শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...শেষ পর্ব




এমন আত্মমগ্ন হয়ে কি ভাবছেন?

নদীর পাড়ে বসে মৃদুমন্দ বয়ে চলা জলরাশির দিকে তাকিয়ে ছিল নূহা। স্পর্শ না করেও বহতা নদীর স্রোতের মাঝে এমন ভাবে ডুবে গিয়েছিল টেরই পায়নি কখন জাওয়াদ পাশে এসে বসেছে। প্রশ্ন শুনে জলরাশি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জাওয়াদকে পাশে দেখে হাসি মুখে বলল, কিছু ভাবছি না তো। নদীর বয়ে চলা দেখছি।

নূহার পাশে বসতে বসতে জাওয়াদ বলল, বহতা নদীর এমন দৃশ্য দেখার পরও চুপটি করে বসে থাকার মতো অলস তো আপনার ভাবনা নয়। আমি নিশ্চিত আপনার মন নদীতে ভাবনারাও  ভাসছে শাপলা, পদ্ম রূপে।

নূহা হেসে বলল, তোমার মনেআছে আমাকে একদিন বলেছিলে আমাদের জীবনের জন্য যা কিছু কল্ল্যাণকর, এমন কিছুকে কখনোই চলে যেতে দেয়া উচিত নয়। এমন কিছুকে কখনোই স্ব ইচ্ছেয় ছেড়ে দিতে নেই। এমনটা করলে নিজেকেই ক্ষতির স্বীকার হতে হয়। জীবনের জন্য যা কিছু অকল্ল্যাণকর, তেমন সবকিছু থেকে অবশ্যই নিজেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু শুভ্রিত সুন্দর কিছুকে যদি আদায় করে নিতে হয় কখনোই দ্বিধা করা উচিত নয়। বরং সেজন্য যদি কৌশলী হতে হয়, হওয়া উচিত। নীরবতা যতই পছন্দের হোক না কেন, প্রয়োজনে সরব হতে হয়। যেখানে বলার সেখানে বলতে হয়। আমি জানি তুমি ব্যক্তি জীবনে এই কথাগুলো মেনে চলে এসেছো সবসময়ই। ভবিষতেও হয়তো মেনেই চলবে ইনশাআল্লাহ। তারপরও জানতে ইচ্ছে করছে তোমার সামনে যদি কখনো এমন কন্ডিশন আসে। যেখানে তোমাকে তোমার ব্যক্তি জীবনের সুখ-আনন্দ এবং ফ্যামিলির খুশির মধ্যে যে কোন একটাকে বেছে নিতে হয়। তাহলে তুমি কি করবে?

একটুক্ষণ সময় নিয়ে জাওয়াদ বলল, আমার ব্যক্তিগত সুখ-আনন্দের সাথে যদি সত্যিই কখনো ফ্যামিলির দুঃখ-বেদনা জড়িয়ে যায়। ইনশাআল্লাহ আমি আমার ফ্যামিলির খুশিকে বেছে নেবো। কিন্তু যদি কিছু জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা স্বর্ত্বেও আমার এমনটা মনেহয় যে, আমার আনন্দকে অক্ষুণ্ণ রেখেও আমি ফ্যামিলিকে কষ্ট পাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবো। সেক্ষেত্রে কখনোই নিজের সুখকে ত্যাগ করবো না। কারণ জগতে সবাই সুখী হতে চায়। তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নিজেকে দুঃখে নিমজ্জিত রেখে ক্রমগত অন্যদেরকে সুখী রাখা সম্ভব নয়। গাছের পাতাও তো স্থির হয়ে যায়, বাতাসের প্রবাহ ছাড়া। সেখানে মন কিভাবে সচল থাকবে কিছু প্রাপ্তির স্পর্শ ছাড়া?

হুমম...

হুমম না কারণ বলো।

কিসের কারণ?

আমাকে এমন প্রশ্ন করার কারণ।

নূহা হেসে বলল, এক ক্লাসমেট আজ চলে যাচ্ছিলো তার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে। তাকে তখন ফ্যামিলির ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর থেকে বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে এমন কন্ডিশন কখনো আমার জীবনে এলে আমি কি করবো? আমি কি আমার ভালোবাসা বেছে নেবো নাকি ফ্যামিলি?

কোনটা বেছে নেবে তুমি? হাসি মুখে প্রশ্ন করলো জাওয়াদ।

এতক্ষণ সত্যিই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কারণ আমার ভালোবাসার যে নির্দিষ্ট একটি চেহারা আছে। ভাবতে গেলে যখনই তার চেহারা ভেসে ওঠে। মনেহয় শুধু ফ্যামিলি কেন এই মানুষটির জন্য তো আমি দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে দিতে পারি।

জাওয়াদ হেসে বলল, এতো বিধ্বংসী ভালোবাসা। আল্লাহ রক্ষা করুক সবাইকে এমন ভালোবাসার কবল থেকে।

নূহা হেসে বলল, এজন্যই তো তোমার কাছে জিজ্ঞেস করলাম। গাইড লাইন পেয়েছি। এখন থেকে এভাবেই চিন্তা করবো ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা দুজন মানুষের জীবন যদি কখনো নদীর দুই কূলের মতো হয়ে যায়, তাহলে কি করা উচিত? আইমিন, একই নদীর দুই কূল কিন্তু সর্বদাই বিপরীত দুই দিকে প্রবাহমান। তাদের নাম, পরিচয়, অস্তিত্ব একই কিন্তু দুই কূল কখনোই এক হতে পারে না। অর্থাৎ, নদীর দুই কূল না একে অন্যের থেকে আলাদা হতে পারে, না কখনো একসাথে মিলতে পারে। দুজন মানুষের জীবন যদি এমন হয়? তারা একই ডোরে বাঁধা কিন্তু দুজন দু প্রান্তে। না তারা মিলতে পারছে, না একে অন্যেকে ছেড়ে যেতে পারছে। কি করা উচিত তখন?

তোমার প্রশ্নের মধ্যেই তো উত্তর রয়েছে। একাকার হওয়ার চেয়েও কিন্তু এক হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এই নদীটির কথাই ধরো। নদীর দুই কূলকে কিন্তু কেউই দুই নামে ডাকে না। দুই কূলের দুরুত্ব যতই হোক না কেন, কোনদিন তারা মিলতে নাইবা পারুক। তাতে কিন্তু কিছুই এসে যায় না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যত দুরুত্ব থাক আর যত যাই কিছু হোক না কেন, তাদেরকে কেউই আলাদা করতে পারবে না। একে অন্যের থেকে শত মাইল দূরে থেকেও নদীর দু কূলের নাম, পরিচয়, অস্তিত্ব একই থাকবে। মনে নেই তোমাকে আটলান্টিক মহাসাগর আর ভারত মহাসাগরের মিলনস্থান দেখিয়েছিলাম? একটা স্থানে এসে দুটা সাগর এক হয়ে গিয়েছে কিন্তু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি। পানির রঙ দেখে তাদেরকে আলাদা করা যায় খুব সহজেই। মহাসাগর দুটি পাশাপাশি একে অপরকে ছুঁয়ে থাকার পরেও উভয়ের অস্তিত্ব আলাদা, নাম ও পরিচয় আলাদা। কিন্তু ভারত কিংবা আন্টলান্টিক মহাসাগরের দুই কূলের দুরুত্ব যতই হোক না কেন, তাদের নাম ও পরিচয় কিন্তু একই। মানুষের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই ব্যাপার। মন যদি এক হয়, তাহলে শারীরিক দুরুত্বে কিছুই এসে যায় না।

নূহা হেসে বললেন, বুঝতে পেরেছি। জাযাকাল্লাহ।

কিন্তু আমি মোটেই বুঝতে পারিনি আপনি আজ এই সমস্ত প্রশ্ন কেন করছেন।

নূহা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, জগতের সবকিছু সবাইকে বুঝতেই হবে এমন কোন নিয়ম নেই।

কিন্তু তোমার উদ্ভট প্রশ্ন তো এই সংজ্ঞার আওয়ায় আসবে না। তাছাড়া বৌয়ের মতি গতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখা প্রতিটি সচেতন স্বামীর জন্য অতীব জরুরি। আর যে স্বামীর বৌয়ের মতি এমন ক্ষণে ক্ষণেই গতিপথ বদলায়। তার তো এছাড়া ভিন্ন কোন অপশনই নেই। তা না হলে সুখ পাখী দুঃখের পালক ঝরাতে ঝরাতে উড়াল দেবে।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, ভালো কথা মনে পড়েছে। সকালে বারান্দায় সুখ-দুঃখ নিয়ে কি আলোচনা হচ্ছিলো তোমার আর বাবার মধ্যে? আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুধু সুখ আর দুঃখ শব্দ দুটোই শুনেছি।

ঘুমের মধ্যেও হাজবেন্ড কি বলছে, না বলছে শোনার জন্য আড়ি পাততে হবে? ঘুমের সময় তো অন্তত ছেড়ে দেয়া উচিত একজন মানুষকে।

কখনোই ছাড়বো না। এক মূহুর্তের জন্যও না। সর্বক্ষণ সিন্দাবাদের ভূতের মধ্যে তোমার মনের মধ্যে বসে থাকবো ইনশাআল্লাহ। সুখ দুঃখ নিয়ে কি বলছিলে তাড়াতাড়ি বলো এখন।

জাওয়াদ হেসে বলল, বলছিলাম জীবনের অনেক নিয়মের মধ্যে একটি হচ্ছে, জীবন কখনোই তোমাকে তোমার আকাঙ্ক্ষিত সব খুশি, সব আনন্দ একসাথে দিয়ে দেবে না। সুখের আঁচল ধরে নানান ধরণের দুঃখও হাজির হবে জীবনে। দুনিয়ার এই জগতের ধারাটাই আসলে এমন। আনন্দের কাব্য বুনে শেষ করতে না করতেই বেজে ওঠে বেদনার ডংকা! স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বটের ছায়ায় বসতে না বসতেই ঝরে পড়ে বিবর্ণ পাতা রূপে শংকা! প্রিয়জনদের সংস্পর্শে হেসে উঠে জীবন উল্লাসে, প্রিয় কাউকে হারানোর শূন্যতা পরিণত হয় দীর্ঘশ্বাসে। হঠাৎ জীবন এমন এক মোড় এসে থমকে দাঁড়ায়, মুহূর্তে পাল্টে যায় চলার পথ, পথের গন্তব্য।

হুমম...

তবে কি জানো? কষ্টের মূহুর্তগুলোর মধ্যেও ছোট ছোট আনন্দ লুকায়িত থাকে। সেইসব আনন্দ কিন্তু এমনিতে কারো কাছে ধরা দেয় না। দুঃখের প্রবাহিত স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে চলা সুখগুলোতে আমাদেরকে খুঁজে বের করে তুলে নিয়ে হয়। তুমি আনন্দভুবনের সদস্য। তোমাকে তাই এটা শিখতে হবে।

নূহা বলল, একজন জ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, সময় এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবনের প্রয়োজনে তাই সময়ই মানুষকে সবকিছু শিখিয়ে দেয়। যখন প্রয়োজন হবে আমিও ইনশাআল্লাহ দুঃসময়ের উলু বন থেকে সুখের মুক্তো কুড়িয়ে নেবো। আর যদি কখনো আমি এমনটা করতে ব্যর্থ হই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে পথ দেখানোর জন্য ঠিক ঠিক তোমাকে পাঠিয়ে দেবেন। তুমি নানান ধরণের হুমকি ধামকি দেবে, কড়া কড়া বিষাক্ত কথা শোনাবে। কিন্তু নিঃসন্দেহে মঞ্জিলে পৌঁছানোর আগে কখনোই আমার হাত ছাড়বে না।

নূহার কথা শুনে হেসে ফেলেছিল জাওয়াদ স্বশব্দে। অতীতে বুনা আসা সুন্দর মূহুর্তের মূছর্নায় হাস্যেজ্জল হয়ে উঠেছিল বর্তমানের সময়টুকুনও। সম্মুখে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর জাওয়াদকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অতীতের মনোমুগ্ধকর এমনই কোন এক নদীর পাড়ে। কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে আসা একসাথে অনেকগুলো প্রিয় কন্ঠস্বরের সম্মিলিত গুঞ্জন বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে এলো জাওয়াদ। ঘুরে তাকিয়ে দেখলো ফায়েজ, আদী, রিসাব, হুমায়ূন এবং রাহাত কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে তার দিকেই। হাসি মুখে সবাইকে উদ্দেশ্যে করে সালাম দিলো জাওয়াদ।

সালামের জবাব দিয়ে আদী বলল, সবাই মিলে পিকনিকে আসার লক্ষ্যই ছিল একসাথে কিছুটা সময় কাটানো। আর তুই কিনা সবাইকে ফেলে এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস?

জাওয়াদ হেসে বলল, মাদার গ্রুপের সবাই মিলে চেপে ধরে যে পরিমাণে খাইয়েছে আজকে। ওয়ার্ক আউট করাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। তোরা সবাই গল্প করছিলি তাই কাউকে বিরক্ত না করে একা একাই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু এই জায়গাটায় এসে অজান্তেই থেমে গিয়েছিল কদম।

রিসাব হেসে বলল, জায়গাটার ভয়াবহ সৌন্দর্য নিয়ে কিছুই বলার নেই। কিন্তু আপনার কাছে প্রশ্ন আছে ভাইজান। সত্যি করে বলেন কোন বিশেষত্ব আছে এই জায়গাটার?

জাওয়াদ হেসে বলল, হুমম, আলহামদুলিল্লাহ তা আছে বলা যায়।

তাহলে এখন বিশেষত্ব বর্ণনা করে আমরা যে আপনার বিশেষ মানুষ সেটা প্রমাণিত করুন। দুষ্টুমি আর হাসি মাখা কন্ঠে বললো হুমায়ূন।

জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, এই জায়গাটায় এসে অনেকদিন পর পেছনে ফিরে তাকানোর সাধ জেগেছিল। পেছন দিকের কিছুটা পথ হেঁটে আসার পর নতুন করে পুরোনো একটা উপলব্ধি নাড়া দিয়ে গেলো মনকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমতের ছায়ায় জীবনের এই অব্দি সফর সুখ স্বাচ্ছন্দেই পেরিয়ে এসেছি আমরা। হ্যা ছোট বড় অনেক পরীক্ষা এসেছে জীবনে। কিন্তু সেই প্রতিটা পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হবার ব্যবস্থাও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন করে দিয়েছেন। সম্মুখেও হয়তো আরো পরীক্ষা প্রতীক্ষামাণ আমাদের জন্য। মনে প্রাণে বিশ্বাস করি অতীতের মতো ভবিষ্যতের বাঁধা-বিঘ্ন গুলোও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দূর করে দেবেন। কিন্তু তারপরেও আমাদেরকে প্রস্তুতি তো নিতেই হবে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। জীবনের মূল লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে চলা অব্যহত রাখতে হবে আমাদেরকে সর্বাবস্থাতে। এবং একই শিক্ষা আমাদের সন্তানদেরকেও দিতে হবে। আজকাল মাঝে মাঝে কখনো বাচ্চাদের কথায়, কখনো শব্দ প্রয়োগে, কখনো বা কন্ঠে কিছু কিছু ব্যাপারে অসন্তোষের আভাস অনুভব করি। নিজ অবস্থানে অসন্তোষ ভয়াবহ কোন জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয় মনোজগতের জন্য। তাই কিছুটা শঙ্কা, কিছুটা ভীতি কাজ করছে মনের মাঝে। কেননা নিজ অবস্থানে অসন্তোষ মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিচার-বিবেচনাকে ওয়ান ট্র্যাক করে দেয়। মানুষ তখন জীবনে কি কি পায়নি সেই হিসেবের মাঝে এমন ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, নিজের হাজারো প্রাপ্তি তাদের চোখে পরে না। মনের এই অন্ধত্বকে আমি প্রচন্ডরকম ভয় পাই। আমি চাই না আমার আশেপাশের কেউ এমন আত্মিক অন্ধত্বের শিকার হোক। যারফলে, যে রব্বের অফুরন্ত নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে ভুলে যাবে। কৃতজ্ঞতাকে সমস্ত উত্তম গুণাবলীর মা এর উপাধী দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, আবেগের সাম্রাজ্যকে সঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য রাজমুকুট কৃতজ্ঞতার মাথাতেই তুলে দিতে হবে। তা না হলে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা অবশ্যম্ভাবী।

রাহাত বলল, তারমানে আমাদের সন্তানদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কৃতজ্ঞ বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আরো সচেতন, আরো দৃঢ় এবং আরো কৌশলী হতে হবে আমাদেরকে। এই ব্যাপারে নিশ্চয়ই আপনার কোন পরিকল্পনা আছে ভাইজান?

জাওয়াদ হেসে বলল, এই মূহুর্তে আসলে ঠিক তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। তবে আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞ বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে আমাদের অভিভাবক গণ যেভাবে শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমাদেরকেও সেই পথ ধরেই চলতে হবে। জানো আমার মাঝে মাঝে ভেবে অবাক লাগে যে, আমাদের অভিভাবকগণের তো আমাদের মতো হিউম্যান সাইকোলজি, চাইল্ড সাইকোলজির ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান ছিল না। তারপরেও কি চমৎকার ভাবেই না উনারা আমাদের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ আলোকিত জীবনবোধ, পরিশুদ্ধ দর্শনের জ্ঞান এবং স্বচ্ছ ও সঠিক যুক্তির চমৎকার কম্বিনেশন আমাদের অভিভাবকগণের প্রতিজন। আর এই অনন্য, অনিন্দ্য কম্বিনেশন উনারা অর্জন করে ছিলেন কুরআন-হাদীসের সঠিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে। সুতরাং, আমাদেরকেও তাই করতে হবে।

আদী হেসে বলল, সুখ সম্পর্কে বলা বাপীর কথাগুলো আমার যখনই মনেহয় আরেকবার করে মুগ্ধ হই। এখনো বাপীর কাছে সাইকোলজি এই জগতের সবচেয়ে বোরিং সাবজেক্ট। ত্রিশ বছর আগে হয়তো সাইকোলজির সাথে বাপীর পরিচয় শুধু এই নামে একটা সাবজেক্ট আছে এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কত চমৎকার ভাবেই না বাপী আমাদেরকে সুখ সম্পর্কে বলতে যেয়ে বলেছিলেন, মানুষের সকল অপূর্ণতা, সকল অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তির মূল কারণ চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যের ফারাক। চাওয়া ও পাওয়ার এই বৈষম্যই মানুষকে দুঃখী করে। চাওয়া ও পাওয়ার আসলে একই ধারার প্রবাহিত হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। কারণ মানুষের চাওয়ার কোন সীমা নেই, গন্ডি নেই। মানুষ যত পায় ততই আরো বেশি চায়। কিন্তু মানুষ যদি শুধু তার চাওয়াকে সীমিত রাখতে পারতো তাহলে হতাশা, নিরাশা, দুরাশার ঘেরাটোপে আঁটকে থাকতো না। সুখের জন্য মানুষের এই যে এত আহাজারি, হাহাকার। এই সুখ জিনিসটা তো মূলত মনের ব্যাপার। কেউ যদি মানসিক ভাবে নিজেকে সুখী ভাবে তাহলে জগতের কোন কিছুই তাকে দুঃখী করতে পারে না। আবার জীবনে কিছু অপূর্ণতা কিছু বেদনা থাকার অর্থ কিন্তু এটা নয় যে সেই ব্যক্তি চির দুঃখী। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আলো-অন্ধকার নিয়েই মানুষের জীবন। তাই কোন মানুষ যদি জীবন থেকে সুখ-আনন্দ-হাসিই পেতে চায়। তাহলে বলতে হবে এরচেয়ে নির্বোধ ও অমূলক কোন চাওয়া হতেই পারে না। দিন রাত্রির পালা বদলের মতো সুখ ও দুঃখও পালাক্রমে জীবনে আসবে। আমরা কি কখনো রাতের আঁধারের মধ্যে দিনের আলোর জন্য হা হুতাশ করি? বরং উভয়ের স্বাভাবিকত্বকে মেনে নিয়ে রাতের আঁধার দূরীভূত করার জন্য নিজেরাই কোন একটা ব্যবস্থা করে নেই। এই ক্ষেত্রেও তাই করতে হবে। কষ্টকে রাখতে হবে কষ্টের জায়গায় আর সুখকে সুখের জায়গায়। সুখ-দুঃখ প্রতিদ্বন্দ্বী নয় মোটেও। বরং সহোদর। তাই সংঘর্ষ নয় সুখ ও দুঃখের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলেই সুখকে আর খুঁজে বেড়াতে হবে না। সুখই পায়ে পায়ে ঘুরবে। আসলে সুখী মানুষ হওয়া তো এই জগতের সবচেয়ে সহজ কাজ। তোমাদের যা কিছু আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকাই হচ্ছে সুখে থাকার সবচেয়ে সহজ ফর্মুলা। মানুষ হন্যে হয়ে সুখের পেছনে ছুটে বেড়ায়। অথচ জানেই না সুখ তার হাতের মুঠোতেই বন্দী। যাপিত জীবনের ভাঁজে ভাঁজে খাঁজে খাঁজে ঝাঁকে ঝাঁকে বাস করে সুখ পাখী।

আদীর কথা শুনতে শুনতে হাসি ফুটে উঠলো সবার মুখেই। রিসাব হাসি মুখে বলল, আসলেই কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত ও যথাযথ জ্ঞানই আমাদের বাবাদের ও মায়েদের চিন্তার জগতকে এমন উদার-উন্মুক্ত ও বিশালত্ব দান করেছিল। যারা কুরআন-হাদীস পড়ার সাথে সাথে বোঝার ও উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। তাদের সাইকোলজি, ফিলোসফি আর লজিক রপ্ত করার জন্য বাড়তি কোর্সের কোন দরকার পড়ে না। বড়আব্বুর সেই নসীহার কথা মনেআছে তোমাদের?

ফায়েজ হেসে বলল, হুম, আলহামদুলিল্লাহ। বড়আব্বু বলেছিলেন, থাকে যদি সুখী হবার গরজ, জেনে নাও সুখে থাকা খুবই সহজ। সুখের জন্য করতে হবে না আরাধনা, জানাতেও হবে না বিরাট সংবর্ধনা। যা কিছু আছে তোমার তাতেই খুঁজে নিলে সন্তুষ্টি, ইনশাআল্লাহ বারো মাসই ঝরবে সুখ নামক বৃষ্টি। শুধু যদি থাকে উপলব্ধি সুখ হাতছানি মিলবে মায়ের হাসিতে, বাবার পরামর্শে! দেখতে পাবে বোনের দুষ্টুমিতে লুকানো সুখ, সুখ ভাইয়ের সাহচর্যে, বন্ধুর পাশে থাকার মাঝেও সুখ! সুখ ভাসে ঝকঝকে নীলাকাশে, সূর্যের ঘুমে সুখ, চাঁদের প্রকাশে! নক্ষত্রের আকাশে জ্বলজ্বল করে সুখ,  মেঘের বুক থেকে বৃষ্টি রুপে ঝরে সুখ! সুখ জোনাকির টিমটিমে আলোতে, পথের কোণে ফুটে থাকা ছোট্ট ঘাসফুলেও সুখ! বাবার হাত ধরে আঁকাবাঁকা পা ফেলে হেঁটে চলা শিশুর উচ্ছ্বাসে সুখ! পরস্পরকে অবলম্বন করে সম্মুখে ধাবমান প্রবীণ দম্পতির নির্ভরতায় সুখ! বাতাসে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে সুখ! বুকের ভেতর ভালোবাসার অস্তিত্বে সুখ! সুখ অভিমানে, অনুরাগে, খুনসুটি ও ত্যাগেও! বিশ্বাসে সুখ, ভরসায় সুখ, আশাতে সুখ, সুখ কিছু কিছু অপূর্ণতাতেও! জয়ে যেমন আছে সুখ, ব্যর্থতাতেও আছে সুখ নব প্রচেষ্টার। জগতের সর্বত্র ছড়ানো সুখের মেলা, তবে কেন কাটাবো  দুঃখবিলাসীতায় বেলা? কেঁদে ভাসাই সুখ বিহনে নিঃসঙ্গ একাকী, কারণ আমাদের জানাই নেই সুখ আসলে কি?

জাওয়াদ হেসে বলল, কিন্তু আমরা জানি সুখ আসলে কি! আমরা জানি কিভাবে সুখী হতে হয় আলহামদুলিল্লাহ। জানিস এই জগতে কিছু কিছু মানুষ আছেন, নতুন প্রজন্ম যাদের মাঝে  ভালোবাসার প্রকৃত সংজ্ঞা খুঁজে পায়! যারা সত্য ও সুন্দরের সমস্ত রুদ্ধ দ্বারগুলো এক এক করে উন্মুক্ত করেন তাদের পরিশুদ্ধ চিন্তার দমকা হাওয়ায়। যাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় এক একটি অনবদ্য গল্প। যাদেরকে দেখে শিল্পীরাও শিখে নেয় শিল্পের নব নব কলাকৌশল! স্বপ্নচারীরা যাদের  মাঝে সন্ধান পায় কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন রাজ্যের। আমাদের অভিভাবকগণের প্রত্যেকজন ঠিক তেমন একজন মানুষ আলহামদুলিল্লাহ। চিন্তা ও কর্মে উনারা সবার চেয়ে এগিয়ে। জীবনের দূর্যোগের অঝোর শ্রাবণধারায় এমন মানুষগুলো এক মুঠো রোদ হয়ে উঁকি দিয়ে যায় বলেই আকাশ জোড়া আশার  রঙধনু ওঠে। জীবনকে এমন মানুষেরা শুধুই যাপন করতে নারাজ। অনুভব করতে চায় সময়ের প্রতিটি মূহুর্তকে। তাই জীবনের রূপ সরল হোক কিংবা জটিল, তারা দু’বাহু উন্মুক্ত করে জীবনকে বোঝার চেষ্টা করে পরিপূর্ণভাবে। অনেকসময় হয়তো দেখে মনেহয় ভীষণ আত্মভোলা এই মানুষগুলো। কিন্তু চারপাশে কি ঘটছে, কেন ঘটছে সেসব ঠিকই ধরা পড়ে যায় তাদের মনের রাডারে। আর এমন মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, জ্ঞানের উত্তাপে মোমের মতো গলে যান। তাদের জ্ঞান যেমন আলো হয়ে জ্বলতে পারে, তেমনি অথৈ পানির বুকে ভাসতে পারে। আবার  প্রয়োজনে সীলগালার কাজও করতে পারে। আরো পারে সূচালো, ধারালো এই পাথরের পৃথিবী থেকে সুখের ছোট্ট ছোট্ট নুড়ি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে নিজেরা সুখী হতে এবং অন্যদেকে সুখী করতে। আমাদের সবাইকে উনাদের মতো হতে হবে। রাহবার হয়ে পথ প্রদর্শন করে গিয়ে উনাদের দায়িত্ব উনারা পালন করে গিয়েছেন। এখন সেই আলোকিত পথ ধরে এগিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের। তাহলে ইনশাআল্লাহ এই পথ ধরে আমাদের সন্তানরাও হাঁটবে তাদের সন্তানদের হাত ধরে।

আবারো সম্মিলিত হাসির রেখে ফুটে উঠলো সবার চেহারাতে। তবে সেই হাসিতে ছিল আশা জাগানিয়া দখীনা পবনের পরশে মনের স্বপ্নীল বাতায়নের কপাট উন্মুক্ত হবার পরিতৃপ্তি। দুনিয়াবী গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে খেতে হঠাৎ সম্মুখে সত্যের আঙিনাকে উদ্ভাসিত হতে দেখার স্বস্থি। অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে ছোট্ট ছোট্ট আলোকধারী জোনাক জোনাক মানুষদের জীবনের মূল গন্তব্য হাসিলের উদ্দেশ্যে নিভৃত স্বপ্নচারী হবার প্রত্যাশা......


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন