রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি......১০




প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বেডরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং হলের দিকে রওনা করেছিলেন আফজাল সাহেব। মেজাজ বিক্ষিপ্ত থাকলে তিনি খেতে পারেন না। কিন্তু ডায়াবেটিসের কারণে রুটিন মেইন্টেইন করতেই হয়। যখন খেতে ইচ্ছে করে না তখন জোড় করে খাওয়াটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ মনেহয়। অবশ্য কঠিন শব্দটাই মনেহয় আপেক্ষিক। যখন যে মূহুর্তের উপর সওয়ার হয়, সেই মূহুর্তটিকে কঠিন কিছুতে পরিণত করে। এইসব ভাবতে ভাবতে ডাইনিং হলে পৌঁছে গেলেন। ডাইনিং টেবিলের দিকে চোখ পড়া মাত্রই মনের বিরক্তি ভাব উবে গিয়ে একটা সুখ সুখ আবেশ ছড়িয়ে পড়লো। চেয়ার টেনে বসতে বসতে আনন্দিত কন্ঠে বললেন, ঘটনা কি আমাদের ডক্টর’সরা সবাই আজ যে এখনো বাড়িতে?

জাওয়াদ, ফায়েজ, আদী তিনজনই হাসিমুখে সালাম দিলো। সালামের জবাব দিয়ে আফজাল সাহেব বললেন, অফ ডে নাকি আজ তোমাদের? জাওয়াদ তাহলে আমাকে একটা অ্যাপয়েন্টম্যান্ট দাও। জরুরি কথা আছে তোমার সাথে।  

জাওয়াদ হেসে বলল, না অফ ডেট না। আদী আর ফায়েজ নাস্তা সেরেই হসপিটালে যাবে। আমিও যাব বিকেল দিকে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমাকে বেরোতে হবে। তবে চাইলে এখন কথা বলতে পারো।  

পরিবারের সদস্যদের জন্য আরেকটু সময় বের করার চেষ্টা করো তোমরা। প্রদ্বীপের নীচে অন্ধকার কথাটার সত্যতা প্রমাণের দায় তো মানুষের না। প্রদ্বীপ জড় পদার্থ তাই চাইলেও নিজের অন্ধকার অংশকে আলোকিত করার কোন সুযোগ নেই তার কাছে। কিন্তু মানুষ ইচ্ছে এবং চেষ্টা করলেই নিজেকে ভালো মতো আলোকিত করে, অতঃপর চারিদিকের আঁধার দূর করার চেষ্টা করতে পারে। তাই আলোর মশাল হাতে বাড়ির বাইরে ছুটোছুটি করার আগে বাড়ির প্রতিটা রুমে আগে একটা করে মশাল লাগাও।

কিন্তু বাড়িতে তো ইলেক্ট্রিসিটি আছেই বাপী। এখানে ইলেক্ট্রিসিটি যাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু তারপরও বাড়তি সতর্কতা স্বরূপ জেনারেটর সিস্টেমও অ্যাক্টিভ থাকে। জানোই তো আমাদের বাড়ি ভর্তি মহা দুষ্টু দুষ্টু সব বাচ্চাকাচ্চায়। দেখা যাবে ঘরে ঘরে লাগানো মশালকে দুষ্টু বাচ্চারা খেলার নতুন সামগ্রী বানিয়ে ফেলবে। অতঃপর বাড়িই দাউ দাউ জ্বলবে বিশাল এক মশালের মতো।  

প্রচন্ড বিরক্ত চোখে আদীর দিকে তাকালেন আফজাল সাহেব। যদিও কথাগুলো খুবই সিরিয়াস কন্ঠে বলেছে আদী কিন্তু মূল উদ্দেশ্যে যে দুষ্টুমি সেটা বুঝতে মোটেই কষ্ট হচ্ছে না আফজাল সাহেবের। এই বাড়ির প্রতিটা ছেলেমেয়েকে তিনি প্রচন্ড রকম ভালোবাসেন, পছন্দ করেন। শুধুমাত্র সবার এই সারাক্ষণ দুষ্টুমির করার সুযোগ খোঁজার স্বভাবটা খুবই অপছন্দ তার। বিরক্ত কন্ঠে বললেন, শোনো আদী সবকিছু নিয়ে ফান করা ঠিক না। তাছাড়া তোমরা এখন আর ছোট নেই। মাঝ বয়সে পৌছে গিয়েছো। এখন কথাবার্তায় একটু গাম্ভীর্য ও ভারীত্ব আনার চেষ্টা করো। তাছাড়া তিন সন্তানের পিতা তুমি। বাবাকে যদি সারাক্ষণ হাসি-মজা আর অন্যেদেরকে বিরক্ত করতে দেখে, কি শিখবে ওরা? 

ভেতর থেকে উঠে আসা হাসিকে প্রাণপণে চেপে ধরে আদী বলল, জ্বি বাপী একদম ঠিক বলেছো। আজ থেকে দুষ্টুমিতে ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই বন্ধ। তাহলে বিনা চার্জে একসময় বিনা নোটিশে বিদায় হয়ে যাবে সকল দুষ্টুমি। যাইহোক, তুমি তোমার সমস্যার কথা বলো বাপী।   

আফজাল সাহেব বললেন, আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা দু’টা। এক, তোমার মা। দুই, তোমার ফান করা স্বভাব। এই দু’টা থেকে মুক্তি পেতে চাই আমি।

কোন কারণে আফজাল সাহেব রেগে আছেন বুঝতে পারলো জাওয়াদ। এই সুযোগ আদী হেলায় চলে যেতে দেবে না। বরং যত্ন করে যে রাগে তেল ঢালবে সেটাও অজানা নয় জাওয়াদের। তাই আদী কিছু বলার আগেই বলল, কি হয়েছে বাপী? ছোট খালামণি আবার কি করেছে?

সবসময় যা করে তাতে কি নতুন করে আরো কিছু করার দরকার আছে? জাওয়াদ তোমাদের উপর আমি খুবই অসুন্তুষ্ট। তোমাদের কারণে এই বুড়ো বয়সে আমাকে পরকালের জন্য পাথেয় সংগ্রহের বদলে বৌয়ের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করে সময় কাটাতে হচ্ছে। 

শব্দ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো আদী। চোখ মুখ কালো করে বলল, এখানে বসে নিজ কানে নিজ মায়ের নামে গীবত শোনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি উঠছি। বাপীর এই সমস্ত কথা শুনেই আমার পেট ভরে গিয়েছে। কথা শেষ করে দুপদাপ পা ফেলে আফজাল সাহেবের ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নীরব হাসিতে ফেটে পড়লো আদী। জাওয়াদ আর ফায়েজ বহু কষ্টে হাসি চেপে চেহারা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। উঠে যাবার আগে এক টিস্যুতে কিছু লিখে জাওয়াদের পাশে রেখে গিয়েছিল আদী। ভাঁজ খুলে ভেতরে লেখা পড়ে না চাইতেও হেসে ফেললো জাওয়াদ।

অবাক চোখে জাওয়াদের দিকে তাকালেন আফজাল সাহেব। বাড়ির এই একটি ছেলেকেই ভারসাম্য পূর্ণ চরিত্রের মানুষ বলে মনে করেন তিনি। অকারণে মানুষকে বিরক্ত করার অভ্যাসও নেই জাওয়াদের। নিজের মনের কথা বলার জন্য তাই জাওয়াদের কাছেই সবসময় ছুটে আসেন তিনি। 

আফজাল সাহেব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বুঝতে পেরে জাওয়াদ বলল, আই এম রিয়েলি সরি বাপী। বলো যা বলছিলে তুমি। কথার ফাঁকে আদীর রেখে যাওয়া টিস্যুকুটটা ফায়েজের দিকে ঠেলে দিলো জাওয়াদ। আদী লিখে রেখে গিয়েছে, আমার প্রাণপ্রিয় ভ্রাতদ্বয় গীবত নামক চাপাটি দিয়ে বাপী যে মৃত ভাইয়ের গোশত তৈরি করছে সেসব আমি কিছুতেই তোমাদেরকে খেতে দেবে না। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই মাকে সাথে নিয়ে ফিরে আসছি ইনশাআল্লাহ। আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকার কারণে জাওয়াদের মতো হেসে না উঠে নিজের হাসিকে সামলে নিলো ফায়েজ।  

একটু ক্ষণ চুপ থেকে আফজাল সাহেব বললেন, তোমাদের চাচী মারা যাবার পর আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে গিয়ে রিয়ালাইজ হলো বিয়ের পর থেকে নিয়ে ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমার জ্ঞানার্জন। ভেবেছিলাম সংসারের নানান ঝামেলায় আমল ও ইবাদতের ঘাতটি সমূহ এখন পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করবো। কিন্তু তোমাদের কারণে আমার সেই আশাতেও গুড়ে বালি পড়লো। এই বয়সে তোমরা সবাই মিলে আমাকে এক রকম জোর করে তোমাদের ছোট খালামণির সাথে আবার বিয়ে দিলে। এরপর থেকে গত তিন বছরে পৃথিবীতে শান্তি নামেও যে কিছু আছে সেটা ভুলতে বসেছি আমি।

তোমাদের দুইজনের বিয়ের আইডিয়া নূহার ছিল বাপী। আস্তে করে বললো জাওয়াদ।

নূহা। হ্যা নূহাই সবচেয়ে বেশি দায়ী আমার এই দূরাবস্থার জন্য। আজই যাব নূহার বাসায় আমি বোঝাপড়া করতে। অবশ্য দোষ আমার নিজেরও কম না। ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা থাকার পরেও আমি তোমাদের কথা শুনে পটে কিভাবে গেলাম?

আসলে বাপী যে ন্যাড়া বার বার বেল তলায় যায় তার নাম হচ্ছে, বিবাহিত পুরুষ। আর যে অভিজ্ঞতা কখনোই নিজের কোন কাজে লাগে না সেটা হচ্ছে, দাম্পত্য অভিজ্ঞতা।

অসাধারণ একটি কথা বলেছো তুমি জাওয়াদ। এজন্যই তোমার সাথে কথা বলে এত মজা পাই আমি।

আর আমার সাথে কথা বলে কি চিরতার স্বাদ পাও? পেছন থেকে হুঙ্কার ভেসে এলে ঘুরে তাকিয়ে মারমুখী ভঙ্গিতে স্ত্রীকে দাঁড়ানো দেখে একবার ছেলেদের দিকে আরেকবার স্ত্রীর দিকে বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকালেন আফজাল সাহেব।

আদী চেহারায় করুন ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ফায়েজ, জাওয়াদ চল আমরা যাই এখান থেকে। বাবা-মায়ের ঝগড়ার সময় বাচ্চাদের সামনে থাকতে নেই। তাদের কোমল মনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে এরফলে।

এক মূহুর্ত দেরি না করে উঠে দাঁড়ালো ফায়েজ আর জাওয়াদ। তারপর তিনজনই নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো ডাইনিং হল থেকে।

বারান্দায় এসে তিনিজনের এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা হাসিরা গুঞ্জরন তুললো। ফায়েজ হাসতে হাসতে বলল, আজ বাপীর খবর আছে। ছোট খালামণি বেচারাকে কেঁচে ফেলবে।

আদী হেসে বলল, তবে যাই বলিস মা কিন্তু সত্যিই বেচারাকে অনেক বেশি যন্ত্রণা করে। মা’র কর্মকান্ড দেখলে মাঝে মাঝে মনেহয় টিনেজ কোন বাচ্চা মেয়ের নতুন বিয়ে হয়েছে।

তিনজনই হাসলো আবারো। জাওয়াদ হেসে বলল, তোদের মনে আছে তখন সবে মাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলাম আমরা। হঠাৎ একদিন পাপা বাড়িতে ফিরে ঘোষণা দিলেন আজ থেকে তোমাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। কারণ আগামীকাল থেকে তোমরা মাদ্রাসায় যাবে। সবার আগে হিফয করবে এরপর অন্য পড়াশোনা। মা, মামণি, খালামণি, ফুপ্পিরা যখন আপত্তি করেছিলেন পাপা জবাবে বলেছিলেন, আগে আমার ছেলেদের দ্বীনের পথে চলতে শেখাবো। তাহলে দুনিয়ার পথে কিভাবে চলতে হবে সেটা আর ওদেরকে শেখাতে হবে না। কিন্তু যদি আগে দুনিয়াতে বিচরণ করে মজা পেয়ে যায়, তাহলে দ্বীনের পথে চলাটাকে বোঝা মনে হবে ওদের কাছে। পাপার এই সিদ্ধান্ত টি আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আজ আমরা ভাইয়েরা যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি মূলত তার ভিত্তি তখনই নির্মিত হয়েছিল। প্রায় দুই বছর লেগে গিয়েছিল আমাদের সবার হিফজ করতে। আল্লাহর কালামকে অন্তরে ধারণ করার এই পরম প্রাপ্তির সাথে সাথে আরেকটা প্রাপ্তিও যুক্ত হয়েছিল আমাদের জীবনে। বাপীর গাইডেন্স। নিঃসন্দেহে ঐ সময় বাপী ছিলেন আমাদের ফ্রেন্ড, ফিলোস্ফার এন্ড গাইড। হিফজ করার আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলাম আমরা বাপীর তাফসীর শুনে। আমাদের অভিভাবকগণ সবাই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আমাদেরকে জীবনকে উপিলব্ধি করতে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু কুরআনকে উপলব্ধি ও নিজের মাঝে ধারণ করতে আমরা বাপীর কাছে শিখেছিলাম। আরেকটা জিনিস বাপী আমাদেরকে শিখিয়েছিলেন। বল তো সেটা কি? 

ফায়েজ হেসে বলল, একসেপ্টেন্স। মেনে নেয়া, মানিয়ে চলা শিখেছিলাম আমরা বাপীর কাছে।

হুমম, বাপী আমাদেরকে বলেছিলেন, জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে খুশি থাকতে পারবে তোমরা যদি একসেপ্ট করার ক্ষমতা তৈরি করতে পারো মনে। আসলেই কিন্তু তাই। একসেপ্টেন্স সুখী জীবনযাপনের ভয়াবহ শক্তিশালী একটি মূলমন্ত্র। যারা জীবনে আগত পরিস্থিতি গুলোকে মেনে নিতে পারে দুঃখও তাদেরকে দুঃখী করতে পারে না। হাসি মুখে বললো আদী।

জাওয়াদ হেসে বলল, হ্যা। কিন্তু কিছুটা বয়স হবার কারণে আমাদের বাপী মনেহয় নিজের এই ফর্মুলাটাকে নিজ জীবনেই অ্যাপ্লাই করার কথা ভুলে গিয়েছেন। সময় করে একদিন বাপীকে মনে করিয়ে দিতে হবে ফর্মূলাটা ইনশাআল্লাহ। যাইহোক, তোমরা তোমাদের ডিউটিতে যাও। আমিও কিছুক্ষণ পর বেরোবো। বিকেলে হসপিটালে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।

একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তখন নিজ নিজ কাজে ছুটলো তিন ভাই।   

@

ডোর বেল এর শব্দ শুনেই নূহা বুঝে গেলো কার আগমন ঘটেছে তার ছোট্ট কুটিরে। আজ সারাদিন ধমকের উপর থাকতে হবে ভাবতেই হাসি ফুটে উঠলো মুখে। মাছ কাটা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে টাওয়েল টেনে নিয়ে দরজা খোলার জন্য ছুটলো। দরজা খুলে ভ্রূ কুঁচকে আফজাল সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সালাম দিয়ে হাসি মুখে নূহা বলল, সু স্বাগতম বাপী।

সালামের জবাব দিয়ে আফজাল সাহেব বললেন, এতক্ষণ লাগে নাকি দরজা খুলতে?

রান্নাঘরে ছিলাম বাপী তাই একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা যাও সরি। এখন তো ভেতরে ঢোকো। 

ঘরের ভেতর পা দিয়েই নাক কুঁচকে ফেললেন আফজাল সাহেব। বিরক্ত কন্ঠে বললেন, এটা কি কোন বাসা নাকি মাছের বাজার? এমন আঁশটে গন্ধ কেন? 

নূহা হেসে বলল, আমি মাছ কাটছিলাম এতক্ষণ। আঁশটে গন্ধ মনেহয় আমার হাত থেকে আসছে। তুমি ড্রইংরুমে গিয়ে বোস। আমি মাছে মসলা মাখিয়ে, ড্রেস চেঞ্জ করে আসছি।

কয়েক কদম এগিয়ে পেছনে ঘুরে আফজাল সাহেব বললেন, দরজা বন্ধ করিস না। তোর মা আর শ্বাশুড়ি নানান ধরণের লতা-পাতা পাঠিয়েছে তোর জন্য। ড্রাইভার নিয়ে আসছে সেসব। 

নূহা হেসে বলল, তাহলে তুমিই রিসিভ করো সেসব। আমি মাছের সুবাসে সুবাসিত হয়ে মানুষের সামনে নাই যাই।

রান্নাঘরে ফিরে এসে দ্রুত মাছ কেটে, ধুয়ে, মসলা মাখিয়ে রাখলো নূহা। এরপর নিজে ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে এলো। আফজাল সাহেব বুক সেলফের কাছে দাঁড়িয়ে বই দেখছিলেন। নূহাকে ঢুকতে দেখে বললেন, এত গল্প-উপন্যাসের বই কেন? তুই কি এইসব পড়িস নাকি আজকাল? এইসব পড়া আর সময় নষ্ট করার মাঝে যে কোন পার্থক্য নেই সেটা কি ভুলে গিয়েছিস? আর ঘন্টার মতো দেয়ালে ঐটা কি ঝুলিয়েছিস? 

নূহা হেসে বলল, গল্প-উপন্যাসের বই, ঘন্টার শোপিস ওগুলো উপহার পেয়েছি বাপী। আমার স্টুডেন্টরা দিয়েছে। ভীষণ সুন্দর একটা মাটির হারিকেনও আছে। এসো তোমাকে দেখাচ্ছি।

এখন কিছুই দেখতে চাচ্ছি না। তুই বোস জরুরি কথা আছে তোর সাথে। তবে তারআগে জরুরি কথাটা বলে রাখি। দুর্জন বিদ্বান হলেও যেমন পরিত্যাজ্য। ঠিক তেমনি উপহার অমূলক বা ফালতু হলেও সেটা পরিত্যাজ্য। বুক সেলফের একটা স্ট্যান্ডার্ড থাকা উচিত। চাইলেই একজন পথচারী যেমন প্রেসিডেন্টের পাশে গিয়ে বসতে পারে না। ঠিক তেমনি একজন জ্ঞান পিপাসু ব্যক্তির সেলফে যে কোন বই চাইলেই জায়গা করে নিতে পারে না। নেক্সড দিন এসে যেন তোর বুক সেলফে এসব আগডুম বাগডুম টাইপের গল্প-উপন্যাসের বই না দেখি। মনে থাকবে?

নূহা হাসি চেপে বলল, জ্বি বাপী অবশ্যই মনে থাকবে।

আরেকটা কথা। 

হ্যা বলো।

নিজেকে মানুষের কাছে কখনোই এতটা উন্মুক্ত করে পেশ করা উচিত না। যাতে যে কেউ যা মনে চাইবে তাই উঠিয়ে নিয়ে হাজির হয়ে যাবে। মানুষের স্বভাব হচ্ছে বাদরের মতো। সুযোগ পেলেই মাথায় উঠে বসে। তাই কেউ কাঁধে উঠার আগেই বাড়ি দিয়ে নীচে ফেলে দিতে হয়। এইসব আলতু ফালতু উপহার দেবার সাহস কিভাবে পায় তোর স্টুডেন্টরা? উপহারের নমুনা দেখেই তো বোঝা যায় সবাইকে শুধু যে মাথায় তুলেছিস তাই নয়। উকুনের মতো চুলের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতাও দিয়েছিস। নিজের স্ট্যান্ডার্ড নিজেকেই ঠিক রাখতে হয়। বুঝেছিস?

জ্বি বাপী বুঝেছি। তুমি কি এসব বলতেই এসেছো?

এসব বলতে আসবো কেন? তোর বাসায় পরিবেশ দেখে এসব বলতে বাধ্য হয়েছি। আমি তোর খালামণিকে নিয়ে কথা বলতে এসেছি। তোর খালামণির অত্যাচার আমার সহ্য সীমার বাইরে চলে গিয়েছে। কিছু একটা বিহিত করা দরকার।

একজন জ্ঞানী ব্যক্তি কি বলেছেন শুনবে বাপী?

কি বলেছেন?       

বলেছেন, “প্রতিটা মানুষই এক একটা উপন্যাসের মতো। আর কোন উপন্যাস যতই অপাঠ্য বা অখাদ্য হোক না কেন মনোযোগ দিয়ে পড়লে কোট করার মতো একটা’দুটা লাইন পাওয়াই যায়। মানুষও ঠিক তেমনই। ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করলে কোন না কোন গুণ, এমনকি একাধিক গুণাবলী খুঁজে পাওয়া সম্ভব তার মধ্যে।” 

তোর খালামণি গুণের চলতি ফিরতি খাজানা এটাই তো বোঝাতে চাইছিস?

নূহা হেসে বলল, উহু, তুমি সারাক্ষণ জ্ঞানী-গুণী মানুষ দ্বারা পরিবেষ্ঠিত থাকতে চাও তাই বোঝাতে চাইছি যে, একটু কম আর বেশি কিন্তু জ্ঞান ও গুণ ছাড়া আসলে মানুষ নেই। জগতে যদি কেউ দাবী করে যে সম্পূর্ণ রূপে গুণমুক্ত। তাহলে ঐ গুণহীনতাই তার গুণ। জ্ঞান পিপাসুদের তাই স্ট্যান্ডার্ড মেইন্টেইন করা উচিত না। এতে জ্ঞানার্জনের মাধ্যম সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। জগতের অসীম জিনিস গুলোর একটি হচ্ছে জ্ঞান। সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র থেকে তাই কখনোই যথাযথ জ্ঞানাহরণ করা সম্ভব নয়।  

জ্ঞানঅর্জন নিয়ে তর্ক করতে চাইছিস বুঝতে পারছি। কিন্তু আগে তোর খালামণির কি করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই আমি। এই বুড়ো বয়সে তুই যে আমাকে কত বড় বিপদে ফেলেছিস সেটা কি বুঝতে পারছিস?

নূহা হেসে বলল, আমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছি জানো বাপী?

কি?

একটা গল্প লিখবো।

গল্প লিখবি? কিসের গল্প?

ভালোবাসার গল্প। তোমাকে থীমটা বলছি শোন। প্রজাপতির মতো ছটফটে, চঞ্চল, বর্ণিল একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটি নিজের অজান্তেই তার বাবার এক বন্ধুর ছেলেকে নিজের জীবনসাথী হিসেবে পছন্দ করে ফেলে। কিন্তু যেহেতু সময়টা ছিল আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের। এবং ভীষণ রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে ছিল তাই নিজের মনের ভাব কিছুতেই প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। ঐদিকে সেই ছেলেটিরও মেয়েটিকে ভীষণ ভালো লাগতো। কিন্তু দুজন প্রায় সমবয়সী ছিল তাই ষোল বছর বয়সে যখন পরিবার থেকে মেয়েটির বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। ছেলেটির পক্ষে মুখ ফুটে নিজের মনের কথা প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। যারফলে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় অন্য একটি ছেলের সাথে। এর আট-দশ বছর পর ছেলেটিও অন্য আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করে নেয়। নিজ নিজ বিবাহিত জীবনে দুজনই সুখী ছিল। কিন্তু বিয়ের পনেরো বছর পর দুই পুত্র আর এক কন্যার দায়িত্ব স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে মেয়েটির স্বামী চলে যান কভু না ফেরার দেশে। পরিবার থেকে আবারো বিয়ে দেবার অনেক চেষ্টা করা হয় কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ে করতে কিছুতেই রাজী হয়না মেয়েটি। তিন সন্তান আর স্বামীর বিজনেস মধ্যের জীবন পথে এগিয়ে চলার প্রেরণা খুঁজে নেন। এর প্রায় বিশ বছর পর আমার গল্পের নায়ক সেই ছেলেটির স্ত্রী একদিনও টুপ করে ঝরে পড়েন জীবন বৃক্ষের শাখা থেকে। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পুত্র-বধূ, কন্যা-জামাই, নাতি-নাত্নী সবকিছু ছিল সেই ছেলেটি এবং সেই মেয়েটির কাছে। ছিল না শুধু জীবনসাথী। তারপর একদিন তাদের পুত্র-কন্যাদের সম্মুখে উন্মোচিত হলো দুজনের শৈশব ভালোলাগা ও ভালোবাসার সেই অধ্যায়। পুত্র-কন্যারা অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে দুজনকে বিয়েতে রাজী করালো। এবং পরিবারের অনাড়ম্বর বিয়ের ট্র্যাডিশন ভেঙে ধুমধাম করে দুজনের বিয়ে দিলো। কেমন আমার গল্পের থীমটা?

এই প্রথম হাসির আভা ফুটে উঠলো আফজাল সাহেবের চেহারাতে।

নূহা হেসে বলল, কিছু কিছু মানুষের নিয়তি কি ভীষণ রকম ম্যাজিক্যাল হয় তাই না বাপী? নাটক-সীনেমা, গল্প-উপন্যাস সবকিছুকে হার মানিয়ে দেয় তাদের জীবন কাহিনী। তাদের জীবনকে আঁকার লক্ষ্যে তখন কোন শব্দের চিত্রকর হাতে তুলে নেয় রং-তুলি। রচিত হয় অসাধারণ এক প্রেমময় উপখ্যান। বাপী তুমি কি কখনো চিন্তা করে দেখেছো কতটা ভাগ্যবান তুমি? এই পৃথিবীতে খুব কম মানুষ ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলার পর আবার তাকে ফিরে পায় জীবনে। আলহামদুলিল্লাহ তুমি আর খালামণি এই অসাধারণ সুযোগটা পেয়েছো। তাহলে কেন মাঝে মাঝে মূল্যায়ন করতে ভুল করো?

আমি করি নাকি তোর খালামণি করে? তোর খালামণির কর্মকান্ড দেখলে মনেই হয় না তার বয়স চৌষট্টি বছর। মনেহয় যেন কোন ষোড়শী কন্যা।

পঁয়ষট্টি বছর বয়সে তুমি ষোড়শী জীবনসঙ্গিনী পেয়েছো এতে তো তোমার খুশি হবার কথা বাপী। আর তুমি কিনা রাগ করছো?

তোর খালামণির কর্মকান্ড দেখলে তোরও রাগ হবে।

উহু, বরং আমি যেখান থেকে দেখছি তুমিও যদি সেখান থেকে দেখো তাহলে খালামণির কর্মকান্ড দেখলে মুগ্ধতা আর ভালোবাসার রিমিঝিমি শ্রাবণের মৌসুম বইবে তোমার মন জুড়ে।

আফজাল সাহেব হেসে বললেন, তাই নাকি? তা কোথা থেকে দেখছিস তুই?

পঁয়তাল্লিশ বছর আগে থেকে। জানো বাপী কিছু মানুষের দেহ বুড়িয়ে যায়, আর কিছু মানুষের বুড়িয়ে যায় মন। দেহকে সজীব ও সতেজ রাখার অনেক পদ্ধতি আছে। কিন্তু মন শুধু ভালোবাসার প্রভাবে সতেজ থাকে। মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি অনুভূতিশীল। আর কিছু কিছু মেয়ে অন্য মেয়েদেরকেও ছাড়িয়ে যায় অনুভূতিশীলতায়। খালামণি ঠিক তেমন একজন মেয়ে। তোমাদের বিয়ের পর খালামণির মনের সেই গুপ্ত কুঠুরিটা খুলে গিয়েছে যেখানে তোমাকে ঘিরে খালামণির মনের অনুভূতিগুলো লুকায়িত ছিল। এক মূহুর্তের ব্যবধানে খালামণির মন কৈশোরের সেই দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছে। বন্দী আবেগ হঠাৎ উড়ার ডানার সন্ধান পেলে যা হয় আরকি। সমস্যাটা কোথায় সেটা কি এবার বুঝতে পেরেছো? সমস্যা হচ্ছে, তুমি ভাবছো এখন তোমাদের জীবনের গোধূলী বেলা। আর খালামণির কাছে এখন তোমাদের জীবনের সুবহে সাদিক। আলোর নূপুর পড়ে সুহাসিনী ভোরের আগমনের সময়।

আফজাল সাহেব হেসে বললেন, এক ফোঁটা একটা মানুষ। এই কদিন আগে ফিডার হাতে করে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতি। এত কিছু বুঝিস কি করে তুই?

নূহা হাসতে হাসতে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমার এই একটাই গুণ বাপী। আমি জীবনকে যতটা না যাপন করি, তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি অনুভব করার চেষ্টা করি। কোন মানুষ যখন আমার সাথে কথা বলে আমি তার শব্দদের শুনি কম, আর অনুভব করি বেশি। যারফলে, তার জীবনের মণি-মুক্তো রুপী উপলব্ধিগুলো আমার প্রাপ্তির ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে দিয়ে যায়, আলহামদুলিল্লাহ।

আফজাল সাহেব হেসে বলল, তাহলে এখন আমাকে কি করতে হবে?

আমার সাথে কিচেনে যেতে হবে। এখনো দুপুরের রান্না করা হয়নি। আমার সাথে কিচেনে চলো বাপী প্লীজ। তাহলে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে রান্নাও সেরে নিতে পারবো।

আফজাল সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা চল যাই। বাকি গল্প কিচেনে বসেই করবো চাচা-ভাতিজি।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন