রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি... ২০



হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে ঘুরে তাকালো নূহা। খাদিজা বেগমকে দাঁড়ানো দেখে হেসে বলল, ওহ! মা তুমি? আমি আরো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

খাদিজা বেগম বললেন, ভিন গ্রহের এলিয়েনরা স্বাভাবিক মানুষের আনাগোনাতে এমন ঘাবড়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।  

হাসতে হাসতে খাদিজা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো নূহা। খাদিজা বেগমও নূহাকে জড়িয়ে ধরে আদর দিয়ে বলল, এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোকে খুঁজে বের করতে গিয়ে পুরো হসপিটালে এল চক্কর দিতে আসতে হয়েছে আমাকে।

তাই? আই এম সরি। আসলে মাথার ভেতর ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছিলো। কফি নিতে এসেছিলাম। এরপর ইচ্ছে হলো কিছুক্ষণ বাগানে বসতে। কিভাবে যে এক ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি। তুমি কখন এসেছো? একাই এসেছো?

আধ ঘন্টার মতো হবে এসেছি। না তোর মামণিও এসেছে আমার সাথে। তোর বাবার কাছে গিয়ে বসেছে। রিসাবের কাছে শুনলাম তুই হসপিতালে কিন্তু কেবিনে গিয়ে পেলাম না। তাই খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। ভেতরে যাবি নাকি এখানেই বসবি?

বসি আরো কিছুক্ষণ এখানেই। ভালো লাগছে বেশ।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে খাদিজা বেগম বললেন, বিকেলের দিকে ফোন দিয়েছিলাম তোর বাসায়। নুসরাত বললো আদী নাকি বাচ্চাদেরকে তোদের জীবনের গল্প শোনাচ্ছে।

কিছু না বলে খাদিজা বেগমের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে রইলো নূহা। বুকের ভেতর আবারো বেদনার তোলপাড় ঝড় বইতে শুরু করলো খাদিজা বেগমের। এক হাতে জড়িয়ে ধরে নূহাকে আরো কাছে টেনে নিলেন। জাওয়াদকে দেখলে খুব কম সময়ই এমন না চাইতেও চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করে, যেমনটা নূহাকে দেখলে হয়। কখনোই মনেহয় না এখনকার জাওয়াদ  আর আগের জাওয়াদের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কিন্তু আগে যারা দূর থেকে নূহাকে দেখেছে, তারাও বুঝতে পারে অনেক বদলে গিয়েছে নূহা। আর সেই বদলের মাত্রা যে কতটুকু সেটা খাদিজা বেগমের চেয়ে ভালো আর কেউ মনেহয় জানে না। সবসময়ই চঞ্চল, ছটফটে স্বভাবের ছিল নূহা।  কিন্তু জাওয়াদের সাথে বিয়ে পর সেই দুষ্টুমির পরিমাণ এত বেড়েছিল মাঝে মাঝে সত্যি সত্যিই বিরক্ত হয়ে ধমক লাগিয়ে দিতেন নূহাকে। অবশ্য ধমক খেয়ে নূহা চুপ তো হতোই না উল্টো হাসির ঝর্ণাধারা বইয়ে দিতো। কারণে অকারণে সারাক্ষণ এত কথা বলতো, বাধ্য হয়ে কানে হাত চাপা দিয়ে বসে থাকতেন। তারপরও নূহার যা বলার অনর্গল বলেই যেত, বলেই যেত। কিন্তু এই  সবকিছুর উর্দ্ধে ছিল তাদের শ্বাশুড়ি-বৌয়ের আনন্দময় বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক। নূহার সাথে এত মজার সম্পর্ক দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে, খাদিজা বেগমের দুই বান্ধবী নিজেদের বোনের মেয়েকে ছেলের বৌ করে এনেছিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য বান্ধবীদের একজনকে নিজের সিদ্ধান্তের  জন্য বেশ কড়া মাশুলই দিতে হয়েছিল। নিজের দুরাবস্থার জন্য সেই বান্ধবী এখনো খাদিজা বেগমকেই দায়ী করেন। বান্ধবীর কথা মনে হলেই হাসি ফুটে উঠলো খাদিজা বেগমের মুখে। নূহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোর শিরিন আন্টির কথা মনে আছে নূহা? আমার ফ্রেন্ড ছিল। প্রায়ই বাড়িতে আসতো মনেআছে?

বোনের মেয়ে পুত্রবধূ হয়ে এসে যার জীবনের সুখ-শান্তি করায়ত্ত করেছিলো?

হাসতে হাসতে খাদিজা বেগম বললেন, হ্যা। তবে মারিয়ামের বোনের মেয়েটা খুবই ভালো। অন্য আর সব ছেলের বৌয়ের চেয়ে নাকি বোনের মেয়েই সবচেয়ে বেশি সেবাযত্ন করে। কথা হয়েছিল মাস খানেক আগে শিরিন আর মারিয়াম দুজনের সাথেই। ওরা এখনো তোর দুষ্টুমির কথা ভোলেনি। কথা প্রসঙ্গে উঠলেই খুব হাসে তোর কর্মকান্ডের কথা বলে। নূহা মনে আছে তুই বলতি পরিবর্তনশীলতা জীবনের শর্ত। শর্ত পূরণে তাই পরিবর্তনকে স্বাগতম। কিন্তু আমার দুষ্টুমি চলছে, চলবে। কতদিন তুই আগের মতো দুষ্টুমি করিস না বল তো মা? জানিস আমার না খুব ইচ্ছে করে তোর আবোল তাবল কথা শুনতে। বিরক্ত হয়ে কানে হাত চাপা দিতে, তোকে জোড়ে করে একটা ধমক দিতে। জাওয়াদের কাছে তোর নামে বিচার দিতে। তোর নামে বিচার দিলে জাওয়াদ কি বলতো মনেআছে?

অতীত স্মরণে নূহার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলেও যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই চুপ করে বসে  রইলো। খাদিজা বেগমের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। এত দুষ্টু ছিল জাওয়াদ। যখনই নূহার নামে কিছু বলতে যেতেন চোখ বড় বড় করে বিস্ময়ের ভঙ্গীতে বলতো, মা আমি শিওর তোমার চশমার পাওয়ারে কোন সমস্যা হয়েছে। তাই তুমি আমার বৌয়ের চেহারাটা ঠিক মতো দেখতে পাচ্ছো না। প্লিজ তুমি চশমাটা ঠিক করে একবার তাকাও ওর দিকে। এবার বলো তুমি কি সত্যিই চাও এই  ছোট্ট টুনটুনি পাখীটার বিচার করি আমি? আচ্ছা যাও তোমার খুশির জন্য দিলাম ওকে শাস্তি। তুমি ওর কাছে যাও। দুহাতে ওর দু’গাল টেনে ধরে কপালে লম্বা করে একটা আদর দিয়ে দাও। জাওয়াদের শাস্তি শুনে নূহার দুষ্টুমি আরো একটু বাড়তো তখন। বুক চিঁড়ে গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো খাদিজা বেগমের।

নূহা বলল, কেন এভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলছো? তোমাকে না বলেছি যেসব কথা মনে করলে কষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে সেগুলো মনে না করাটাই উত্তম।

আমিও মন খারাপ করা কিছু মনে করতে চাই না। কিন্তু যখন বদলে যাওয়া তোকে দেখি তখন না চাইতেও অতীতের কথা মনে এসেই যায়।

বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে নূহা বলল, মানুষের জীবনটা বইয়ের মতো হলে মন্দ হতো না তাই না মা? পৃষ্ঠা উল্টে পেছনে চলে যাওয়া যেত। আবার প্রথম থেকে শুরু করা যেত। তবে আমি একদম প্রথম থেকে শুরু করতাম না আমার জীবনের। জাওয়াদের আমেরিকাতে মেডিকেল ট্যুরে  যাওয়ার আগের দিন থেকে শুরু করতাম। এবং ভীষণ রকম ঝগড়া করতাম, চিৎকার-চেঁচামেচি  করতাম, জোর জবরদস্তি করতাম। কিন্তু এবার কিছুতেই জাওয়াদকে যেতে দিতাম না আমি।  জাওয়াদ অনেক বিরক্ত হতো আমার উপর, সত্যি সত্যিই হয়তো রাগ করতো, আমিও সেইসব মেয়েদের মতই যারা নিজেদের স্বার্থপরতার কারণে স্বামীকে দ্বীনের পথে চলতে বাঁধা দেয়। এমন আরো অনেক কড়া কড়া কথা শোনাতো। আমি চুপচাপ সব অভিযোগ মেনে নিয়েও অটল থাকতাম উনাকে যেতে না দেবার সিদ্ধান্তে।

নূহাকে আরেকটু শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন খাদিজা বেগম। নিজের মনের কষ্টের কথা কখনোই কাউকে বলে না নূহা। আজ বলছে তারমানে সামাল দিতে পারছে না নিজেকে। নূহার স্বভাব ভালো মতোই জানা আছে। তাই জানেন এখন বোঝাতে গেলে ক্ষেপে যাবে। চুপ করে কারো  পাশে বসে থাকাটাই বেশি পছন্দ করে নূহা। তিনিও তাই চুপ করে বসে রইলেন। কিন্তু মনের ভাবনাদেরকে তো আর চুপ করে কোথাও বসিয়ে রাখা যায় না। ভাবনারা তাই টেনে নিয়ে গেলো অতীতের সেই দিনটিতে, যেদিন একটি ফোন কল সারাজীবনের মতো বদলে দিয়েছিল তাদের সবার জীবনকে।     

জীবনের অন্যান্য সব দিনের মতোই একদম স্বাভাবিক ভাবে শুরু হয়েছিল সেই দিনটিরও। নীচে নেমে ডাইনিং টেবিলে অপরিচিত এক মহিলাকে বসে থাকতে দেখে আপন মনেই খাদিজা বেগম বলে উঠেছিলেন,আজ আবার কাকে ধরে এনেছে এই মেয়ে? নাহ এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। ছোটবেলা থেকেই নূহার এই স্বভাব। বাড়িতে কেউ সাহায্য চাইবার উদ্দেশ্যে আসবে, নূহার সামনে  পড়বে আর নূহা তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে এটা অসম্ভব ব্যাপার। তাকে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসবে, আরাম করে বসে খাওয়াবে, এরপর মন দিয়ে তার সমস্যা শুনবে। তারপর বাড়ির সবার মাথা নষ্ট করবে সেই সমস্যার সমাধান করে দেবার জন্য। এসব ভাবতে ভাবতে  কিচেনে ঢুকে নূহাকে খাবার রেডি করতে দেখে বললেন, ডাইনিং টেবিলে একজন মহিলা বসে আছে দেখলাম। সে কে?  

নূহা মুখ গম্ভীর করে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, সে একজন সাহায্যপ্রার্থীনি মা। সুখী রমণীর শাড়ির সন্ধানে এসেছে।এটা নিয়ে আমি চিন্তায় বিশাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি।

কিসের চিন্তা?

কার শাড়ি দেবো সেই চিন্তা। কার শাড়ি দেই বলো তো মা? তোমার, মামণির নাকি আমার? আচ্ছা কে বেশি সুখী? তুমি, মামণি নাকি আমি?

খাদিজা বেগম হেসে বললেন, তোর শাড়ি দে। তুই বেশি সুখী।

হাসতে হাসতে নূহা বলল, আমারো সেই রকম ধারণা। তোমাকে চা দেবো?

তোকে কিছুই করতে হবে না। চেকআপের জন্য গিয়েছিলি সবকিছু ঠিক আছে তো?

আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু ঠিক আছে।

তাহলে যা উপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নাস্তা পাঠাচ্ছি তোর জন্য।

মহিলাটিকে খাবার দিয়েই যাচ্ছি। আমার এক ক্লাসমিটের গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছে উনি। তুমি না বলেছিলে ছোট খালামনি কাজের লোক খুঁজছেন তাই নিয়ে এসেছি। খুব বিপদে আছে বেচারী।

আচ্ছা দেখবো আমি। তুই মানুষের উপকার করিস খুব ভালো কথা কিন্তু সারাক্ষণ এমন দুষ্টুমি করিস নাতো।  শেষে তোর মতো মহা দুষ্টু নাতি-নাতনি হবে আমার। এক তোর যন্ত্রণাতেই বাড়ির সবাই অস্থির। জাওয়াদ ফোন করেছিলো। তোকেও করেছিলো মোবাইল বন্ধ পেয়েছে। বিরক্ত হয়েছে খুব। যা গিয়ে ফোন কর।

তোমার ছেলের  ফেবরেট হবিই হচ্ছে বিরক্ত হওয়া। কারণে অকারণে সারাক্ষণ বিরক্ত হবার জন্য রেডি থাকেন জনাব। আচ্ছা যাচ্ছি আমি তুমি কথা বলে দেখো মহিলাটির সাথে।

বাইরে সবার সাথে যতই দুষ্টুমি আর ছটফট করুক না কেন রুমে ঢুকলেই মন খারাপ হয়ে যায় নূহার। যেদিকেই তাকায় জাওয়াদের শূন্যতা ঘিরে ধরে মনকে। দুই সপ্তাহের জন্য আমেরিকা গিয়েছিল জাওয়াদ কিন্তু প্রায় একমাস হয়ে গিয়েছে এখনো আসতে পারেননি নানারকম কাজের ঝামেলার কারণে। বেশ কয়েকবার ফোনে ট্রাই করে জাওয়াদকে না পেয়ে বই হাতে বিছানাতে বসলো নূহা। প্রতিমাসেই অনেকগুলো বইয়ের সাথে একটা করে স্পেশাল বইও উপহার দেয় জাওয়াদ নূহাকে। স্পেশাল বইটির নির্দিষ্ট কোন ক্যাটাগরি নেই। সারা মাস নূহার পারফর্মেন্সের উপর নির্ভর করে জাওয়াদের স্পেশাল বইটা কেমন হবে। যেমন কোন মাসে যদি প্যাকেট খুলে লাভ স্টোরি দেখে নূহা বুঝতে পারে পরিবার-পড়াশোনা নিয়ে এত বেশি মশগুল ছিল যে, তেমন করে সময় কাটানোই হয়ে ওঠেনি জাওয়াদের সাথে। প্যাকেট খুলে যদি দেখে ইতিহাস ভিত্তিক কোন বই। তার অর্থ এই মাসে যথেষ্ট উল্টো পাল্টা কাজ করেছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলা হচ্ছে বইয়ের মাধ্যমে। জাওয়াদের কিছু কিছু কান্ড এত বেশি অন্যরকম। যা ভালো লাগার তীব্রতাকে আরেকটু করে বাড়িয়ে যেত নূহার মনে। তবে স্পেশাল বইয়ের টপিকের চেয়েও নূহার কাছে বেশি আকর্ষণীয় প্রতিটি বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাতে তাকে  ঘিরে লেখা জাওয়াদের কবিতা। বই খুলে জাওয়াদের লেখার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। পদধ্বনি শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি বই পাশে রেখে শুয়ে পড়লো বিছানায়।  

নাস্তা নিয়ে রুমে ঢুকে খাদিজা বেগম হাসতে হাসতে বললেন, জন্মের পর থেকে দেখছি তোকে। তুই যে কত বড় অভিনেত্রী খুব ভালো করে জানা আছে আমার। চুপচাপ উঠে নাস্তা করে নে। ওঠ মা অল্প একটু খেয়ে নে নয়তো শরীর আরো দুর্বল লাগবে। এখনি কিন্তু জাওয়াদ ফোন করবে। তুই এখনো নাস্তা করিসনি শুনলে কিন্তু মন খারাপ করবে। আচ্ছা চল আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোকে।

এই প্রস্তাব শুনে হাসি মুখে উঠে বসলো নূহা। কিছুক্ষণ চুপচাপ খেয়ে বলল, আচ্ছা মা আমার জায়গায় যদি অন্য কোন মেয়ে জাওয়াদের বৌ হয়ে আসতো। তখনো কি তুমি এভাবেই আদর যত্ন করতে পুত্রবধূকে? অসুস্থ হলে সেবা করতে? খেতে না চাইলে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে?  

এটা আবার কেমন ধরণের প্রশ্ন?

আমার এক বান্ধবী আছে ওর শ্বাশুড়ির কথা জানার পর থেকে আমার মনে এই প্রশ্নটা ঘুরছে। আমার এত আদর এত যত্ন-আত্তির আসল কারণ কি আমি তোমার বোনের মেয়ে সেজন্য নাকি অন্য কোন মেয়ে তোমার ছেলের বৌ হয়ে এলেও তুমি এভাবেই তার খেয়াল রাখতে?

কেন বাড়ির অন্য বৌদেরকে কি আমি আদর যত্ন করি না?

আমার মতো করো না।

ওরা কি তোর মতো আমার খেয়াল রাখে?

ও আচ্ছা তারমানে যে তোমার খেয়াল রাখবে তুমি শুধু তার খেয়াল রাখবে। এই তো?

এই কথা কখন বললাম আমি? তুই এত প্যাঁচাচ্ছিস কেন ?

তুমি বিরক্ত হচ্ছো কেন? আমি তো জাস্ট জানতে চাচ্ছি সত্যিটা কি। তুমি যখন আমার এত আদর-যত্ন করো তখন আমার কি মনেহয় জানো মা? পৃথিবীর সব শ্বাশুড়িরা যদি পুত্রবধূকে মেয়ে আর পুত্রবধূরা যদি শ্বাশুড়িকে মা মনে করতো তাহলে সম্পর্কের বাঁধন পরিবারে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের কাজ করতো। বাড়ির আঙ্গিনা ভরা থাকতো গোলা ভরা ভালোবাসাতে। আর এই কাজটি আমরা মেয়েরাই শুধু করতে পারি। শ্বাশুড়ি আর পুত্রবধূ  দুজনই তো মেয়ে। আর একজন মানুষকে ঘিরেই তাদের বন্ধন। তাহলে কেন বাঁধে দ্বন্দ্ব? ইনশাআল্লাহ! আমি খুব ভালো শ্বাশুড়ি হবো। আমার ছেলেকে বোনের মেয়ের সাথে বিয়ে দেই আর বাইরে থেকে মেয়ে আনি, উভয়ের সাথে আমার আচরণ সমান হবে ইনশাআল্লাহ।  

খাদিজা বেগম হেসে বললেন, আচ্ছা আগে সে সময় আসুক। এখন খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো পাকনা মেয়ে।

নূহা হেসে বলল, তুমিও খাও। আসো আমিও তোমাকে খাইয়ে দেই। গল্প করতে করতে নাস্তা করলো দুজন। খাদিজা বেগম বেড়িয়ে যেতেই আবার জাওয়াদকে ফোন করলো নূহা। এবারো ফোন করে জাওয়াদকে না পেয়ে ছবি আঁকতে বসলো। এই একটা কাজ ছোটবেলা থেকে এখনো পর্যন্ত সমান প্রিয় নূহার কাছে। জাওয়াদের সাথে বিয়ের আগে ইচ্ছে ছিল পেইন্টার হবার। কিন্তু জাওয়াদ যেদিন বলেছিল, আমি চাই ঘরে-বাইরে সব জায়গায় তুমি আমার সাথে হাতে হাত রেখে চলো। নূহা প্রশ্ন করেছিল, তাহলে কি আমাদের প্রফেশনও এক হওয়া উচিত? জাওয়াদ হেসে জবাব দিয়েছিল, আমি তো সেটাই চাই। এরপর পেইন্টিংকে শখ হিসেবেই রেখে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে নূহা। জাওয়াদ যা কিছু পছন্দ করে, তা যদি নিজের পছন্দের সম্পূর্ণ বিপরীত কিছুও হয়। তবুও সেসব করতে অদ্ভুত এক ধরণের শান্তি পায় নূহা। অন্যেকে খুশি করে যে শান্তি পায় মন, এটাই কি ভালোবাসা? হবে হয়তো। তবে জাওয়াদের মতো মানুষ কাটাকাটি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই নূহার। তার ইচ্ছে বাচ্চাদের ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু তাহলে আবার ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদেরকে কষ্ট পেতে দেখতে হবে। উফফ, আবারো অকারণ ভাবনারা আসতে শুরু করেছে দলে দলে। ভাবনাদের থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে অর্ধেক আঁকা পেইন্টিংয়ের দিকে তাকালো। পেইন্টিংটা দেখিয়ে যখন জাওয়াদের কাছে জানতে চেয়েছিল, কেমন হচ্ছে? কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে জাওয়াদ বলেছিল, মনেহচ্ছে কোন পেইন্ট ফ্যাক্টরীতে বোম ব্লাস্ট হয়েছে। তাই চারিদিকে শুধু রঙ আর রঙ। ঐ সময় রাগ করলেও এখন হেসে ফেললো নূহা। আসলেই রঙের ছড়াছড়ি একটু বেশি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে কথাটা সরাসরি বললেই হতো। কিন্তু জাওয়াদ বলবে সোজা কথা সোজা করে? অসম্ভব। খোঁচাখুঁচি শাস্ত্রে পিএইচডি করা ডক্টর বলে কথা। আবারো জাওয়াদের শূন্যতা জাপটে ধরলো নূহাকে।

শূন্যতাকে হ্রাস করার লক্ষ্যে একটি হাত ধীরে ধীরে পেটের উপর নেমে এলো নূহার। স্বর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা  করলো বেবীদেরকে অনুভব করার। ভালোবাসার আবেশ জড়ানো কণ্ঠে বলল, কেমন আছো সোনামণিরা আমার? আমার মতো তোমাদেরও বুঝি মনখারাপ? মিস করছো পাপাকে? আমিও ভীষণ মিস করছি তোমাদের পাপাকে জানো। তোমরাই বলো খুব বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না এটা? দুই সপ্তাহের কথা বলে এক মাস। অনেক সহ্য করেছি আমি। যথেষ্ট হয়েছে । আজ শুধু ফোন করতে দাও তোমাদের পাপাকে। খুব করে ঝগড়া করবো তার সাথে। আচ্ছা তোমরা কার পক্ষ নেবে, মামণির নাকি পাপার? আমি এখন থেকেই বুঝতে পারছি যে তোমরা পাপার পক্ষই নেবে। পাপা মামণির চেয়ে অনেক বেশি সুইট তাই না? দেখো না মামণি এখনো তোমার জন্য কোন গিফটস কিনিনি। কিন্তু পাপা তোমাদের জন্য কত কিছু  কিনেছেন জানো? গতকাল একঘণ্টা ফ্রী সময় পেয়ে শুধু তোমাদের জন্য শপিং করেছেন। কি খুশি লাগছে জেনে? দেখো তো মামণির পেইন্টিং কেমন হচ্ছে? জানো এটা মামণি তোমাদের পাপার জন্য আঁকছি। তোমাদের পাপার কি ইচ্ছে শুনবে? আমাদের বাড়ির ছাদে ছোট্ট একটা গ্যালারী করা। আর তাতে শুধু তোমাদের পাপা  আর আমার জলরঙে আঁকা ছবি থাকবে। পাপাও যে ছবি আঁকেন নিশ্চয়ই জানা নেই তোমা্দের? ডোন্টওয়ারি  সবার সবকিছু মামণি তোমাদেরকে ধীরে ধীরে জানিয়ে দেবো ইনশাআল্লাহ। আমাদের বাড়ির নাম কি জানো? আনন্দবাড়ি। কিন্তু তোমাদের দাদুমনি বলেন যে এই বাড়ির নেমপ্লেট বদলে রাখা উচিত পাগলাগারদ। দাদুমনি সারাক্ষণ রেগে থাকার ভান করে বুঝলে। কি করবে বল তোমাদের চাচ্চু, ফুপ্পি, খালামনি আর মামারা  সবাই আউট অব কন্ট্রোল টাইপের।

আচ্ছা তো এখন থেকেই আমাদের নামে বদনাম করে কান ভারী করা হচ্ছে বাবুর? কথা শুনে ঘুরে তাকিয়ে  দরজায় তাকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে ঝগড়ার স্টাইলে বোনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নূহা হেসে বলল, রাহা দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো।

রাহা হেসে বলল, না তুমি নীচে চল। সবাই বসে গল্প করছে।  

খুশি মনেই তখন রাহার সাথে পরিবারের সবার সাথে এসে বসেছিল নূহা। পরিবারের সবাই মিলে গল্প করার মুহুর্তগুলো সবসময়ই খুব প্রিয় তার কাছে। কিন্তু সেদিন কেন যেন কোন কিছুতেই প্রাণের ছোঁয়া পাচ্ছিলো না। হয়তো সকাল থেকে বেশ কয়েকবার বার ফোন করেও জাওয়াদের সাথে কথা না হবার কারণে অস্থির ছিল মন। কিংবা হয়তো জীবন যাকে ঘিরে আবর্তিত তার কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ার পুর্বাভাস অবচেতনেই শঙ্কিত করে যাচ্ছিলো নূহাকে বার বার...      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন