রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি......৩



রান্নাঘরের দরজার কাছে আসতেই দাদীর কথা শুনতে পেলো নাবিহা। হাসি ফুটে উঠলো নাবিহার মুখে। নিশ্চয়ই আজ আবারো কোন কারণে পাপার উপর ক্ষেপেছে দাদী। যতক্ষণ রাগ না কমবে ততক্ষণ এমন একা একা পাপাকে বকাঝকা করতেই থাকবে। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে হাসি মুখে বলল, গুড মর্নিং দাদী।  

হাতে ধরে থাকা রুটি তাওয়ার উপর সজোরে আছড়ে ফেলে বড় বড় চোখ করে নাতনীর দিকে তাকালেন খাদিজা বেগম। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, গুড মর্নিং মানে কি?

গুড মর্নিং মানে শুভ সকাল দাদী। হাসতে হাসতে জবাব দিলো নাবিহা।

তোর বাপ বাড়িতে থাকলে এই বাড়ির সকাল গুড হবার কি কোন সুযোগ আছে? মোটেও নেই। আর তুই কি লর্ড গভর্ণরের কন্যা নাকি যে সালাম না দিয়ে গুড মর্নিং শেখাচ্ছিস আমাকে?

হাসতে হাসতে দাদীকে জড়িয়ে ধরে সালাম দিলো নাবিহা। তারপর বলল, এই সাত সকালেই কেন তোমার মেজাজ এত গরম হয়েছে বলো তো দাদী? পাপা কি আজ আবার কি দুষ্টুমি করেছে তোমার সাথে? আজ আমি তোমার দলে। চলো দুইজন মিলে পাপাকে শাস্তি দেবো।

জানিস তোর পাপা কি করেছে? গতকাল রাতে খাবার দিয়ে এসেছিলাম আমি। সকালে গিয়ে দেখি সেই খাবার তেমনি পরে রয়েছে। ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি। এত অনিয়ম করলে শরীর খারাপ করবে না বল? এই কথাটা বুঝিয়ে বলতে গেলাম আমি। তোর পাপা জবাবে বলল, পৃথিবীতে লাখো কোটি সন্তান তাদের মায়ের সামনে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে। সেখানে তোমার ছেলে মোটে এক বেলা না খেয়ে থেকেছে। এতে এত অস্থির হবার কি আছে? ক্ষুধা লাগেনি তাই খাইনি।

ক্ষুধা না লাগলে জোর করে না খাওয়াই ভালো দাদী।

কথা শেষ হবার আগে মাঝখান দিয়ে কথা বলবি না। মৃদু ধমক দিলেন নাতনীকে খাদিজা বেগম।

নাবিহা হাসি চেপে বলল, আচ্ছা ঠিকআছে আর মাঝখান থেকে কিছু বলবো না। তুমি বলো এরপর কি হলো।

এরপর আর কি হবে দুনিয়ার লেকচার দেয়া শুরু করলো পৃথিবীর মানুষদের নিয়ে। বাড়িতে কত অপচয় করি আমরা সেসব নিয়ে কিছুক্ষণ বকবক করলো। তোর বাপ বুড়া হয়ে যাচ্ছে বুঝলি!  অকারণে বেশি কথা বলা বার্ধ্যকের লক্ষণ।

খিলখিল করে হেসে ফেললো নাবিহা। নাতনীর সাথে খাদিজা বেগমও হাসিতে যোগ দিলেন। কিছুক্ষণ হাসাহাসি করার পর নাবিহা বলল, আজ পাপার জন্য  আমি নাস্তা বানাবো দাদী।  

তোর পাপা নাস্তায় খাবে ওটস নয়তো কর্ণফ্লেক্স। এগুলোর আবার বানাবি কি?

অনেক কিছু। সুন্দর একটা বাটিতে দুধ হালকা গরম করে কর্নফ্লেক্সের সাথে ছোট ছোট করে কয়েক রকমের ফল কেটে দেব, কয়েকটা কাজু বাদাম ও পেস্তা কুঁচি করে দেবো, সামান্য একটু জাফরান দেব এবং সব শেষে এক চামচ সুইটলেস মধু দেব। দেখবে পাপা সাথে সাথে খেয়ে নেবে। বাচ্চারা খেতে না চাইলে মায়েদের এমন ভাবেই খাওয়াতে হয় বুঝেছো?   

এখন বুঝেছি এমনিতেই কি আর প্রবাদ বাক্যে হয়েছে 'মার চেয়ে মাসীর দরদ বেশি'?  

নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, মার চেয়ে মাসীর দরদ বেশি না হতে পারে। কিন্তু ছেলের জন্য মায়ের চেয়ে বাবার জন্য মেয়ের দরদ অবশ্যই বেশি।    

হাসলেন খাদিজা বেগম। তাই তো দেখছি। কিন্তু হঠাৎ বাবার প্রতি মেয়ের এত দরদের কারণ কি?  

চেহারার দুষ্টুমি ভাব হঠাৎ করেই উবে গেলো নাবিহার। মন খারাপের সুরে বলল, নানাভাই অসুস্থ হবার পর থেকে গত এক সপ্তাহে আমি বেশ কয়েকবার হসপিটালে গিয়েছি। মামণির নানাভাইকে নিয়ে অনেক গল্প করেছে আমার সাথে। মামণি নানাভাইকে অনেক বেশি ভালোবাসে সেটা আমি সবসময়ই জানি। কিন্তু সেই ভালোবাসা কখনো এমন করে প্রকাশ করতে দেখিনি মামণিকে। নানাভাইয়ের প্রতি মামণির ভালোবাসা দেখে আমার মনেহয়েছে আমি মোটেই পাপাকে ভালোবাসি না। দাদী আমিও মামণির মত মেয়ে হতে চাই। পাপার সবকিছু খেয়াল রাখতে চাই। জানো মামণির সবচেয়ে প্রিয় কাজ কি ছিল? প্রতিদিন ফজরের নামাজ সেরে নিজ হাতে নানাভাইর জন্য চা বানানো। বারো বছর বয়স থেকে মামণি নানাভাইর জন্য চা বানাতো। আমার বয়স তেরো বছর নয় মাস। অথচ আমি কখনোই পাপার জন্য ফজরের পর চা বানাইনি। নানাভাইকে আমি যখনই কিছু জিজ্ঞেস করি নিজের সম্পর্কে। নানাভাই হাসতে হাসতে বলেন, তোমার মামণিকে জিজ্ঞেস করো। এমন বলেন কারণ মামণি নানাভাই সম্পর্কে সবকিছু জানে। কিন্তু আমি তো পাপা সম্পর্কে সবকিছু জানি না। 

নাতনীর ব্যথিত কন্ঠস্বর শুনে হেসে ফেললেন খাদিজা বেগম। কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বললেন, হয়েছে এখন আর গাল ফুলাতে হবে না। যা তোর পাপার জন্য নাস্তা রেডি কর। আর শোন।

হ্যা বলো শুনছি।

খাদিজা বেগম হেসে বলল, তোর পাপা মোটেই তোর নানাভাইয়ের মত সহজ সরল মানুষ না। কেউ যখন মন থেকে চায় যে তাকে সবাই বা বিশেষ কেউ সত্যিকার অর্থে বুঝুক। শুধু তখনই তাকে বোঝা সম্ভব। তোর পাপা এমনটা কখনোই চায় না। নিজের চারপাশে তাই রহস্যের জাল বিছিয়ে রেখেছে। সেই জাল মাকড়শার জাল নয় যে হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলবি। ছিঁড়তে গেলে তোর হাত কেটে পড়ে যাবে কিন্তু জালের কিছুই হবে না।  

সেদিন না বললে মামণি নিজের চারপাশে রহস্যের জাল বিছিয়ে রেখেছে। হাসতে হাসতে বললো নাবিহা।

তোর পাপা আর মামণি একই রকম। রহস্যপুরীর রহস্য কন্যা আর রহস্য পুত্র। অকারণে মানুষদেরকে মানসিক অশান্তিতে রাখা হচ্ছে ওদের ফেব্রেট হবি।

নাবিহা হেসে বলল, আচ্ছা দাদী মানুষ যাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তাদের উপরই কেন সবচেয়ে বেশি রাগ করে, সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হয়? তোমার আর নানুমণির সাথে সময় কাটাতে এলেই এই প্রশ্নটা জাগে আমার মনে। তুমি আর নানুমণি সারাক্ষণ হয় পাপা, নাহয় মামণিকে বকাঝকা করতেই থাকো। কিন্তু এই কথা আমরা সবাই জানি পাপা আর মামণি তোমাদের দুইজনের জানের জান, পরাণের পরাণ।  

হয়েছে পাকামো করতে হবে না। বাপের জন্য নাস্তা বানাতে এসেছিস তাই কর চুপচাপ।

নাবিহা দাদীর সাথে দুষ্টুমি কিছুক্ষণের জন্য এক পাশে সরিয়ে রেখে মনের আনন্দে পাপার জন্য নাস্তা তৈরি করাতে মনযোগ দিলো। 

@

নাস্তার ট্রে হাতে পাপার রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো নাবিহা। দরজা খোলা থাকায় নক না করেই রুমের ভেতর উঁকি দিলো। পাপাকে বুক সেলফের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দরজা নক করে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ পাপা। আমি কিন্তু তোমার রুমে ঢুকে পড়েছি।

হাতের বইটা সেলফে রেখে ঘুরে মেয়ের দিকে তাকিয়ে সালামের জবাব দিয়ে জাওয়াদ বলল, একেবারে দাদীর যোগ্য নাতনী হয়েছো তুমি।

নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, না পাপা আমি এখনো পুরোপুরি দাদীর মত হতে পারিনি তো। মনেআছে কয়েকদিন আগে দাদী দড়াম করে তোমার রুমে ঢুকলে তুমি বলেছিলে, রুমে ঢোকার আগে একবার অন্তত নক করা উচিত মা। জবাবে দাদী বলেছিল, কোন দেশের লর্ড গভর্ণর তুই যে নক করা ছাড়া রুমে ঢোকা যাবে না? আজই আমি খুন্তি দিয়ে পিটিয়ে তোর রুমের দরজা ভেঙে গুড়াগুড়া করে দেব। না থাকবে দরজা, না দরকার হবে নক করার।

জাওয়াদ হেসে ফেলে বলল, আম্মাজান আপনিও সেই পথেই এগুচ্ছেন। যাইহোক, আমি এখন বেরুবো। জটপট আপনার আগমনের কারণ বলে ফেলেন।

তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছি পাপা। আজ আমি তোমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেবো। খাওয়ানোর সময় ভিডিও করবো। তারপর সেই ভিডিও দাদী আর নানুমণিকে সেন্ড করবো। যাতে দুইজন বুঝতে পারে যে, আমি উনাদের চেয়ে ভালো মা।

এগিয়ে এসে মেয়ের পাশে বসতে বসতে জাওয়াদ বলল, আমার গত কয়েকমাসের পর্যবেক্ষণ বলছে তোমার চিন্তা-ভাবনাতে দুষ্টু কোন ভাইরাসের আক্রমণ ঘটেছে। দুষ্টু ভাইরাস তোমার চিন্তা-ভাবনাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলার আগেই টিট্রমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে।

চোখ বড় বড় করে তীব্র প্রতিবাদের কন্ঠে নাবিহা বলল, কক্ষনো টিট্রমেন্ট করাবো না আমি। কারণ এই দুষ্টু ভাইরাস অর্ধেক আমার পাপার কাছ থেকে এসেছে, আর অর্ধেক মামণির কাছ থেকে।

হেসে নাস্তার ট্রে নিজের দিকে টেনে নিয়ে জাওয়াদ বলল, দেখতে তো ডেলিশিয়াস লাগছে।

ইনশাআল্লাহ খেতেও ডেলেশিয়াস লাগবে পাপা। কেন জানো?

কেন?

কারণ কোন খাবার তখনই সুপার ডেলিশিয়াস হয় যখন উপকরণ সমূহের সাথে প্রচুর পরিমাণে ভালোবাসা মেশানো হয়। আমিও এত্তো এত্তো ভালোবাসা মিশিয়ে তোমার জন্য এই নাস্তা বানিয়েছি।

হুমম, বুঝলাম। তা এই তথ্যখানি আমার আম্মাজান পেলেন কোথায়? তার মামণির কাছে?

নাবিহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ এমন ফাটাফাটি তথ্য আমার মামণি ছাড়া আর কে দেবে?

তাও অবশ্য ঠিক। আপনি নাস্তা করেছেন?

উহু, আমি মামণির সাথে খাবো।

খাওয়ার উদ্দেশ্যে চামচ মুখের কাছে নিয়েও থেমে গেলো জাওয়াদ। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মামণি বাড়িতে?

নাবিহা হেসে বলল, না। মামণি হসপিটালে নানাভাইয়ের কাছে। আমি এখন তোমার সাথে হসপিটালে যাবো মামণির জন্য নাস্তা নিয়ে। দাদী মামণির জন্য নাস্তা বানাচ্ছে।

আর কিছু না বলে চুপচাপ পাপাকে নাস্তা করাতে মন দিতে দেখে নাবিহাও কিছুক্ষণ নীরব রইলো। এরপর হেসে বলল, পাপা জানো আমাদের আর্ট ক্লাসে অনেক মজার একটা হোমওয়ার্ক দিয়েছে।

মজার হোমওয়ার্ক?

হুম! প্রফ আমাদের সবাইকে নিজ নিজ জীবনের সবচেয়ে সুন্দর একটি মূহুর্ত এঁকে নিয়ে যেতে বলেছে। কিন্তু আমি মহা বিপদে পড়ে গিয়েছি পাপা।   

কেন?

কারণ আমার জীবনের সব মূহুর্তই তো সুন্দর।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু জীবনের অসংখ্য সুন্দর মূহুর্তের মাঝেও কিছু কিছু স্পেশাল মূহুর্ত থাকেই। যে মূহুর্তগুলোর স্মরণে অজানতেই কখনো ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে, কখনো বা চোখ ভিজে ওঠে আনন্দাশ্রুর স্রোতে। তুমি গভীর ভাবে চিন্তা করো। ইনশাআল্লাহ পেয়ে যাবে এমন কোন না কোন মূহুর্ত।

মুখ গোমড়া করে নাবিহা বলল, জানো না তো পাপা কি হয়েছে। অনেক ভাবার পর আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্তটি খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু কিভাবে সেই মূহুর্তটি আঁকতে হবে সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি। নানাভাই অসুস্থ না থাকলে মামণিকে সাহায্য করতে বলতাম। কিন্তু এখন নানাভাইয়ের জন্য এমনিতেই মামণির অনেক মন খারাপ। আমার সুন্দর সেই মূহুর্তটির কথা শুনলে মামণির মন আরো খারাপ হয়ে যাবে।

তোমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত তোমার মামণির মন খারাপ করে দেবে? বেশ অবাক কন্ঠেই প্রশ্ন করলো জাওয়াদ।

হ্যা দেবে। কারণ তুমি যেদিন প্রথম আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলে সেই মুহুর্তটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত। আর আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কমপ্লিমেন্ট কি শুনবে পাপা?  

জাওয়াদ হেসে বলল, অবশ্যই শুনবো মা। বলো।

আমাকে প্রথম কোলে তুলে নেবার পর কপালে আদর দিয়ে তুমি যে বলেছিলে, মাশাআল্লাহ আজকের পর থেকে তো আমাকে কোনদিন আর আকাশের পানে তাকিয়ে জোছনা দেখতে হবে না। আপনি তো ধরত্রীর বুকে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ আম্মাজান। তুমিই বলো এসব শুনলে মামণির মন খারাপ হবে না?

মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, হুম অনেক মন খারাপ হবে তোমার মামণির। তোমার মামণি আর তোমার নানাভাইয়ের বন্ধনটা অন্যরকম মুগ্ধতা আর ভালোবাসার সংমিশ্রণ। জানো আমি সবসময় দোয়া করতাম আল্লাহ যাতে আমাকেও একটি মেয়ে দেন। যাতে আমিও তোমার নানাভাইয়ের মতো অসাধারণ একজন বাবা হতে পারি।

তুমি নানাভাইয়ের মতোই অসাধারণ পাপা। কিন্তু আমি এখনো মামণির মতো মেয়ে হতে পারিনি।

তুমি তো এখনো অনেক ছোট মা। ধীরে ধীরে হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এখন যাও তুমি রেডি হয়ে এসো। আমাদেরকে এখনি বেরোতে হবে।

নাবিহা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ঠিকআছে পাপা এক্ষুনি রেডি হয়ে আসছি।              

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন