রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি... ১৭




নিজের কেবিনে ঢুকে বাচ্চাদের হৈ চৈ শুনতে পেয়ে এক মূহুর্তের থমকে দাঁড়িয়ে গেলো নূহা। এরপর এগিয়ে গিয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠলো মুখে। নাবিহা সবাইকে নাস্তা সার্ভ করছে। আমিত্তির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে আফজাল সাহেব বললেন, এটা কি? নাবিহা জবাব দিলো, এটা হচ্ছে আমিত্তি। আফজাল সাহেব বিরক্ত কন্ঠে বললেন, তোদের মায়ের তো কান্ডজ্ঞান হ্রাস পেয়েছে দেখছি। ডায়বেটিস রোগীদের জন্য এক গাদা মিষ্টি আইটেম নাস্তা  বানিয়ে রেখে গিয়েছে। সাথে সাথে হুঙ্কার ছেড়ে জিশান বলল, মুখ সামনে কথা বলো চাদা ভাই। আমাদের মা’র যদি কান্ডজ্ঞান না থাকে তাহলে পৃথিবীতে কান্ডজ্ঞান নামে কোন জিনিসই নেই।  আর তুমি ভুলে যেও না কার সামনে বসে কথা বলছো। জিশান সব সহ্য করতে পারে কিন্তু মা’র নামে ব্যাড কমেন্ট শুনলে মানুষ থাকে না। আফজাল সাহেব বলল, মানুষই তো আছিস দেখতে পাচ্ছি। জিশান বলল, বাইরে মানুষ আছি কিন্তু ভেতরে যোদ্ধা হয়ে গিয়েছি। ফালা ফালা করে দেবো শত্রু পক্ষকেও। জারিফ হাত তুলে বলল, ভাইয়া আমিও চাদা ভাইকে ফালা ফালা করতে চাই। জিশান জারিফের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আলবৎ অনুজ। তুমি তো আমার ডান হাত। হেসে ফেললো সবাই। হাসি ছড়িয়ে পড়লো নূহার চেহারাতেও। নূহার সত্যিই প্রচন্ড ইচ্ছে করছিল বাসায় বাচ্চারা কি করছে সেটা দেখার জন্য। জাওয়াদকে খুব কম সময়ই মনের ইচ্ছেগুলোকে মুখ ফুটে বলতে হয়েছে নূহাকে। বেশির ভাগ সময়ই কোন চাওয়া মনের কোনে উঁকি দিয়ে যেতে না যেতেই কিভাবে যেন বুঝে নিতো জাওয়াদ। আজও তেমনি করেই বুঝে নিয়েছে বলেই নূহা যাতে বাচ্চাদেরকে দেখতে পারে চুপচাপ সেই ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছে। কতটা নিঃশব্দে কাউকে ভালোবাসা যায়, কারো কেয়ার করা যায় জাওয়াদকে দেখেই জেনেছিল, বুঝেছিল এবং শিখেছিল নূহা। অবশ্য জাওয়াদের এমন নিঃশব্দ ভালোবাসা পরিবারের প্রতিটি সদস্যেকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।

দৃষ্টি স্ক্রিনের দিকে থাকলেও নূহার মনের ভাবনারা হঠাৎ পেখম মেলে দিলো। না চাইতেও ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে ছুট লাগালো অতীত পানে। আল্লাহর অশেষ রহমতে জীবনে অসংখ্য সুন্দর মূহুর্ত এসেছে। কিন্তু জাওয়াদের সাথে বিয়ের দৃশ্যটুকু সমস্ত সুন্দর মূহুর্তকে ম্লান করে দেয়। নূহার ভাবনারাও বার বার ব্যর্থ হয় সেই দৃশ্যটিকে আঁকতে। জীবনের ছোট্ট গন্ডির সল্প অভিজ্ঞতার আয়নার নূহার কাছে তাদের বিয়েটাই মনেহয় পৃথিবীর একমাত্র বিয়ে যে বিয়েতে কবুল বলতে গিয়ে বর ঝরঝর কান্না করেছে আর বধূ খিলখিল করে হেসেছে। আর কাজী সাহেব থেকে নিয়ে শুরু  করে বিয়েতে উপস্থিত থাকা সবাই একবার হেসেছে, একবার কান্না করেছে। বিয়ের পর সবাই রুম  থেকে বেরিয়ে গেলে জাওয়াদ আর নূহা দুজনই নিশ্চুপ বসেছিল অনেকক্ষণ। কি বলবে বুঝেই উঠতে পারছিল না। অনেকটা সময় পেরোনোর পর নূহা বলেছিল, আমি কোনদিন ভাবিনি আমাদের নতুন জীবনের শুরুটা এভাবে হবে। কিন্তু যেভাবেই হোক শুরু হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। সেজন্য আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে চাই। সেন্স আসার পর থেকে গত কয়েকদিন আমি শুয়ে শুয়েই নামাজ আদায় করছি। আমি চাচ্ছিলাম দুজন একসাথে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে। জাওয়াদ হেসে বলেছিল, আমিও একথাই ভাবছিলাম।

দুজন একসাথে নামাজ আদায়ের পর অদ্ভুত একরকম প্রশান্তি অনুভব করেছিল নূহা। মনের সমস্ত জড়তা কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাওয়াদ তখনো ভীষণ চুপচাপ ছিল। চোখের কোনে অশ্রুকণারা চিকচিক করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছিলো। নূহা হাসি মুখে বলল, তোমার চোখে আবারো কেন কান্না? আচ্ছা তুমি অতো দূরে বসে আছো কেন? আমার কাছে এসো। আমাকে শক্ত করে কিছুক্ষণ তোমার বুকে জড়িয়ে ধরে রাখো। ইনশাআল্লাহ দেখবে আমি অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাবো তাহলে। জাওয়াদ উঠে এসে আলতো করে বুকে টেনে নিয়েছিল নূহাকে। ঐ মূহুর্তে দুজনের চোখ দিয়েই ঝরঝর অশ্রু নেমে এসেছিল। একটু ক্ষণ পর নূহা বলল, জানো এখন আমার প্রচন্ড ভয় হচ্ছে এক্সিডেন্টের কথা চিন্তা করলেই। জাওয়াদ প্রশ্ন করলো, কেন? জবাবে নূহা বলল, আমি যদি মারা যেতাম এক্সিডেন্টে তাহলে এই পৃথিবীর বুকে কত শত প্ল্যান অপূর্ণ থেকে যেত জানো? আমার মেমোরির অর্ধেকের বেশি বোঝাই করা তোমাকে জ্বালা যন্ত্রণা দেবার অভিনব সব  ফর্মূলাতে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেসবের মধ্যে অনেক ধরণের দিক নির্দেশনাও আছে। আমি মারা গেলে তো সব আমার সাথেই চলে যেত। কি হতো তাহলে?

জাওয়াদ তখন হেসে ফেলেছিল সশব্দে। নূহাও হেসে বলেছিল, তুমি কি জানো তোমার হাসির আমার কত প্রিয়? আমার আজ ভীষণ আনন্দ হচ্ছে ভেবে যে, আল্লাহকে ভয় করে আর কখনো তোমার হাসি ভরা চেহারা থেকে আমাকে চোখ সরিয়ে নিতে হবে না। তুমি যখন এমনি করে হাসবে আমি মুগ্ধ চোখে অপলক তাকিয়ে থাকতে পারবো তোমার দিকে। আজ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া  তায়ালার কাছে আমার নতুন আরেকটি দোয়া শুরু হবে। কি দোয়া? জাওয়াদের এই প্রশ্নের জবাবে নূহা বলল, ইনশাআল্লাহ যদি আমাদের বেবী হয় তাহলে ওদের হাসি যেন একদম তোমার মতো হয়। জাওয়াদ হাসলেও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল, আমিও প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম  তোমার এক্সিডেন্টের কারণে। এখনো নেতিবাচক কোন সম্ভাবনার চিন্তা আমার নিঃশ্বাসকে ভারি করে দেয়। তোমাকে নিয়ে আমি অনেক লম্বা একটা জীবনের স্বপ্ন দেখেছি নূহা। কেন জানো?  কারণ আমি আমার ভালোবাসার গভীরতা তোমাকে দেখাতে চাই। আমরা কথায়, কাজে, বিরক্তিতে, রাগে, অভিমানে,হাসিতে, শাসনে সব ভাবে সেই ভালোবাসা আমি তোমাকে দেখাতে চাই। তুমি আমাকে যন্ত্রণা দেবার যে প্ল্যান নিয়েছ সেসব যন্ত্রণা উপভোগ করতে চাই। আমাদের ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীতে নতুন প্রাণের সৃষ্টি করতে চাই। স্বামী-স্ত্রী’র জীবনে সবচেয়ে অসাধারণ, অনন্য, অনিন্দ সুন্দরতা হচ্ছে দুজন মিলে ছোট্ট একটি প্রাণকে পৃথিবীতে নিয়ে আসাটা! ভালোবাসার মূহুর্তগুলোকে জীবন্ত করে তোলার এই মিরাকল শুধু স্বামী-স্ত্রী মিলেই করতে পারে। আর আমার মন কেন জানি বলে আমাদের মিরাকলগুলো এক্সট্রা মিরাকল হবে।

ভীষণ হৈ চৈ এর শব্দে নূহার ভাবনারা ছুটে পালালো হঠাৎ। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে প্ল্যাস্টিকের খেলনা হাতুড়ি, তলোয়ার, তীর-ধনুক নিয়ে আফজাল সাহেবকে ঘিরে মারমুখী ভঙ্গীতে ঘুর্ণায়মান বাচ্চাদেরকে দেখে হেসে ফেললো নূহা। জাওয়াদের মনের ভবিষ্যৎ বাণী কতটাই না নির্ভুল ছিল। তাদের মিরাকলগুলো আসলেই এক্সট্রা মিরাকল। নূহার মাঝে মাঝে মনেহয় কারো জীবনে একবার কোন মিরাকল ঘটলে, এরপর মিরাকলটাই মনেহয় স্বাভাবিক কিছু হয়ে যায়। এটা আর কারো  জীবনে সত্য না হলেও নূহার জীবনের চরম সত্য এটাই। বর্তমান জগতের সবচেয়ে বড় মিরাকল নিঃস্বার্থ ভালোবাসাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল মানুষ আর সম্পর্কের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, কুটিলতা-জটিলতা, স্বার্থপরতা, পরিশ্রীকাতরতা, এমনকি স্বার্থসিদ্ধির জন্য হত্যাকেও বিস্ময়ের চোখে দেখে না। এখন মানুষের মনে বিস্ময় জাগায় সম্পর্কের মাঝে ভালোবাসা, বোঝাপরা, মানিয়ে চলা, ত্যাগ করার মতো ইতিবাচক গুণাবলীর অস্তিত্ব। আর নূহার ভুবন উপচে পড়ে এমন স্বার্থহীন মানুষদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সৌরভে। ভাবনার ঘুড়ি মনের আকাশে বাঁধনহারা হবার আগেই রাশ টেনে ধরলো নূহা। ঘুড়িকে গুটিয়ে এক পাশে রেখে বাচ্চাদের দিকে তাকালো।  

নিজ মুখে যদি বাচ্চাদেরকে তাদের জীবনের গল্পটা বলতে পারতো তাহলে হয়তো বেশি শান্তি ও স্বস্থি ফিল করতো। কেননা কিছু কিছু ব্যাপার আছে, কিছু কিছু মুহুর্ত আছে যা অন্য কারো পক্ষে কখনোই বোঝানো সম্ভব নয়। তাছাড়া তাদের জীবনের একান্ত সহমর্মিতা ও ভালোবাসাময় মূহুর্তগুলো তো পৃথিবীর অন্য সবার স্পর্শের বাহিরে। বিয়ের পর হসপিটালে কাটানো দু’টি সপ্তাহ নূহার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম দিন ছিল। ঐ দুই সপ্তাহেই নূহা জেনেছিল আল্লাহর রঙে নিজেকে  রাঙানো একজন আশরাফুল মাখলুকাত মূলত কেমন হয়। উপলব্ধি করেছিল আপনজনদের সেবা করার মাঝে যে কি আনন্দ, কি পরিতৃপ্তি লুকায়িত থাকে সেটা সব অন্তর অনুভব করতে পারে না। কিন্তু যে অন্তরে এই উপলব্ধির ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে! সে অন্তর শুধু নিজেই প্রশান্ত হয় না। সমৃদ্ধ হয় তার আমলের ভান্ডারও! এবং একই সাথে আপনজনদের মনে তার তরে খুলে যায় দোয়ার দুয়ার। সেই দু’সপ্তাহে এমন একটি রাতও আসেনি ঘুম ভেঙে যাবার পর জাওয়াদকে জায়নামাজে প্রার্থনারত দেখেনি। রাত্রির শেষ প্রহরে জাওয়াদের ভরাট আর সুমধুর কন্ঠের তিলাওয়াত প্রাপ্তির আনন্দাশ্রু হয়ে ঝরে পড়তো নূহার দু’চোখের কোন বেয়ে।

সেই দু’সপ্তাহে আরেকটা জিনিসও উপলব্ধি করেছিল নূহা। জগতে যা কিছুই ঘটে তার অন্তরালে নিহিত থাকে কল্যাণ। তাই তো যেই এক্সিডেন্টটাকে তাদের স্বপ্নভঙ্গের কারণ ভেবেছিল। সেই এক্সিডেন্টের কল্যাণেই একে অপরের দুঃসময়ের সাথী হয়ে জাওয়াদ আর নূহা প্রবেশ করেছিল প্রেমময়  এক স্বপ্নীল ভুবনে। সুখের সাথীদের সাথে বন্ধন দুঃসময়ে এসে নড়বড়ে হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু যাদের সফর শুরুই হয় দুঃসময়কে মোকাবিলার মাধ্যমে। যারা কন্টকাকীর্ণ পথে হাঁটার বেদনার  সাথে পরিচিত, তারা ফুলেল পথেও অতি সাবধানে হাঁটে। ব্যথার যাতনার সাথে পরিচিত বলে সাবধান থাকে ফুলের বুকেও যাতে অকারণ বাড়তি চাপ না লাগে। তাই হয়তো আড়াই বছরের  বিবাহিত জীবনে জাওয়াদ আর নূহা সবসময় সতর্ক থেকেছে কখনোই যাতে একে অন্যের কষ্টের  কারণ না হয়। যখনই মনে হয়েছে একজনের ছোট্ট একটু ছাড় অন্যজনকে খুশি করবে দ্বিতীয় বার আর চিন্তা করেনি ছাড় দিতে। দুজন মানুষ যখন একে অন্যেকে সুখী করার ব্যাপারে সজাগ ও  সচেতন থাকে তখন তাদের দুঃখী হওয়াটাই অসম্ভব বা অস্বাভাবিক কিছু হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য এমনটাও নয় যে জাওয়াদের সাথে নূহার কখনোই ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়নি। কিন্তু অন্য আর সবকিছুর মতো সম্পর্কের মাঝে ঝগড়াটাও যে একটা আর্ট। যারা আঁকতে জানে তারা ঝগড়ার দ্বারাও এঁকে ফেলে মনোমুগ্ধকর কোন চিত্র।  

এমনি একদিনের কথা স্মরণে হাসি ফুটে উঠলো নূহার চেহারাতে। ঘুম ভাঙ্গার পর পাশে তাকিয়ে জাওয়াদকে না দেখে অবাক হয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসেছিল নূহা। গতরাতের কথা মনে পড়তেই একরাশ  অভিমান দানা বেঁধে উঠলো মনে। নূহাকে যখনই কেউ জিজ্ঞেস করতো, তোমার হাজবেন্ডের সবচেয়ে ভালো  গুণ কি? জবাবে  মুগ্ধতা আর ভালো লাগার আবেশ জড়ানো কণ্ঠে বলতো, আমি যত ভুল বা অন্যায়ই করি না  কেন উনি কখনোই কারো সামনে আমাকে কিছু বলেন না। কিছু বলা তো দূরে থাক রাগ যে করেছেন সেটাও বুঝতে দেন না কাউকে। যা বলার রুমে গিয়ে বলেন কিন্তু তখনও উত্তেজিত হন না। ধীরে ধীরে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন। প্রচণ্ড কড়া কথা যদি বলেন কখনো, পর মুহুর্তেই এমন কিছু বলেন বা করেন যে আমি হেসে ফেলতে বাধ্য হই। আর যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন আমি যদি কিছু বলতে যাই, তাহলে সম্পুর্ণ মনোযোগ সহকারে আমার কথা কিছুক্ষণ শোনেন তারপর বলেন যে, আমি এখন একটু ব্যস্ত তো ফ্রী হয়ে তোমার সাথে আজ অনেক গল্প করবো ইনশাআল্লাহ। এবং ফ্রী হয়ে সত্যিই তাই করেন।

কিন্তু গতকাল রাতে কি যে হল পরিবারের সবার সামনে সামান্য একটা কারণে খুব রাগ দেখালো জাওয়াদ নূহার প্রতি। বেডরুমে গিয়েও কোন কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। এমন কিছুর জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না নূহা। একবার ভেবেছিলো সে কি জাওয়াদের কাছে যাবে? সরি বলবে? পর মুহুর্তেই মনে হয়েছিলো যে আমি কেন বলবো? সামান্য একটা কারণে অন্যায় আচরণ তো উনি করেছেন। সরি বলতে হলে উনি বলবেন, আমি না। নূহার মনের চন্দ্রালোকিত বাসন্তি রাতকে অভিমানের অমাবস্যা ছেয়ে ফেলছিল। রাত চরা পাখীর মতো নানা রকম অনুভূতি চমকে চমকে মনের আবছায়া প্রান্তরে ডাক দিয়ে যাচ্ছিলো। সবার সামনে বলা জাওয়াদের  কথাগুলো কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুরছিল মাথার মধ্যে। কষ্টরা মনে একই ভাবে জমাট বেঁধে থাকে না, ঘনত্ব বদলায়....ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়....রূপ পাল্টাতে থাকে অনুভূতির স্পর্শে। কিন্তু পেছন ফিরে শুয়ে থাকা জাওয়াদকে দেখে নূহার মনকে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছিল। তাই শেষপর্যন্ত আর কিছু বলতে পারেনি সেদিন জাওয়াদকে। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে।     

কিন্তু ঘুম থেকে উঠে জাওয়াদকে রুমে না দেখে সত্যিই অস্থির লাগছিল। ফজরের নামাজ আদায় করতে  মসজিদে গিয়েছে বুঝতে পারছিল কিন্তু তাকে না ডেকে, কোন কথা না বলেই এভাবে চলে গেলো? এতো রাগ  করার মতো কি সত্যিই কিছু করেছে সে? ভাবতে ভাবতে দু’চোখ অশ্রুতে ভরে উঠলো। চোখ মুছে ওজু করার  জন্য ওয়াশ রুমে গিয়ে বেসিনের গ্লাসের সাথে কাগজ লাগানো দেখে সেটা তুলে নিলো নূহা। ভাঁজ খুলে জাওয়াদের হাতের লেখা দেখতেই হার্টবিট রেসের ঘোড়ার গতিতে ছুটতে শুরু করে দিয়েছিল। জাওয়াদ   লিখেছিল “প্রথমেই মাফ চেয়ে লম্বা চড়া কিছু লিখবো কিনা ভাবছি! খুব কষ্ট পেয়েছো তাই না? আমি সত্যিই  তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। মাঝে মাঝে আমিও খুব বোকার মতো কাজ করে ফেলি। তবে পৃথিবীর আর কারো সাথে যে বোকামো হয় না শুধু তোমার সাথেই কেন হয় জানো? কারণ আমার বোকামোরা জানে যে এই মানুষটি তাদেরকে বুঝবে, কখনোই ভুল বুঝবে না। কিন্তু গতরাত থেকে আমার বোকামো অসহায়ের মতো দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। কারণ তার একমাত্র নির্ভর যোগ্য আশ্রয় থেকে সে বিনা নোটিশে বিতাড়িত হয়েছে। তুমি তো আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু তাই না? পরামর্শ দাও না এখন কি করি আমি আমার বোকামোকে নিয়ে? যে ভুল সে করে ফেলেছে তাকে তো বদলাতে পারবে না এখন। তাহলে এমন কি করবে যাতে সেই মানুষটা তাকে মাফ করে দিয়ে আবার তার আশ্রয় হবে?”

মুখে মিষ্টি হাসি আর দু’চোখ বেয়ে নেমে এলো আনন্দাশ্রু নেমে এসেছিল নূহার। নিজের উপর রাগ হলো  খুব। কেন সে রাতে সরি বলতে যেতে পারলো না জাওয়াদের কাছে? জাওয়াদ নিশ্চয়ই ভেবেছিলো সে যাবে, নিশ্চয়ই অপেক্ষাও করছিল নূহার এগিয়ে যাবার। তাছাড়া তার নিজেরই তো যাওয়া উচিত ছিল। ভুল  তো আসলে তারই হয়েছিলো। অভিমানের জায়গায় এখন অপরাধবোধ নূহার মনকে ঘিরে ধরলো। একজন প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি কখনোই অন্য কারো মনোবেদনার কারণ হয় না। সেকি জাওয়াদের মনে কষ্ট দিয়ে ফেললো? মনের এই অশান্ত ভাব দূর করার জন্য আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অন্যকোন উপায় খুঁজে না পেয়ে, ওজু সেরে  নামাজ আদায়ে মনোনিবেশ করেছিল। নামাজ আদায় করার পর জাওয়াদের মসজিদ থেকে ফিরে আসার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দাতে।

তবে মসজিদ থেকে ফিরে অন্যান্য দিনের মতো রুমে না এসে বাগান পরিচর্যায় লেগেছিল জাওয়াদ। অবশ্য বাড়িতে থাকলে বাগান পরিচর্যার কাজটি  নিজ হাতেই করার চেষ্টা করতো জাওয়াদ। ভীষণ রকম ভালো লাগা কাজ করে এই কাজটিকে ঘিরে তার মনে। শব্দ শুনে ঘুরে তাকিয়ে মার বদলে ট্রে হাতে নূহাকে দেখে বেশ অবাক হলেও সালাম দিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো জাওয়াদ।

সালামের জবাব দিয়ে নূহা বলল, মার শরীর খারাপ লাগছে তাই নামাযের পর আবার শুতে চলে গিয়েছেন।  

ঠিকআছে বোস তুমি।

গোলাপ গাছগুলো উঠিয়ে ফেলেছো কেন?

ঠিক করেছি বাগানে কোন গোলাপ গাছ রাখবো না।

কেন?

গাছ ভর্তি কাঁটা। গতকালও দেখেছি গাছে পানি দিতে এসে কাঁটার খোঁচা লেগেছে তোমার হাতে। অথচ এই অধিকার শুধুই আমার।

কোন অধিকার?

তোমাকে খোঁচা দেবার। গোলাপের সাথেও এটা শেয়ার করতে রাজী নই আমি। তাই বাগান থেকে সব গোলাপ গাছ আউট।

হাসতে হাসতে নূহা বলল, মাঝে মাঝে আমার তোমাকে ছোট্ট বাবু মনেহয়।

আর তোমাকে আমার সবসময়ই এই বাড়ির দাদীআম্মা মনেহয়।

তুমি কি এখনো আমার উপর রেগে আছো?

আমি রাগ ভুলে যেতে পারি এমন কিছু কি তুমি করেছো?

একটু অবাক চোখেই জাওয়াদের দিকে তাকালো নূহা।

জাওয়াদ হেসে বলল, তুমি কি জানো কিছু কিছু গুণীজন বৌয়ের রাগকে আগুনের সাথে তুলনা করেছেন।

হুম্ম জানি। তুমিই বলেছিলে।

সাথে আর কি বলেছিলাম?

কোথাও আগুন লাগলে সেখানে এতো পরিমাণ পানি দেয়া উচিত যাতে ধোঁয়াও বের না হয়। আচ্ছা তারমানে ওয়াশরুমের গ্লাসে সাঁটিয়ে যাওয়া চিরকুটটি পানি ছিল এই তো?

হাউ ইন্টালিজেন্ট ইউ আর। এজন্যই আমি আমার ভাই আর বন্ধুদেরকে বলি যে সকল ডিমান্ড ভুলে শুধু বুদ্ধিমতি মেয়ে খোঁজ বিয়ে করার জন্য।

নূহা উঠে দাঁড়ালে জাওয়াদ হাত টেনে ধরে হাসতে হাসতে বলল, আরে তুমি তো দেখছি রেগে যাচ্ছো। লিসেন মাই ডিয়ার লাভলী ওয়াইফ সকাল বেলা টগবগ করে ফুটতে থাকা চা বা কফি ভালো লাগে। কিন্তু টগবগ করে ফুটতে থাকা মানুষ না। তাই পানি ঢালার দরকার ছিল।  

আমি কোন কথা বলবো না তোমার সাথে।

রাগের চেয়ে অভিমান একশো গুণ ভালো। নূহা রাতের ব্যাপারটা নিয়ে আমি তোমার সাথে কথা বলতে  চাচ্ছিলাম। আর সেজন্য তোমার স্বাভাবিক মুডে থাকা দরকার। কারণ রাগের সময় খুব যুক্তিবাদী ও বুদ্ধিমান মানুষেরাও বোকার মতো আচরণ ও চিন্তা করে। গতরাতে কথা বলতে গেলে আমার নিজেরও মেজাজ হারানোর ভয় ছিল তাই আমি নীরব থাকাটা ভালো মনে করেছি।

তুমি সবার সামনে ওভাবে রিঅ্যাক্ট না করে আমাকে রুমে এসে বুঝিয়ে বলতে পারতে না?

পারতাম কিন্তু গতকাল সবার সামনে রিঅ্যাক্ট করার প্রয়োজন ছিল। আমাদের বোনেরা ওদের ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে যাবার পারমিশন চেয়েছে আর তুমি দিয়ে দিয়েছো। দশ-বারোটা মেয়ে একা একা দেড়শো কিলোমিটার দূরে ঘুরতে গিয়েছে। যে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। আমি যদি ওদের সামনে তোমার উপর রাগ না করতাম তাহলে তো ওরা বুঝতো না যে আমি বিরক্ত হয়েছি। ওরা ভাবতো ভাবীর কাছে অনুমতি নিয়ে কিছু করলে ভাইয়া আর কিছুই বলবে না। সুতরাং অন্যায় বা ভুল আবদার করার একটা পথ তৈরি হয়ে যেতো ওদের সামনে।

আমি বুঝতে পেরেছি। আই এম রিয়েলী ভেরি সরি। তুমি কষ্ট পাওনি তো আমার আচরণে?

কষ্ট পেতে তো ভীষণ ইচ্ছে করছিলো কিন্তু তুমি এত্তো ছোট্ট একটা মানুষ যে তোমার আচরণ থেকে কষ্ট নেয়াটাও আমার জন্য কষ্টকর। তবে আমাকে না বোঝার জন্য শাস্তি অবশ্যই দেবো তোমাকে।

কি শাস্তি?

খুব শিঘ্রীই আমরা দক্ষিণ সাগরের বেশ কয়েকটি দ্বীপে মেডিক্যাল ট্যুরে যাচ্ছি। তুমি আমার সাথে যাবে।

নো, বলে চিৎকার করে উঠলো নূহা। এরচেয়ে আমাকে দুটা থাপ্পড় মারো কিন্তু প্লীজ আমাকে প্লেনে উঠতে বলো না। আই জাস্ট হেইট প্লেন জার্নি।

হেইট করো বলেই তো শাস্তি হিসেবে নির্ধারন করা হয়েছে এটাকে। কোন বাহানা শুনতে চাই না আমি। এখন বাবুদের মতো ঘ্যানঘ্যান বন্ধ করে এটা নাও।

জাওয়াদের বাড়িয়ে ধরা কাগজের দিকে তাকিয়ে নূহা বলল, এটা কি আরো পানি?

জাওয়াদ হেসে বলল, পানি নারে বোকা বালিকা এটা নিমন্ত্রণ পত্র। তুমি পড়তে থাকো আমি ততক্ষণে আমার মাকে দেখে আসি। জাওয়াদ চলে যাবার পর নিমন্ত্রণ পত্র চোখের সামনে মেলে ধরলো নূহা। জাওয়াদ লিখেছিল,  

চলো না ঘুরে আসি ঘাস ফুলে ছেয়ে যাওয়া কোন পাহাড়ে

ঘাস আর ফুল মিলেমিশে যেথায় সুর তুলেছে মেঘেদের সেতারে

দিগন্ত রেখাকে ছুঁয়ে আকাশের সাথে একাকার বর্নালী ঘাসফুল

তুমি কানে তুলে নেবে সেথায় প্রিয় রঙয়ের ঘাসফুলের দুল

হারিয়ে যাবো দুজন ঘাসফুলে ঘেরা স্বপ্নিল সেই ভুবনে

ঘাস আর ফুল একাকার মিশে রয় যেমনি করে সঙ্গোপনে

বসন্তের টানে ঘাসফুলের জোয়ারে ভেসে যায় সেখানে প্রকৃতি

আমাদের মনেও বয়ে চলবে অবিরত ঘাসফুলে ঘেরা ভালোবাসার ঝর্ণাধারাটি........

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন