রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি... ১৯




নিউজ পেপার নিয়ে বসলেও জাওয়াদের দৃষ্টি নূহার দিকে ছিল। বেবীদের আগমনের বার্তাটি জানার পর থেকেই  নতুন এক নূহার জন্ম হয়েছে যেন। যার জীবনের স্বপ্ন-আশা- আকাঙ্ক্ষা-ভালোবাসা-পরিকল্পনা সবকিছুই এখন অনাগত সন্তানদেরকে ঘিরে ঘুরছে। গত সপ্তাহে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজে ডিজাইন করে নিজ হাতে বানাবে বাবুদের জন্য ড্রেস। এরপর থেকে অন্য সব ভুলে সেই কাজেই ব্যস্ত। এখনো একমনে বাচ্চাদের ড্রেসের ডিজাইন করছে নূহা। চেহারা জুড়ে খেলা করছিল অদ্ভুত এক মায়াবীয়তা। অতি যত্নের সাথে এত আলতো ভাবে ড্রইংবুকে পেন্সিল দ্বারা আঁকছিল, দেখে মনেহচ্ছিলো কোন মা যেন তার মমতা মাখা হাত বুলাচ্ছে অতি আদরের সন্তানের গায়ে। মায়ের হাতের স্পর্শে ছোট্ট শিশুটি হাত-পা ছুঁড়ে আনন্দের ধ্বনি ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। যা দেখে মায়ের ঠোঁটের কোনে এসে বসেছে হাসির প্রজাপতি, চোখের দীঘিতে কম্পন তুলেছে আনন্দাশ্রু। এতদিন শুধু শুনেছিল যে মাতৃত্বের অনুভূতি একটি মেয়েকে আমূল বদলে দেয়। সেই বদলের মাত্রা যে কতখানিক সেটা গত ছয় মাসে নূহাকে দেখে প্রতি মূহুর্তেই একটু করে বুঝতে পেরেছে জাওয়াদ। শুধু তাই নয় একটি সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসাটা যে পরম সৌভাগ্য, প্রাপ্তি, আনন্দ এবং ভালো লাগার সাথে সাথে কত কঠিন একটা কাজ সেটাও খুব ভালো মতো উপলব্ধি করেছে গত ছয় মাসে। নূহার কষ্ট দেখে একেক সময় জাওয়াদের চোখেই ভিজে উঠেছে। প্রথম দু’মাসের প্রায় পুরোটা সময়ই ধরতে গেলে হসপিটালে থাকতে হয়েছে নূহাকে। সলিড কিছু খাওয়া তো দূরে থাক পানি খেলেও সাথে সাথে বমি হয়ে যেত। তারপরও নিজের কষ্টের চেয়ে নূহার বেশি চিন্তা ছিল বাচ্চাদের নিয়ে। একটু পর পরই জাওয়াদকে প্রশ্ন করতো, আমি যে খেতে পারছি না সেজন্য কি আমাদের বাবুরাও না খেয়ে আছে? আচ্ছা ওদের কোন কষ্ট হচ্ছে নাতো? ওরা ঠিক মতো বড় হচ্ছে তো? গত এক মাস ধরে বেশ কিছুক্ষণ বাবুদের নড়াচড়া টের না পেলেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে নূহা। চিন্তিত কন্ঠে জাওয়াদের কাছে এসে বলে, ওরা তো নড়ছে না সেই কক্ষন থেকে। এতক্ষণ ধরে এক ভাবে শুয়ে থাকলে আবার ঝিঁঝিঁ লেগে যাবে নাতো হাতে বা পায়ে? প্রশ্ন শুনে হাসি পেলেও যখন একজন মায়ের তার সন্তানদের ঘিরে উদ্বিগ্নতা ফিল করার চেষ্টা করেছে বুকের ভেতরটা ভার হয়ে এসেছে জাওয়াদের। কত কষ্টই না করতে হয় প্রতিটি মাকে তাদের সন্তানদের জন্য। নূহার সাথে সাথে তাই নিজের মা এবং দুনিয়ার সব মায়েদের প্রতিই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাটাও তাই প্রতিনিয়ত আরো একটু করে বেড়ে চলেছিল জাওয়াদের মনে।  

আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ নূহাকে অবলোকন করে নিউজ পেপার ভাঁজ করে রাখতে রাখতে জাওয়াদ বলল, ইনশাআল্লাহ তোমার বাবুরা খুব বেশি সৌভাগ্যবান হবে।   

ড্রইংবুক থেকে মুখ তুলে নূহা বলল, একথা বলছো কেন?

কারণ ওরা দুনিয়াতে আসার আগেই ওদের মা ওদের জন্য ছোট্ট এক ভুবন সাজিয়ে ফেলছে। যার ডেকোরেশনের ব্যবহার করছে মায়ের মনের সমস্ত স্নেহ-মমতা-আদর-স্বপ্ন-ভালোবাসা।   

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমি সত্যিই আমার মনের আদর-ভালোবাসা দিয়ে ওদের জন্য ভুবন সাজাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু জানি না কতটুকু পারছি বা পারবো। তবে আমাদের বাবুকে স্বাগতম জানানোর জন্য অনেক পরিকল্পনা আছে আমার।

পরিকল্পনা গুলো যদি আমার সাথে একটু আধটু শেয়ার করতে তাহলে আমিও টুকটাক সাহায্য করতে পারতাম তোমাকে। তা না হলে তো তোমার বাবুরা দুনিয়াতে কদম রেখেই নানাধরণের কথা শোনাবে আমাকে। ওদের জন্য আমি কিছুই করিনি, সবকিছু ওদের মা একাই করেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

নূহা হেসে বলল, আজ সকালে কি জেনেছি জানো? শেষের দিকের সময়টাতে শিশুরা সচেতন ভাবে মায়ের কথা শোনে, অনুভব করে। মায়ের কাছ থেকে সমস্ত তথ্য বাচ্চার ডিএনএ লেভেলে চলে যায়। এই তথ্য সত্য হোক বা না হোক বাবুদের সাথে কথা বলার হাজার হাজার টপিক পেয়ে গিয়েছি আমি এটা জানার ফলে। কুরআন-হাদীস-তাফসীর-ইসলামের ইতিহাস-সাহিত্য-জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় অবাধ বিচরণ করবো আমার ছোট্ট বাবুদেরকে সাথে নিয়ে ইনশাআল্লাহ। আইডিয়াটা কেমন বলো তো? 

জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, তুমি সত্যিই পাগলী বুঝলে?

মোটেই পাগলী নই আমি। শোন আমি বাচ্চাদের উপর লেখা বিখ্যাত প্রায় সব বইগুলো ইতিমধ্যেই পড়ে ফেলেছি। জেনেছি সহজাতভাবেই বাচ্চাদের উপর মায়ের প্রভাব বেশি। তাই মা’ই পারে সন্তানদের অনন্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। প্রেগনেন্সির সময় উৎফুল্ল থাকতে হয়, সৎ চিন্তা করতে হয়। আমি যাতে সারাক্ষণ উৎফুল্ল থাকতে পারি এবং ভালো ভালো চিন্তা করতে পারি তার রসদ সংগ্রহের দায়িত্ব তোমাকে দিলাম।  

ইনশাআল্লাহ! আমি চেষ্টা করবো যথাযথ দায়িত্ব পালনের। অনেক সুন্দর হয়েছে বাবুর ড্রেসগুলো। অবশ্য মায়ের মমতার রং আর ভালোবাসার তুলির ছোঁয়ায় আঁকা হয়েছে সুন্দর না হয়ে তো পারেই না।

আলহামদুলিল্লাহ একটা বাণীতে পড়েছিলাম যে, ‘কারো মনে যদি পাপ না থাকে তাহলে বাইরের পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারে না’। আমি দুনিয়াকে থেকে তো পাপকে দূর করতে পারবো না কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করতে চাই আমার সন্তানের মনকে পাপ শূন্য করে গড়ে তুলতে। আর তার বীজ এখনই বপন করতে হবে আমাদেরকে। কারণ চুপটি করে বসে আড়ি পেতে আমাদের সব কথাই শুনছে দুষ্টু বাবুরা।

আমি তো ভয় পাচ্ছি বাবুদেরকে পেয়ে না তুমি আবার আমাকে ভুলে যাও। লক্ষণ দেখে তো তাই মনেহচ্ছে।

তাহলে বলতে হবে তুমি দৃষ্টিবিভ্রাটে আক্রান্ত হয়েছো। স্বামী-স্ত্রীর সম্মিলিত রূপ হয়ে একটি শিশু পৃথিবীতে আসে। এতে তো ভালোবাসা-আকর্ষণ কমার কথা নয় বরং বাড়ার কথা। একটা ম্যাজিকাল ব্যাপার কি জানো? আমরা দুজন কাছে থাকি বা দূরে, কিন্তু আমাদের সন্তানের মধ্যে আমরা সবসময় একাকার হয়ে মিশে থাকবো। পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদেরকে আর আলাদা করতে পারবে না। ধরো কখনো যদি আমাদের ফাটাফাটি কোন ঝগড়া হয়। আমি যদি ব্যাগ গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাই। যাবার সময় তো বাবুদেরকেও সাথে নিয়ে যাবো অবশ্যই। এরফলে কি হবে জানো? ওরা যখন আমার আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করবে, তোমার কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাবে। আর সন্তানরা যেহেতু ভালোবাসার ফলে জীবনে আসে। ওরা তাই ভালোবাসার মূহুর্ত গুলোই মনে করিয়ে দেবে। তখন আমার সব রাগ পানি হয়ে যাবে। আমি তখন এক ছুটে নীচতলা থেকে আবারো দোতলাতে চলে আসবো তোমার কাছে।

জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, এসব ভাবনা তোমার মাথায় আসে কোত্থেকে বলো তো! তোমার বাবুরা তো তোমার ভাবনাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলছে দিন দিন।

আলহামদুলিল্লাহ! বাবুদেরকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু কয়েকদিন আগে নসীম হিজাজীর মরণজয়ী বইটা পড়ার পর থেকে আমার স্বপ্নে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সব স্বপ্নকে ছাপিয়ে আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে এক বীর মুজাহিদের মা হবার স্বপ্ন। তুমি কি অবাক হচ্ছো আমার কথা শুনে?

না। তবে আমার জানতে ইচ্ছে করছে তোমার স্বপ্নটা।

আমিও এখন সাবেরার মতো স্বপ্ন দেখি আমার প্রিয় পুত্র দুশমনের সারি ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে বীর পদভারে। দুশমনের ঘোড়া আর হাতী তার নির্ভীক হামলার সামনে দাঁড়াতে না পেরে আগে আগে সরে যাচ্ছে। আমার নওজোয়ান ছেলে তাদের অনুসরণ করে ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গর্জন মুখর দরিয়ার বুকে। বারবার সে এসে যাচ্ছে দুশমনদের নাগালের ভেতরে। তারপর শেষ পর্যন্ত আঘাতে আঘাতে ক্লান্ত হয়ে কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে নির্বাক হয়ে যাচ্ছে। তারপর জান্নাতের হুরদল শারাবন তহুরার জাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দুজনের প্রতীক্ষায়।

থমকে গেলো জাওয়াদ কিছুক্ষণের জন্য। এমন কিছু শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে। অপলক নির্বাক তাকিয়ে রইলো নূহার দিকে। মনেহচ্ছিলো মুখ না নূহার অন্তর কথা বলছে আজ। চোখের অশ্রুই জানান দিচ্ছে এতক্ষণ যা বলেছে সত্যিই সে এমন স্বপ্ন দেখছে তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে। নূহাকে কাছে টেনে নিয়ে জাওয়াদ বলল, আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমার স্বপ্ন পূরণের পথকে সুগম করে দেন। বীর মুজাহিদ যদি নাও না হয়, তোমার সন্তানরা যেন দুনিয়ার বুকে সত্য, শান্তি ও ভালোবাসার মশালধারী হয়।  

চোখ মুছে নূহা হাসি মূখে বলল, আমিন। আমিও এখন আল্লাহর কাছে এই দোয়াই করি যে, “ওগো যমিন-আসমানের মালিক! মুজাহিদের মায়েরা যখন হাজির হবেন তোমার দরবারে, তখন আমি যেন কারো পেছনে না থাকি। এই বাচ্চাকে তুমি এমন যোগ্যতা দান করো, যেন সে পূর্বপুরুষদের গৌরবময় ঐতিহ্য কায়েম রাখতে পারে।

তুমি আজ আমাকে আবারো মুগ্ধ করে দিলে নূহা। এখনকার যুগের বেশির ভাগ মায়েদের সন্তানকে ঘিরে স্বপ্ন  মানেই হচ্ছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নয়তো বিজ্ঞানী। বীর মুজাহিদ সন্তানের আশা কেউ করে না।

নসীম হিজাজী একটা জায়গায় লিখেছিলেন-“ আপন বাচ্চাকে বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায় যে মায়েরা, সিংহের মোকাবিলা করবার স্বপ্ন তারা কি করে দেখবে? নীড়ের আশেপাশে উড়ে বেড়ায় যেসব পাখী, কি করে পরিচিত হবে তারা আকাশচারী ঈগলের উড়ে বেড়ানোর সাথে!” সত্যিই তো তাই কি করে দেখবে এমন সপ্ন? কি করে পরিচিত হবে মুক্ত আকাশের সাথে?

ঠিক বলেছ। ইনশাআল্লাহ আমরা আমাদের সন্তানদেরকে বিড়ালের ভয় দেখাবো না। নীড়ের পাখী হয়ে না বরং  আমরা ওদেরকে বিশাল বিস্তিত আকাশে মুক্ত ডানা মেলে যাতে উড়ে বেড়াতে পারে সেই শিক্ষা দেবো। শিশুদের  আচার আচরণ ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে পারিপ্বার্শিক পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাব অত্যন্ত বেশি। তাই আমরা যদি বীর মুজাহিদের পিতা-মাতা হতে চাই তাহলে সেই পরিবেশ আগে তৈরি করতে হবে ওদের জন্য।

নূহা বলল, হ্যা পরিবেশ থেকে যদি শিশুরা অন্যের প্রতি দয়া, সুবিবেচনা, শ্রদ্ধা-সম্মান ইত্যাদির বদলে ক্রোধ, অন্যের কথা না মানা, সহিংস আচরণ দেখে, তাহলে তারাও ধীরে ধীরে এসবই রপ্ত করে। তাদের মানসিকতা নেতিবাচক দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এমন যাতে নাহয় সেজন্য আমাদেরকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের সন্তান আমাদের জান্নাত হবে না জাহান্নাম তা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের মৃত্যুর পর যাতে  সাদাকায়ে জারিয়া হতে পারে সেই আলোকে গড়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা আমাদেরকে করতে হবে।

ইনশাআল্লাহ আমরা সেই চেষ্টা অবশ্যই করবো। আজ থেকে আমাদের জীবনের নতুন মিশন হলো এই জান্নাতি ফুলগুলো যাতে আবারো জান্নাতে ফিরে যেতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করা।

ইনশাআল্লাহ। চলো আমরা একসাথে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহর সাহায্য কামনা করি।  ওদের জন্য মন ভরে দোয়া করি। 

নামাজ আদায় করার পরও আরো অনেকক্ষণ দুজন জায়নামাজে বসে রইলো। নূহার চেহারায় হাসি খুশি ভাব দেখে জাওয়াদ বলল, গতরাতে যে তোমাকে আমার আমেরিকা যাবার কথা বলেছিলাম মনে আছে তো?

মূহুর্তেই আঁধারে ঢেকে গেলো নূহার চেহারা। অভিমানী কন্ঠে বলল, গতরাতে আমি তোমাকে কি বলেছিলাম সেটা মনে আছে তো?

নূহা মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য যেতে চাচ্ছি আমি। দুই সপ্তাহ দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

দেখতে দেখতে তোমার হয়তো কাটবে দুই সপ্তাহ কিন্তু আমাদের কাটবে না। তুমি আমাদেরকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছো না। এটাই ফাইনাল কথা।

নূহা প্লীজ বোঝার চেষ্টা করো।

আমি বোঝার চেষ্টা করবো না সেটা তো গতরাতেই বলেছি। আর দম্পতিদের মধ্যে একজন যখন বুঝতে অপারগ থাকে তখন অপরজনকে বুঝতে হয়। তাই তুমি বোঝার চেষ্টা আমি কেন যেতে দিতে চাচ্ছি না তোমাকে।

তুমিই বুঝিয়ে কেন চাচ্ছো না?

আশ্চর্য জাওয়াদ তুমি কিভাবে আমাদেরকে এই সময় একা ফেলে দুই সপ্তাহের জন্য আমেরিকা যেতে চাইছো? আমার কথা নাহয় বাদই দিলাম বাবুরা তোমাকে কতটা মিস করবে সেটা কি তোমার অজানা?

জাওয়াদ হেসে বলল, তুমি তো আছোই ওদের কাছে। আর আমি যখনই সময় পাবো তোমাদেরকে ফোন দেবো ইনশাআল্লাহ।

তুমি চলে গেলে কার তিলাওয়াত শুনে ওদের ভোর হবে? কে নবী-রাসূল, সাহাবা, মুসলিম মনীষীদের গল্প শুনিয়ে ওদেরকে ঘুম পাড়াবে? এমন আরো একশোটা প্রয়োজন আছে তোমার। তুমি কোথাও যাচ্ছো না ব্যাস।  

একটু ক্ষণ চুপ থেকে জাওয়াদ বলল, আমি কেন যেতে চাইছি সেটা তো তোমার অজানা হয় নূহা। তুমি তো এর আগে কখনোই আমার ট্যুরে যাওয়া নিয়ে আপত্তি করোনি। তাহলে এবার কেন এমন অবুঝের মতো আচরণ করছো?

কারণ আমার একটুও ইচ্ছে করছে না তোমাকে যেতে দিতে। প্লীজ তোমার যাওয়াটা ক্যান্সেল করে দাও।

সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে নূহা। আমাকে তাই যেতেই হবে।

যাবার সিদ্ধান্ত তো তুমি নিয়েই নিয়েছো। তাহলে আর শুধু শুধু আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করছো কেন? তাছাড়া এটা তো নতুন কিছু না। সবসময়ই তোমার যেটা করার তুমি করবেই। জিজ্ঞেস করাটা জাস্ট একটা ফর্মালিটি তোমার কাছে। তাই তোমার যেখানে মন চায় চলে যাও।

জাওয়াদ হেসে বলল, আমার ইচ্ছে আর চাওয়া তোমাদেরকে ঘিরেই আবর্তিত নূহা। কিন্তু সেজন্য তো আমি আমার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতে পারি না। তাছাড়া এমন তো নয় যে তুমি আমার ভিশন জানো না! তোমার তো অজানা নয় খুব ছোটবেলা থেকে আমার জীবনের একটাই স্বপ্ন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যেমন মুসলিম বণিক সম্প্রদায়, শাসকবৃন্দ, মুবাল্লিকগণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য, তেমনি করে সভ্যতা থেকে বিছিন্ন মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াহ পৌঁছে দেয়া। আর শুধু স্বপ্নের জন্যই নয় এটা আমার দায়িত্বও নূহা। কারণ সেই যোগ্যতা ও ক্ষমতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে দিয়েছেন। তাছাড়া একথা তো তুমিও জানো একজন মুসলিমের দাওয়াহ থেকে বিরত থাকার কোন সুযোগই নেই। এখনো চুপ করে থাকবে?

আমি তো তোমাকে যেতে বলেছিই। শুধু শুধু এত কথা বলার দরকার কি?

এত কথা বলছি কারণ তুমি খুশি মনে আমাকে যেতে বলোনি। নূহা আমরা দুজন কিন্তু একে অন্যের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, কখনোই দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়াকে আমাদের মাঝে দেয়াল হতে দেবো না। আমাদের কাছে সবসময়, সর্বাবস্থায় আগে আল্লাহর খুশি তারপর নিজেদের ইচ্ছে-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগা। আমরা দুজনই তো মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এই দুনিয়াটা একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র বৈ কিছুই নয়। তাই এখানে আমরা শুধু একে অন্যেকে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হবার জন্য যত রকমের সাহায্য সহযোগীতা করার প্রয়োজন সেজন্য সদা খুশি মনে প্রস্তুত থাকবো। যাতে পরকালের অনন্ত জীবনে আমরা একসাথে থাকতে পারি। জানো যখন থেকে জীবনসঙ্গিনীর প্রয়োজনীয়তা ফিল করেছি জীবনে। সবসময় আল্লাহর কাছে শুধু এমন কাউকেই চেয়েছি যে আমার ভিশন, আমার জীবনের মিশনে পূর্ণ সহযোগী হবে। তোমার সাথে বিয়ের পর গত দুই বছরের অভিজ্ঞতায় আমার উপলব্ধি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমার দোয়া কবুল করে নিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ এত ছোট একটা মানুষ হবার পরও একজন আদর্শ মুসলিম জীবনসঙ্গিনীর সমস্ত গুণ তোমার মধ্যে উপস্থিত।

যেতে তো বলেছিই তোমাকে। এত কথা বলতে হবে না শুধু শুধু।

নূহার অভিমানী কন্ঠ আর চেহারা দেখে হেসে ফেললো জাওয়াদ। হাত বাড়িয়ে নূহাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, যেদিন তোমার একান্ত নিজের করে পেয়েছিলাম সেদিন মনেহয়েছিল, আমি যদি সারাজীবনে কোন উত্তম কাজ করে থাকি যাতে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হয়েছেন। তার পুরষ্কার স্বরূপই মনেহয় তোমাকে পেয়েছি। আমার এমন ভাবনা যদি ভুল হয়ে থাকে সেজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে ক্ষমা করুন। কিন্তু এমনটা ভাবনা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারিনি। দুনিয়ার এই ছোট্ট জীবনে আমি আর কিছুই চাইনা তোমাকে ছাড়া। কেন জানো? কারণ তুমি কাছে থাকলে আমার মন আর কোন কিছুরই অভাব বোধ করে না নিজের জন্য। তোমার মধ্যে আমি পৃথিবীর সব সম্পর্ককে খুঁজে পাই। এমনকি বাচ্চাদেরকেও।

নূহা হেসে বলল, কেন পঁচা কথা বলো?

জাওয়াদ হেসে বলল, আমি সত্যি বলছি। তুমি যখন জেদ করো, অতি সামান্য কারণেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকো, তোমার এই ছোট্ট একটূ চাইনীজ নাকটা টেনে টেনে কান্না করো, নিত্যনতুন দুষ্টুমি করো, হৈচৈ করে বাড়ি মাথায় তোলো। তখন আমার মনেহয় এই বাড়িতে বাচ্চার আর কি দরকার আছে? তুমি একাই তো যথেষ্ট বাড়িকে সরগরম রাখার জন্য।

জাওয়াদকে সরিয়ে দিয়ে নূহা বলল, এত সব আহ্লাদী টাইপ কথা তুমি কেন বলছো সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। তোমার এসব কথা শুনে আমি মোটেই কনভিন্স হইনি। কিন্তু তারপরও খুশি মনেই তোমাকে যাবার পারমিশন দিচ্ছি। কারণ আমি কখনোই চাই না আমার কারণে তোমার কোন স্বপ্ন অপূর্ণ থাকুক। তবে একটা শর্ত আছে।

জাওয়াদ হেসে বলল, বলো তোমার কি শর্ত?

কিছুক্ষণ আগে যে বললে দুনিয়ার এই ছোট্ট জীবনে আমাকে ছাড়া আর কিছুই চাও না তুমি। এই কথাটা উইড্রো করো। এই মূহুর্তে উইড্রো করো। এবং জীবনে আর কখনো কোনদিন এই কথাটা বলবে না।

জাওয়াদ হেসে বলল, উইড্রো করবো? কিন্তু কেন?

বুদ্ধু তুমি জানো না যে মানুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে সেই পরীক্ষা, যেই পরীক্ষা তাকে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসের দ্বারা করা হয়। আমি তাই কখনোই তোমার সবচেয়ে প্রিয় হতে চাই না। আমি তোমার পরীক্ষা হতে চাই না।

জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, অদ্ভুত সব চিন্তা-ভাবনা তোমার।

হোক অদ্ভুত। তোমাকে ঐ কথা উইড্রো করতে বলেছি তুমি উইড্রো করো।

উইড্রো করলে তো মিথ্যা বলা হবে। নিজের কাছে মিথ্যা বলার চেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার খুব কম আছে পৃথিবীতে। কেউ যখন নিজেকে মিথ্যা বলে, অর্থ দাঁড়ায় তার বিবেক মৃত। আর বিবেকহীন মানুষ পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নূহা বলল, ধুর, তোমার সাথে আমি আর কথাই বলবো না। যা ইচ্ছে বলো, যা ইচ্ছে করো তুমি। আমি যাচ্ছি এই রুম থেকে।

দুপদাপ পা ফেলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো নূহা। হাসতে হাসতে জাওয়াদও পিছু নিলো।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন