রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...৩





এমনিতে খুবই শান্ত ও ঠান্ডা স্বভাবের মেয়ে তাইয়্যেবা। কিন্তু একসাথে অনেকগুলো বিরক্তিকর কারণ যখন একসাথে সামনে এসে দাঁড়ায় তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেশির ভাগ সময়ই ব্যর্থ হয়। এই মূহুর্তে যেমন প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিলো নিজেকে সামাল দিতে। আগামীকাল খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রেজেন্টেশন আছে তার। গত তিন ধরে একটানা জ্বর ছিল তাইয়্যেবার ছেলে তাওহীদের। সারাক্ষণ ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এখনো ধরতে গেলে কিছুই রেডি করা হয়নি প্রেজেন্টেশনের। মাগরীবের নামাজ সেরে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে ভেবেছিল ছোট মেয়েকে রাতের খাবার খাইয়ে কাজ নিয়ে বসবে। কিন্তু আধ ঘন্টা ধরে চেষ্টা করার পরেও এক চামচ খাবার মুখে দেয়াতে পারেনি মেয়ের। নিজের পড়াশোনা, জব ব্যক্তিগত অন্যান্য সবকিছুর আগে সংসার আর বাচ্চাদেরকেই প্রায়োরিটি দেবার চেষ্টা করে সবসময়। সবসময় সতর্ক থাকে অন্য কোন কাজের টেনশনের কারণে যেন কখনোই সন্তানদের উপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। তারপরেও মাঝে মাঝে সবকিছু মিলিয়ে এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়, মেজাজ ঠিক রাখাটা খুব বেশি কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। শ্বাশুড়ি সামনে বসে না থাকলে কোন মতেই যে এখন নিজেকে সামাল দেয়া সম্ভব হতো না সেটা বুঝতে পারছিল তাইয়্যেবা। অনেক কষ্টে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, শেষবারের মত জানতে চাইছি তুমি কি খাবে নাকি আমি খাবার নিয়ে চলে যাবো?

খুবই বিরক্ত হচ্ছে এমন ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকালো উনাইশাহ। এরপর ডানে বামে প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো সে এখন কিছুতেই খাবে না।

অনেকক্ষণ থেকেই চুপচাপ নাতনী আর পুত্রবধূর খাদ্য যুদ্ধ দেখছিলেন মিসেস নুসরাত। নীরবতা ভেঙ্গে বললেন, খেতে যখন চাইছে না এত জোর করছো কেন? থাকতে দাও না খেয়ে কিছুটা সময়। ক্ষুধা লাগলে ঠিকই খেবে।

তাইয়্যেবা বলল, জোর না করলে কখনোই খাবে না আম্মি। যদি খাওয়ায় কথা না বলি সারাদিন না খেয়ে থাকবে।

তাহলে থাকতে দাও দু’একটা দিন না খেয়ে। একটু ক্ষণ বাচ্চা না খেলেই এমন অস্থির না হয়ে বরং ক্ষুধা কি জিনিস বুঝতে দাও ওদেরকে। তখন আর এত ঝামেলা করবে না। কিন্তু তোমরা কি আর ক্ষুধা টের পাওয়ার কোন পথ রাখো বাচ্চাদের সামনে। খাদ্য হজম হবার আগেই আবার খাদ্য নিয়ে হাজির হয়ে যাও। বাচ্চার পেটে জায়গা না থাকলে কি হবে? মায়েদের দুচোখে বাচ্চাদের পেট সর্বদা খা খা মরুভূমি। যারফলে, খাদ্যের মর্ম বোঝা তো দূরে থাক, বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজনীয়তাও টের পায় না বাচ্চারা। ওদেরকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় তোমাদের সবচেয়ে অপছন্দের কাজ কি? জবাবে বলে, খাওয়া হচ্ছে আমার সবচেয়ে অপছন্দের কাজ। আমার কথা বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখো তোমার মেয়েদেরকে। আমি যেটা বললাম সেই জবাবই দেবে। এমন জবাবের জন্য কিন্তু বাচ্চারা না তোমাদের মতো মায়েরা দায়ী। যারা জোর করে, বাধ্য করে খাওয়াতে গিয়ে জীবন ধারণের সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসটিকেই বাচ্চাদের সবচেয়ে অপছন্দনীয় জিনিসে পরিণত করো।

আলহামদুলিল্লাহ একদম সত্যি কথা বলেছো আম্মি। তোমার কথাগুলো বাচ্চা আদ্দু গাদ্দু সমিতির মায়েদের চেয়ার পারসন আমাদের ছোট মামীকে ট্যাগ করে এক্ষুনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া উচিত। বাচ্চা আদ্দু গাদ্দু সমিতির সদস্যা মায়েদের ফ্রেন্ডলিষ্ট গিজগিজ করে তাদের মতো মায়েরাই। তারা সারাদিনই তাদের বাচ্চারা কিছুই খায় না, দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখ কোঠরে ঢুকে যাচ্ছে, পাঁজরের হাড় একটা একটা করে গোনা যায়। ইত্যাদি ইত্যাদি স্ট্যাটাস দিয়ে সারাক্ষণই হা-হুতাশ করতে থাকেন। তোমার কথাগুলো একবার শুধু কোন ভাবে তাদের যে কোন একজনের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেই হয়েছে। ছড়িয়ে দেয়ার কাজ তারাই করবেন নিজ নিজ দায়িত্বে কিংবা নিজেদের অজান্তেই।        

কিছু কিছু মানুষের কথা কোন কারণে মনের কোনে খুঁটির সাথে আটকা পরে যাওয়া হাসিকে এক টানে খুলে দেয়। তাদের শব্দরা দমকা হাওয়ার রূপে এক ঝাটকাতে উন্মুক্ত করে দেয় মনের রুদ্ধ বাতায়ন। হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করে মিষ্টি আবেশ মাখা সোনালু রোদ। কোন একটি আবেগের দ্বারে থমকে দাঁড়িয়ে থাকা মন হঠাৎ বইতে শুরু করে কূলকুল ধ্বনি তুলে। মাকে উদ্দেশ্যে করে বলা আদীর কথাগুলো শুনে তাইয়্যেবার মনও তেমনি মূহুর্তেই বিরক্তির ডোবা থেকে বেরিয়ে আনন্দের ঝিলে গা ভাসালো। হাসলে শ্বাশুড়ি বিরক্ত হবেন তাই হাসি চেপে মুগ্ধতা ও ভালোবাসা মাখা দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালো তাইয়্যেবা।      

আগামীকাল তোমার প্রেজেন্টেশন আছে না তাইয়্যেবা? প্রশ্ন করলো আদী।

জ্বি। কিন্তু এখনো অনেক কাজ বাকি।

তাহলে তুমি যাও প্রেজেন্টেশন রেডি করো। উনাইশাহকে আমি খাইয়ে দেব ইনশাআল্লাহ।

মনে মনে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে হাসি মুখে নিজের রুমের দিকে ছুট লাগালো তাইয়্যেবা।

প্রচন্ড বিরক্ত চোখে আম্মিকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদী হেসে সালাম দিয়ে পাশে বসে বলল, কেমন আছো আম্মি? তোমার মন মেজাজ ভালো আছে তো?

সালামের জবাব দিয়ে মিসেস নুসরাত বললেন, তোকে না বলেছি সবসময় দুষ্টুমি না করতে আমার সাথে?

আদী হেসে বলল, আচ্ছা এই মূহুর্ত থেকে দুষ্টুমি বন্ধ। বলো কেন ডেকেছো আমাকে?

তোর বাপীর সাথে কথা বলার জন্য। সুস্থ কোন মানুষের পক্ষে তো তোর বাপীকে কিছু বোঝানো সম্ভব নয়। কারণ সবকিছুতে দোষ খুঁজে বের করাটাই বর্তমানে তার জীবনের মিশন। সবার কথার উল্টা বলাটাকেই নিজের পার্সোনালিটি মনে করে। এক কথায় প্রকাশ হচ্ছে তোর বাপী এ টু জেড সাইকো। তাকে বোঝানোর জন্য তাই ঐ লাইনের কাউকেই দরকার।   

আবার কি করেছে আবার বাপী? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো আদী।

আত্মজা ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়তে চাইছে। কিছুতেই পারমিশন দিচ্ছে না তোর বাপী। মেয়ে সারাদিন আমার সাথে ঘ্যানঘ্যান করে বাপীকে রাজী করাও, বাপীকে রাজী করাও। আমি কথা বলতে গিয়েছিলাম তোর বাপী হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ভাবলে কি করে তুমি বলবে আর আমি আমার মেয়েকে দর্জিগিরি করার পারমিশন দিয়ে দেবো?

স্বশব্দে হেসে ফেললো আদী। হেসে ফেললেন মিসেস নুসরাতও। হাসতে হাসতে বললেন, আত্মজাকে এই কথা বলার পর তো মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির। এখন হয় তুই তোর বাপীকে বুঝিয়ে রাজী করা। নয়তো তোর বোনকে বুঝিয়ে মেডিকেলে কলেজে ভর্তি করে দিয়ে আয়। এইসব যন্ত্রণা আমার আর ভালো লাগে না।

আদী হেসে বলল, ঈশার নামাজের পর বেশ অনেকক্ষণ মসজিদে থাকেন বাপী। ঐ সময়টাতে মন মেজাজ বেশ শান্ত থাকে। তখন ইনশাআল্লাহ কথা বলার চেষ্টা করবো। এখন আমার কন্যাকে খাওয়ানো যায় কিনা সেই চেষ্টা করে দেখি। উনাইশার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে আদী বলল, আমার মা কি করছে?

উনাইশাহ হেসে জবাব দিলো, তোমার মা খেলা করছে আদীব্বা।

খেলা করতে করতে কি আমার মা অল্প একটু পাস্তা খাবে? দেখো কত মজা করে আম্মু রান্না করেছে তোমার জন্য। তুমি খেলা করো আর আদীব্বা তোমাকে খাইয়ে দেই। কেমন?

না আমি খাবো না এখন। মাথা নাড়তে নাড়তে বললো উনাইশাহ।

আমার মা’টা কেন খাবে না?

ইচ্ছে করছে না যে।

তাহলে খেতে হবে না। ইচ্ছে না করলে জোড় করে খাওয়া ঠিকও না। আমার মা’র কি করতে ইচ্ছে করছে এখন?

তোমার কোলে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।

মেয়েকে কোলে বসিয়ে আদর করে আদী বলল, ঠিকআছে বসে থাকো কোলে।

এখন তোমার দুষ্টু কথা শুনতে ইচ্ছে করছে।

আদী হেসে বলল, আচ্ছা তাহলে শোনো দুষ্টু কথা। রবীন্দ্রনাথ কি বলেছেন শুনবে? বলেছেন, “কোলে  থাকিলেও নারী রেখো সাবধানে। শাস্ত্র, নৃপ, নারী কভু বশ নাহি মানে।”

নারী কি? প্রশ্ন করলো উনাইশাহ।

আদী হেসে বলল, নারী হচ্ছে তোমার দাদুমণি।  

মিসেস নুসরাত পাশেই বসে ছিলেন। ঢিসুম করে এক ঘুষি লাগিয়ে দিলেন আদীকে। উনাইশাহ সাথে সাথে চিৎকার করে বলল, খবরদার দাদুমণি আমার আদীব্বাকে মারবে না।  

মিসেস নুসরাত বললেন, আমার ছেলেকে আমি একশো বার মারবো তোর কি?

উনাইশাহ বাবার কোল থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাহলে কিন্তু আমি জাল দাদুভাইকে গিয়ে মারবো।

মিসেস নুসরাত হেসে বললেন, তাই? এই কথা আগে বলিসনি কেন? বলতে বলতে ঢিসুম করে আরেকটা ঘুষি লাগিয়ে দিলেন আদীকে।

এক মূহুর্ত দেরি না করে মিসেস নুসরাতের বেডরুমের দিকে ছুট লাগালো উনাইশাহ। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বিজয়ী কন্ঠে বলল, দুইটা ঘুষি দিয়ে এসেছি জাল দাদুভাইকে?

মিসেস নুসরাত জাযাকিল্লাহ বলে আরেকটা ঘুষি দিলেন আদীকে। সাথে সাথেই উনাইশাহ আবারো ছুট লাগালো দাদুকে মারার জন্য। মিসেস নুসরাত হাসতে হাসতে বললেন, তোর বাপী বহুত যন্ত্রণা করে আমাকে। আজ পেয়েছি সুযোগ। তোর খন্নাস মেয়েকে দিয়ে মার খাওয়াতে খাওয়াতে ভর্তা করে ফেলবো আজ তোর বাপীকে। তুই কোন কথা বলবি না। চুপচাপ বসে আমার ঘুষি খেতে থাক।  

আদী হাসতে হাসতে বলল, যাহা বলিবেন আপনি মাতা, বিনা বাক্যে আমি পালন করিবো তা।

যদিও মিসেস নুসরাতের পরিকল্পনা শেষপর্যন্ত সফল হলো না। নাতনীর হাতে তিন ঘুষি খেয়েই  আফজাল সাহেব রুমের দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলেন। হাতের মুঠোয় চতুর্থ ঘুষি নিয়ে দরজা বন্ধ দেখে উনাইশাহ নক করতে করতে বলল, জাল দাদাভাই তুমি কেন দরজা বন্ধ করেছো? এক্ষুণি দরজা খুলে দাও আমি তোমাকে ঘুষি মারবো। নয়তো কিন্তু আমি কান্না করবো।

নাতনীর কান্নার হুমকিও নড়াতে পারলো না আফজাল সাহেবকে। আরো কিছুক্ষণ দরজা বক করে বাবা আর দাদীর কাছে ফিরে এসে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে উনাইশাহ বলল, জাল দাদাভাই দরজা খুলছে নাতো। আমি কিভাবে ঘুষি দেব এখন?   

ছোট বড় সবার সাথেই একই রকম সিরিয়াস আফজাল সাহেবের আচরণ। নাতনীর হাতে ঘুষিকে মোটেই বিনোদন হিসেবে নেবেন না তিনি সেটা খুব ভালো করেই জানা আছে আদীর। তাই উঠে গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, উনাইশাহ তুমি কি দেখেছো দাদুমণির হাত কত্তো বড় আর তোমার হাত কত্তো ছোট্ট?

একবার নিজের হাতের দিকে আরেকবার দাদুমণির হাতের দিকে তাকিয়ে উনাইশাহ বলল, আমি তো ছোট মানুষ তাই আমার হাতও ছোট।

এবং ছোট বলে তোমার হাতে শক্তিও তো অনেক কম। দাদুমণির ঘুষিতে আদীব্বা অনেক ব্যথা পেয়েছি। কিন্তু তোমার ঘুষিতে তো দাদাভাই একটু ব্যথা পায়নি।

আমি কি জাল দাদাভাইকে আরো তিনটা করে ঘুষি দিয়ে আসবো।

কিন্তু আবারো তো দাদাভাই ব্যথা পাবে না।

তাহলে? চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলো উনাইশাহ।

তাহলে এখন একটাই উপায়। তুমি জটপট দাদুমণির হাতে পাস্তা খেয়ে নাও। আর আদীব্বা তোমার জন্য বড় এক গ্লাস দুধ নিয়ে আসছি। পাস্তা আর দুধ খেলে তোমার হাতে অনেক শক্তি এসে যাবে ইনশাআল্লাহ। এরপর হবে দাদাভাইয়ের সাথে বক্সিংয়ের ফাইনাল রাউন্ড।

ছুটে গিয়ে দাদুমণির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো উনাইশাহ। বলল, দাদুমণি তাড়াতাড়ি আমাকে পাস্তা খাইয়ে দাও। আদীব্বা তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও দুধ নিয়ে এসো আমার জন্য। তাড়াতাড়ি যাও।

মিসেস নুসরাত নাতনীতে কোলে বসিয়ে পাস্তার প্লেট টেনে নিলেন হাসি মুখে। আদীও হাসি মুখে দুধ আনার জন্য রান্নাঘরে রওনা দিলো। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন