রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি......৮





বারান্দায় ঢুকে রাহাতকে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো নূহা। মন যখন একাকীত্বের মাঝে শান্তি খুঁজে পায়, তখন খুব ভালো লাগার কাউকে দেখেও যে আনন্দিত ফিল করে না সেটা টের পেলো। তারপরও চেহারাতে হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি এখানে যে? ঘুমোতে যাওনি কেন?

তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। জানতাম বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলে তুমি উঠে আসবে। সেজন্যই তো তোমার জন্য কফিও বানিয়ে রেখেছি। কথা শেষ হাসি মুখে কফির মগ বাড়িয়ে ধরলো রাহাত।

কফির মগ হাতে নিয়ে রাহাতের পাশে বসতে বসতে নূহা বলল, এত বেশি জানতে নেই কাউকে। কিছু কিছু মানুষকে যত কম জানা যায় ততই মঙ্গল। তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে কিছু কিছু মানুষের জীবন খোলা বইয়ের মতো হয়। কিন্তু সেই খোলা বইয়ের ভাঁজে কিছু কিছু পৃষ্ঠা একে অন্যের সাথে এমন ভাবে জোড়া লাগানো থাকে যে উভয় পৃষ্ঠাকে আলাদা করতে গেলে ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। একে অন্যের সাথে লেগে থাকা পৃষ্ঠা গুলোকে তাই কখনোই খুলতে যেতে নেই। কিন্তু যাদের জানার আগ্রহ খুব বেশি থাকে তারা ঐ পৃষ্ঠাগুলোতে কি তথ্য লুকায়িত আছে সেটা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। এবং জানতে গিয়ে বেশির ভাগ ছিঁড়ে ফেলে পৃষ্ঠাগুলোকে। 

এটা কি আমার জন্য সতর্ক বাণী নাকি হুমকি?

নূহা হেসে ফেলে বলল, কফি অনেক ভালো হয়েছে। জাযাকাল্লাহ। আচ্ছা ছোটবেলায় তুমি স্ট্যাচু এন্ড ওভার খেলেছো? 

হুম, খেলেছি। কেন?

তাহলে যে পর্যন্ত আমি ওভার না বলবো স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকো। আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তোমার কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ তারা গুনতে ইচ্ছে করছে।

রাহাত হেসে বলল, আমি অল টাইমই স্ট্যাচু। 

জানি।

বেশি জানতে নেই।

সেটাও জানি।

আচ্ছা জানা জানি বন্ধ। নক্ষত্র গোনার শখ হয়েছে সেটাই করো। 

রাহাতের কাঁধে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলো নূহা। অনেকক্ষণ পর বলল, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে অকারণ ভাবনাগুলোকে বাক্সবন্দি করে মনের অতলান্ত সাগরে সজোরে নিক্ষেপ করি। কিংবা সোনার কাঠি, রূপোর কাঠির অদল বদলে ঘুমের রাজ্যে পাঠিয়ে দেই।

সেকি এমন ইচ্ছে হয় কেন আবার? হাসি মুখে প্রশ্ন করলো রাহাত।

কারণ এইসব অকারণ ভাবনার লুকোচুরি খেলাতে বেশির ভাগ সময়ই আরাধ্য চিন্তাটাকে খুঁজে বের করতে পারি না। যারফলে সঠিক চিন্তাগুলো হারিয়ে যায় এলোমেলো,অগোছালো চিন্তার ভিড়ে। কল্পনার জগতে ভাসতে ভাসতে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছি বাস্তবতা থেকে। নিজেই বুঝতে পারছি একদম ঠিক হচ্ছে না এটা।

জটিল, কঠিন, নিদারুন রুক্ষ বাস্তবতা থেকে যত দূরে থাকা যায় ততটাই তো ভালো।

উহু, তোমার এই কথাটা মানতে পারলাম না রাহাত। কারণ সত্য যতই কঠিন আর রুক্ষ হোক না কেন। সেটা মেনে নেবার মাঝেই কল্ল্যাণ। তাছাড়া কল্পনার মাঝে শুধু বিচরণ করা যায়। বসবাস তো আমাদেরকে বাস্তবতার মাঝেই করতে হয় তাই না? যার মাঝে নিত্য চলাচল, তার থেকে পালিয়ে কোথা যাব বল?

হুমম তাও ঠিক। কিন্তু তবুও কল্পনার রাজ্যে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও জীবনটাকে উপভোগ করা যায় নিজের মত করে।

তা হয়তো যায়। কিন্তু এর বিনিময় যে হারাতে হয় সঠিক কোন চিন্তার বদৌলতে জমার খাতায় স্থায়ী সাদাকায়ে জারিয়া অর্জনের সুযোগ। সঠিক চিন্তা আল্লাহর দেয়া নেয়ামত, আমানাত উভয়ই আমাদের জন্য। এলোমেলো চিন্তার ভিড়ে আমরা যে শুধু আমানতের খেয়ানত করি তাই’ই নয়। অবমূল্যায়ন করি আমাদেরকে দেয়া নেয়ামাতেরও। কল্পনার রাজ্যে হলো মস্তিষ্কের সেই সকল ছবি যা মানুষ নিজেই সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সঠিক চিন্তা আল্লাহর রহমতস্বরূপ আমাদের কাছে আসে। তাই সারাক্ষণ এলোমেলো ভাবনার পেছনে না ছুটে, কিছুটা সময় সেই আরাধ্য চিন্তার অনুসন্ধানেও অতিবাহিত করা উচিত যা কিনা হতে পারে সাদাকায়ে জারিয়ার উসিলা।

হুম, আমি আসলে এভাবে ভেবে দেখিনি। জ্ঞানী-গুণী মানুষদের জীবনসাথী হবার এটাই তো সবচেয়ে বড় বেনিফিট। তাদের বিষণ্ণতাও জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে দিয়ে যায়।

একটুক্ষণ চুপ থেকে নূহা বলল, আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দেই তাই না?

আরে আমি তো জ্ঞানের কথা বললাম। তুমি কষ্ট পেলে কোথায়? তাছাড়া যে আনন্দ দেয়, বেদনা দেবার হক তারই সবচেয়ে বেশি থাকে। শুধু সুখ চাইলে তো জীবনসাথী হওয়া যায় না। আমি তো সবসময় তোমার জীবনসাথী হতে চেয়েছি। সুখ এবং দুঃখ উভয়ের সাথী। কিন্তু তুমি সবসময়ই আমাকে তোমার দুঃখগুলো থেকে আড়াল করে রেখেছো। হয়তো আমারই সেই যোগ্যতা নেই। যার কারণে দীর্ঘ এক যুগ পরেও আমি শুধুই তোমার সুখের সাথী।

তুমি সত্যিই আজ কোন কারণে ভীষণ ইমোশনাল। হাসতে হাসতে বললো নূহা। আচ্ছা চলো ঘুমোতে যাই আমরা।

কেন নক্ষত্র গুনবে না?

নূহা হেসে বলল, যে কয়টা গোনার ছিল গুনে নিয়েছি। তুমি রুমে যাও। আমি বাচ্চাদেরকে আরেকবার দেখে আসছি।

রাহাত উঠে যাবার কিছুক্ষণ পর নূহাও উঠে দাঁড়ালো। তারা ভরা আকাশের পানে তাকিয়ে গভীর ভাবে নিশ্বাস নিলো। মৃদু হাসির রেখে ফুটে উঠলো নূহার চেহারাতে। সুখকে খুবই কমই কারো খোঁজে বের হতে হয়। কারণ মানুষ হন্য হয়ে সুখের সন্ধানে মগ্ন থাকে। তাই হয়তো মানুষের জীবনেও সুখের সাথীর অভাব পড়ে না কখনোই। কিন্তু দুঃখ কে সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চায়। কেউ দুঃখকে সাথীকে হিসেবে পেতে চায় না। বেচারা দুঃখকে তাই নিজের সাথীর সন্ধান নিজেকেই করতে হয়। সেজন্যই জগতে সুখের সাথী অসংখ্য হলেও দুঃখের সাথী কেউ কেউ হয়। এমন কেউ দুঃখও যার মাঝে সুখ খুঁজে পায়।

হাসলো নূহা আপন মনেই। এরপর বাচ্চাদের রুমের দিকে রওনা দিলো।      

@     

ঘুম ভেঙে যাবার পরও চোখ বন্ধ করে চুপচাপ কান পেতে বিছানায় শুয়ে বাচ্চাদের সাথে রাহাতের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করছিল নূহা। জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় একটি কাজ এই আড়ি পেতে কথা শোনাটা। ছোট থাকতেও যখন বাচ্চাদেরকে উইকএন্ডে দুদিনের জন্য নূহার কাছে আসতো তখনো আড়িপাতার এই কাজটি করতো নূহা। ভোর হতে শুধু দেরি, লাইন ধরে সকালবেলার পাখীর মতো কিচিরমিচির জুড়ে দিতো। একটার পর একটা ফরমান জারি করতে শুরু করতো চার ভাইবোন মিলে। আর বাধ্য পিতার মতো রাহাত সেসব পালন করতো। কোন কোন দিন দেখা যেত চার বাচ্চাকে নিয়ে মিলে নূহার জন্য নাস্তা বানাতে গিয়ে পুরো রান্নাঘরের চেহারাই বদলে দিতো রাহাত। কোনদিন আবার ফজরের নামাজ সেরেই বাচ্চাদের নিয়ে আশেপাশের কোন গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তো নূহা আর রাহাত। প্রকৃতির কোলে বসে বাচ্চাদের নিয়ে জমে উঠতো ব্রেকফার্স্ট পার্টি। অনেকদিন বাচ্চাদের নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেলো নূহার। বাচ্চারা যত বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে সবকিছুই কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। মানসিক দুরুত্ব যাতে কখনোই তৈরি না হয় সেদিকে সবসময়ই খেয়াল রাখে নূহা। কিন্তু বাচ্চাদের পড়াশোনা, নূহার নিজের ব্যস্ততা, জাওয়াদের প্রায়ই বাচ্চাদেরকে নিয়ে এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহের জন্য ভ্রমণে বের হয়ে যাওয়া সবকিছু মিলিয়ে শারীরিক দুরুত্ব যথেষ্টই তৈরি হয়েছে।  

আস্তে বেশি শব্দ করো না তোমাদের মামণির ঘুম ভেঙে যাবে। রাহাতের কথাটা কানে আসতেই নিজের ভাবনাদের ছুটি দিয়ে আবারো আড়ি পেতে কথা শোনাতে মন দিলো নূহা। কিন্তু আর কোন শব্দ বা কথা শুনতে না পেয়ে বেশ অবাক হলো। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে প্রথমে ওয়াশরুমে থেকে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। হলরুমে উঁকি দিয়ে কার্পেটের উপর বসে তিন পুত্রকে গভীর মনোযোগ সহকারে লেগো দিয়ে স্পেসশীপ তৈরিতে ব্যস্ত এবং সোফায় শুয়ে থাকা রাহাতের মাথার কাছে বসে কন্যাকে মনের আনন্দে তার বাবার মাথা টিপে দিতে দেখে চারিদিকে এমন সুনসান নীরবতার কারণ বুঝতে পারলো। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে সবার কর্মকান্ড দেখার পর নূহা হাসি মুখে বলল, আজ কেন সবাই এত বেশি চুপ চুপ, ঝরছে না কেন শব্দরা অবিরাম টুপটুপ? লাগছে না যে ভালো নিশ্চুপ, নীরবতা, চলো না সবে মিলে বলি কিছু টক-মিষ্টি কথা।     

নূহাকে দেখা মাত্রই লেগো ফেলে ছুটে এলো জিশান আর জারিফ। জিহাদ হাসতে হাসতে বলল, মা আমরা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। 

নূহা হেসে বলল, তাই? কিন্তু সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। এতক্ষণ ডাকোনি কেন আমাকে তোমরা?

নাবিহা হেসে বলল, রাতে তোমার ঘুম হয়নি তো সেজন্য বাবা তোমাকে ডাকতে নিষেধ করেছিল  মামণি।

হুম, কিন্তু তোমাদের বাবার কি হয়েছ?

মামণি বাবার মাথা ব্যথা করছে। তাই আমি মাথা টিপে দিচ্ছি। পাপার যখনই মাথা ব্যথা করে তখনো আমি ঠিক এমনি করেই পাপার মাথা টিপে দেই। মাথার সমস্ত ব্যথা আমার দু’হাত দিয়ে টিপে টিপে বাইরে বের করে নিয়ে আসি। এরপর দু’হাত ভর্তি করে ব্যথা পাপার সামনে মেলে ধরি। পাপা তখন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। মাথা ব্যথাও তখন ছুমন্তর হয়ে যায়।

মেয়ের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে ফেললো নূহা। হাসতে হাসতেই বলল, ঠিকআছে তোমার বাবার মাথা ব্যথাও ছুমন্তর করে সবাই মিলে ডাইনিংয়ে এসো। আমি নাস্তা রেডি করছি তোমাদের জন্য।

ডাইনিং রুমে এসে টেবিলে সুন্দর করে নাস্তা সাজানো দেখে বেশ অবাক হলো নূহা। রাহাত পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পেরে ঘুরে তাকিয়ে হেসে বলল, এত সব আয়োজন এত নিঃশব্দে কি করে সংঘটিত হলো?

জগতের বড় বড় কর্মকান্ডের সূচনা নিঃশব্দেই হয়। হাসি মুখে বললো রাহাত।

আচ্ছা তো মিস্টার রাহাত আজকাল ফিলোসফির চর্চা করছেন। হুমম, নট ব্যাড। হাসতে হাসতে বললো নূহা। 

রাহাতও হেসে বলল, আজকের নাস্তায় আমরা পিতা-কন্যা এবং পুত্ররা মিলে আপনার পছন্দের সব মেন্যু রেডি করেছি। কোনটা দিয়ে শুরু করবেন বলেন? অবশ্য মেন্যুতে আরেকটা জিনিস আছে যেটা টেবিলে রাখা হয়নি। 

কি সেটা?

আমার হৃদয়। ঠিক কিভাবে খেতে চাও জানা ছিল না তো তাই তৈরি করতে পারিনি।

কথা বলতে গিয়েও বাচ্চাদেরকে ঢুকতে দেখে থেকে গেলো নূহা। চোখের ভাষায় রাহাতকে তোমার খবর আছে থ্রেট দিয়ে হাসি মুখে বলল, আমার সোনা মোনা বাচ্চাগুলো সকাল থেকে এত কষ্ট করেছে মামণির জন্য?

জান্নাত কি আর এমনি এমনি পাওয়া যায়। জান্নাত পাবার জন্য মানুষকে কষ্ট তো করতেই হয়। তুমিও তো আমাদের জান্নাত মা।

জারিফের খুবই সিরিয়াস ভঙ্গীতে বলা এই কথাগুলো শুনে হেসে ফেললো সবাই। নূহাও হাসতে হাসতে বলল, জারিফ দুষ্টু ছেলে খুব বেশি পাকা পাকা কথা শিখেছো তুমি।

নাবিহা হেসে বলল, মামণি শুধু পাকা পাকা কথাই না দার্শনিক টাইপ কথাও শিখে ফেলেছে জারিফ। জারিফের দুধ বাবা গত রাতে বেশি গরম করে ফেলেছিল। তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা করার জন্য বাবা একটা আইস কিউব দিয়ে দিয়েছিল দুধের ভেতর। বাবা চলে যাবার পর জারিফ আমাকে কি বললো শুনবে?

জারিফ ডানে বামে জোড়ে জোড়ে মাথা নেড়ে বলল, আপ্পি বলো না। মা তাহলে আমাকে পন্ডিত বেবী বলে কান টেনে দেবে।

নূহা হাত বাড়িয়ে জারিফের চুল এলোমেলো করে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা আজকে কান টেনে দেবো না। তুমিই বলো আমাদেরকে কি বলেছিলে আপ্পিকে রাতে।

একটু নড়েচড়ে বসে জারিফ বলল, মা জানো দুধে দেবার পরেই আইস কিউবটা ধীরে ধীরে গলে যেতে শুরু করেছিল। তারপর একসময় একদম মিশে গেলো দুধের সাথে। খুঁজেই পাওয়া গেলো না আইস কিউবটাকে আর। কিন্তু গ্লাসের দুধ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি আপ্পিকে বলেছিলাম, বরফের জীবনটা কত ছোট। গলে গেলেই শেষ। তখন আপ্পি বলেছে, শুধু বরফ না মানুষের জীবনটাও অনেক ছোট। প্রতি মূহুর্তে আমরাও নাকি বরফের মতো একটু একটু করে গলে যাচ্ছি।

রাহাতকে হাসি চেপে চেহারা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে দেখে নূহাও ভেতর থেকে উঠে আসা হাসির জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ দিয়ে বলল, মাশাআল্লাহ তুমি আর তোমার আপ্পি দুজনেরই অনেক সুন্দর শিক্ষা খুঁজে নিয়েছো আইস কিউবের ভেতর থেকে। আসলেই আমাদের জীবনটাও বরফের মতই একটু একটু গলে নিঃশেষ হয়ে যায়। শুধু থেকে যায় আমাদের কাজগুলো। ঠিক যেমন গলে যেতে যেতে বরফ তার কাজ শীতলতা তৈরি করে গিয়েছিল। ঠিক তেমন আমাদেরকে গলে যাবার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। কিন্তু সেজন্য আগে ভালো মতো জানতে হবে আমাদের কাজটাকে। বরফের জীবনের লক্ষ্য শীতলতা তৈরি করা। বলো তো আমাদের জীবনের লক্ষ্যে কি?

জিহাদ বলল, আমি বলবো মা?

নূহা হেসে বলল, হ্যা বলো।

আমাদের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে, আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা।

মাশাআল্লাহ একদম ঠিক বলেছো বাবা। বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে পাশে বসে থাকা জিহাদকে জড়িয়ে ধরে আদর দিলো রাহাত।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা চলো এখন আমরা আগে নাস্তা করি। এরপর ইনশাআল্লাহ গল্প করবো।

সবাই তখন নিজ নিজ পছন্দের খাবার প্লেটে উঠিয়ে নিয়ে নাস্তা করাতে মনোযোগ দিলো।     

@

বাইরে যাবার উদ্দেশ্যে দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই পেছন থেকে নাবিহার ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালো রাহাত। হাসি মুখে বলল, কিছু বলবে মা?

নাবিহা এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়িয়ে বলল, বাবা তুমি তো হসপিটালের ঐদিকেই যাবে তাই না?

হ্যা। কেন?

নাবিহা হাতে ধরে থাকা প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে হেসে বলল, এখানে আমি পাপা আর আদীব্বার জন্য আমাদের বানানো নাস্তা প্যাক করে দিয়েছি। ফোন করে বলেও দিয়েছি যাতে নাস্তা না করে পাপা আর আদীব্বা। তুমি যাবার সময় প্যাকেটটা দিয়ে দিও হসপিটালে প্লিজ।

রাহাত প্যাকেট নিয়ে হেসে বলল, অবশ্যই মা। আমি যাবার সময় তোমার এগুলো তোমার পাপা আর আদীব্বার কাছে পৌঁছে দেবো ইনশাআল্লাহ। আর কিছু মা?

নাবিহা হেসে বলল, আর কিছু না বাবা। জাযাকাল্লাহ।

মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসি মুখে বেড়িয়ে গেলো রাহাত।

দরজা বন্ধ করে নাবিহা হলরুমে উঁকি দিয়ে ভাইদেরকে স্পেসশীপ বানানোতে ব্যস্ত দেখে ওদেরকে বিরক্ত না করে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো।

মেয়েকে দেখে নূহা হেসে বলল, আমি তোমাকে ডাকতে যেতে চাচ্ছিলাম। দুপুরে কি খাবে আজ? জিহাদ, জিশান আর জারিফকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওরা বলেছে তুমি যা খাবে ওরাও তাই খাবে।

নাবিহা গাল ফুলিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল, আমি কিছুই খাবো না আজ। আমার খুব খুব মন খারাপ।

সবজি বের করার জন্য ফ্রীজের দরজায় সবে মাত্র হাত রেখেছিল নূহা। নাবিহার মন খারাপের কথা শুনে ঘুরে ভালো মতো তাকালো মেয়ের দিকে। কাছে এগিয়ে এসে আদুরে গলার বলল, কেন মন খারাপ আমার রাজকুমারীর?

ভাইয়া, জিশান আর জারিফের কত্তো মজা। তিনজন মিলে কত কিছু খেলতে পারে। আর আমি? আমার একটাও বোন নেই। আমার কোন গল্প করার সাথীও নেই।

মাহা, নাবা ওদেরকে ফোন করে আসতে বলবো?

না।

কেন?

আমি যতবার আসবো ততবারই কি সবাইকে নিয়ে আসতে পারবো সাথে করে? তাছাড়া পারলেও আমি বাইরে থেকে কাউকে আনতে চাই না। আমার ঘরেই কোন গল্পের সাথী লাগবে। হয় তুমি আমাকে একটা বোন এনে দাও। নয়তো।

মেয়ের মন খারাপ ভাব এবং বলার ভঙ্গীতে ফুটে ওঠা সিরিয়াস ভাব দেখে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না নূহা। তার উপর কথা বলতে বলতে হঠাৎ নাবিহাকে থেমে যেতে দেখে বলল, নয়তো? নয়তো কি সোনা?

নাবিহা লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল, হয় আমাকে একটা বোন এনে দাও। নয়তো তুমি আমার বন্ধু হয়ে যাও।

এতক্ষণে মেয়ের দুষ্টুমি কিছুটা আঁচ করতে পারলো নূহা। হেসে বলল, একদম তোমার পাপার স্বভাব পেয়েছো তুমি। অকারণে মানুষকে টেনশন দাও।

এগিয়ে এসে নূহাকে জড়িয়ে ধরে আদর দিয়ে নাহিবা বলল, উহু, আমি আমার মামণির মতো হয়েছি। তুমি জানো দাদী আর নানুমণি দিনের মধ্যে তিন-চার বার করে আমাকে বলে যে, একেবারে মায়ের মতো ফাজিল হয়েছিল, একেবারে মায়ের মতো আহ্লাদী হয়েছিস, মায়ের মতো আমাদের জীবনকে ভাজাভাজা করে দিতে এসেছিস। ইত্যাদি ইত্যাদি বলতেই থাকে।

হেসে ফেললো নূহা। নাবিহাও মায়ের সাথে হাসিতে যোগ দিয়ে বলল, আমি যখন কোন কিছু নিয়ে জেদ করি তখন পাপাও বলে।

কি বলেন তোমার পাপা? মুখে হাসি ধরে রেখেই প্রশ্ন করলো নূহা।

নাবিহা হেসে বলল, পাপা বলে, যতই দিন যাচ্ছে একদম মায়ের মতো অবাধ্য এক বালিকাতে পরিণত হচ্ছো তুমি। তোমার মা’র যদি জানাও থাকতো তাকে ডানে যেতে হবে, তবুও শুধুমাত্র আমার অবাধ্যতা করার জন্য সে বাম দিকে ছুট লাগাতো। তুমিও এখন সেই পথের পথিক হবার আয়োজন করছো।

আর তোমার পাপা নিজে কোন পর্বতের সাধু মশাই ছিলেন? অসহ্যকর একজন মানুষ।

না আমার পাপা তো ভীষণ ভীষণ ভীষণ সুইট। প্রতিবাদের কন্ঠে বললো নাবিহা।

নূহা কোমরে হাত রেখে বলল, আচ্ছা? কে বেশি চেনে তোমার পাপাকে? কার অভিজ্ঞতা বেশি?

নাবিহা দুই হাত কোমরের দুই পাশে রেখে বলল, ঠিকআছে চলো কম্পিটিশন হয়ে যাক কে বেশি জানে পাপা সম্পর্কে। আমি তোমাকে ত্রিশটা প্রশ্ন করবো পাপা সম্পর্কে। যদি সঠিক উত্তর দিতে পারো তাহলেই মেনে নেবো তোমার অভিজ্ঞতা বেশি। বলো রাজী?

কিছু না বলে হেসে রান্নাতে মন দিলো নূহা। নাবিহার ইনটেনশন বুঝতে মোটেই কষ্ট হচ্ছিলো না নূহার। বুঝতে পারছিল নাবিহা ওর পাপাকে নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী। বিভিন্ন ভাবে হয়তো অনেক প্রশ্ন জমেছে ওর মনে। সেসবের সঠিক উত্তর শোনার জন্য উদগ্রীব ওর মন। এমন একদিন আসবে সেটা অনেক আগে থেকেই জানতো নূহা। জীবনের অস্বাভাবিকত্ব গুলোকে যত সুন্দর ও মসৃণ করেই পেশ করা হোক না কেন বাচ্চাদের সামনে। তবুও একদিন ওদের আদালতে দাঁড়ানোর ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল নূহা। তবে এত দ্রুত সেই দিনটা চলে আসবে সেটা ভাবতে পারেনি। মেয়ে বলেই হয়তো নাবিহার চিন্তাভাবনা জিহাদ, জিশানের চেয়ে অনেকখানি বেশি এগিয়ে। নূহা নিজেও একটি মেয়ে তাই টিনএজে মেয়েদের মনের স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে সজাগ, সচেতন। এই সময়ে ছোট্ট একটা ভুলও সারা জীবনের জন্য নাবিহার মনে একটি গভীর ক্ষত তৈরি করে দিতে পারে। এলোমেলো, অগোছালো করে দিতে পারে সম্পর্কের সুন্দর বন্ধনগুলোকে। নূহা অবশ্য কখনোই চায়নি সন্তানদের কাউকে আঁধারে রাখতে। একদিন বাচ্চাদের নিয়ে গোল হয়ে বসে জীবনের গল্প বলার দৃশ্যটুকুন সবসময়ই কল্পনাকে ছিল, আছে। অপেক্ষা ছিল শুধু গল্পের অবিশ্বাস্য মোড়টুকুকে বাচ্চাদের বোঝার ও মেনে নেবার মতো জ্ঞান হবার। সেই অপেক্ষায় দিন শেষ হতে চলেছে নাবিহার কথা যেন সেই আভাসই দিয়ে যাচ্ছিলো নূহাকে।

কি হলো মামণি তুমি চুপ হয়ে গেলে কেন? কম্পিটিশন করবে না?

নূহা হেসে বলল, কিছুক্ষণ আগেই না তুমি বললে তোমার বন্ধু হয়ে যেতে?

হ্যা বলেছি। কিন্তু তুমি তো রাজী হওনি।

তোমার বন্ধু হবো না এমনটাও তো বলিনি।

তারমানে আমাদের ফ্রেন্ডশীপ ডান? হাসি ছড়িয়ে পড়লো নাবিহার পুরো চেহারা জুড়ে।

কিন্তু বন্ধুত্বের মাঝে তো নো কম্পিটিশন। তুমি যে আবার কম্পিটিশনে নামতে চাইছো?

নাবিহা হেসে বলল, কম্পটিশন বাদ মামণি। টোট্যলি বাদ। তুমি আমার বন্ধু হলে আমার আর কিছুই লাগবে না।

আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে ফ্রেন্ডশীপ ডান।

আনন্দে চিৎকার করে মামণীকে জড়িয়ে ধরলো নাবিহা। চিৎকার শুনে জিহাদ জিশান আর জারিফ ছুটে এলো। মামণির সাথে বোনের ফ্রেন্ডশীপের কথা জেনে সাথে সাথে তিন ভাইও লাইনে দাঁড়িয়ে গেলো বন্ধুত্বের আর্জি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত চার সন্তানের সাথেই ফ্রেন্ডশীপ করতে হলো নূহাকে। মামণীর সাথে হ্যান্ডশেক সেরেই চারজন ছুট লাগালো তাদের এই বন্ধুত্বের সংবাদ পুরো পরিবারে ছড়িয়ে দেবার জন্য। নূহাও কিছুক্ষণের জন্য বাচ্চাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে রান্নার আয়োজনে মন দিলো।                   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন