রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...৭




সুবহা ভাবীর খোঁজে বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়ে বারান্দায় লাইন ধরে কোমরে হাত দিয়ে ঝগড়ার স্টাইলে সমবয়সী বোন ও ভাবীদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেললো নূহা। সাথে সাথে সবার চেহারার গাম্ভীর্য আরো এক ধাপ উপরে উঠে গেলো। নূহা হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা ঠিকআছে সরি বলছি। মাফ চাইছি। যাও কানও ধরছি। এখন সম্মিলিত বিদ্রোহ ত্যাগ করো।

রাহা বলল, তোমার অপরাধ কি এতই অল্প যে সরি বললে, মাফ চাইলে আর কান ধরলেই সব ভুলে বিদ্রোহ ত্যাগ করা সম্ভব?

নূহা হেসে বলল, উহু, আমার অপরাধ বিশাল বড়। তবে সেটা কখনোই তোমাদের মনের ক্ষমার বিশালত্বকে ছুঁতে পারবে না। তোমাদের মনের আকাশ সমান বিশালতার কাছে আমার অপরাধ উড়ন্ত কোন এক পাখীর সমান ক্ষুদ্র।

তাইয়্যেবা, হাবীবা, ফারাহ, আইজা, নুসাইবা আর রাহা সবাই একসাথে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে নূহাকে আদরের একটা ঘুষি লাগিয়ে দিয়ে রাহা বলল, এই কথা বলার ক্ষমতা যদি আল্লাহ তোমাকে না দিতেন। তাহলে স্বার্থপর স্বভাবের কারণে এতদিনে সবাই তোমাকে ত্যাগ করে চলে যেত।

একদম ঠিক বলেছিস রাহা। নূহা তুই কিন্তু খুবই অন্যায় করিস আমাদের সাথে। যখনই বাড়িতে আসিস হয় বড়দের সাথে মিটিং মিছিল করিস, নয়তো জুনিয়র গ্রুপ নয়তো কিড গ্রুপের সাথে গল্পগুজব বা হৈচৈ করেই সময় কাটিয়ে দিস। শেষবার কবে আমরা বোনেরা মিলে একসাথে বসে গল্প করেছি বলতো? তোর এমন আচরণে আমরা মাঝে মাঝে সত্যিই খুব কষ্ট পাই।

আইজার মুখে বলা শব্দগুলো চেহারাতেও ফুটে উঠেছিল বেদনা রূপে। হাত বাড়িয়ে আইজার হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে নূহা বলল, আই এম সরি। কিন্তু কি করবো বলো? এত অল্প সময়ের জন্য আসি ইচ্ছে থাকলে তোমাদের সাথে আলাদা সময় কাটানো হয়ে ওঠে না।  

তাইয়্যেবা বলল, এত অল্প সময়ের জন্য কেন আসো নূহা? আমরা সবাই তোমাকে কতটা মিস করি সেটা তো তোমার অজানা নয়। আমরা সবাই কতটা অধীর হয়ে তোমার একেবারে বাড়িতে ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুণছি সেটাও তুমি জানো। তাহলে? মামণি, মা, আম্মি প্রতিদিন নিজ হাতে একবার করে তোমার রুম সাজায়, গুছায়। যাতে রুমে ঢুকে কখনো তোমার একথা মনে না হয় যে, তুমি ছিলে না বাড়িতে। বাবা, পাপা এমনকি বাপী পর্যন্ত তোমার রুমে গিয়ে বসে থাকেন মাঝে মাঝে। সবার এমন ভালোবাসাকে আর কতদিন এভাবে অবমূল্যায়ন করবে বলো তো?

তুইও বলিস কারো অকৃত্রিম ভালোবাসাকে কখনোই উপেক্ষা করতে নেই। তাহলে একসময় ভালোবাসার অভাবে তৃষিত জীবন কাটাতে হয়। বললো ফারাহ।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, ও আচ্ছা এতক্ষণে না আমি বুঝলাম আসল কাহিনীটা কি। মাদারস গ্রুপ তোমাদেরকে এমন দলবল বেঁধে পাঠিয়েছে তাই না? আমাকে ইমোশনালী ব্ল্যাকমেইল করার জন্য? কিন্তু ভগ্নীগণ আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, ব্ল্যাক ইমোশনকে হোয়াইট করা আর মেল-ফিমেলের ইমোশনের মারপ্যাঁচের সমাধান করার কাজই সারাক্ষণ করতে হয় আমাকে। আলহামদুলিল্লাহ এই কাজে তাই তোমাদের চেয়ে এবং মাদারস গ্রুপের চেয়ে আমি অনেক বেশি দক্ষ।  

হেসে ফেললো সবাই আবারো একসাথে। কিন্তু পরমূহুর্তেই মুখ গোমড়া করে হাবীবা বলল, তোমার এই অকারণ জেদ ছেড়ে দাও না নূহা প্লিজ। তুমি বাড়িতে আসার পরও যাতে অপ্রয়োজনীয় দেখা, সাক্ষাৎ হয়ে না যায় সেজন্য ভাইজান আলাদা কটেজ বানিয়ে নিয়েছেন নিজের এবং বাচ্চাদের জন্য। মাসের পর মাস পেরিয়ে যায় আমরাই দেখা পাইনা ভাইজানের। তুমি চলে এলে ভাইজান যদি বাড়িতে ঢোকার এবং বেড়োবার জন্যও আলাদা গেট বানিয়ে নেয় অবাক হবো না আমরা। তাহলে সমস্যা কোথায়?

নূহা হেসে বলল, উনি এমনটা করলে আমিও অবাক হবো না। প্রায় তিন বছর আমি উনার সাথে ছিলাম। তাই আমি উনার ভালোবাসা যেমন জানি, দৃঢ়তা ও কঠোরতাও জানি। আলহামদুলিল্লাহ উনি অনেক মজবুত ঈমানের একজন মানুষ। কিন্তু সেই তুলনায় আমার ঈমান অনেক বেশি দুর্বল। তবে তোমাদের কাছে আমি ওয়াদা করছি। কোনদিন যদি নিজের ভেতর অতখানিক দৃঢ়তা অনুভব করি, যারফলে একই বাড়িতে থাকাটা সম্ভব মনেহয় আমার কাছে। আমি অবশ্যই চলে আসবো তোমাদের সাথে থাকার জন্য। জানি আমার অনুপস্থিতি তোমাদের সবাইকে অনেক কষ্ট দেয়। কিন্তু তোমরা জানো না তোমাদের শূন্যতা আমার মনে লক্ষ, কোটি, সহস্র তলার ইমারত গড়ে উঠেছে। যার প্রতিটি কক্ষের একটাই মিল। শূন্যতার ভয় জাগানিয়া আর্তনাদ। তবুও আমি দূরে থাকি। কারণ আমি জানি আবেগের দুর্বলতার বিধ্বংসী রূপ। আমি আমার সন্তানদের থেকে দূরে থাকি। কারণ চাই না সন্তানদেরকে টার্গেট করে শয়তান আমাকে ভুল পথে পরিচালিত করুক।

হঠাৎ করেই যেন সমস্ত গুঞ্জরন থেমে গিয়ে নীরবতা নেমে এলো বাগিচায়। বেশ অনেকক্ষণ পর নূহার কাঁধে হাত রেখে হাবীবা বলল, সরি নূহা। আমরা আসলে এতকিছু ভেবে এসব কথা বলিনি।

নূহা হেসে বলল, ইট’স আলরাইট। আমরা অন্যের অবস্থান থেকে ভাবি না বলেই আসলে এত দৃঢ় ভাবে অন্যের সমালোচনা করতে পারি বা তাকে ভুল প্রমাণিত করার চেষ্টা করতে পারি। অথচ প্রতিটি মানুষই কিন্তু নিজের অবস্থা, ক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনা করেই জীবনের নাজুক কোন সিদ্ধান্ত নেয়। মজার একটা ব্যাপার কি জানো? জাওয়াদ ভাইয়াই আমাকে বলেছিলেন, জীবনের আবেগীয় সিদ্ধান্তগুলো নেবার সময় কখনোই অন্যদের অ্যাকশন ও রিঅ্যাকশনে চিন্তা করবে না। সবসময় তোমার নিজের যোগ্যতা ও ক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রেখে সিদ্ধান্ত নেবে। যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের উপর সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না। সেখানে অন্যদের খুশির জন্য নিজের সাধ্যের বাইরের কিছু নিজের উপর চাপিয়ে নেবায় চেয়ে নির্বুদ্ধিতা আর কিছু নেই। এবং এই বাড়তি বোঝা বইতে যদি কোনদিন তুমি ব্যর্থ হও, যাদের জন্য তুমি নিজের উপর এই বোঝা চাপিয়েছিলে তারা কেউ সেদিন এগিয়ে এসে তোমার দায় বহন করতে রাজী হবে না। যেদিন তুমি আল্লাহর আদালতে দন্ডায়মান থাকবে। সেদিন নিজের সমস্ত দায় শুধু তোমাকে একাই বহন করতে হবে। তাহলে কেন যাবে অন্যের জন্য বাড়তি বোঝা বহন করে নাস্তানাবুদ হতে?

রাহা বলল, উফ ভাইজানকে তো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারাতে নোবেল প্রাইজ দেয়া উচিত।

হেসে ফেললো সবাই আবারো। নূহাও হেসে বলল, আচ্ছা এখন আমাকে যেতে হবে। নয়তো আমার সোনা মোণা বেবীদেরকে সারপ্রাইজ দেয়া মিস হবে যাবে। আজ ইনশাআল্লাহ থাকছি আমি রাতেও। সুতরাং, তোমরা সবাই রেডি হও নিশি যাপনের জন্য। আর এখন নিজ নিজ মোবাইলের এসএমএস চেক করো। একই ম্যাসেজ তাই যে কোন একজনেরটা চেক করলেও হবে।

নুসাইবা হেসে বলল, কি পাঠিয়েছো?

নূহা হাঁটতে হাঁটতে বলল, উফফ, এত্তো অলস কেন এই মেয়েগুলা? নিজেরা পড়ে নাও। ফী আমানিল্লাহ।

রাহা বলল, সবার মোবাইলই তো দেখি রুমে রয়ে গিয়েছে। দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি। রাহা ছুটে গিয়ে নিজের মোবাইল নিয়ে এলো। আধঘন্টা আগে এসএমএস পাঠিয়েছে নূহা অথচ খেয়ালই করেনি কেউ। এসএমএস ওপেন করে রাহা বলল, আচ্ছা আমি পড়ে শোনাচ্ছি। “হাতে হাত রেখে চলো চলে যাই মোরা দূর কোন গাঁয়। দু'পা বিছিয়ে ঘাসের মাদুরে বসি সুশীতল গাছের ছায়। মেতে উঠি চলো হৈ হুল্লোরে, ছড়াই সুপ্তিত কথার ফুলঝুরি। বেঁধে ছন্দের সুতোয় লাটাই ঘুরাই, মনটা যে মোদের ইচ্ছে ঘুড়ি। মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে বেড়াই, এঁকে দেই সব অধরা স্বপ্ন গুলোরে। নিঃসঙ্গ ক্ষণে টিমটিময়ে জ্বলবে তারা নক্ষত্রের পুষ্পিত সম্ভারে। ছুটি দিয়ে সকল ব্যস্ততার হিসাব নিকাশ মেলে দেই ডানা। ভাবনার চড়ুইভাতি খেলবো আজ ভুলে যাবো জগত চির চেনা। তুলে নেবো সযতনে মনের গহীনে লুকানো শেষবিন্দু হতাশা। সন্তোষের ঝর্ণাধারায় মেটাবো অন্তরের মরুময় শুষ্ক পিপাসা। ইনশাআল্লাহ।”

হাসি ফুটে উঠলো সবার চেহারাতেই। তাইয়্যএবা বলল, চলো আমাদের নিশি আড্ডার জন্য নূহার পছন্দের নাস্তা বানাই সবাই মিলে।

আইজা হেসে বলল, গ্রেট আইডিয়া। হ্যা চলো যাই। এখন রান্নাঘরও ফাঁকা আছে।

@

স্কুল থেকে বাচ্চাদেরকে আনতে যাবার উদ্দেশ্যে গাড়ীতে উঠে বসতে বসতে সুবহা বলল, নায়লার সাথে খালামণির আচরণটা খেয়াল করেছিল বেরোনোর সময়? ভাবতেই প্রচন্ড কষ্ট হয় যে, আমাদের পরিবারটাও ধীরে ধীরে অন্য সব সাধারণ পরিবারের মতোই হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সেখানে কেউ কাউকে বোঝার চেষ্টা করে না। কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটলে এর পেছনে নিজের কতটুকু দায় আছে সেটা খুঁজে দেখার বদলে, অন্যের উপর সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে তাকে নাজেহাল করার চেষ্টা করে। খালামণি ঠিক এই কাজটিই করছে নায়লার সাথে। মানছি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছে নায়লা। কিন্তু এমন রুড বিহেব করলে যে মেয়েটার অপরাধবোধ কমে গিয়ে সেখানে বিদ্রোহী ভাবের জন্ম নেবে সেটা বুঝতেই চাইছেন না খালামণি।

ভাবী আমাদের বাচ্চারা সব তো টিনএজে পৌঁছে গিয়েছে। ওদের ব্যাপারে মনেহয় আরো সতেচন আর সজাগ থাকা উচিত আমাদের। জিহাদ, জিশান, আবীর ওদের তো প্রায় চৌদ্দ হয়ে গিয়েছে বয়স। আবার নাবিহা, মাঈশা, কাশফিয়াও একই বয়সী। ওদের একে অন্যের সাথে পর্দার বিষয়টা এখন থেকেই সিরিয়াসলি নেয়া উচিত। আমরা যখন ছোট ছিলাম বারো বছরের পর থেকেই এই ব্যাপারগুলো খুব শক্ত হাতে হ্যান্ডেল করেছেন মামণি, খালামণিরা।

এদের ব্যাপারেও এসব খেয়াল রাখা হচ্ছে। কিন্তু তোকে আমি কি বলছি আর তুই কি বলছিস?

নূহা হেসে বলল, ফুপির ব্যাপারে যা বলার উনার সামনে বলবো। উনার ভুল কাজের হিসাব নিকাশ করতে বসে শুধু শুধু গীবত করে আমাদের পরকালে হিসাবকে কঠিন করতে যাবার দরকার কি?

সুবহা হেসে বলল, একেব্বারে জাওয়াদের ডুব্লিকেট কপি তুই।

আলহামদুলিল্লাহ। ভুলে যাচ্ছেন কেন ভাবীজান হি ইজ মাই মডেল, মাই হিরো। সারাটা জীবন তো আমি উনার মতোই হতে চেয়েছি। এখন যেমন চাই আমাদের বাচ্চারা সবাই উনার মতো হোক। আমি আসলে বাচ্চাদেরকে নিয়ে খুব টেনশনে আছি। বিশেষ করে মেয়েদের নিয়ে। গত সপ্তাহে আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল সুপার মার্কেটে। কিছুক্ষণ নিজেদের অতীত দিনগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর পর বর্তমানে এসে দাঁড়াতেই আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ে গিয়েছিল ওর। ভীষন মন খারাপ করে সাব্রিনা বলেছিল, সংসার তো যেমন তেমন চলে যাচ্ছে কিন্তু সন্তানদের নিয়েই যত অশান্তি। বিশেষ করে ইউরোপের বৈরী পরিবেশে টিনএজ মেয়েকে নিয়ে নিত্য হাবুডুবু খেতে হচ্ছে। মেয়েকে কিছু বোঝেতে যাওয়া এভারেস্ট জয় করার মতো কিছু মনেহয়। আর প্রতিদিনই একাধীক বার এভারেস্ট জয়ের জন্য অভিযাত্রী হতে হয়। মেয়েগুলো কেন এমন হয়? কেন বুঝতে চেষ্টা করে না মাকে? কেন মনেকরে মা তার শত্রু? শত চেষ্টা করেও কেন বোঝানো যায় না কল্যাণ কামনা করাই মায়ের উদ্দেশ্য থাকে? অবশ্য শুধু সাব্রিনাই না অভিজ্ঞতাতে মনেহয়েছে মেয়েদেরকে ঘিরে এমন এক ঝাঁক অভিমানী প্রশ্নমালা মনেহয় বেশির ভাগ মায়ের মনেই থাকে। ঠিক তেমনি মেয়েদের মনেও থাকে এমন একগুচ্ছ অভিমানী শব্দ।

সুবহা হেসে বলল, আসলেই। জানিস টিনএজে আমাকে দেয়া আম্মুর অনেক উপাধীর মধ্যে একটা  ছিল ‘তর্ক কুমারী’। যখন উপাধীটা পেয়েছিলাম তখন অখুশি হলেও এখন বুঝি কতটা পারফেক্ট ছিল উপাধীটা আমার জন্য। অতীতের পানে দৃষ্টি রাখলে উপলব্ধি করি সত্যিই ভয়াবহ রকমের তার্কিক ছিলাম আমি। আমার মনের খাপে ঠিক মতো না বসলে আমাকে দিয়ে সেই কার্য সম্পাদন করাতে ঘাম ছুটে যেত আম্মুর। যদিও বেশির ভাগ সময়ই আম্মু আমাকে বোঝাতে ব্যর্থ হতেন কাজটি কেন আমার জন্য ভালো। যারফলে হয় আমি কাজটি থেকে বিরত থাকতাম, কিংবা করলেও অসন্তোষ নিয়ে করতাম। আম্মুকে ঘিরে একটাই অভিযোগ ছিল সেটি হচ্ছে-“আমাকে একদম বোঝেন না। আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোন মূল্য নেই আম্মুর কাছে।” এই ভাবনা অভিমানের শ্রাবণ হয়ে কত ভিজিয়েছে আমাকে একাকীত্বে।আম্মু প্রায়ই অভিমানের সুরে বলতেন যে, যেদিন তুই মেয়ের মা হবি সেদিন বুঝবি আমাকে। আর তখন তোর এইসব কর্মকান্ডের কথা মনে হলে নিজেই নিজেকে বকে দিতে ইচ্ছে করবে। আমার অবশ্য মোটেই এমন ইচ্ছে করে না। কারণ সেই মুহুর্তগুলো এখন আমার বিনোদনের অতি উত্তম মাধ্যম। তবে নিজেই নিজের দিকে চোখ পাকিয়ে অতি আদুরে গলায় মাঝে মাঝে বলি, ফাজিলের চূড়ান্ত একটা মেয়ে ছিলে তুমি। আর ডায়েরীর পাতায় পাতায় আম্মুকে ঘিরে রচিত ‘ক্ষোভের উপাখ্যান’কে মনেহয় ‘হাসির ঝুড়ি’।

নূহা হেসে বলল, আমিও যখনই অবুঝ আচরণ করতাম মামণি বলতেন যখন নিজে মা হবি তখন বুঝবি। মামণির অভিমানী কথাটা প্রায়ই বেজে উঠতো মনে। মাঝে মাঝে ভাবতাম সত্যিই কি মাকে বোঝার জন্য মেয়ের মা হওয়াটা শর্ত? কিন্তু কখনোই খুঁজে পাইনি জবাব। কিন্তু অবশেষে একদিন বোঝার সেই মুহুর্তটি আমার জীবনেরও এসে গিয়েছিল। যেদিন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ রহমাহ স্বরূপ আমি নাবিহাকে পেয়েছিলাম। প্রিম্যাচিউর হবার কারণে জিহাদ আর জিশানকে বেশ অনেকটা সময় স্পেশাল কেয়ারে রাখতে হয়েছিল। নাবিহা দুই ভাইয়ের তুলনায় স্টং হবার কারণে ওদের দুজনের আগেই ডক্টরদের কেয়ারকে বিদায় জানিয়ে মায়ের মমতায় সিক্ত হবার জন্য হাজির হয়ে গিয়েছিল। মানসিক ভাবে সম্পুর্ণ রূপে বিধ্বস্ত ছিলাম আমি ঐ সময়। কিছু নাবিহাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম মনে হয়েছিল আকাশের সবগুলো তারা যেন এক সাথে ঝিলমিলিয়ে উঠলো। প্রথম যখন ওকে কোলে নিয়েছিলাম এমন এক উপত্যকায় চলে গিয়েছিলাম যার নাম বোধ করি ‘প্রশান্তির দ্বীপ’।ওর দুচোখে চোখ রাখতেই খুঁজে পেয়েছিলাম সেই স্বপ্নপুরী যার অস্তিত্ব এতদিন শুধুই আমার কল্পনায় ছিল। ওর তুলতুলে নরম হাত দিয়ে যেই মুহুর্তে ছুঁয়ে দিয়েছিল আমাকে প্রথম বারের মতো, সোঁদা গন্ধে ভরে শিশির কণাদের ঝিরঝির বরষা জাগিয়ে গিয়েছিল সত্ত্বা জুড়ে মাতৃত্বের তৃষ্ণা। এখনো স্পষ্ট মনেআছে প্রথম বার যখন আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে কান্নার ভঙ্গী করেছিলো, মমতার চাদরে জড়িয়ে উষ্ণ ছোঁয়ায় আশ্বস্ত করে বলেছিলাম, কোন ভয় নেই সোনা এই তো মামণি আছি তোমার কাছে। মায়ের মুখে শোনা ভালোবাসার পরশে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তখন নাবিহা। ওকে জড়িয়ে ধরে মামণির দিকে চোখ যেতেই দেখতে পেয়েছিলাম, নিজেকে আড়াল করে মুছে নিচ্ছে চোখের অশ্রুবিন্দু। হুমম… সেদিনই প্রথম উপলব্ধি  করেছিলাম মেয়েকে ঘিরে মায়ের মনের ভালোবাসার নিরবধি ঝর্ণাধারাকে।

তোর কথা শুনে তো ইচ্ছে করে এমনই আরেকবার মা হয়ে যেতে। অনুভব করতে এসব মূহুর্তকে আবারো। হাসতে হাসতে বললো সুবহা।

নূহাও হেসে বলল, হয়ে যাও বাঁধা দিয়েছে কে তোমাকে?

বয়স রে ভগ্নী বয়স। ফোরটি টু চলছে আমার সেই খেয়াল আছে?

নূহা হেসে বলল, কিন্তু তোমাকে দেখে থার্টিও মনেহয় না মাশাআল্লাহ।

সুবহা হেসে বলল, উপরেই ফিটফাট বুঝলি। ভেতরের কলকব্জা সব বুড়ি হয়ে গিয়েছে। তবে কি জানিস? নিজ অভিজ্ঞতা থেকে আমারো মনে হয়েছে যেসব মিষ্টি জিনিসে একটু লবণের ছিটা পড়লে স্বাদ আরো বেড়ে যায় মা-মেয়ের সম্পর্ক হচ্ছে তেমন ধরণের মিষ্টি বন্ধন। কখনো মা মেয়েকে বোঝে না তো কখনো মেয়ে মাকে,কখনো দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্যর কারণে মতের অমিল,রুচিবোধের ভিন্নতার কারণে পছন্দের অমিল।আরো কত কি লবণের ছিটা যে পড়ে মা-মেয়ের এই বন্ধনের উপর। কিন্তু তাতে কখনোই বন্ধন ছিড়ে যায় না। যাবেই না কিভাবে মেয়েরা তো মায়েরই অংশ। আর মেয়েরা মায়েরই অংশ বলেই হয়তো মা ভুলে যান যে তার মেয়েটি শুধুই তার মেয়ে নয়। সেই সাথে তার আরেকটি সত্ত্বাও তার আছে। সে একজন নারীও। আর জন্মের পর থেকে নিয়ে নারী হবার সফর পারি দিতে তাকে পেড়োতে হয়-শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের ধাপ। ঠিক অনেকটা ঋতু বদলের মত। একেক ঋতু যেমন একেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়। বয়সের প্রতিটি ধাপও তেমনি একেক রূপ নিয়ে হাজির হয় সামনে। মা যদি নিজের দিকে ভালো করে তাকান তাহলে অনুভব করতে পারেন তার মেয়ে এখন কোন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কারণ সেই পথ মাড়িয়েই তাকে ‘কারো মেয়ে’ থেকে ‘কারো মা’ হতে হয়েছে। আবার এটাও ঠিক যে মেয়েরা ভুলে যায় তার মা ‘একজন মা’ হবার সাথে সাথে একজন নারীও। তাই শুধু মা ভেবে নারী হিসেবে মাকে মূল্যায়ন করতে ভুলে যায়।

হুমম... মা আর মেয়ে দ্বন্দ্বের সমাধান আসলে নারীত্বের মূল্যায়নেই। আমি তাই আপ্রাণ চেষ্টা করি সবসময় নাবিহাকে মায়ের চোখে না দেখে মাঝে মাঝে নিজের কৈশোরের আয়নায় ওর প্রতিচ্ছবি দেখতে। নাবিহাকেও বোঝাতে চেষ্টা করি তোমার বয়সটা আমিও পেড়িয়ে এসেছি। তাই এইটুকু  ভরসা রাখো যে মামণি তোমাকে বুঝবো। কিন্তু কখনোই ভুল বুঝবো না, ইনশাআল্লাহ। আসলে ভালো মা কিংবা ভালো মেয়ে হবার প্রথম শর্তই হচ্ছে একে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করা। একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস রাখা। আর মায়ের অভিজ্ঞতা যেহেতু বেশি তাই দায়িত্বও বেশি। জন্মের পর মেয়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় মায়ের মমতার চাদরের। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুরন্ত শিশুতে রুপান্তরিত মেয়েটির মমতার চাদরের চেয়েও বেশি দরকার হয় এমন একজন সঙ্গীর যে তার দুরন্তপনাকে উপভোগ করবে। হেসে, হাততালি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করবে। ঠিক এমনি ভাবেই কখনো বন্ধু, কখনো প্রেরণাময়ী, কখনো সমব্যথী আর কখনো কখনো শুধুই মা হতে হবে একজন মাকে। মমতার চাদরে সর্বক্ষন জড়িয়ে না রেখে সময়ের দাবী মেনে মাকে রূপ বদলে মেয়ের সামনে আসতে হবে। অনেকটা সাত রঙের সংমিশ্রণে রঙধনু হয়ে। এটা অবশ্য একান্তই আমার নিজের ধারণা।

সুবহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমার ধারণাটাও এমনই।

সেজন্যই তো তোমার সাথেই কথা বলতে এসেছি এই বিষয়টা নিয়ে। আমাদের বাকি বোনদের এবং ভাবীদেরকেও জানাতে ও বোঝাতে মা-মেয়ের সম্পর্কটাকে কিভাবে সুন্দর ও নির্ঝঞ্ঝাট রাখা যায়। আজ রাতেই এসব নিয়ে কথা বলবো ভাবছিলাম ওদের সাথে। তুমি কিন্তু অবশ্যই থাকবে আমাদের সাথে।

ইনশাআল্লাহ থাকবো। যাইহোক, আমারো তোর সাথে জরুরি একটা বিষয়ে কথা ছিল। এখন তাহলে সেটা বলি।

সুবহা ভাবীর জরুরি কথা মানেই হচ্ছে ইনিয়ে বিনিয়ে জাওয়াদের একাকীত্বের দুঃখ কথন গাওয়া। সেটা খুব ভালো মতই জানা আছে নূহার। তাই বলল, এটা কিন্তু আমাদের খুবই অন্যায় হচ্ছে ভাবী।

কি অন্যায় হচ্ছে?

এই যে তুমি ড্রাইভ করতে করতে এত কথা বলছো। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না অন্য কথা। খেয়ালে আসার পর জেনে বুঝে অন্যায় করা খুবই নিন্দনীয় একটা কাজ হবে। তাই তুমি মনোযোগের সহিত ড্রাইভ করো। আমি রাহাতকে ফোন দিয়ে দেখি জারিফকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছে কিনা।

নূহার চালাকি বুঝতে পেরে হেসে ফেললো সুবহা। নূহাও হাসতে হাসতে সেলফোন বের করে রাহাতের নাম্বারে ডায়াল করলো।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন