শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২৫


চোখের সামনে প্রশ্নপত্র মেলে ধরতেই স্বস্থির হাসি ফুটে উঠলো সাহিলের মুখে। ভাইজান বলেছিলেন প্রথম প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পেলেই বাকি প্রশ্নের জবাবগুলোও পেয়ে যাবে। এক সপ্তাহ অনেক ভাবার পর তার জীবনের লক্ষ্য কি প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিল সাহিল। একজন মুসলিমের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত চিন্তা ও কর্মের দ্বারা দুনিয়াতে কল্যাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আখিরাতে জান্নাত প্রাপ্তি। এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাবার সাথে সাথেই ম্যাজিকাল একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো সাহিল। বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে তার আর মোটেই কষ্ট হচ্ছে না। সময়কে কাজে লাগিয়েই দুনিয়াতে কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুতরাং, সময় তার কাছে এমন এক নেয়ামত যার যথাযোগ্য ব্যবহার সুগম করবে তার অভিষ্ট লক্ষ্য পানে চলা পথকে। আর এরজন্য তাকে রুটিন মেনে চলতেই হবে। এখানে পছন্দ বা অপছন্দের কোন অবকাশই নেই। মানুষের জীবনের কল্যাণকর সবকিছুর সূচনা জ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব বলেই হয়তো মানুষের উদ্দেশ্যে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তায়ালার বলা প্রথম শব্দটি ছিল “পড়ো”। আল্লাহ তায়ালার প্রথম নির্দেশ হচ্ছে পড়া। তাই পড়াশোনাকে ভালো লাগা ছাড়া জীবন তো বৃথা। আর সাহিল চায় না তার জীবনকে বৃথা যেতে দিতে। এরপর থেকে ক্লাসের বইয়ের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব সহকারে সাহিল ইসলামী সাহিত্য, ইসলামের ইতিহাস, মনীষীদের জীবনী পড়তে শুরু করেছে। কুরআন, হাদীস, তাফসীর আগে পড়তে হবে তাই পড়তো কিন্তু এখন অন্তর থেকে ভালোবেসে পড়ে। এমন প্রতিটা প্রশ্নের জবাবই সাহিল খুব সহজেই খুঁজে পেলো যখন শরীয়তের আলোকে চিন্তা করলো।

হঠাৎ যদি কোনদিন খাবারের টেবিল সামান্য এলোমেলো দেখে খাবার নিয়ে নিজের রুমে চলে যায় সাহিল। আর বাড়িতে যেদিন স্পেশাল কোন মেহমান আসে খাবারের আইটেমগুলোর চেহারাই বদলে যায়। গার্নিশিং প্রতিটা খাবারের শোভা বর্ধন করে একশো গুণ বেশি। সেদিন খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মনেহয় যেন ক্ষুধা মিটে যায়। শরীরের খোড়াকের সৌন্দর্য যেখানে মনের উপর এমন প্রভাব ফেলে। যেখানে সেই মনের খাবারের সৌন্দর্য অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আগে নিজের রুম এলোমেলো করে রাখতো। কিন্তু যেদিন থেকে তার ঘরের পরিবেশ সুন্দর সাজানো গোছানো। সেদিন থেকে মনও অনেক প্রফুল্ল লাগে। আগে একটা বই খুঁজতে হলে দশটা নামিয়ে দেখতে হতো। এই খোঁজার আলসেমির কারণেও অনেক সময় পড়তে বসা হতো না। কিন্তু এখন পড়াশোনার সমস্ত উপকরণ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। পরিবারের গুরুত্বও অনুধাবন করেছে। জীবনের চলার পথে পরিবার প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে ট্র্যাফিক সিগন্যাল আর স্টীট লাইটের মত। হলুদ বাতি জ্বালিয়ে সাবধান করা, লালবাতি জ্বালিয়ে থামতে বলা আর সবুজ বাতি জ্বালিয়ে বুঝিয়ে দেয়া যে এগিয়ে যাও তোমার চলার পথ এখন নিরাপদ। আর আঁধারে স্টীট লাইটের মত আলোকিত করে পথ। অনেক চিন্তাভাবনার পর সাহিল উপলব্ধি করেছে, তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সে নিজেই। কারণ সে আছে বলেই তার জীবন আছে। আর জীবন আছে বলেই তো এত হিসাব নিকাশের প্রয়োজনীয়তা।

কিছুটা কষ্ট হচ্ছে অনলাইন জগতের অভ্যাসটি কমাতে। তবে এই ব্যাপারে একদমই তাড়াহুড়া করছে না সাহিল। আস্তে আস্তে অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। আগে যেখানে চার-পাঁচ ঘন্টা  সময় কাটাতো। এখন প্রতিদিন চেষ্টা করছে বিশ মিনিট, আধ ঘন্টা করে কমিয়ে আনার। আরো  কমানোর চেষ্টা জারি রেখেছে। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ হয়ে যাবার পর পড়াশোনায়ও মনোযোগ বাড়তে শুরু করেছে। মনোযোগের ব্যাপারে নূহা আপা বলেছিল, এটা একশো ভাগ ঠিক যে মনোযোগ সহকারে না পড়লে কখনোই জ্ঞানার্জনে বরকত আসে না। মনোযোগ কেন আসে না জানিস? কারণ মনের সামনে একাগ্র হবার মত কোন লক্ষ্য থাকে না। যেমন ধর তুই যখন পরীক্ষার হলে। প্রশ্নপত্র হাতে পাবার পর তুই কি করবি? সবকিছু ভুলে ঝাপিয়ে পড়বি উত্তর লিখতে। কারণ তোর হাতে সময় মাত্র দুইঘন্টা। এরমধ্যে সব প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে। এমন অবস্থায় কিন্তু কখনোই তোর মনে অন্যকোন চিন্তা জায়গা করে নিতে পারবে না। তোর ইচ্ছে করবে না ফেসবুকে ঢুকতে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে কিংবা একটু ঘুমিয়ে নিতে। কারণ তোর লক্ষ্য নির্ধারিত এবং তোর কাছে সেটা স্পষ্টও। আসলে আমরা মনোযোগ আনতে পারি না বা ধরে রাখতে পারি না এর কারণ আমাদের সামনে স্পষ্ট কোন লক্ষ্য থাকে না। আমরা আমাদের ভাবনাগুলোকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখি চারপাশে। কিন্তু যখন বাধ্য হই তখন কিন্তু ঠিকই আমরা মনোযোগ একটি বিষয়ের উপর ধরে রাখতে পারি।

মনকে তাই কখনোই তার ইচ্ছের উপর ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। তাহলে মন ডালপালা ছাড়িয়ে একাকার করে ফেলে।মনোযোগ যাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না পড়তে যেটা বোঝাতে আপা বেশ মজার একটা গল্প বলেছিল সাহিলকে। এক রাজা ছিলেন যার সিংহাসনের পাশে সবসময় একটা বানর বাঁধা থাকতো। রাজা প্রতিদিন দরবারে বসার পর একটা চাবুক দিয়ে বানরটার পিঠে সপাৎ করে একটা বাড়ি দিতেন। বানরটা ব্যথায় কিচকিচ করে উঠতো তারপর চুপচাপ বসে থাকতো বাকিটা সময়। দিনের পর দিন একই কান্ড দেখে একদিন রাজদরবারীরা বললেন, রাজা মশাই এত ভদ্র একটা বানরকে আপনি প্রতিদিন কেন চাবুক দিয়ে আঘাত করেন? রাজা বললেন, এই বানরটা আমার খুবই প্রিয়। তাই সবসময় আমি ওকে পাশেই রাখি। আর প্রতিদিন কেন মারি সেটা জানতে চান? ঠিকআছে আপনাদেরকে জানানোর ব্যবস্থা করছি। পরদিন দরবারে বসে রাজা বানরকে মারলেন না। বানর সারাদিন চুপ করে বসে রইলো। এরপর দিনও মারলেন না। তৃতীয় দিনও যখন মারলেন না বানর নড়াচড়া শুরু করলো। চতুর্থ দিন বানর রাজার সিংহসনের হাতলে চড়ে বসলো। পঞ্চম দিন রাজার ঘাড়ে, ষষ্ট দিন রাজার মাথায় এবং সপ্তম দিনে রাজার মাথা থেকে মুকুট কেড়ে নিয়ে সে রাজ সিংহাসনে বসে পড়লো। সেদিন রাজা আবার চাবুক হাতে নিলেন। বানর কিচকিচ করতে করতে আবার তার স্থানে ফিরে গেলো।

মানুষের মনটাও নাকি অনেকটা এই বানরের মত। মনকে যদি ছেড়ে দেয়া হয় সে যা ইচ্ছে তাই করে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। তাই বানরের মতই মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যও দরকার নিয়মিত চাবুকের বাড়ি। কিন্তু মন তো ধরা ছোঁয়ার বাইরের জিনিস। আর যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না তাকে চাবুক কিভাবে মারা সম্ভব? তাহলে উপায়? উপায় হচ্ছে, অধরা মনের দায়িত্ব এমন কাউকে দেয়া যে নিজেও অদেখা কিন্তু অধরা মনকে দেখতে ও ধরতে সক্ষম। সে হচ্ছে আমাদের বিবেক। মনের লাগাম যদি বিবেকের কাছে থাকে তাহলে বেসামাল হবার সুযোগ অনেক কমে যায়। আর বিবেককে পরিচালিত করে আমাদের জ্ঞান। আমাদের অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতেই বিবেক কোন সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আমরা যদি আমাদের বিবেককে শরীয়তের জ্ঞান দ্বারা সজ্জিত করতে পারি। তাহলে বিবেকও মনকে প্রতিটি কর্মের পেছনে একটি অভিষ্ট লক্ষ্য দিতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ। তবে সাথে সাথে আপা সাহিলকে অভয় দিয়ে একথাও বলে দিয়েছিল যে, এমনটা কখনোই একদিনে সম্ভব না। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে আয়ত্ত্ব করতে হবে। যেমন বাংলা রিডিং পড়ার আগে অ, আ, ক, খ ইত্যাদি শিখতে হয়েছে, আ-কার, ই-কার শিখতে হয়েছে, এরপর বেশ কিছুদিন বানান করে পড়তে হয়েছে ঠিক তেমন। মনোযোগের ব্যাপারেও তেমন আগে ইনগ্রিডিয়েন্স সমূহকে একত্রিত করতে হবে ধীরে ধীরে। অতঃপর সবকিছুর সংমিশ্রণে তৈরি হবে উৎকৃষ্ট, মজাদার এবং আরাধ্য কিছু।

নিজেকে পুনঃপুনঃ চেষ্টায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সাহিল এখন আর ঘুমের মধ্যে এলোমেলো স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্ন দেখে না। এখন সে খোলা চোখে স্বপ্ন দেখে। অন্তত জীবন চির শান্তির জান্নাতে সকল প্রিয়জনদের নিয়ে একসাথে কাটাবে সেই স্বপ্ন। এই মূহুর্তেও বুক ভরা প্রশান্তি নিয়ে খোলা চোখে স্বপ্ন দেখাতে মগ্ন ছিল সাহিল। বাগানে দিকে চোখ পড়তেই চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে আপাআআ বলে চিৎকার দিলো।

বাইরে যাবার উদ্দেশ্যে মেইল গেটের দিকে যাচ্ছিলো নূহা। চিৎকার শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকিয়ে সাহিলকে দেখতে পেয়ে হাসি মুখে বলল, কিরে সাত সকালে টারজান হবার সাধ জেগেছে নাকি তোর?

সাহিল হেসে বলল, আপা তোমার সাথে অনেক জরুরি আলোচনা আছে আমার।

কিন্তু এখন তো আমি বেরোচ্ছি।

আজ তো তোমার ডিউটি নেই বলেছিলে। এত সকালে তাহলে কোথায় যাচ্ছো?

বাবার শরীর খারাপ করেছে তাই দেখতে যাচ্ছি।

তাহলে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো আমার জন্য প্লিজ আপা। আমিও যাবো তোমার সাথে ফুপাজানকে দেখতে।
পাঁচ মিনিটের এক সেকেন্ড বেশিও অপেক্ষা করবো না। জারিফ ওর বাবার সাথে গাড়িতে অপেক্ষা দশ মিনিট ধরে আমার জন্য। অলরেডি দুইবার আমাকে ফোন দিয়েছে। এখন যদি আবার শোনে তোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে বাচ্চা কান্নাই জুড়ে দেবে।

আপা এই কথা বলে তুমি আমার স্পীড বাড়িয়ে দিয়েছো। আমি আমার সুইট ভাগিনাকে চোখে একবিন্দু অশ্রুকণাও আসতে দেবো না। ড্রেস চেঞ্জ করার ইচ্ছে ত্যাগ করলাম। শুধু আম্মুকে বলেই আমি আসছি। কথা শেষ করেই ছুট দিলো সাহিল।

নূহাও হেসে মেইন গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করলো।

@

বিবেক যদি টেবলেট আকারে পাওয়া যেত দুনিয়াতে এত আত্মিক দীনতার ছড়াছড়ি থাকতো না। শারীরিক রোগের সমাধানের জন্য কত ধরনের ঔষুধ আছে। মনের রোগেরও এমন ঔষুধ থাকা উচিত ছিলো। মানুষের মধ্যে যখন নুন্যতম বিবেক বোধেরও অনুপস্থিতি দেখি সত্যি অনেক খারাপ লাগে। বিবেক বোধ তো দূরে থাক কমনসেন্স বলে যে একটা জিনিস আছে সেটাও অনুপস্থিত বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে।  

ফাইল থেকে মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকালো আদী। বাচ্চাদের এলোমেলো করে রাখা খেলনা গুছাতে গুছাতে নিজ মনেই গজগজ করছে তাইয়্যেবা। ফাইল পাশে রেখে হাসিমুখে বলল, কমনসেন্স না থাকা কিংবা কম থাকাই আসলে ভালো। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি কি বলেছেন জানো? বলেছেন, কমনসেন্স ইজ নট অ্য গিফট, ইট’স অ্য পানিশমেন্ট। বিকজ ইউ হ্যাভ টু ডিল উইথ এভরিওয়ান হু ডাজনট হ্যাভ ইট।    

কিছুটা বিরক্তি মাখা কণ্ঠে তাইয়্যেবা বলল, আমার এমনিতেই মেজাজ গরম। আপনি এইসব পাগল টাইপ কথাবার্তা বলবেন নাতো এখন।  

হাসতে হাসতে আদী বলল, তা তোমার মেজাজ গরম হইবার মত কর্মখানা কার দ্বারা সংঘটিত হইলো?  

আপনাকে মানা করলে আরো বেশি করে ফান করেন সবসময়। সত্যি অনেক মেজাজ খারাপ আমার।  

আচ্ছা ফান বন্ধ। বরং তোমার মেজাজ ভালো করার মত কোন পরামর্শ দেই চলো।মাঝে মাঝে মানুষের উদ্ভট কথাবার্তা ও কর্মকান্ড দেখে বা শুনে আমারো প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মন। তখন আমি নিজেকে বলি, হে আমার রব আমাকে এমন একটা ধৈর্য্যশীল ও প্রশান্ত মনের অধিকারী করো, যা সর্বদা থাকবে সদ্য প্রস্ফুটিত কোন ফুলের ন্যায়। যার সৌন্দর্য মনকে করবে মুগ্ধ,যার সুগন্ধ ছড়িয়ে যাবে চারপাশে। এমন আত্মিক সুষমা মণ্ডিত সুমধুর শব্দভাণ্ডার দাও আমাকে, যার আলোকময়তা স্পর্শ করে যাবে হৃদয় বীণা। আমাকে করে দাও জ্ঞানের আলোকবর্তিকা। পথহারা একটি মানুষের তরেও যেন হতে পারি বাতিঘর। কখনো যেন কাউকে ঘৃণা ভরে অবজ্ঞা না করি। না হই যেন কারো মর্মবেদনার কারণ। দিতে পারি যেন অকৃত্রিম ভালোবাসা। ক্রোধকে করতে পারি যেন দমন। প্রতিহিংসা যেন হয় পরাভূত আমার উদারতার কাছে। হে দয়াময় আমাকে সর্বোত্তম সম্পদ উত্তম আখলাক দান করো। বিনয় যেন হয় সেই প্রদ্বীপের তেল যেই আলো আমি ছড়াতে চাই। কিছুক্ষণ পরই আমি অনুভব করি যে, পাখীর পালকের মত নরম, কোমল, পেলব কিছু পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে আমার মেজাজে। অদ্ভুত এক পশলা শান্তির শ্রাবণধারা ধুয়ে মুছে দিয়ে যায় মনের সমস্ত বিরক্তি।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে কপট রাগের ভাণ করে তাইয়্যেবা বলল, আপনি আর আপনার সাইকোলজির দুইটাই অসহ্য। সুপার অসহ্য। এইসব শোনার চেয়ে গিয়ে বাচ্চাদের হৈচৈ শোনা ভালো।  

আদী হেসে বলল, এটা অবশ্য ঠিক বলেছো তুমি বাচ্চাদের হৈচৈ এর চেয়ে মনোমুগ্ধকর আসলে খুব কম জিনিস আছে পৃথিবীতে।  

এবার হেসে ফেললো তাইয়্যেবা। আপনি সবসময় এমন পজিটিভ মাইন্ডের থাকেন কিভাবে সত্যিই বুঝি না আমি!  

সবসময় থাকি কে বললো? তাছাড়া কোন মানুষই সবসময় পজেটিভ মাইন্ডের থাকতে পারে না। এমন অসংখ্য ব্যাপার আছে যা আমাকেও অস্থির করে তোলে। কিন্তু মানুষের ব্যাপারে তো ধৈর্য্য রাখতেই হবে। আমার প্রফেশনই এটা। তাছাড়া আমার কি মনেহয় জানো? ব্লক, বুটিক, সেলাইয়ের কাজ বা ভালো রান্না জানা যেমন একজন মানুষের এক্সট্রা কোয়ালিটির মধ্যে পড়ে। ঠিক তেমনি উদারতা, সহনশীলতা, সহানুভূতি, কমনসেন্স এসবও মানুষের এক্সট্রা কোয়ালিটি। এখন কেউ ভালো রান্না না জানলে যেমন আমরা তাকে শিখে নিতে উৎসাহিত করি, ক্ষেত্র বিশেষে সাহায্য করি। উদারতা, সহনশীলতা ইত্যাদির ঘাটতিতেও যদি তেমনটা করতে পারতাম তাহলে কতই না ভালো হতো। কিন্তু আমরা তেমনটা সচারচর করি না। আমরা তাদের উপর ক্ষুব্ধ হই, তাদের নিন্দা ও সমালোচনা করি। তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে দেই যে তারা মানুষ সুবিধার না। যারফলে মানুষ হিসেবে সুবিধা জনক স্থানে তারা কখনোই উঠে আসতে পারে না।

বুঝলাম আপনার কথা। কিন্তু উদারতা, সহনশীলতা, সহানুভূতি, কমনসেন্স এসব মানুষের এক্সট্রা কোয়ালিটি এটা মেনে নিতে পারলাম না। এগুলো মানুষের ফিতরাতের অন্তঃর্গত। প্রতিটা মানুষ জন্মের সময়ই এসব সাথে করে নিয়ে আসে।

একটা বীজের ফিতরাত কি জানো? তাকে মাটিতে বপন করা হবে, চারা বের হবে, ধীরে ধীরে বড় হবে এবং ফুল ও ফল দেবে। এখন একটা বীজকে তুমি মাটিতে বপন করলে কিন্তু অনুকূল পরিবেশ ও আবহাওয়া দিলে না। সে কি ফিতরাতে অবিচল থাকতে পারবে? হ্যা অনুকূল পরিবেশ ও আবহাওয়া ছাড়াও গাছ জন্মে। কিন্তু তাদের নাম দেয়া হয় আগাছা। অবশ্য ব্যতিক্রম কিছু ঘটনাও ঘটে। কিন্তু সেজন্যই তো সেটা ব্যতিক্রম বলে খ্যাত হয়। রাসূল (সাঃ) কিন্তু এই কথাটি বলে গিয়েছেন। "প্রতিটি শিশু (ইসলামের) ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। তার পিতামাতাই তাকে ইহুদি বানায়, খ্রিষ্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক বানায়।" ঠিক তেমনি পিতামাতা সন্তানদেরকে অমানবিক, অসৎ ইত্যাদিও বানায়।

আর কিছু না বলে হেসে নিজের কাজে মন দিলো তাইয়্যেবা। কিছুক্ষণ পর কিছু একটা বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতে যেয়েও আদীর দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেলো তাইয়্যেবা। আদীর সমস্ত মনোযোগ নিবিষ্ট হাতে ধরে থাকে ফাইলের মধ্যে।
এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছে জিজ্ঞেস করতে যেয়েও আবার নিজেকে সামলে নিলো তাইয়্যেবা। পরিচিত হোক বা অপরিচিত কারো ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েই আলোচনা করে না আদী কখনোই। বিয়ের প্রথম প্রথম এই স্বভাবটা মনে কষ্ট তৈরি করলেও এখন তাইয়্যেবা বোঝে এটা আদীর অনেক বড় একটা গুণ। প্রতিটা সম্পর্কের মধ্যে রেসপেক্ট অত্যাবশ্যকীয় একটা জিনিস। একজন ডক্টর ও পেশেন্টের সম্পর্কও এর বাইরে নয়। অনেক ভরসা নিয়ে একজন পেশেন্ট ডক্টরের কাছে আসে। খুলে বলে তার শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। সবদিক দিয়ে এই ভরসা যারা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন তারাই আসলে প্রফেশনাল ও পারসোনাল উভয় দিক দিয়ে একজন কল্যাণকামী মানুষ। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনেহয় তাইয়্যেবার এমন একজন মানুষের জীবনসঙ্গিনী হতে পারার জন্য। আদীকে আর বিরক্ত না করে চুপচাপ খেলনা গুছিয়ে রেখে বাচ্চাদের খোঁজে বের হলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন