রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...১




প্রকৃতিকে কিভাবে উজাড় করে ভালোবাসতে হয়! প্রকৃতির মাঝে আকন্ঠ ডুবে থেকে কিভাবে তুলে আনা যায় জগতের আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণ! কিভাবে প্রকৃতির রঙ-রূপের মাঝ থেকে শিক্ষা কুড়িয়ে নিয়ে নিজেকে করে তুলতে হয় ঐশ্বর্যময়! মেয়েটি যেন তাই শিখিয়ে যায় শব্দের মূর্ছনায়! জটিল কঠিন এই বিশ্বটা ভীষণ মায়াময় আর আনকোরা তার কাছে! তার মন উচ্ছলতা ফিরে পায় রঙের ছোঁয়ায়। প্রাণ ফিরে পায় আলোর স্পর্শে!ভাবুকতার কাব্যিক দৃষ্টি পাথরের বুকেও ছড়িয়ে দেয় পুষ্পের মেলা। যা কিছুই তার অভিজ্ঞতায় আসে হারিয়ে যেতে দেয় না কখনোই। উপলব্ধির সৌরভে রূপান্তরিত করে অমূল্য কোন মোতিতে। সযতনে রেখে দেয় মনের হিমাগারে। তাই তো জীবনের ভাবাবেগগুলো অবিকল বলে যেতে পারে সে নামতা পাঠের মতোই। জটিলতা এড়িয়ে যায় ছোট্ট হাঁসের ছানার শরীর থেকে পানি ঝেড়ে ফেলার নিপুণতায়। সরলতায় উড়ে বেড়ায় ডানা মেলা পাখীর মতোই নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে! কল্পনাবিলাসী মেয়েটি! ভীষণ রকম স্বপ্নময়ীও! বড় বেশি প্রাণবন্ত, সমৃদ্ধ, বৈচিত্রময় আর বর্ণিল তার অনুভূতিরা। হাতে হাত রেখে, কদমে কদম ফেলে কল্পরাজ্যে তাকে অনুসরণ করা এক কথায় দুঃসাধ্য-ই বলতে হবে। মূহুর্তেই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে যায় চাঁদের পাহাড়ের এক্কেবারে সর্বোচ্চ চূড়োয়। পরক্ষণেই ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্মুক্ত নীলাভ সাগরের বুকে। ছুটে দাঁড়িয়ে যায় উচ্চতা থেকে ঝরে পড়া টলটলা ঝর্ণার নীচে। ভাসিয়ে দেয় নিজেকে পর মূহুর্তেই খরস্রোতা কোন পাহাড়ি নদীর কোলে!

বিষ্ময়কর অভিব্যক্তির অধিকারী মেয়েটি! শুধু শব্দ বুনেই ক্ষান্ত হয় না তার দু’চোখ! গুনগুনে ধ্বনি তুলে ছড়িয়ে দেয় মায়াবী সুর! শুধু একটাই দোষ তার! খুব বেশি সংবেদনশীল সে। একটুতেই নিজেকে গুঁটিয়ে নেয় লজ্জাবতী পাতার মত। নিজের মনের ভাবনাগুলো কখনোই কাউকে মুখে বলবে না এ যেন তার জীবন মরণ পণ। নিজের মনোবাসনা গুলোকে এমন ভাবে আগলে রাখবে যেন মহা মূল্যবান কোন রত্ন ভান্ডার। তার মনের গভীরের জগতটাই তার একান্ত আপনার ভুবন! আনন্দচিত্তে নিজের সাথেই কাটিয়ে দিতে পারে অগুনতি সময়। সবার তরে তাই আলীবাবার সেই চল্লিশ চোরের গুহার মতোই তার মনের দুয়ারও রুদ্ধ। গুহায় ঢোকার সুপ্ত সেই মন্ত্র একমাত্র তার নিজেই জানা। তাই তার মনে প্রবেশ আরাধ্যই থেকে যায়!এতো গেলো তার মনোজগতের বিবরণ। এবার চলো তোমাদেরকে বিচরণ করিয়ে আনি সেই মেয়েটির দরদী সত্তার সাথে। দু’পা ছড়িয়ে, কাজল কালো আঁখি মেলে বিমুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে থাকা পাঁচ নাত্নীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন আজাদ সাহেব। এতটুকু হৈচৈ না করে চুপ করে গভীর মনোযোগ সহকারে এতক্ষণ ধরে কথা শুনতে থাকা নাত্নীদের দিকে আদর ভরা দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। বাড়ির বড় পাঁচ ছেলের এই পাঁচ কন্যা যেন অনেকতা নিজ নিজ পিতার রিপ্রেজেন্টিভ। নাতীদের চাইতেও এই পাঁচ নাত্নীর মধ্যেই সন্তানদের প্রতিচ্ছবি বেশি খুঁজে পান আজাদ সাহেব। প্রতিদিনই বিকেলের নির্দিষ্ট একটা সময় কাটান নাত্নীদের সাথে। কথা বলেন বিভিন্ন বিষয়ে, কখনো বা ওদের কথা শোনেন মনোযোগ দিয়ে। নাত্নী পাঁচটিও ভীষণ শান্ত ও মনোযোগী স্বভাবের। কিন্তু কথার সম্রাজ্ঞী সবাই। একবার ওদের শব্দের বর্ষণ শুরু হলে সুরেলা রিমঝিম ছন্দ তুলে ঝরতে থাকে অক্লান্ত মনে। তবে প্রত্যেকেরই আছে নিজস্ব রঙ-রূপ-বৈশিষ্ঠ্য। তারপরও এক জায়গায় ওরা মিলে মিশে একাকার। সেটা হচ্ছে, ওরা সবাই ওদের মামণির মতো হতে চায়।

নূহাকে বাড়ির সব বাচ্চারাই মামণি ডাকে। আর তাই নাত্নীদের নূহার গল্প শোনাতে বসেছেন। কারণ আজাদ সাহেব নিজেও চান ওরা সবাই কিছুটা হলেও যেন তার নূহা মা’র মতোই হয়। যেন জগতের তাবদ জটিলতার বুকে ওরা হতে পারে নিরবধি কূলকূল প্রবাহিত সরলতার মিঠা সরবোর! যেন ফেটে চৌচির মরুময় রুক্ষ ভূমির বুকে ফুটে থাকা ঘাসফুলের মতোই হয় নয়নাভিরাম। পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরা হিংসা-দ্বেষ-কুটিলতা, দুরাশা- নিরাশা-হতাশার বিছানো চোরাবালির ফাঁদ এড়িয়ে যাবার ব্যাপারে ওরা যেন থাকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং অন্যের তরে আশাজাগানিয়া! অরাজকতা-হানাহানি-মিথ্যার ঘোর কালো রাত্রির অবসানে হয় যেন সঙ্ঘবদ্ধ সুহাসিনী ভোর! জ্ঞানহীনতার আঁধারে নিমজ্জিত রুদ্ধ মনগুলোকে জ্ঞানের উর্মিমেলায় বিধৌত করার লক্ষ্যে খুলে দিতে পারে যেন জ্ঞানের আলোকিত বাতায়ন! দুঃখ-কষ্টের আগমনে নিদারুণ আর্তনাদে লিপ্ত প্রাণগুলোতে করতে যেন পারে উপলব্ধির অন্তঃদৃষ্টি উন্মোচনকারী। বুঝিয়ে যেন দিতে পারে রোদ-বৃষ্টির সংমিশ্রণেই আকাশে কদম রাখে বর্ণিল রঙের, রঙধনু! ভুলের স্রোতে ভেসে মূল গন্তব্যের সন্ধান হারিয়ে দিগ্বিদিক উদ্ভ্রান্ত ছুটে চলা পথিকের ওরা যেন হয় রাহবার, দিতে যেন পারে সুবহে সাদিকের সন্ধান।

কি হলো নানাভাই তুমি চুপ করে আছো কেন? আমাদেরকে বলো মেয়েটির দরদী মনের গল্প।  নাবিহার ডাক শুনে নিজের ভাবনাদের ছুটি দিয়ে হাসি মুখে আজাদ সাহেব বললেন, সেই মেয়েটির দরদী মনের গল্প তোমাদেরকে আরেকদিন শোনাবো ইনশাআল্লাহ।

আরেকদিন কেন দাদাভাই? আজ নয় কেন? প্রশ্ন করলো আজাদ সাহেবের বড় ছেলে ফায়েজের একমাত্র কন্যা মাঈশা।

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, কারণ আজ আমি তোমাদের কথা শুনবো।

আমাদের কথা? আমাদের আবার কি কথা? চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলো মুবাশ্বারা।

হাত বাড়িয়ে মুবাশ্বারাকে কাছে টেনে নিলেন আজাদ সাহেব। আদীর দুই কন্যার মধ্যে মুবাশ্বারার প্রতি অন্যরকম টান অনুভব করেন তিনি। প্রকৃতি, গাছপালা, ফুল-পাখী সবকিছুর প্রতিই ভীষণ আকর্ষণ মুবাশ্বারার। ওকে বাগানে আপন মনে ঘুরে বেড়াতে দেখে আজাদ সাহেবের মনেহয় নূহাই যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুবাশ্বারার মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি মুখে আজাদ সাহেব বললেন, চারপাশের জগতটাকে সুন্দর করার জন্য তোমরা কে কি করতে চাও সেসব কথা শুনবো আজ।

সাথে সাথেই হাত উপরে তুলে কাশফিয়া বলল, আমি আগে বলি দাদাভাই?

হেসে ফেললেন আজাদ সাহেব। শুধু চেহারা না স্বভাবেও পিতার কার্বন কপি হয়েছে কাশফিয়া। ছোটবেলায় রিসাবও এমন ছিল। কিছু বলে শেষ করার আগেই জবাব দেয়ার জন্য হাত তুলে বসে থাকতো। বললেন, আচ্ছা ঠিকআছে তুমি বলো সবার আগে।

কিন্তু আগে তো জানতে হবে তুমি কেন শুনতে চাইছো আমাদের কথা? সবসময়ের মতোই বিজ্ঞ প্রশ্ন করলো ইমামা। ইমামা অবশ্য মোটেই তার বাবার মতো হয়নি। জন্মের পর থেকে নিয়ে গত তেতাল্লিশ বছরে ছোট ছেলে হুমায়ূনকে কোনদিনও সিরিয়াস হতে দেখেননি আজাদ সাহেব। বাবার এই ঘাতটি দূর করার জন্যই বোধহয় ইমামা জন্মের সাথে সাথেই ভ্রূ দু’খানা কুঁচকে চারপাশকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছিল। প্রায়ই দেখা যায় আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে ইমামা তার বাবাকে শাসন করছে কোন দুষ্টুমির জন্য। আর হুমায়ূন অপরাধী পিতার মতো মাথা নীচু করে, সরি আম্মা, সরি আম্মা বলছে।

হাত বাড়িয়ে ইমামার নাক টেনে দিয়ে আজাদ সাহেব বললেন, কারণ আমার ভান্ডারে পাঁচটি উপনাম আছে। যা আমি তোমাদের সবাইকে একটি করে দিতে চাই। কাকে কোন উপনাম দেবো সেটা নির্ভর করবে তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর উপর।

নাবিহা বলল, উপনাম পাঁচটি কি কি নানাভাই? আমরা কি জানতে পারি?

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, অবশ্যই জানতে পারো। উপনাম পাঁচটি হচ্ছে, আশা জাগানিয়া, আলোকিত বাতায়ন, সুবহে সাদিকের সন্ধানে, রঙধনু এবং সুহাসিনী ভোর।

সাথে সাথে হাত তুলে কাশফিয়া বলল, দাদাভাই আমি রঙধনু হতে চাই।

আজাদ সাহেব হেসে বলল, উহু শুধু মুখে চাইলে তো হবে না। তোমার চিন্তাভাবনাতে আসলেই রঙের ছড়াছড়ি আছে কিনা, তুমি সত্যিই চারপাশকে একটু করে রাঙিয়ে দেবার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ কিনা সেটা আগে জানতে হবে আমাকে। এখন একজন একজন করে এই ভুবনটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার ব্যাপারে তোমাদের নিজ নিজ ভাবনাগুলো বলো।

নাবিহা বলল, আমরা আগামীকাল বলি নানাভাই? কিছু চিন্তাভাবনা আমাদের আছে ভুবনকে সুন্দর করে সাজানোর। কিন্তু স্পেশাল করে কখনো ভাবা হয়নি সেভাবে। আজ আমরা সবাই চিন্তা-ভাবনা করি। আগামীকাল তোমাকে জানাবো ইনশাআল্লাহ।

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, ঠিকআছে। তবে একদিন সময় দেয়া যাবে না। এক ঘন্টা সময় দিচ্ছি তোমাদেরকে ভেবে দেখার জন্য। তোমরা তাহলে এখন থেকেই চিন্তা-ভাবনা শুরু করো। আমি ততক্ষণ বাগান পরিচর্যা করে আসি।

আজাদ সাহেব উঠে যাবার পর পাঁচ বোনই গালে হাত দিয়ে চিন্তা-ভাবনাতে মনোনিবেশ করলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ নাবিহা বলল, আলহামদুলিল্লাহ পেয়ে গিয়েছি আইডিয়া।

নাবিহার উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে মৃদু চিৎকার শুনে মাঈশা, কাশফিয়া, মুবাশ্বারা আর ইমামা চারজনই কৌতূহলী চোখে তাকালো।

নাবিহা হেসে বলল, পাপা কিছুক্ষণ আগে হসপিটাল থেকে ফিরেছে তো।

ধীরে ধীরে হাসি মুখে উঠলো বাকি চারজনের মুখের। মাঈশা আনন্দিত কন্ঠে বলল, আরে তাই তো!পাপা তো এখন বাসায়। তারমানে সব সমস্যার সমাধান ইনশাআল্লাহ। চল পাপার কাছে যাই।

শুধু বলতে দেরি লাফিয়ে উঠে পাঁচজনই ছুট লাগালো বাড়ির ভেতরে।

হসপিটাল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেড়িয়ে পাঁচ কন্যাকে গোল হয়ে কার্পেটে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলেও সেটা ওদেরকে বুঝতে না দিয়ে লম্বা করে শ্বাস টেনে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জাওয়াদ বলল, এই বাড়ির নারীগণকে সবকিছু শেখানো সম্ভব কিন্তু অনুমতি ছাড়া কারো বেডরুম ঢোকা থেকে ব্যহত করা সম্ভব নয়।

মুবাশ্বারা, নাবিহা, কাশফিয়া, ইমামা আর মাঈশা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো একদম। হাসি জারি রেখেই সম্মিলিত সালাম দিলো। জাওয়াদ সালামের জবাব দেবার পর নাবিহা বলল, পাপা আমরা জানি তুমি বেশ ক্লান্ত। আমরা মোটেই অকারণ কথা বলে তোমাকে বিরক্ত করতে আসিনি। আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলার জন্য এসেছি।

জাওয়াদ বলল, আলহামদুলিল্লাহ সেটা তো আপনাদের সম্মিলিত আগমন দেখেই বুঝতে পেরেছি। বলুন কি সেই জরুরি বিষয় যার কারণে আমার পঞ্চ রত্নাকে একসাথে দেখার সৌভাগ্য হলো?
মাঈশা বলল, আমরা পাঁচজন তোমাকে পাঁচটি প্রশ্ন করবো। উত্তর বলে দিলেই চুপচাপ চলে যাব।

ইমামা বলল, হ্যা। আর উত্তর বলে না দিলে অনেক বিরক্ত করবো তোমাকে আমরা সবাই মিলে।

নাবিহা, মুবাশ্বারা, মাঈশা, কাশফিয়া চারজনই হেসে ফেললো। জাওয়াদও হেসে কান টেনে দিলো ইমামার। এরপর বলল, ঠিকআছে বলেন কি কি প্রশ্ন আছে আপনাদের।

মুবাশ্বারা বলল, পাপা তোমার মনে আছে ছয়মাস আগে জাল দাদাভাই যখন অসুস্থ ছিলেন তখন একদিন তুমি আমাদের তাফসীর ক্লাস নিয়েছিলে?

হুম, আমার মনে আছে মা। জবাব দিলো জাওয়াদ।

কাশফিয়া বলল, তাহলে তোমার নিশ্চয়ই এটাও মনে আছে সেদিন তুমি আমাদেরকে বলেছিলে, প্রতিটি মানুষই স্পেশাল। কারণ প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কোন না কোন স্পেশাল গুণ থাকেই। মানুষকে শুধু তার স্পেশালিটি খুঁজে বের করে সেই বিষয়ে স্পেশালিষ্ট হতে হয়।

জাওয়াদ হেসে বলল, তোমাদেরকে যা যা বলেছিলাম সব মনে আছে আমার। তোমরা কি নিজ নিজ স্পেশালিটি খুঁজে বের করতে আগ্রহী?

মুবাশ্বারা বলল, অনেকটা তাই। আমরা তোমাদেরকে পাঁচটি নাম বলবো। সেখান থেকে একটি করে নাম তুমি আমাদের জন্য পছন্দ করে দেবে। নাম পাঁচটি হচ্ছে, এক. আশা জাগানিয়া। দুই. আলোকিত বাতায়ন। তিন. সুবহে সাদিকের সন্ধানে। চার. রঙধনু। এবং পাঁচ. সুহাসিনী ভোর। এখন তুমি আমাদেরকে বলে দাও আমরা কে কোনটা?

জাওয়াদ হেসে বলল, তোমাদের নানাভাইর হোমওয়ার্ক বুঝি এটা?

নাবিহা বলল, ঠিক হোমওয়ার্ক না। নানাভাই আমাদের পাঁচজনকে এই পাঁচটি উপনাম থেকে একটি করে দিতে চান। কিন্তু নানাভাইয়ের শর্ত হচ্ছে আমরা নাম পছন্দ করলে হবে না। আমাদের ভাবনা জানার পর নানাভাই নাম পছন্দ করে দেবেন। তুমি কি আমাদের বলে দেবে পাপা? আমরা আসলে একদমই বুঝতে পারছি না। আমার তো পাঁচটি নামই পছন্দ।

আমারো। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ইমামা। পাঁচটিই হতে ইচ্ছে করছে আমার।

সমস্যা কোথায়? হয়ে যাও প্রতেক্যেই পাঁচটি। হাসি মুখে বললো জাওয়াদ।

কাশফিয়া চোখ বড় বড় করে বলল, একজনের পক্ষে কি পাঁচটিই হওয়া সম্ভব?

অবশ্যই সম্ভব। এবং এটাই স্বাভাবিক। একজন মানুষের পক্ষে সবসময় একই রকম থাকাটাই বরং অসম্ভব। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, জীবন আমাদের সামনে যখন যেভাবে হাজির হবে তখন তাকে সেভাবেই স্বাগত জানাতে হবে। যেমন ধরো সুহাসিনী ভোর হতে চাইলে আগে তোমাদেরকে ঘোর আঁধারের বুকে সুবহে সাদিকের সন্ধানে অক্লান্ত চলতে হবে। আর এমনটা কখনোই সম্ভব নয় যদি না তোমাদের মনের আলোকিত বাতায়ন উন্মুক্ত থাকে। কেননা তা না হলে তো তোমরা সুহাসিনী ভোরের প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করে, সুবহে সাদিকের সন্ধানে বেড়োবার সাহসই করতে পারবে না। আবার জীবন কখনোই একই ধারাতে প্রবাহিত হয় না। আলো-আঁধার, রোদ-বৃষ্টির ক্রমানয়ে আসতে থাকে আমাদের জীবনে। মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে। এই লাইনটা তো শুনেছোই। অর্থাৎ, সর্বাবস্থায় মনের মাঝে জ্বালিয়ে রাখতে হবে আশার দিয়া। হতে হবে আশা জাগানিয়া। তাহলেই কেবল দুঃখ-সুখের সংমিশ্রণে তৈরি করতে পারবে রঙধনু।

তাই তো? এভাবে তো আমরা ভেবেই দেখিনি। জাযাকাল্লাহ পাপা। সম্মিলিত চিৎকার করে উঠলো সবাই।

জাওয়াদ হেসে বলল, এখন আমার কথা শোনো। তোমরা তো নিশ্চয়ই জানো পশুপাখী, গাছপালা থেকে নিয়ে শুরু করে এই জগতে ছোট-বড় যত ধরণের প্রাণের অস্তিত্ব আছে বেঁচে থাকার জন্য তাদের শুধু বাহ্যিক চাহিদার পূরণই যথেষ্ট। কেবল মাত্র মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের বেঁচে থাকার জন্য দৈহিক চাহিদার বাইরেও আরেকটি চাহিদার পূরণ অত্যাবশ্যক। সেই চাহিদাটা যদি অপূর্ণ থেকে যায় তাহলে মানুষের দেহ তো বেঁচে থাকে কিন্তু মনুষ্যত্ব ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। তোমরা কেউ বলতে পারবে মানুষের অপর সেই চাহিদাটি কি?

মেয়েদের পাঁচজনকেই চিন্তায় পড়ে যেতে দেখে জাওয়াদ হেসে বলল, একজনও বলতে পারবে না? নাবিহা আমি খেয়াল করেছি দু’বার তুমি কিছু বলতে গিয়েও আবার থেমে গিয়েছো। তার মানে তোমার মনে মানুষের অপর সেই চাহিদাটা উঁকি দিয়েছে। কিন্তু যদি সঠিক না হয় তাই বলতে দ্বিধা করছো। আমি কি ঠিক বলেছি?

নাবিহা হেসে বলল, জ্বি পাপা। আমার মনেহয় মানুষের অপর সেই চাহিদাটা হচ্ছে জ্ঞানার্জন। কারণ দেহের সাথে সাথে মানুষকে তার আত্মার খোরাকও যোগার করতে হয়। আর আত্মার খোরাক জ্ঞান।

মাশাআল্লাহ একদম ঠিক বলেছো। মানুষের আত্মার খোরাক হচ্ছে জ্ঞান। আর এই জ্ঞানই মানুষকে যেমন অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করে। ঠিক তেমনি জ্ঞানের তারতাম্যই একজন মানুষ থেকে অন্য একজন মানুষদের যোগ্যতা ও পার্থক্যের পরিমাপক। জ্ঞানই মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করে, বিবেককে সমুন্নত করে। মানুষকে ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণের মাঝে পার্থক্য করতে শেখায়। তাই সবার আগে তোমাদেরকে আলোকিত বাতায়ন হতে হবে। জ্ঞানের ঝর্ণাধারায় স্নাত হতে হবে। যত বেশি সিক্ত হবে তোমাদের অন্তর, ততবেশি আশা জাগানিয়া হবে তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গী। তখন আর আঁধার দেখে ঘাবড়ে যাবে না। জীবনে সুহাসিনী ভোরকে নিমন্ত্রণ জানানোর জন্য ঘোর কালো রাতে সুবহে সাদিকের সন্ধানে ছুটে চলতে পারবে অক্লান্ত। রাঙিয়ে দিতে পারবে ভুবনটাকে রঙধনু রঙে ইনশাআল্লাহ।

ইনশাআল্লাহ আমরা অবশ্যই পারবো। আমাদেরকে পারতেই হবে। ঠিকআছে আমরা তাহলে এখন নানাভাই কাছে যাই। তুমি রেষ্ট নাও।

জাওয়াদ হেসে বলল, আরেকটা কথা শোনো। জীবন যুদ্ধের যোদ্ধা হতে চাইছো তোমরা। তাই সবসময় মনে রাখবে যে, এই জগতে যারা জোনাকি হতে চায়, তারা সামনে শুধুই আঁধার পায়। সন্ধান করে আলোর কিন্তু তাদেরকে হাতছানি দেয় ঘোর কালো। আবার যারা পুষ্পবাগ হতে চায়, তাদের সামনে শুধুই তেপান্তর, রিক্ত শ্বাপদ বন, শুষ্ক মরুভূমি এসে দাঁড়ায়। যারা আশাজাগানিয়া হতে চায়, রুক্ষ মনের নিদারুণ কাঠিন্য, হতাশার ধূলি-ধূসর মরিচিকা, চোরাবালির তাদের মনে নিত্য ফাঁদ পেতে দিয়ে যায়। যারা বদ্ধ বাতায়ন খুলে দিতে চায়, তাদের জীবনে ঝড় উদ্দেশ্যহীন তোলে তর্জন-গর্জন, ঝলসে ওঠে বিজলী, থমকে যায় পবন, মধ্যাহ্ন রোদ নিঃসঙ্গতা ডোবাতে চায় শূন্যতায়। যারা দিতে চায় সুবহে সাদিকের সন্ধান, নির্জনে একাকী তাদের প্রহর গুণতে হয় নিরালায়। আশার বীজ বুনে হৃদয়-মৃত্তিকায়, আজন্ম দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নিশ্চল প্রতীক্ষায়। যারা আকাশজোড়া রঙধনু হতে চায়, বিবর্ণ রঙহীন পথে তাদের হেঁটে চলতে হয় অবিচল। বিন্দু বিন্দু ঝরে নিঃশেষ হয় বর্ণিল রঙ, তবুও আকাঙ্ক্ষা থাকে তাদের মনে মেলবে ভালোবাসা পাঁপড়ি একদিন। আর যারা হতে চায় সুহাসিনী ভোর, উসখুশ রাতের স্বেচ্ছাচারী ভয়াল থাবা নাড়িয়ে দেয় বিশ্বাসের ভীত, কম্পিত হয় তাদের অন্তর। কিন্তু তবুও করে চলে চেষ্টা সবে রবের তরে বিশ্বাস ও ভরসায় নিরন্তন।

কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো পাঁচজনই। জাওয়াদ হেসে বলল, কয়েকদিন আগে না তোমরা আমাকে বললে তোমাদের মামণি তোমাদেরকে বলেছে, ‘মুচকি হেসে জীবন ছড়িয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার ধ্বনি, অপূর্ণতাকে দিতে পূর্ণতা চলো নতুন স্বপ্ন বুনি। আশার কিরণ বলে চুপিচুপি আঁধার যাবে হারিয়ে, শক্তি নাও ভক্তি থেকে, ভুবনটা দাও রাঙিয়ে’। তাই যখনই শঙ্কা, ভয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বসবে মনে জাঁকিয়ে, শক্তি নিয়ে ভক্তি থেকে দিয়ো তাদের তাড়িয়ে।

পাপার কথা শুনে মেয়েদের চেহারার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া সূর্যটা ভক্তির শক্তি মেখে পূর্ণ আলোতে বিকশিত হয়ে উঠলো মূহুর্তেই। পাঁচজনই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো পাপাকে। সবার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলো জাওয়াদ। এরপর পাঁচজনই তাদের নানাভাইয়ের সন্ধানে ছুট লাগালো। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন