রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি... ৪




হসপিটালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেড়োতে যাবে এই সময় সেল ফোন বেজে উঠলো নূহার। স্ক্রিনে ছোট ফুপির নাম্বার দেখে ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আর আমার হসপিটালে যাওয়া হচ্ছে না।

রাহাত হেসে বলল, একা যেতে পারবে ফুপির বাড়িতে নাকি আমি ড্রপ করে দেবো তোমাকে?

আমাকে ড্রপ করতে গেলে তো তোমার দেরি হয়ে যাবে। আমি যেতে পারবো ইনশাআল্লাহ। তুমি কষ্ট করে দুপুরে জারিফকে স্কুল থেকে আমার কাছে দিয়ে এসো।

রাহাতকে বিদায় দিয়ে ফোন রিসিব করে সালাম দিলো নূহা। সালামের জবাব দিয়ে ফুপি শুধু দু'টি বাক্য বললেন, নূহা তোমার খুবই সাথে জরুরি কথা আছে। এই মূহুর্তে তুমি বাসায় চলে এসো। বাক্যে দু’টি বলেই লাইন কেটে দেন। এটা অবশ্য নতুন কিছুই না। সবসময়ই ছোট ফুপি শুধুমাত্র জরুরি ভিত্তিতে তার বাড়িতে যাবার কথা বলার উদ্দেশ্যেই ফোন দেন। কারণ ফোনে কথা বলাটা ফুপির ভীষণ অপছন্দ। তবে খুব জরুরি কিছু বলবেন বলেই যে ডেকে পাঠিয়েছেন সেটা নিয়েও কোন সন্দেহ নেই। তাদের বাবা, চাচ্চু আর ফুপিদের মধ্যে ছোট ফুপি সবার চেয়ে অন্যরকম। খুব বেশি চুপচাপ স্বভাবের। নিজের মতো থাকতে পছন্দ করেন। এই কারণেই সব ভাইবোনেরা একসাথে এক বাড়িতে থাকলেও ফুপি আলাদা বাড়িতে থাকেন। যদিও দুই বাড়িতে দুরুত্ব বলতে শুধু মাঝখানের বাউন্ডারি।

নাবিহা, জিশান আর জিহাদের জন্য কিছু গিফট কিনেছিল গতকাল। এই সুযোগে ওদেরকে নিজ হাতে গিফটগুলোও দিয়ে আসা যাবে ভেবে প্রচন্ড ভালো লাগা ঘিরে ধরলো নূহাকে। জটপট সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ফুপির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করলো। সকাল বেলা হলেও রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা থাকায় ফলে সোয়া এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলো নূহা। মেইন গেট পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই পোড়া গন্ধ এসে নাকে লাগলো নূহার। এই বাড়িকে ছোট খাট একটা রেস্টুরেন্ট বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না। বাড়িতেই ফুপাজান চেম্বার খুলে বসেছেন। জীবনের গোধূলি বেলায় এসে ফুপাজান অন্যের উপকার করতে পারার মাঝে জীবনের সার্থকতা খুঁজে নিয়েছেন। প্রবাসে এসে যে কোন আইনগত বিপদে পড়া বাঙ্গালীদের জন্য ফুপাজানের বাড়ির দুয়ার সমসময়ই উন্মুক্ত। প্রথম কিছুদিন ফুপি আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত ফুপার পরোপকার করার সংকল্পের কাছে হার মেনে  নিয়েছেন। তাই সারাদিনই দেখা যায় লোকজন আসতেই থাকে বাড়িতে। যাদের কাউকেই চা নাস্তা না করিয়ে যেতে দেয় না ফুপাজান। যার ফলে বাসায় সারাক্ষনই রান্না হতেই থাকে।

বাড়ির ভেতরে পা দিয়েই ফুপির সন্ধানে চারপাশে তাকালো নূহা। ছোটবেলা থেকেই নূহার কাছে পরিবারের সবচেয়ে জটিল চরিত্র হচ্ছে ছোটফুপি। ছোটবেলায় ঠিক পছন্দ করতো না ফুপিকে। সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে রাখা কাউকে পছন্দ করাটা বাচ্চাদের জন্য বেশ কঠিনও বটে। কিছু বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুঝতে পেরেছে ছোট ফুপি মানুষটিই একটু অন্যরকম। এরপর থেকে নূহা কখনোই উনার কাছে হাসি-খুশি প্রানোবন্ত আচরণ আশা করেনি। বরং উনি যেমন তেমন ভাবেই মেনে নিতে চেষ্টা করেছে। আসলে পারিবারিক সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে যে যেমন তাকে সেভাবেই মেনে নিতে পারলে, তাদের সাথে জীবন যাপন অনেক সহজ হয়ে যায়। মেনে না নিয়ে যখন একে অন্যেকে বদলে নিজের মনের মত গড়তে চেষ্টা করা হয়। তখনই বাঁধে যত বিপত্তি। খাবার পুড়েছে সুতরাং ফুপিকে হয়তো এখন রান্নাঘরেই পাওয়া যাবে। তাই রুমে না গিয়ে রান্নাঘরের দিকেই রওনা দিলো। কিন্তু রান্নাঘরের দরজায় পৌছে যা দেখলো সেটার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না।

ফুপি ভীষণ রকম রাগত স্বরে ছোট মেয়েকে শাসাচ্ছেন। ছোট ফুপাতো ফোন নায়লার দিকে তাকিয়ে দেখলো মাথা নীচু করে অঝোরে কাঁদছে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকিয়ে নূহাকে দেখে ছোটফুপি বললেন, কি জন্য তোমাকে ডেকে এনেছি বুঝতে পারছো তো এবার?    

নূহা যদিও কিছুই বুঝতে পারলো না। তবুও ঠোঁটের কোণে হাসির আভা ফুটিয়ে তুললো। ফুপির মেজাজের যা অবস্থা। তাতে কেন বুঝতে পারেনি এটাও বিশাল বড় কোন অপরাধের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। তাই হিকমাহ অবলম্বন করাই উত্তম।

নূহার কাছে এগিয়ে এসে ফুপি বললেন, কথা বলো নায়লার সাথে। সারাক্ষণ ধ্যানে মগ্ন থাকে আজকাল। কোন একটা কাজ ঠিকমতো করে না। ডানে বললে বামে যায়। হাঁটতে গিয়ে কখনো দরজায় ঢাক্কা খায়, কখনো ফার্নিচারে। ভাত রান্না করতে বললে জাউ রান্না করে ফেলে। এখনো ভাঁজি চুলায় দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। পোড়া গন্ধে পুরো বাড়ির মানুষের দম বন্ধ অবস্থা। আর উনি এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে টের পাওয়া পরের কথা, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিলেন। এসব লক্ষণ কিসের তা কি আর আমার জানা নেই ভেবেছে? আমি নিশ্চিত এই বেয়াদব মেয়ে কারো প্রেমে ট্রেমে পড়েছে। কার প্রেমে পড়েছে সেটাও অবশ্য আমি আন্দাজ করতে পারছি। দুই সপ্তাহ আগে দেশ থেকে তোমার ফুপাজানের চাচাতো ভাই এসেছে। কোথাও থাকার জায়গা নেই তাই তোমার ফুপাজান স্বাদরে তাকে এই হোটেলে উঠিয়েছেন। এরপর থেকেই এই মেয়ের এমন অবস্থা দেখছি। তোমাকে ডেকে এনেছি প্রেম রোগ ঝেটিয়ে বিদায় করার জন্য। তুমি না পারলে এরপরের ব্যবস্থা আমি করবো। চোখ খুলে যারে দেখবো তার সাথেই ওকে বিয়ে দিয়ে দেব। সেটা রাস্তার ঝাড়ুদার হোক বা বাড়ির পঞ্চাশ বছর বয়সী কেয়ার টেকার।

নূহা হাসি চেপে বলল, ঠিকআছে ফুপি আমি দেখছি। তুমি যাও রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাএ। এত উত্তেজিত হলে শেষে অসুস্থ হয়ে পড়বে।    

ফুপিকে রুমে পাঠিয়ে নায়লার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো নূহা। কাঁধে হাত রাখতেই ফুঁপিয়ে উঠলো নায়লা। নূহা  হেসে বলল, গতবার যখন এসেছিলাম লেবু চা বানিয়ে দিয়েছিলে মনে আছে? 

জ্বি আপ্পা মনে আছে।

তোমার রাহাত ভাইয়া কি বলেন জানো? আমার মত লেবু চা নাকি পুরো পরিবারে কেউ বানাতে পারে না। কিন্তু তোমার বানানো লেবু চা টেষ্ট করলে নির্ঘাৎ উনি বলবেন, পুরো শহরে কেউ এমন লেবু চা বানাতে পারে না।

হালকা খুশির ছোঁয়ায় মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো নায়লার চেহারাতে। নূহা হেসে বলল, আজ যাবার আগে অবশ্যই আমাকে শিখিয়ে দেবে কিভাবে এমন গোল্ডেন এ প্লাস লেবু চা বানাতে হয়। ঠিকআছে?

নায়লা হেসে বলল, ঠিকআছে আপ্পা।   

এখন একদম হুবহু সেদিনের মতো এক মগ লেবু চা বানিয়ে নিয়ে ছাদে এসো। ছাদে যাচ্ছি আমি। ফুপির  কালেকশনে নতুন কি কি গাছ এসেছে দেখে আসি।  

ছাদে এসে মুগ্ধ হয়ে গেলো নূহা। ফুপির বাড়িতে এলে তার বেশির ভাগ সময় ছাদেই কাটে। দেশি-বিদেশি নানান ধরণের বৃক্ষের সমাহারে অপূর্ব সুন্দর বাগান গড়ে তুলেছেন ফুপি পুরো ছাদ জুড়ে। সবসময়ই ছাদে  কদম রাখার সাথে সাথে অজান্তেই গুনগুণ করে ওঠে নূহার মন। কিন্তু আজ মন জুড়ে বইছে দুশ্চিন্তার হাওয়া। ফুপি নায়লাকে নিয়ে যা সন্দেহ করছেন সেটা ঠিক না বেঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। তাদের এই জেনারেশনের ভাইবোন গুলোর মধ্যে নায়লা স্বভাবে সবার চেয়ে শান্ত। বাড়ির সবাই শরীয়তের বিধি-নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করে। আর নায়লার মধ্যে সবসময় বাড়তি সতর্কতা দেখেছে। অবশ্য এটা যে কোন যুক্তি হতে পারে না সেটা নূহা নিজেও জানে। মানুষের মন যে কোন মূহুর্তে লাগামহীন হয়ে যে কোন ভুল করে ফেলতে পারে। সেজন্যই তো মনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সার্বক্ষণিক। ফুপিকে এক কোনে বসে গোলাপ গাছের যত্ন করতে দেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। নূহার দিকে তাকাতে গিয়ে আঙ্গুলে কাঁটার খোঁচা লেগে উফ করে উঠলেন শরিফা খানম।  

নূহা পাশে বসে বলল, বেশি লাগেনি তো ফুপি?

না ঠিকআছে। কিন্তু তুমি এখানে কেন? তোমাকে না বললাম নায়লার সাথে কথা বলতে!

এখানে বসে কথা বলবো ভাবছিলাম। আচ্ছা আমি নীচে চলে যাচ্ছি।

তুমি থাকো আমিই বরং নীচে যাই। আমার গোছলের সময় হয়ে গিয়েছে।

ফুপি উঠে দাঁড়ালে নূহা বলল, কত যতনেই না একটি গোলাপ গাছে ফুল ফোঁটাতে হয় মালিকে। এই যতন  করার সময় কতবারই তো কাঁটা এসে বেঁধে মালির হাতে। মালি কিন্তু সেজন্য কখনোই গাছটিকে তুলে ফেলে দেয় না। কিংবা পাল্টা আঘাত করে না গাছকে। তাহলে অতি আদর যত্নে যেই সন্তানদেরকে আমরা বড় করি। তারা যদি একটা ভুল করে ফেলে, সেটা বুঝে হোক বা না বুঝে। তাদেরকে কেন সাথে সাথে শাস্তি দিতে চাই আমরা? কেন বহু সাধনার ফুলের মত তাদের দেয়া আঘাতকে হাসি মুখে মেনে নিতে পারি না? মানে তাদের ভুলগুলোকে মেনে নিয়ে তাদেরকে সংশোধন করার চেষ্টা করি না? ফুপি তুমি আমার চেয়ে অনেক বড়। দুনিয়া, মানুষ ইত্যাদি সম্পর্কে তোমার জ্ঞান আমার চেয়ে অনেক বেশি। তোমার অভিজ্ঞতাও আমার চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ। তবুও আমি বলতে চাইছি যে, সন্তানরা যখন ভুল করে বা ভুল পথে চলতে শুরু করে। বাবা-মার রাগ না করে তাদেরকে সেটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করা উচিত।

কোন কথা না বলে চুপচাপ ছাদ থেকে চলে গেলেন শরিফা খানম। আকাশের দিকে তাকালো নূহা। সকালে বেশ মেঘলা ছিল আকাশ। ধরেই নিয়েছিল আরেকটা বৃষ্টিমুখর দিন কাটাতে যাচ্ছে। কিন্তু এখন রোদের আভায় চিকচিক করছে আকাশের বুকে ছড়িয়ে থাকা নীলাভ সাগর আর তার কোলে ভাসমান শুভ্র মেঘের ভেলা। ধূসর মেঘের শামিয়ানা গুঁটিয়ে নেয়া হয়েছে যেন আকাশের উপর থেকে। মানুষের মনটাও আসলে ঐ আকাশের মতোই অনেকটা। ক্ষণে ক্ষণেই বদলে যায় রঙ, রূপ। সেজন্যই হয়তো চেনা কেউ হয়ে যায় অচেনা, আবার অচেনা কেউ বদলে হয় খুব চেনা। মানুষকে তাই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় চেনা-অচেনার সীমানায়। নিজেকে ঠিক এমন এক সীমানায় দন্ডায়মান দেখছে নূহা। চেনা ও অচেনায় দোলনায় চেপেছে মন, দোল দোল দোলায়িত কাটছে প্রতিটা ক্ষণ! করতে চায় না ভুল, হারাতে চায় না কূল, ফোটাতে চায় ফুল, হতে চায় পথচারী নির্ভুল!   

আপ্পা চা নিয়ে এসেছি। নায়লার কথা শুনে আকাশ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো নূহা। হেসে বলল, অনেক  শুকরিয়া। কিন্তু এখন পিঠা এনেছো কেন? আমি নাস্তা করে এসেছি বাসা থেকে।

আমি শুধু চা নিয়েই আসছিলাম। এসব খাবার মা দিয়েছে তোমার জন্য। তোমাকে ফোন করে আসতে বলেই মা পাটিসাপটা আর চিতই পিঠা বানিয়েছে তুমি পছন্দ করে সেজন্য। এখনো দেখে এসেছি নানান পদের ভর্তার আয়োজন করছে দুপুরে তোমার জন্য। মা তোমাকে অনেক ভালোবাসে সেটা হয়তো তুমি জানো না!

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ! জানবো না কেন? অবশ্যই জানি। আমিও ফুপিকে খুব ভালোবাসি।

নায়লা মুখ গোমড়া করে বলল, ভালোবাসার মত আমি তো কিছুই খুঁজে পাই না মা’র মধ্যে।

এটাই নিয়ম বুঝলে। একটা কথা শোনোনি? ঐ যে মক্কার মানুষ হজ্জ পায় না।

ঐ কথার সাথে এটার সম্পর্ক?

সম্পর্ক আছে। সমস্যা কি জানো? কাছের চেয়ে দূরের জিনিসের মূল্যায়ন সবসময় বেশি করি আমরা। ভালোর সন্ধানে দৃষ্টি প্রসারিত থাকে বলে কাছের উত্তম কিছুই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়না। ব্যাপারটা অনেকটা হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকার মতো। কবি সাহিত্যিকরা তো আর শুধু শুধু এসব উপমা দেননি। অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকেই বলেছেন। কাঁটার খোঁচা খেয়েও আমরা ফুলের সৌন্দর্যকেই গুরুত্ব দেই। কিন্তু কাছের মানুষদের রাগ বা শাসনের পেছনে লুকায়িত ভালোবাসাকে, কল্যাণকামীতাকে মূল্যায়ন করতে পারিনা। তাই তো এমন ঠাস করে বলে ফেলতে পারি, মায়ের মধ্যে ভালোবাসার মতো কিছু খুঁজে পাই না। বাবার আদর কি জিনিস জানি না।

নায়লা মাথা নীচু করে বলল, আই এম সরি আপ্পা। আসলে মা’র উপর আমি অনেক রেগে আছি।

রাগ হতেই পারে বাবা-মা বা আপনজনদের উপর। কিন্তু তার অর্থ তো এটা নয় যে তাদের সমস্ত অবদান ভুলে যেতে হবে! বরং রাগের সময় আরো বেশি বেশি তাদের ভালোবাসার কথা স্মরণ করার চেষ্টা করা উচিত। এতে মন শান্ত হয়ে যাবার সম্ভবনা নাইনটি পারসেন্ট।

নায়লা হেসে বলল, কিন্তু এমনটা কি সম্ভব?

অবশ্যই সম্ভব। যদি সম্পর্কগুলোকে আমরা ফুলের মতো গুরুত্ব দিতে পারি। তবে এটা ঠিক যে এমনটা চাইলেই সম্ভব নয়। এরজন্য ইচ্ছা, চেষ্টা ও অনুশীলন প্রয়োজন। ইনশাআল্লাহ শিখিয়ে দেবো তোমাকে। এখন চলো চা পান করতে করতে বাগানের নতুন সদস্যেদের সাথে আগে পরিচিত হই।

নায়লা হেসে বলল, হ্যা চলো।      

বাগান ঘুরে দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নায়লার সাথে কথা বললো নূহা। চাইছিল নায়লা নিজ থেকেই তার মানসিক অবস্থা নিয়ে কথা বলুক। যখন কেউ নিজ থেকে সমস্যা শেয়ার করে তখন মন খুলে কথা বলে। এবং ততটাই খোলা মনে সমস্যার সামধান মেনে নিতে চেষ্টা করে। ঠিক উল্টোটা ঘটে যদি কাউকে বাধ্য করা হয় সমস্যা বলার জন্য। এতে দেখা যায় কথা যতটুকু বলে, তারচেয়ে বেশি আড়ালেই  রেখে দেয়। যারফলে পরামর্শ দেয়া যায় না। আর যেহেতু পরামর্শ সে না চাইতেই পাচ্ছে, বা জোড় করে দেয়া হচ্ছে! তাই সেটাকে গ্রহণও করে না সেভাবে। সেজন্যই নহা কিছুই হয়নি এমন সহজ স্বাভাবিক ভাবেই  কথাবার্তা বলছিল নায়লার সাথে। বাগান ঘুরে দেখার পর ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে বলল, তারপর তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে বলো? এগজাম তো মনেহয় প্রায় এসে গিয়েছে তাই না?

হ্যা, দেড় মাস বাকি আছে। আপ্পা...

হুম! বলো।

একটু দ্বিধা করলো নায়লা। তারপর বলল, ঐ বিষয়টা নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি আমি।

নূহা বলল, কোন বিষয়? আর যে কোন বিষয়েই তুমি আমার সাথে কথা বলতে পারো। এত হেজিটেট করার কি আছে? মনেআছে বেশ কয়েক মাস আগে তুমি একদিন না বলে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে চলে গিয়েছিলে? ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যাবার পর বাড়ির সবাই খুব বিরক্ত হয়েছিলেন তোমার উপর।

নায়লা হেসে বলল, হ্যা। কিন্তু তুমি বিরক্ত হওনি। তুমি সবাইকে বুঝিয়ে বলেছিলে অনেকসময় মানুষের প্রভাবে আমাদের দ্বারা এমন কোন কিছু ঘটে যায়, যা কিনা আমাদের স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই কারো দ্বারা এমন কিছু ঘটে গেলে তাকে দোষী না করে বরং বুঝিয়ে বলা ও সতর্ক করে দেয়া উচিত।

আর তোমাকে কি বলেছিলাম?

বলেছিলে, আমার সাথে নিশ্চিন্তে তোমার মনের সব কথা শেয়ার করতে পারো। ইনশাআল্লাহ আমি তোমাকে বুঝবো, কখনোই ভুল বুঝবো না।

তাহলে দ্বিধা করছো কেন আমার সাথে কথা বলতে?

নায়লা বলল, সরি আপ্পা। আসলে আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু কিভাবে যে আমার দ্বারা এমন কিছু ঘটে গিয়েছে নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না। মা রান্নাঘরে যা বলছিলেন সেসব সত্যি কথা ভাবী।

নূহা নায়লার হাতের উপর হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, আমি জানি। কিন্তু আমিও বুঝে উঠতে পারছি না ঠিক কিভাবে এই সম্পর্কটার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছো তুমি?!

আমি নিজেও জানি না। তুমি তো জানো আমি কারো সামনে যাই না। কিন্তু গত কয়েকদিন আগে নীচের বাগানে হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল সৈকতের সাথে। পরের দিন আমি নিজের অজান্তেই বাগানে চলে গিয়েছিলাম। কথা হয়েছিল কিছু। এর পরদিন কলেজ থেকে বেড়িয়ে দেখি সৈকত গেটে দাঁড়ানো। এরপর আর কিছুই জানি না আপ্পা। কিভাবে যেন ওকে ভালো লেগে গেলো।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূহা বলল, বাইরে ঘুরতে গিয়েছো দুইজন মিলে কখনো?

শুধু একদিন গিয়েছিলাম কলেজ মিস করে। সেদিন বাসায় ফেরার পর থেকেই আমার মনে খুব অপরাধ বোধ হচ্ছে। আমি জানি শয়তানের ওয়াসওয়াসার ফলেই আমি এমনটা করছি। আমি এসব থেকে বেরোতে চাই। কিন্তু সেটাও পারছি না। ভাবতে না চাইলেও সারাক্ষণ মনে পড়ে ওর কথা। কথা বলতে ইচ্ছে করে ওর সাথে। আমি কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছি না আপ্পা। কেমন যেন একটা অনুভূতি ঘিরে ধরেছে আমাকে। সারাক্ষণই ওর উপস্থিতি টের পাই আমার চারপাশে। সব কাজ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মা এসব কারণেই টের পেয়ে গিয়েছে।

আমি বুঝতে পারছি। যে কোন নতুন সম্পর্কের শুরুতেই এমন আকর্ষণ ঘিরে ধরে মনকে। সেখানে এটা তো সবচেয়ে স্পর্শকাতর সম্পর্ক। তারউপর তোমার বয়সটাই এখন একটু অন্যরকম। মন কখনো স্বপ্নে বিভোর হয় তো কখনো কল্পনায় মেলে দেয় ডানা। আর সারাক্ষণ মনে পড়া বা উপস্থিতি টের পাওয়াটাও আসলে তেমন বিস্ময়কর কিছু না। বাতাসে দেখো ইলিশ মাছ ভাজার ঘ্রাণ। এর কারণ কি বলতো?

মা মনেহয় ইলিশ মাছ ভাজি করছে তোমার জন্য।

নূহা হেসে বলল, হুম! এখন ভেবে বলো গোশত রান্না করার সময় কি কখনো মাছের ঘ্রাণ পাও? কিংবা  সবজি বা ডিম ভাজির ঘ্রাণ কি ভেসে আসে গোশতের পাতিল থেকে? কখনোই না তাই না?! কেন বলোতো?

কারণ গোশত থেকে অন্যকোন খাবারের ঘ্রাণ আসা সম্ভব নয়।

রাইট। আমাদের চিন্তারাও আসলে অনেকটা এমনই। মানুষ মনের উনুনে যেই চিন্তা চাপায় সেই চিন্তার ঘ্রাণেই মৌ মৌ করে তার মনোজগত। এজন্য দেখা যায় যে ব্যক্তির কুরআন তিলাওয়াত শোনার বা করার অভ্যাস, সে নিজের অজান্তেও কুরআনের বাণী তিলাওয়াত করে ওঠে। কারণ তার কানে কুরআনের ধ্বনিই প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। আবার যে ব্যক্তির গান শোনা বা করার অভ্যাস, সে আপন মনেই গুনগুন করতে হবে। চিন্তারাও ঠিক এমনই। মানুষ যা চিন্তা করে চারপাশে ঠিক তেমন কিছুই দেখতে পায় বা অনুভব করে। তোমার চেতন মন হয়তো কোন কিছু ভাবা থেকে নিজেকে বিরত রাখছে। কিন্তু অবচেতনে সেই ভাবনারাই ঘোরাফেরা করার কারণে তার প্রভাব মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বুঝতে পেরেছো?

আরো বুঝিয়ে বলো আপ্পা।

নূহা হেসে বলল, তোমার ক্ষেত্রে আসলে এটা আবেগ আর বিবেকের দ্বন্দ্ব। তুমি শরীয়তের আলোকে গড়ে উঠেছো। তোমার বিবেক জানে যে পথে তুমি চলছো সেটা ভুল, শরীয়তে এর অনুমোদন নেই। পরিবারে বিষয়টা জানাজানি হলেও তোমাকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। এই ভয়ও কাজ করছে তোমার মনে। কিন্তু আনার নতুন সম্পর্কের পরশ পাওয়া মনের আবেগী অংশটা এসব যুক্তি-তর্ক মেনে নিতে চায় না। তাছাড়া আবেগী মনকে এসব ব্যাপারে অবাধ্য করে তোলার জন্য শয়তান তো আছেই। এটা কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমরা আল্লাহর অস্তিত্ব সবসময় মনে রাখতে চেষ্টা করলেও, শয়তানের অস্তিত্বের কথা বেশির ভাগ সময়ই ভুলে যাই। তাই মনে শুদ্ধ চিন্তা আসার সাথে সাথে আলহামদুলিল্লাহ বললেও, অশুদ্ধ চিন্তা আসার সাথে সাথে আউজুবিল্লাহ হি মিনাশ শায়তানির রাজিম বলতে খেয়াল থাকে না। আবেগ আর বিবেকের দ্বন্দ্বটাকে শয়তান আর ফেরেশতার দ্বন্দ্ব বলতেন আমাদের এক প্রফ। অর্থাৎ, আমাদের ভেতরের ভালো সত্ত্বা ও মন্দ সত্ত্বা। কেউ যাতে ভালো কাজ করতে না পারে সেই ব্যাপারে সদা সচেষ্ট মন্দ সত্তা। কেউ তার ভাবনাকে পবিত্র রাখতে চাইলে, মন্দ সত্তা সেই সবকিছু একের পর এক সাপ্লাই করে যা তার মনটাকে কুলষিত করে তুলবে। এবার বুঝেছো?

জ্বি। আমি তাহলে এখন কি করবো আপ্পা?

তুমিই বলো ঠিক কি করতে চাও। তুমি যদি এই সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসতে চাও। তাহলে আমি সেভাবে পরামর্শ দেবো তোমাকে। আর যদি তোমার মনেহয় সৈকত তোমার লাইফ পার্টনার হবার মত যোগ্যতা রাখে। তোমাদের একে অন্যের প্রতি আবেগ অনেষ্ট। তাহলে সম্পর্কটা যাতে শয়তানের ওয়াসওয়াসার কারণ না হতে পারে তোমাদের জন্য সেই ব্যবস্থা করবো ইনশাআল্লাহ।

মানে কি বিয়ে? কিন্তু মা কি রাজী হবে?

মা রাজী হবে কি হবেন না সেই চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তুমি তোমার চিন্তা করো।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর নায়লা বলল, আমার সৈকতকে অনেক পছন্দ। যেটুকু কথা হয়েছে ভালো মানুষ বলেই মনে হয়েছে। যেদিন বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম এমন কোন কথা বা আচরণ করেনি যাতে খারাপ ধারণা করা যায়। শুধু একটাই সমস্যা।

কি?

সৈকত অনার্সে ভর্তি হবার কয়েক মাস পরেই পারিবারিক কারণে দেশের বাইরে চলে এসেছে। আমাদের পরিবারের কেউ কি এটা মেনে নিতে রাজী হবে?

এই প্রশ্নে কিছুটা থমকে গেলো নূহাও। তাদের পরিবারে অবশ্য সার্টিফিকেটধারী, ডিগ্রীধারীর চেয়ে মানুষকে তার চারিত্রিক গুণাবলী ও শরীয়তের মানদণ্ডেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তারপরও এমন ঘটনা যেহেতু আগে কখনোই ঘটেনি। তাই সবার রিঅ্যাকশন্টা ঠিক কেমন হবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। নায়লার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তাকে চুপ দেখে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে। ওকে আশ্বস্ত করতে হেসে বলল, আচ্ছা এসব পরে বিবেচনা করে দেখা যাবে। আগে আমাকে যাচাই করে দেখতে হবে তুমি সৈকতের ব্যাপারে যা যা বলছো সেসব কতটুকু সত্যি। কেননা শুধু তোমার কথার উপর ভরসা করে তো আমরা বিয়ের পর এক বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।

তুমি সৈকতের সাথে কথা বলবে আপ্পা?

নূহা হেসে বলল, অপরিচিত কারো সাথে আমি কিভাবে কথা বলবো আপু? জাওয়াদ ভাইয়াকে বলবো যাতে সৈকতের সাথে কথা বলেন। এছাড়া অন্য কেউ কথা বললে তো লাভও হবে না। ফুপি আর ফুপাজান তো জাওয়াদ ভাইয়া ছাড়া অন্য কারো কথা মানতে রাজীও হবেন না।

ভাইয়া যদি শুনে রেগে যায় তাহলে? আমার এখনই ভয়ে শরীর কাঁপছে আপ্পা।

যখন ভয় পেলে একটা অন্যায় ও ভুল করা থেকে বেঁচে যেতে পারতে, তখন যেহেতু ভয় করোনি। তাই এখনো ভয় করো না। অন্যায় বা ভুলকে ফেস করতে না পারার ভয় সেই অন্যায় ও ভুলের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। কয়েকদিন পর পরীক্ষা তাই এখন থেকে পড়ালেখাতে মনোযোগ দাও। এমন কিছু যেন না হয় যাতে ফুপি বিরক্ত হতে পারেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা। সৈকতের সাথে দেখা করা, কথা বলা সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলবে। আর কখনোই যেন সৈকত তোমার কলেজে না যায়। এসব জানলে বাড়ির সবাই প্রচন্ড বিরক্ত হবেন সেটা তো জানোই। আমি আগে জাওয়াদ ভাইয়ার সাথে কথা বলি এরপর দেখি কি করা যায়।

ঠিকআছে আপ্পা।  

এখন তাহলে চলো নীচে যাই। ফুপি একা একা রান্না করছেন চলো উনাকে সাহায্য করি দুজন মিলে।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন