু নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসেছিল। বুঝতে পারছিল কোন কারণে খুব বেশি আনন্দিত নাবিহা। কিন্তু সন্তানদের চোখে আনন্দাশ্রুও দেখলেও বুকের মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করে জাওয়াদের। মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বলল, কি হয়েছে আমার মামণিটার?

নাবিহা চোখ মুছে মুখের হাসি আরো বিস্তৃত করে বললো, মামণি যে গতরাতে হুট করে চলে গেলো। আমি সেজন্য অনেক মন খারাপ করে একটা ম্যাসেজ লিখেছিলাম। অনেক অভিমানী কথা লিখেছিলাম মামণীকে। পাপা দেখো মামণি ম্যাসেজের জবাবে আমাকে কি লিখে পাঠিয়েছে।

জারিফ লাফ দিয়ে উঠে বলল, কি লিখেছে মা তোমার জন্য আপ্পি?

জিশান আর জিহাদও এগিয়ে এলো। জাওয়াদ হেসে বলল, নাবিহা আমরা সবাই বসছি। তুমি আমাদেরকে পড়ে শোনাও মা কি লিখেছে তোমাকে নিয়ে।  

নাবিহা আনন্দময় হাসি বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে বলল, মা লিখেছে,“অনেক আগে একটা কার্টুন দেখেছিলাম নাম ছিল ‘ডুমবো’। ছোট্ট একটা হাতির বাচ্চাকে নিয়ে ছিল কার্টুনটি। সেই কার্টুনেই আমি প্রথম দেখেছিলাম বকরা তাদের ঠোঁটে ঝুলিয়ে স্বর্গরাজ্য থেকে ছোট্ট ছোট্ট নবজাতক শিশুকে এনে দিচ্ছে তাদের মায়েদের কাছে। শিশুদের পেয়ে মায়েদের সে কি আনন্দ। বুঝেছিলাম শুধু মানুষই না সব প্রাণীদের মধ্যেই মাতৃত্ব অনুভূতিটা অন্যরকম মন ছুঁয়ে যাওয়া কিছু। হুমম, তবে তখন শুধু দেখেছি আর আনন্দ পেয়েছি কিন্তু নিজে মা হবার পর উপলব্ধি করেছিলাম অনুভবের সাগরে প্রাপ্তির কেমনতর জোয়ার আসে নতুন প্রাণের আগমনে। যেন তেন প্রাণ কিন্তু নয়, সেই প্রাণ যে একটু একটু করে বেড়ে ওঠে নিজেরই ভিতরে। অনেকটা বকের গলায় ঝুলে ঝুলেই আমার জীবনে আগমন ঘটেছিলো আমার ছোট্ট রাজকন্যার। ওকে প্রথম যখন দেখেছিলাম মনেহয়েছিল এটা কি সত্যিই কোন মানব শিশু নাকি পরীদের দেশ থেকে আসা কোন ফুলপরী? যেভাবে চারপাশ ওর আলোয় আলোকিত হয়ে যাচ্ছে নাকি চাঁদের এক টুকরাই খসে পড়েছে পৃথিবীতে? অনেক খুঁজে যখন শরীরে কোথাও ডানাকাটার দাগ পেলাম না, নিশ্চিন্ত হলাম যে না আমি কোন মানব শিশুকেই দেখছি। কোলে নিয়ে মুখপানে চাইতেই চোখ আটকে গেলো ওর স্বপ্নালু দুটি চোখে। খোলা চোখও যে এমন স্বপ্নের আবেশ জড়ানো থাকে সেই প্রথম জেনেছিলাম আমি। গায়ের রঙ দেখে মনেহচ্ছিল সদ্য ফোঁটা শিশির স্নাত হালকা গোলাপী এক গোলাপকে জড়িয়ে ধরে বসে আছি। ভালোলাগার সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছিলাম ওর অনিন্দ্য সুন্দর চেহারা দেখে। কল্পনার সব রঙ মিশিয়ে তুলি দিয়ে আঁকা এক স্বপ্নকন্যা যেন আমার ছোট্ট রাজকুমারী।

ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আমার রাজকুমারীর ভীষণ প্রিয়। পছন্দ করে রংবেরংয়ের ফুল, পাখী, গাছপালা। এজন্যই মনেহয় ওর আবেগ খুবই সমৃদ্ধ, রঙিন আর বৈচিত্র্যময়। রূপকথার রাজ্যে বসবাসের প্রতি তীব্র আকর্ষণ থাকলেও উর্বর কল্পনাশক্তি দিয়ে সৃজনশীলতাকে বের করতে জানে। শব্দ আর ছন্দের খেলা ভীষণ ভালোবাসে বলেই হয়তো খুব সহজেই রপ্ত করে ফেলেছে ছড়া ও কবিতা লেখা। স্বভাবে ভীষণ আদুরে। এতোটা যে প্রিয় খাবার কি জিজ্ঞেস করলে বলে ‘আদর’। একটুতেই অভিমান করে, সহজে মনোবাসনা ব্যক্ত করতে চায় না। কিন্তু সবাই ওকে আদর-স্নেহ-ভালোবাসাতে ডুবিয়ে রাখুক এটাই ওর একান্ত কামনা। মনেহয় এই সেদিন আকাশে উড়ন্ত পাখী দেখে অঝোর কান্নার সাথে আবদার করছিলো ওকে দুটি ডানা লাগিয়ে দিতে যাতে আকাশে উড়তে পারে। ওকে সেদিন বলেছিলাম মানুষের উড়তে ডানা লাগে না, লাগে স্বপ্ন, চেষ্টা আর ইচ্ছা। আর মামণি তোমার স্বপ্নে একটা ইচ্ছা আর আরেকটা চেষ্টার ডানা লাগিয়ে দেবো। তুমি উড়বে মুক্ত বিহঙ্গের মতো। কি বুঝেছিল জানি না কিন্তু মেনে নিয়েছিলো আমার কথা। বছর ঘুরে ঘুরে আমার রাজকুমারী ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাবে জানি। কিন্তু বয়স যে মনের মধ্যে ছাপ ছেড়ে যায় এমনটা আমার পছন্দ না। বয়স যতই বাড়ুক মনের মধ্যে ছেলেমানুষি থাকতে হবে, চোখে থাকতে হবে স্বপ্নালু ভাব। কল্পনাকে জয়ের আশ্বাসে থাকতে হবে স্বপ্ন দেখার গুণ। তাহলেই মনজয়ী কৌশলগুলো প্রস্ফুটিত হবে চরিত্রে। জানি সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন আমার রাজকুমারী নাবিহা বিনতে জাওয়াদ সংসার সমুদ্রে নৌকা ভাসাবে নিজের ভুবনে যাবার জন্য। দোয়া করি জগতের সকল আনন্দ-হাসি-সুখ যেন বারবার আন্দোলিত করে যায় আমার রাজকুমারীকে। তাকে দেখে যেন মনেহয় মানুষ আসলেই আশরাফুল মাখলুকাত।"

পড়তে পড়তে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো নাবিহার। হাত বাড়িয়ে মেয়েকে বুকে টেনে নিলো জাওয়াদ। অন্যসময় হলে অশ্রু গোপন করার চেষ্টা করতো কিন্তু এই মূহুর্তে ঝরে দিতে দিলো। জিহাদ, জিশান আর জারিফও পাপা আর বোনের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, তোমাদেরকে কি একটা ফাটাফাটি আনন্দের সংবাদ দেবো?

কি সংবাদ পাপা? চারজনই একসাথে জিজ্ঞেস করলো।

বিকেলে তোমাদের মা আর বাবা আসছে। এবং আগামী দুই সপ্তাহ তোমাদের সাথে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

এই সংবাদ শোনা মাত্রই তো আনন্দে চিৎকার করে উঠলো চারজন। বাচ্চাদের আনন্দ উল্লাসে মগ্ন করে দিয়ে জাওয়াদ প্যাকিং করার উদ্দেশ্যে নিজের রুমে রওনা দিলো।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন