শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৯



ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনের মিক্সড ফ্রুট স্যালাডটা ভীষণ পছন্দের ছিল আমার। প্রথমদিন খাওয়ার পর থেকে গড়ে প্রায় প্রতিদিনই ঐ ফ্রুটস স্যালাডটা দিলেই লাঞ্চ করতাম। তবে এত পছন্দের ফ্রুটস স্যালাডটাতে একটা সমস্যা ছিল। অন্যান্য ফ্রুটসের সাথে চেরিও দেয়া হতো স্যালাডে। চেরি হচ্ছে এমন একটা ফল যার গাছের নীচ দিয়ে যাবার সময়ও এলার্জীর অ্যাটাকে আমার ননস্টপ হাঁচি শুরু হয়ে যেত। ক্যান্টিনে অনুরোধ করে বলেছিলাম আমার স্যালাডে যাতে চেরিটা না দেয়া হয়। কিন্তু সপ্তাহের বড়জোর দু থেকে তিনদিন সেই অনুরোধ মনে থাকতো ক্যান্টিনের স্টাফদের। বাকি দিনগুলোতে চেরি সহ ই স্যালাড নিয়ে হাজির হতো। যদিও আমি কখনোই চেরি খেতাম না। তুলে রেখে দিতাম। কিন্তু তারপরও এলার্জীর অ্যাটাক থেকে রক্ষা পেতাম না। আবার ছোটবেলা থেকেই  ভ্রমণের খুব শখ আমার। সুযোগ পেলেই ছুট লাগাতাম দু চোখ ভরে জগতটাকে দেখার জন্য। দু’তিন মাস পর পরই ক্লাসমিটরা মিলে প্যাকেজ ট্যুরের আয়োজন করতো। ট্যুরে যাবার প্রস্তুতির সময় যতটা আনন্দিত থাকতাম, ট্যুরে কোথায় যাওয়া হবে সেটা ফাইলান হবার পর সেই আনন্দে  প্রায়ই ভাঁটা পড়ে যেত। কারণ বেশির ভাগ সময়ই দেখা যেত সবাই এমন জায়গা পছন্দ করেছে যেখানে অলরেডি আমি ঘুরে এসেছি। কিন্তু সবার পছন্দ ও উৎসাহের সামনে নিজেকে জাহির করতে ইচ্ছে হতো না। মুখে হাসি টেনে তাই বেরিয়ে পড়তাম সবার সাথে ভ্রমণে। নতুন কোন  জায়গা ভ্রমণের সময় যে আনন্দ উদ্দীপনা ঘিরে ধরতো মনকে ঠিক তেমনটা অনুভব না করলেও সবার সাথে হাসি আনন্দেই কাটতো সময়। জীবনে অসংখ্যবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বার বার এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হতে হয়েছে আমাকে। যেখানে আমি যা চাচ্ছিলাম তা পেয়েছিলাম। কিন্তু ঠিক সেভাবে নয় যেভাবে আশা করেছিলাম কিংবা প্ল্যান করেছিলাম। কখনো পছন্দের সাথে সাথে অপছন্দের কিছুও হাজির হয়েছে। কখনো বা অপছন্দের কিছুর সাথে অ্যাডজাস্ট করে নিতে হয়েছে। তখন বয়স কম ছিল। অভিজ্ঞতার ঝুড়িটাও শূন্যই ছিল বলা চলে। কিংবা এভাবেও বলা যায় চলার পথ থেকে সবে মাত্র একটা দুটা করে ফুল কুড়াতে শুরু করেছিলাম। তাই খুব সহজ ভাবে মেনে নিতে কষ্ট চাওয়া ও পাওয়ার মাঝে এমন কিঞ্চিৎ গড়মিলও। প্রায়ই উদাস চোখে দিগন্তের পানে চেয়ে ভাবতাম কেন সবকিছু ঠিক সেভাবেই হচ্ছে না যেভাবে আমি আশা করি, আমি পরিকল্পনা করি? কেন আমার ভালো লাগার হাত ধরে মন্দ লাগাও চলে আসে জীবনে?

ঠিক এই প্রশ্নগুলোই আমার মনেও সারাক্ষণ ঘোরা ফেরা করে ভাইজান। চাওয়ার সাথে সাথে না হলেও বেশির ভাগ সময়ই পেয়ে যাই আকাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলো। কিন্তু ঠিক সেভাবে নয় যেভাবে আমি চেয়েছিলাম। প্রায় সময়ই বিস্তর ফারাক থেকে যায় চাওয়া ও পাওয়ার মাঝে। বলতে বলতে আবারো কিঞ্চিৎ বিষণ্ণতা ছেয়ে গেলো জাহিনের চেহারাতে।
হাসি মুখে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকালো জাওয়াদ। সকালের নাস্তার পর বাগানে এসে বসার পরপরই জাহিন এসে হাজির হয়েছিল গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘে ভরা মন নিয়ে। হাত বাড়িয়ে জাহিনের কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, তোমাকে ফ্রুটস স্যালাড আর ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা কেন বললাম জানো? কারণ তোমার মতই আমিও একসময় চাওয়া ও পাওয়ার অমিল মেনে নিতে পারতাম না। বিষণ্ণ প্রহরের বিনিময়ে অবশেষে একদিন উপলব্ধি করেছিলাম। এই জগতের সবকিছুই কেমন যেন একে অপরের সাথে মেলানো মেশানো। রাতের সমাপ্তিতে দিন আসে, অতঃপর দিন হারিয়ে যায় রাতের গভীরে। কেউ জয়ের মুকুট মাথায় পড়তে পারে  অন্য কেউ পরাজিত হয় বলেই। অপছন্দনীয় কিছুর যাতনা অসহনীয় বলেই পছন্দকে আঁকড়ে ধরে রাখার আকুলতা। দুঃখ আছে বলেই সুখের এত কদর। জগতের সবকিছু কেমন যেন জোড়ায় জোড়ায় আবদ্ধ। তাই একটা চাইলে অপরটা সাথে চলেই আসে। যেমন, আনন্দ সবাই চায় আর বেদনা কেউই চায় না। কিন্তু আনন্দ-বেদনা যে একই ডোরে বাঁধা। কেউ না চাইলেও তাই সুখের সাথে সাথে দুঃখও হাজির হয়ে যায়। জীবন নামক এই সফরে সবকিছুই আসলে প্যাকেজ ডীলের মতো। অনেককিছুই যেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত কিংবা অপ্রয়োজনীয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। মূলত একটি প্যাকেজের সবকিছুই মনের মতো হবে না। সেই সত্যটাকে যেদিন উপলব্ধি করে মনে প্রাণে মেনে নিয়েছিলাম। আমার সমস্ত বিষণ্ণতা সেদিন ওয়ান ওয়ে টিকিট কেটে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিল। আলহামদুলিল্লাহ এরপর থেকে আজ অব্দি তার দেয়া পাইনি।

জাহিন হাস্যেজ্জল চেহারায় বলল, আমিও আমার সমস্ত বিষণ্ণতারকে ওয়ান ওয়ে টিকিট কেটে নিরুদ্দেশ যাত্রায় পাঠিয়ে দিতে চাই ভাইজান। কোথায় পাবো এই টিকিট?

জাওয়াদ হেসে বলল, দুনিয়া নামক এই পরীক্ষাক্ষেত্রে সবর নামক একটি স্ট্রেশন আছে। সেখানে পাবে সমস্ত বিষণ্ণতার ওয়ান ওয়ে টিকিট। আচ্ছা চলো তোমাকে স্টেশনে পৌঁছার নকশা বলে দিচ্ছি। সূরা বাকারাহ এর ২১৬ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, “হতে পারে তোমরা এমন কিছুকে অপছন্দ করছো যা প্রকৃত পক্ষে তোমাদের জন্য কল্ল্যাণকর অথবা এমন কিছুকে পছন্দ করছো যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন কোনটা তোমাদের জন্য উত্তম, তোমরা জানো না(ভাবানুবাদ)”। এই নকশা ধরে চলতে গিয়েও যদি কখনো পথ হারিয়ে ফেলো কিংবা ক্লান্তি চেপে ধরে তখন আমাদের পথ প্রদর্শক রাসূল(সাঃ)এর কথা স্মরণ করবে। তিনি বলেছেন, “কিয়ামতের দিন ইনসাফের দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। দাতাগণ আসলে তাদের দান-সাদাকা ওজন করে সেই পরিমাণে সওয়াব প্রদান করা হবে। এমনিভাবে, নামাজ, হাজ্জ্ব প্রভৃতি ইবাদতকারীদের তাদের আমল অনুযায়ী মেপে প্রতিদান দেয়া হবে। অতঃপর বালা-মুসিবতে সবরকারীরা আগমন করলে তাদের জন্য কোন ওজন ও মাপ হবে না। বরং অগণিত ও অপরিমিত সওয়াব তাদের দেয়া হবে তাদেরকে”। সূরা যুমার ১০ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও বলেছেন, “যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরষ্কার পায় অগণিত”।

আলহামদুলিল্লাহ আমি বুঝতে পেরেছি ভাইজান।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। চলো তোমাকে একটা মজার একটা ঘটনা বলি। বড়আব্বু ঈদের সময় আমাদেরকে ভীষণ স্পেশাল সব ঈদী দিতেন। আমরা বড়আব্বুর ঈদীর জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম। একবার খুব সুন্দর কারুকার্য খচিত ইনভেলাবের ভিতর বড়আব্বু সূরা যুমার ১০ নং আয়াত এবং রাসূল (সঃ) এর “কিয়ামতের দিন ইনসাফের দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা বিষয়ক হাদীসটা আমাদেরকে ঈদী দিয়েছিলেন। আমাদের খানিকটা আশাভঙ্গ হয়েছিল। কিন্তু পরে যখন বড়আব্বু বললেন, জীবনের চলার পথে যখনই আঁধার ঘনিয়ে আসবে। তোমরা সম্মুখে কিছুই দেখতে পাবে না। সবকিছু দুর্বোধ্য লাগবে তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এবং রাসূল সঃ এর এই বাণী দুটো স্মরণ করো। ঘোর আঁধারে নাইট ভিশন চশমার কাজ করবে ইনশাআল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ বড়আব্বুর কথাটিকে আমি সবসময় সত্য বলে প্রমাণিত পেয়েছি আমার জীবনে। যখনই জীবন অন্ধকারের প্রলেপ মেখে দিয়েছে আমার চলার পথে। সবরের নাইট ভিশন গগল এর শক্তিতে কখনো বহুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা আলোকরশ্মি দেখে, কখনো বা আঁধারের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা আলোর গুঞ্জরন অনুভব করে আশ্বস্ত বোধ করেছি। আজ যদিও ঈদ নয়। অবশ্য আপনজনদেরকে উপহার দেবার জন্য কোন বিশেষ দিন জরুরিও নয়। তাই বড়আব্বুর দেয়া সেই ঈদী আজ তোমাকে উপহার দিচ্ছি।

জাহিন হেসে বলল, জাযাকাল্লাহ ভাইজান। ইনশাআল্লাহ আমি জীবনে পাওয়া সবচেয়ে আরাধ্য কিছুর মতোই আগলে রাখবো এই উপহারটিকে এবং যথাযথ মেনে চলতেও আপ্রাণ চেষ্টা করবো।

হাসলেও মুখে আর কিছু বললো না জাওয়াদ। আসলে চাওয়া ও পাওয়ায় দ্বন্দ্বে ভরাই মানুষের জীবন। কাঙ্ক্ষিত জিনিস না পাওয়াটা যেমন কষ্টের, তেমনি ঠিক যেভাবে আশা করা হয়েছিল সেভাবে না পাওয়াটাও যাতনার। অবুঝ মন মানতেই চাও না যদি চাওয়াটা পূরণ হলোই সেভাবে কেন হলো না যেভাবে সে চেয়েছিল? এই প্রশ্নের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাওয়ার কারণেও অনেক সময় মানুষ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় ভিন্ন কিছু প্রাপ্তির মাঝে লুকায়িত কল্ল্যাণকে। তাছাড়া মানুষ শুধু চাইতে পারে, সেই লক্ষ্যে চেষ্টা ও পরিশ্রম করতে পারে। কিন্তু তার পূর্ণতা তো কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইচ্ছাধীন। নিজেদের ক্ষুদ্র জ্ঞানের কারণে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে না বলেই হতাশ হয়, আহাজারি করে চাওয়া ও পাওয়ার অমিলের দ্বন্দ্বে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতিটি সিদ্ধান্তই মানুষ জন্য কল্যাণময়। তবে বেশির ভাগ সময়ই হয়তো নানান পরীক্ষার আড়ালে আসে বলে সেই কল্ল্যাণ সমূহকে খালি চোখে দেখা যায় না। উপলব্ধিতে সবরের নাইট ভিশন গগলস লাগিয়ে খুঁজে নিতে হয় কল্ল্যাণময়তাকে।

@

“তোমার অভিমানে মনের অনুভূতিরা হয় হিম শীতল, রোদে ছাওয়া আকাশকে ঢেকে ফেলে জমাট বিষন্ন মাখা বাদল। সুবাস ছড়ায় না ফুলেরা, চঞ্চল প্রজাপতি বসে থাকে নিশ্চুপ, ঝরে পরে মনের কোনে জমে থাকা সুখের মূহুর্তরা টুপটুপ। পাখীরা ভুলে যায় কুহুতান, গুঞ্জন তোলে না জোনাকি আলোর, আঁধারে উন্মোচনে ঊষার নূপুর পায়ে এগিয়ে আসে না সুহাসিনী ভোর”।

কবিতা শুনে প্রচন্ড বিরক্তি ভরা চোখে মিসেস সুরাইয়া নূহার দিকে তাকালেন। নাবিহা হাসতে শুরু করলে নূহাও মেয়ের সাথে হাসিতে যোগ দিলো। মিসেস সুরাইয়া চোখ থেকে বিরক্তি কন্ঠে নামিয়ে এনে বলল, মা মেয়ে মিলে হিহি বন্ধ কর। না তোদের কবিতা শুনতে চাই, না তোদের হিহি।

নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে মনের সব অভিমান উড়িয়ে দাও বাতাসে, চলো তিনজন মিলে গল্প করি আনন্দের সিংহাসনে বসে।  

নূহা বলল, হুম, তা না হলে মিলাবো ছন্দ আরো ভয়ঙ্কর, বাঁচতে চাইলে অভিমানকে তাড়াও মেরে চড়।

কিছুতেই হাসবেন না সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল মিসেস সুরাইয়ার। কিন্তু মেয়ে আর নাতনীর ছন্দ শুনে হেসে ফেলে নূহার পিঠে আদরের থাপ্পড় লাগিয়ে দিলেন একটা। সাথে সাথেই নাবিহা হুঙ্কার ছেড়ে বলল, খবরদার নানুমণি আমার মামণিকে মারবে না।

তোর মামণি কাজকর্ম করে মার খাওয়ার মতো। মারবো নাতো কি করবো?

বুঝিয়ে বলবে। আমার মামণি মাশাআল্লাহ অনেক সমঝদার মেয়ে। বুঝিয়ে বললেই বোঝে। তাই মা মামণি?

নূহা চেহারায় নিরীহ ভাব ফুটিয়ে তুলে অতি বাধ্য মেয়ের মতো মেয়ের কথায় সম্মতি সূচক মাথা ঝাঁকালো।

মিসেস সুরাইয়া হেসে ফেলে বললেন, মেয়েটাকে নিজের মতো বহুরূপী গিরগিটি বানাস না। নয়তো আজ আমি যেমন ভুগছি, কাল তোকেও ভুগতে হবে। শীত যে এক মাঘে যায় না হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছেড়ে দেবে তোর মেয়ে তোকে।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, মামণি তারমানে তুমিও নিশ্চয়ই আমার নানুমণিকে এক কালে মাঘ মাস দেখিয়েছিলে।

নাবিহা খিলখিল করে হেসে ফেললো। মিসেস সুরাইয়াও হেসে বললেন, এটাই তো রহস্য। আমি এত শান্তশিষ্ট ছিলাম সারাটা জীবন। অথচ আমার মেয়ে হয়ে তুই এত অশান্ত কিভাবে হলি?

নূহা হেসে বলল, এটাকে সাম্যাবস্থা বলে জননী। তুমি অতি শান্ত ছিলে তাই আমি অতি অশান্ত। তুমি আর আমি মিলে ভারসাম্যপূর্ণ ভার্সন হচ্ছে নাবিহা। কখনো অশান্ত কখনো প্রশান্ত।

নাবিহা হেসে বলল, হ্যা নানুমণি। তাছাড়া অ্যান্টি হিরো ছাড়া যেমন হিরো হয় না। তেমনি কারো অশান্ত হওয়ার জন্য কারো শান্ত হওয়াটা জরুরি।

মিসেস সুরাইয়া বললেন, উফফ, আরো কত নতুন নতুন তত্ত্ব কথা যে শুনতে হবে তোমাদের মা মেয়ের কাছ থেকে।
নাবিহা হেসে বলল, এটা আমার নাতো নানুমণি পাপার কথা। গত কয়েকদিন আগে আমাদের গ্রুপের একজনকে পাপা শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু জিহাদ ভাইয়া কিছুতেই চাচ্ছিলো না সে শাস্তি পাক। তাই পাপাকে যখন তার সাপোর্টে বলতে গিয়েছিল তখন পাপা বললেন, তোমরা এখনো অনেক  ছোট। তোমাদের যে কোন ভুল, যে কোন অন্যায় একবার কেন শতবার মাফ করতে প্রস্তুত থাকি আমি। কিন্তু মিথ্যাচার, মিথ্যাচরণ এর জন্য কোন মাফ নেই। এত সুযোগ, এতটা ইতিবাচক পরিবেশ দেবার পরও যদি তোমাদের মধ্যে কেউ মিথ্যা পরিহার করতে না পারো। তাহলে যখন ট্রেনিংসেন্টার থেকে বেরিয়ে নেতিবাচকতায় ভরপুর এই দুনিয়াকে মোকাবিলা করতে হবে তখন কি করবে? তখন তো ভুল আর মিথ্যার স্রোতে ভেসে যাবে উপলব্ধি বিহীন। সুতরাং, মিথ্যা বলার শাস্তি তো পেতেই হবে। এমনকি মিথ্যাবাদী কারো সাপোর্টে যে কথা বলবে তাকেও আমি শাস্তি দেবো। কেননা সেও শয়তানের প্ররোচনার স্বীকার হয়েই মিথ্যাবাদীর আশ্রয়দাতা হতে চাইছে। জিহাদ ভাইয়া তখন আই এম সরি পাপা বলে চুপচাপ বই নিয়ে বসলো। পাপা অনেক বিরক্ত বুঝতে পেরে জিশান আর আমিও বই নিয়ে পড়তে বসে গেলাম। কিছুক্ষণ পর জিশান বলল, পাপা সব দোষ আসলে শয়তানের। শয়তান শুধু পঁচা পঁচা কাজ করতে বলে, মিথ্যা বলতে বলে। শয়তান না থাকলে আমরা সবাই সর্বক্ষণ ভালো থাকতে পারতাম।

মিসেস সুরাইয়া আর নূহা হেসে ফেললে নাবিহাও হেসে বলল, জিশানের কথা শুনে পাপাও হেসে ফেলেছিল। এরপর বললেন, কয়েকদিন আগে যে শিশুদের একটা আর্ট ফ্লিম দেখেছিলে তোমরা মনে আছে? যেখানে আব্দুল্লাহ নামে খুব ভালো একটি ছেলে ছিল। যে ঠিকমতো লেখাপড়া করতো, বড়দের  কথা শুনতো, মানুষের উপকার করতো। এককথায় গুড বয় ছিল আব্দুল্লাহ। শুধু একটু ভীতু ছিল। কিন্তু ইকবাল খুবই দুষ্টু আর সাহসী ছিল। কাউকে ভয় পেতো না, স্কুলেও ঠিকমতো যেত না। এছাড়াও ইকবাল সারাক্ষণ আব্দুল্লাহকে বিরক্ত করতো। দুষ্টু কথা বলতো, মারতো। ইকবালকে শিক্ষা দেবার জন্য আব্দুল্লাহ ধীরে ধীরে সমস্ত ভয় কাটিয়ে অনেক সাহসী হয়ে উঠেছিল। এবং একদিন দুষ্টু ইকবালকে হারিয়ে গুড বয় থেকে সুপার বয় হয়ে গিয়েছিল আব্দুল্লাহ। এখন ভেবে বলো তো যদি  ইকবাল না থাকতো তাহলে কি আব্দুল্লাহ নিজের ভয়কে জয় করার মিশনে নামতো? এবং অতি সাধয়ায় ভয়কে জয় কখনো সুপার বয় হতো? কখনোই না। তারমানে আব্দুল্লাহর ভালোর পাশাপাশি সাহসী ও প্রতিবাদী হবার পেছনে ইকবালের দুষ্টু স্বভাবেরও অবদান আছে। এটা থেকে কি বুঝলাম আমরা? জিশান সাথে সাথে জবাব দিলো, জগতে দুষ্টুরা মোটেই মিনিংলেস, জব লেস না। তাদেরও অনেক অবদান আছে জগতকে সুপার করে তোলার পেছনে। পাপা তখন হেসে বললেন, জ্বি আপনি  তো এই কথাই বলবেন। দুষ্টুর শিরোমনি বলে কথা।

নূহা হেসে ফেলে বলল, সেটাই তো দুষ্টুমির সাপোর্টে কথা বলার এত বড় সুযোগ কি জিশান হাতছাড়া করতে পারে? যাইহোক, এরপর কি বলেছিলেন পাপা তোমাদেরকে?

নাবিহা হেসে বলল, পাপা বলেছিলেন  খুব ছোটবেলায় আমি একটা জিনিস উপলব্ধি করেছিলাম। একজন হিরোর সুপার হিরো হবার জন্য তার জীবনে একজন অ্যান্টি হিরো বা ভিলেনের খুব বেশি প্রয়োজন। যেমন, আমার নানাভাইর সাথে নীতির দ্বন্দ্বে অনেক ছোটবেলাতেই জড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। এরপর থেকে আমি এমন অনেক কাজ করেছি যা হয়তো কখনোই করতাম না যদি না নানাভাইর সাথে সহিহ গলদের প্রতিযোগীতা না থাকতো। আমি অকপটে স্বীকার করি নানাভাই আমার পেশেন্সের চারাগাছকে বটবৃক্ষ হতে সহায়তা করেছিল। সকল অন্যায়, ভুল পথ, মতের বিরুদ্ধে অনঢ়, অটল ভাবে আমার টিকে থাকার শক্তিশালী একটা কারণ হিসেবে কাজ করেছে। মোটকথা আমার সারভাইভ্যল স্কিল্ক পুনঃপুনঃ বুলন্দ করেছেন। নানাভাইর প্রতিটা চ্যালেঞ্জকে দ্বিগুণ গতিতে ফিরিয়ে দেবার জেদ চেপে বসেছিল আমার মনে। পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং সর্বোপরি আল্লাহর উপর ভরসা একজন মানুষকে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে জিরো থেকে হিরোতে রুপান্তরিত করতে পারে এটাই প্রমাণ করে দেখাতে চেয়েছিলাম আমি নানাভাইকে। এবং এই লক্ষ্য অর্জনে আমি দিন-রাতের প্রভেদ ভুলে গিয়েছিলাম, নাওয়া-খাওয়া, বিশ্রাম ভুলে গিয়েছিলাম। এবং একটা সময় অভিষ্ট্য লক্ষ্যকে ছুঁয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছিলাম নানাভাইর সামনে।  এমনটা কিন্তু নয় যে নানাভাই আর আমার সম্পর্কে ভালোবাসার কোন ঘাটতি ছিল। বুঝতে শেখার পর থেকে নিয়ে এখনো পর্যন্ত নানাভাই আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষদের একজন। আমাদের দ্বন্দ্ব ছিল নীতি নিয়ে। যেই দ্বন্দ্বের কারণেই আমি প্রাচুর্যের মোহজাল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। খুঁজে পেয়েছিলাম জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেকে। উপলব্ধি করেছিলাম জীবনের প্রকৃত স্বরুপ। নানাভাইর সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া ছাড়া ব্যক্তি আমি হয়তো আজ এই অবস্থানে এসে পৌঁছাতাম না। ঠিক তেমনি একজন ঈমানদার হিসেবে টিকে থাকার পেছনেও শয়তানের অনেক অবদান খুঁজে পাই আমি। নেতিবাচক কিছু মনে আসার সাথে সাথেই শয়তানের ওয়াসওয়াসা ভেবে এই যে নিজেকে সাবধান করা, সংশোধন করা এবং নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এরজন্য শয়তানের উপস্থিতি জরুরি ছিল। যখন চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু চলে আসে এবং আল্লাহর ভয়ে দৃষ্টি অবনত করি। তখন কিন্তু শয়তানকে হারিয়ে দেবার স্বস্থিও কাজ করে। সকল ভুলের তরে এত শত সতর্কতা তো শয়তানের ধোঁকার পরে যাতে আল্লাহকে নারাজ না করে ফেলি সেজন্যই। তাই যদি তোমরা প্রকৃত মুসলিম হিসেবে সত্যিকার অর্থেই হিরো হতে চাও, তাহলে অ্যান্টি হিরো বা ভিলেন অর্থাৎ, শয়তানের সাথে লড়াই করেই সেটা হতে হবে। কেননা অ্যান্টি হিরো আছে বলেই তো সুপার হিরোর এত সম্মান। তাই তোমাদের জীবনে সবসময় অ্যান্টি হিরোদের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত রাখবে। তবেই হতে পারবে এক একজন সুপার হিরো ইনশাআল্লাহ।
নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এজন্যই তোমার পাপার শেখানোর স্টাইলটার ভীষণ ভক্ত আমি। জানো উনি খুব কম সময়ই আমাকে হাতে কলমে কিছু শিখিয়েছেন। ৯৫ পার্সেন্ট সময়ই উনি শিক্ষার উপকরণের সাথে আমাকে শুধু ইনভল্ভ করে দিয়েছেন, কিছু একটার সাথে রিলেট করে দিয়েছেন, আমার মনের দ্বারে নাড়া দিয়ে উপলব্ধিকে জাগ্রত হতে সহায়তা করেছেন। আমাকে জীবনের রত্নভান্ডারের সন্ধান দিয়েছেন। চলার পথের নকশা হাতে গুঁজে দিয়ে দূর থেকে মঞ্জিল দেখিয়ে দিয়েছেন। অন্তঃদৃষ্টি উন্মোচন করতে সহায়তা করেছেন।শুধুমাত্র বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখে এই দুনিয়াতে স্বস্থিতে থাকার আসলে কোনই সুযোগ নেই। উপলব্ধি বিহীন জীবনের কোথাও তৃপ্তি নেই। জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত থেকে নিজের জন্য কল্ল্যাণ খুঁজে নেবার জন্য অন্তঃদৃষ্টি ও আত্মপোলব্ধি সংমিশ্রণ তাই অতীব জরুরি। আমাদের চারপাশে এত সমস্যা এর একটা কারণ কিন্তু এটাও যে, অন্তঃদৃষ্টি তো অনেক পরের কথা বাহ্যিক দৃষ্টি থাকতেও আমরা অন্ধের মতো পথ চলি। মনের মধ্যে সর্বক্ষণ আবেগের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবার পরেও আমরা অনুভব, উপলব্ধি বিহীন একটা জীবন কাটিয়ে যাচ্ছি। পর্দার আড়ালে কি আছে পর্দা সরিয়ে দেখার সুযোগ থাকতেও ধারণা করতেই পছন্দ করা স্বভাবের মানুষ আমরা। সেই আমরা সমস্যার ভাঁজে ভাঁজে লুকায়িত সম্ভাবনা খুঁজে নেবার তাগিদা বোধ করবো না এটাই তো স্বাভাবিক।

নাবিহা হেসে বলল, পাপা আমাদেরকেও সবসময় এভাবেই শেখান।

নূহা বলল, এটাই আসলে শিক্ষা দেবার সঠিক পদ্ধতি। একজন উত্তম শিক্ষক কখনোই সবটা বলে দিয়ে অন্যকে দেখে নকলে অভ্যস্ত করেন না তার ছাত্রদের। কেননা জীবনকে মুখস্ত যাপনের সুযোগ সময় খুব কমই দেয় মানুষকে। জীবন নামক পরীক্ষাক্ষেত্রে সবার প্রশ্নপত্রেই শব্দার্থ, বাক্য রচনা, ভাব-সম্প্রসারণ, সারাংশ-সারমর্ম, ট্রান্সলেশন, বীজগণিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি ইত্যাদি থাকে। কিন্তু সব ক্লাসের প্রশ্নপত্র যেমন একরকম হয় না। তেমনি ব্যক্তি ভেদে জীবনের  প্রশ্নপত্রও থাকে আলাদা আলাদা। তাই প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়ার চেয়ে সমস্যা সমাধানের নিয়ম ও ফর্মূলা শিখিয়ে দেয়াটাই একজন শিক্ষকের দায়িত্ব।

মিসেস সুরাইয়া বললেন, হুম! বুঝলাম। এখন একটা কথা পরিষ্কার করে বলো তোমাদের মাতা-কন্যার কি শিক্ষাসফরে বের হবার ইচ্ছে? তাহলে আমি রন্ধনশালায় যাবো।

নূহা হেসে বলল, মোটেই না। আমাদের মাতা-কন্যার তো আপনাকে সাথে নিয়ে গল্পসফরে বের হবার ইচ্ছে।

নাবিহা হেসে বলল, হ্যা। ঐ যে দেখো পাপার গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ির গেট দিয়ে। চলো বাগানে বসে আমরা গল্পসফর শুরু করবো। বলতে বলতে দুহাতে মামণি আর নানুমণির হাত ধরে টানতে টানতে বাগানের দিকে হাঁটতে শুরু করলো নাবিহা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন