রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...১৫



ফজরের নামাজের সময় জাওয়াদকে মসজিদে না দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো নাবিহার। তারমানে পাপা নিশ্চয়ই রাতেই আবার হসপিটালে চলে গিয়েছিলেন কোন কারণে। গত তিন মাস ধরে প্রতিদিন নিজ হাতে পাপা আর দাদীর জন্য চা বানায় সে। ফজরের পরে পাপা আর দাদীর গল্পের আসরে নিজের জন্যও একটা পাকাপোক্ত সীট দখল করে ফেলেছে নাবিহা গত তিন মাসে। যেদিন সকালে পাপা আর দাদীর সাথে গল্প করা হয়ে ওঠে না সেদিনের শুরুটাকেই কেমন যেন পানসা লাগে। মনে পড়লো এই কথাটা যেদিন বলেছিল জবাবে পাপা হেসে বলেছিলেন, যখন আমরা কোন কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, তখন হঠাৎ সেই জিনিসটা শূন্যতা আমাদের মনে প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। তাই কোন কিছুর সাথে অভ্যস্ত হতে চাইলে হতে পারো সমস্যা নেই। কিন্তু কোন কারণে সেই জিনিসটা যদি না পাও এবং তখন যাতে তোমার মন থমকে দাঁড়িয়ে না যায় সেজন্য অলটারনেটিভ কিছুর আয়োজন করে রাখবে আগে থেকেই। এটা না হলে আমার চলবেই না এটা হচ্ছে বোকা চিন্তা। বুদ্ধিমানের চিন্তা থাকে কোন কারণে যদি এটা না হয় বা না পাই, তাহলে আমি ওটা দিয়ে চালিয়ে নেবো ইনশাআল্লাহ। তাই যেদিন ভোরে পাপা থাকবো না তুমি আর দাদী মিলেই চা পান করতে করতে গল্প করবে। কিংবা বাড়ির কোন সদস্যকে সেদিন তোমার সাথে প্রভাতী চা পানের নিমন্ত্রণ দেবে। পাপার কথার স্মরণে হাসি ফুটে উঠলো নাবিহার মুখে। এই সময় রান্নাঘরে চাচী, খালামণি বা ফুপ্পিদের কাউকে না কাউকে অবশ্যই পাওয়া যাবে। যাকে পাওয়া যাবে তাকেই আজ প্রভাতী চা পানের নিমন্ত্রণ জানাবে ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলো নাবিহা।  

কিন্তু রান্নাঘরের দরজায় পৌঁছে যাকে দেখলো তাকে দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না নাবিহা। আনন্দবাড়িতে সবচেয়ে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার রেকর্ড বহু বছর ধরে অটুট রেখে চলছেন যেই রাহা খাম্মি, সেই রাহা খাম্মি কিনা এত ভোরে ডিমের অমলেট তৈরি করছে? বেশ অবাক হলেও হেসে সালাম দিলো নাবিহা।

পেছন ফিরে তাকিয়ে নাবিহাকে দেখে হাসি মুখে সালামের জবাব দিয়ে রাহা বলল, নাবিহা কিছু লাগবে আম্মু?

নাবিহা হেসে বলল, না খাম্মি কিছু লাগবে না। আমি রান্নাঘরে যাকেই পাবো তাকে আমার সাথে প্রভাতী চা পানের নিমন্ত্রণ দিতে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি তো মনেহয় এখন ঘুমোতে যাবে আবার?

রাহা হেসে বলল, তোমার সাথে বসে প্রভাতী পান করার জন্য একদিন কেন প্রতিদিনের ঘুম বিসর্জন দিতে পারে তোমার খাম্মি। ফজরের নামাজের পর প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছিল তাই টোস্ট আর অমলেট বানাচ্ছি। তুমি খাবে? বানাবো তোমার জন্য?

নাবিহা হেসে বলল, ওকে খাবো। কিন্তু আমার টোস্ট বাটার ফ্রি করো।

এখনই এতো ডায়েট? তুমি তো একদমই তোমার মামণির মতো হয়েছো। তোমার মামণিও বারো বছর বয়স থেকে বাটার খাবো না, মসলা খাবো না করে করে আমাদের মামণির জীবন অতিষ্ট করে তুলেছিল।

নাবিহা হেসে বলল, খাম্মি তোমাদের ছোটবেলার গল্প বলো। মামণিকে নিয়ে মজার কোন গল্প।

রাহা হেসে বলল, তোমার মামণির সব কর্মকান্ডই তো মজা লাগে আমার কাছে। আচ্ছা চলো আজ তোমাকে আমাদের জীবনের এক শিহরণ জাগানো স্মৃতিকথা বলি।

শিহরণ জাগানো স্মৃতিকথা?

রাহা হেসে বলল, হ্যা। আমি সামান্য একটু ফাঁকিবাজ স্বভাবের সেটা তো নিশ্চয়ই এতদিনে কিছুটা বুঝতে পেরেছো।

খিলখিল করে হেসে ফেললো নাবিহা। খুব ভালো মতোই জানা আছে শুধু ফাঁকিবাজ না রাহা খালামণি হচ্ছে বাড়ির অ্যাওয়ার্ড ধারী ফাঁকিবাজ।

রাহাও হাসতে হাসতে বলল, জীবনে একবারই আমি সমস্ত ফাঁকিবাজি ছেড়ে দিয়ে ভালো হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অবশ্য পরবর্তীতে যে সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকা সম্ভব হয়নি সেটা তো বুঝতেই পারছো। ছোটবেলায় পড়াশোনার ক্ষেত্রে আমাদের ভাইয়াদের করা কঠিন একটা নিয়ম ছিল পুরো বই অবশ্যই পড়তে হবে সবাইকে। বেছে বেছে প্রশ্নের উত্তর পড়ার কোন সুযোগ তাই আমাদের কারো ছিল না। কিন্তু আমি যেহেতু সুযোগ সন্ধানী তাই শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও সুযোগ খুঁজেই  নিতাম। আমরা ক্লাস টেনে উঠার পরপরই বাবা-মামণিকে কিছু প্রয়োজনে নিউজিল্যান্ড যেতে হয়েছিল দুই মাসের জন্য। আমাদের মামণি যদি পাশে ফুপির বাসায়ও যেতেন তাও তোমার মামণিকে চেপে ধরে সাথে করে নিয়ে যেতেন। সেখানে নূহাকে ছেড়ে দুই মাসের জন্য মামণি নিউজিল্যান্ড যাবেন এটা কল্পনাও বাইরে। আবার তোমার মামণির যাওয়া মানে সাথে আমারো যাওয়া। ব্যাস বইপত্র সাথে নিয়ে আমরা দুই বোন উড়াল দিলাম বাবা-মামণির সাথে।

নাবিহা হেসে বলল, ইশশ, অনেক মজা করেছিলে তোমরা তাই না?   

রাহা হেসে বলল, আমি অনেক মজা করেছিলাম। যেহেতু বড় মামার বাসায় উঠেছিলাম। আমাদের সমবয়সী দুই বোন ছিল। সারাদিন গল্পগুজব আর হৈহুল্লোর করে কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু শত কিছুর মাঝেও নূহা পড়াশোনায় কখনোই ফাঁকি দেয়নি। কিন্তু আমি ধরতে গেলে কিছুই পড়িনি সেই দুই মাস। দেশে আসার পর তো মহা বিপদে পড়ে গেলাম। এদিকে ১ম সাময়িক পরীক্ষাও নাকের ডগায়। এত পড়া কিভাবে শেষ করবো বুঝতে না পেরে এক ক্লাস ফ্রেন্ডের দেয়া সাজেশন ফলো করতে লাগলাম। সে আবার স্কুলের টিচারদের কাছে কোচিং করতো। প্রথম চার-পাঁচটা পরীক্ষাতে সেই ফ্রেন্ডের দেয়া সাজেশন অনুযায়ী সব কমন পড়াতে ওর দেয়া সাজেশনের উপর এমন বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে এর বাইরে পড়াই ছেড়ে দিলাম। এরপরের দুই পরীক্ষা সেই বিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দিলো। ধরা খেলাম গিয়ে ফিজিক্স পরীক্ষার দিন। যখন দেখলাম দুই-তিনটা প্রশ্ন ছাড়া আর সবই আনকমন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো আমার। কারণ আমি সাজেশনের বাইরে একটা লাইনও পড়িনি। এমন জোরে জোরে হার্টবিট হচ্ছিলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম নিজেই। টুকটাক যা কিছু তো জানা ছিল তাও ভুলে গেলাম ভাইয়াদেরকে কি জবাব দেব সেই ভয়ের চোটে। তবে মনের মাঝে উথাল-পাতাল ঝড় নিয়েও লেখা চালিয়ে গিয়েছি। কি লিখছিলাম নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। এমনিতে জানা বিষয়ও আরেকবার নিশ্চিত হবার জন্য আমার সামনের সীটে বসা তোমার মামণীর পিঠ ছিদ্র করে দিতাম কলমের খোঁচা দিতে দিতে। কিন্তু আমার সকল বিপদের  সাথী, ঘোর আঁধারের বুকে এক টুকরো আলো রূপী বোনকেও ডাকতে ভুলে গিয়েছিলাম সেদিন। মাথার মধ্যে শুধু ঘুরছিল প্রশ্ন কমন পড়েনি এই কথা কিভাবে বলবো ভাইয়াদেরকে? কেন সিলেবাসের সব পড়া পড়িনি এর কৈফিয়তই বা কি দেবো? এর মাঝে একঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে। এতক্ষণ কি লিখেছি দেখার জন্য খাতায় চোখ বুলাতে গিয়ে তো প্রচন্ড শব্দে মাথায় বাজ পড়লো। ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি, বায়োলজি, সমাজবিজ্ঞান মিলিয়ে এমন খিচুড়ি পাকিয়েছিলাম পরীক্ষার খাতায়! আল্লাহ গো এখনো সেই স্মৃতি স্মরণে হৃদপিণ্ড রেসের ঘোড়া হয়ে যাচ্ছে।

রাহার কথা আর বলার স্টাইল শুনে হাসতে হাসতে নিজেকে সামলাতে গিয়ে তাড়াতাড়ি পাশ থেকে চেয়ার টেনে বসেই পড়লো নাবিহা।

রাহাও হাসতে হাসতে বলল, এখন তো তোমার সাথে হাসছি। কিন্তু ঐ সময় পরীক্ষায় হলে মাথা ভনভন করে ঘোরা শুরু করেছিল খাতার অবস্থা দেখে। মনে হচ্ছিলো এক্ষুণি পড়ে যাব সীট থেকে। এমনিতে আমার কলমের খোঁচা না খাওয়ার আগ পর্যন্ত নূহা কখনোই পেছনে তাকাতো না। কিন্তু সেদিন কি মনে করে যেন পেছনে ফিরে তাকিয়েছিল। আমার চেহারা দেখেই বুঝে নিয়েছিল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। নূহার চেহারা দেখার পর তো আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম  না। স্যার কান্নারত আমাকে দেখে জানতে চাইলেন কি হয়েছে? মাথা ঘুরাচ্ছে বলাতে স্যার বললেন গিয়ে হাত-মুখে পানি দিতে আসতে। ওয়াশ রুম থেকে এসে দেখি ডেক্সের উপর আমার বদলে নূহার খাতা। নূহার দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রাণপণে লিখে যাচ্ছে। কারণ মাত্র ৪০ মিনিট বাকি পরীক্ষা শেষ হতে।পরে জেনেছিলাম আমি ওয়াশরুমে যাবার স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নূহা খাতা বদল করেছিল। নূহা আর আমার হাতের লেখা প্রায় একইরকম। খুব ভালো করে খেয়াল না করলে পার্থক্য বোঝা যায় না। আমাদের বোনদের সবকিছু একই রকম থাকবে এই লক্ষ্যে আমরা সবাই একই রকম হাতের লেখা বানিয়েছিলাম অনেক প্র্যাকটিস করে সেটা তো তুমি জানোই।

নাবিহা হেসে বলল, জ্বি খাম্মি আমি জানি। এরপর কি হলো? তোমরা কি ধরা পড়ে গিয়েছিলে?

রাহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সেই দুঃখের কথা আর জিজ্ঞেস করো না গো মা। এই ভয়াবহ ঘটনাটি এখানেই সমাপ্তি ঘটতে পারতো। কিন্তু বিঁধি বাম বলেও তো একটা কথা আছে। তাই নূহা পরীক্ষার খাতা, মূলত আমার পরীক্ষার খাতা নিয়ে তোলপাড় কান্ড বেঁধে গেলো। আমাদের ফিজিক্স স্যার পরীক্ষার খাতা দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না উনার কলিজার টুকরা নূহা এই সব লিখতে পারে। বিঁধি বাম হবার আরেকটা কারণ হচ্ছে ফিজিক্স স্যার আমাদের চাচ্চু ছিলেন। বাবার খালাতো ভাই। চাচ্চু পারসোনালি নূহাকে ডেকে কথা বলেও শান্ত হলেন না। সেই খাতা নিয়ে  বাড়িতে চলে এলেন বাবাকে দেখানোর জন্য। কিন্তু তোমাকে আগেই বলেছি বিঁধি বাম বলে কথা। ঐ সময় তোমাদের পাপা মানে আমাদের ভাইজান দেশে এসেছিলেন বিজনেস মিটিং অ্যাটেন্ড করার জন্য। ফিজিক্স চাচ্চুর হাত থেকে খাতা নিয়ে চোখ বুলিয়ে ভাইজান ‘হোয়াট দ্য’ বলে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

আরেক চোট কিছুক্ষণ হাসির ফুলঝুরি ছোটালো খালা-ভাগ্নী মিলে। এরপর রাহা বলল, কিছুক্ষণ পর পুরো পরিবার হল রুমে একত্রিত হলো। সবার সামনে অবনত মস্তকে তোমাদের মামণি দন্ডায়মান। আমার মনেহচ্ছিলো ভূমিকম্প হচ্ছে। কারণ চোখের সামনে পুরো বাড়ি দুলছিল। ভাইজান ঘটনাক্রমে ঘটনাস্থলে উপস্থিত না হলে আসলে বিপদের মাত্রা এত প্রকট আকার ধারণ করতো না। ভাইজান গম্ভীর গলার নূহাকে প্রশ্ন করলেন, এসব কি? নূহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিলো, মানুষের ভুল হতেই পারে। এটা নিয়ে এমন সিন করার কি আছে? সবকিছুতেই বেশি বেশি বাড়াবাড়ি এই বাড়ির লোকজনের। কোন একটা ঘটনাকে সহজ ভাবে নিতে পারে না কেউ। মিটিং-মিছিল শুরু করে দেয়। আমি কারো কাছে কোন কৈফিয়ত দিতে পারবো না এই ব্যাপারে। নূহার মুখে এমন কথা শুনে তো সবাই অবাক হয়ে গেলো। ভাইজান কন্ঠস্বর আরো গম্ভীর করে বললেন, তুমি কি বুঝতে পারছো কি বলছো?  নূহা সাথে সাথে জবাব দিলো, জ্বি আমি যা বলি বুঝেই বলি। এই ব্যাপারে আমি কোন কথা বলবো না বলেছি মানে হচ্ছে বলবোই না। শাস্তি দিতে চাইলে দাও। ভাইজান তখন রাগ করে খাতা টেবিলের উপর রেখে উঠে চলে গেলেন। কিন্তু মামণির যেন হঠাৎ কি হলো। উঠে এসে নূহাকে প্রচন্ড এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, কিছুই বলা হয় না তারমানে কি তুই বড়দেরকে সম্মান করে কথা বলা ভুলে যাবি? দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে। তোর চেহারা দেখতে চাই না আমি। নূহা তখন চুপচাপ রুমে চলে গেলো।

নানুমণি তার মামণিকে মেরেছে শোনার সাথে সাথে নাবিহার এতক্ষণ ধরে হাস্যেজ্জল চেহারাটা হঠাৎ ম্লান হয়ে গেলো। রাহা নাবিহাকে আদর করে হেসে বলল, আসলে ঘটনাটা এমন ভাবে পেঁচিয়ে গিয়েছিল আমি যে কাউকে কিছু বলবো সেই সাহসই করতে পারছিলাম না। খুবই অসহায়ত্ব নিয়ে রুমে গিয়ে দেখি নূহা নির্বিকার বসে পড়ছে। আমাকে ঢুকতে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলো, আগামীকাল বায়োলজি পরীক্ষার জন্য সাজেশন লাগবে সিস? নূহাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সেদিন প্রমিস করেছিলাম জীবনে আর কোনদিন কোন ব্যাপারে আমি ফাঁকিবাজি করবো না। বলতে বলতে রাহার কন্ঠস্বর আবেগাপ্লুত হয়ে গেলো।

নাবিহা তখন দুহাতে রাহাকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, তুমি দেখছি এখনো কান্না করছো খাম্মি।

চোখ মুছে নিয়ে মুখে হাসি টেনে রাহা বলল, ঐদিন কান্নাকাটি শেষ করে কিছুটা শান্ত হয়ে তোমার মামণিকে বললাম, তুই এত অদ্ভুত কেন? এমন ভান করছিস যেন কিছুই হয়নি। নূহা হাসতে হাসতে বলেছিল, শোন খাতা এক্সচেঞ্জ করার সময়ই আমি জানতাম এটা নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটবে। ফিজিক্স চাচ্চু যে খাতা নিয়ে বাড়িতে চলে আসবেন সেই ব্যাপারেও সন্দেহ ছিল না। ভাইয়া যেহেতু এখন দেশে তাই পারিবারিক বৈঠক বসবে এটা নিয়ে সেটাও জানা ছিল। তাই শুধুমাত্র মামণির থাপ্পড় ছাড়া বাকি সবকিছুর জন্যই মোটামুটি প্রস্তুত ছিলাম। আর একথা তো তুমিও জানো যে, প্রস্তুতি থাকলে অনেক বড় ঝড়ের মোকাবিলাতেও মানুষ টিকে যেতে পারে অবলীলায়। তবে মামণির থাপ্পড়টা আমার জন্য শান্তির কাজ করেছে। ভাইয়া প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচার ওভাবে কথা বলা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আমার জায়গায় ভাইদের কেউ হলে ভাইয়া নিজেই দুইটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিতেন ওভাবে কথা বলার শাস্তি স্বরুপ। কিন্তু আমাদের গায়ে উনি হাত দেবেন না। রাগ করে উঠে চলে যাবেন। আর ভাইয়া উঠে যাওয়া মানে বিনা বিচারে তালগাছ আমার। কিন্তু ভাইয়া যখন রাগ করে উঠে চলে যাচ্ছিলেন খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছিলো নিজেকে। মামণির থাপ্পড় সেই অপরাধ বোধটাকে কমিয়ে দিয়েছে অনেকখানিক। আমি তখন হাতের উপর হাত রেখে বললাম, আই এম রিয়েলি ভেরি সরি। প্রমিস আর কখনোই এমন বোকামি করবো না আমি ইনশাআল্লাহ। নূহা হেসে বলেছিল, সরি আসলে আমার বলা উচিত। তুমি যে বোকার সর্দারনী বুক্কুশী সেটা তো আমি জানিই। আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল তোমার দিকে। যখন নিউজিল্যান্ড ছিলাম তোমাকে জোড় করে পড়তে বসানো উচিত ছিল। দেশে ফেরার পর তুমি ঠিকমতো পড়াশোনা করেছো কিনা সেটা দেখা উচিত ছিল। কিন্তু আমি আমার বোনের দিকে খেয়াল করিনি। তার পরীক্ষার প্রিপারেশনের অবস্থা জানতে চাইনি। পরীক্ষার প্রশ্ন হাতে পাবার পর বোনের দিকে তাকিয়ে সবকিছু ঠিক আছে নিশ্চিত না হয়েই নিজে পরীক্ষা দিতে মগ্ন হয়ে গিয়েছি। এইসব আমার ভুল। সেজন্যই তো শাস্তিও আমি নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছি। তাই আমি প্রমিস করছি এরপর থেকে তোমাকে কখনোই এমন ভুল করতে দেবো না ইনশাআল্লাহ। কবির ভাষায়-" সকল ভুলের তরে রাখবো তোমায় ঘিরে, বারংবার ব্যর্থতায় ভুল যাবে তোমায় ছেড়ে।"

নাবিহা হেসে বলল, তখন কি মামণি আর পাপার বিয়ে ঠিক হয়েছিল খাম্মি?

রাহা হেসে বলল, না। তোমার পাপা-মামণির বিয়ে এই ঘটনারও প্রায় দুই বছর পর হয়েছিল।

আচ্ছা এরপর কি হলো বলো।

এরপর তো আমরা দুজন বায়োলজি পরীক্ষার প্রিপারেশন নিলাম। পড়া শেষ করেই নূহা আমাকে ধরে টানতে টানতে রান্নাঘরে ছুট লাগালো। রান্নাঘরে ঢুকেই বলল, চিংড়িমাছ বের করো মালাইকারীর জন্য। ইলিশ মাছের পাতুরি রান্না করবো। পুঁইপাতা লাগবে। ইয়া বড় বড় পুঁইপাতা। কোত্থেকে জোগার করবে আমি জানি না। ব্যাস এনে দিতে হবে আমাকে। মামণিকে যে রান্নার কাজে সাহায্য করতেন তিনি বললেন, কিন্তু বেবী রাতের রান্না হয়ে গিয়েছে। নূহা বলল, সব ফ্রিজে রেখে দাও। ভাইয়াদের জন্য রান্না আমি করবো। তুমি পুঁইপাতা এলে দাও পাতুরির জন্য। আসলে ঈদের সময় ছাড়া ভাইয়া দেশে এসে দুই-চার দিনের বেশি কখনোই থাকতেন না। ভাইয়াদের জন্য রান্না করা নিয়ে মামণি আর নূহার ফাইট চলতো সেই দুই-চার দিন। মামণি নিজ হাতে পুত্রদের জন্য রান্না করতে চাইতেন। কিন্তু নূহার যুক্তি ছিল, সারাজীবন তো তুমিই রান্না করে খাইয়েছো। এখন ভাইয়ারা আমাদের রান্না খাবে। অন্যদিন হলে রান্না হয়ে যাবার পর রান্না করার জেদ ধরলে মামণি বকা দিত নূহাকে। কিন্তু কন্যাকে মেরে মামণি নিজেই বেদনার সাগরে ভাসছিলেন। তাই একজনকে পাঠালেন সেজ খালামণির বাড়ির সব্জি বাগান থেকে পুঁই পাতা নিয়ে আসার জন্য।

তোমাদের সেজ খালামণি মানে আমাদের আগের চাদী মণি?

রাহা বলল, হুম। আফিয়া খালামণি অনেক মজার ছিলেন। বাপীও তখন এত বেশি খিটপিট করতো না। খালামণি মারা যাবার পর থেকে বাপী এমন হয়ে গিয়েছেন। যাইহোক, পুঁইপাতা এসে পৌঁছতে পৌঁছতে তোমার নানুমণি আর মামণির ভাব হয়ে গেলো। আফিয়া খালামণিও পুঁইপাতার সাথে সাথে বাপীকে নিয়ে নিজেও হাজির হয়ে গিয়েছিলেন পাতুরি খাবার জন্য। আগে রান্না করা সব খাবার তুলে রেখে ভাইজানের জন্য চিংড়ির মালাইকারী, ইলিশ মাছের পাতুরি, তেলাপিয়া মাছের দোপেয়াজা রান্না করলো মামণি আর নূহা মিলে। তোমাদের আদীব্বা মাছ খায় না তাই উনার জন্য লেমন  চিকেন, বীফ কারী আর ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে আলুভাজি করা হলো। আফিয়া খালামণি আর আমিও অবশ্য ছিলাম সহকারী হিসেবে। কিন্তু সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটলো রাতে খাবার টেবিলে।

কি ঘটনা খালামণি? চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো নাবিহার।

রাহা হাসতে হাসতে বলল, ভাইজান উনার জন্য করা মজার মজার কোন খাবারে হাত না দিয়ে শুধু সালাড তুলে নিলেন প্লেটে। মামণি ভাইজানের প্লেটে খাবার দিতে গেলে ভাইজান বললেন, কোন অবাধ্য মেয়ের হাতের রান্না করা খাবার আমি খাবো না। মামণি আমি সিরিয়াসলি তোমাকে একটা কথা বলে যাচ্ছি। আগামীকাল থেকে তোমার ঐ অবাধ্য মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করবে। বাড়ি থেকে এই মেয়ে বিদায় হবার আগে আমি আর দেশে আসবো না। নূহার চেহারাটা তখন দেখার মতো হয়েছিল। কারন এই ঝড়ের জন্য তোমার আবহাওয়াবিদ মামণি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। শরতের আকাশের মত রোদুজ্জল চেহারা তাই হঠাৎ ঢেকে গিয়েছিল ঘন কালো মেঘের আঁধারে।

নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, তারপর কি হলো? পাপা কি সত্যিই কোন খাবার খায়নি সেদিন?

রাহা হেসে বলল, বলছি সব। কিছু ফিজিক্যাল সমস্যার কারণে হঠাৎ করে ওজন বাড়তে শুরু করেছিল আফিয়া খালামণির। খালামণি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ওজনে সেঞ্চুরির রেকর্ড করার পর ওজন কমানোর জন্য এক্সারসাইজ করা শুরু করবেন। সেঞ্চুরি হতে মাত্র তিনশো গ্রাম বাকি ছিল খালামণির। খাবার সামনে পাবার সাথে সাথেই তাই চারপাশের সবকিছু ভুলে খাদ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ভাইজানের মুখে পাত্র খোঁজা শব্দটা কানে যাবার সাথে সাথে মুখ তুলে তাকিয়ে বিরাট হাসি দিয়ে  বললেন, আমার সন্ধানে একটা ভালো পাত্র আছে। হেঁজিপেঁজি স্বভাবের ছেলে তোদের খন্নাস বোনের জন্য একদম পারফেক্ট হবে। অবাধ্যতা করলেই সকাল-বিকাল ছ্যাচা দিয়ে কন্ট্রোলে রাখতে পারবে তোদের বোনকে। ভাইজান বললেন, কি সব অদ্ভুত শব্দ বলো খালামণি। খালামণি বলল, তুই শব্দ ধরছিস কেন? পয়েন্ট ধর। ভাইজান বললেন, ধরার মত পয়েন্টটা কোথায় যে ধরবো? খালামণি বলল, পয়েন্ট হচ্ছে বাড়ি থেকে অবাধ্য মেয়ে দূর করার জন্য উদ্ধারকর্মী পাওয়া গিয়েছে। ভাইজান বললেন, কে সেই উদ্ধারকর্মী? খালামণি হেসে বলল, ঐ যে বললাম হেঁজিপেঁজি স্বভাবের একটা ছেলে আছে আমার সন্ধানে। খাওয়া শেষ করতে দে পরে তোকে ডিটেইল বলছি। তুই বীফ কারীর বাটিটা এদিকে দে। ভাইজান বাটি সরিয়ে বললেন, আর এক টুকরোও না। স্যালাড নাও বেশি করে। খালামণি তখন বলল, অনেক গবেষণা করে আমি তোর সারাক্ষণ রেগে থাকার রহস্য বের করেছি। ঘাস-লতা-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করিস বলেই তোর মুখে কোন রস নেই। স্যালাড খাইলে আমার চেহারাও তোর মতো পার্মানেন্ট ভোঁতা হয়ে যাবে। তোর বাপীর বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। ভীমরতিতে পাবার বয়স এটা। এখন তাই আমার চেহারা সুরাত ঠিক রাখা জরুরি। সুতরাং নো স্যালাড। গোশতের বাটি দে নয়তো এঁটো হাতের থাপ্পড় খাবি। ভাইজান গোশতের বাটি দিয়ে বললেন, এই বদ্ধ উন্মাদে ভরা বাড়িতে আমি কেন আসি আল্লাহ জানেন। খালামণি বলল, ভুলে যাচ্ছিস কেন তুই হেড অব দ্য বদ্ধ উন্মাদে ভরা বাড়ি। এবার তাহলে ভেবে দেখ তুই কত বড় উন্মাদ বলে তোকে আমরা আমাদের নেতা নির্বাচন করেছি। কথোপকথনের এই পর্যায়ে আর টেবিলে বসে থাকা কারো পক্ষে হাসি চেপে রাখা সম্ভব হলো না। ভাইজানও হেসে ফেললেন সবার সাথে। আর হাসি মানেই রাগ বাসি। ভাইজানও তখন রাগ ভুলে গিয়েছিলেন।

নাবিহা হাসলেও আফসোস ভরা কন্ঠে বলল, আগে তোমরা অনেক মজা করতে তাই না খাম্মি?

রাহা হেসে বলল, হুম, আলহামদুলিল্লাহ। নাটকীয়তায় ভরপুর ছিল আমাদের আনন্দবাড়ির প্রতিটা দিন।

আমাকে তোমাদের সেসব দিনের সব গল্প শোনাবে খাম্মি? আমি আরো শুনতে চাই তোমাদের দুষ্টুমির কথা, পাপা-মামণির কথা, আদিব্বার কথা। তুমি আমাকে বলবে?

রাহা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ অবশ্যই বলবো মা। কিন্তু আগে এসো আমরা নাস্তা করে নেই। এরপর প্রভাতী চা পান করতে করতে তোমার পাপা-মামণির মজার কোন গল্প শোনাবো।

নাবিহা হাসিতে বিকশিত হয়ে বলল, ঠিকআছে খাম্মি চলো আগে নাস্তা করে নেই আমরা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন