রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...১০




সকাল থেকেই আজাদ সাহেব সুযোগ খুঁজছিলেন নূহার সাথে একান্তে বসে কথা বলার। খেয়াল করেছেন গত দু’তিন মাসে বেশ বদলে গিয়েছে নূহা। বাড়িতে আসছে প্রায়ই। আগে এলে শুধুই বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতো। কিন্তু এখন বাড়ির সবার সাথেই অনেক স্বাভাবিক আচরণ করে। দু’একদিন এসে সবার জন্য রান্নাও করে। আজাদ সাহেব অনুভব করছিলেন সেই নূহা আবারো ফিরে আসতে শুরু করেছে যার দুষ্টুমির পরশে বাড়ির প্রতিটা সদস্য কম-বেশি অতিষ্ট ছিল। তবে দুষ্টূমির দ্বারা নূহা সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিতো জাওয়াদকে। গড়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একবার নূহাকে আজাদ সাহেব আর সুরাইয়ার কাছে এনে জাওয়াদ বলল, এই নেন বুঝিয়ে দিয়ে গেলাম আপনাদের মেয়ে আপনাদেরকে। আপনাদের দুইজনকে সাবধান করে বলে যাচ্ছি এরপর যদি আবার উপরে পাঠান মেয়েকে এবং পরবর্তীতে তার হাড়-গোড় দুমড়ানো মোচড়ানো পান সেই দায় আমার থাকবে না। কারণ সারাক্ষণ থাপ্পড় দেয়ার মতো কাজকর্ম করে আপনাদের মেয়ে। আজাদ সাহেব আর সুরাইয়া তখন মনের আনন্দে হাসতেন। কখনো যদি দু’চার দিন পেরিয়ে যেত টেনশনে পড়ে যেতেন দুইজন ভেবে যে ঘটনা কি জাওয়াদ আর নূহার হৈচৈ শোনা যাচ্ছে না কেন বাড়িতে? দুষ্টুমি করতে করতে সত্যি সত্যিই কোন সমস্যা হয়নি তো আবার। একদিন তো টেনশনে স্থির থাকতে না পেরে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে কান পেতে ছিলেন নূহা আর জাওয়াদের রুমে।    

প্রায় সাথে সাথেই নূহার কন্ঠ শুনতে পেয়েছিলেন। জাওয়াদকে উদ্দেশ্যে করে বলছিল, বেড়িয়ে যাও আমার রুম থেকে তুমি। এই মূহুর্তে বেড়িয়ে যাও। জবাবে জাওয়াদ বলেছিল, তুমি বলার আগে থেকেই আমার প্রচন্ড ইচ্ছে হচ্ছে যে রুমে তোমার মত বেয়াদব মেয়ে থাকে সেই রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে। নূহা বলল, আচ্ছা তাহলে যাচ্ছেন না কেন শুনি? কে আপনার পায়ে ধরে রেখেছে? জাওয়াদের জবাব ছিল, কাউকে পা ধরার সুযোগ দিলেই না সে ধরবে। আমি যাচ্ছি না মানবতাবোধের কারণে। কেননা আমি ‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর’ এই তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাই আমি চাই না আমার কারণে কারো উপর লানত বর্ষিত হোক। নূহা প্রশ্ন করলো, মানে কি? জাওয়াদ জবাব দিয়েছিল, মানে হাদীস পড়োনি? স্বামী রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রি যাপন করলে সেই স্ত্রীর উপর সারারাত ফেরেশতারা লানত বর্ষণ করেন। তুমি রাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য রুমে রাত্রী যাপনের মত কাজ করার পরও আমি রাগ না করে, রুম থেকে বেরিয়ে না যেয়ে তোমাকে ফেরেশতাদের লানত থেকে রক্ষা করতে চাইছি। এটা কি আমার উদারতা নয়? হেসে উঠেছিল তখন নূহা। হাসতে হাসতে বলেছিল, উদারতা না ছাই। ভন্ড দ্য গ্রেট। এরপর থেকে আর কখনোই আড়ি পাততে যাননি আজাদ সাহেব আর সুরাইয়া। বুঝতে পেরেছিলেন সশব্দে হোক বা নিঃশব্দে তাদের মেয়ে আর জামাইয়ের দিনকাল দুষ্টুমি আর হাসি আনন্দেই কাটে সবসময়। প্রাণ ভরে সেদিন রবের শুকরিয়া আদায় করেছিলেন তাদের মেয়ের জীবনে জাওয়াদের মতো এমন অসাধারণ জীবনসাথী দেবার জন্য।

অবশ্য নূহার শত আবদার, অকারণ জেদ, সারাক্ষণ দুষ্টুমি জাওয়াদ মেনে নেবে নাতো কে নেবে? নূহার জন্য অপরিসীম ত্যাগ না করাটাই বরং অস্বাভাবিক জাওয়াদের জন্য। একদম ছোটবেলা থেকেই নূহার খুশির জন্য, কোন কষ্ট যাতে নূহাকে স্পর্শও করতে না পারে সেজন্য সদা জাগ্রত অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করে আসছে জাওয়াদ। যখনই নূহার ছোটবেলার কথা চিন্তা করেন নিজের চেয়ে জাওয়াদকেই আদর্শ অভিভাবকের স্থানে দন্ডায়মান দেখতে পান। এমনি একদিন বাগানে দু’পা ছড়িয়ে রঙ- তুলি হাতে পাতাবাহার গাছের পাশে নূহাকে বসে থাকতে দেখে পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে পেছন থেকে চোখ চেপে ধরেছিল জাওয়াদ।  

ভাইয়া দুষ্টুমি করো না। দেখছো না আমি কাজ করছি। এক মূহুর্ত দেরি না করে বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠেছিল নূহা।

পাশে বসে হাসিমুখে জাওয়াদ বলেছিল, তুমি কি করে বুঝলে যে ভাইয়া তোমার চোখ চেপে ধরেছে?

আমি সব বুঝি।

তাই? কিন্তু কিভাবে?

বুঝি তো। কথা বলো না আমি কাজ করি তো।

আচ্ছা। কিন্তু কি এত কাজ আমার ছোট্ট নূহা বেবীটা?

ভাইয়া দেখো এই পাতাটাতে তেরোটা ইয়োলো বিন্দু। কিন্তু এটাতে মাত্র নয়টা। তেরো থেকে নয় বিয়োগ করলে থাকবে চার। মানে চারটা বিন্দু কম। ঐ পাতাটাতে বেশি বিন্দু তো তাই এই পাতাটার মন খারাপ। দেখো কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই আমি ওর গায়েও বিন্দু এঁকে দিচ্ছি। তিনটা বিন্দু এঁকে দিয়েছি। আরেকটা বাকি। আমাকে বিরক্ত করো না এখন। কাজ করতে দাও। কথা শেষ করেই হলুদ রঙ ব্রাশে লাগিয়ে পাতায় গায়ে বিন্দু আঁকাতে মনোযোগ দিয়েছিল নূহা।

নূহার কর্মকান্ড সবসময়ই ভীষণ মুগ্ধ করতো জাওয়াদকে। ঐ মূহুর্তেও করেছিল। ছোট্ট একটা শিশুর  মাঝে চারপাশের সবকিছুকে খুশি রাখার এই আকুলতা, প্রচেষ্টা আল্লাহর অফুরন্ত রাহমার নিদর্শনই মনে হতো জাওয়াদের।

জাওয়াদ আর নূহাকে বাগানে বসে থাকতে দেখে আজাদ সাহেব এগিয়ে গিয়ে হাসি মুখে বলেছিলেন,  কি করছে আমার বড় বাবা আর ছোট মা’টা মিলে?

কথা শুনে পেছন ফিরে আজাদ সাহেবকে আসতে দেখে দাঁড়াতে যাচ্ছিলো জাওয়াদ। কিন্তু দু’হাত দিয়ে টেনে ধরে নূহা বলেছিল, ভাইয়া কথা বলবে না বাবার সাথে।  

জাওয়াদ হেসে বলল, কেন বেবী?

বাবা আমাকে ধমক দিয়েছে। আমি রাগ বাবার সাথে। তুমিও রাগ করো বাবার সাথে। কথা বলবে না। বলতে বলতে গাল ফুলিয়ে বসেছিল নূহা।

আজাদ সাহেব কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বললেন, জাওয়াদ তোমার এই আদরের বোন আজ সকালে আমার পুরো লাইব্রেরী তছনছ করেছে।

নূহার দিকে তাকিয়ে জাওয়াদ বলল, নূহা তুমি এমন করেছো?

সব ফালতু বই। কোন ছবি নেই বইতে শুধু লেখা। আমি বইয়ে ছবি এঁকে সুন্দর বই বানিয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু বাবা আমাকে ধমক দিয়েছে। বাবাও ফালতু।

ছিঃ নূহা বাবাকে এভাবে বলতে হয় না। ভাইয়া তোমাকে অনেক ছবি আঁকা বই এনে দেব। কিন্তু আগে বাবাকে সরি বলো।

বাবা কেন ধমক দিলো আমাকে? আমি সরি বলবো না। কক্ষনো না। ডানে বামে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো নূহা।

জেদ করে না নূহা।

আমি জেদ করবো।

তাহলে কিন্তু ভাইয়া রাগ করবো তোমার উপর!

আমিও তাহলে কান্না করবো। কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো মূহুর্তে নূহার কন্ঠস্বর।

না তুমি কক্ষনো কান্না করবে না। তুমি কান্না করলে ভাইয়ার ভীষণ কষ্ট হয়। কেন হয় বলো তো?

আনন্দে ঝিকমিক করে উঠে আদুরে গলায় নূহা জবাব দিলো, নূহা যে ভাইয়ার কলিজা সেজন্য।

নূহাকে কোলে টেনে নিয়ে আদর দিয়ে জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, তাহলে নূহা কেন ভাইয়ার কথা শোনে না?

আমি তোমার কথা শুনি তো।

তাহলে বাবাকে সরি বলে দাও।

মূহুর্তেই গাল ফুলিয়ে বাবার দিকে অভিমানী চোখে তাকালো নূহা। এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে দুইজনের  কথোপকথন শুনতে শুনতে নীরবে হাসছিলেন আজাদ সাহেব। এবার পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত  বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ঠিকআছে বাবা সরি বলছি। আর কখনো বাবা নূহাকে ধমক দেবে না।

হাসি ফুটে উঠলো নূহার চেহারাতে। দু’হাত বাড়িয়ে আজাদ সাহেবের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আমিও সরি। আর তোমাকে ফালতু বাবা বলবো না। তুমি আমার অনেক ভালো বাবা।

থ্যাংক ইউ। হাসতে হাসতে বললেন আজাদ সাহেব।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জাওয়াদের হাত ধরে টানতে টানতে নূহা বলল, চলো চলো আমরা যাই।

কোথায়?

ছবি আঁকা ভালো ভালো বই কিনতে।

বিকেলে যাব আমরা ছবি আঁকা ভালো ভালো বই কিনতে। কেমন?

না এখন যাব ভাইয়া। এক্ষুনি, এক্ষুনি যাব। চলো তুমি চলো।

আচ্ছা ঠিকআছে এক্ষুনি যাব আমরা। তুমি যাও ড্রেস চেঞ্জ করে এসো। দেখো রঙ লেগে গিয়েছে এটাতে। আর মামনিকেও বলে এসো।

এক মূহুর্ত দেরি না করে বাড়ির ভেতর ছুট লাগালো নূহা।

মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাসি মুখে আজাদ সাহেব সেদিন জাওয়াদকে উদ্দেশ্যে করে বলেছিলেন, এত আদর দিও না জাওয়াদ নূহাকে। শেষে বিপদে পড়ে যাবে। খেয়াল করেছো যত দিন যাচ্ছে ততই জেদি হচ্ছে নূহা।

জাওয়াদ হেসে বলেছিল, জ্বি চাচ্চু আমিও খেয়াল করেছি নূহা খুব বেশি জেদি স্বভাবের। কিন্তু কেন জানি না ওর মনখারাপ হবে এমন কিছুতে বাঁধা দিতে পারি না। ওর মনখারাপ কেন জানি না  আমাকে ওর চেয়েও বেশি ব্যথিত করে।
আজাদ সাহেব হেসে বললেন, এটা বোঝে বলেই তো তোমাকেই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা আর ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে।

জাওয়াদ হেসে বলল, নূহা তো এখনো অনেক ছোট চাচ্চু। মাত্র ছয় বছর বয়স। আরেকটু বড় হলে যখন বুঝতে শিখবে ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তুমি যাবে আমাদের সাথে বই কিনতে?

আজাদ সাহেব হেসে বলেছিলেন, বই কিনতে যেহেতু যাবে সাথে যাওয়া যায়। তাছাড়া নূহাকে ধমক দিয়ে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হচ্ছে সকাল থেকে। ওকে বই কিনে দিলে আমার মনটাও শান্ত হয়ে যাবে। সেদিন নূহা যে কটা বইতে হাত দিয়েছিল সব কিনে দিয়েছিল জাওয়াদ। ছোটবেলা থেকেই তাই নূহার এটা খুব ভালো মতো বোঝা হয়ে গিয়েছিল, কারো কাছে যে আবদার করা যাবে না সেটাও জাওয়াদের কাছে অবলীলায় করা যাবে। নূহা আর জাওয়াদের জীবনে ঘটে যাওয়া এক্সিডেন্টের পর নূহার সিদ্ধান্ত যখন রাহাতের সাথেই থেকে যাওয়া ছিল। বাড়ির অন্য সবার মতো আজাদ সাহেবও জাওয়াদকে বোঝাতে গিয়েছিলেন জীবনটাকে যেন এভাবে থামিয়ে না রাখে। আবার যেন বিয়ে করে নতুন করে সবকিছু শুরু করে। জাওয়াদ সেদিন হেসে বলেছিল, বাড়ির অন্য কাউকে যে কথাটা আমি বলিনি, কখনো বলার ইচ্ছেও নেই। সেকথাটা তোমাকে বলছি চাচ্চু। দ্বিতীয় বিয়ে করতে না চাইবার পেছনে আমার সন্তানদের চেয়েও বড় কারণ নূহা। নূহা কখনোই সহ্য করতে পারবে না আমার পাশে অন্য কাউকে। আমার প্রায়ই মনে পড়ে একদিনের কথা। নূহার যখন ছয় বছর বয়স। ওর সবচেয়ে প্রিয় টেডিবিয়ারটা সোফার উপর রেখে নীচে বসে ছবি আঁকছিল। আমি সোফায় বসার সময় কি মনে করে যেন পাশ থেকে তুলে টেডিবিয়ারটাকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম। ছবি আঁকার ফাঁকে হঠাৎ যখন নূহা এটা খেয়াল করেছিল। আমার কোল থেকে টেডিবিয়ারটা নিয়ে শরীরের সবটুকুন শক্তি একসাথ করে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিল, তুমি কেন আমার ভাইয়ার কোলে বসেছো? ভাইয়ার কোলে শুধু নূহা বসবে আর কেউ না। বুঝেছো? তোমার সাথে আমি আর কোনদিন খেলবো না। কোনদিন না, কোনদিন না। এবং সত্যি সত্যিই  নূহা এরপর আর কোনদিন ছুঁয়েও দেখেনি ঐ টেডিবিয়ারটাকে। নূহা আমার পাশে ওকে ছাড়া আর কাউকে দেখে অভ্যস্ত নয় চাচ্চু। মুখে যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন একথা আমি যেমন জানি তেমনি তুমিও জানো কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো ঠিক ততটাই অবুঝ নূহা যতটা ছয় বছর বয়সে ছিল। আর আমার কাছে নূহা কখনোই শুধু আমার ওয়াইফ ছিল না। আড়াই বছরের দাম্পত্য জীবনের চাইতেও আমার কাছে আমাদের সেই আত্মিক বন্ধনটা বেশি গুরুত্ব বহন করে। আমার আত্মত্যাগ যতটা না আমার সন্তানদের মায়ের জন্য। তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি সেই নূহার জন্য যাকে ছোটবেলায় বাবার নাম, মায়ের নাম, ভাইয়ের নাম, বোনের নাম, বন্ধুর নাম যাই জিজ্ঞেস করা হতো। জবাবে বলতো, জাওয়াদ। চাচ্চু নূহার আর আমার যে সম্পর্করা ভেঙে যাবার মতো ছিল সেটা ভেঙে গেলেও এখনো অটুট কিছু বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছি আমরা। তাই আমি এমন কিছু করতে পারবো না যারফলে নূহার জীবনের কষ্ট আরো বেড়ে যাবে। এরপর আর কখনোই জাওয়াদকে বিয়ের ব্যাপারে কিছুই বলেননি আজাদ সাহেব। সেদিনের পর থেকে আজাদ সাহেবেরও মনেহয়, জাওয়াদ নূহার জন্য আত্মত্যাগ করবে নাতো কে করছে? একটা সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে তো কি হয়েছে? আরো অসংখ্য সম্পর্ক এখনো স্ব মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জাওয়াদ আর নূহাকে এক ডোরে বেঁধে রাখার জন্য। যার প্রায় সবগুলোই অটুট এবং অপরিবর্তনশীল। ঐ তো তার চোখের সামনেই খানিকটা দূরেই ছুটে বেড়াচ্ছে জিশান। যার মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে জাওয়াদ আর নূহা। সেটাও এমন ভাবে যা কখনোই এবং কারো পক্ষেই আলাদা হবার নয়।        

সারাদিনই বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় প্রচন্ড ইচ্ছে থাকার পরেও কথা বলা হয়ে ওঠেনি নূহার সাথে। তাই বিকেলে যখন নূহা বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে পাহাড়ি ঝর্ণার ধারে ঘুরতে যাবার কথা বললো সাথে সাথেই সবার বডিগার্ডের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন আজাদ সাহেব। ঝর্ণার আরেকপাশেই বিশাল বড় লেক। যেখানে মাছ ধরার ব্যবস্থাও আছে। পার্কে পৌছেই বাচ্চারা সবাই হৈ হুল্লোর করে মাছ ধরার খেলায় মগ্ন হলো। নূহা বেশ খানিকটা দূরে ঘাসের উপর বসে তাকিয়ে ছিল বাচ্চাদের দিকে। কিছুক্ষণ নাতী-নাতনীদের সাথে কাটিয়ে আজাদ সাহেবও এসে নূহার পাশে বসলেন। মুখে কিছু না বলে চুপচাপ বাবার কাঁধে মাথা রেখে বসলো নূহা। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আজাদ সাহেব বললেন, আমার মায়ের মনটা কি কোন কারণে খারাপ? দুপুরের পর থেকেই কেমন যেন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে আমার মা'টাকে। নূহা কি হয়েছে মা?  

বাবার কন্ঠের দরদে নূহার ধৈর্য্যের বাঁধ ছুটে গেলো হঠাৎ। তেমনি করে নিশ্চুপ বসে রইলো কিন্তু দু'চোখ দিয়ে ঝর্ণাধারার মত প্রবাহিত হতে শুরু করলো অশ্রু। মেয়ের নীরব কান্নাকে অনুভব করে ভিজে উঠলো আজাদ সাহেবের আঁখিদ্বয়ও। অনেকটা ক্ষণ এভাবেই কেটে যাবার পর নূহা বলল, আমার কাছে প্রতিদিন অন্তত পক্ষে একজন ক্লায়েন্ট এমন অবশ্যই আসে যার জীবনের মূল সমস্যা তার স্বামী। কারো স্বামী ঘরের চেয়ে বাইরে থাকতে বেশি পছন্দ করে, কারো স্বামী অন্য কোন মেয়ের সাথে ইনভলবড হয়ে পড়েছে, কারো স্বামী অতি তুচ্ছ কারণেই গায়ে হাত তোলেন, কারো স্বামী পান থেকে চুন খসতেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে, কারো স্বামী কাছে তার থাকা বা না থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, কারো স্বামী কাছে সে শুধুই একটি ভোগের সামগ্রী। গত মাসে একটি মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। যার স্বামী তাকে বিভিন্ন হোটেল, বারে নিয়ে যায় জোর করে। তুলে দেয় কোন কোন দিন একাধিক জনের হাতেও। এসব অভিজ্ঞতার অর্জনের পর যখন স্টুডেন্টদের মধ্যে কেউ কেউ ভীত কন্ঠে বলে, ম্যাম জীবনে আর যাই কিছু করি কোনদিন বিয়ে করবো না। তখন ইচ্ছে হয় বলি, ভেরি গুড আইডিয়া। বিয়ে করে জীবন হেল করার কোন যুক্তি নেই। তারচেয়ে স্বনির্ভর হয়ে মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করো। এসব বোঝা মাথায় নিয়ে যখন বাসায় ফিরি। যখন রাহাতকে দেখি, ওর আকুল করা অকৃত্রিম, নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে অনুভব করি। যখন পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি স্বভাবের জ্বলন্ত মশাল হয়ে জ্বলজ্বল করতে দেখি রাহাতকে। তখন মনেহয় বিয়ের চেয়ে সুন্দর কোন বন্ধনই নেই পৃথিবীতে। স্বামীর চেয়ে পরম নির্ভরতার আশ্রয় আর কিছুই হতে পারে না একটি মেয়ের জন্য। ঐ মূহুর্তে ইচ্ছে করে স্টুডেন্টদেরকে টেক্সট করে বলি, গাধী তোরা জীবনে আর কিছু করিস বা না করিস একটা করে বিয়ে অবশ্যই করিস।  

স্বশব্দে হেসে ফেললেন আজাদ সাহেব। নূহাও হেসে ফেললো। কিছুক্ষণ মনের আনন্দে বাবা-মেয়ে মিলে হাসলো। এরপর নূহা বলল, আমার জীবনকে ঘিরে আবর্তিত মানুষ গুলো এত বেশি ভালো কেন বাবা? দু'এক জন মানুষ যদি সাধারণ মানুষের মতো খুব বেশি খারাপ স্বভাবের হতো তাহলে আমার চলার পথটা মনেহয় অনেক সহজ হয়ে যেত। কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়ে যেত আমার জন্য। আমি তখন খুব সহজেই খারাপ মানুষটিকে জীবন থেকে মুছে ফেলে ভালো মানুষটিকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে পারতাম। খারাপ মানুষদের সাথে খারাপ কিছু করার পর হয়তো বিবেক ক্ষমা দিয়ে দিতো। কিন্তু ভালো কোন মানুষের সাথে আমি কিভাবে নিষ্ঠুর হবো বাবা?

অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন আজাদ সাহেবও। এরপর বললেন, জীবনের পরীক্ষাগুলো আমাদের কাছে যেভাবে আসে সেভাবেই তাকে মেনে নিয়ে রবের শুকরিয়া আদায় করা উচিত মা। এজন্য যে এরচেয়েও অনেক কঠিন পরীক্ষা মানুষকে দিতে হচ্ছে, মানুষ দিচ্ছেও। তাই জীবন থেকে যখন খুব আকাঙ্ক্ষিত কিছুও দূরে চলে যায়, এর পেছনের কারণটা যে মঙ্গলময় এমনটাই আশা করা উচিত। ভাবা উচিত হয়তো অনেক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমি। কিন্তু একই সাথে আমার কাছে হয়তো এমন অনেককিছু আছে যা থেকে পৃথিবীর লাখো কোটি মানুষ বঞ্চিত। তোর যেমন ভালোবাসাময় একটি পরিবার আছে। যে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সেই নীল ভোমরা তুই। যার মধ্যে গচ্ছিত সবার প্রাণ পাখী। নিজ নিজ প্রাণের মতোই তাই আগলে রাখে সবাই তোকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে যা কিছু দেন না সেটা যেমন পরীক্ষা। যা কিছু আমাদেরকে দেন সেসবও পরীক্ষা। সুতরাং কার পরীক্ষা উত্তম কিছুর দ্বারা হচ্ছে আর কার পরীক্ষা মন্দ কিছুর দ্বারা হচ্ছে এসব ভেবে সময় নষ্ট করা যাবে না। কিভাবে নিজের পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ভাবে উত্তীর্ণ হওয়া যায় সেই চেষ্টা করতে হবে আমাদেরকে। বেশি বেশি করে নিজের নেয়ামত সমূহের কথা চিন্তা করতে হবে। তাহলে উপলব্ধি করতে পারবো, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে যা কিছু দেননি এটার চেয়েও যা কিছু দিয়েছেন তার পরিমাণ অনেক অনেক গুণ বেশি। এজন্যই তো ছোটবেলায় তোদেরকে শিখিয়েছিলাম। “আত্নপর্যালোচনা নিজেকে করে পুনঃপুন উন্নত, অপ্রাপ্তির হিসাব মনকে করে তোলে অভুক্ত। নিজের সাথে তুলনায় ঘাতটি হয় উন্মোচিত, অন্যের সাথে তুলনা হতাশাকে জানায় স্বাগত। আত্নউন্নয়নের চেষ্টায় জীবনের সার্থকতা নিহিত, সর্বাবস্থায় আল্লাহতে যার ভরসা হয় না কভু আশাহত।

তোমার সাথে আর কথা বলবো না আমি। তোমার কাছে বসবোও না। তুমি সবসময় এসব কথা বলে আমার লাইনচ্যুত মনকে আবারো সঠিক পথে ফিরিয়ে আলো। তুমি একটা অনেক পঁচা বাবা। যাও তুমি যাও। তোমার সাথে কাট্টি। গাল ফুলিয়ে অভিমানী কন্ঠে বললো নূহা।  

আজাদ সাহেব হাসতে হাসতে নূহাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, আচ্ছা আর বলবো না এসব কথা। চল তোকে গল্প শোনাই। গল্প তো শুনবি?

আচ্ছা বলো। কিন্তু শুধুই যেন গল্প হয়। গল্পের আড়ালে কিন্তু আবার লেকচার দেবে না আমাকে।

আজাদ সাহেব হাসি মুখে বললেন, নিশ্চিন্তে থাক একদম লেকচার ফ্রি গল্প। আসলে কি হয়েছে জানিস? কদিন থেকে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছি। প্রকৃতিকে নিজের মাঝে ধারণ করা এক ছোট্ট বালিকার গল্প। যার মনের ‎আলোকিত বাতায়নের ওপাশের আশা জাগানিয়া প্রকৃতিরা বুনে দিয়ে যায় সহস্র স্বপ্নের বীজ। বালিকাটি ‎সাঁঝের মায়া আচ্ছন্ন হলেও সাঁঝেই ফুরিয়ে যায়না কখনো। বরং রঙধনু গায়ে মেখে সুবহে সাদিকের সন্ধানে ছুটে চলে নিরন্তর, প্রত্যাশিত সুহাসিনী ভোরের প্রতীক্ষায়। গল্পের প্লটটা তোর কেমন মনেহচ্ছে বলতো মা? জানিসই তো আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি। এখন কি আর ছন্দ-কাব্য আসবে তেমন করে মনের মাঝে বল? আমাকে সাহায্য কর না মা এই গল্পটা লিখতে। করবি সাহায্য?  

নূহা বাবার কাঁধে মাথা রেখে মাছ ধরা উৎসবে রত বাচ্চাদের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে হাসি মুখে বলল, লিখতেই যদি হয় ওদেরকে নিয়ে গল্প লিখবো। কারণ ওরা ফুলের মতো সুবাসিত, তারার মতো আলোকিত। সকল ম্লানতা থেকে পবিত্র, ভেদাভেদ করে না শত্রু-মিত্র। জগতটাকে ভাবে নিজের মত, তাই দূরে রাখতে হবে ওদের থেকে দীনতা যত। উড়তে দিতে হবে ওদের মেলে দিয়ে ডানা, পুঁজি করে মনের শুদ্ধ ও শুভ্র ভাবনা। ওরাই গড়বে সুন্দর এক নতুন পৃথিবী, যেথায় থাকবে না কোন আত্মিক অভাবী। রবের সন্তোষ অর্জনের ইচ্ছেশক্তির টানে, হাতে হাত রেখে ছুটবে সবে মিলে জান্নাতের পানে..ইনশাআল্লাহ।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন