সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৬

ভালোবাসার সুতোয় গাঁথি সম্পর্কের মোতি...১




হাইওয়ে রোডের পাশে বাসা হবার একটা অন্যরকম মজা আছে। ছুটন্ত গাড়ি, চলন্ত মানুষ, খোলা আকাশ, খন্ড খন্ড মেঘের উড়াউড়ি সবকিছু মিলিয়ে জীবনের জীবন্ত উপস্থিতি সর্বত্র, সর্বদা। গত কয়েকদিন আগে নিজের পড়ার টেবিলটা বারান্দার এক কোণে বসিয়ে দিয়েছে নূহা। যাতে দৃষ্টি সীমায় ধরা দেয় ভোরের আধো আলো, দুপুরের কড়া রোদ, বিকেলের নম্র উষ্ণতা, সন্ধ্যার আলো-আঁধারি, রাতের তারা ভরা আকাশ, জোছনার জোয়ার। প্রকৃতির সংস্পর্শে সারাক্ষনই যেন জীবনের সরব আনাগোনা টের পায় চারিপাশে। তাকিয়ে থাকে কখনো আনমনে মানুষের দিকে। হেঁটে চলছে সবাই নিজ নিজ জীবিকা, গন্তব্যের সন্ধানে! কত বৈচিত্র্যতা এই হেঁটে চলার মাঝেও। সূর্যকিরণ সকালের মিষ্টতার রেশ কাটিয়ে দুপুরের কড়া রৌদ্দুদের যাত্রা পথে ধীর পায়ে এগিয়ে চলছে। মিষ্টি রোদ আর মৃদুমন্দ বাতাসের দোলায় প্রকৃতির সাথে সাথে নূহার মনেও ভালো লাগার পরশ বুলিয়ে গেলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো বড় এক খন্ড মেঘ ভাসতে ভাসতে প্রতি মূহুর্তে বদলে ফেলছে নিজের আকার। ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ছে বহু খন্ডে চারিপাশে। আজকাল নূহার মনের ভাবনারাও এমন ছড়িয়ে পরে ক্ষণে ক্ষণেই। ভাবনাদের বাঁধার চেষ্টা না করে ইচ্ছে মত বয়ে যেতে দেবার মজাও কিন্তু বেশ। ভাবনার স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দেয়া একটি শুকনো পাতার রূপে। তারপর স্রোতের প্রবাহে নিশ্চিন্তে ভেসে চলা। এই মূহুর্তেও নূহার ইচ্ছে করছিল নিজেকে ভাবনার স্রোতে ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু এখন আপন মনে ভেসে যাবার কোন অবকাশ তার নেই। জীবনের অনেক লম্বা একটা সময় নিজ ইচ্ছের স্রোতে ভেসে পাড় করে দিয়েছে। বুকের ভেতরটা আবারো ভার হয়ে এলো নূহার। পরক্ষণেই আবার মনেহলো, ব্যর্থতার স্মরণ জীবন পথকে করে দুর্গম, যা চলে গিয়েছে তা ভুলে যাওয়াটাই উত্তম। ফিরে পেতে হারানো মনের পরিতুষ্টি, যা কিছু আছে তাতেই খুঁজে নিয়ে সন্তুষ্টি। আগত নব নব সম্ভাবনার পথ করতে হবে সুগম।
নিজ করণীয়র কথা ভাবতে ভাবতে বাগানের দিকে দৃষ্টি যেতেই দেখতে পেলো সাফিন হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে তুলে জানতে চাইলো নূহা, কি রে তুই এমন দাঁত বের করে তাকিয়ে আছিস কেন? নতুন লাগিয়েছিস?
স্বশব্দে হেসে ফেললো সাফিন। হাসতে হাসতে বলল, তুই একা একা নিজের সাথে বিড়বিড় করছিলি সেটা দেখে দাঁত বের করেছি। নতুন লাগাইনি তবে কিছুক্ষণ আগে ঘষে ঘষে মেসওয়াক করে এসেছি। একটা ক্লোজআপ দান্তিক হাসি তাই বোনের দিকে তাকিয়ে দিতেই পারি এই মূহুর্তে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তুমি একা একা কি কথা বলছিলি?
কি কথা বলছিলাম সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজের সাথে একান্ত কথোপকথন বেশ জরুরি। স্বামী বিবেকানন্দ কি বলেছেন জানিস? বলেছেন, "দিনে একবার হলেও নিজের সাথে কথা বলুন। অন্যথায় এ পৃথিবীর একজন চমৎকার মানুষের সাথে সাক্ষাত লাভের সুযোগ থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন"।
সাফিন হেসে বলল, বাহ উক্তিটা তো ভীষণ সুন্দর। তোর ভেতরের চমৎকার মানুষটার সাথে কথোপকথন কি শোনা যাবে? আজকাল প্রায়ই তোকে বিড়বিড় করতে দেখি একা একা। জানতে ইচ্ছে করে কি এত কথা বলিশ নিজের সাথে।
নূহা হেসে বলল, আচ্ছা শোনাবো কখনো তোকে আমার সাথে আমার কথোপকথন। তারআগে জানতে চাই ইফতি ভাইয়ার সাথে দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে? চুপ করে আছিস কেন? আমি ভেবে ভেবে হয়রান হচ্ছি ‘ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, চলো করি বন্ধ’ শ্লোগান বেমালুম ভুলে গিয়ে কিভাবে তুই আর ইফতি ভাইয়া দেড় মাস ধরে নিজেদের মধ্যে সমস্যা বয়ে বেড়াচ্ছিস। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে, ভাইবোনদের সাথে মনোমালিন্য, মতপার্থক্য হতেই পারে। কিন্তু সেটা কখনোই এমন দীর্ঘ সময় বয়ে বেড়ানো উচিত না। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি কি বলেছেন জানিস? আপনজনদের প্রতি রাগ হওয়া উচিত দুধের বলকে ওঠার মতো। যাতে হালকা ফু’ই যথেষ্ট হয় গড়িয়ে পড়াকে ব্যহত করার জন্য।
সাফিন হেসে বলল, ভাইজান নিউজিল্যান্ড থেকে কবে ফিরবেন সেটা কি তুই জানিস? ভাইজানের শূন্যতা খুব ফিল করছি। ভাইজান এখানে থাকলে নিশ্চিত ইফতি ভাইয়া আর আমার সমস্যাটাকে এতটা দীর্ঘ হতে দিতেন না। আর তোর তো সময়ই নেই পরিবারের সদস্যদের জন্য। জনকল্যাণে নূহা হয়েছিস।
হেসে ফেললো নূহা। বলল, আমার তো মনেই ছিল না তোদের ঝগড়ার কথা। গতরাতে বড়মামার সাথে গল্প করার সময় কথা প্রসঙ্গে মামা যখন বললেন তখন জানতে পারলাম তোরা শান্তির শ্বেত কবুতরের পায়ে বেঁধে রাগকে উড়িয়ে না দিয়ে, মনের খাঁচায় যতনে পুষে বেড়াচ্ছিস। কবি কি বলেছেন জানিস? অভিমান অভিযোগ সমস্যার সমাধান নয়, সম্পর্কের মিষ্টতা এতে ধীরে ধীরে হয় ক্ষয়। দ্বন্দ্ব মিটায় ত্যাগ ও সমঝোতা, দূর করে অকারণ যত তিক্ততা। ভালোবাসায় সাজে ভুবন, ঘৃণাতে কভুও নয়।
বুঝতে পারছি ভুল হয়ে গিয়েছে অনেক। সত্যি বলতে আমি বেশ কয়েকবার ইফতি ভাইয়ার সাথে কথা বলার প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন ভাইয়ার বলা কথাগুলো আমাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়েছিল। যখনই ভাইয়াকে দেখি কথাগুলো মনে পড়ে বুকের মধ্যে খচখচ করতে শুরু হয়।
নূহা হেসে বলল, এজন্যই তো কবি বলেছেন, ‘সুখের পিহু গুঞ্জরনে সময়টা যখন অনন্য, হঠাৎ স্মৃতির তিক্ততা মনকে করে দেয় বিষণ্ণ। হাত নেড়ে বিদায় জানায় খুশি, বেদনার ঢেউ উঠে রাশি রাশি। প্রাপ্তির বাগিচায় চোখে ভাসে শুধুই অসংখ্য শূন্য’। আসলে এমনটা মনেহয় আমাদের সবারই হয় মাঝে মাঝে। খুব আনন্দময় ক্ষণ বিষণ্ণতায় চাদর মুড়িয়ে বসে পড়ে অতীতের তিক্ত কোন স্মৃতির স্মরণে। অতীতকে বদলানোর কোন সুযোগ নেই জানা স্বর্ত্বেও অতীত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমরা বর্তমানকে বদলে যেতে দেই খুব সহজেই। বেশ কয়েকমাস আগে এক বোন এমন সমস্যা নিয়েই হাজির হয়েছিল আমার কাছে। স্বামীর সাথে খুবই সুখী সুন্দর সংসার বোনটির। কিন্তু দাম্পত্য জীবনের শুরুর দিককার অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না দুজনের। এখন প্রায় সময়ই অতীতে একে অন্যেকে দেয়া আঘাতের স্মরণ তাদের বর্তমান খুব সুন্দর মূহুর্তগুলোকে নষ্ট করে দেয়। বোনটিকে বোঝানোর সময় অনেক আগে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। পরিবারের আদর আহ্লাদে অভ্যস্ত আমাকে একবার খুব পছন্দের একজন মানুষের কাছ থেকে কিছু কড়া কথা শুনতে হয়েছিল। পরবর্তীতে উনি উনার আদর ভালোবাসায় আমার মনের কষ্ট দূর করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে প্রায়ই যেটা হতো উনি যখন আমার সাথে খুব আহ্লাদ করতেন, সেই কড়া কথাগুলোর কথা মনে পড়ে যেতো। এবং উনার উজার করা ভালোবাসা আমি ঠিক উজার করে গ্রহণ করতে পারতাম না ঐ মূহুর্তে। কিছুতেই বের হতে পারছিলাম না এই বেড়াজাল থেকে। একদিন ভাইয়াকে আমার এই অবস্থার কথা খুলে বললাম। কিন্তু ভাইয়া ঐ সময় তেমন কিছুই বললেন না।
কে বলেছিল কড়া কথা তোকে?
নূহা হেসে বলল, সেটা জানাটা মোটেই জরুরি না। তবে ভাইয়াকে বলার বেশ কিছুদিন পর আমার ভীষণ পছন্দের মাটন বিরিয়ানি খাচ্ছিলাম। খেতে খেতে হঠাৎ মুখের মধ্যে এলাচ চলে এসেছিল। এই জিনিসটা আমি সহ্যই করতে পারিনা একদম। চিৎকার করে উঠে মুখের খাবার ফেলে দিয়ে পানি খেয়ে আবারো খাওয়াতে মনোযোগ দিলাম। ভাইয়া পাশেই বসে খাচ্ছিলেন চুপচাপ। বেশ কিছুক্ষণ পর বললেন, খুব পছন্দের খাবার খাওয়ার সময় মুখে যখন খুব অপছন্দের এলাচ বা কাঁকড় চলে আসে তখন কিন্তু আমরা পুরো খাবারটা ফেলে দেইনা। বরং অপছন্দের এলাচ বা কাঁকড় ফেলে দিয়ে খাওয়া কন্টিনিউ করি। ঠিক এমনই পছন্দের বা প্রিয় মানুষেরা অসংখ্য সুখ ও আনন্দ দেবার সাথে সাথে কিছু কষ্ট, কিছু তিক্ততাও দিয়ে ফেলেন আমাদেরকে। সেজন্য কখনোই তাদের দেয়া সুখ ও আনন্দকে অবমূল্যায়ন উচিত নয়। বরং পছন্দের খাবার থেকে এলাচ বা কাঁকড় তুলে ফেলে দেবার মতোই, প্রিয়জনদের দেয়া কষ্ট বা তিক্ততা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাদের দেয়া সুখানন্দে ভেসে চলা উচিত আমাদের। আলহামদুলিল্লাহ খুব সাধারণ একটা জিনিস থেকে সেদিন অসাধারণ একটা শিক্ষা অর্জন করেছিলাম আমি। সেই বোনটিকেও আমার অর্জিত শিক্ষাটাই বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছিলাম। আজ তোকেও বললাম। তুই না তোর ভাইজানের শূন্যতা অনুভব করছিলি? নে শুনিয়ে দিলাম তোর ভাইজানের লেকচারের কিছু অংশ।
সাফিন হেসে বলল, জাযাকিল্লাহ। ইনশাআল্লাহ আজই কথা বলবো আমি ইফতি ভাইয়ার সাথে। কিন্তু আম্মু যে বললো তোর বাসায় আজ পার্টি।
হুমম, আমাদের জুনিয়র ভগ্নী বাহিনীর সামার ভ্যাকেশন শুরু হয়েছে। উনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দল বেঁধে আমার সাথে কিছুদিন থাকবেন। আমারও যেহেতু লীভ চলছে তাই আসতে বলেছি ওদের সবাইকে। তাছাড়া মেয়েগুলো আশেপাশে থাকলে আমিও কেমন যেন ওদের বয়সী হয়ে যাই। ওদের সাথে সাথে আমিও উপভোগ করি উনিশ-কুড়ি বছরের আনন্দ উচ্ছলতা। নয়তো ওদের বয়সে আমি তিন বাচ্চার আম্মা হয়ে বসেছিলাম।
সাফিন হেসে বলল, সেজন্য বুঝি আফসোস হয় তোর?
নূহা হাসি মুখে বলল, উহু, সেজন্য কোন আফসোস হয় না। আমার আফসোসটা অন্য জায়গায়।
কোন জায়গায়?
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর নূহা বলল, ছোটবেলা থেকে আমার চারপাশের পরিবেশটাই এমন ছিল যে আমি খুবই সন্তুষ্ট চিত্ত, প্রশান্ত আত্মার একজন মানুষ ছিলাম। জীবনকে ঘিরে কখনোই আমার কোন অভিযোগ ছিল না। যেমনই ছিলাম নিজেকে নিয়ে খুশি ছিলাম। ভালোবাসতাম নিজেকে সবার চেয়ে বেশি। তাই সেই সমস্ত কাজ করা থেকে বিরত থাকতাম যাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা অসন্তুষ হতে পারেন আমার উপর। সেই সমস্ত কাজ বেশি বেশি করার চেষ্টা করতাম যা আমাকে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে সহায়তা করবে। মানবতার বাগিচায় আগাছা হিসেবে আমার জন্ম হয়নি। আমি বহু যতনে গড়ে তোলা চারাগাছ। আমার ডালপালা যতটা না উর্দ্ধে বিস্তৃত ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ও মজবুত ছিল আমার শেকড়। আমি বেড়ে উঠেছি একাধিক ছায়াদানকারী, সুশীতল জ্ঞানবৃক্ষের কোল ঘেঁষে। তাই জানতাম কি করছি, কেন করছি এবং এর কেমন প্রতিফল হতে পারে। যখন কারো আঘাতের বদলে আঘাত না করে ক্ষমা করে দিতাম। মনে মনে স্বস্থি বোধ করতাম নিশ্চয়ই এরফলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমার কোন অন্যায়কে ক্ষমা করে দেবেন। কারো গোপন কথাকে যখন মনের কৃষ্ণগহ্বরে বিস্মৃত হয়ে যেতে দিতাম। আশা জেগে উঠতো আমার গোনাহগুলোও নিশ্চয়ই এমনি করেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দুনিয়ার সবার কাছ থেকে আড়াল করে রাখবেন। বড়ই বেখেয়াল আমি চলতে ফিরতে এখানে সেখানে ধাক্কা খেতেই থাকি। প্রতিটা ব্যথা পাবার মূহুর্তে উফফ উচ্চারিত হবার আগেই আলহামদুলিল্লাহ বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে এই ভেবে যে নিশ্চয়ই এই ব্যথার বদলে আল্লাহ আমার কোন ভুল মাফ করে দিয়েছেন। এমনি করে নিজের প্রতিটা কথা, কাজ ও আচরণের পেছনে যুক্তি ছিল আমার। সেই সব যুক্তি মিলিত হতো একই মোহনায়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মোহনায়। সদা সর্বদা আমার এই একটাই লক্ষ্য ছিল। মাঝে মাঝে যে ভুল হয়নি এমনটা নয়। কিন্তু ছায়াদানকারী জ্ঞানবৃক্ষরা তো ছিলেনই সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য। রব্বের সন্তোষের পথে চলাটা তাই খুব বেশি কঠিন ছিল না আমার জন্য কখনোই।
এখানে আফসোসের কি আছে? সে কারো জন্যই তো এটা পরম পাওয়া।
এখানে আফসোসের কিছুই নেই। আফসোস হচ্ছে, যখন আমার ঈমানের জোর পরীক্ষার সময় এলো। আমি ভুলে গিয়েছিলাম জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেকে, আমার ছায়াদানকারী রাহবারদের দেয়া শিক্ষাকে। যারফলে আল্লাহ কতৃক তাকদীরের ভালো মন্দ নির্ধারণের পরীক্ষায় সন্তুষ্ট থাকার ব্যাপারে ভয়াবহ ভাবে অকৃতকার্য হয়েছিলাম। বুঝতে শেখার পর থেকে আমি কখনোই জীবনসঙ্গী কেমন হবে সেটা নিয়ে স্বপ্ন দেখিনি। সেই ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল মাতৃত্বকে ঘিরে। সন্তানদের তরে দুনিয়ার বুকে জান্নাত হবার স্বপ্ন লালন করা আমার কাছে স্বপ্নটা যখন বাস্তব হয়ে এসেছিল আমি সেই স্বপ্নকে পালন করতে পারিনি। ব্যর্থ হয়েছিলাম মা হিসেবেও চরম ভাবে। কষ্ট দিয়েছি সেই বাবাকে যার কাছে আমার কষ্টের চেয়ে কঠিন হয়তো কিছুই নেই জগতে। আমার জন্য উন্মুক্ত জান্নাতের দ্বার বার বার সশব্দে নিজেই বন্ধ করেছি। এতটুকুও ব্যথা মনে না নিয়ে মামণি বার বার আমার তরে খুলে দিয়েছেন জান্নাতের রুদ্ধ দ্বার। তাতেও ভুল ভাঙেনি আমার। ভুলের পথে চলা সফরটা খুব বেশি লম্বা হয়ে গিয়েছে আসলে। যারফলে খুব বেশি অকৃতজ্ঞ ও অশান্ত আত্মার একজন মানুষে পরিণত হয়েছিলাম। শান্তির পথ ছেড়ে অশান্তির পথে চলেছি ইচ্ছে করে, জেদ করে। যার ফলাফল কখনোই আমার জন্য কল্ল্যাণকর হয়নি। কিন্তু তবুও থমকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যটাকে ঠিক করে নেয়ায় প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। হয়তো অনুভব করার মতো অনুভূতিই ছিল না আমার কাছে। আবেগশূন্য, অনুভূতিশূন্য বীভৎস সেই সময়ের স্মৃতিগুলো এখন আমাকে বিষধর সাপের মতোই দংশন করে। আত্মদহনের জ্বালা বড়ই অসহনীয়। মুক্তি পেতে ইচ্ছে করে এই শ্বাসরুদ্ধকর আত্মিক দীনতার কারাবাস থেকে। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে আবারো সেই সন্তোষ ও প্রশান্ত আত্মায় আমার আমির কাছে। সত্যিকার আমার কাছে। যে আমি কোন এক ঝড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম নিজের কাছ থেকেই। তবে স্বস্থি এতটুকুই দূরে বহুদূরে হলেও এখন চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে অস্পষ্ট, আবছা মতো দেখতে পাই আমার আমিকে.. আলহামদুলিল্লাহ।
সাফিন বলল, আলহামদুলিল্লাহ। বুঝতে যখন পেরেছিস তাহলে আর অপেক্ষা কিসের? নিজের কাছে জিম্মি করে না রেখে আনন্দবাড়িতে ফিরে যা আনন্দের বাহার নিয়ে।
নূহা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ যাবো। অবশ্যই যাবো। তবে এই মূহুর্তে আগে কিচেনে যেতে হবে। চুলায় ফিরনী দিয়ে এসেছিলাম। এতক্ষণে পুড়ে নির্ঘাৎ শেষ।
নূহাকে কিচেনের উদ্দেশ্যে ছুট লাগাতে দেখে হাসতে হাসতে সাফিন বলল, পুড়ে শেষ হয়ে গিয়ে না থাকলে আমার জন্য এক বাটি ফিরনী পাঠিয়ে দিস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন