রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

নিয়তি...২২




অনেকক্ষণ ধরে স্বামীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছেন মিসেস সুরাইয়া। গত এক সপ্তাহে প্রতিদিনই এই প্রত্যাশা নিয়ে হসপিটালে আসেন আজই হয়তো উঠে যাবেন আজাদ সাহেব। কিন্তু প্রতিদিনই ঝরে যায় তার প্রত্যাশার ফুল। আবারো আশার কলির জন্ম হয়, ফুল ফোঁটে অতঃপর ঝরে যায় আবারো। ভেতরে ভেতরে আকূল হয়ে আছেন মিসেস সুরাইয়া স্বামীর সাথে কথা বলার জন্য। যে পর্যন্ত সারাদিনের সবকথা স্বামীকে না বলতেন কিছুতেই শান্তি পেতেন না। সেখানে গত এক সপ্তাহে কত শত কথা জমেছে বলার মতো। আর আজ তো মনটা খুব বেশি অস্থির। ভাবনাগুলোকে নিজের মধ্যে চেপে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। এমন কারো সাথে যে বুঝে নিয়ে পারবে শব্দের পেছনে লুকায়িত আবেগকেও। যার কথারা সান্ত্বনা দিয়ে অস্থিরতা দূর করার সাথে সাথে মনে সন্তোষের বীজও বুনে দিতে পারবে। মনে করিয়ে দেবে প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনার আড়ালেই লুকায়িত আছে কল্যাণ। শুধুমাত্র আমরা দেখতে পাই না নির্দিষ্ট সময়ের আগে। সুরাইয়া নিজেও একথা বিশ্বাস করেন কিন্তু মাঝে মাঝে মন এত দুর্বল হয়ে যায়, কিছুই বোঝার বা মেনে নেয়ার অবস্থায় থাকে না। হসপিটালে ঢোকার সময় নূহাকে বাগানের এক কোনে নিজের থেকেই বিস্মৃত হয়ে বসে থাকতে দেখার পর, নিজেও বেসামাল হয়ে পড়েছেন। এমন আত্মবিস্মৃত নূহাকে তো কখনোই দেখতে চাননি তিনি। নূহা যাতে আবারো স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে যেতে পারে সেজন্যই সবাই মিলে জোর করেছিলেন বিয়ের জন্য। একরকম বাধ্য করে সবাই নূহাকে আবারো বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বাধ্যতা তো সন্তানদের জন্য কল্যাণকামীতাই ছিল। তাদের কারোরই তো জানা ছিল না এই কল্যাণকামীতাই নূহার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে। আর জাওয়াদ? জাওয়াদের কথা মনে পড়তেই অশ্রু নেমে এলো দু’চোখে। ফিরে আসার পর কাউকে কিছুই বলেনি জাওয়াদ। কারো সাথে একবারও কৈফিয়ত বা অভিযোগের সুরে কোন কথা বলেনি। তিন সন্তানকে সাথে নিয়ে আলাদা একটা জগত তৈরি করে নিয়েছিল নিজের জন্য। রাহাত আর জারিফকে সাথে নিয়ে নূহাও আলাদা হয়ে গিয়েছিল পরিবার থেকে। যে পরিবার থেকে এক মূহুর্তের জন্য দূরে থাকাটা নূহার কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন ছিল। নিজ ইচ্ছেয় সেই পরিবার ছেড়ে চলে গিয়েছিল নূহা। গাড়িতে মাত্র দেড় ঘন্টার পথ। অথচ মাসের পর মাস পেরিয়ে যায় নূহা বাড়িতে আসে না। পরিবারের কোন আনন্দ, কোন উৎসবে অংশগ্রহণ করে না। এমনকি ঈদের দিনও মেয়ের প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকতে থাকতে শেষপর্যন্ত আজাদ সাহেবকে সাথে নিয়ে তিনিই গিয়ে দেখে আসেন নূহাকে। তাদের আত্মিক সম্পর্কের বন্ধনগুলো এমন করে মাধুর্য হারিয়ে ফেলবে কোনদিন চিন্তাও করেননি। পরিবারের সবাই যদিও সবকিছু স্বাভাবিক আছে এমনটাই বোঝানোর চেষ্টা করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। কিন্তু কোথাও যে ছন্দ ভঙ্গ হয়েছে, তাল কেটে গিয়েছে সেটা সম্পর্কেও সবাই অবগত।

দু’হাতে আজাদ সাহেবের হাত আঁকড়ে ধরে অশ্রু ভেজা কন্ঠে সুরাইয়া বললেন, জানি নূহার বিয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি অস্থির আমিই হয়েছিলাম। আমিই তোমাদের সবাইকেও বাধ্য করেছিলাম নূহাকে বুঝিয়ে বিয়েতে রাজী করাতে। কিন্তু আমি তো আমার মেয়ের কষ্ট দূর করতে চেয়েছিলাম। ওকে আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম। কতটুকুনই বা বয়স ছিল তখন নূহার? মাত্র উনিশ বছর। কিভাবে কাটাবে দীর্ঘ জীবন একা একা এই চিন্তা করাটা কি আমার ভুল ছিল? জবাবের আশায় স্বামীর দিকে তাকালেন সুরাইয়া। একই রকম নিশ্চুপ দেখে বাঁধ ভাঙা অশ্রু নেমে এলো দু’চোখে।

অনেক বছর আগে নূহাকে নিজের কাছ থেকেই হারিয়ে যেতে দেখে এমন করেই অঝোর কাঁদতে কাঁদতেই আজাদ সাহেবকে উদ্দেশ্যে করে বলেছিলেন, আমাদের মেয়েটার সাথেই কেন এমন হলো বলতে পারবে? কত স্বপ্ন ছিল আমাদের মনে নূহাকে ঘিরে। কেন সবকিছু এমন ওলটপালট হয়ে গেলো?

আজাদ সাহেব জবাব দিয়েছিলেন, আমরা নিজেদের জন্য অনেককিছু চিন্তা করি কিন্তু সবসময় তা হয় না। কারণ আল্লাহর সিদ্ধান্ত অন্যকিছু থাকে। আর ঐ সিদ্ধান্তটাই আমাদের জন্য সঠিক। সেটা আমরা মানি বা না মানি। হ্যা মাঝে মাঝে প্রচন্ড কষ্ট পাই আমরা, অকল্পনীয় সারপ্রাইজড হই। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্তই সঠিক আমাদের জন্য। তাই আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর ভরসা রাখো।

মিসেস সুরাইয়া বলেছিলেন, আমি চাই নূহা আবার নতুন করে জীবনটাকে সাজিয়ে নিক।

এটা তো আমাদের সবার চাওয়া সুরাইয়া। কিন্তু শুধু আমরা চাইলে তো হবে না। নূহা মাকেও চাইতে হবে। দেখলেই তো আদীর সাথে বিয়ের কথা বলার সাথে সাথে নূহা মানা করে দিলো।

কিন্তু একমাত্র আদীর সাথে বিয়ে হলেই আমার আর কোন চিন্তাই থাকতো না নূহাকে নিয়ে। নূহাকে রাজী করাতে হবে যেভাবেই হোক। অনেক মিল নূহা আর আদীর। ওরা দুজন দুজনকে বুঝবে বলেই মনেহয় আমার।

এটাই প্রার্থনা আমারো আল্লাহর কাছে। আদীকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই কিন্তু নূহা এখন যে মন মানসিকতা মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাতে ওকে নিয়ে আমার চিন্তা হয় খুব। অবশ্য শুধু নূহাই না তোমরা মেয়েরাই হচ্ছো গিয়ে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে জটিল সৃষ্টি।  

কি বলতে চাইছো তুমি?

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, বলতে চাইছি অত্যন্ত সূক্ষ্মতা আর জটিলতায় ঘেরা প্রতিটি মেয়ের মনোজগত। সে মনোজগতের রহস্যকে বোঝা আমাদের মতো সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে সরল সৃষ্টি পুরুষদের পক্ষে খুবই কঠিন। তোমাদের মেয়েদের মন হচ্ছে এই বৃষ্টি তো এই রোদ্দুর, রিমঝিম শ্রাবণের মাঝেই মেঘ ডাকে গুড়গুড়।

স্বামীকে ঘুষি লাগিয়ে মিসেস সুরাইয়া বললেন, মেয়েদের সম্পর্কে ভালোই তো জানেন দেখি।

হাসতে হাসতে আজাদ সাহেব বললেন, আমার জীবন অসাধারণ সব মেয়েতে ঘেরা তো সেজন্য জানি।

তাহলে বলেন তো দেখি একটি মেয়ে তার সাথীর কাছে কি চায়?

তোমাদেরকে দেখে আমার মনেহয়েছে একটা মেয়ে শুধু ভালোবাসা আর নিরাপত্তা চায় তার সাথীর কাছে। তুমিই বলো কি চায় একটি মেয়ে তার সাথীর কাছে?

তার সাথী তাকে এমনভাবে ভালোবাসুক যেমনভাবে পৃথিবীতে কেউ কাউকে কোনদিন ভালোবাসেনি। ব্যাস আর কিছুই চায় না।

আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটির সে চাওয়া কি পূরণ হয়েছে?

আলহামদুলিল্লাহ্‌ যেভাবে চেয়েছিল তারচেয়েও অনেকগুণ বেশি পূরণ হয়েছে। আমি আল্লাহর কাছে দিনরাত প্রার্থনা করতাম আমার মেয়েদের চাওয়াও যেন এমনি করে পূরণ হয়। বিয়ের এত বছর পরও আমি যেমন বলতে পারছি আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারীদের একজন। আমার মেয়েরাও যেন তেমন বলতে পারে। বিয়ের পর জাওয়াদ আর নূহাকে দেখে সবসময় মনেহতো আল্লাহ বুঝি আমার চাওয়াটাকেই পূরণ করেছেন। কিন্তু...

থাক এখন এসব কথা। নূহা একা একা বাগানে বসে আছে। চলো আমরা দুজন ওর পাশে গিয়ে বসি। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে বাগানে নেমে নূহার দিকে তাকিয়ে অজান্তেই  বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এসেছিল আজাদ সাহেবের। তাঁর সবচেয়ে দুরন্ত, ছটফটে আর প্রাণবন্ত মেয়েটা কেমন যেন নিশ্চুপ, নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রথম বাড়ির সবাই ভেবেছিলো সময়ের সাথে সাথে নিজেকে সামলে নেবে নূহা।  কিন্তু যতদিন যাচ্ছে হৃদি ততই আত্মমুখী হয়ে উঠছে। তিন সন্তানকে ঘিরেই এখন নূহার ভুবন। এর বাইরে কে আছে কি নেই বা কি ঘটছে সব ব্যাপারেই উদাসীন। এভাবে আসলেই আর চলতে দেয়া যায়না। চোখের সামনে তিনি তার সবচেয়ে আদরের মেয়েটিকে এভাবে নিঃসঙ্গতার দহনে জ্বলতে দেবার জন্য ছেড়ে দিতে পারেননা। আর এরজন্য যদি নূহার উপর সামান্য জোর খাটাতে হয় তা তিনি খাটাবেন।

বাবা আর মামণিকে এগিয়ে আসতে দেখে মুখে হাসি টেনে সালাম দিলো নূহা।

সালামের জবাব দিয়ে আজাদ সাহেব বললেন, এতো রাতে বাগানে বসে আছিস কেন মা? ঘুম আসছে না?

এই তো বাবা যাবো এক্ষণই।

জিহাদ, জিশান আর নাবিহার কোন সাড়াশব্দ পেলাম না যে আজ বাড়িতে ঢোকার পর?

ওরা আজকে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা। আমারো ঘুম পাচ্ছে। তোমরা দুজন বসে গল্প করো। আমি ঘুমোতে যাই।

নূহাকে ধরে বসিয়ে আজাদ সাহেব বললেন, আমি ঠিক করেছিলাম সবাই তোকে সান্ত্বনা বা বোঝানোর চেষ্টা করলেও আমি কখনোই করবো না। কারণ আমি বাবা হবার আগে সারাজীবন তোর বন্ধুই বেশি হতে চেষ্টা করেছি। আর বন্ধুত্বের দাবী হচ্ছে বন্ধুকে বুঝে সাপোর্ট দেয়া। আমি তোর সেই সাপোর্ট হতে চেষ্টা করেছি সবসময়। কিন্তু বন্ধু যখন ভুল পথে চলে তাকে সঠিক পথের দিশা দেয়াটাও বন্ধুর দায়িত্ব।

আমি কি ভুল পথে চলছি বাবা?

একথা যদি নাও বলি তোর পথটা যে সঠিক না এইটুকু তো তুইও বুঝিস। জীবন থেকে কারো চলে যাওয়া মানে জীবনকে থমকে দেয়া নয়। যদি তাই হতো তাহলে পৃথিবী অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেতো। কারণ প্রতি মুহুর্তে এই পৃথিবীতে কেউ না কেউ তার প্রিয় মানুষকে হারাচ্ছে। এই হারানোকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার নামই বেঁচে থাকা। আর এই ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েই দিয়েছেন। কারণ তা না হলে পৃথিবীর স্বাভাবিক গতি ব্যহত হবে। তাই কেউ যখন কষ্ট থেকে বের হতে পারেনা তারমানে হচ্ছে সে বের হতে চায়না কিংবা জানে না কিভাবে বের হতে হবে। তুই যে জানিস সে ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু তুই বের হতে চাসনা।

তোমরা সবাই আমাকে আবার বিয়ে দেবেই তাই না বাবা?

আমি বিয়ের কথা তো বলিনি মা। তবে এটা ঠিক যে আমরা চাচ্ছি তুই নতুন করে জীবনটাকে সাজিয়ে নে। তাহলে একাকীত্ব না তোকে কুড়ে কুড়ে খাবে না। তাছাড়া পাশে একজন মানুষ থাকলে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

অবশ্যই সহজ হয়ে যায় যদি সেই মানুষটা মনের মত হয় তাহলে। কিন্তু কি লাভ কেউ পাশে থাকলে যদি তাকে ভালোই না বাসা যায়? আর তাছাড়া জাওয়াদের সাথে আমার জীবনের সমস্ত আনন্দময় মুহুর্ত আর  অনুভূতিগুলো উপভোগ করে ফেলেছি। যেসব ছাড়া বিয়ে অর্থহীন। শুধুমাত্র একসাথে থাকার উদ্দেশ্যে দুজন মানুষের বিয়ে আমি কল্পনাও করতে পারিনা বাবা।

আমিও পারিনা।

তাহলে আমাকে এমন কিছু করার কথা  কেন বলছো?

কারণ কেউ দাবী করে একথা বলতে পারেনা যে সে তার জীবনের সব আনন্দময় মুহুর্ত আর অনুভূতিগুলো উপভোগ করে ফেলেছে। ভালোবাসা মনে আবার দোলা দেবে না এই ব্যাপারেও লাইফ গ্যারান্টি দেয়া সম্ভব না।

বাবা কাউকে যন্ত্রণা দেয়ার মাঝে যে ভালোবাসা, লড়াই-ঝগড়া করা ভালোবাসা, প্রেমিকার মতো ভালোবাসা, স্ত্রীর মতো ভালোবাসা, ইনফ্যাক্ট ভালোবাসতেও আমি জাওয়াদকে দেখেই শিখেছি। এই  ভালোবাসার কোন অল্টারনেটিভ নেই। দূরত্ব হয়তো অনেক বেশি এখন আমাদের মধ্যে। কিন্তু তাই বলে ভালোবাসা কমেনি একটুও। এখনো তেমনটিই রয়ে গিয়েছে। আমার সকল একাকীত্ব দূর করতে সে ভালোবাসার ছোট কোন একটা স্মৃতিই যথেষ্ট।

ঠিকআছে আমি মেনে নেবো তোর কথা। কিন্তু স্মৃতিই যথেষ্ট তার প্রমাণ দেখা তাহলে আমাকে?

আমাকে কি করতে হবে বাবা?

স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। আমি বলছি না যে তুই আগের সেই সারাক্ষণ হাসি আনন্দে মেতে থাকা নূহা হয়ে যা। আমি শুধু চাই তোকে দেখলে যাতে স্বাভাবিক একজন মানুষ মনেহয়। ক্লাসে যাওয়া শুরু কর। পড়াশোনা শুরু করলে তোর ব্যস্ততা বাড়বে এবং বাড়ি থেকে অন্তত বের হওয়া হবে।

কিন্তু বাবা জিহাদ, জিশান, নাবিহা ওদের বয়স মাত্র আট মাস। ওদেরকে রেখে আমি ক্লাসে কি করে যাবো?

ওরা তিনজন এমনিতেও হয় ওদের দাদীর কাছে থাকে নয়তো নানুর কাছে। তুই যে ওদের সাথেও সময় কাটাস না এটা আমি যেমন জানি তুইও জানিস।

আমি মেডিকেলে পড়তে চাই না বাবা।

এটা নিয়েও আমার কোন আপত্তি নেই। তোর যা পছন্দ তাতেই আমি রাজী। আমি শুধু চাই আল্লাহ তোকে যে মেধা ও প্রতিভা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তুই তা কাজে লাগা। সাথে সাথে যে বুদ্ধি-বিবেক আল্লাহ তোকে দিয়েছেন সেসবও কাজে লাগা। মনেআছে ছোটবেলায় তোদেরকে আমি মেধা ও প্রতিভা যে আল্লাহর দান এবং এগুলোকে যথাযথ কাজে না লাগানো যে এগুলোকে হত্যা করার সামিল এই বিষয়ে বলেছিলাম?

জ্বী বাবা মনেআছে আমার। তুমি বলেছিলে আমাদের প্রত্যেকেরই মনে রাখা উচিত যে এসব আল্লাহর দেয়া নেয়ামত। আর মানুষ কোন কাজে এসব ব্যবহার করেছে কিয়ামতের দিন আল্লাহ সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। আর একথা আল্লাহ বলেও দিয়েছেন সূরা আত তাকাসুর এর ৮ নং আয়াতে-“ এরপর অবশ্যই তোমরা সেদিন নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”

তাহলে আমি কি আশা করবো যে আমার মা আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয়ে ভীত হবে এবং এই মুহুর্ত থেকে নিজের নেয়ামত সমূহের কদর করবে?

ইনশাআল্লাহ বাবা আমি চেষ্টা করবো।

সুস্বাস্থ্যও কিন্তু বিরাট নেয়ামত আমাদের জন্য। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করে অনিয়ম করে তাই অসুস্থ হওয়া যাবে না। আর মা মানুষের সত্যিকার ভালোবাসাও অনেক বড় একটা নেয়ামত। সবার ভাগ্য এটা জোটে না।

নূহা হেসে বলল, এরপর তুমি কি বলবে বুঝতে পারছি।

মেয়েকে একহাতে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে আজাদ সাহেব হেসে বললেন, মারে তোর প্রতি আল্লাহ খুব বেশি মেহেরবান বলেই হয়তো বার বার তোর জীবনে সত্যিকার ভালোবাসা এসে হাজির হয়। আদীকে অন্তত একটা সুযোগ দেয়া উচিত তোর।

নূহাকে নীরব দেখে মিসেস সুরাইয়া বললেন, অন্তত জিহাদ, জিশান আর নাবিহার কথা চিন্তা করেও তোর রাজী হয়ে যাওয়া উচিত। তোর তো অজানা নয় তুই কনসিভ করেছিস জানার পর কত শত পরিকল্পনা নিয়েছিলো জাওয়াদ। একদিন আমার আর বড়পার কাছে এসে বলেছিলো, মা, মামণি আমার ব্যস্ততা নিয়ে তো তোমাদের অভিযোগের শেষ নেই। তাই এখন থেকেই তৈরি হয়ে যাও খুব শিঘ্রীই আমার অবসর দেখতে দেখতে তোমরা বিরক্ত হয়ে যাবে। আমাদের জীবনকে পরিপুর্ণ করতে যারা আসছে এখন থেকে আমার পুরো সময় শুধু তাদের জন্য। এক মুহুর্তেও জন্যও ওদেরকে চোখের আড়াল করতে চাইনা আমি। ওদের মুখের প্রথম হাসি, প্রথম বলা শব্দ, উঠে বসা, হামাগুড়ি দিয়ে চলা, এক’পা দু’পা করে হাঁটতে শেখা কোনকিছু আমি মিস করতে চাইনা। আগে মা বলবে না পাপা বলবে সেটা নিয়ে তোমার নাক বোঁচা কন্যার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাইট করবো। আমি চাই আমার সন্তানরা হাঁটতে শেখার পর প্রথম যখন ওদের পা  বেসামাল হয়ে যাবে, জীবনের প্রথম সাহায্যকারী হিসেবে আমার হাত বাড়িয়ে ধরবো ওদের সামনে। আমার হাত ধরে ওরা উঠে দাঁড়াতে শিখবে, চলতে শিখবে। জীবনের উঁচু-নিচু পথে কিভাবে হাসি মুখে হাঁটতে হয় সে শিক্ষা তো ছোটবেলা থেকেই দিতে হয়। আমি ওদের হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে সেই শিক্ষা দেবো, ইনশাআল্লাহ। নূহা তুই তো জানিস বাচ্চাদেরকে ঘিরে জাওয়াদের এসব স্বপ্নের কথা। ওদের সাথে কিভাবে সময় কাটাবে, কিভাবে বড় করবে, আরো কত কি। অথচ দেখ ওরা তিনজন বাবার ভালোবাসা ছাড়াই বড় হচ্ছে। আমরা কেউ এমনটা চাইনা। আমরা চাই আমাদের নাতীরাও সেইরকম আদর-ভালোবাসা পেয়ে বড় হোক, বাবার যেমন ভালোবাসা পেয়ে তোরা সবাই বড় হয়েছিস।

তোমরা সবাই কেন আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছো না মামণি?

কারণ তুই অবুঝের মতো চিন্তা করছিস। মনেআছে তুইই সবাইকে সবসময় পজেটিভ চিন্তা করার কথা বলতি? পরিবারের কারো যখনই মনখারাপ হতো কোন কারণে তুই বলতি যে, মনের সুখ, আনন্দ, খুশিকে কখনোই পরনির্ভরশীল হতে দেয়া ঠিক নয়।

আমার সব মনে আছে মা। কিন্তু জাওয়াদের এত স্মৃতি, এত ভালোবাসার কথা আমি কিভাবে ভুলে যাবো?

তুই কিভাবে ভুলবো, কখনোই ভুলতে পারবো না! এই কথাগুলোর মধ্যে তোর চিন্তা-চেতনাকে আটকে ফেলেছিস। দেখ মা কোন ঘটনা মনকে সেভাবেই প্রভাবিত করে যেভাবে আমরা ঘটনাটাকে দেখি। আর তুই সবকিছুকে নেতিবাচক ভাবে দেখছিস। আমারও আমাদের সন্তানকে হারিয়েছি। যে শূন্যতা জাওয়াদ দিয়ে গিয়েছে তা কেউ পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু সেজন্য তো জীবন থেমে থাকবে না। কারণ মৃত্যু যে মানুষের জীবনের সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা। মেনে নেয়া যতই কঠিন হোক না কেন এটাই জীবনের বাস্তবতা। তুই যদি তোর জীবনকে থামিয়ে বসে থাকিস তাহলে কি জাওয়াদ ফিরে আসবে? বল আমাকে অতীত কি বদলে যাবে?

নূহাবলল, না কিছুই বদলে যাবে না। 

তাহলে? আমরা আমাদের অতীতকে তো বদলাতে পারবো না। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতকে সুন্দর করে গড়ে তোলার চেষ্টা অন্তত করতে পারি। জিহাদ, জিশান আর নাবিহা জন্মের পর থেকে আদী ওদেরকে নিজ সন্তানের মতই দেখে আসছে। শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও এমন কোন একটি দিন যায়নি যেদিন আদী ছুটে আসেনি ওদের কাছে। একথা তুইও জানিস জাওয়াদের মত করে ভালোবাসা শুধুমাত্র আদীই ওদেরকে দিতে পারবে। তাহলে আদীকে বিয়ে করতে কেন এত আপত্তি তোর? আমি জানি যে তোর জীবনের সিদ্ধান্ত নেবার কোন অধিকার আমার নেই। কিন্তু পরামর্শ তো আমিও দিতেই পারি, তাই না?

তুমি এভাবে কেন বলছো মামণি? 

কারণ তোরা নিজেদেরকে অনেক জ্ঞানী আর বিবেচক মনে করিস। আমাদের দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা তোদের কাছে কোন মূল্যই রাখেনা। কারো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা মানে নিজেই নিজের জন্য কষ্ট তৈরি করা। কিন্তু তোদের কাছে এটা হচ্ছে ভালোবাসার প্রমাণ। আমাদের আর তোদের ভালোবাসার সংজ্ঞাই আলাদা। তাই কিছু বোঝাতে যাওয়াও বোকামি।

তোমার কাছে ভালোবাসা সংজ্ঞা কি মামণি?

নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসার মানুষকে সুখী করার চেষ্টাটাই আমার কাছে ভালোবাসা। তার ইচ্ছে, পছন্দ, ভালো লাগাকে মূল্যায়ন করা আমার কাছে ভালোবাসা। তার স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা আমার কাছে ভালোবাসা। তার অপ্রাপ্তি, অপুর্নতা, অপরগতাকে আলোর দিশা দেখানো আমার কাছে ভালোবাসা। জাওয়াদের স্মৃতি আগলে বসে না থেকে জাওয়াদের অপুর্ণ ইচ্ছা আর চাওয়া গুলোকে পূরণ করাটাই কি ভালোবাসার প্রমাণ বেশি বহন করবে না? তোর একার পক্ষে তো সেসব পূরণ করা সম্ভব না। আর অন্য সবার মতো তুইও জানিস যে আদীর চেয়ে ভালো সঙ্গী কেউ হতে পারবে না তোর জন্য।    

অনেকক্ষণ নীরব থেকে নূহা বলল, ঠিকআছে তোমাদের কথা মেনে নিলাম। কিন্তু আদী ভাইয়ার সাথে নতুন করে জীবন শুরু করতে চাই না আমি। আমার কাছে ফায়েজ ভাইয়া আর আদী ভাইয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উনি শুধু এবং শুধুই আমার ভাইয়া। আমি একটা শর্তেই আবারো বিয়ে করতে রাজী আছি। ফ্যামেলির কেউ হতে পারবে না। এমনকি দূর সম্পর্কের কোন রিলেটিভও না। সম্পূর্ণ বাইরের কেউ হতে হবে। এবং তাকে সবকিছু জেনে, বুঝে খুশি মনে তিন বাচ্চা সহ আমাকে কবুল করতে হবে। যদি এমন কাউকে খুঁজে বের করতে পারো তোমরা। যখন বলবে তখনই আমি বিয়ে করে নেবো।

মিসেস সুরাইয়া জানেন কেন নূহা ঐ রকম শর্ত দিয়েছিলো। নূহার ধারণা ছিল পরিবারের বাইরে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়াও সম্ভব হবে না এবং ওকে আর কোনদিন বিয়েও করতে হবে না। কিন্তু মানুষের ধারণা যে কখনোই তার নিয়তির লিখনকে ছুঁতে পারে না। নূহার জীবনের রাহাতের আবির্ভাব আবারো সেই কথাটাই প্রমাণ করে দিয়েছিল তাদের সবাইকে।          

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন