রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি......১৩




সীট বেল্ট ঠিক মতো বাঁধা আছে কিনা ভালো করে আরেকবার দেখে নাও। এবার সবাই শক্ত হয়ে বসো। প্রথমে কিন্তু প্রচন্ড একটা ঝাঁকি লাগবে স্পেশশীপে। এরপরও মসৃণ গতিতে চলা শুরু হতে আরো কিছুটা সময় লেগে যাবে। তাই ভয়ের কিছু নেই। তৈরি তো তোমরা সবাই অতীত ভ্রমণে যাবার জন্য?

জিহাদ, জিশান, নাবিহা আর জারিফ চারজনই ইয়েস বলে চিৎকার করে উঠলো। হঠাৎ চিৎকার থামিয়ে জারিফ প্রশ্ন করলো, আমরা কি সফরের দোয়া পড়বো আদীব্বা?

আদী হাসি চেপে বলল, অবশ্যই। তোমরা সবাই সফরের দোয়াও পড়ে নাও।

আদীব্বা অতীত ভ্রমণে গেলেও তো আমরা মুসাফির হবো তাই না? বাবা বলেছে মুসাফিরের দোয়া আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সরাসরি কবুল করেন। আমরা কি তাহলে এখন নানাভাইয়ের জন্য দোয়া করতে পারবো? যাতে নানাভাই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান। নানাভাই অসুস্থ হবার পর থেকে মা’র অনেক মন খারাপ। মা’র মন খারাপ থাকলে আমার একটুও ভালো লাগে না।

হাত বাড়িয়ে জারিফকে কাছে টেনে নিলো আদী। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে জিহাদ, জিশান আর নাবিহার দিকে তাকালো। তিনজনই হাসি মুখে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক বড় এবং কঠিন একটা দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছে আজ নূহা আদীকে। বাচ্চাদেরকে তাদের অতীতে ঘটে যাওয়া আনন্দ-বেদনার কাহিনী শোনানোর। ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে, কিভাবে শুরু করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না আদী। কোন রকমের মানসিক কষ্টের স্বীকার যাতে হতে না হয় বাচ্চাদেরকে, কোন ঘটনা থেকে যাতে ভুল কোন তথ্য ঢুকে না যায় ওদের কোমল মনে। সেজন্য সতর্কতার যেমন প্রয়োজন, তেমনি আবার সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে পারাটাও জরুরি।

কি হলো আদীব্বা তুমি এমন চুপ করে বসে আছো কেন? জারিফকে ওর সীটে বসিয়ে দিয়ে স্পেশশীপ স্টার্ট করো।

জিশানের কথা শুনে ভাবনার অতল থেকে বেড়ীয়ে এলো আদী। জারিফকে বসিয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল, আগে বলো তোমরা অতীত ভ্রমণ কোথা থেকে শুরু করতে চাও? তোমাদের পাপার ছোটবেলা থেকে নাকি তোমাদের মা’র ছোটবেলা থেকে?

নাবিহা বলল, পাপার ছোটবেলাতে তো মামণি নেই। আর মামণির ছোটবেলাতে পাপা অল্প অল্প আছে। আমরা অতীত ভ্রমণে এমন কোথাও যেতে চাই যেখানে আমাদের পাপা আর মামণি দুজনই আছে একসাথে।

জিশান বলল, আমিও নাবিহার সাথে একমত। জিহাদ সবসময়ের মতো হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে ভাইবোনকে সমর্থন করলো। জারিফও মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, আপ্পি যা বলবে তাই হবে।

আদী হেসে বলল, আচ্ছা তাহলে আমাদের ভ্রমণ শুরু হলো এখন এই মূহুর্ত থেকে। তাকিয়ে দেখো সামনে গাছপালায় ঘেরা শান্ত-স্বিদ্ধ পরিবেশে আনন্দময় ভঙ্গীতে একটি বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির গেটে যিনি বসে আছেন উনার নাম মোস্তাফিজ। উনি আনন্দময় ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ বাড়িটির কেয়ার টেকার। শুধু নামে না কিন্তু সত্যি সত্যিই বাড়ির প্রতিটা জিনিসের ব্যাপারে উনি সর্বদা সজাগ ও সচেতন থাকেন। বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই উনাকে মোস্তাফিজ চাচা বলে ডাকতো। তাকিয়ে দেখো মোস্তাফিজ চাচার চোখে মুখে আনন্দ ঝিলমিল করছে। গভীর ভাবে যদি অনুভব করার চেষ্টা করো তাহলে উপলব্ধি করতে পারবে বাড়িটির আকাশ বাতাস জুড়েও গুঞ্জরিত হচ্ছে আনন্দ। চারিদিকে এমন আনন্দের ছড়াছড়ির কারণ হচ্ছে, বাড়ির সবচেয়ে আদরের ছোট কন্যার বিয়ের আয়োজন চলছে। কন্যাটির প্রতি বাড়ির সদস্যদের ভালোবাসার প্রচন্ডতা বোঝানোর জন্য একটি বাক্যেই যথেষ্ট। বলা হতো, ঐ পুরো বাড়িটি যদি একটি দেহ হয়, তাহলে সেই দেহের আত্মা হচ্ছে ঐ কন্যাটি।

তারমানে সবার জানের জান, পরাণের পরাণ, কলিজার টুকরো ছিল কন্যাটি। হাসতে হাসতে বললো নাবিহা।

আদীও হেসে বলল, রাইট। কন্যাটির ব্যাপারে আরো বলা হতো আকাশ থেকে যেভাবে তারা ছিটকে পড়ে। ঠিক সেই তারার মতই একদিন ছুটে এসে আনন্দের বোমার মত ঐ বাড়িতে বিস্ফোরিত হয়েছিল কন্যাটি। সাথে করে নিয়েছিল আনন্দের অবিরাম ঝর্ণাধারা। যার আগমনে বদলে গিয়েছিল ঐ বাড়ির প্রতিটি সদস্যের জীবন। যে সবার মনের ভেতর জায়গা করে নিয়েছিল এক টুকরো ভালোবাসা রূপে। যার দখলে ছিল আনন্দ রাজ্যের শত শত বীজ। স্পর্শের ভেতর যাকেই পেত টুক করে বুনে দিত সেই বীজ তার মনে। যে মানুষকে তো অকাতরে ভালোবাসতোই। গাছাপালা-পশুপাখীর প্রতিও তার মমতার কমতি ছিল না। গাছকে শুধু পানিই খেতে দেয়া হয় এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই নিজের দুধের গ্লাস নিয়ে গাছের গোঁড়ায় ঢেলে পরম মমতায় গাছকে খেতে দিতো।যাতে দুধ খেয়ে গাছ তাড়াতাড়ি বড়, মোটাতাজা হতে পারে। খাবারের সন্ধানে পাখীদের ঘুরে বেড়াতে হয় এটা নিয়েও তার দুঃখের শেষ ছিল না। সেজন্য নিজের খাবার নিয়ে পাখীদের দিত। যাতে পাখিদের শক্তি বেড়ে যায়। এবং তারা আরো বেশি উঁচুতে উড়তে পারে।

জিশান হাসতে হাসতে বলল, কন্যাটি তো তাহলে দারুন মজার ছিল।

সাথে ভয়ংকরও ছিল। যেমন তাকে নিয়ে শপিংয়ে যাওয়াটা ছিল এক ভয়াবহ আতংক। নিজের  জন্য কিছু কেনার আগে বাড়ির সবার জন্য তাকে গিফট কিনে দিতে হতো। এমনকি বাড়ির কাজের লোকদের জন্যও। যুক্তি ছিল তা না হলে সবাই মনখারাপ করবে। একবার তো সে আবদার করলো তার ক্লাসের সব বাচ্চাদের জন্যও গিফট কিনে দিতে হবে। না দিয়ে কোন উপায় ছিল না। কারণ চিৎকার করে শপিং সেন্টার ধ্বসিয়ে দিতো তা না হলে। এই ঘটনার পর তাকে শপিংয়ে নেয়াই বন্ধ করে দেয়া হলো। আবার পুরুষ ভিখারী এলে বাড়ির কারো পাঞ্জাবী বা শার্ট, মহিলা ভিখারী শাড়ি, কামিজ দিয়ে দিত। আর বাচ্চা কেউ ভিক্ষা করতে এলে তো পায় কে তাকে। নিজের জামাকাপড়, খেলনা সব দিয়ে দিতো পারলে। স্কুলে টিচার যদি কখনো ক্লাসের কোন স্টুডেন্টকে বকা দিত। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলত, টিচার ও ছোট মানুষ তো একদম বোঝে না। তাই দুষ্টুমি করে ফেলেছে। বড় হলে আর দুষ্টুমি করবে না। ওকে বকা দিবেন না প্লিজ।
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো জিহাদ্ম জিশান, জারিফ আর নাবিহা। আদীও হাসিতে যোগ দিয়ে বলল, সেই কন্যাটির অদ্ভুত সব কান্ডকারখানার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। তবে কন্যাটির কচি কচি হাতের ছোঁয়া ,ছোট্ট ছোট্ট কথা, মিষ্টি হাসি ভরা মুখ, সদা চঞ্চল অভিব্যক্তি সর্বদা চির সজীব ছিল পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মনে। এবার তো নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারছো সেই কন্যার বিয়েতে বাড়ির প্রতিটি সদস্য কতটা এক্সাইটিং ছিল?

জ্বি আদীব্বা আমরা বুঝতে পারছি।

তাহলে চলো এখন আমরা বাড়ির ভেতরে যাই। ডাইনিং টেবিলের সামনে ভ্রূ কুচকে ভীষণ মায়াবী চেহারার যে মহিলাটি দাঁড়িয়ে আছেন। উনার নাম সুরাইয়া। আর টেবিলের উপর ঢাকা পড়ে থাকা খাবার দেখে উনার চেহারায় ওমন বিরক্তির রেখা ফুটে উঠেছে। কারণ ঈশার নামাজ পড়তে যাবার আগে কম করে হলেও দশবার মেয়েকে খেতে আসতে বলেছেন তিনি। এই মেয়েটা একবার বললে কোন একটা কাজ যদি করতো সময় মতো। একসপ্তাহ পর যে মেয়ের বিয়ে তাকে এখনো বলেবলে খাওয়াতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে খাবার নিয়ে মেয়ের রুমে রওনা করলেন তিনি। রুমে ঢুকে মেয়েকে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকতে  থেকে মেজাজ গরম হয়ে গেলো। খাবার ট্রে সজোরে টেবিলে রেখে মেয়ের হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে  বললেন,কয়বার খেতে যেতে বলেছি তোকে? শ্বাশুড়ির হাতে খুন্তির বাড়ি খাওয়ার আগে তোর বইয়ের নেশা  যাবে না বুঝলি। খবরদার হাসবি না। তোর হাসি দেখলে গা জ্বালা করে।

মাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে নূহা বলল,আর বেশিদিন তোমাকে এই গা জ্বালানো হাসি দেখতে হবে না। অতি শিঘ্রীই এই গা জ্বালানো হাসি সহ আমি এই বাড়ি হইতে প্রস্থান করিবো ইনশাআল্লাহ। সেই আনন্দে এখন আমাকে খাইয়ে দেন আপনি।

কান ধরে কিছুক্ষণ ঝাঁকিয়ে মেয়েকে আদর করে খাইয়ে দিলেন মিসেস সুরাইয়া। এরপর বললেন, চুলের এ কি অবস্থা করে রেখেছিস? আয় তোর চুল বেঁধে দিচ্ছি। লক্ষ্মী মেয়ের মতো মেয়ের কাছে গিয়ে বসলো তখন নূহা। কিছুক্ষণ চুপচাপ মেয়ের চুলের যত্ন করার পর মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন,তোর এত লম্বা চুল দেখলে আমাদের জামাই বাবাজ্বি নির্ঘাৎ ফিট খাবে।

একবার বলো তোর চেহারা দেখলে ফিট খাবে,আরেকবার বলো গান শুনলে ফিট খাবে,এখন আবার বলছো চুল দেখলে ফিট খাবে। সে যদি সারাক্ষণ শুধু ফিটই খেতে থাকে তাহলে ঘর সংসার করবে কখন? বলি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আসবে কিভাবে শুনি?

মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেললেন মিসেস সুরাইয়া, তুই তো সাংঘাতিক দুষ্টু হয়েছিস।মাকে এসব বলছিস।

নূহা হেসে বলল, মাকে সব রকম কথাই বলা যায়।  

তোর বাবা বলছে তোদের বিয়ের পর তোকে আর জামাইকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবে। তোরা সবসময় আমাদের সাথে থাকবি।

তারমানে ঘরজামাই? অসম্ভব।

আচ্ছা যা তাহলে আমরা তোদের বাড়িতে গিয়ে থাকবো।

এটা তো আরো অসম্ভব। আমি আর তোমাদের জামাই হবো এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক ক্যাপল ইনশাআল্লাহ। তোমাদের জামাইকে জ্বালা-যন্ত্রণা দেবার হাজার হাজার ফর্মূলা আবিষ্কার করে জমা করে রেখেছি আমি। তোমরা আশেপাশে থাকলে তো তাকে আমি জ্বালা-যন্ত্রণা দিতে পারবো না।

রোম্যান্টিক ক্যাপলরা আবার একে অন্যেকে জ্বালা-যন্ত্রণা দেয় নাকি।

রোম্যান্টিক ক্যাপলরা জগতের অভিনব সব জ্বালা-যন্ত্রণার আবিষ্কারক জননী।

তুই আস্ত একটা পাগলী বুঝছিস? হাসতে হাসতে বললেন মিসেস সুরাইয়া।

হুমম....বুঝেছি। মামণি তোমার কয়টা নাতি-নাতনীর শখ? জানো আমার না অনেকগুলো বাবুর শখ।

কয়টা?

সাতটা। রংধনুর মতো সাত রংয়ের সাতটা বাবু চাই আমি।

সারাক্ষণ তো থাকিস বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে তোর বাচ্চাদের লালন-পালন করবে কে শুনি?

সেটা পরে দেখা যাবে। এখন তুমি আমাকে দোয়া করে দাও যেন আমার শখ পূরণ হয়। মায়ের দোয়াতে স্পেশাল বরকত আছে।

আমার দোয়া সবসময় তোর সাথে আছে। আল্লাহ তোর সব শখ পূরণ করবেন। কেন জানিস? কারণ তুই স্পেশাল।

স্পেশাল মানে?

মানে যেসব জিনিস মানুষের জীবনে কখনো কখনো আসে। যেমন ধর রংধনু।

মাকে জড়িয়ে ধরে নূহা বলল, তোমার উপমাটা অসাধারণ মামনি।

মেয়েকে আদর করতে করতে মিসেস সুরাইয়া বললেন, তুই স্পেশাল কেন জানিস? কারণ তুই এই পৃথিবীতে ভালোবাসার ফলে এসেছিস। তোর বাবা-মামনির অফুরন্ত ভালোবাসার সৃষ্টি তুই। তুই দুনিয়াতে আসার আগেই আমরা দুজন তোর জন্য এমন জীবন প্রার্থনা করেছিলাম যেখানে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসাই থাকবে। তুই যেখানেই যাবি শুধু ভালোবাসাই পাবি। আর এটা তোর বাবা-মামনির দোয়া।

জাযাকিল্লাহ মামনি। আমি একথা সবসময় মনে রাখবো যে আই এম স্পেশাল। আমি ভালোবাসার ফলে সৃষ্টি হয়েছি, আর আমি যেখানেই যাব ভালোবাসা আমাকে নিজেই খুঁজে নিবে ইনশাআল্লাহ।

এখন সত্যি করে একটা কথা বল আমাকে। তুই এতো ছেলে থাকতে ঐ বুড়ো ছেলেকে বিয়ে করার জন্য পাগল হলি কেন?

ছিঃ মামনি কি সব বলছো? উনি বুড়ো হবেন কেন?

ইশ...এখনি এত্ত লাগে। এজন্যই তো জানতে চাইছি কিভাবে কি ঘটলো। আমার সবচেয়ে লক্ষ্মী আর সারাক্ষণ বইয়ের জগতে ডুবে থাকা কন্যাটা তার চেয়ে প্রায় ষোল বছরের বড় ছেলেকে বিয়ে করার জন্য পাগল হলো কেন? দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে থাকা মেয়ের মুখ থেকে টেনে হাত সরিয়ে হাসতে হাসতে মিসেস সুরাইয়া বললেন, জাওয়াদ যেদিন প্রথম বলেছিলো যে তোকে বিয়ে করতে চায় তোর বাবার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গিয়েছিলো।
মামণির হাত সরিয়ে তখন ছুটে পালান দিলো নূহা। মেয়ের এই ভালোবাসা মিশ্রিত লাজুকতা দেখে মিসেস সুরাইয়ার দুচোখ ভরে উঠলো আনন্দ্রাশ্রুতে।   

মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে ছাদে গিয়ে লুকালো নূহা। আশাপাশে কেউ নেই তবুও লজ্জা লাগছিলো তার। বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে পরিবারের সবার মুখে এই একই প্রশ্ন। সবাই ঠোঁটের কোনে চাপা হাসি নিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সমবয়সী কাজিনরা শব্দের প্রয়োগে, কখনো বা বডি ল্যাংগুয়েজের মাধ্যমে প্রশ্ন করে, হাউ ইজ ইট পসিবল? কিভাবে নূহা সবার সেই প্রশ্নের জবাব দিবে,যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর তার নিজেরই জানা নেই ঠিকমতো। বিশাল বড় যৌথ ও ভীষণ রকমের রক্ষণশীল পরিবার তাদের। কাজিনরা সবাই একসাথে ভাইবোনের মতো বড় হলেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত মেলামেশার সুযোগ কখনোই ছিল না। আর জাওয়াদ পরিবারের বড় ছেলে না হলেও নিজ যোগ্যতা, দক্ষতা, বিচক্ষণতা, দায়িত্বশীলতার গুণে হেড অব দ্যা  ফ্যামেলি স্থান জয় করে নিয়েছেন সবার মনে। যে ক’টা  পরিবার নিয়ে তাদের বাড়ি গড়ে উঠেছে কেউই জাওয়াদের উপরে কোন কথা বলেন না। যে কোন ব্যাপারে জাওয়াদের সিদ্ধান্তই সবার কাছে চূড়ান্ত। এর কারণ অবশ্য এই বৈরী পরিবেশে সম্পূর্ণ শরীয়তের আলোকে একটি পরিবার গড়ে তোলার পেছনে জাওয়াদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। দশ বছর আগে একদিন বাড়ির একটা নাম রাখার চিন্তা করছিলেন বড়রা সবাই। নূহার এখনো মনে আছে সেই দিনের কথা। বাড়ির   নাম কি হবে যখন ভাবা হচ্ছিলো জাওয়াদ বলেছিলেন, আমাদের জীবনের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে আছে আনন্দের  নানা  উপকরণ। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে অনেক সময় আমরা দেখতে বা খুঁজে নিতে পারি না সেই আনন্দগুলোকে। অনেক সময় অন্যের অভিজ্ঞতা শুনে উপলব্ধি করি যে, আরে এমন আনন্দের অনেক মুহুর্ত তো আমার জীবনেও প্রায়ই আসে। এই উপলব্ধিটুকু যাতে পরিবারের প্রতিটি সদস্য একে অন্যের মনে জাগিয়ে যেতে পারি সেজন্য আমাদের বাড়ির নাম হবে ‘আনন্দবাড়ি’।  

অতীত স্মরণ নিজের অজান্তেই হাসি ফুটিয়ে তুলল নূহার মুখে। ভালো লাগা তো সবসময়ই ছিল জাওয়াদকে ঘিরে কিন্তু জীবনসাথী হিসেবে ভাবার চিন্তা কখনোই নূহার মনে আসেনি। তাছাড়া জাও্যাদ বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরেই থাকেন। যেটুকু সময় বাড়িতে থাকেন রুটিন মাফিক ছোট ভাইবোনদের খোঁজ খবর নেয়া ছাড়া কারো সাথে কথা বলার সময়ও উনার কখনোই হয় না। তাছাড়া পর্দার বিধান যথাযথ মেনে চলতে চেষ্টা করে পরিবারের সবাই। তাই খুব প্রয়োজন ছাড়া কাজিনরা একে অন্যের সামনে যাওয়া থেকে যথা সম্ভব বিরত থাকে। গত মাসে ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই বড় খালামণি উঠে পড়ে লেগেছিলেন জাওয়াদের বিয়ের জন্য। বিয়ে না করার পেছনে জাওয়াদের আর কোন কোন বাহানাই শোনা হবে না পরিস্কার জানিয়ে  দিলেন। গত পাঁচ বছর থেকে নানা ব্যস্ততার অযুহাত দেখিয়ে পালিয়ে বেড়ানো জাওয়াদ যখন বিয়ে করবে  সম্মতি দিলো। শুরু হয়ে গেলো কন্যা খোঁজার ধুম। তাদের মামণি, খালামণিরা তিন বোন, তিন ফুপি, তাদের বান্ধবীরা মিলে সকালে এক মেয়ে দেখতে যায় তো বিকেলে যায় আরেকজনকে দেখতে। পরিবারের মাদার’স গ্রুপের হিরো জাওয়াদ। তাই কোন মেয়েকেই পছন্দ হচ্ছিলো না মাদার’স গ্রুপের রাজপুত্রের জন্য।

যেদিন জাওয়াদের ছোট বোন সাফার বিয়ে হয়েছিল ভীষণ মন খারাপ ছিল নূহার। তাকেও একদিন তাদের আনন্দবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবতেই চোখ বেয়ে নেমে এসেছিল অঝোর শ্রাবণ। সবার কাঁদতে দেখলে অস্থির হয়ে যাবে কিন্তু কান্নার কারণ শুনলে হাসাহাসি করবে তাই একাকী ছাদে চলে গিয়েছিল নূহা । ছাদে উঠে জাওয়াদকে ছাদে দেখে নেমে যাচ্ছিলো কিন্তু তাকে ডেকে মনখারাপের কারণ জানতে চাইলেন জাওয়াদ। পরিবারকে ছেড়ে চলে যাবার ভাবনাতে খুব বেশি আচ্ছন্ন ছিল বলেই নূহা বলে ফেলেছিল, ভাইয়া আমার ভীষণ  মন খারাপ হয় ভাবলে  আমি কেন এই বাড়ির মেয়ে হয়ে জন্মেছি। কতই না ভালো হতো যদি মেয়ে না হয়ে  আমি এই বাড়ির বৌ হতাম। তাহলে কখনোই আমাকে এই বাড়ি ছেড়ে দূরে যেতে হতো না। যেন এমন কিছু  শোনার অপেক্ষাতেই ছিল জাওয়াদ। তাই এক মুহুর্ত দেরি না করে বললেন, নূহা তোমার কষ্ট দেখে আমি প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করছি অন্তরে। আচ্ছা বলো তো এই বাড়ির বৌ হবার জন্য পাত্র হিসেবে আমাকে তোমার কেমন লাগে? নূহার মনে হয়েছিল হঠাৎ বুঝি কেউ তাকে ভীষণ কোন অরণ্যে একলা ফেলে রেখে চেলে গেল। বাকরুদ্ধ ও বিস্ফোরিত চোখে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এক মুহুর্তের জন্য নূহার চোখে চোখ রেখেছিল জাওয়াদ। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আমি আমার সারাটা জীবন তোমার  সাথে কাটাতে চাই, ইনশাআল্লাহ। তুমিও যদি এমনটা চাও তাহলে আমি পরিবারের সবার সাথে কথা বলবো। এবং সেটা এখনি।      

সময় কিছুটা ক্ষণের জন্য সেখানেই থমকে গিয়েছিল। দুজনই চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর জাওয়াদ যখন জানতে চেয়েছিলেন, আমি কি পরিবারের সবার সাথে কথা বলবো? অস্ফুট স্বরে নূহা শুধু বলেছিল, জ্বী। এরপর কিভাবে যে কি হয়ে গেলো নূহা নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু পরিবারের কেউ এই কথা মানতে রাজী না। বিশেষ করে সমবয়সী ভাইবোনগুলো তো পাগল বানিয়ে ছাড়বে তাকে। এখন আবার মামণিও শুরু করেছে দুষ্টুমি।

আমরাও মানতে রাজী নই। নিশ্চয়ই আরো কোন ঘটনা আছে। কথার মাঝখানে আদীকে থামিয়ে দিয়ে বললো জিশান।

আদী হেসে বলল, যদি আর কোন ঘটনা থেকে থাকে তাহলে সেটাও উন্মোচিত হবে তোমাদের সামনে। এত অস্থির হবার কিছু নেই। কারণ ঘটনার আড়ালে ঘটনা থাকা যেমন স্বাভাবিক। ঠিক তেমনি কিছু ঘটনা কিছুটা সময় পেরিয়ে যাবার পর জানার মাঝেই কল্যাণ। এতে সেই ঘটনা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা তুলে নেয়াটা অনেক সহজ হয়। এখন তাই এই মূহুর্তের ঘটনাতে ফোকাসড করো। আগে কি ঘটেছে, পরে কি ঘটবে ভাবতে গিয়ে বেশির ভাগ মানুষ বর্তমান ঘটনাকে নোটিশ করতেই ভুলে যায়। যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা অর্জনে মাহরুম থেকে যায়। বুঝেছো?

জিশান হেসে বলল, জ্বি আদীব্বা আমি বুঝেছি। চলো কন্টিনিউ করি আমাদের ভ্রমণ।

হ্যা চলো। দেখো ছাদে দাঁড়িয়ে মিষ্টি অতীত স্মৃতিতে কেমন বিমুগ্ধ মনে ভেসে বেড়াচ্ছে নূহা। হঠাৎ কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুরে তাকিয়ে বোনকে দেখে নূহা বলল,প্লীজ আবার একই প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বোস না এখন।           

রাহা হাসতে হাসতে বলল,  আমি প্রশ্নের ঝাঁপি খুলতে আসিনি মাই ডিয়ার সুইট সিস্টার। মা আমাকে পাঠিয়েছেন তোমাকে নীচে নিয়ে যেতে।

একটু পরে যাবো। ভালো লাগছে খুব এখানে। তুমি মুখ টিপে হাসছো কেন?

হাসতে হাসতে রাহা বলল, নূহা তুমি সত্যি জানো না জাওয়াদ ভাইয়া তোমাকে কেন বিয়ে করতে চেয়েছেন?

আশ্চর্য আমি মিথ্যা বলবো কেন?

তাহলে ভাইয়া বিয়ের কথা বলার পর তুমি সামান্যতম আপত্তিও করলে না কেন? আমাদের সকল প্রশ্ন আর সন্দেহের সূত্রপাত এইখানে। তাছাড়া বড় খালামনি যখন জাওয়াদ ভাইয়ার জন্য একটা পাত্রী প্রায় পছন্দ করে ফেলেছিলেন,মনেআছে কতটা আপসেট ছিলে তুমি তখন।  

নূহা লাজুক হেসে বলল, সব মুখস্ত করে এসেছো একদম। ক্লাসের পড়াগুলো এভাবে মুখস্ত করলেই তো আর পরীক্ষায় ডাব্বা পেতে না।

কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। ঘটনা না জেনে আজ আমি তোমাকে ছাড়ছি না।

আমি তোমাকে কি বলবো রাহা, সত্যিই নিজেই বুঝতে পারছি না কিভাবে কি হয়েছে। অস্বীকার করবো না যে বড় খালামনি যখন উনার জন্য মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছিলেন আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু কেন কষ্ট হচ্ছিলো,কেন আমি তোমাদের সবার মতো আনন্দিত হতে পারছিলাম না,শত চেষ্টা করেও বুঝতে পারছিলাম না বলেই আপসেট হয়ে পড়েছিলাম।

তুমি বুঝতে না পারলেও ভাইয়া নিশ্চয়ই পেরেছিলেন।

সেটাও আমি জানি না। উনাকে যে কিছু জিজ্ঞেস করবো সেই সাহসও আমার নেই।

ভাইয়া নিজ থেকে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। তাই না বলার সাহস নেই সেজন্য আবার হ্যা বলোনি তো তুমি?

না তা হবে কেন? এমন তো বলিনি আমি।

আচ্ছা তারমানে তো এই যে তোমারও ভাইয়াকে পছন্দ ছিলো?

বোনের আদরের ঘুষি দিয়ে নূহা বলল, বুঝেছি প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে কথাবার্তা সাজিয়ে এসেছো একদম।

তুমিই তো বাধ্য করছো আমাদেরকে এত সব করতে। আমরা তো শুধু বোন না,একে অন্যের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুও। তাহলে এত লজ্জা পাচ্ছো কেন বলতো?

কিছুক্ষণ নীরবতার পর নূহা বলল, তোমার মনেআছে রাহা বাবা আমাদের সব ভাইবোনদেরকে একবার  বলেছিলেন যার যার স্বপ্নের জীবনসাথী সম্পর্কে লিখতে?
হ্যা মনেআছে। স্বপ্নের জীবনসাথীর কথা লিখে বাবা জমা দিতে বলেছিলেন আমাদের সবাইকে। যাতে যখন আমাদের জীবনসাথী নির্বাচনের সময় আসবে বাবাকে কনফিউজড হতে না হয়। বাবার এই ব্যাপারগুলো সত্যিই খুব মজার।

আমি লিখেছিলাম,আমার জীবনসাথীকে অবশ্যই একজন আদর্শ মুসলিম হতে হবে। সত্যিকার একজন মানুষ হতে হবে। যাকে চোখ বন্ধ করে আশরাফুল মাখলুকাত বলা যায়। যে একজন আদর্শ সন্তান,যেমন সন্তানের স্বপ্ন বাবা-মা’রা দেখেন। পরিবার-পরিজন,আত্মীয়-স্বজন,প্রতিবেশী,বন্ধু-বান্ধবের প্রতি যে যথাসাধ্য  দায়িত্বশীল। যে সম্পর্কের হক আদায়ে সদা সচেষ্ট থাকেন। যার মধ্যে থাকবে মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর চমৎকার সমন্বয়। অর্থাৎ, বিচক্ষণতা,স্থিরতা,ভারসাম্যপুর্ন মেজাজ,পরিশ্রম প্রিয়তা,প্রশস্ত চিত্ততা,ধৈর্যশক্তি,চিন্তার বিশুদ্ধতা, উদারতা,দানশীলতা,দয়া-মায়া-ভালোবাসা ও ক্ষমা করার মানসিকতা এবং উন্নত নৈতিকতা। যার মধ্যে থাকবে নীতিতে অটল থাকার দৃঢ়তা। কোন কিছুর জন্য বা কারো জন্যই যে নীতির সাথে কখনোই কোন কম্প্রোমাইজ করবে না। মোটকথা মানুষ হিসেবে যে নীতিবান ও হৃদয়বান। একজন মানুষ ক্ষতি করলেও যে প্রতিশোধের চিন্তা করে না,যে কারো পেছনে কথা বলা পছন্দ করে না,মনের মধ্যে কথা চেপে ধরে মনকে বিষাক্ত করে না,যে অকাতরে মানুষকে ভালোবাসতে পারে,বাস্তবধর্মী চিন্তা করতে পারে। আমার লেখা পড়ে বাবা মজা করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, নূহা মা এতো কিছু না লিখে তুই শুধু এই কথা লিখলেই পারতি যে, আমার জাওয়াদ ভাইয়ার মতো ছেলে পছন্দ।

আচ্ছা তো আসল প্যাঁচ তাহলে বাবা লাগিয়েছিলেন।  

নূহা হেসে বলল, বাবার কথা শোনার পর আমি ভেবে দেখলাম যে সত্যিই আমার মন যা চায়,যেমন চায় উনি হুবহু সেইরকম। কিন্তু আমি কখনোই আমার মনের এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দেইনি। যে শিক্ষা ছোটবেলা থেকে আমাদেরকে দেয়া হয়েছে আমি তার ব্যতিক্রম কিছু করার কথা চিন্তাও করতে পারি না। বাবা-মা বা পরিবারের কারো মনে কষ্ট তৈরি হতে পারে এমন কোন কাজ আমি কখনোই করতে চাইনি।

হুম, এমন কোন কাজ তুমি চাইলেও করতে পারবে না। কারণ বাবা-মামনির সোনা সোনা মেয়ে বলে কথা। এবার বুঝতে পেরেছি তোমার এতো লাজুকতার কারণ। জাওয়াদ ভাইয়ার সাথে কখনোই কথা হয়নি তোমার এই বিষয়ে?

কখনোই না। সেজন্যই তো কিছুই বুঝতে পারছি না উনি এমন হঠাৎ করে বিয়ের কথা কিভাবে বললেন?

হয়েছে এখন আর এসব ভাবতে হবে না। যাকে তোমার পছন্দ তাকেই তুমি জীবনসাথী হিসেবে পাচ্ছো এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। আর ভাইয়া কেন তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন সে কথা ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করবে এমন সাহস তো আমাদের কারোই নেই। বিয়ের পর তুমিই জিজ্ঞেস করে জেনে নিও,তারপর আমাদেরকে জানিয়ো। ভীষণ কষ্ট হবে কিন্তু আমরা একসপ্তাহ ধৈর্য ধরে থাকবো। এছাড়া যেহেতু উপায়ও নেই কোন। এখন নিচে চলো মা নয়তো আবার টেনশন করবেন।
নূহা হেসে বলল, আচ্ছা চলো নীচে যাই।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন