রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২৫



লাইব্রেরীতে ঢুকে সামনে তাফসীর খুলে রেখে চোখ বন্ধ করে আফজাল সাহেবকে বসে থাকতে দেখে দুষ্টুমির পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিলো নূহা। অভিজ্ঞতা থেকে জানে এই মূহুর্তে বাপী খুবই সিরিয়াস মুডে আছেন। সবসময় যতটা সিরিয়াস থাকেন তারচেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এখন দুষ্টুমি করতে যাওয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়ালি মারা। ইচ্ছে ছিল ঢুকেই কথার দ্বারা অ্যাটাক করবে বাপীকে। এবং কোন কিছু ঠিক মতো বুঝে ওঠার আগেই আত্মজার ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ার পারমিশন আদায় করে নেবে। কিন্তু আধ্যাত্মিক চিন্তামগ্নতায় নিজের মাঝে ডুব দিয়ে থাকা কারো সাথে দুষ্টুমি করাটা নিশ্চয়ই সঠিক কাজের মধ্যে গণ্য হতে পারে না। তাই নিঃশব্দে চেয়ার টেনে চুপচাপ বাপীর সামনে বসে রইলো নূহা। বেশ অনেকটা সময় পর আফজাল সাহেব বললেন, তুই কি কিছু বলতে এসেছিস?  

নূহা হেসে সালাম দিয়ে বলল, আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরেও তুমি ইচ্ছে করেই ধ্যানমগ্ন হয়ে বসেছিলে এতক্ষণ তাই না?

সালামের জবাব দিতে দিতে চোখ খুললেন আফজাল সাহেব। ধীরে ধীরে বললেন, সাইকোলজি পড়ার সাথে আন্দাজে কথা বলার কি কোন সম্পর্ক আছে? তোর আর আদীর স্বভাবে আন্দাজে কথা বলাটা মহামারী পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কথায় বলে, ঝড়ে বক মরে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে। অন্ধকারে সঠিক নিশানায় একটা ঢিল লেগে গেলেই লাফ দিয়ে আকাশে উঠে যাওয়া ঠিক না বুঝেছিস? আরেকটা ব্যাপারও আমি খেয়াল করেছি।

নূহা হাসি মুখে বলল, সেটা আবার কি?

তোদের কথাবার্তার ভেতর থেকে দিন দিন কুরআন ও হাদীসের উল্লেখ কমে যাচ্ছে। মানেহচ্ছে, কুরআন ও হাদীসের কথাই বলছিস কিন্তু সেটা সাইকোলজির ভাষায়। এটা আমার খুবই অপছন্দ। পার্থিব জ্ঞান যেমন মানুষকে শুধুমাত্র অর্থকরী বিদ্যায় জ্ঞানী করতে পারে। ঠিক তেমনি পার্থিব জ্ঞানের প্রয়োগে মানুষের মনে খানিকটা সময়ের জন্য শান্তি ভাব জাগ্রত করতে পারলেও, সত্যিকার অর্থে আশ্বস্ত করতে পারে না। কি বলা হয়েছে সূরা নাহলের ৪৪ নং আয়াতে?

নূহা বলল, “আগের রসূলদেরকেও আমি উজ্জ্বল নিদর্শন ও কিতাব দিয়ে পাঠিয়েছিলাম এবং এখন এ বাণী তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের সামনে সেই শিক্ষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে যেতে থাকো৷ যা তাদের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে লোকেরা (নিজেরাও) চিন্তা-ভাবনা করে”৷

এখনো জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই ভাবানুবাদ বলতে পারিস তাহলে? মাশাআল্লাহ। আমি তো আরো ভেবেছিলাম যেই হারে সাইকোলজি আর গল্প-উপন্যাসের বই পড়ছিস তাতে ভেতর ফাঁকা হয়ে গিয়েছে প্রকৃত জ্ঞান থেকে।

নূহা বলল, পুরো কুরআনের ভাবানুবাদ সত্যিই মনে নেই। আগের মতো করে বলতেও পারি না। এটা আমার কোট করা আয়াত সমূহের একটি তাই হুবহু বলতে পেরেছি?

বাড়ি থেকে দূরে থাকার কারণেই যে তোর এই অধঃপতন হয়েছে সেটা কি বুঝতে পারছিস? হিফজ কমপ্লিট হয়েছে?

নূহা নাক মুখ কুঁচকে লজ্জিত স্বরে বলল, এখনো না।

এখনো না? বিস্ময় মাখা কন্ঠে প্রশ্ন করলেন আফজাল সাহেব। একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তোর তিন সন্তান হিফজ করেছে আরো দুই বছর আগে। আর তুই কিনা বলছিস এখনো না? তুই তাহলে করিসটা কি? জারিফের কি অবস্থা?

আলহামদুলিল্লাহ ওর লাস্ট পারার সূরা গুলো প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছে?

আফজাল সাহেব চোখ কপালে তুলে বলল, এখনো শেষ পারার সব সূরাই মুখস্ত হয়নি? রাহাত করেটা কি? তোদের অবস্থা তো আমি যতটা ভেবেছিলাম তারচেয়েও নাজুক। জিশান কত বছর বয়সে হিফজ কমপ্লিট করেছিল মনে আছে তোর? আট বছর বয়সে। জিহাদ সাড়ে নয় আর নাবিহা দশ বছরে হিফজ কমপ্লিট করেছিল।জারিফের দশ চলছে। অথচ এখনো শেষ পারাতেই বসে আছে। তুই আমাকে এভাবে নিরাশ করবি এটা আমার চিন্তারও বাইরে ছিল।  

জবাব দেবার মতো কিছুই ছিল না নূহার কাছে। তাই চুপ করে বসে রইলো।

"চিন্তার দিগন্তকে করতে চাইলে সম্প্রসারিত, চিন্তা ও উপলব্ধির সমন্বয়ে কুরআনকে করো পঠিত। অন্ধকার দূরীভূত করে ঘটবে আত্মিক সূর্যোদয়, পাবে শান্তি ও স্বস্থির সন্ধান জীবন হবে আলোকময়।" কে লিখেছে এই কথাগুলো?

ভেতরটা কেমন যেন ভারী হয়ে গিয়েছিল নূহার। খুব আস্তে করে বলল, আমি লিখেছিলাম বাপী।

কেন লিখেছিলি? নিশ্চয়ই আত্মোপলব্ধি থেকেই লিখেছিলি। এখন কোথায় তোর সেই কথা ও কাজে মিল রেখে চলার ব্যাপারে দৃঢ়তা ও সতর্কতা? চুপ করে আসিস কেন? মাথা নীচু করে রেখেছিস কেন? তাকা আমার দিকে।

নূহা চোখ তুলে তাকানোর সাথে সাথে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো আফজাল সাহেবের। এই মেয়েটার চোখের অশ্রুকে অ্যাসিডের মতো মনেহয় সবসময়। সহ্য করা খুব বেশি কষ্টকর। দুনিয়ার কারো চোখের পানি যা করতে পারে না নূহার ছলছল দৃষ্টিই যথেষ্ট আফজাল সাহেবকে নরম করার জন্য। মন সিক্ত হয়ে উঠলেও কন্ঠে বিরক্তি ধরে রেখেই বললেন, কি মুশকিল আবার কান্না করছিস কেন? কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে এমন কান্না করাটাই বা কোথায় শিখেছিস? বাড়ির বাইরে থাকলে এমন আরো কত অধঃপতন যে হবে তোর। আচ্ছা এখন থাক এসব কথা। তোর কথা বল। কি যেন বলতে এসেছিলি?  

নূহা বলল, এখন ইচ্ছে করছে না। আগামীকাল বলবো ইনশাআল্লাহ।

আত্মজার পড়ার ব্যাপারে কিছু নাতো আবার?

হুম।

আচ্ছা যা আত্মজাকে বলে দে ওর যেখানে ইচ্ছে সেখানে ভর্তি হতে। কিন্তু তারআগে তোর এই ভোঁতা মুখ ঠিক কর। একদম দেখতে পারিনা আমি এমন চেহারা।

নূহা অভিমানী কন্ঠে বলল, তুমিই তো মুখ ভোঁতা করতে বাধ্য করেছো আমাকে। আমাকে কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে কতগুলো কথা শোনালে।

সেটা তো যেদিন সবার মুখ মলিন থাকবে সেদিনও যাতে আমার মায়ের এই চাঁদ মুখটা আলোকোজ্জ্বল থাকে সেজন্য বলেছি। আমি আজকাল প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখি বুঝলি মা। দেখি চির শান্তির জান্নাতে অকল্পনীয় সুন্দর এক বাগিচায় হাত ধরাধরি করে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাদের চোখে হাসি কিন্তু মুখে তর্ক। অবশ্য জান্নাতে মনেহয় না মানুষ অকারণে তর্ক-বিতর্ক করবে।

নূহা হেসে ফেললো। আফজাল সাহেবও ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, জান্নাতের বিবরণ পড়ছিলাম। তোর একটা প্রিয় আয়াত ভাবানুবাদ সহ বল শুনি।

একটুক্ষণ চিন্তা করে নূহা সূরা ইউনুসের ৯ ও ১০ নং আয়াত তিলাওয়াত করলো। এরপর বলল, “নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস করেছে এবং ভাল কাজ করেছে তাদের প্রতিপালক তাদের বিশ্বাসের কারনে তাদেরকে পথ প্রদর্শন করবেন, শান্তির উদ্যানসমূহে তাদের (বাসস্থানের) তলদেশ দিয়ে নদীমালা প্রবাহিত থাকবে। সেখানে তাদের বাক্য হবে, ‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা’ (হে আল্লাহ! তুমি মহান পবিত্র)! এবং পরস্পরের অভিবাদন হবে সালাম। আর তাদের শেষ বাক্য হবে, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ (সমস্ত প্রশংসা সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য)"।

আফজাল সাহেব বললেন, সুবহানাআল্লাহ! অন্তরকে প্রশান্তিময় শীতলতায় ভরিয়ে তোলে এই আয়াত দুটি। জান্নাতবাসীরা যে বিমোহিত সুরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কৃতজ্ঞতা জানাবে সেকথাই ফুটে উঠেছে। সকাল থেকে ঘুরে ফিরে বার বার একটি হাদীসই পড়ছি। আবূ সাইদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “মহান প্রভু জান্নাতীদেরকে সম্বোধন করে বলবেন, ‘হে জান্নাতের অধিবাসিগণ!’ তাঁরা উত্তরে বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমি হাযির আছি, যাবতীয় সুখ ও কল্যাণ তোমার হাতে আছে।’ তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছ?’ তাঁরা বলবে, ‘আমাদের কি হয়েছে যে, সন্তুষ্ট হব না? হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো আমাদেরকে সেই জিনিস দান করেছ, যা তোমার কোন সৃষ্টিকে দান করনি।’ তখন তিনি বলবেন, ‘এর চেয়েও উত্তম কিছু তোমাদেরকে দান করব কি?’ তারা বলবে, ‘এর চেয়েও উত্তম বস্তু আর কী হতে পারে?’ মহান প্রভু জবাবে বলবেন, ‘তোমাদের উপর আমার সন্তুষ্টি অনিবার্য করব। তারপর আমি তোমাদের প্রতি কখনো অসন্তুষ্ট হব না।” রবের সন্তুষ্টি আদায়ে প্রাণটা উন্মুখ হয়ে আছে রে মা। দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্রে। কিন্তু নিজের জন্য কোন ফসলই তো এখনো ঘরে তুলতে পারলাম না। থেকে থেকেই তাই মনে কাঁপন উঠে যায়। শেষপর্যন্ত মিলবে তো রবের সন্তুষ্টি?  

শেষপর্যন্ত মিলবে তো রবের সন্তুষ্টি? প্রশ্নটার দিকে চোখ তুলে তাকানোর আগেই বুক কেঁপে উঠলো নূহারও। চলার পথে বার বারই থমকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যের সঠিক দিশাতেই যাচ্ছে কিনা সেটা দেখে নিতে শিখেছিল ছোটবেলাতেই। কিন্তু আজকাল যে সে থমকে দাঁড়াতেই ভুলে যাচ্ছে। চারপাশে ভালো মত খেয়াল না করেই উর্দ্ধশ্বাসে শুধু ছুটছে আর ছুটছে। বাড়ি থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে বড় ঘাটতি এতদিন মনে হয়েছে পরিবার ও সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকাটা। কিন্তু এখন আত্মোপলব্ধি হলো, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ইবাদত। দিন কে দিন হালকা হয়েছে আমলের ভান্ডার। ধারালো না হয়ে ক্রমাগত ভোঁতা হয়েছে আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা। যখন বাড়িতে ছিল প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাপীর সাথে অবশ্যই কিছুক্ষণ কুরআন ও হাদীস বিষয়ক আলোচনা করতো। প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে দশ আয়াত করে পড়া দিতেই হতো জাওয়াদকে। আদরের সময় আদর আর শাসনের সময় শাসন করা স্বভাবের মানুষ জাওয়াদ। তাই ফাঁকি দেবার কোন সুযোগ ছিল না। একদিন আলসেমি করে দশ আয়াতের বদলে পাঁচ আয়াত মুখস্ত করার এমন কথা শুনিয়েছিল। দ্বিতীয়বার কোনদিন আর পড়ায় ফাঁকি দেবার সাহস করেনি নূহা। সূরা কাহাফ পর্যন্ত মেমোরাইজও হয়ে গিয়েছিল জাওয়াদের লেগে থাকার কারণে। কিন্তু এরপর তার জীবনের অন্য আর সবকিছুর মতো আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনে ছুটে চলাটাও থেমে গিয়েছিল।

দুনিয়ার সকল মানুষের মধ্যে কমন জিনিসের একটি হচ্ছে, সবাই স্বপ্ন দেখে। সবাই বুকের মাঝে অনেক স্বপ্ন লালন করে। কিন্তু বেশির ভাগ স্বপ্নই একসময় হারিয়ে যায় জীবন প্রবাহে। আবার কিছু কিছু স্বপ্ন থেকে নিতে হয় স্বেচ্ছা অব্যহতি। তারপরও বেশির ভাগ স্বপ্নই থেকে যায় অপূর্ণ। তবে একটা স্বপ্ন আছে যেটা কখনোই হারিয়ে যাবার সুযোগ নেই। যে স্বপ্ন থেকে অব্যহতি নেবার অবকাশ নেই। যে স্বপ্ন অপুর্ণ হবে কিনা এই চিন্তা থেকে নিরাশ হবারও সুযোগ নেই। সেই স্বপ্নটা কি বল তো মা?

নূহা বলল, আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন আমিও দেখেছি বাপী। এখনো আমারও মনের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন এটিই। এই স্বপ্নটা দেখা থেকে আমার হৃদয় কখনোই নিজেকে বঞ্চিত করেনি। তবে স্বপ্ন পূরণের রসদ সংগ্রহে কখনো বুঝে, কখনো বা না বুঝে অবহেলা অবশ্যই করেছি। সেজন্যই হয়তো স্বপ্নটা এখনো পাপড়ি মেলতে পারেনি, এখনো কলিই রয়ে গিয়েছে। অথচ আমি যাদেরকে দেখে এই স্বপ্নটা দেখতে শিখেছিলাম তারা শুধু আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েই ছেড়ে দেয়নি। বরং নিজেরা উদাহরণ হয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে স্বপ্নকে মনের মাঝে লালন করতে হয়! কিভাবে কলিকে যত্ন করতে হয়, কিভাবে ডানা মেলতে সহায়তা করতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু স্বপ্ন একা একা কখনোই সফলতার দোর গোঁড়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় না। সেজন্য সাথীর প্রয়োজন হয়। আমার স্বপ্নের সাথীরা আমার কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছিল কিংবা আমিই তাদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম বলেই হয়তো আমার স্বপ্নটা আজ যে শুধু দলছুট তাই নয়। ভীষণ রকম মলিনও।  

নূহার হাতের উপর হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে হাসি মুখে আফজাল সাহেব বললেন, ইনশাআল্লাহ সব আবার ঠিক হয়ে যাবে।

বেশ দৃঢ় কন্ঠে নূহা বলল, হ্যা বাপী সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সবাই মিলে সবকিছু আবার ঠিক করে ফেলবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তারআগে তুমি আমাকে ঠিক করবে। যতদিন এখানে আছি প্রতিদিন তিন বেলা আমাকে একবার করে শাসন করবে।

যতদিন এখানে আছিস? তারমানে আবারো চলে যাবি?

নূহা চুপ করে থাকলে আফজাল সাহেবও বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। এরপর বললেন, নায়লার কি করলি শেষপর্যন্ত?

ভাইয়াদের অপছন্দের কথা জানিয়েছি ওকে। আমার অভিজ্ঞতার দ্বারা বোঝাতেও চেষ্টা করেছি। এরপর ভেবে দেখতে বলেছি। এখনো কোন সিদ্ধান্ত জানায়নি।

ওর হাবভাবে কি মনে হলো তোর? মেনে নেবে নাকি ঝামেলা করবে?

একটু আগেই না তুমি আন্দাজে কথা বলা নিয়ে কত কিছু শোনালে আমাকে। আমার ধারণার কথা তাই বলবো না তোমাকে। নায়লা যখন সিদ্ধান্ত জানাবে তখনই একেবারে শুনে নিও।

আফজাল সাহেব হেসে বলল, সাইকোলজি নিয়ে বলাতে কি সাইকো মাস্টারের ইগোতে লেগেছে নাকি? নিজেই চিন্তা করে দেখ আদী আর তুই এই বাড়ির সবচেয়ে দুষ্টু স্বভাবের কিনা! ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলার ওস্তাদ তোরা দুটাই।

মোটেই না। সবচেয়ে দুষ্টু স্বভাবের হচ্ছে উনি। উনি তোমার সামনে অতি ভদ্র ছেলে সেজে থাকেন। আর ইনিয়ে বিনিয়ে কথার তো বিশাল এক ফ্যাক্টরীর সত্ত্বাধিকারী উনি।

উনি উনি করছিস কেন? নাম ধরে ডাক নয়তো ভাইয়া বলে সম্বোধন কর। উনি উনি আবার কি? আর সবার আগে গিয়ে নায়লার সমস্যার সমাধান কর। আজ সকালে দেখেছি নুসরাত আর শরীফা বাগানে বসে ফিসফাস করছে। বাড়ির মহিলারা কোনায় কানায় বসে বসে ফিসফাস করা মোটেই ভালো লক্ষণ না। কিছু একটা পাকাচ্ছে এরা।

নূহা হেসে বলল, তুমি কি ভয় পাচ্ছো ছোট ফুপ্পি আরশের সাথে নায়লার বিয়ের প্রস্তাব দেবেন?

ভয় পাচ্ছি না। প্রস্তাব যে দেবে সেটা আমি শিওর। তিন-চার মাস আগে একদিন কথায় কথায় বলেছিল শরীফা আমাকে এই কথা।

যদি এমনটা হয়ও সমস্যা কি?

সমস্যা আছে। আরশের জন্য আমি অলরেডি মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছি।

প্রথমে বিস্ময় এরপর চেহারায় অভিমান ফুটিয়ে তুলে নূহা বলল, এটা কেমন কথা হলো? তুমি একা একা কিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারো আরশের বিয়ের? আম্মি যখন এই কথাটা জানবে মনে আঘাত পাবে না? নির্ঘাৎ ভেবে নেবে আপন মা নন বলে তুমি উনাকে ছেলের জন্য বৌ পছন্দ করা থেকে বঞ্চিত করছো। এই বয়সে সংসারে এমন অশান্তি টেনে আনার বুদ্ধিটা তোমার মাথায় কিভাবে এলো?

তোর উনি উনি আছে না? তার মাথা থেকে এসেছে।

সেটা আবার কিভাবে?

সেটা আমি বলতে পারবো না। জানতে হলে জাওয়াদের সাথে কথা বলতে হবে তোকে। এখন এসব দুনিয়াবী চিন্তা ভাবনা থেকে লগ আউট করে চল মসজিদে যাই।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, দুনিয়াবী চিন্তা ভাবনা থেকে লগ আউট? ইয়া আল্লাহ! আমার বাপী এসব কি ভাষা বলছে।

আফজাল সাহেবও হেসে বললেন, এসব ভাষাও তোর উনি উনিই শিখিয়েছে আমাকে। ছেলেটা আসলেই বিশাল এক কথার ফ্যাক্টরীর সত্ত্বাধিকারী মাশাআল্লাহ। কিন্তু তুই এখন আমাকে কৈফিয়ত দে মাগরীবের নামাজ কেন মসজিদে পড়িসনি? আশেপাশে কোন মসজিদ নেই বলে বাড়ির বাইরে এত সুন্দর করে একটা মসজিদ তৈরি করলো জাওয়াদ। মহিলাদের জন্য আলাদা নামাজ আদায়ের এত চমৎকার ব্যবস্থা করলো। অথচ বাড়ির কোন একজন সিনিয়র মহিলা নিয়মিত নামাজ আদায় করে না মসজিদে গিয়ে। নাবিহা, কাশফিয়া সহ বাচ্চারা ছাড়া শুধু আত্মজা আর জুয়াইরিয়া নিয়মিত মসজিদে যায়। এই বিষয়টা নিয়েও কথা বলবি তুই সবার সাথে। কিন্তু কোন মুখে বলবি? নিজেই তো যাসনি মাগরিবের সময়।

নূহা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ আর মিস হবে না। তুমি মসজিদে যাও। আমি বাড়ির মহিলাদেরকে নিয়ে আসছি।

তুই যা মহিলাদের সাথে কথা বল। আমি বইগুলো গুছিয়ে রেখে এরপর যাচ্ছি ইনশাআল্লাহ।

নূহা তখন হাসি মুখে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে বাড়ির অন্দর মহলের দিকে রওনা দিলো।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন