শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৬



তন্দ্রাভাব এসে দস্তক রাখতে না রাখতেই হঠাৎ মুখে ঠান্ডা কিছুর ছিটা অনুভব করে খানিকটা চমকে উঠে চোখ খুলে তাকালো জাওয়াদ। চেহারায় হাত বুলিয়ে বুঝতে পারলো ঠান্ডা পানিতে মাখামাখি হয়ে আছে। আশেপাশে কেউ না থাকলেও পর্দায় পেছনে নাড়াচাড়া দেখে জাওয়াদের বুঝতে মোটেই কষ্ট হলো না এই দুষ্টু কাজটি কার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। উঠে বিছানাতে হেলান দিয়ে বসতে বসতে বলল, জিশান দুষ্টু ছেলে কান টেনে ছিঁড়ে দেবো তোমার।

সাথে সাথে বিশাল হাসি দিয়ে এক লাফে পর্দার আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো জিশান। এবং দ্বিতীয় লাফে পাপার কোলের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাসতে হাসতে বলল, গুড মর্নিং মোষ্ট হ্যান্ডসাম এন্ড সুইটু পাপা ইন দ্য ওয়াল্ড।  

ছেলের কান টেনে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জাওয়াদ বলল, গুড মর্নিং মোষ্ট দুষ্টু এন্ড কিউটু সান ইন দ্য ওয়াল্ড।

জিশান হাসি আনন্দ ভরা কন্ঠে বলল, পাপা আই লাভ ইউ এত্তোগুলা।

আই লাভ ইউ টু তত্তোগুলা। এখন আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও।

পাপা তুমি শুধু প্রশ্নটা করো। সাথে সাথে জিশান জবাব দিয়ে দেবে ইনশাআল্লাহ।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমস্ত দুষ্টুমি করা জিশান কবে ছাড়বে?

জবাব হচ্ছে, জিশান প্রায়ই দুষ্টুমি ছেড়ে দেবার কথা ভাবে। কিন্তু পাপার সাথে দুষ্টুমি করা জিশানের কাছে অক্সিজেনের মতো। মানুষ যেমন অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না। জিশান তেমন পাপার সাথে দুষ্টুমি করা ছাড়া থাকতে পারে না। আবার স্ব ইচ্ছায় অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে নিজের উপর জুলুম করলে তো আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে। এখন তুমিই বলো জিশান ছোট বাচ্চাটা কি করবে?

জাওয়াদ হেসে বলল, দুষ্টুর সাথে সাথে কথার মারপ্যাঁচও তো ভালোই শিখেছে জিশান। মা’র বাসায় গিয়ে কি প্যাঁচালো কথার ট্রেনিং নেয়া হচ্ছে নাকি আজকাল।

জিশান হেসে ফেলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে মূহুর্তেই চেহারাতে গুরুগম্ভীর ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, এভরিথিং ইজ ডান। বাট আমার সোনা মা’র ব্যাপারে ব্যাড কমেন্ট নট ডান। নেভার এভার ডান। আন্ডাসট্যান্ড?

জাওয়াদ হেসে বলল, ইয়েস স্যার। ব্যাড কমেন্ট উইথড্রো করা হলো। এখন বলেন আপনার ভাই বোন কোথায়?

জিশান হেসে বলল, গুড বয় ভাইয়া পড়ছে আর অ্যাংরি গার্ল নাবিহা নাস্তা বানাচ্ছে।

নাবিহা একা একা নাস্তা বানাচ্ছে? চলো আমরা যাই ওকে সাহায্য করবো।

আমি গিয়েছিলাম তো পাপা সাহায্য করতে। নাবিহা ধমক দিয়ে বের করে দিয়েছে কিচেন থেকে। আর যাবো না ওকে সাহায্য করতে। তাছাড়া এখন সাইন্স চ্যানেলে আমার ফ্রেব্রেট শো লিটল সায়েন্টিস্ট শুরু হবে।    

বিছানা থেকে নামতে নামতে জাওয়াদ বলল, ওকে মাই লিটল সায়েন্টিস্ট আপনি আপনার ফ্রেব্রেট শো দেখেন। আমি যাচ্ছি আমার কন্যাকে সাহায্য করার জন্য। রুম থেকে বেড়িয়ে কিচেনে যাবার পথে দরজা খোলা দেখে জিহাদের রুমে উঁকি দিলো জাওয়াদ। জ্ঞানার্জনে গভীর আত্মমগ্ন পুত্রের দিকে হাসি ফুটে উঠলো মুখে। দুর্বোধ্য জিনিসগুলোও সময়ের ব্যবধানে কত সহজ স্বাভাবিক রূপেই না ধরা দেয়। ত্রিশ বছর আগে বাবা কেন আড়াল থেকে মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিতে থাকেন কিছুতেই বোধগম্য হতো না। কিন্তু আজ নিজে পিতার স্থানে দাঁড়িয়ে অজানা যেই রহস্যের সমাধান উপলব্ধির করায়ত্ত। ঠিক তেমনি বর্তমানের অনেক রহস্য, অনেক অজানা প্রশ্নের জবাব হয়তো প্রতীক্ষমাণ ভবিষ্যতের কোন এক মোড়ে। আসলেই সময়কে সময় দিতে পারলেই জীবনের অধিকাংশ রহস্য আঁধারের পর্দা ভেদ করে আলোয় উদ্ভাসিত হয়।

কিচেনের দরজায় নক হিবার শব্দ শুনে ঘুরে তাকিয়ে পাপাকে দেখতে পেয়ে আনন্দ চিকচিক করে উঠলো নাবিহার দু’চোখে। সালাম দিয়ে হাসি মুখে বলল, ভেতরে এসো পাপা।

সালামের জবাব দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জাওয়াদ বলল, আমার মা নাকি একা একা নাস্তা বানাচ্ছে? পাপাকে কেন ডাকেনি?

নাবিহা হেসে বলল, তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। আমি আজ ছোটবেলায় আমাদের খুব পছন্দের একটা নাস্তা বানাচ্ছি। তুমি যে আমাদেরকে ছোট ছোট স্যান্ডুইচ বানিয়ে দিতে সেই নাস্তাটা।

জাওয়াদ হেসে বলল, এটা তো আমারো অনেক পছন্দের নাস্তা। চলো দুজন মিলে বানাই। তাহলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।
নাবিহা হেসে বলল, নাস্তা বানানো শেষ তো পাপা। এখন শুধু টেবিলে সাজাতে হবে। তুমি তাহলে নাস্তা টেবিলে দাও। আমি নানাভাই দাদাভাইদেরকে স্যান্ডুইচ দিয়ে আসি।

নাবিহা বেরিয়ে যাবার পর টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে দুই ছেলেকে ডাকলো জাওয়াদ। ডাক দেবার প্রায় সাথে সাথে জিহাদ চলে এলেও ফেব্রেট শো থেকে উঠিয়ে আনার জন্য বেশ কয়েকবার ডাকতে হলো জিশানকে। নাস্তা টেবিলে এসে বসতে বসতে জিশান বলল, জানো পাপা সাইন্স চ্যানেলে নতুন একটা প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। আর ইউ গুড অর ইভিল ফাটাফাটি সব কথাবার্তা বললো প্রোগ্রামটাতে। বুঝলে পাপা মানুষের মধ্যে ভালো ও মন্দ দুটা স্বত্বাই থাকে। পরিবেশ ও জেনেটিক সমস্যা মিলিয়ে কিছু মানুষ ইভিল হয়ে যায় আর কিছু মানুষ ফাটাফাটি ভালো হয়ে যায়।

জাওয়াদ বললেন,একথা প্রোগ্রামে বলেছে?  

জিশান মুখ খোলার আগেই জিহাদ বলল,পাপা সত্যিই কি একজন খুব খারাপ মানুষের সন্তানদের জেনেটিক ভাবেই খারাপ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে?  

জাওয়াদ হেসে বললেন, ভালো ও মন্দের সমন্বয়েই প্রতিটি মানুষ। তাই সম্ভাবনা উভয়টারই থাকে। তবে একটি শিশু যদি জন্মের পর থেকে খুব ভালোবাসাময়,সুন্দর ও পবিত্র পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠে। তাহলে জেনেটিক প্রভাব মুক্ত থাকাটা খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। ঠিক তেমনি একজন অতি উত্তম মানুষের সন্তান যদি খুবই নেতিবাচক কোন পরিবেশে,অর্থাৎ,ঘৃণা,অনৈকতা,অবহেলা ইত্যাদি পেতে পেতে বড় হয়। তাহলে তার অ্যান্টিসোশ্যাল হবার সম্ভাবনাই বেশি।

জিহাদ বলল,তার মানে জেনেটিক ফ্যাক্টরের চেয়ে এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাক্টর বেশি ইম্পটেন্ট। পরিবেশের প্রভাবে খুব খারাপ কেউও ভালো হয়ে যেতে পারে। ঠিক তেমনি খুব ভালো কেউ হয়ে যেতে পারে খারাপ।

জিশান বলল,তবে ভালোর চেয়ে খারাপ হওয়াটা বেশি সহজ তাই না পাপা?  

জাওয়াদ হেসে বললেন,গোঁড়ায় গলদ বলে একটা কথা আছে। এরমানে হচ্ছে,বীজ কিংবা অঙ্কুরেই যদি সমস্যা থাকে,তাহলে যথাযথ ও পর্যাপ্ত পরিচর্যার পরেও আশানুরূপ ফসল উৎপাদন সম্ভব হয় না। তাই গোঁড়া থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,মানুষের গোঁড়াটা কোথায়?  

জিশান হাত উঁচু করে বলল,মানুষের গোঁড়া হচ্ছে,শৈশব। একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে একটি বীজের মতো থাকে। রাইট পাপা?

স্যরি রাইট বলতে পারছি না। একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে বীজ থেকে চারা গাছে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
জিহাদ বলল,তারমানে মানুষের গোঁড়া হচ্ছে তার বাবা-মা। তাই না পাপা?  

জাওয়াদ হেসে বললেন,রাইট। একটি উৎকৃষ্ট বীজের জন্য ভালো মানের বৃক্ষ হওয়াটাও জরুরি। শুদ্ধতার সফর তাই বীজ থেকে নয়। বীজ উৎপাদিত হয় যে গাছ থেকে। সেই গাছ থেকেই শুরু করতে হয়।

জিশান বলল,আরেকটু সহজ করে বলো না পাপা প্লিজ।

ওকে সহজ করেই বলছি। আমাদের ছোটবেলার একটা গল্প বলি তোমাদেরকে। আমরা তখন গ্রামে থাকতাম। আমাদের একজন প্রতিবেশী চাচা ছিলেন। উনার চার ছেলে ছিল। সেই চার ছেলে নিয়ে উনি সারাক্ষণই একটা কম্পিটিশনের মুডে থাকতেন আমাদের বাবা-পাপাদের সাথে। খুব গর্ব করতেন নিজের সন্তানদের নিয়ে। অবশ্য উনার চার ছেলে বেশ বাধ্য ও অনুগত ছিল বাবা-মার। উনারা যা বলতেন ছেলেরা তাই শুনতো। আমরা পাঁচ ভাই মোটেই তেমন ছিলাম না। তখনো বাবা-মায়েদের কোন কথা যদি আমাদের কাছে সঠিক মনে না হতো। আমরা তীব্র বিরোধ করতাম। আমাদের চোখের সামনে কেউ অন্যায় করলে সে বয়সে ছোট নাকি বড় সেই চিন্তা না করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম। আমরা তাই গ্রামের অতি অবাধ্য ছেলে হিসেবেই পরিচিত ছিলাম। কিন্তু প্রতিবেশি ঐ চাচার চার ছেলের খুব সুনাম ছিল গ্রাম জুড়ে। ক্লাস সিক্সে ওঠার পরই আমরা ঢাকায় চলে এসেছিলাম। এর কয়েক বছর পর দেশের বাইরে। সবকিছু মিলিয়ে অনেক বছর গ্রামে যাওয়া হয়নি আমাদের। এরপর যখন গ্রামে গিয়েছিলাম আমাদের বয়স বিশের কাছাকাছি ছিল। ঐ সময় গ্রাম জুড়ে প্রতিবেশী সেই চাচার ছেলেদের অনৈতিক কর্মকান্ডের কথা ভেসে বেড়াতো। কিন্তু ঐ চাচা-চাচী কিছুতেই সেসব কথা বিশ্বাস করতেন না। কারণ তারা তাদের সন্তানদেরকে সবসময়ই ভালো সন্তান হিসেবেই পেয়েছে। সমস্যাটা তাহলে কোথায় হয়েছে? সমস্যাটা হচ্ছে,ভালো সন্তান বলতে উনারা শুধু পিতামাতার বাধ্য ও অনুগত এই ব্যাপারটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু ভালো মানুষের সংজ্ঞা এত ক্ষুদ্র নয়। কেউ যখন মানসিক ও আত্মিক দিক থেকে উন্নত ও পবিত্র থাকে। এবং মানবিক গুণাবলীতে সজ্জিত থাকে।  তাকেই কেবল একজন আদর্শ মানুষ বলা যায়।

আরো সহজ করে বলো পাপা। অনুরোধের স্বরে বললো জিশান।

আমি তো বলতে চেষ্টা করছি বাবা। একটু ধৈর্য্য ধরে পাপার সম্পূর্ণ কথা শুনতে হবে বোঝার জন্য।

জিশান হেসে বলল,আচ্ছা আর কথা বলবো না মাঝখানে।

আমার পরিচিত এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের শরীয়তের জ্ঞান যথেষ্ট। চর্চাও করেন শরীয়তের বিধি বিধানের। তারা ফিজিক্যালি কোন মানুষকে আঘাত করেন না কখনোই। কিন্তু প্রায়ই অতি ক্ষুদ্র কারণে মানুষকে ইমোশনালি বিধ্বস্ত করে দেন পুরোপুরি। এবং এদের মধ্যে অনেকেই অন্যের ভালো করছেন ভেবেই তাকে আঘাতের পর আঘাত করে। এর কারণ তাদের অনুভূতি আছে কিন্তু সহানুভূতি নেই। তাদের চিন্তার গন্ডি খুবই সংকীর্ণ। যেমন,আমার সন্তান শুধু আমার বাধ্য ও অনুগত হলেই উত্তম মানুষের সার্টিফিকেট ধারী হয়ে যায় না। অন্যের সাথে তার ভারসাম্যপূর্ণ আচরণও জরুরি। আমি অবশ্যই ভুল কাউকে সংশোধনের লক্ষ্যে কিছু বলতে পারি। কিন্তু তাকে কখনোই আমি মানসিক ভাবে আঘাত করতে পারিনা।

জিহাদ বলল,আমরা অন্যকে অনুভব করার চেষ্টা করি না বা পারি না বলেই,খুব সহজে আঘাত করতে পারি। তাই না পাপা?

হুম! নিজের কষ্টের আয়নায় যদি অন্যের প্রতিচ্ছবি দেখার চেষ্টা করতে পারতাম। তাহলে আমাদের প্রতিটা কথা, কাজ ও আচরণ অন্যের তরে কল্ল্যাণকামী হয়ে যেত। যাইহোক,যা বলছিলাম। আমাদের বাড়ি থেকে বাজারের দিকে যাবার পথে একটা স্থানে লাল পিঁপড়ার বাসা ছিল। আমি যতদিন বাবার সাথে বাজারে গিয়েছি। সবসময় দেখেছি বাবা খুব সাবধানে প্রতিটা কদম ফেলতেন ঐ স্থানটা পাড় হবার আগ পর্যন্ত। বাবা সতর্ক থাকতেন কোন  ভাবেই যাতে পায়ের নিচে একটা পিঁপড়া চলে না আসে। বাবা কখনোই মুখে আমাকে কিছুই বলেননি। কিন্তু  বাবাকে দেখে আমিও রপ্ত করে নিয়েছিলাম ছোট্ট ঐ প্রাণীটির প্রতি সহানুভূতির প্রদর্শন। যাদের অ্যাফেক্টিভ এমপ্যাথি। অর্থাৎ,যারা অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা অন্যের দুঃখ কষ্ট ব্যথা সহ্য করতে পারে না। অন্যের দুঃখকে নিজের মত করে অনুভব করে ব্যথিত হয়ে ওঠে। অন্যের কষ্টে তাদের চোখ ভিজে ওঠে। অন্যের ভালোর চিন্তায় তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু যাদের এই এমপ্যাথি থাকে না। তারা অবলীলায় অন্যকে আঘাত,কষ্ট দিতে পারে। অন্যায়,অপকর্ম করতে পারে। তাই ছোটবেলা থেকেই এমপ্যাথির উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে এর ঘাটতি দেখা দেবেই স্বভাব,চরিত্রে।    

এমপ্যাথির উন্নয়ন ঘটানোর জন্য আমাদেরকে কি করতে হবে পাপা? প্রশ্ন করলো জিহাদ।

প্রতিদিন তোমার ভেতরের এমপ্যাথি ব্যবহার করতে হবে। চলার পথে আমার পায়ের নীচে যখন একটা শুকনো পাতাও উড়ে আসে। আমি চেষ্টা করি সেটাকে না মাড়িয়ে পথ চলতে। কি দরকার বৃক্ষের কোল থেকে ঝরে পরা শুষ্ক পাতাটিকে গুঁড়িয়ে দেবার? মোটকথা,মানবিক গুণাবলীর চর্চা থেকে এক মূহুর্তের জন্যও বিরত থাকা চলবে না। কারণ কারো ভেতর যখন মানবিক গুণাবলীর চর্চা হ্রাস পায়। ধীরে ধীরে তার মনুষত্ব্য ক্ষয় হতে শুরু করে।    

জিশান হেসে বলল,আলহামদুলিল্লাহ এবার বুঝতে পেরেছি। আমাদেরকে সহনুভূতিশীল ও দরদী হতে হবে। তাহলে আমরা অন্যায় করা থেকে,মানুষকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারবো। এবং আমাদের মধ্যের ইভিলকে ধ্বংস করে ফাটাফাটি ভালো মানুষ হয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।  

জাওয়াদ হেসে বললেন,তোমার সহানুভূতিশীলতার একটা উদাহরণ শোনাও আমাদেরকে।  

জিশান বলল,আমার ফেব্রেট প্রোগ্রাম চলছে। কিন্তু দেখো আমি তোমাকে কোম্পানি দিতে চলে এসেছি। প্রোগ্রাম যখন আবার রিপিট হবে তখন দেখে নেবো। কিন্তু আমার পাপা আর ভাইবোন একা একা খাবে এটা সহ্য করা আমার পক্ষে ইমপসিবল। এবার বুঝেছো তো আমি কত্তো সহানূভুতিশীল?

জিহাদ হেসে কুটিকুটি হলো জিশানেরর উদাহরণ শুনে। জাওয়াদও হেসে ফেলে ছেলের কান টেনে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,এই সমস্ত উদাহরণ যখন দেবে তখন আমার হাতের কাছ থেকে নিরাপদ দুরুত্বে থাকার চেষ্টা করবে। নয়তো কবে দেখবে তোমার চেহারা আছে কিন্তু দুইপাশ থেকে কান দুটা ঘায়েব হয়ে গিয়েছে।    

হুমকিতে ভয় পাওয়ার বলদে হাসতে হাসতে একদম পাপার গায়ে গড়িয়ে পড়লো জিশান। হাসিতে যোদগ দিল জাওয়াদ আর জিহাদও।

নাবিহা ঢুকে সবাইকে হাস্যরত দেখে মুখ গোমড়া করে গাল ফুলিয়ে বলল, আমি একটুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছি আর সবাই একা একা আনন্দ করতে শুরু করে দিয়েছে।

জাওয়াদ হেসে বলল, নাবিহাকে ছাড়া আনন্দ? এটা তো পসিবলই না। আপনি মনেহয় ভুলে গিয়েছেন সল্টি বেবী লবণ ছাড়া যেমন সবকিছু ফিকা, আপনাকে ছাড়া তেমন আমাদের আনন্দরাও ভবঘুরে একা।

চেয়ার টেনে সবার সাথে বসতে বসতে নাহিয়া বলল, তাহলে বলা হোক কেন সবাই হাসছিল এতক্ষণ। জিহাদ হাসি মুখে এতক্ষণের আলোচনার বিষয়বস্তু খুলে বললো বোনকে। শোনার পর নাবিহা বলল, পাপা এমপ্যাথি সম্পর্কে আরো বুঝিয়ে বলো আমাদেরকে।

একটুক্ষণ চুপ থেকে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল,  পৃথিবীর সমস্ত কিছুর উর্দ্ধে আমার কাছে আশরাফুল মখলুকাত হিসেবে জন্মগ্রহণ করার  পর,আশরাফুল মখলুকাত হয়েই বিচরণ করা এবং আশরাফুল মখলুকাত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই অন্যকে খালি চোখে দেখলেও,নিজেকে সর্বদা মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে দেখতে সচেষ্ট থাকি। কারণ যে মানুষ মানবীক গুণাবলীর চর্চা থেকে দূরে সরে যায়। তার মনুষ্যত্বও ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করে। হিউম্যান সাইকোলজির উপর বিশেষ কিছু কোর্স করার আগে এই বোধটা হয়তো আমার ভেতর এমন ভাবে ছিল না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমি সহানুভূতিশীল ও দরদী মনের মানুষ হবার শিক্ষা পেয়েছিলাম অভিভাবকগণের কাছ থেকে। আলহামদুলিল্লাহ! আমি দরদী ছিলাম মানুষ থেকে নিয়ে শুরু করে ছোট্ট একটা পিঁপড়া,এমনকি প্রতিটি ঝরা পাতার প্রতিও। আমার এমপ্যাথি প্রবল ছিল তাই জ্ঞানত দূর থাকার চেষ্টা করতাম খারাপ কথা,কাজ ও আচরণ থেকে,অন্যকে কষ্ট দেয়া থেকে,সব ধরনের অন্যায় থেকে। এর মানে আবার এটা নয় যে,একেবারে বিশুদ্ধ একজন মানুষ ছিলাম। এমন অসংখ্য কাজ করেছি যা হয়তো  সঠিক ছিল না। কিন্তু সেসব অজান্তে করেছি। এবং জানার সাথে সাথে নিজেকে সংশোধন করার সাধনায় রত হয়েছি। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে আসার পর। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার অফুরন্ত নেয়ামতে ছায়াতলে আশ্রয় পাবার পর। নিজেকে আর কোন ভুলের স্রোতে ভাসতে দিতে নারাজ আমি। তাই প্রতিটা কথা,কাজ ও আচরণ করার আগে মনুষ্যত্বের আয়নায় নিজেকে একবার করে দেখে নেই। আমার দৃষ্টিতে এটাই এমপ্যাথি।

ইনশাআল্লাহ আমাদের দৃষ্টিতেও আজ থেকে এটাই এমপ্যাথি। নাবিহা, জিহাদ, জিশান একসাথে বললো।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এখন চলো সবাই আগে নিজ নিজ নাস্তা শেষ করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন