রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি...২৩




মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকালেন মিসেস সুরাইয়া। জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, আমার ভীষণ কফির তেষ্টা পেয়েছে। সাথে কথা বলার মতো একজন সাথীরও অভাব ফিল করছি। আপনি কি আপনার মহা মূল্যবান সময় থেকে কিছু মূহুর্ত দান করে আমাকে ধন্য করবেন মাদার-ইন-ল?

মিসেস সুরাইয়া হেসে বললেন, কখনোই তুই সোজা কথা সোজা করে বলতে পারিস না তাই না?

জাওয়াদ হেসে বলল, কারণ সোজা কথা সোজা করে বলে খুব কমই মেয়েদেরকে কনভিন্স করা সম্ভব হয়। কারো কথা যত বেশি বাঁকা হয় মেয়েদের কাছে সেটা তত বেশি আকর্ষণীয় হয়।  তাছাড়া প্রবাদও তো এই কথাই বলে যে, রতনে রতন চেনে। বাঁকা স্বভাবের মেয়েরা তেমন বাঁকা কথাতেই মুগ্ধ হয়। উদাহরণ স্বরূপ তুমি এই মূহুর্তের কথাটাই ধরো। আমি যদি এসে বলতাম, চলো মামণি কফি পান করতে করতে দুজন মিলে গল্প করবো। তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত শ্রান্ত কন্ঠে বলতে, একদমই ইচ্ছে করছে না এখন বাবা। কিন্তু এই একই কথাটা একটু ঘুরিয়ে বলার কারণে তোমার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। এভাবেই বিষে বিষ ক্ষয় করে ছেলেদের টিকে থাকতে হয় বুঝলে মামণি।

জাওয়াদকে মেরে মিসেস সুরাইয়া হাসতে হাসতে বললেন, তুই আসলেই যতই দিন যাচ্ছে আরো বেশি দুষ্টু হচ্ছিস।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আমার মা, মামণি, খালামণি আর ফুপিদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যদি আরো দুষ্টু হতে হয় তাতেও কোন আপত্তি নেই আমার। এখন তুমি চলো আমার সাথে।

মিসেস সুরাইয়াকে ধরে উঠতে সাহায্য করলো জাওয়াদ। এরপর দুজন মিলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো। মামণিকে একদমই নীরব দেখে জাওয়াদ বলল, তোমার কি মন খুব বেশি খারাপ আজ? বুঝতে পারছি তুমি বাবাকে খুব মিস করছো আজ। তুমি চাইলে তোমার ভাবনাদের আমার সাথে শেয়ার করতে পারো মামণি।

মিসেস সুরাইয়া বললেন, অনেক বছর ধরেই আমার ভাবনাদের আমি তোর সাথে শেয়ার করতে চাইছি। কিন্তু তুই কখনো সেই সুযোগই দিসনি আমাকে।

জাওয়াদ হেসে বলল, ঠিকআছে আজ দিচ্ছি। তুমি বলো তোমার কথা। আমি শুনবো।

তারআগে বল তুই চলে যাবার পর নূহার জন্য আমরা যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম সেটা কি ভুল ছিল?

ভুল ছিল না বলেই তো আমি কখনোই তোমাদের কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করিনি। তোমাদের সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল নূহার জন্য।

তাহলে তুই আর নূহা কেন মনে কষ্ট পুষে রেখেছিস আমাদের প্রতি?  

তোমাদের প্রতি কোন রকমের কোন কষ্ট আমার মনে আমি লালন করিনা মামণি। নূহাকে যতটুকু জানি এমনটা নূহাও করে না। তুমি যদি গত কয়েকদিন আগের বাবাকে বলা নূহার কথাগুলোকে যুক্তি হিসেবে পেশ করতে চাও। তাহলে বলবো অনেক সময় এমন হয়ে মামণি। যখন নিজের কষ্ট, অপরাগতা কাছে বন্দী মন হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তখন মানুষ একটু শান্তি বা স্বস্থির সন্ধানে অন্যের উপর দায় চাপিয়ে দেয়। নূহার সাথেও ঠিক এমনটাই হয়েছিল ঐদিন। বাচ্চাদের কাছ থেকে দূরে থাকাটা ওর সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। ছোট খালামণি যখন সেখানে আঘাত করেছিল নিজেকে সামলাতে পারেনি নূহা। ঐ আচরণটা যে অপ্রতিরোধ্য রাগ আর আবেগের সংমিশ্রণে করে ফেলেছিল সেটা তো ওর কিছুক্ষণের পরেও আচরণই প্রমাণ করে। তাই এসবকে ইস্যু করে তোমরা অকারণে নিজেদেরর জন্য কষ্ট তৈরি করো না। আমরা সবাই যদিও নিজ নিজ জীবনের সাথে অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছি। কিন্তু মানুষ তো আমরা, যন্ত্র তো নই যে সারাক্ষণ একই রকম আচরণ করে যেতে পারবো। কখনোই আমাদের ভারসাম্য হারাবে না। তাই একজন যদি কোন কারণে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে অন্যদের উচিত তাকে সাহায্য করা। সেটাকে কখনোই ইস্যু করা উচিত না।

কিন্তু এই যে নূহা বাড়ি থেকে চলে গেলো। কয়েক মাস পর পর একটু ক্ষণের জন্য আসে। বাড়ির কোন আনন্দে অংশগ্রহণ করে না। এগুলো কি আমাদের প্রতি নীরব অভিমানের প্রকাশ নয়?

আমি তো বলবো অবশ্যই তা নয়। এসব নূহার অভিমান নয় মামণি, বরং ওর সতর্কতা।  বুদ্ধিমান মানুষ কারা জানো? যারা নিজেদের দুর্বলতা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখে। যারা জানে কনফিডেন্স হচ্ছে সেই আবেগ যা মানুষের অন্তঃচক্ষু উন্মোচন করে। আর ওভার-কনফিডেন্স সেই ভাবাবেগ যা চিন্তা করার স্বাভাবিক ক্ষমতাকেও রুদ্ধ করে ফেলে। তাই তারা নিজের প্রতি ওভার কনফিডেন্টের কারণে কখনোই এমন কোন কিছু করে না, যা তাদেরকে অধঃপতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই পতনের ভয় আছে এমন সব পরিস্থিতি থেকে তারা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে সর্বাত্মক সতর্ক থাকে। মামণি তোমরা সবাই কেন ভুলে যাও যে, আমার আর নূহার বিচ্ছেদ দম্পতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার কারণে হয়নি। আমাদের নিজেদের ইচ্ছেতেও হয়নি। বরং বিচ্ছেদটা আমাদের নিয়তি ছিল। একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা, দুর্বলতা তাই এখনো ঠিক আগের মতোই রয়ে গিয়েছে আমাদের মনে। এবং আমরা দুজনই সেই ভালোবাসা ও দুর্বলতার মাত্রা কতটা গভীর সেই সম্পর্কে অবগত। তাই একে অন্যেকে এড়িয়ে চলা ছাড়া আমাদের কাছে ভিন্ন কোন চয়েজ বা অপশন নেই।

সত্যিই কি তোদের কাছে ভিন্ন কোন চয়েজ বা অপশন ছিল না? নেই?

জাওয়াদ হেসে বলল, আমার অভিজ্ঞতা কি বলে জানো মামণি? অপরাগতা ও অসহায়ত্বের কারণে কোন পরিস্থিতিকে মেনে নেয়াকে ধৈর্য্য বলে না। আপতিত ঘটনা বা দুর্ঘটনাকে পরীক্ষা মনে করে ‘সন্তোষ ভরা মনে’এর মাঝেই কল্যাণ নিহিত আছে এই ‘বিশ্বাসকে’আঁকড়ে ধরাটা ধৈর্য্যের পরিচয় বহন করে। আমি আর নূহা তাই সন্তোষ ভরা মনে আমাদের নিয়তিকে মেনে নেয়াটাকেই উত্তম মনে করেছি। হ্যা তোমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো অপশন ছিল। রাহাতকে আমরা আমাদের মাঝ থেকে সরিয়ে দিতে পারতাম। রাহাত ওর স্বভাব সুলভ চুপচাপ আমাদের মাঝ থেকে সরেও যেত। কিন্তু তাতে আবারো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো নূহার সাথে। মামণি রাহাত আমাদের পরিবারের কেউ কেউ নয় বলেই হয়তো তোমরা সবাই এত সহজে ওকে দূরে সরিয়ে দেবার কথা ভাবতে পেরেছিলে। রাহাতের জায়গায় যদি আদী থাকতো তখনো কি তোমরা এভাবে ভাবতে? তখনো কি ছোট খালামণি এভাবে এগারো বছর ধরে আমাদের সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে যেত? আমি জানি আমার সব প্রশ্নের উত্তর না। যখন দুই ছেলের মধ্যে একজনের সুখকে বেছে নেবার প্রশ্ন উঠতো, তোমাদের রিঅ্যাকশন কখনোই এমন হতো না। তোমরা তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে। এবং আমরা যা সিদ্ধান্ত নিতাম সেটাই চুপচাপ মেনে নিতে। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত তখনো এটাই হতো ইনশাআল্লাহ। কারণ আমার সিদ্ধান্তের মানদণ্ড শরীয়ত নির্ধারণ করে, কে পরিবারের ভেতরের আর কে বাইরের সেটা দ্বারা কখনোই প্রভাবিত হয় না। আমার সবচেয়ে বেশি অবাক লাগে ভাবলে, তোমরা কিভাবে রাহাত আর নূহার ডিভোর্সের চিন্তাভাবনা করেছিলে তখন? এই তথ্য জানা থাকার পরেও যে নূহা জারিফকে কন্সিভ করেছে! গত এগারো বছর ধরে আমি কেন এইসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলেছি জানো?

কেন?

কারণ আমার পরিবারের সদস্যদের আত্নকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার এমন মুখোশ আমার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল। যার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ রূপে অজ্ঞাত ছিলাম। বুঝতে শেখার পর থেকে পাপা, বাবা, চাচ্চুদেরকে একটি আদর্শ পরিবার গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনতে দেখেছি। দাদী মারা যাবার পর দাদাভাইয়ের দ্বিতীয় বিয়ে এবং নতুন দাদীর অত্যাচারে জর্জরিত পাপাদের পাঁচ ভাই আর তিন বোনের কষ্টের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি আমি। ছোটবেলায় আমার স্বপ্নে কখনোই রাক্ষস-খোক্ষস আসেনি ভয় দেখাতে। কিন্তু আমিও দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে জেগে উঠতাম। মা’র কোলের মধ্যে থরথর করে কাঁপতাম। আমার স্বপ্নের সেই ভয়ংকর প্রাণীগুলো কে ছিল জানো? মানুষ। এখনো পর্যন্ত মানুষকেই আমার সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী বলে মনেহয়। কিন্তু ছোটবেলায় তো দুনিয়ার এত অভিজ্ঞতা ছিল না আমার। তাই অবাক হয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতাম, মানুষ কেন মানুষের সাথে যুদ্ধ করে? মানুষ কিভাবে মানুষকে মারে? মানুষ কেন অন্য মানুষের বাড়িতে চুরি করে, মানুষ কেন অন্যে মানুষকে আঘাত দিয়ে আনন্দ পায়? মনের এই প্রশ্নগুলো যেদিন ছোট চাচ্চুকে বলেছিলাম জবাবে চাচ্চু বলেছিলেন, কারণ ওরা মানুষের মতো দেখতে হলেও আসলে মানুষ না। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি শুধু দেখতে মানুষের মতো হবো না। আমি প্রকৃত অর্থে একজন মানুষ হবো। সেই মানুষ যাকে সৃষ্টির সেরা জীবের সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছে। স্কুলে এইম ইন লাইফ লিখতে গিয়েও শরীয়তের আলোকে আলোকিত একটি আদর্শ পরিবার গড়ার স্বপ্ন লিখেছিলাম। এমন একটি পরিবার যাদের কাছে সর্বাবস্থায় জীবন যাপনের একমাত্র মানদণ্ড হবে শরীয়ত। এবং পরিবারের সবার সম্মিলিত ইচ্ছে, চেষ্টা, হাল ছেড়ে না দিয়ে লেগে থাকা, ত্যাগ, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সর্বোপরী আল্লাহর সাহায্যে আমরা সত্যিই একটি আদর্শ পরিবার গড়ে তুলেছিলাম। অন্য রকম একটি পরিবার। প্রতিটি সম্পর্কের বন্ধন যেখানে পারফেক্ট ছিল। পরিবারের প্রত্যেকে যেখানে একে অন্যের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য মুখিয়ে থাকতো। কিন্তু যখন সবকিছু ঠিক থাকে, তখন সঠিক থাকার মাঝে কি খুব বাড়তি কোন কৃতিত্ব আছে?

তুই কি বোঝাতে চাইছিস? আমাদের মধ্যের সমস্ত উত্তম গুণাবলী ইতিবাচক পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে ছিল? মূলত আমরা ভালো মানুষ ছিলাম না?

জাওয়াদ হেসে বলল, কি বলা হয় জানো মামণি? একজন মানুষ আসলেই কতটা ভদ্র, মার্জিত ও শোভন চরিত্রের সেটা বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তাকে সাংঘাতিক ভাবে রাগিয়ে দেয়া। যদি প্রচন্ড রাগের মূহুর্তেও সে মুখের সভ্যতা বজায় রাখতে পারে। তাহলে বলা যায় যে আসলেই সে একজন ভদ্রলোক। ঠিক তেমনি যখন সবকিছু ঠিক থাকে তখন কারো জন্য ত্যাগ স্বীকার করা, কাউকে দান করা এসব খুব বড় কোন ব্যাপার নয়। আত্মত্যাগ হচ্ছে সেটা যেটা করার কথা চিন্তা করার আগেও বুকে কম্পন ওঠে। কিন্তু তোমাদের বুকে কি কম্পন উঠেছিল রাহাতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার আগে? আমি ফিরে এসেছি তাই রাহাতের প্রয়োজন শেষ নূহার জীবনে। এমন চিন্তা করার আগে কি তোমাদের বিবেক বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল? তাহলে কিভাবে হলে তোমরা উত্তম মানুষ? একজন আদর্শ মুসলিম তো স্বজনপ্রীতিতে আক্রান্ত হয়ে উপকারীর অপকারের চিন্তা কখনোই করতে পারে না। তোমরা তাহলে কিভাবে রাহাত আর নূহার বিচ্ছেদের চিন্তা করেছিলে আমাকে খুশি করার জন্য? রাহাত আর আমি উভয়ই তোমাদের একই কন্যার জীবনে অংশ ছিলাম। যার মুখের এক টুকরো হাসি দেখার জন্য আনন্দবাড়ির প্রতিটি সদস্য যে কোন কাজ করতে প্রস্তুত। তাহলে আমার আর রাহাতের মর্যাদার মধ্যে এত পার্থক্য কেন? শুধু কি এজন্য নয় যে আমি তোমাদের ছেলে আর রাহাত বাইরের? তুমিই বলো কিসের ভিত্তিতে আমি বলবো আমাদের পরিবার একটি আদর্শ মুসলিম পরিবার? আমাদের পরিবারের সদস্যরা একেকজন আদর্শ মুসলিম? যে পরিবারের সদস্যরা জীবনে আসা প্রথম জটিল পরীক্ষার সামনেই এমন ভাবে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে। সেই পরিবার আর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আমি অন্তত গর্ব করতে পারিনা। 

কি বলবেন জাওয়াদকে বুঝতে না পেরে চুপ করে বসে রইলেন মিসেস সুরাইয়া।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে জাওয়াদ বলল, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি মামণি। কিন্তু তোমাদের এইসব আচরণ গত এগারো বছর ধরে ভেতরে ভেতরে আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। এত অসাধারণ একেকজন মানুষ তোমরা। তাহলে কেন এই ছোট্ট পরীক্ষাতে এমন করে হার মেনে নিলে? কেন আমাকে দেখার সাথে সাথে তোমাদের কাছে রাহাতকে অপ্রয়োজনীয় পথের কাঁটা মনে হয়েছিল? আমাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত তোমাদের এই ভাবনাটা দিয়েছিল। এবং নূহাকেও। কারণ নূহাকে আমি আমার মনের মতো করে গড়ে তুলেছিলাম। বেদনায় একটু একটু করে ক্ষয়ে যাবে নূহা কিন্তু কখনোই কারো সাথে স্বার্থপর আচরণ করবে না, কখনোই নিজের খুশির জন্য অন্যেকে কষ্ট দেবে না। কখনোই দুনিয়াবী সুখের আশায় আখিরাতের উত্তম প্রতিদান পাবার সুযোগ হাতছাড়া করবে না। কারণ আমার মতো নূহাও জানে এবং বিশ্বাস করে দুনিয়ার জীবনে আমাদের উপর আপতীত দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, বিপদাপদ সবকিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিকল্পনার অংশ। আল্লাহ কখনোই কোন বান্দার উপর তার সাধ্যাতীত বোঝা চাপান না। তাই কারো উপর কোন কষ্ট নেমে আসার অর্থ সেটা বহন করার যোগ্যতা তার রয়েছে। তাই ঘাবড়ে না গিয়ে, দুর্বল না হয়ে তার উচিত আল্লাহ্‌র উপরে ভরসা রাখা এবং ধৈর্য্য ধরে আল্লাহর পরবর্তী সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করা। কারণ ধৈর্য্যহারা হয়ে আসলে কোন লাভ হয় না। উল্টো পরীক্ষায় ব্যর্থ হবার সম্ভাবনাটাই ত্বরান্বিত হয়।

তুই যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতি তাহলে আমরাও এতদিনে সবকিছু স্বাভাবিক বলে মেনে নিতাম?

আমার জীবন কোন দিক দিয়ে অস্বাভাবিক মামণি? শুধুমাত্র দ্বিতীয়বার বিয়ে করিনি বলে আমার জীবন অস্বাভাবিক হয়ে গেলো তোমাদের কাছে? যেখানে আমি আমার বাচ্চাদের নিয়ে সুখী, সেখানে তোমরা কেন কুঁড়ে কুঁড়ে দুঃখ খুঁজে বের করার চেষ্টা করো? আচ্ছা এসব কথা নাহয় বাদ দিলাম। আমি যদি নিয়ে করতেও চাইতাম। কাকে করতাম? যেহেতু আমার সাথে আমার তিন সন্তান ছিল। আমি তো চাইলেই যে কাউকে বিয়ে করতে পারতাম না। যখন আমি একা ছিলাম তখনই পরিবারের বাইরে থেকে কাউকে নিজের জন্য পছন্দ করতে পারিনি। সেখানে ছোট ছোট তিনটা বাচ্চার দায়িত্ব নেবার মতো মেয়ে আমি কোথায় পেতাম? আবার পরিবারের ভেতরেও এমন কেউ ছিল না যাকে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে ভাবা যায়। তারপরও যদি কাউকে বিয়ে করতাম যেহেতু নূহার সাথে আমার ম্যারেড লাইফ দেখেছে। তাই সারাক্ষণই একটা তুলনা কাজ করতো তার ভেতর। এমন আরো অসংখ্য বিষয় ছিল যা আমি চিন্তা করেছি। কিন্তু তোমাদের ভাবনাতে সেসব আসেনি। আসলে সমস্যাটা কোথায় জানো মামণি? মানুষ বড়ই ধারণা স্ববর্স্ব প্রাণী। নিজের ধারণার বিপরীত কিছুতেও যে কেউ ভালো থাকতে পারে, সুখে থাকতে পারে মানুষ সেটা মানতে নারাজ থাকে। তোমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে। তোমাদের ধারণা আমি আর নূহা দুঃখের অতল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই আমাদের জীবনের স্বাভাবিকত্ব মেনে নিতে তোমরা নারাজ। নূহা বাড়ি ছেড়ে গেলো কেন? নূহা বাড়িতে আসে না কেন? নূহা আর আমি দুরুত্ব বজায় রেখে চলি কেন? নূহা মেজাজ দেখালো কেন? নূহার চোখের কোন ভেজা লাগে কেন? নূহা গতরাতে না খেয়ে ঘুমালো কেন? কেন কেন আর কেন? আবার জাওয়াদ বিয়ে করলো না কেন? রাতের বেলা একা একা বাগানে বসে আছে কেন? চোখটা লালচে লাগছে কেন? তারমানে নিশ্চয়ই ঘুমাইনি সারারাত! অথচ এই ব্যাপারগুলো কি বাড়ির অন্যান্যদের ক্ষেত্রেও ঘটে না মাঝে মধ্যে? মানুষ আসলে স্বভাবতই এক্সামিনার টাইপ প্রাণী বুঝলে। খালি প্রশ্ন আর প্রশ্ন সবার  মনে। একেকজন নিজেকে ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান মনে করে। কাউকে শুধু পেলে হয়েছে, ব্যাস  প্রশ্ন করা শুরু। জীবনে আপতীত সমস্যাও আমাদের জন্য ততটা জটিলতা তৈরি করতে পারে না। যতটা জটিলতা মানুষের অকারণ প্রশ্ন আমাদের সমস্যাগুলোকে করে তোলে।

হেসে ফেললেন মিসেস সুরাইয়া। বললেন, আচ্ছা যা মেনে নিলাম তোদের মতো সুখী আর স্বাভাবিক মানুষ পুরো দুনিয়াতে আর কেউ নেই। এখন খুশি তো?

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ দুনিয়ার লাখো কোটি মানুষের তুলনায় সত্যিই তো ভীষণ রকম সুখী আর স্বাভাবিক আমার জীবন। মামণি একথা তো আমি কখনোই অস্বীকার করিনি যে, আমার একদমই কষ্ট হয় না। কিন্তু মানুষ যদি জেনে, বুঝে নিজের কষ্টগুলোকে আপন করে নিতে পারে। তাহলে কষ্টগুলোর পরশেও মন পেখম মেলে ময়ূরীর মতো। চারপাশে ছড়িয়ে দেয় মুগ্ধতা ছোঁয়া সুন্দরতা। কষ্টগুলোই তখন তাদের চলার পথের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। টেনে নিয়ে যায় মূল গন্তব্য পানে। আসলে কষ্ট আমাদেরকে দুঃখী করে না। কষ্টকে মেনে না নেবার ইচ্ছে আমাদেরকে বেদনার চোরাবালিতে আটকে ফেলে। নূহা আর আমি আমাদের জীবনের কষ্টটাকে মেনে নিয়েছি। আমরা বুঝতে পেরেছি একে অন্যের পরীক্ষা হওয়াটাই আমাদের নিয়তি। আমরা তাই নিজ নিজ পরীক্ষাতে মনোনিবেশ করেছি। হ্যা কিছু কিছু সময়ে আমরা একটু অস্বাভাবিক আচরণ করি সবার সাথে। সেটা মানুষের স্বভাব সুলভ দুর্বলতার প্রভাব। তাছাড়া দুর্বল হতে কোন দোষ নেই, দুর্বলতার প্রভাবে প্রভাবিত হওয়াটা দোষের। আমরা একে অন্যেকে এড়িয়ে চলি এটাও ঠিক। এর সবচেয়ে বড় কারণ শরীয়তের বিধান। আমরা একে অন্যের মাহরাম নই। তাই অপ্রয়োজনীয় সাক্ষাৎ, কথাবার্তা এড়িয়ে তো চলতেই হবে। এরপর যেটা বাকি থাকে সেটা হচ্ছে নূহা কেন বাড়িতে আসে না। এরজন্য তোমরা সবাই দায়ী। বাড়িতে এলে একটা মূহুর্ত শান্তিতে বসতে দাও না তোমরা মেয়েটাকে। তোমাদের কারো কান্না শুরু হয়, কারো অভিযোগ শুরু হয়, কারো দীর্ঘশ্বাস শুরু হয়। তোমরা যদি স্বাভাবিক আচরণ করতে তাহলে নূহাকে পরিবার থাকতেও এমন একাকীত্বের জীবন যাপন করতে হতো না। মামণি প্রতিটি সমস্যার সাথে তার সমাধানও থাকে। কিন্তু সমস্যাকে আমরা এমন গোলকধাঁধায় পরিণত করি যে সমাধান পথই খুঁজে পায় না আমাদের কাছে আসার। তাই বেরিয়ে এসো নিজেদের তৈরি করা গোলকধাঁধা থেকে।

এসব কথা তাহলে এত বছর বলিসনি কেন আমাদেরকে?

কারণ তোমরা কেউ বলার সুযোগ দাওনি। আর আমি জোড় করে বোঝাতে গেলে তোমরা পাত্তা দিতে না। ঐ যে বললাম নিজ নিজ ধারণার জাল। মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার সমূহের একটি এটাও, তারা শুধু যে নিজে স্বার্থের বাইরে চিন্তা করতে পারে না তাই নয়। অন্য কারো স্বার্থহীন আত্মত্যাগের সিদ্ধান্তকেও স্বীকৃতি বা মর্যাদা দিতে পারে না যথাযথ।  

হুম, আমারো এখন তাই মনেহচ্ছে। আসলেই আমাদের কারণেই নূহা বাড়িতে আসে না। আমরা তিনবোন লেগেই থাকি ওর পিছনে। রাহাতের ব্যাপারেও আমাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তাই তো  আমরা কিভাবে ঐ রকম স্বার্থপর চিন্তা করতে পেরেছিলাম? রাহাত নিজ ইচ্ছেয় রাজী হয়েছিল নূহাকে বিয়ে করার জন্য। রাহাত যাতে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় সেজন্য কত অদ্ভুত অদ্ভুত শর্ত ওর সামনে রেখেছিল নূহা। আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম যখন রাহাত নূহাকে বলেছিল, সমস্ত শর্ত সহ আমি আপনাকে কবুল করছি। ছয় মাস রাহাতকে কি পরিমাণ যন্ত্রণা নূহা করেছে সেটাও তো আমাদের অজানা ছিল না। কিন্তু চুপচাপ সবকিছু মেনে নিয়েছে রাহাত। আমাদের কাছেও কখনো অভিযোগ করে কিছু বলেনি। কতটা ভালো হবার কারণে নূহা রাহাতকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছিল সেটা তো তোকে অন্তত বুঝিয়ে বলার দরকার নেই।

হুম, আমি জানি। আমাদের সংগঠনের সবচেয়ে অসাধারণ কর্মীদের একজন ছিল রাহাত। আল্লাহ আমাকে তাওফীক দিয়েছিলেন রাহাতের দুঃসময়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর। এর বদলে রাহাতকে আমি সবসময় একজন কৃতজ্ঞ মানুষ হিসেবেই পেয়েছি। তাই মোটেই অবাক হইনি রাহাতের নিজ ইচ্ছেয় নূহাকে বিয়ে করতে চাওয়াতে।

হ্যা অনেক ভালোবাসে তোকে রাহাত। তোর প্রতি রাহাতের ভালোবাসা সম্পর্কে অবগত ছিলাম বলেই আমরা সাহস করেছিলাম নূহার সাথে বিয়ে দিতে। তাছাড়া রাহাতের বাবা-মা ছিল না, অন্য কোন পিছু টান ছিল না। আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবে, নূহাও জেদ ধরে বসে ছিল পরিবারের কাউকে বিয়ে করবে না। সবকিছু মিলিয়ে রাহাতকেই তাই পারফেক্ট মনে হয়েছিল।

আলহামদুলিল্লাহ রাহাত এখনো পার্ফেক্ট নূহার জন্য। মামণি সবকিছুই পার্ফেক্ট আছে। শুধু তোমাদের চিন্তা ভাবনাগুলো ভুল ছিল।

বাবা-মায়েরা কখনো কখনো সন্তানদের সুখের কথা ভেবে এমন স্বার্থপর হয়ে ওঠে। তুই নিজেও তো বাবা। তোর তো বোঝা উচিত।

বুঝি বলেই তো চুপ করে থাকি। আজ তোমার সাথে অনেক কঠিন করে কথা বলে ফেলেছি মামণি। সেজন্য মাফ করে দাও। কিন্তু ঐভাবে না বললে তুমি চুপ করে শুনতে না আমার কথা। উল্টো যুক্তি দিতে। তোমাদের সাথে আমাদের চিন্তার মূল পার্থক্যটা কোথায় হয়েছে জানো?

কোথায়?

আমার আর নূহার সম্পুর্ণ ফোকাস ছিল আমাদের সন্তানদের উপর। আর তোমাদের ফোকাস ছিল তোমাদের সন্তানদের উপর। তোমরা চেয়েছো যেভাবেই হোক নূহা আর আমাকে সুখী করতে। আর আমরা কোনভাবেই যাতে আমাদের সন্তানদের উপর কোন নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছি। তবে বাচ্চারা না থাকলে হয়তো আমাদের সিদ্ধান্ত অন্য রকম হলেও হতে পারতো। রাহাত আর নূহার জীবনে জারিফ চলে না এলেও হয়তো আমি এতটা উদারতা দেখাতে পারতাম না। জিহাদ, জিশান আর নাবিহার জীবনে মায়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে রাহাতও হয়তো নিজ থেকেই সরে যেতো আমাদের মাঝ থেকে। কিন্তু আমি এমন একটা সময়ে ফিরে এসেছিলাম। যখন সন্তানদেরকে সবকিছুর উর্দ্ধে প্রায়োরিটি দেয়াটাকেই সবচেয়ে সহজ সিদ্ধান্ত মনে হয়েছিল আমাদের কাছে। এবং এখনো পর্যন্ত আমাদের কাছে আমাদের চার সন্তানই মূখ্য। ওদের খুশিই আমাদের খুশি, ওদের আনন্দই আমাদের আনন্দ। সেজন্যই হয়তো ভালো থাকাটাকেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এত সহজ করে দিয়েছেন আমাদের তিন জনের জন্যই।

আলহামদুলিল্লাহ। আমি ওয়াদা করছি আজ থেকে আর কখনোই তোদের ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করতে আসবো না। তোদেরকে সাহায্য করতে না পারি। কিন্তু অকারণ যন্ত্রণা দেয়া থেকে বিরত থাকতেই পারি।

জাওয়াদ হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা মামণি আমাকে এখন উঠতে হবে। তুমি কি বাবার কাছে যাবে নাকি বাগানে মা আর নূহার সাথে গিয়ে বসবে?

মিসেস সুরাইয়া বললেন, বাগানেই যাই। গল্প করা যাবে দুইজনের সাথে।

মিসেস সুরাইয়াকে বাগানের কাছে পৌঁছে দিয়ে জাওয়াদ নিজের কাজে রওনা হলো।        

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন