শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৮



“ছোট্ট একটা পরী, ভীষণ দুষ্টু বুড়ি। একদিন এলো উড়ে, আমাদের সংসারে। এরপর হলো জাদু, গড়লো সে আনন্দসিন্ধু। শব্দে ছিল তার মায়া, ভালোবাসার প্রতিচ্ছায়া। হাসতো ফুল ছড়িয়ে, গাইতো সুর সাজিয়ে। অভিমানে ঝরাতো বৃষ্টি, ছিল গভীর অন্তঃদৃষ্টি। স্বপ্নের অবিরাম ঝর্ণাধারা, মনটা ছিল বড্ড বাঁধনহারা”। বইয়ের প্রথম পাতায় ভালোবাসার তুলির ছোঁয়ায় বুনে দেয়া শব্দগুলো পড়ার সময় আনন্দ ছুটে এসে জাপটে ধরলেও চেহারায় গাম্ভীর্য অক্ষুণ্ণ রেখে নাবিহা বলল, আমি খুব ভালো করে জানি তো এটা যে নকল কবিতা। মোটেই তুমি লেখোনি আমার জন্য। এটা সুবহা চাচী লিখেছিল তোমার জন্য।

অভিমানী মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে নূহা হাসি মুখে বলল, তাকে কি? আমি যদি আমার ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় খেলনাটা তোমাকে দিতে পারি, আমার শৈশবের ডায়েরি তোমাকে দিতে পারি। তাহলে আমাকে দেয়া আমার প্রিয় কারো কবিতা কেন দিতে পারবো না? তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, আমি তোমার জন্য যে শব্দগুলোকে ভালোবাসার ফ্রেমে বাঁধতে চাচ্ছিলাম। সেগুলো যদি আগেই কেউ তার ভাবনার জালে আঁটকে ফেলে থাকে। সেই দোষ কি আমার? বলো তুমিই বলো। বিবেচনা করে বলো।

নাবিহা হেসে বলল, আমি জানি তো তুমি আমাকে পটাতে চাইছো।

তাহলে আর দেরি না করে ঝটপট পটে যাও। তারপর চলো আমরা দুজন মিলে গল্প করি।

নাবিহা চেহারা আঁধার করে বলল, পরশুরাতেও তুমি বলেছিলে গল্প করবে। আমি রাত দু’টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। কিন্তু তুমি ফোন করোনি।

নূহা হেসে বলল, ভুলে গিয়েছিলাম আমি সেটা তো বলেছি তোমাকে। সেজন্য তোমাকে সরিও বলেছি। অথচ এরপরও তুমি অভিমান করে আছো। এখন যদি মামণি অভিমান করি তোমার উপর?

নাবিহা চোখ বড় বড় করে অবাক কন্ঠে বলল, তুমি কেন অভিমান করবে আমার উপর?

কারণ তুমি তো জানোই মামণি ভুলে যাই। যখন আমি ফোন দিতে দেরি করছিলাম তুমি কেন কল করোনি আমাকে? জানি তুমি পরীক্ষা করে দেখতে চাইছিলে আমার মনে থাকে কিনা তোমাকে ফোন দেবার কথা। আচ্ছা আমি যদি তোমার পরীক্ষায় পাশ করতাম তাহলে কি হতো? স্পেশাল কিন্তু তেমন কিছুই হতো না। ফোন দেবার কথা ছিল তাই দিতাম এবং কিছুক্ষণ গল্প করতাম তুমি আর আমি। এবার ভেবে দেখো তো তোমার পরীক্ষায় আমি ফেল করাতে কি হয়েছে? তুমি অপেক্ষা করেছো অনেকটা সময় ধরে। অপেক্ষায় সময়টুকুতে আমি ফোন করবো কি করবো না এই দোদুল্যমনতায় ভুগেছো। শেষপর্যন্ত ফোন না করাতে কষ্ট পেয়েছো, কান্নাও করেছো জানি। এবং এরপর থেকে আমার উপর অভিমান করে বসে আছো। গতকাল সারাদিন সারারাত তুমি একবারও আমার সাথে কথা বলোনি, ম্যাসেজ করোনি, আমার ম্যাসেজের জবাবও দাওনি। সবসময় আমি বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে তুমি সবার আগে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ো আমার কোলে। কিন্তু আজ অভিমান বোঝানোর জন্য তুমি ছুটে আসোনি আমার কাছে। এটা আমার জন্য প্রচন্ড কষ্টের ছিল। এখনো ভাবতে গিয়ে আমার চোখ ভিজে আসছে। অথচ তুমি যদি পরশুরাতে ফোন দিতে আমাকে তাহলে এসবের কিছুই হতো না। না চাইতেও আমরা দুজন একে অন্যের কষ্টের কারণ হতাম না। গত তেতাল্লিশ ঘন্টার যে ছোট্ট দুরুত্বটা আমাদের মাঝে তৈরি হয়েছিল সেটা হতো না।

দুহাতে নূহাকে জড়িয়ে ধরে কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে একরকম ফুঁপিতে উঠে নাবিহা বলল, আই এম সরি মামণি। আই এম রিয়েলি ভেরি সরি। আমি আর কখনো কোনদিন এমন বোকামি করবো না ইনশাআল্লাহ। আই প্রমিস।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হেসে ফেললো নূহা। হাত বাড়িয়ে চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রুবিন্দু মুছে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, তবে মাঝে মধ্যে এমন একটু আধটু মান অভিমানেরও দরকার আছে। মনেরও তো কখনো সখনো ইচ্ছে করে স্পাইসি কিছু টেস্ট করে দেখতে।

নাবিহার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলেও অপরাধী কন্ঠে বলল, তারপরেও আমার ওমন করাটা ঠিক হয়নি।

নূহা হেসে বলল, হুমম, সেটা অবশ্যই ঠিক হয়নি। জীবন তো সারাক্ষণই নানান ধরণের পরীক্ষার আয়োজন সাজিয়ে চলার পথের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য। জীবন নামক এই পরীক্ষা ক্ষেত্রে আপনজনেরাই তো আমাদের এক টুকরো প্রশান্তির আশ্রয়। সেই কাছের মানুষেরাও যদি পরীক্ষা নেয়া শুরু করে তাহলে কোথায় গিয়ে স্বস্থির একটু নিঃশ্বাস ফেলবো আমরা?

আমি বুঝতে পেরেছি মামণি। আর কখনোই এমন হবে না ইনশাআল্লাহ। এরপর থেকে যখনই তুমি কোন কিছু ভুলে যাবে আমি তোমাকে জোর করে মনে করিয়ে দেবো।

নূহা হেসে বলল, আমাদের তো আসলে এমনটাই করা উচিত। আপনজনদের চলার পথটাকে যতটা সম্ভব মৃসুন করে তোলার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা উচিত। আপনজনদের পরীক্ষাগুলোকে কিভাবে সহজ করে তোলা যায়, কিভাবে তাদেরকে পাশ মার্ক তুলতে সহয়তা করা যায় সেই পথ ও পন্থার সন্ধান করা উচিত। কখনোই তাদের চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করা উচিত নয় যে, কাঁটার আঘাত এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে কিনা। যদি সে না পারে তাহলে পথে কাঁটা বিছানোর দায় তো আমাদের উপরই বর্তাবে তাই না?

জ্বি মামণি।

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা চলো এখন আমরা অন্য কথা বলি। তোমার স্কুলের গল্প শোনা হয়নি কিন্তু বেশ কিছুদিন। কেমন আছে তোমার ক্লাসফ্রেন্ডরা সবাই?

নাবিহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে। শুধু তাজকিয়া ছাড়া।

কেন? কি হয়েছে তাজকিয়ার? এখনো কি একটুতেই মনখারাপ করে বসে থাকে?

হ্যা মামণি কেউ কিছু বললেই তাজকিয়া মনখারাপ করে, কান্না করে। ওকে যতই বলি মনখারাপ হয় এমন কথা বেশি ভাবতে নেই। ততই আরো বেশি বেশি ভাবে আর মনখারাপ করে। মামণি তাজকিয়াকে একদিন নিয়ে আসি তোমার কাছে?

নূহা হেসে বলল, আগে তুমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করো। একান্তই যদি না বোঝে তোমার কথা। এরপর নাহয় আমি কথা বলবো ওর সাথে।

নাহিবা হাসি মুখে বলল, আচ্ছা। তাহলে আমাকে বলে দাও কিভাবে ওকে বোঝাবো।

একটুক্ষণ সময় নিয়ে নূহা হেসে বলল, একটা সময় ছিল যখন অতি সামান্য কারণেই মনের ঘরের ইলেকট্রিক কানেকশন, জেনারেটর পাওয়ার, চার্জ লাইট, চর্ট লাইট, হারিকেন, মোমবাতি সবকিছু নিভিয়ে দুনিয়া আঁধার করে বসে থাকতাম আমি। কোন কিছু মনের মতো না হলেই মননদীতে জোয়ার  এসে চোখের কূল ভেঙে ছলকে ছলকে বেরিয়ে আসতো জলধারা। কেউ কেন এমন কথা বলবে যা আমার পছন্দ নয়? এই প্রশ্নের উত্তাপে ফেটে পড়তো মনের আগ্নেয়গিরি। নিজ চিন্তার লকলকে লাভার স্রোতে দগ্ধ হতে হতে ভস্ম হয়ে যেতাম নিজেই। আসলে একটু বেশির স্পঞ্জি স্বভাবের ছিল আমার মনটা তখন। তাই যাই শুনতাম বা দেখতাম নিজের মাঝে ধারণ করে ফেলতাম। ইতিবাচক হলে তো সমস্যা ছিল না। কিন্তু নেতিবাচক যে কোন কিছুই আমাকে খুব ব্যথিত করতো। ছোট ছিলাম তাই নেতিবাচক ও ইতিবাচক অভিজ্ঞতাকে সমূহকে আলাদা যেমন করতে পারতাম না। তেমনি ইতিবাচকতার ছোঁয়ায় নেতিবাচক কিছুকে বদলে দিতেও পারতাম না। আবার না পারতাম নেতিবাচকতাকে নিংড়ে বের করে ফেলতে। যারফলে, উনিশ থেকে বিশ হলেই আমার মনের আকাশ ছেয়ে যেত ঘন কালো মেঘে। অকারণ কষ্ট পাবার, কষ্ট তৈরি করার, কষ্ট পোষার একটা স্বভাব তৈরি হতে শুরু করেছিল আমার ভেতর। একদিন তোমার পাপার খুব সামান্য একটা কথাতে মনের আকাশ থেকে ঝিলমিলে তারাগুলোকে টেনে টেনে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের নীচে নিজেকে গুঁটিয়ে বসেছিলাম।

নাবিহা হেসে বলল, পাপা কি বলেছিল তোমাকে?

নূহা হেসে বলল, সেটা তো বলা যাবে না। টপ টাইপের সিক্রেট কথা এটা। তবে এরপর কি বলেছিলেন সেটা বলতে পারি তোমাকে।

নাবিহা লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, নাই মামার চেয়ে কানা মামা নাকি ভালো। বলো সেটাই বলো শুনি।

নূহা হেসে বলল, সেদিন তোমার পাপা বলেছিলেন, “জীবন আলো আঁধাররির সংমিশ্রণ, শুধু সুখ কিংবা দুঃখ হবে না অর্জন। আনন্দের সুর শুনতে পাবে এই ক্ষণে, বেদনা তুলে দেবে কম্পন পরক্ষণে। মেনে নিয়ে পথ চলে যারা এই সত্য, তারাই উপভোগ করে সময়কে নিত্য। জীবনে  বারংবার ঘটবে মন খারাপের ঘটনা, কষ্ট নানান মুখোশে পুনঃপুনঃ করবে ছলনা। প্রতিবারই যদি হও তুমি উদাস, অর্জিত করবে উপাধী নফসের দাস। তাই বিবেকের কার্যাবলীকে করতে না চাইলে শিথিল, আজ থেকেই তিলতিল করে মনকে করো তোলো পিচ্ছিল”।

নাবিহা হেসে বলল, মনকে করো তোলো পিচ্ছিল?

হাসতে হাসতে নূহা বলল,  কথাটা শুনে আমিও অনেক মজা পেয়েছিলাম সেদিন। মনখারাপ ভুলে আমি হেসে ফেললে তোমার পাপাও হাসি মুখে বলেছিলেন,  আজ থেকে রোজ নিয়ম মাফিক দুইবেলা তোমার মনে অলিভ অয়েল মাখবে। এক্কেবারে তেল চপচপা তেলতেলে করে ফেলবে মনকে। মনকে বিষণ্ণ করা, উদাস করা কোন কথাই যেন স্থির হয়ে দুদন্ড দাঁড়ানোর সুযোগ না পায় তোমার মনে। নেতিবাচক সমস্ত কিছুর প্রভাব যেন পিছলে গিয়ে দূরে চিৎপটাং হয়।
নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, তারমানে তাজকিয়াকে পাপার এই অয়েল ফর্মূলাটা দিতে হবে। তাই না?

হ্যা। এবং একই সাথে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলবে, দুনিয়ার এই ছোট্ট জীবনে মনখারাপ করার মতো, কষ্ট পাবার মতো, ব্যথিত হবার মতো, আহত হবার মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আমরা শত চেষ্টা করেও জীবনে আসা এইসব নেতিবাচকতাকে থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারবো না। কিন্তু ইচ্ছেশক্তি ও চেষ্টার দ্বারা এইসবের নেতিবাচক প্রভাব থেকে অবশ্যই নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারবো। এবং নিজের জন্যই এমনটা করতে হবে আমাদেরকে। তা না হলে জীবনের ইতিবাচক দিক সমূহের সুফল থেকেও বঞ্চিত হতে হবে আমাদেরকে। জীবন বেদনা যেমন দেয়, আনন্দও তো দেয়। বেদনায় নিমজ্জিত থাকি বলেও কিন্তু অনেক আনন্দের আগমনী ধ্বনি শুনতে পাইনা আমরা। দেখতে পাইনা অনেক সুখের মৃদু হাতছানি। সর্বাবস্থাতেই তাই ইতিবাচক চিন্তা করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা আমরা কোন কিছুকে কিভাবে দেখছি, কিভাবে ভাবছি সেটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। আবার চিন্তার প্রতিফলনই আমরা বাস্তবে দেখতে পাই। তাই আমরা মনকে নেতিবাচকতা নাকি ইতিবাচকতা সাপ্লাই করছি সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনকে আমরা যেই কাঁচামাল সাপ্লাই করবো মন তার দ্বারাই গড়ে তুলবে প্রোডাকশন হাউস। সেজন্য আমরা যদি সুখী ও সুন্দর একটা জীবন চাই তাহলে আমাদেরকে ইতিবাচক সবকিছুর প্রতিই মনোযোগী হতে হবে। এবং নেতিবাচক সবকিছুর জন্য মনকে স্পেশালি ট্রেনিং দিয়ে করে তুলতে হবে পিচ্ছিল।

নাবিহা হেসে বলল, একদম সুপার পিচ্ছিল। ইনশাআল্লাহ আমি তাজকিয়া বুঝিয়ে বলবো।

নূহা হেসে বলল, দ্যাটস লাইক অ্য মাই গার্ল। আচ্ছা এখন তুমি তোমার জন্য নিয়ে আসা বইটা পড়ো। আমাকে দু’চার ঘন্টার জন্য হসপিটালে যেতে হবে। ইনশাআল্লাহ ফিরে এসে সন্ধ্যায় অনেক গল্প করবো আমরা।

জড়িয়ে ধরে মামণিকে আদর করে দিয়ে বিদায় জানিয়ে বই খুলে বসলো নাবিহা।

@      

ফজরের নামাজ আদায় করে বারান্দায় এসে বাইরের দিকে তাকাতেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো নাবিহার মন। বাইরে অঝোর ধারায় ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে। যতটা না বৃষ্টির জন্য তারচেয়ে বেশি খুশি হলো আজকের নিজের শুরুটা বৃষ্টিমুখর হবার জন্য। গতরাতেই গল্প করার ফাঁকে মামণি তাকে বলেছিল বৃষ্টিমুখর দিনে সকালের নাস্তায় মসলা চা আর গরম গরম সবজি পাকোড়া খেতে ভীষণ পছন্দ করে। গতরাতে যখন মামণির সাথে গল্প করছিল তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। দোয়া চাইবার মোক্ষম সময়টা হাতছাড়া হতে দেয়নি নাবিহা। আল্লাহর কাছে এমন একটা বৃষ্টিমুখর দিন চেয়েছিল। যাতে নিজ হাতে মামণিকে মসলা চা আর সবজি পাকোড়া বানিয়ে খাওয়াতে পারে। তার খুব ভালো মতোই জানা আছে বৃষ্টির দিনে পাপার প্রিয় নাস্তাও মসলা চা আর সবজি পাকোড়া। আর এক মূহুর্ত দেরি না করে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে ছুট লাগালো নাবিহা। কিন্তু দরজায় পৌঁছে রান্নাঘরের ভেতরে নানাভাইকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো।

কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে নাবিহাকে দাঁড়ানো দেখে হেসে সালাম দিলেন আজাদ সাহেব।
সালামের জবাব দিয়ে ধমকের সুরে নাবিহা বলল, নানাভাই তুমি এত ভোরে কিচেনে কি করছো? চুরি করে মিষ্টি খেতে এসেছো বুঝি?

হেসে ফেললেন আজাদ সাহেব। হাসতে হাসতে বললেন, তুমি যে কারণে এসেছো আমিও ঠিক একই কারণে এসেছি।

হাসি ফুটে উঠলো নাবিহার চেহারাতেও। গতরাতে তার আর মামণির গল্পের আসরে নানাভাইও ছিল। তার মতো নানাভাইও নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে বৃষ্টির দোয়া করেছিল। আনন্দময় কাজে সঙ্গী পেয়ে যাওয়াটাও আনন্দের। নানাভাইকে সাথে পেয়ে নাবিহারও আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেলো। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে চোখ বড় বড় করে ঝগড়া করার স্টাইলে বলল, মামণির জন্য মসলা চা আর সবজি পাকোড়া কিন্তু আমি বানাবো। তুমি দূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখবে। এটা হচ্ছে কন্ডিশন। বুঝেছো?

আজাদ সাহেব হেসে বলল, সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু কথা হচ্ছে গিয়ে আমাদের দুজনের লক্ষ্য যেহেতু এক। শুধু শুধু কন্ডিশন টেনে এনে দুরুত্ব তৈরি করার কি দরকার মাঝখানে বলো? তারচেয়ে চলো দুজনে মিলেই আমাদের মায়ের জন্য তার পছন্দের নাস্তা বানাই।

নাবিহা হেসে বলল, আচ্ছা ডান। কিন্তু নাস্তা বানাতে বানাতে আমাকে মামণির গল্প শোনাতে হবে।

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, অবশ্যই শোনাবো। জানো নূহা আর আমিও মাঝে মাঝে এমন একসাথে রান্না করতাম। তবে সেইসব রান্না বেশির ভাগ সময়ই হতো গভীর রাতে।

নাবিহা হেসে বলল, গভীর রাতে কেন? অন্যসময় কি নানুমণি বকা দিতো?

আসলে আমাদের পিতা-কন্যার গল্পের আসর বসতো রাতের বেলা। গল্প করতে করতে ক্ষুধা লেগে গেলে দুজন মিলে কিছু একটা বানিয়ে খেতাম। বেশির ভাগ সময়ই বিভিন্ন ধরণের পাকোড়া, নয়তো আলুর চপ বা বেগুনী, কিংবা অন্য কোন স্পাইসি নাস্তা বানাতাম। সাথে চা কমন। তবে দু'একদিন আবার হেভি কিছু খেতে ইচ্ছে করতো। এমন দিনগুলোতে হয় আমার পছন্দের প্লেইন পোলাও আর কাবাব, নয়তো নূহার পছন্দের ভেজিটেবল বিরিয়ানি রান্না করতাম।

নানূমণির হাতে ধরা পড়তে না কখনোই? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো নাবিহা।

আজাদ সাহেবও মুখের হাসি আরো বিস্মৃত করে বললেন, তোমার নানুমণি তো রোজই হাজির হয়ে যেতো খাবারে ভাগ বসানোর জন্য। জাওয়াদের সাথে নূহার বিয়ের পর আমাদের নিশি আড্ডার সদস্য সংখ্যা আরেকজন বেড়েছিল। সত্যি বলতে জাওয়াদ যোগ দেবার পর থেকে আমাদের আড্ডার আনন্দও অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। একদিন আমরা চারজন মিলে লং ড্রাইভে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। সারারাত বাইরে ঘুরাঘুরি করে একদম ফজরের একটু আগে বাড়িতে ফিরেছিলাম। জাওয়াদ সাথে না থাকলে আমার কখনোই সাহস হতো না গভীর রাতে নূহা আর তোমার নানুমণিকে নিয়ে বাইরে বেরুবার।

ইশশ, তোমরা কত্তো মজা করেছো। তখন আমি থাকলে আমিও আনন্দ করতে পারতাম।

নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি মুখে আজাদ সাহেব বললেন, প্রকৃতি জুড়ে যখন যে ঋতুর মেলা বসে। তখন সেখান থেকেই আনন্দের উপকরণ খুঁজে নিতে হয়। যেমন ধরো, বরষার সময় বৃষ্টিকে উপভোগ করাই আনন্দ, বসন্তে ফুলের সমারোহে ছড়ানো থাকে খুশি। জীবনও তেমনি একেকসময় একেক ঋতু নিয়ে হাজির হয় আমাদের কাছে। তখন জীবনে হেমন্ত এসেছিল। নবান্ন উৎসবের পাশাপাশি সুখানন্দের অনেক ফসলও ঘরে তুলেছিলাম আমরা আলহামদুলিল্লাহ। এই শীতে সেখান থেকে নিজেদের খোঁড়াক মেটাই চলো।

নাবিহা হেসে বলল, হ্যা হ্যা তাই করবো আমরা। নানাভাই তোমার কথা পাপা মামণির মতোই ফাটাফাটি।

আজাদ সাহেব হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। এখন তাহলে চলো তোমার পাপা মামণির জন্য ফাটাফাটি মসলা চা আর পাকোড়া বানানোতে মনোযোগ দেই। তোমার নানুমণি এলে আমাদেরকে নির্ঘাৎ রান্নাঘর থেকে বের করে দেবে।

হ্যা নানাভাই চলো তাড়াতাড়ি করে নাস্তা বানিয়ে ফেলি আমরা। বৃষ্টি থেমে যাবার আগেই নাস্তা দিতে চাই মামণি পাপাকে। গল্পে সাময়িক বিরতি টেনে নানা নাতনী মিলে তখন নাস্তা বানানোতে মনোনিবেশ করলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন